নীহারিকা অনুকল্প
From Wikipedia, the free encyclopedia
সৃষ্টিতত্ত্বের ক্ষেত্রে নীহারিকা অনুকল্প (ইংরেজি: nebular hypothesis) হল সৌরজগতের উদ্ভব ও বিবর্তন তথা অন্যান্য গ্রহব্যবস্থারও সৃষ্টিতত্ত্ব-ব্যাখ্যাকারী সর্বাধিক স্বীকৃত তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, সূর্য-প্রদক্ষিণকারী গ্যাস ও ধুলোর থেকে সৌরজগতের উৎপত্তি ঘটেছিল। ১৭৫৫ সালে ইমানুয়েল কান্ট তাঁর "বিশ্বজনীন প্রাকৃতিক ইতিহাস ও অন্তরীক্ষ তত্ত্ব" গ্রন্থে এই তত্ত্বটি প্রথম প্রকাশ করেন। পরে ১৭৯৬ সালে পিয়ের সিমোঁ লাপ্লাস এই তত্ত্বে কিছু পরিবর্তন সাধন করেছিলেন। আদিতে সৌরজগতের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হলেও গ্রহজগৎ উদ্ভবের প্রক্রিয়াটিকে এখন সমগ্র মহাবিশ্বেই ক্রিয়াশীল বলে মনে করা হয়। নীহারিকাতত্ত্বের সর্বাধিক স্বীকৃত আধুনিক রূপান্তরটি হল সৌর নীহারিকা চাকতি মডেল (ইংরেজি: solar nebular disk model বা SNDM) বা সৌর নীহারিকা মডেল (ইংরেজি: solar nebular model)।[1] এই তত্ত্বের মাধ্যমে গ্রহগুলির প্রায়-বৃত্তাকার ও একতলীয় কক্ষপথ এবং সূর্যের আবর্তনের সঙ্গে একই দিকে গ্রহগুলির গতি সহসৌরজগতের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ব্যাখ্যা প্রদান করার চেষ্টা করা হয়। মূল নীহারিকা অনুকল্পের কিছু কিছু উপাদান গ্রহ গঠন-সংক্রান্ত আধুনিক তত্ত্বগুলিতেও প্রতিধ্বনিত হয়েছে। কিন্তু সেই মূল তত্ত্বের অধিকাংশ উপাদানই নতুন তত্ত্ব দ্বারা অপসারিত হয়েছে।
নীহারিকা অনুকল্প মতে, আণবিক হাইড্রোজেনের প্রকাণ্ড ও ঘন মেঘসমূহ বা দৈত্যাকার আণবিক মেঘ (ইংরেজি: Giant Molecular Cloud বা GMC) থেকে নক্ষত্রগুলি গঠিত হয়। এই মেঘগুলি অভিকর্ষীয় দিক থেকে অস্থির এবং এগুলির মধ্যকার পদার্থ একাঙ্গীভূত হয় ক্ষুদ্রতর ও ঘনতর গুচ্ছের সৃষ্টি করে। তারপর এই গুচ্ছগুলি আবর্তিত হয়, ভেঙে পড়ে এবং নক্ষত্রের সৃষ্টি ঘটায়। নক্ষত্রের উৎপত্তি একটি জটিল প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় সর্বক্ষেত্রেই নবীন নক্ষত্রকে ঘিরে একটি গ্যাসময় আদিগ্রহীয় চাকতি (প্রোপ্লাইড) সৃষ্টি হয়। নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে এই চাকতি থেকে গ্রহেরও উদ্ভব ঘটতে পারে, তবে এই পরিস্থিতির কথা সঠিক জানা যায় না। এই জন্য গ্রহজগতের উদ্ভবকে নক্ষত্রের উৎপত্তির একটি স্বাভাবিক ফলশ্রুতি মনে করা হয়। সূর্যের মতো একটি নক্ষত্রের উৎপত্তি ঘটতে প্রায় ১০ লক্ষ বছর লাগে এবং তারপরে আদিগ্রহীয় চাকতিটি বিবর্তিত হয়ে একটি গ্রহজগতের রূপ নিতে সময় লাগে ১-১০ কোটি বছর।[2]
আদিগ্রহীয় চাকতি হল একটি উপচয় চাকতি যা থেকে কেন্দ্রীয় নক্ষত্রটি পরিপুষ্ট হয়। প্রথম দিকে চাকতিটি অত্যন্ত উষ্ণ অবস্থায় থাকে। তারপর টি টরি নক্ষত্র স্তর নামে পরিচিত পর্যায়ে পৌঁছে সেটি শীতল হতে শুরু করে। এই স্তরেই পাথর ও বরফ দ্বারা গঠিত ছোটো ছোটো ধুলোর দানা সৃষ্টি হয়। এরপর এই দানাগুলি ঘনীভূত হয়ে সম্ভবত কিলোমিটার-আকারবিশিষ্ট প্ল্যানেটসিমাল সৃষ্টি করে। চাকতিটি যদি যথেষ্ট বড়ো হয় তবে পলাতক উপচয়ের সূত্রপাত ঘটে, যার ফলে দ্রুত—১০০,০০০ থেকে ৩০০,০০০ বছরে—উপগ্রহ গঠিত হয় মঙ্গল-আকারবিশিষ্ট গ্রহীয় ভ্রূণের মধ্যে। নক্ষত্রের কাছে গ্রহীয় ভ্রূণগুলি অত্যুগ্র নিমজ্জনের একটি পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে যায়, যার ফলে অল্প কয়েকটি শিলাময় গ্রহের উদ্ভব ঘটে। শেষ পর্যায়টি সম্পূর্ণ হতে সময় লাগে প্রায় ১০ কোটি থেকে একশো কোটি বছর।[2]
দানব গ্রহগুলির উৎপত্তি আরও জটিল একটি প্রক্রিয়া। মনে করা হয় যে এই ঘটনা ঘটে হিমরেখার বাইরে, যেখানে গ্রহীয় ভ্রূণগুলি প্রধানত বিভিন্ন ধরনের বরফের দ্বারা গঠিত হয়। এর ফলে এই ভ্রূণগুলি আদিগ্রহীয় চাকতির অভ্যন্তরীণ ভাগের তুলনায় বেশ কয়েক গুণ ভারী হয়। ভ্রূণ গঠনের পরে কী ঘটে তা সম্পূর্ণ স্পষ্ট নয়। কয়েকটি ভ্রূণের আকার বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে এবং পরিণামে তা ৫-১০ পার্থিব ভর অর্থাৎ ন্যূনতম মানে উপনীত হয়, যা চাকতি থেকে হাইড্রোজেন-হিলিয়াম গ্যাসের উপচয়ের সূচনার জন্য প্রয়োজনীয়।[3] অন্তঃস্থলে গ্যাসের পুঞ্জীভবন প্রথম দিকে ধীর প্রক্রিয়া হিসেবে থাকে, যা বেশ কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে চলতে থাকে। কিন্তু গঠনশীল আদিগ্রহগুলি প্রায় ৩০ পার্থিব ভরে (টেমপ্লেট:পার্থিব ভর) পৌঁছে গেলে তা ত্বরান্বিত হয় এবং একটি পলায়নী ভঙ্গিতে অগ্রসর হয়। মনে করা হয় যে, বৃহস্পতি- ও শনি-সদৃশ গ্রহগুলি মাত্র ১০,০০০ বছরের মধ্যেই তাদের ভরের প্রধান ভাগটি পূঞ্জীভূত করেছিল। গ্যাস নিঃশেষিত হয়ে গেলে উপচয় বন্ধ হয়ে যায়। গঠিত হওয়া গ্রহগুলি গঠিত হওয়ার সময় বা তার পরে দীর্ঘ পথ অভিপ্রয়াণ করতে পারে। ইউরেনাস ও নেপচুনের মতো হিম দৈত্যগুলিকে ব্যর্থ অন্তঃস্থলবিশিষ্ট গ্রহ মনে করা হয়। চাকতিটি প্রায় সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর অনেক দেরিতে এগুলি গঠিত হয়েছিল।[2]