দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি কলকাতার একটি অগ্রণী গবেষণা সংস্থা। ১৭৮৪ সালের ১৫ জানুয়ারি ভারততত্ত্ববিদ স্যার উইলিয়াম জোনস ব্রিটিশ ভারতের তদানীন্তন রাজধানী কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেন।[1][2] ভারতের তদানীন্তন গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ছিলেন এই সংস্থার প্রধান পৃষ্ঠপোষক।[2] ১৮০৮ সালে দক্ষিণ কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের একটি ভবনে সংস্থাটি স্থানান্তরিত হয়। ১৯৬৫ সালে এই ঐতিহাসিক ভবনটির পাশেই সোসাইটির দ্বিতীয় ভবনটির দ্বারোদ্ঘাটন করা হয়।[3] বর্তমানে সোসাইটির একটি নিজস্ব গ্রন্থাগার ও নিজস্ব সংগ্রহালয়ও রয়েছে। এই গ্রন্থাগার ও সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে অনেক প্রাচীন পুঁথি, বইপত্র, তাম্রসনদ, মুদ্রা, প্রতিকৃতি, ছবি ও আবক্ষ মূর্তি।[3] উল্লেখ্য, কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি সমজাতীয় সংস্থাগুলির মধ্যে প্রাচীনতম।[3]

দ্রুত তথ্য স্থাপিত, অবস্থান ...
দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি
Thumb
স্থাপিত১৭৮৪ (1784)
অবস্থান১, পার্ক স্ট্রীট
কলকাতা – ৭০০০১৬
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
ধরনসংগ্রহালয়
প্রতিষ্ঠাতাউইলিয়াম জোন্স
সভাপতিস্বপন কুমার প্রামাণিক
নিকটতম গণপরিবহন সুবিধাপার্ক স্ট্রিট
ওয়েবসাইটasiaticsocietycal.com
বন্ধ

প্রতিষ্ঠার ইতিহাস

Thumb
এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা স্যার উইলিয়াম জোনস

অষ্টাদশ শতাব্দীর অন্তিম ভাগে উইলিয়াম জোনস প্রাচ্য সম্বন্ধে গবেষণার উদ্দেশ্যে কলকাতা শহরে একটি উচ্চশিক্ষা সংস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগী হন। ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জানুয়ারি তার পাঠানো একটি আমন্ত্রণপত্রে সাড়া দিয়ে বিচারপতি জন হাইড, জন কার্নাক, হেনরি ভ্যান্সিটার্ট, জন শোর, চার্লস উইল্কিন্স, ফ্রান্সিস গ্ল্যাডউইন, জোনাথন ডানকান প্রভৃতি তিরিশ জন ইউরোপীয় বিদগ্ধ ব্যক্তি কলকাতা শহরের পুরাতন সুপ্রিম কোর্ট ভবনের এক সভায় মিলিত হন। এই সভার সভাপতিত্ব করেন মুখ্য বিচারপতি স্যার রবার্ট চেম্বার্স। এই সভায় জোনসের পরিকল্পনা মতো দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। এই প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য ছিল, এশিয়ার ভৌগোলিক সীমার মধ্যে মানুষ ও প্রকৃতি দ্বারা সৃষ্ট সমস্ত বিষয় সম্বন্ধে অনুসন্ধান ও অধ্যয়ন করা।[n 1] সংস্থার প্রথম সভায় তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস সভাপতিত্ব করেন এবং উইলিয়াম জোনস সহসভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেন। ওয়ারেন হেস্টিংস এই সংস্থার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সহানুভূতিশীল হলেও তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত হতে অস্বীকার করেন এবং তার অনুরোধে জোনস ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি এই পদে অধিষ্ঠিত হন এবং আমৃত্যু এই পদে থাকেন। প্রথম দিকে এই প্রতিষ্ঠানের কার্যকরী সমিতি ছিল না এবং শুধুমাত্র সভাপতি ও সম্পাদক নামক দুইটি পদ ছিল যারা সমস্ত বিষয় দেখাশোনা করতেন। জোনসের মৃত্যুর পর সভার কাজ অনিয়মিত হয়ে পড়ে এবং হেনরি ট্রেল সহ বেশ কয়েকজন কার্যনির্বাহী সদস্য পদত্যাগ করলে প্রতিষ্ঠানটি কয়েক বছরের জন্য গুরুত্বহীন হয়ে পড়লেও ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে আবার ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। ১৮০৮ খ্রিষ্টাব্দে চিকিৎসাশাস্ত্র, ভৌতবিজ্ঞান প্রভৃতির উন্নতি সাধনের জন্য ফিজিক্যাল কমিটি এবং সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, শিল্পকলা প্রভৃতি বিষয়ের উন্নতি সাধনের জন্য লাইব্রেরি কমিটি গঠিত হয়।[4]

নামকরণ

প্রতিষ্ঠাকালে এশিয়াটিক সোসাইটির ইংরেজি নামের বানানটি ছিল Asiatick Society। ১৮২৫ সালে কোনওপ্রকার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই নামটির আধুনিকীকরণ করে ইংরেজি k অক্ষরটি বাদ দেওয়া হয়। এই সময় এশিয়াটিক সোসাইটির প্রাতিষ্ঠানিক নামকরণ হয় "দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি" ("The Asiatic Society")। ১৮৩২ সালে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় "দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল (The Asiatic Society of Bengal)। ১৯৩৬ সালে পুনরায় নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় দ্য রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল (The Royal Asiatic Society of Bengal)। অবশেষে ১৯৫১ সালের ১ জুলাই এশিয়াটিক সোসাইটির বর্তমান নামটি প্রবর্তিত হয়।[5]

সদস্য

প্রতিষ্ঠার পর থেকে এশিয়াটিক সোসাইটিতে শুধু ইউরোপিয়রাই এর সদস্য পদ গ্রহণ করতে পারতেন। জন হাইড, জন কার্নাক, হেনরি ভ্যান্সিটার্ট, জন শোর, চার্লস উইল্কিন্স, ফ্রান্সিস গ্ল্যাডউইন, জোনাথন ডানকান প্রভৃতি এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম সদস্য ছিলেন। কিন্তু ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন সম্পাদক হোরেস হেম্যান উইলসনের পরিকল্পনা মতো ভারতীয়রা এই প্রতিষ্ঠানের সদস্য পদের অধিকারী হন। প্রসন্নকুমার ঠাকুর, দ্বারকানাথ ঠাকুর, রসময় দত্ত এবং রামকমল সেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম ভারতীয় সদস্য ছিলেন। ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে রাধাকান্ত দেবকে সদস্য হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে রামকমল সেন প্রথম ভারতীয় সম্পাদক এবং ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজেন্দ্রলাল মিত্র এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম ভারতীয় সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।[4]

গ্রন্থাগার

Thumb
পুরাতন এশিয়াটিক সোসাইটি ভবন
Thumb
নতুন এশিয়াটিক সোসাইটি ভবন

এশিয়াটিক সোসাইটির গ্রন্থাগারে ছাব্বিশটি ভাষা ও লিপিতে লিখিত প্রায় ৪৭,০০০ পুঁথি এবং প্রায় ১,৪৯,০০০ খণ্ড ছাপা পুস্তকের সম্ভার রয়েছে। এই গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠানের সদস্য ছাড়াও বহু ইউরোপিয় ও ভারতীয়দের দেওয়া উপহার সংগ্রহ করে গড়ে উঠেছে। ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ হেনরি রিচার্ডসন সাতটি ফারসি পুঁথি এবং ১০ নভেম্বর উইলিয়াম মার্সডেন তার লেখা সুমাত্রা দ্বীপের ইতিহাস গ্রন্থটি দান করে এই গ্রন্থাগারের সূচনা করেন। ১৮০৮ খ্রিষ্টাব্দে এই গ্রন্থাগার জনগণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ১৮০৮ খ্রিষ্টাব্দে টিপু সুলতানের প্রাসাদের গ্রন্থাগার থেকে বহু দুর্মূল্য পুঁথি এই গ্রন্থাগারকে দান করা হয়, যার মধ্যে গুলিস্তান গ্রন্থের একটি পুরাতন পুঁথি এবং মুঘল সম্রাট শাহ জাহানের স্বাক্ষর করা বাদশাহনামা নামক গ্রন্থ ছিল উল্লেখযোগ্য। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ বন্ধ হয়ে গেলে এই কলেজের সমস্ত সংস্কৃত, আরবি, উর্দু ও ফারসি ভাষার পুথিগুলি এশিয়াটিক সোসাইটির তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসা হয়।[6]

এই প্রতিষ্ঠানের সংগৃহীত পুঁথিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সপ্তম শতাব্দীতে রচিত কুব্জিকামাতম, ১৩৬২ খ্রিষ্টাব্দে রচিত ঋগবেদপদপাঠ, কিরণাবলি, চারুচর্য, পরাসিকাপ্রকাশ, ললিতবিস্তার, দায়ভাগ, কালচক্রটীকা, কালচক্রাবেতার, দেবীমাহাত্ম্যম্, সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত রামচরিত মানস, শ্রীনিবাস রচিত ভট্টিকাব্যটীকা, দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত কালাইদ-আল-ইকুয়াইন-ওয়া-মহসিন-আল-আয়ান ও খারিদাত আল-কাস্র, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রচিত আ-মাদখুল ও তাফসির-ই-কুরান, পঞ্চদশ শতাব্দীতে রচিত তুহফাত-আল-আহবার-ফি-উসুল-আত-হাদিথ-ওয়া'ল-আখবর, অষ্টাদশ শতাব্দীতে রচিত কিতাব আল-ই'লান ও আদাব-ই-আলমগিরি, অষ্টসহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা, অপরিমিতায়ুর্নাম মহাযান সূত্র, পঞ্চরক্ষ, পরমার্থনাম সঙ্গতি, বিবেক পঞ্চামৃত, শাহনামা, ফরং-ই-ঔরং শাহী, দিওয়ান-ই-মখফি, কিসসা-ই-নুশ-আফারিন, আমির নামা তুতিনামা, ইয়ার-ই-দনেশ, তফ্রিবুল-ইমরাহ, ইমারাতুত-আকবর প্রভৃতি।[7]

সংগ্রহালয়

১৮১৪ খ্রিষ্টাব্দে এশিয়াটিক সোসাইটির সংগ্রহালয় আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে এই প্রতিষ্ঠান থেকে সরকারের নিকট কলকাতা শহরে জনগণের জন্য উন্মুক্ত একটি সংগ্রহালয় নির্মাণের জন্য আবেদন করা হয়। ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় সংগ্রহালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর এশিয়াটিক সোসাইটির সংগ্রহালয় থেকে সংগৃহীত বহু সামগ্রী নবনির্মিত ভারতীয় সংগ্রহালয়ে স্থানান্তরিত করা হয়।[8]

প্রকাশনা

উইলিয়াম জোনস এশিয়াটিক মিসচ্যালেনি নামক একটি বার্ষিক গবেষণা পত্রিকা চালু করেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সামর্থ্য ভালো না হওয়ায় এই পত্রিকা অনিয়মিতভাবে ছাপা হত। অবশেষে ম্যানুয়েল ক্যান্টোফার নামক ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছাপাখানার এক কর্মচারী এই পত্রিকা ছাপাতে রাজি হন। গবেষণা পত্রিকাটির নাম পাল্টে রাখা হয় এশিয়াটিক রিসার্চার্স এবং এর প্রথম সংস্করণ ১৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দে বের হয়। ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে ডেপুটি সার্ভেয়ার জেনারেল ক্যাপ্টেন হার্বার্ট গ্লিনিংস ইন সায়েন্স নামক একটি মাসিক পত্রিকা চালু করলে জেমস প্রিন্সেপ এই পত্রিকার নাম পরিবর্তন করে দ্য জার্নাল অব দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি রাখার প্রস্তাব করেন। ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে এই প্রস্তাব গৃহীত হয়।[8]

পাদটীকা

  1. The bounds of its investigations will be the geographical limits of Asia, and within these limits its enquiries will be extended to whatever is performed by MAN or produced by NATURE.[4]

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

Wikiwand in your browser!

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.

Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.

Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.