সিন্ধু সভ্যতা
ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতা / From Wikipedia, the free encyclopedia
সিন্ধু সভ্যতা ছিল একটি ব্রোঞ্জ যুগীয় সভ্যতা (৩৩০০ – ১৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ; পূর্ণবর্ধিত কাল ২৬০০ – ১৯০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)। এই সভ্যতার কেন্দ্র ছিল মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের[1] পশ্চিমাঞ্চলে[2][3] অবস্থিত সিন্ধু নদ অববাহিকা।[n 1] এই সভ্যতা প্রস্তর যুগে বিকাশ লাভ করে (প্রাচীন যুগকেই প্রস্তর যুগ বলে)। প্রথম দিকে এই সভ্যতা পাঞ্জাব অঞ্চলের সিন্ধু অববাহিকায় বিকাশ লাভ করে। পরে তা প্রসারিত হয় ঘগ্গর-হকরা নদী উপত্যকা[7] ও গঙ্গা-যমুনা দোয়াব অঞ্চল পর্যন্ত।[8][9] বর্তমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ, ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের পশ্চিমদিকের রাজ্যগুলি, দক্ষিণ-পূর্ব আফগানিস্তান এবং বালোচিস্তান প্রদেশের পূর্ব অংশ এই সভ্যতার অন্তর্গত ।
এই নিবন্ধটির রচনা সংশোধনের প্রয়োজন হতে পারে। কারণ ব্যাকরণ, রচনাশৈলী, বানান বা বর্ণনাভঙ্গিগত সমস্যা রয়েছে। |
Alternative names | সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা, সিন্ধু সভ্যতা, হরপ্পা সভ্যতা |
---|---|
ভৌগলিক সীমা | দক্ষিণ এশিয়া |
সময় | ব্রোঞ্জ যুগ দক্ষিণ এশিয়া |
তারিখ | আনু. ৩৩০০ – আনু. ১৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ |
টাইপ সাইট | হরপ্পা |
প্রধান স্থান | হরপ্পা, মহেঞ্জোদাড়ো, লোথাল, কালিবঙ্গান, আলমগীরপুর, সুৎকাগেন্দর, বালাকোট, রাখিগড়ি, রুপার, আমির, প্রভৃতি |
পূর্বসূরী | মেহেরগড় |
উত্তরসূরী | ধূসর কুম্ভসংস্কৃতি অংকিত সমাধিক্ষেত্র এইচ সংস্কৃতি |
পূর্ণবর্ধিত সময়কালে এই সভ্যতা হরপ্পা সভ্যতা নামে পরিচিত। হরপ্পা ছিল এই সভ্যতার প্রথম আবিষ্কৃত নগরগুলির অন্যতম। ১৯২০-এর দশকে তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে এই শহরটি আবিষ্কৃত হয়।[10] ১৯২০ সাল থেকে সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নস্থলগুলিতে খননকার্য চলছে। ১৯৯৯ সালেও এই সভ্যতার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নসামগ্রী ও আবিষ্কৃত হয়েছে।[11] মহেঞ্জোদাড়ো সিন্ধু সভ্যতার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
হরপ্পা ভাষা প্রত্যক্ষভাবে প্রমাণিত হয়নি এবং এই ভাষার উৎস অজ্ঞাত। যদিও ইরাবতম মহাদেবন, অস্কো পারপোলা, এফ জি বি কুইপার ও মাইকেল উইটজেল প্রমুখ বিশেষজ্ঞেরা এই ভাষার সঙ্গে প্রোটো-দ্রাবিড়ীয়, এলামো-দ্রাবিড়ীয় বা প্যারা-মুন্ডা সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন। ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে বর্তমান সময়ে সিন্ধু সভ্যতা অন্তর্গত।
হরপ্পা সভ্যতার প্রথম দিকে আবিষ্কৃত মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা নগরটি সিন্ধু উপত্যাকা অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল। যার ওপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিকরা সিন্ধু নদীর নাম অনুযায়ী এই সংস্কৃতিকে সিন্ধু সভ্যতা নামকরণ করা হয়েছিল।
কিন্তু পরে সিন্ধু উপত্যকার বাইরে নানাস্থান থেকেও এই সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হতে থাকে। এই সভ্যতার ব্যাপক বিস্তৃতির পরিপ্রেক্ষিতে এখন আর একে সিন্ধু সভ্যতা বলা হয় না। ঐতিহাসিকরা প্রত্নতত্ত্বের একটি ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে এই সভ্যতার প্রথম আবিষ্কৃত প্রত্নক্ষেত্র হরপ্পার নাম অনুসারে এই সভ্যতাকে হরপ্পা সভ্যতা নামকরণ করেছেন। যা বর্তমান যুগের ঐতিহাসিকদের অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছে। এছাড়া ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পরে এই নামটি ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্র দ্বারা গ্রহণ করা হয়।
তবে বর্তমান যুগের এক দল ঐতিহাসিকরা নতুন এক নামকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। তারা এই সভ্যতা কে সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা বলতে বেশি আগ্রহী। তাদের মতে উত্তর-পশ্চিম ভারতে ঘাগর-হাকড়া নদীর তীরে সিন্ধু উপত্যকার তুলনায় অধিক সংখ্যক প্রত্নক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। বিভিন্ন ঐতিহাসিকরা ঘাগর-হাকড়া নদীকে ঋকবেদে উল্লেখিত সরস্বতী নদীর সঙ্গে তুলনা করেছেন। ঘাগর-হাকড়া নদীটি প্রাচীন ভারতে সরস্বতী নদী নামে বিখ্যাত ছিল । হরপ্পা সভ্যতা সরস্বতী নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল তাই বিভিন্ন ইতিহাসবিদ এই সভ্যতাকে সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা বলে উল্লেখ করেছেন।[12][13]
স্যার জন মার্শালের সময় থেকেই হরপ্পা সংস্কৃতির কাল নির্ণয়ের চেষ্টা চলছে। জন মার্শাল সিন্ধু সভ্যতা সম্বন্ধে ' 'ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন-এ' সর্বপ্রথম একটি নিবন্ধ লেখেন ২০ সেপ্টেম্বর ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ।এই বিশদ প্রবন্ধটির নাম ছিল " ফার্স্ট লাইট অন এ লং ফরগটেন সিভিলাইজেশন : নিউ ডিসকভারিজ অব অ্যান আননোন প্রি-হিস্টরিক পাস্ট ইন ইন্ডিয়া " এই প্রবন্ধটি বেরোনোর এক সপ্তাহের মধ্যে প্রত্নতত্ত্ববিদ এ.এইচ. সায়েস লক্ষ্য করেন যে হরপ্পায় প্রাপ্ত বিভিন্ন সীলমোহরগুলি মেসোপটেমিয়ার "প্রোটো-এলামাইট" সিলমোহরের মতন দেখতে । প্রোটো-এলামাইট ট্যাবলেটগুলির বয়স আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের কাছাকাছি । সায়েস, তাই প্রাসঙ্গিকভাবে লিখেছেন যে 'হরপ্পা সীলমহর ।গুলির আবিষ্কার ভারতীয় সভ্যতার যুগ এবং উৎপত্তি সম্পর্কে আমাদের ধারণাগুলিকে বদলে দিতে পারে '।[14]
পরবর্তী সময়ে প্রত্নতত্ত্ববিদ আর্নেস্ট জে.এইচ.ম্যাকে, যিনি মার্শালকে লিখেছিলেন যে সুমেরীয় সভ্যতার ,শহর-রাজ্যগুলির মধ্যে এবং কিশ-এ একটি ছোট বর্গক্ষেত্র স্টেটাইট সীলমোহরের সন্ধান পাওয়া গেছে । কিস থেকে প্রাপ্ত সীলটি জন মার্শালর (প্রত্নতত্ত্ববিদ)নিবন্ধের প্রাপ্ত চিহ্নগুলির মতো দেখতে।এই প্রমাণ গুলির মাধ্যমে এটা প্রমাণ হয়। যে হরপ্পা সভ্যতা মেসোপটেমিয়া সভ্যতার সমসাময়িক ছিল। জন মার্শাল এই প্রমাণ গুলোর উপর নির্ভর করে হরপ্পা সংস্কৃতির কাল সীমা আনুমানিক ৩২৫০ - ২৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ধার্য করেছিলেন।তবে জন মার্শাল সিন্ধু সংস্কৃতির যে কাল নির্ণয় করে ছিলেন তা বর্তমানে পরিত্যক্ত হয়েছে।[14]
সি.জে. গ্যাড, অভিমত প্রকাশ করেছেন ২৩৫০ থেকে ১৭৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হরপ্পা সংস্কৃতির বিকাশকাল। স্টুয়ার্ট পিগট ও মরটিমার হুইলার হরপ্পা সংস্কৃতির সময় ২৫০০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ধার্য করেছেন। মেসোপটেমিয়ায় পাওয়া কিছু সীলমহর , হরপ্পা প্রত্ন সামগ্রী ও ইরানের প্রভৃতি স্থানের উপাদানের উপর নির্ভর করে তারা এই সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছিলেন।[15]
আধুনিক সময়ে রেডিও কার্বন পরীক্ষা হরপ্পা সংস্কৃতির কাল নির্ণয়ের শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। প্রথম দিকে ডি.পি আগরওয়াল এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হরপ্পা অঞ্চলে ব্যাপক অনুসন্ধান কার্য পরিচালনা করেন । বর্তমান সময়ে হরপ্পা সভ্যতার বিভিন্ন প্রত্ন ক্ষেত্র থেকে পরিণত হরপ্পার ৭০ টিরও বেশি নতুন তারিক পাওয়া গেছে এই তারিখ অনুযায়ী হরপ্পা সভ্যতার পরিণত কাল ২৬০০ থেকে ১৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত ।[16]
মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা নগর উত্তর সংস্কৃতির রেডিও কার্বন পরীক্ষা লব্ধ তারিখ অষ্টাদশ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত প্রসারিত।১৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নাগাদ মহেঞ্জোদারো বিনষ্ট হয়েছিল বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মতবাদ। প্রায় একই সময় আরো কিছুকাল পর হরপ্পাও মানবহীন প্রান্তরে পরিণত হয়েছিল। লোথাল , রংপুর প্রভৃতি কেন্দ্রের নগর উত্তর হরপ্পা সংস্কৃতি অবলুপ্ত না হয়ে স্থানীয় সংস্কৃতির রূপে বিদ্যমান থাকে। হরপ্পা সভ্যতার অবলুপ্তির কাল ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিকরা মনে করেন।[15]
বিভিন্ন ইতিহাসবিদ মনে করেন কটদিজি ও আমিরের মতো কেন্দ্রে আদি সংস্কৃতির অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে আদি হরপ্পা সংস্কৃতির সূচনা হয়েছে। ঐতিহাসিক গিগরি.এল পোশেল কোটদিজি সংস্কৃতি সূচনা পর্ব ৩২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দকে নির্ণয় করেছেন। ঐতিহাসিক দিলীপকুমার চক্রবর্তী ৩৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ধার্য করেছেন।[15]
বিভিন্ন আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ঐতিহাসিক আদি , পরিণত ও উত্তর হরপ্পা সংস্কৃতির নিম্নরূপ কাল সীমা ধার্য করেছেন।
আদি হরপ্পা সংস্কৃতি :৩২০০ - ২৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। পরিণত হরপ্পা সংস্কৃতি :২৭০০ - ১৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। উত্তর হরপ্পা সংস্কৃতি :১৯০০ - ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।[17]
সিন্ধু সভ্যতা মোটামুটিভাবে প্রাচীন বিশ্বের অন্যান্য নদীমাতৃক সভ্যতার সমসাময়িক ছিল যেমন প্রাচীন মিশরীয় , মেসোপটেমিয়ান ও চৈনিক সভ্যতা । প্রায় ৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ বেলুচিস্তানে সিন্ধু উপত্যকায় সর্বপ্রথম কৃষির উদ্ভব হয়েছিল। কৃষির উদ্ভবের ফলে মানুষ যাযাবর বৃত্তি ছেড়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে, যার ফলে তাদের জনসংখ্যা দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছিলো। কৃষির অত্যধিক পরিমাণে উন্নতির কারণে সাধারণ মানুষের কাছে প্রচুর পরিমাণে উদ্বৃত্ত বেঁচে যাচ্ছিল । যার মাধ্যমে মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে আর ক্রমশ তারা একটি গ্রামীণ সংস্কৃতি থেকে একটি নগর সভ্যতায় পরিণতি লাভ করে । হরপ্পা সভ্যতার মহেঞ্জোদারো এবং হরপ্পার বৃহৎ নগর কেন্দ্র গুলিতে সম্ভবত ৩০,০০০ থেকে ৬০,০০০ ব্যক্তি বসবাস করত এবং সভ্যতার প্রাপ্ত বয়সে , উপমহাদেশের জনসংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেয়েছিল ।[15]
হরপ্পা সভ্যতার প্রধান দুটি নগর সিন্ধু অববাহিকায় আবিষ্কৃত হয়েছিল বলে এই সভ্যতা প্রথমদিকে সিন্ধু সভ্যতা নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু পরে সিন্ধু উপত্যকার বাইরে নানা স্থানে এই সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে । এই সভ্যতার ব্যাপক বিস্তৃতির পরিপ্রেক্ষিতে একে এখন আর সিন্ধু সভ্যতা বলা হয় না প্রথম আবিষ্কৃত কেন্দ্রের নাম অনুসারে একে হরপ্পা সভ্যতা বলা হয়। ভারতে উপমহাদেশ এর বিশাল এক অংশ জুড়ে বিস্তৃত হরপ্পা সভ্যতা। এই সভ্যতার বসতিগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম স্তরটিতে রয়েছে বৃহত্তম বসতিগুলি যেমন মহেঞ্জোদারো (২০০ হেক্টরের বেশি)। হরপ্পা ( ১৫০ হেক্টরের ) গানেরিওয়ালা (৮১.৬ হেক্টরের বেশি), রাখিগড়ী (৮০ হেক্টরের বেশি), এবং ধোলাভিরা (প্রায় ১০০ হেক্টর) এছাড়া চোলিস্তানের লুরেওয়ালা, যার আনুমানিক জনসংখ্যা প্রায় ৩৫,০০০ ,ঐতিহাসিকরা মনে করেন মহেঞ্জোদারোর মতোই বড় ছিল এই নগরটি । এছাড়াও অন্যান্য বড় প্রত্নক্ষেত্র ২০০ হেক্টরের মধ্যে যেমন নাগুর, থারো ওয়ারো দারো, এবং সিন্ধুর লাখুয়েঞ্জো-দারো এবং বেলুচিস্তানের ননদৌরি। সম্প্রতি, মানসা জেলার পাঞ্জাব-ধালেওয়ান (প্রায় ১৫০ হেক্টর) এবং গুরনি কালান I (১৪৪ হেক্টর), হাসানপুর II (প্রায় ১০০হেক্টর), লক্ষ্মীরওয়ালা (২৫৫হেক্টর), এবং বাগলিয়ান দা থেহ (প্রায় ১৫০ হেক্টর) সম্প্রতিক এরকম কিছু খুব বড় পত্নক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে । হরপ্পা সভ্যতার বসতিগুলির দ্বিতীয় স্তরটি হল মাঝারি আকারের ১০ থেকে ৫০ হেক্টর, যেমন জুদেরজোদারো এবং কালিবঙ্গান। তারপরে, ৫-১০ হেক্টরের আরও ছোট প্রত্নক্ষেত্র রয়েছে, যেমন আমরি, লোথাল, চানহুদারো এবং রোজদি। তৃতীয় স্তরটি হল ১-৫ হেক্টর অঞ্চলে বিস্তৃত রয়েছে এমন প্রত্নক্ষেত্রগুলি হল আল্লাহদিনো, কোট ডিজি, রূপার,বালাকোট,সুরকোটাদা,নাগেশ্বর,নওশারো এবং গাজী শাহ। এছাড়াও কিছু ছোট ছোট প্রত্ন ক্ষেত্র আমরা লক্ষ্য করতে পারি।[18] খননকার্য সম্প্রসারণ এর সঙ্গে সঙ্গে আরো যে বহু পরিণত হরপ্পা বসতির সন্ধান পাওয়া যাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গোড়ার দিকে সামান্য কয়েকটি কেন্দ্রিক এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল কিন্তু ধীরে ধীরে তার নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়ে ।
বর্তমান সময়ে হরপ্পা সভ্যতার প্রত্নক্ষেত্রের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০২২ যার মধ্যে ৪০৬টি পাকিস্তানে এবং ৬১৬টি ভারতে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ৯৭টি খনন করা হয়েছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর পরিসংখ্যান আরো বৃদ্ধি পাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই । মোটামুটি ভাবে এই সভ্যতা পশ্চিমে সুটকাগেনদর থেকে পূর্বে দিল্লির নিকটবর্তী আলমগীরপুর এবং উত্তরে জম্বুর কাছা কাছি মান্ডা দক্ষিনে গোদাবরী আবহবাহিকার দাইমাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। হরপ্পা সভ্যতার পশ্চিম পূর্বে সর্বোচ্চ বিস্তার ১৫০০ কি.মি. উত্তর দক্ষিনে এই বিস্তার ১২৫০ কি.মি.সব মিলিয়ে, এই সভ্যতার আয়তন ছিল প্রায় ৮00,000 কিমি আজকের ভারতের প্রায় এক-চতুর্থাংশ । যদি আমরা সমসাময়িক সভ্যতার সাথে তুলনা করি তাহলে প্রাচীন মিশর এর ২০ গুন এবং মেসোপটেমিয়াকে একত্রিত করে ১২ গুন বড় । প্রাচীন বিশ্বের বৃহত্তম সভ্যতা হল এই হরপ্পা সভ্যতা । এই বিশাল বিস্তৃতিটি অবশ্যই বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদান করেছিল হরপ্পা বাসীদের।[13]
কারা হরপ্পা সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিলেন সে সম্পর্কে প্রত্নতত্ত্ববিদরা নানা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। হরপ্পা লিপির পাঠোদ্ধার হলে এ সম্পর্কে হয়তো চূড়ান্ত কথা বলা যেত। সিন্ধুবাসি কারা এ নিয়ে বিভিন্ন তর্কের অবতারণা হয়েছে। নানা জীববিজ্ঞানী আমাদের নিশ্চিত ভাবে জানিয়েছেন যে আধুনিক হোমো স্যাপিয়েন্স মানুষ আফ্রিকা থেকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাদের আফ্রিকা ত্যাগের প্রধান কারণ ছিল আবহাওয়া জনিত। প্রায় ৭০,০০০ বছর আগে আফ্রিকা ত্যাগ করে হোমো স্যাপিয়েন্সর একদল আরব উপদ্বীপে পৌঁছায় এবং ধীরে ধীরে সমগ্র বিশ্বতে ছড়িয়ে পড়ে। তারা সর্বশেষ প্রায় ১৬,০০০ বছর আগে আমেরিকা মহাদেশ পৌছায়। এবং ৭০,০০০ থেকে ১৬,০০০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চলে নিজেদের উপনিবেশ তৈরি করে ।[19] এবং নৃবিজ্ঞানীবিদরা প্রায় ৬৫,০০০ বছর আগে তাদের ভারতে পৌছানোর প্রমাণ পেয়েছেন । তবে ধীরে ধীরে ভারত ভূখণ্ডে আরো বিভিন্ন নেগ্রিটো, আদি অস্ট্রালয়েড, মঙ্গোলয়েড ভূমধ্যসাগরীয় ও নর্ডিক প্রভৃতি জাতির ফলে বর্তমান সময়ের অধিকাংশ জনজাতি গুলির উদ্ভব হয়েছে।[20]
তবে একসময় মনে করা হতো মেসোপটেমিয়া ও সুমেরের লোকেরা সিন্ধু সভ্যতা সৃষ্টি করেছে। তখন হরপ্পা ও মেসোপটেমিয়া সভ্যতার আপাত সাদৃশ্য বিষয়গুলিকে বড় করে দেখা হতো। কিন্তু পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকরা মনে করেন এই সাদৃশ্য ছিল উপর উপর ও ভাসা ভাসা। এমনকি তাদের চোখে দুই সংস্কৃতির ভাস্কর্যের পরিবর্তনগুলি ধরা পড়েছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান কোনোও ঐতিহাসিক আর মেসোপটেমিওদের সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা বলে মনে করেন না।[21]
ফাদার হেরাস, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সুমিত কুমার চট্টোপাধ্যায়, এ এল ব্যাসম প্রমুখ দেশি-বিদেশি অনেক পন্ডিতেরা ধারণা দ্রাবিড়রা সিন্ধু সভ্যতা সৃষ্টি করেছিলেন। তারা মনে করেন, সিন্ধু সভ্যতার সংস্কৃতি বৈদিক সভ্যতার থেকে একেবারে আলাদা। তারা প্রমাণের স্বপক্ষে বলে থাকেন, বৈদিক আর্যরা লোহার ও ঘোড়ার ব্যবহার জানতেন কিন্তু সিন্ধু বাসীরা এ বিষয়ে অজ্ঞ ছিলেন। এরূপ নানা যুক্তির সাহায্যে পন্ডিতরা প্রমাণ করতে চেয়েছেন হরপ্পা ও বৈদিক সংস্কৃতির চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা যারা বৈদিক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিলেন এই আর্যরা নিশ্চয়ই হরপ্পা সভ্যতা সৃষ্টি করেননি, আর্যদের বাদ দিলে প্রাগৈতিহাসিক যুগে ভারতে মুন্ডা ও দ্রাবিড় জাতি প্রধান ছিল। এবং পন্ডিতরা বলেন সুদূর অতীতে দ্রাবিড় ভাসিরা উত্তর ভারতে এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিলেন এবং পরে প্রতিপক্ষের তারা খেয়ে এই জাতি দক্ষিণ ভারতে চলে যায়। আজও দ্রাবিড়ভাসি ব্রাহিরা বাস করেন দক্ষিণ বেলুচিস্তানে।[15] তবে, ঐতিহাসিক টনি জোসেফ তার ২০২০ সালের আর্লি ইন্ডিয়া বইতে প্রত্নতাত্ত্বিক, জেনেটিক্স , ভাষাভিত্তিক বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে এই তত্ত্বটিকে প্রমাণ করেন । তিনি প্রাপ্তবয়স্ক হরপ্পা যুগ থেকে উদ্ধার হওয়া প্রাচীন ডিএনএর উপর ভিত্তি করে ভারতীয়দের একটি মিশ্র জনসংখ্যা ছিল বলে মনে করেন এবং ইরানের জাগ্রোস পর্বত অঞ্চলের কিছু কৃষক প্রায় দশ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ সিন্ধু উপত্যকার অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করেছিল এবং ভারতীয় ও ইরানিয়দের মিশ্রিত এই জনজাতি সিন্ধু সভ্যতার সৃষ্টি করেছিল। এছাড়া রবার্ট ক্যাল্ডওয়েলও ইরানীয় ভাষা এলামাইট সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের তামিল ভাষার মিল খুঁজে পান।[22]
একদল পন্ডিত মনে করেন দ্রাবিড়রা নন আর্যরাই হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টাা এ ডি পুসলকর , বি বি লাল, এস পি গুপ্তা, এস আর রাও , এদের মত যেমন দেশি পন্ডিত আছেন তেমনি অলচিনদের মতো বিদেশী ঐতিহাসিক আছেন। এদের সকলের নিজের নিজের অভিমত আছে তবে এরা সকলেই বিশ্বাস করেন যে হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টারা হলেন আর্য। আর্যরা সিন্ধু সভ্যতার সৃষ্টি করেছেন এই মতের সমর্থনে বেশ কয়েকটি যুক্তি প্রদর্শিত হয়েছে যেমন-বৈদিক সাহিত্যকে যত অর্বাচীন ভাবা হয় বৈদিক সাহিত্য তা নয়। যে বৈশিষ্ট্য গুলিকে খাঁটি হরপ্পিও বলে দাবি করা হয়েছে সেগুলি সব বৈদিক সাহিত্যে বর্তমান। তাদের মতে , সিন্ধুবাসীরা ঘোড়া ব্যবহার করতেন না এ ধারণার ঠিক নয়, আনুমানিক ৪৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকেই যে ভারতে ঘোড়ার ব্যবহার শুরু হয়েছে । খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম সহস্রাবদের মাঝামাঝি সময়ের সুরকোটডাই ঘোড়ার অস্থি পাওয়া গেছে। সিন্ধু উপত্যকায় বিভিন্ন স্থান থেকে পোড়ামাটির ঘোড়ার টেরাকোটা আবিষ্কৃত হয়েছে বলে এই ধরনের ঐতিহাসিকদের মত ।[15] তবে বসন্ত সিন্ধে পুনের ডেকান কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল এবং 2012 থেকে 2016 রাখিগড়ী খননের সময় কবরখানা থেকে 40টি কঙ্কাল সংগ্রহ করেছিলেন এবং কঙ্কাল গুলির গবেষণার ভিত্তিতে তিনি এখনো পর্যন্ত জানিয়েছেন যে রাখিগর্হিতে স্থানীয় মানুষেরাই সামান্য বসতি থেকে ক্রমে নগরে গড়ে তুলেছিল এবং অনেক বর্তমান সংস্কৃতি প্রাচীন রূপ সেই সময়ের মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন। যেমন হাতজোড় করে নমস্কার ,মাথায় সিঁদুর, যোগী মূর্তি ইত্যাদি।[23]
চার্লস ম্যাসন তার ন্যারেটিভ অফ ভ্যারিয়াস জার্নিস ইন বালোচিস্তান, আফগানিস্তান অ্যান্ড দ্য পাঞ্জাব গ্রন্থে হরপ্পার ধ্বংসাবশেষের কথা প্রথম উল্লেখ করেন। স্থানীয় অধিবাসীরা তাকে "তেরো ক্রোশ" দূরে একটি প্রাচীন নগরীর উপস্থিতির কথা বলেছিল। কিন্তু প্রায় শতাব্দীকাল এই বিষয়ে কেউ কোনো প্রকার প্রত্নতাত্ত্বিক আগ্রহ দেখাননি।[24]
১৮৫৬ সালে ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার জন ও উইলিয়াম ব্রান্টন করাচি ও লাহোরের মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানি লাইন স্থাপনের দায়িত্ব পান। জন লিখেছেন: "রেললাইন স্থাপনের জন্য উপযুক্ত ব্যালাস্ট কোথা থেকে পাওয়া যায়, সেই ভেবে আমি খুবই চিন্তিত ছিলাম।" তাদের বলা হয় যে, লাইনের নিকট ব্রাহ্মণাবাদ নামে এক প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। সেই শহরে এসে তারা শক্ত ও ভালভাবে পোড়ানো ইঁটের সন্ধান পান এবং নিশ্চিত এই ভেবে যে "ব্যালাস্টের একটি উপযুক্ত উৎস পাওয়া গেছে।" ব্রাহ্মণাবাদ শহর এই ভাবে ব্যালাস্টে পরিণত হয়।[25] কয়েক মাস পরে, আরও উত্তরে জনের ভাই উইলিয়াম ব্রান্টনের কর্মস্থলে "লাইনের অংশে অপর একটি শহরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। এই ধ্বংসাবশেষের ইঁট নিকটবর্তী হরপ্পা গ্রামের অধিবাসীরাও ব্যবহার করত। এই ইঁটেরই ব্যালাস্টে তৈরি হয় লাহোর থেকে করাচি পর্যন্ত ৯৩ মাইল (১৫০ কিলোমিটার) দৈর্ঘ্যের রেলপথ।"[25]
১৮৭২-৭৫ সালে আলেকজান্ডার কানিংহাম প্রথম হড়প্পা সিলমোহর প্রকাশ করেন। তিনি ভুলবশত এটি ব্রাহ্মী লিপি মনে করেছিলেন।[26] এর প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে ১৯১২ সালে জে. ফ্লিট আরও কতকগুলি হরপ্পা সিলমোহর আবিষ্কার করেন। এই সিলমোহর দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯২১-২২ সালে স্যার জন মার্শাল এই অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য অভিযান চালান। এই অভিযানের ফলশ্রুতিতেই স্যার জন মার্শাল, রায়বাহাদুর দয়ারাম সাহানি ও মাধোস্বরূপ ভাট হরপ্পা এবং রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ই. জে. এইচ. ম্যাককি ও স্যার জন মার্শাল মহেঞ্জোদাড়ো আবিষ্কার করেন। ১৯৩১ সালের মধ্যেই মহেঞ্জোদাড়োর অধিকাংশ প্রত্নস্থল আবিষ্কৃত হয়ে গিয়েছিল। তৎসত্ত্বেও খননকার্য অব্যাহত থাকে। এরপর ১৯৪৪ সালে ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের তদনীন্তন ডিরেক্টর স্যার মর্টিমার হুইলারের নেতৃত্বে অপর একটি দল এই অঞ্চলে খননকার্য চালায়। ১৯৪৭ সালের পূর্বে আহমদ হাসান দানি, ব্রিজবাসী লাল, ননীগোপাল মজুমদার, স্যার মার্ক অরেল স্টেইন প্রমুখ এই অঞ্চলে খননকার্যে অংশ নিয়েছিলেন।
ভারত বিভাগের পর সিন্ধু সভ্যতার অধিকাংশ প্রত্নস্থল পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্গত হয়। উল্লেখ্য, পাকিস্তান ভূখণ্ডই ছিল এই প্রাচীন সভ্যতার মূল কেন্দ্র। ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান সরকারের পুরাতাত্ত্বিক উপদেষ্টা স্যার মর্টিমার হুইলার এই সব অঞ্চলে খননকার্য চালান। সিন্ধু সভ্যতার সীমান্তবর্তী প্রত্নস্থলগুলি আবিষ্কৃত হয়েছে পশ্চিমে বালোচিস্তানের সুকতাগান ডোর এবং উত্তরে আফগানিস্তানের আমুদারিয়া বা অক্সাস নদীর তীরে শোর্তুগাই অঞ্চলে।
সম্প্রতি সিন্ধু সভ্যতার সময়কালের একটি বিশাল সমাধিস্থল ভারতে আবিষ্কৃত হয়েছে। ভারতের রাজ্য গুজরাটে পাকিস্তান সীমান্ত থেকে অল্প দূরে কচ্ছ অঞ্চলের একটি প্রত্যন্ত গ্রামের কাছে বালি আর মাটির স্তূপ খনন শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালে। সিন্ধু-সভ্যতার অন্তত পাঁচশোটি কবরের অস্তিত্ব রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় দুশোটি কবর খনন করা হয়েছে। ধারনা করা হচ্ছে খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ থেকে ২৬০০ পর্যন্ত প্রায় পাঁচশো বছর ধরে ব্যবহৃত হয়েছিল এই সমাধিস্থল[27]
মেহরগড় হল পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের একটি নব্য প্রস্তর যুগের প্রত্নক্ষেত্র যার সময় কাল প্রায় আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দ পর্যন্ত।[28] উৎখলনের ফলে মেহেরগড়ের নব্যপ্রস্তর যুগেও পর্বের তিনটি পর্যায়ে সন্ধান পাওয়া গেছে যা সিন্ধু সভ্যতার উত্থানের নতুন তথ্য সরবরাহ করে থাকে ।[29] অনেকে আবার এই সংস্কৃতির মধ্যে পূর্ব এশিয়ার সংস্কৃতির সামঞ্জসতা খুঁজে পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন।[30][31] দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম দিককার কৃষিকাজ ও পশুপালনের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে এই স্থানে । এছাড়া "গৃহপালিত গমের চাষ, চাষের প্রাথমিক পর্যায়, মৃৎশিল্প, অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, কিছু গৃহপালিত উদ্ভিদ এবং পশুপালন "প্রভৃতি কারণে মেহেরগড় ঐতিহাসিক মহলে বিখ্যাত হয়ে আছে। [32]
মেহেরগড়ের একটি স্বাধীন উৎপত্তির পক্ষে যুক্তি দেন জাঁ-ফ্রাঁসোয়া জ্যারিজ। জ্যারিজ উল্লেখ করেন, "বিভিন্ন ঐতিহাসিকরা যে অনুমান করে থাকেন যে কৃষি অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে নিকট-পূর্ব থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবর্তিত হয়েছিল এবং পূর্ব মেসোপটেমিয়া এবং পশ্চিম সিন্ধু উপত্যকার নব্য প্রস্তর যুগীয় প্রত্নক্ষেত্র গুলির মধ্যে সামঞ্জস্য রয়েছে যা তারা "সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা" বলে উল্লেখ করেছেন।[33] আবার বেশ কিছু ঐতিহাসিক যেমন ই জে এইচ ম্যাকে, ডি. এইচ গার্ডন, প্রভৃতি ঐতিহাসিকরা এই তথ্যের ভিত্তিতে সিন্ধু সভ্যতাকে মেসোপটেমিয়ান সংস্কৃতির অংশ হিসেবে তুলে ধরেন ।[17] কিন্তু মেহেরগড়ের প্রত্নতাত্ত্বিক তত্ত্বের ভিত্তিতে , জ্যারিজ উপসংহারে পৌঁছেছেন যে মেহেরগড় সংস্কৃতিটি স্বাধীনভাবে গড়ে উঠেছিল এবং এখানে কৃষিকাজ ও পশুপালন একান্ত নিজস্ব পদ্ধতিতে গড়ে উঠেছিল এবং এটি "প্রাচ্যের নব্যপ্রস্তর সংস্কৃতির 'ব্যাকওয়াটার' নয়"।[33]
অবশ্য ,গ্যালেগো রোমেরো অন্যান্য ঐতিহাসিকরা (২০১১) ভারতের ল্যাকটোজ সহনশীলতার উপর তাদের গবেষণা চালিয়ে পরামর্শ দেন যে "রিখ এট আল (2009) দ্বারা চিহ্নিত পশ্চিম ইউরেশীয় জেনেটিক অবদান প্রধানত ইরান এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে জিন প্রবাহকে প্রতিফলিত করে।"[34]তারা আরও উল্লেখ করেন যে দক্ষিণ এশিয়ায় গবাদি পশু পালনের প্রাচীনতম প্রমাণ মেহেরগড়ের সিন্ধু নদ উপত্যকা থেকে পাওয়া গেছে ।[35][34]
বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মতে নব্য প্রস্তর যুগে মানুষের জীবনযাত্রা প্রায় পুরোটাই পাল্টে গিয়েছিল। মানুষ ক্রোমশই সভ্য হয়ে উঠেছিল মানুষের এই ব্যাপক অগ্রগতির বর্ণনা করতে গিয়ে গার্ডন চাইল তার ম্যান মেকস হিমসেলফ গ্রন্থে নব্য প্রস্তর যুগকে বিপ্লব বলে আখ্যায়িত করেছে[36]। এই যুগের প্রথম বৈপ্লবিক পরিবর্তন ছিল খাদ্য উৎপাদন। মানুষ এই পর্যায়ে খাদ্য সংগ্রহ পর্ব থেকে খাদ্য উৎপাদক পর্বে উত্তীর্ণ হয়। অবশ্য খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ অব্দ নাগাদ মেহেরগড়ের প্রথম পর্যায়ে কিছু কৃষি জাতীয় যব ও বুনো যব একত্রে পাওয়া গেছে এ থেকে মনে হয় সম্ভবত মেহেরগড়ে প্রথম জবের চাষ শুরু হয়।[37]ছিল। এছাড়া মেহেরগড়ে কিছু তৈল বীজ ও কার্পাসে নিদর্শন পাওয়া গেছে। এ যুগের অর্থনীতির আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পশুপালনের সূচনা। এছাড়া বৈপ্লব পরিবর্তন ঘটেছিল শিল্পক্ষেত্র। এ যুগে কুমোরেরা চাকার আবিষ্কার করেছিল। সিন্ধু সভ্যতার সূচানার প্রথম পর্যায়ে হিসেবে মেহেরগড় কে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এবং মেহেরগরের এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন তৈরি করেছিল সিন্ধু সভ্যতার রঙ্গমঞ্চ।[38]
মেহেরগড় সভ্যতা আবিষ্কারের আগেই, প্রত্নতত্ত্ববিদ অমলেন্দো ঘোষ ১৯৬৫ সালে প্রাক হরপ্পান সংস্কৃতি এবং রাজস্থানের সোথি সংস্কৃতির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন এবং পরিণত হরপ্পা সংস্কৃতি ও পূর্ববর্তী হরপ্পা সংস্কৃতির মধ্যে মিল সনাক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকা এবং উত্তর বেলুচিস্তানের প্রাক হরপ্পা প্রত্নক্ষেত্রগুলির প্রমাণ প্রথম ব্যাপক বিশ্লেষণ করেন বিখ্যাত পাকিস্তানি ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদ মিঃ মুঘল। তার অনুমান, নিম্ন সিন্ধু ও গঙ্গা যমুনা-দয়াব অঞ্চলের চতুর্থ সহস্রাবদের পূর্বের পর একটু একটু করে স্থায়ী বসতে তৈরি হয়েছিল।[21] বর্তমান সময়ের ঐতিহাসিক মহল প্রারম্ভিক হরপ্পা সংস্কৃতিকে রভি পর্ব হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে , নিকটবর্তী রভি নদীর নামে এই সংস্কৃতির নামকরণ করা হয়েছিল, যার সময় কাল প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৪০০ অব্দ। এটি শুরু হয়েছিল যখন পাহাড়ি উপত্যকা থেকে কৃষকরা ধীরে ধীরে নিম্নভূমির নদী উপত্যকাই স্থানান্তরিত হয়েছিল,[39] এই সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃতি হল কোটদিজি ,সিন্ধুতে আমির, পশ্চিম সিন্ধু সমভূমিতে দেরা জাট, পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের উত্তর অংশের সরাই খোলা এবং হাকড়া সংস্কৃতিটি পশ্চিমে ঘগর-হাকড়া নদী উপত্যকায় গড়ে উঠেছিল। [40][41]
বিখ্যাত ঐতিহাসিক কেনোয়ার হরপ্পা ক্ষেত্রের দীর্ঘদিনের গবেষণার পর আমাদের জানিয়েছেন যে কোটদিজি দশায় মৃৎশিল্পে কিছু চিহ্নের ব্যবহার হচ্ছে যা এর পরের পর্বে পরিপূর্ণতা লাভ করবে, যা ধীরে ধীরে গড়ে উঠবে সিন্ধু লিপিতে। এ পর্যায়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সিলমহর গুলি ব্যবহারের দাম সাদাত , কোটদিজি সংস্কৃতি সাক্ষ্য বহন করছে। প্রাথমিক দিকে সিলমহর-এ লিপি বা লেখা কিছু থাকত না , থাকতো নানা জ্যামিতিক নকশা। পরবর্তী পর্যায়ে এই ধরনের সিলমহর-এর ব্যবহার অনেক বৃদ্ধি পায় এবং হরপ্পা,মহেঞ্জোদারো , রাখীগড়ী ,লোথাল ,কালিবঙ্গান সহ বহুস্থানে তার ব্যবহার আমরা লক্ষ্য করতে পারি।[42]
সিন্ধু সভ্যতার পরিণত পর্যায়ে আগের পর্বগুলো নির্দেশ করে পাকিস্তানের কিছু অঞ্চল যেমন রেহমান ধেরি এবং আমরি প্রভৃতি।[38]আবার কোটদিজি পর্বে পরবর্তী পরিণত হরপ্পার কিছু বৈশিষ্ট্য ঐতিহাসিকরা খুঁজে পেয়েছে। যেমন দুর্গ কেন্দ্রীভূত কর্তৃত্ব এবং ক্রমবর্ধমান শহুরে জীবনযাত্রা। এই পর্যায়ের আরেকটি শহর হাকরা নদীর তীরে ভারতের কালিবঙ্গানে পাওয়া গেছে। আবার একদল ঐতিহাসিক হরপ্পা সভ্যতার পূর্ববর্তী পর্যায়ের অধিকাংশ প্রত্নক্ষেতর গুলি ঘগর হাকরা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে পাওয়া যাওয়ায় এই সভ্যতাকে সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা বলে উল্লেখ করেছেন।[43]
সেই সময় থেকে জীবিকা নির্বহর সিন্ধু সভ্যতা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। খেজুর ও আঙ্গুরের চাষ হচ্ছে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভেড়া, ছাগল ও দু ধরনের গবাদি পশু। কালিবঙ্গানে প্রাচীন লাঙ্গল চাষের উপরিভাগ সযত্নে রক্ষিত আছে। এছাড়া প্রাচীন কালে কালিবাঙ্গানের এবং সোথি ও সিসিওয়াল সংস্কৃতিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে তামা ব্যবহারের নির্দেশন মেলে। এই সময়কার দেওয়াল গুলো মহেঞ্জোদারো মত পুরু ছিল না।[44]
হস্তশিল্পের দিক দিয়ে নাগরিক যুগ পর্বের আগে কেবলমাত্র মেহেরগড় মতো বসতি এলাকায় তামা , ব্রোঞ্জ অল্পমাত্রায় ব্যবহারিত হয়েছে। অবশ্য, পূর্ববর্তী পর্যায়গুলিতে ধাতু, বালা, গহনা, হাতির দাঁতের বিভিন্ন অলংকার প্রভৃতি ব্যবহার হতো বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এছাড়া এই পর্যায়েতেই শিলখড়ির ব্যবহার চালু হয়ে গিয়েছিল।[15]
প্রারম্ভিক হরপ্পা যুগের চূড়ান্ত পর্যায়গুলি কিছু বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে থাকে যেমন বড় প্রাচীরযুক্ত বসতি , বাণিজ্য নেটওয়ার্কের বিস্তৃতি এবং মৃৎশিল্পের শৈলী, অলঙ্কার এবং সিলমোহরর ভিত্তিতে ঐতিহাসিকরা আঞ্চলিক সম্প্রদায়গুলির একটি "আপেক্ষিকভাবে অভিন্ন" বলে বস্তুগত সংস্কৃতি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই বৈশিষ্ট্য গুলির মাধ্যমে বিভিন্ন প্রত্নতত্ত্ববিদরা প্রাথমিক সিন্ধু সংস্কৃতিগুলোকে চিহ্নিত করে থাকেন।তবে, জটিল সিন্ধু লিপির ব্যবহার পরিণত হরপ্পা সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য বলে মনে করেন।[45]