গ্রেট ব্রিটেন
ইউরোপের উত্তর-পশ্চিম উপকূলে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের দ্বীপ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ইউরোপের উত্তর-পশ্চিম উপকূলে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের দ্বীপ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
গ্রেট ব্রিটেন[note 1], বা ব্রিটেন /ˈbrɪ.tən/, হল মহাদেশীয় ইউরোপের উত্তর-পশ্চিম উপকূল থেকে কিছু দূরে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থিত একটি দ্বীপ। এই দ্বীপের আয়তন ২,২৯,৮৪৮ কিমি২ (৮৮,৭৪৫ মা২)। এটি ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ তথা ইউরোপের বৃহত্তম দ্বীপ এবং বিশ্বের নবম বৃহত্তম দ্বীপ।[5][6] ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে এই দ্বীপের জনসংখ্যা ৬১,০০০,০০০। ইন্দোনেশিয়ার জাভা ও জাপানের হোনশুর পরেই এটি বিশ্বের তৃতীয় সর্বাধিক জনবহুল দ্বীপ।[7][8] গ্রেট ব্রিটেনকে ঘিরে রয়েছে ১০০০টিরও বেশি ছোটো দ্বীপ।[9] আয়ারল্যান্ড দ্বীপটি এই দ্বীপের পশ্চিম দিকে অবস্থিত।
স্থানীয় নাম: | |
---|---|
ভূগোল | |
অবস্থান | উত্তর-পশ্চিম ইউরোপ |
স্থানাঙ্ক | ৫৩°৫০′ উত্তর ২°২৫′ পশ্চিম |
দ্বীপপুঞ্জ | ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ |
সংলগ্ন জলাশয় | আটলান্টিক মহাসাগর |
আয়তন | ২,২৯,৮৪৮ বর্গকিলোমিটার (৮৮,৭৪৫ বর্গমাইল)[1] |
আয়তনে ক্রম | ৭ম |
সর্বোচ্চ উচ্চতা | ১,৩৪৪ মিটার (৪,৪০৯ ফুট) |
সর্বোচ্চ বিন্দু | বেন নেভিস |
প্রশাসন | |
কান্ট্রি | ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও উত্তর আয়ারল্যান্ড |
বৃহত্তর বসতি | লন্ডন (জনসংখ্যা 8,878,892) |
জনপরিসংখ্যান | |
জনসংখ্যা | ৬০,৮০০,০০০[2] (২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে) |
জনঘনত্ব | ৩০২ /বর্গ কিমি (৭৮২ /বর্গ মাইল) |
জাতিগত গোষ্ঠীসমূহ |
এই দ্বীপটি গ্রেট ব্রিটেন ও উত্তর আয়ারল্যান্ড যুক্তরাজ্যের অঙ্গ। দ্বীপটি ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস, উত্তর আয়ারল্যান্ড—এই চারটি অঞ্চলে বিভক্ত। এই চার অঞ্চলের রাজধানী যথাক্রমে লন্ডন, এডিনবরা, কার্ডিফ ও বেলফাস্ট। রাজনৈতিকভাবে, গ্রেট ব্রিটেন বলতে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও উত্তর আয়ারল্যান্ড এবং এই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত পার্শ্ববর্তী দ্বীপগুলিকে বোঝায়।[12]
গ্রেট ব্রিটেন রাজ্যটি ১৭০৭ সালের ইউনিয়ন আইন বলে স্কটল্যান্ড রাজ্য ও ইংল্যান্ড রাজ্যের (যা অধুনা ইংল্যান্ড ও ওয়েলস নিয়ে গঠিত ছিল) সঙ্গে যুক্ত হয়। এই ঘটনার প্রায় ১০০ বছর আগে, ১৬০৩ সালে, স্কটিশ রাজা ষষ্ঠ জেমস ইংল্যান্ডের রাজা হয়েছিলেন। কিন্তু ১৭০৭ সালেই প্রথম দুই দেশের পার্লামেন্ট সংযুক্ত রাজ্য গঠনের ব্যাপারে একমত হয়। এরপর ১৮০১ সালের ইউনিয়ন আইন বলে পার্শ্ববর্তী আয়ারল্যান্ড রাজ্য গ্রেট ব্রিটেনের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯২২ সালে আয়ারল্যান্ডের ছয় ভাগের পাঁচ ভাগ অঞ্চল নিয়ে আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্র গঠিত হলে যুক্তরাজ্যের নাম হয় গ্রেট ব্রিটেন ও উত্তর আয়ারল্যান্ড যুক্তরাজ্য।
ব্রিটেনের বিচারব্যবস্থা উপর্যুক্ত ভূমিকা পালনের পাশাপাশি প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের উপর নিয়ন্ত্রণমূলক কিছু ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে, শাসন বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের উপর ব্রিটেনে বিচার বিভাগের এ নিয়ন্ত্রণ অবাধ বা সীমাহীন নয়। ব্রিটেনে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত ও সুপ্রতিষ্ঠিত। তাই ব্রিটেনে বিচার বিভাগকে পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের পরিধির মধ্যে থেকে কাজ করতে হয়।
দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে এই দ্বীপপুঞ্জ একটিমাত্র নামে চিহ্নিত হয়ে আসছে। গ্রিকো-রোমান (ক্ল্যাসিকাল) ভৌগোলিকেরা ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জকে যে নামে চিহ্নিত করতেন, সেই নামগুলি থেকেই এই দ্বীপের বর্তমান নামের উৎপত্তি ঘটে। খ্রিস্টপূর্ব ৫০ অব্দ নাগাদ গ্রিক ভৌগোলিকেরা ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জকে Prettanikē বা ওই জাতীয় নামে চিহ্নিত করতেন।[13] যদিও রোমানরা ব্রিটেন দখল করার পর গ্রেট ব্রিটেন দ্বীপটি ব্রিটানিয়া নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে ক্যালিডোনিয়ার দক্ষিণে রোম-অধিকৃত ব্রিটেন রোমান ব্রিটেন নামে পরিচিত হয়।[14][15][16]
গ্রেট ব্রিটেনের প্রাচীনতম যে নামটি জানা যায়, সেটি হল অ্যালবিওন (Ἀλβίων) বা ইনসুলা অ্যালবিওনাম। এই নামটির সম্ভাব্য উৎস দুটি হতে পারে। এক লাটিন অ্যালবাস বা সাদা (মহাদেশীয় ইউরোপ থেকে ডোভারের সাদা পার্শ্বদেশটি দেখা যায়, তার প্রসঙ্গক্রমে) অথবা অ্যালবিয়ান জাতির দ্বীপ, এই অর্থে। দ্বিতীয় নামের উৎসটি পাওয়া যায়, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের ম্যাসালিওট পেরিপ্লাস ও পাইথেয়াসে।[17]
গ্রেট ব্রিটেন-সংক্রান্ত পরিভাষার প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় অ্যারিস্টটল (খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪–৩২২ অব্দ) বা সম্ভবত ছদ্ম-অ্যারিস্টটল রচিত অন দ্য ইউনিভার্স গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে। এই বইতে আছে: "ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ নামে পরিচিত দ্বীপপুঞ্জে দুটি বড়ো দ্বীপ আছে, অ্যালবিওন ও আইয়ের্ন।"[18]
প্লিনি দি এল্ডার (২৩–৭৯ খ্রিষ্টাব্দ) তার ন্যাচারাল হিস্ট্রি বইতে গ্রেট ব্রিটেনের এই বর্ণনা দিয়েছেন: "আগে এর নাম ছিল অ্যালবিয়ন। কিন্তু পরবর্তীকালে যে দ্বীপগুলির কথা আমরা এবার আলোচনা করব, সেই সব কটি দ্বীপই 'Britanniæ' নামে পরিচিত হয়।"[19]
ব্রিটেন নামটি এসেছে নাটিন নাম ব্রিটেন, Britannia বা Brittānia, ব্রিটনদের দেশ, প্রাচীন ফরাসি Bretaigne (আধুনিক ফরাসিতেও Bretagne) এবং মধ্যযুগীয় ইংরেজি 'Bretayne, Breteyne থেকে। ফরাসি শব্দগুলি প্রাচীন ইংরেজি Breoton, Breoten, Bryten, Breten (বা Breoton-lond, Breten-lond) শব্দগুলিকে প্রতিস্থাপিত করে। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী থেকেই রোমানরা ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জকে ব্রিটানিয়া নামে চিহ্নিত করে আসছিল। এই নামটি এসেছে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩২০ অব্দের প্রাচীন গ্রিক পর্যটক পাইথেয়াসের বর্ণনা। এই বর্ণনায় উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের থুলে (সম্ভবত নরওয়ে) পর্যন্ত বিভিন্ন দ্বীপের বর্ণনা পাওয়া যায়।
মার্সিয়ান অফ হেরাক্লিয়া তাঁর পেরিপ্লাস মারিস এক্সটেরি গ্রন্থে এই দ্বীপপুঞ্জকে বলেছেন "প্রেটানিক দ্বীপপুঞ্জ" (αἱ Πρεττανικαὶ νῆσοι)।[20]
এই দ্বীপের অধিবাসীদের বলা হত প্রিটেনি (Πρεττανοί) বা প্রেটানি।[17] প্রিটেনি নামের উৎস ওয়েলস শব্দ প্রাইডাইন (অর্থাৎ, ব্রিটেন), যেটি এবং গোইডলিক শব্দ ক্রুইথেন (আয়ারল্যান্ডের প্রাচীন ব্রিথোনিক-ভাষী জাতি) শব্দদুটির উৎস এক।[21] দ্বিতীয় নামটি পরে রোমানরা পিক্ট বা ক্যালিডোনিয়ান শব্দে অভিহিত করে।
গ্রিক লেখক টলেমি তাঁর অ্যালমাজেস্ট (১৪৭–১৪৮ খ্রিস্টাব্দ) বইয়ে বৃহত্তর দ্বীপটিকে "বৃহৎ ব্রিটেন" (megale Britannia) ও আয়ারল্যান্ডকে "ক্ষুদ্র ব্রিটেন" (mikra Brettania) বলে উল্লেখ করেন।[22] পরবর্তী গ্রন্থ জিওগ্রাফি-তে (১৫০ খ্রিস্টাব্দ) তিনি দ্বীপগুলির নামকরণ করেন।[23] অ্যালয়িওন, আইওয়ের্নিয়া ও মোনা (আইল অফ ম্যান), এই নামগুলি এই দ্বীপের স্থানীয় নাম ছিল। সম্ভবত অ্যালমাজেস্ট লেখার সময় টলেমি এই পৃথক নামগুলি জানতেন না।[24] সম্ভবত রোমানদের ব্রিটেন জয়ের পর থেকেই "অ্যালবিয়ন" নামটি অপ্রচলিত হয়ে পড়ে এবং "ব্রিটেন" নামটি গ্রেট ব্রিটেনের নাম হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।[17]
অ্যাংলো-স্যাক্সন যুগের পর "ব্রিটেন" শব্দটি একটি ঐতিহাসিক পরিভাষায় পর্যবসিত হয়। জিওফ্রে অফ মনমাউথ তাঁর ছদ্ম-ঐতিহাসিক হিস্টোরিয়া রেজাম ব্রিটানিয়া (১১৩৬ খ্রিস্টাব্দ) গ্রন্থে গ্রেট ব্রিটেন দ্বীপটিকে Britannia major ("বৃহত্তর ব্রিটেন") নামে চিহ্নিত করেন। খ্রিস্টীয় পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ থেকে কেল্টিক অভিনিবেশকারীরা আধুনিক ব্রিটানির কাছে যে মহাদেশীয় অংশে বসতি স্থাপন করেছিলেন, তাকে তিনি Britannia minor ("ক্ষুদ্রতর ব্রিটেন") নামে অভিহিত করেছিলেন।[25] ১৪৭৪ সালে ইংল্যান্ডের রাজা চতুর্থ এডওয়ার্ডের কন্যা সিসিলি ও স্কটল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জেমসের পুত্র চতুর্থ জেমসের বিবাহ প্রস্তাবে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে "গ্রেট ব্রিটেন" কথাটি ব্যবহৃত হয়। ১৬০৪ সালে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমস "কিং অফ গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আয়ারল্যান্ড" উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।
ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে "গ্রেট ব্রিটেন" বলতে গ্রেট ব্রিটেন দ্বীপটিকে এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসকে বোঝায়।[26] যদিও কখনও কখনও সমগ্র যুক্তরাজ্যকেই গ্রেট ব্রিটেন বলে উল্লেখ করা হয়।[27]
১৯৭৫ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের সরকারি ইয়ারবুকে গ্রেট ব্রিটেনের বিপরীত অর্থেই "ব্রিটেন" শব্দটি ব্যবহৃত হত।[28] ২০০২ সাল থেকে ইয়ারবুকে শুধুই "যুক্তরাজ্য" কথাটি ব্যবহৃত হয়।[29]
সাদমান
গ্রেট ব্রিটেন যুক্তরাজ্যের বৃহত্তম দ্বীপ। রাজনৈতিকভাবে গ্রেট ব্রিটেন বলতে সমগ্র ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসকে বোঝায়।[30] উত্তর আয়ারল্যান্ড এর অন্তর্ভুক্ত নয়। আইল অফ উইট, অ্যাংলেসে, আইল অফ সিলি, হেব্রাইডস এবং ওর্কনি ও শেটল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ এর অন্তর্গত নয়। আইল অফ ম্যান ও চ্যানেল আইল্যান্ড ব্রিটিশ অধীনস্থ দ্বীপ। এগুলিও গ্রেট ব্রিটেনের অন্তর্গত নয়।[30][31]
ইউরোপীয় মূল ভূখণ্ড থেকে একটি স্থলসেতুর মাধ্যমে এই অঞ্চলে প্রথম মানুষের আগমন ঘটে। নরফোকে ৮০০,০০০ বছরের পুরনো মানুষের পদচিহ্ন পাওয়া গিয়েছে।[32] ৫০০,০০০ বছরের পুরনো জনবসতির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে সাসেক্সের বক্সগ্রোভ কুয়েরিতে।[33] ৩০,০০০ বছরের পুরনো আধুনিক মানুষের বসতির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে গ্রেট ব্রিটেনে।
গ্রেট ব্রিটেন ১৪,০০০ বছর আগে পর্যন্ত আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে এবং ৮,০০০ বছর আগে পর্যন্ত আধুনিক ডেনমার্ক ও নরওয়ের সঙ্গে একটি নিচু জলাভূমির মাধ্যমে যুক্ত ছিল।[34] ব্রিস্টলের কাছে চেডডার জর্জে ইউরোপীয় মূল ভূখণ্ডের কিছু প্রাণীর দেহাবশেষ পাওয়া গিয়েছে। সঙ্গে একটি মানুষের মাথার খুলিও ('চেডডার ম্যান') পাওয়া গিয়েছে যেটি আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৭১৫০ অব্দের। অর্থাৎ, অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে মানুষও নিশ্চয় একটি ভৌগোলিক সেতুর মাধ্যমে ইউরোপের মূল ভূখণ্ড থেকে গ্রেট ব্রিটেনে এসেছিল।[35] শেষ হিমবাহ যুগের শেষে হিমবাহগুলি গলতে শুরু করলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। এই সময় গ্রেট ব্রিটেন একটি দ্বীপে পরিণত হয়।
গ্রেট ব্রিটেনের লৌহযুগীয় অধিবাসীদের ব্রিটন বলা হয়। এরা একটি কেল্টিক ভাষায় কথা বলত। রোমানরা উত্তর ইংল্যান্ডের হ্যাড্রিয়ান'স ওয়াল পর্যন্ত দ্বীপের অধিকাংশ অঞ্চল জয়ের পর এটি প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের ব্রিটানিয়া প্রদেশে পরিণত হয়। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের ৫০০ বছর পর দক্ষিণ ও পূর্বের ব্রিটনরা একজোট হয়েছিল অবস্থা অনুপ্রবেশকারী জার্মানিক উপজাতিগুলির (এঙ্গেলস, স্যাক্সন ও জুটস, যাদের একত্রে অ্যাংলো-স্যাক্সন বলা হয়) দ্বারা বিতাড়িত হয়েছিল। একই সময় গেলিক উপজাতিগুলি আয়ারল্যান্ড থেকে উত্তর-পশ্চিমে অনুপ্রবেশ শুরু করে। এরা উত্তর ইংল্যান্ডের পিক্টস ও ব্রিটনদের গ্রাস করে নিয়ে নবম শতাব্দীতে স্কটল্যান্ড রাজ্য গঠন করে। স্কটল্যান্ডের দক্ষিণাংশ এঙ্গেলস দ্বারা শাসিত নরদামব্রিয়া রাজ্য গঠন করে। ১০১৮ সাল পর্যন্ত এই রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব ব্রিটেনের অধিবাসীদের নাম এঙ্গেলস নামটির অপভ্রংশে ইংলিশ বা ইংরেজ জাতি নামে পরিচিত হয়।
জার্মানিক ভাষাভাষীরা ব্রিটনদের "ওয়েলশ" (Welsh) বলত। এই শব্দটি সাধারণত আধুনিক ওয়েলস অঞ্চলের অধিবাসী বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ওয়ালেস বা কর্নওয়াল পদবিগুলিতে এখনও এই শব্দটির অংশ দেখা যায়। ওয়েলশ থেকে নিজেদের পৃথক করতে ব্রিটনরা "কাম্রি" (Cymry) নামে নিজেদের অভিহিত করত। এই নামটি এখন কামব্রিয়া স্থাননামের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ওয়েলস, কামব্রিয়া ও কর্নওয়াল অঞ্চলের ব্রিটনরা জার্মানিক জাতিগুলির মধ্যে মিশে যায়নি। তার ফলস্রুতিতে এখনও এই সব অঞ্চলে কিছু কেল্টিক ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে।[36] দক্ষিণ ব্রিটেনে জার্মানিক অনুপ্রবেশের সময় অনেক ব্রিটন আধুনিক ব্রিট্যানি অঞ্চলে চলে যায়। এখানে ব্রেটন নামে একটি কেল্টিক ভাষা ওয়েলস ও কর্নিশ ভাষা এবং এই ভাষার অপভ্রংশ রূপটি এখনও বর্তমান। নবম শতাব্দীতে একাধিক ড্যানিশ আক্রমণের ফলে উত্তর ইংল্যান্ডের রাজ্যগুলি ড্যানিশ অধিকারে আসে। এই অঞ্চলটি ডেনল নামে পরিচিত। ৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে সর্বশেষ রাজ্য নরদামব্রিয়া রাজা প্রথম এডগারের কাছে আত্মসমর্পণ করলে অবশ্য সবকটি ইংরেজ রাজ্য ইংল্যান্ড রাজ্যের অধীনে আসে। ১০৬৬ সালে নর্ম্যানরা ইংল্যান্ড জয় করে। এরপর একটি নর্ম্যান-ভাষী প্রশাসন চালু হয় এই দেশে। ১২৮২ সালে ওয়েলস আসে অ্যাংলো-নর্ম্যান অধিকারে। ষোড়শ শতাব্দীতে এই রাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ইংল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়।
১৬০৪ সালের ২০ অক্টোবর রাজা জেমস পৃথকভাবে ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের সিংহাসনে আরোহণ করার পর নিজেকে "কিং অফ গ্রেট ব্রিটেইন, ফ্রান্স অ্যান্ড আয়ারল্যান্ড" বলে ঘোষণা করেন।[37] ১৬২৫ সালে জেমসের মৃত্যুর পর ইংল্যান্ডের প্রিভি কাউন্সিল একটি ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করেন। এই ঘোষণাপত্রে জেমসের ইচ্ছানুসারে "কিং অফ গ্রেট ব্রিটেন" কথাটি ব্যবহৃত হয়।[38] জেমসের একাধিক উত্তরসূরি এই উপাধিটিই ব্যবহার করেছেন। যদিও এই সময় ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড আইনত পৃথক দেশ ছিল। ১৭০৬ সালে ইউনিয়ন ট্রিটি সাক্ষরিত হওয়ার পর ১৭০৭ সালে দুই দেশের সংসদে ইউনিয়ন আইন পাস হয়। এই আইনবলে যুক্তরাজ্য স্থাপিত হয়। ১৭০৭ সালের ১ মে একক পার্লামেন্ট ঘোষিত হয়। এই সনদ অনুসারে সমগ্র দ্বীপরাজ্যটি "গ্রেট ব্রিটেন যুক্তরাজ্য" নামে পরিচিত হয়।
মহাদেশীয় ইউরোপের উত্তর-পশ্চিম উপকূলরেখায় ইউরোপীয় মহাদেশীয় সোপানে গ্রেট ব্রিটেন অবস্থিত। ইউরোপের মূল ভূখণ্ড থেকে এই দ্বীপপুঞ্জকে পৃথক করে রেখেছে উত্তর সাগর ও ইংলিশ চ্যানেল। ডোভার প্রণালীর কাছে মহাদেশীয় ইউরোপ ও গ্রেট ব্রিটেনের দূরত্ব মাত্র ৩৪ কিমি (১৮ নটিক্যাল মাইল; ২১ মা)।[39] উত্তর প্রণালী, আইরিশ সাগর, সেন্ট জর্জস প্রণালী ও কেল্টিক সাগর এই দ্বীপটিকে পশ্চিমে আয়ারল্যান্ড থেকে পৃথক করেছে।[40] বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্রতল রেল টানেল চ্যানেল টানেল মহাদেশীয় ইউরোপের সঙ্গে গ্রেট ব্রিটেনের সংযোগ রক্ষা করেছে। ১৯৯৩ সালে এই টানেল নির্মাণ সমাপ্ত হয়। গ্রেট ব্রিটেনের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চল পর্বতময় এবং পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চল নিম্নভূমি। এক হাজারেরও বেশি দ্বীপ ও অতি ক্ষুদ্র দ্বীপ গ্রেট ব্রিটেনকে ঘিরে রয়েছে।
ইংলিশ চ্যানেল সম্ভবত ৪৫০,০০০ থেকে ১৮০,০০০ বছরের মধ্যে গঠিত হয়েছিল। দুটি হিমবাহ হ্রদের গলে যে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছিল, তাতেই এই চ্যানেল সৃষ্টি হয়।[41] প্রায় ১০,০০০ বছর আগেও গ্রেট ব্রিটেন দ্বীপ ছিল না। এই দ্বীপ সেই সময় ছিল মহাদেশীয় ইউরোপের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অংশ। সেই সময় সমৃদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আজকের চেয়ে ১২০ মিটার (৩৯০ ফু) কম ছিল। উত্তর সাগর ছিল শুকনো। এটি সেই সময় গ্রেট ব্রিটেনকে মহাদেশের সঙ্গে জুড়ে রাখত। এটি ডগারসল্যান্ড নামে পরিচিত। খ্রিস্টপূর্ব ৬৫০০ অব্দ নাগাদ ডগারসল্যান্ড উত্তর সাগরে নিমজ্জিত হয়ে ব্রিটিশ উপদ্বীপকে ইউরোপ মহাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।[42]
পরবর্তী ব্রোঞ্জ যুগে ব্রিটেন আটলান্টিক ব্রোঞ্জ যুগ নামে পরিচিত একটি সংস্কৃতির অংশীদার হয়। এই যুগে ব্রিটেনের সঙ্গে আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন ও পর্তুগালের সমুদ্র বাণিজ্য শুরু হয়। কেলটিক ভাষাসমূহের উৎপত্তি হলস্ট্যাট সংস্কৃতি থেকে—এই প্রচলিত মতবাদের বিপক্ষে[43] ২০০৯ সাল থেকে জন টি. কোচ ও অন্যান্যরা বলছেন যে কেলটিক ভাষাগুলি ব্রোঞ্জ যুগীয় পশ্চিম ইউরোপ (বিশেষত আইবেরিয়ান উপদ্বীপ) থেকে এসেছে।[44][45][46][47] কোচের প্রস্থাব যদিও কেলটিক ভাষাবিদদের মধ্যে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হয়।[43]
মনে করা হয়, আধুনিক কালের সব কটি ব্রাইথোনিক ভাষা (ব্রেটোন, কর্নিশ, ওয়েলশ) একটি সাধারণ আদি ভাষা থেকে উৎসারিত। এই আদি ভাষাটিকে ব্রিটোনিক, ব্রিটিশ, কমন ব্রাইথোনিক, ওল্ড ব্রাইথোনিক বা প্রোটো-ব্রাইথোনিক নামে চিহ্নিত করা হয়। সম্ভবত এটি খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে প্রোটো-কেল্টিক বা আদি উপদ্বীপীয় কেল্টিক থেকে উৎপন্ন।[48]
ফোর্থ ও ক্লাইড নদীর দক্ষিণে গ্রেট ব্রিটেনের বৃহত্তর অংশে রোমান অভিযানের আগে ব্রাইথোনিক ভাষাগুলিই ছিল প্রধান ভাষা। যদিও আইল অফ ম্যানে পরবর্তীকালে ম্যানক্স নামে একটি গৈডেলিক ভাষা চালু হয়েছিল। উতর স্কটল্যান্ডে চলত প্রিটেনিক ভাষা। যেটি পরবর্তীকালে পিকটিশ ভাষায় পরিণত হয়। এটিও সম্ভবত একটি ব্রাইথোনিক ভাষা ছিল।
রোমানরা দক্ষিণ ব্রিটেন জয় করে নেওয়ার পর (খ্রিস্টীয় ৪৩ থেকে ৪১০ অব্দ) সাধারণ ব্রাইথোনিক ভাষা প্রচুর লাতিন শব্দ ধার করে। আধুনিক ব্রাইথোনিক ভাষাগুলিতে লাতিন থেকে ধার করা প্রায় ৮০০ শব্দ রয়ে গিয়েছে। রোমান লেখকদের ব্যবহৃত ভাষাটির লাতিনীকৃত রূপটির নাম হল রোমানো-ব্রিটিশ। এখন এই দ্বীপে চলে আধুনিক ইংরেজি ভাষা।
আদি মধ্যযুগ থেকে খ্রিস্টধর্ম গ্রেট ব্রিটেনের প্রধান ধর্ম। প্রাচীনকালে রোমানরা এই ধর্ম গ্রেট ব্রিটেনে নিয়ে আসে। সেই সময় এই ধর্ম ছিল আদি উপদ্বীপীয় খ্রিস্টধর্ম। সাধারণত মনে করা হয় খ্রিস্টীয় প্রথম অথবা দ্বিতীয় শতাব্দীতে খ্রিস্টধর্ম গ্রেট ব্রিটেনে এসেছিল। এখানে অ্যাংলিক্যানিজম (স্কটল্যান্ডে যা এপিস্কোপ্যালিজম নামে পরিচিত) খ্রিস্টধর্মের বৃহত্তম সম্প্রদায়। যুক্তরাজ্যের চার্চের প্রধান হলেন রাজা বা রানি। তাকে "সুপ্রিম গভর্নর অফ দ্য চার্চ অফ ইংল্যান্ড" বলা হয়। এটিই ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় চার্চ। বর্তমানে এই চার্চের অনুগামীর সংখ্যা ২ কোটি ৬০ লক্ষ।[49] দ্বিতীয় বৃহত্তম সম্প্রদায় হল রোমান ক্যাথলিক চার্চ। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে অগাস্টিনের মিশনের মাধ্যমে এই ধর্ম ইংল্যান্ডে এসেছিল। বর্তমানে ব্রিটেনে ৫০ লক্ষ ক্যাথলিক খ্রিস্টান বাস করেন। এদের মধ্যে ৪ লক্ষ ৫০ হাজার ক্যাথলিকের বাস ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে[50] এবং ৭৫০,০০০ ক্যাথলিক বাস করেন স্কটল্যান্ডে।[51]
গ্রেট ব্রিটেনের তৃতীয় বৃহত্তম খ্রিস্টান সম্প্রদায় চার্চ অফ স্কটল্যান্ডের অনুগামীর সংখ্যা ২ কোটি ১০ লক্ষ।[52] জন নক্স প্রবর্তিত এই চার্চ স্কটল্যান্ডের সরকারি চার্চ। এখানে যুক্তরাজ্যের রাজা বা রানি একজন লর্ড হাই কমাশনারের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব করেন। মেথডিজম গ্রেট ব্রিটেনের চতুর্থ বৃহত্তম খ্রিস্টান সম্প্রদায়। জন ওয়েসলে অ্যাংলিক্যানিজম থেকে এই সম্প্রদায়কে পৃথক করেছিলেন।[53] পুরনো শিল্পশহর ল্যাঙ্কাশায়ার ও ইয়র্কশায়ার এবং কর্নওয়ালের টিন খনি শ্রমিকদের মধ্যে এই মত জনপ্রিয়।[54] ওয়েলসের প্রেসবিটারিয়ান চার্চ ওয়েলস অঞ্চলের বৃহত্তম সম্প্রদায়। এটি ক্যালভিনিস্টক মেথডিজম ) [[ , মতের অনুগামী। সেন্ট অ্যালবান গ্রেট ব্রিটেনের পৃষ্ঠপোষক সন্ত।[55] তিনি রোমানো-ব্রিটিশ যুগের প্রথম খ্রিস্টান শহিদ। খ্রিস্টধর্ম ত্যাগ করতে অস্বীকার করায় তাঁলে রোমান দেবতাদের উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হয়েছিল।[56]
যুক্তরাজ্যের তিনটি কান্ট্রির রাজধানী শহর হল:
জনসংখ্যার হিসেবে গ্রেট ব্রিটেনের অন্যান্য বড়ো শহরগুলি হল বার্মিংহাম, গ্লাসগো, লিডস, লিভারপুল, ম্যানচেস্টার, নটিংহ্যাম ও শেফিল্ড।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.