স্পেন
আফ্রিকার অঞ্চল সহ দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের দেশ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
স্পেন (স্পেনীয়: España আ-ধ্ব-ব: [esˈpaɲa] ( এস্পাঞা) বা স্পেন রাজ্য ( )স্পেনীয়: Reino de España) ইউরোপ মহাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত একটি রাষ্ট্র। শাসনব্যবস্থার ধরন অনুযায়ী দেশটি একটি সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজতন্ত্র। এটি ইবেরীয় উপদ্বীপের প্রায় ৮৫% অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত। উপদ্বীপটির অবশিষ্ট অংশে স্পেনের ক্ষুদ্রতর প্রতিবেশী রাষ্ট্র পর্তুগাল এবং ব্রিটিশ প্রশাসনিক অঞ্চল জিব্রাল্টার অবস্থিত। স্পেনের আয়তন ৫,০৫,৯৯০ কিমি২ (১,৯৫,৩৬০ মা২); আয়তনের বিচারে রাশিয়া, ইউক্রেন ও ফ্রান্সের পরে স্পেন ইউরোপের ৪র্থ বৃহত্তম এবং দক্ষিণ ইউরোপের বৃহত্তম দেশ। মাদ্রিদ স্পেনের বৃহত্তম নগর ও রাজধানী। বার্সেলোনা, বালেন্সিয়া, সেবিইয়া, বিলবাও এবং মালাগা অন্যান্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর।
স্পেন রাজ্য | |
---|---|
রাজধানী ও বৃহত্তম নগরী বা বসতি | মাদ্রিদ ৪০°২৬′ উত্তর ৩°৪২′ পশ্চিম |
সরকারী ভাষা এবং জাতীয় ভাষা | স্পেনীয়[lower-alpha 3] |
সহ-সরকারী ভাষাসমূহ কিছু স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলে | কাতালান গালিসীয় বাস্ক অক্সিতঁ |
নৃগোষ্ঠী (২০১৫) |
|
ধর্ম (২০১৭[4]) |
|
জাতীয়তাসূচক বিশেষণ | স্পেনীয় |
সরকার | ঐকিক সংসদীয় সাংবিধানিক রাজতন্ত্র |
• রাজা | ৬ষ্ঠ ফেলিপে |
• প্রধানমন্ত্রী | মারিয়ানো রাহোয় |
• উপ-প্রধানমন্ত্রী | সোরায়া সাএন্জ দে সান্তামারিয়া |
• সিনেটের সভাপতি | পিও গার্সিয়া-এসকুদেরো |
• সংসদের নিম্নকক্ষের সভাপতি | আনা পাস্তর হুলিয়ান |
• সর্বোচ্চ আদালতের সভাপতি | কার্লোস লেসমেস সের্রানো |
আইন-সভা | কোর্তেস হেনেরালেস |
• উচ্চকক্ষ | সংসদের উচ্চকক্ষ বা সিনেট |
• নিম্নকক্ষ | সংসদের নিম্নকক্ষ বা কংগ্রেস |
গঠন | |
ইতিহাস | |
• ইউনিয়ন অফ ক্যাস্টাইল আরাগণ সম্রাজ্য | ১৯শে অক্টোবর ১৪৬৯ |
• হলি রোমান সাম্রাজ্য এর অন্তর্ভুক্ত হয় | ৪ আগস্ট ১৪৯৬ |
• হলি রোমান সম্রাজ্য হতে স্বাধীনতা | ১লা নভেম্বর ১৭০০ |
• প্রতিষ্ঠা | ১লা নভেম্বর ১৭০০ |
• ক্যাথলিক | ১৯শে অক্টোবর ১৪৬৯ |
• স্প্যানিশ রাজতন্ত্র | ১ নভেম্বর ১৭০০-১১ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৩, ২৮অক্টোবর ১৯৮০- |
• স্প্যানিশ প্রজাতন্ত্র | ১১ফেব্রুয়ারি ১৮৭৩-২৮অক্টোবর১৯৮০ |
• প্রথম সংবিধান | ১৯ মার্চ ১৮১২ |
১লা জানুয়ারি ১৯৮৬ | |
আয়তন | |
• মোট | ৫,০৫,৯৯০[5] কিমি২ (১,৯৫,৩৬০ মা২) (৫১তম) |
• পানি (%) | ১.০৪ |
জনসংখ্যা | |
• ২০১৬ আদমশুমারি | ৪,৬৩,৫৪,৩২১ [lower-alpha 5] (৩০তম) |
• ঘনত্ব | ৯২/কিমি২ (২৩৮.৩/বর্গমাইল) (১১২তম) |
জিডিপি (পিপিপি) | ২০১৭ আনুমানিক |
• মোট | ১ লক্ষ ৭৬৯ হাজার কোটি মার্কিন ডলার[7] (১৬তম) |
• মাথাপিছু | ৩৮,১৭১ মার্কিন ডলার[7] (৩১তম) |
জিডিপি (মনোনীত) | ২০১৭ আনুমানিক |
• মোট | ১ লক্ষ ৩০৭ হাজার কোটি মার্কিন ডলার[7] (১২তম) |
• মাথাপিছু | ২৮,২১২ মার্কিন ডলার[7] (৩০তম) |
জিনি (২০১৬) | ৩৪.৫[8] মাধ্যম |
মানব উন্নয়ন সূচক (২০১৫) | ০.৮৮৪[9] অতি উচ্চ · ২৭তম |
মুদ্রা | ইউরো[lower-alpha 6] (€) (EUR) |
সময় অঞ্চল | কেইউস (CET) (সাসস (ইউটিসি) + ১) পইউস (WET) (সাসস) |
ইউটিসি+১ (কেইউগ্রীস (CEST) (সাসস (ইউটিসি) + ২) পইউগ্রীস (WEST)) | |
Note: স্পেন কেইউস/কেইউগ্রীস (CET/CEST) মেনে চলে; তবে কানারিয়াস দ্বীপপুঞ্জ ব্যতিক্রমীভাবে পইউস/পইউগ্রীস (WET/WEST) মেনে চলে। | |
তারিখ বিন্যাস | দিদি/মামা/বববব (সাযু (CE) |
গাড়ী চালনার দিক | ডানদিকে |
কলিং কোড | +৩৪ |
আইএসও ৩১৬৬ কোড | ES |
ইন্টারনেট টিএলডি | .es[lower-alpha 7] |
স্পেনের উত্তর সীমানাতে আটলান্টিক মহাসাগরের একটি বাহু বিস্কায়া উপসাগর অবস্থিত। উত্তর-পূর্ব সীমানায় পিরিনীয় পর্বতমালা স্পেনের সাথে ফ্রান্স এবং অতিক্ষুদ্র রাষ্ট্র অ্যান্ডোরার একটি প্রাকৃতিক সীমানা গঠন করেছে। পূর্ব দিকে ভূমধ্যসাগর, দক্ষিণে ভূমধ্যসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগর এবং পশ্চিমে পর্তুগাল ও আটলান্টিক মহাসাগর স্পেনের অবশিষ্ট সীমানা নির্ধারণ করেছে। স্পেনের সর্বদক্ষিণ বিন্দুটি মরক্কোর দিকে মুখ করে অবস্থিত এবং দেশ দুইটি সরু জিব্রাল্টার প্রণালী দ্বারা একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন; স্পেন তাই ইউরোপের সাথে আফ্রিকার সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। এছাড়া আটলান্টিক মহাসাগরের লাস কানারিয়াস দ্বীপপুঞ্জ এবং ভূমধ্যসাগরের বালেয়ারীয় দ্বীপপুঞ্জগুলিও স্পেনের শাসনাধীন। এছাড়া মরক্কোতে সেউতা এবং মেলিইয়া নামের দুইটি ছিটমহল স্পেন পরিচালনা করে। উত্তর আফ্রিকার উপকূলের কাছে অবস্থিত পেনিয়ন দে বেলেস দে লা গোমেরা নামক দ্বীপ, আলহুসেমাস ও চাফারিনাস দ্বীপপুঞ্জগুলিও স্পেনের অধিকারে পড়েছে। ব্রিটিশদের অধীনে অবস্থিত জিব্রাল্টার স্পেনের মূল ভূখণ্ডের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তসীমায় অবস্থিত।
স্পেনের প্রাণকেন্দ্রে সমুদ্র সমতল থেকে অর্ধমাইল উচ্চতায় অবস্থিত মেসেতা (Meseta) নামক একটি প্রশস্ত কেন্দ্রীয় মালভূমি দেশটির অধিকাংশ আয়তন জুড়ে অবস্থিত। এই অঞ্চলের অধিকাংশ ভূমিতে গবাদি পশুপালন ও শস্য উৎপাদনের ঐতিহ্য রয়েছে। মিগেল দে সের্ভান্তেসের দোন কিহোতে (Don Quixote) গ্রন্থে বর্ণিত সুউচ্চ বায়ুর কলগুলি এখনও এই গ্রামীণ অঞ্চলের বহু স্থানে ছড়িয়ে ছটিয়ে আছে। মেসেতা মালভূমির ভেতরে এবং এর চারপাশ ঘিরে অনেক পাহাড়-পর্বত রয়েছে, যাদেরকে স্থানীয় ভাষায় সিয়ের্রা (Sierra) নামে ডাকা হয়। সুইজারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়ার পরে স্পেন ইউরোপের সর্বাধিক পর্বতসংকুল দেশ। মেসেতা মালভূমিটির কেন্দ্রে মাদ্রিদ নগরী অবস্থিত। মাদ্রিদ ইউরোপ মহাদেশে সমুদ্র সমতল থেকে সর্বাধিক উচ্চতায় অবস্থিত রাজধানী নগর। মেসেতা মালভূমিটির জলবায়ু রূঢ় এবং শুষ্ক। তাই স্পেনের অধিকাংশ জনগণ সমুদ্র-উপকূল অঞ্চলে কিংবা প্রধান কিছু নদীর অববাহিকাতে বসবাস করে। দেশের উত্তর-পূর্ব অংশে রয়েছে এব্রো নদীর প্রশস্ত উপত্যকা, কাতালুনিয়ার পার্বত্য অঞ্চল এবং বালেন্সিয়া নামক পাহাড়ি উপকূলীয় সমভূমি অঞ্চল। উত্তর-পশ্চিমে আছে গালিসিয়া নামক অঞ্চল ও তার রুক্ষ কান্তাব্রীয় পর্বতমালা, যেখানে বৃষ্টিস্নাত শ্যামল নিবিড় অরণ্যাবৃত উপত্যকাগুলির মাঝে মাঝে সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। স্পেনের দক্ষিণে আছে ফেদেরিকো গার্সিয়া লোর্কা ও আন্তোনিও মাচাদো তাদের কবিতায় যে নদীর গুণকীর্তন করে গেছেন, সেই গুয়াদালকিভির নদীর উপত্যকার কমলালেবু-জাতীয় ফলের উদ্যানে পরিপূর্ণ ভূমিগুলি। এই উপত্যকা থেকেই উত্থিত হয়েছে হিমাবৃত সিয়ের্রা নেবাদা পর্বতমালা। স্পেনের দক্ষিণ প্রান্তটি মরুময়; আলমেইরা নামের এই মরুভূমিটি আফ্রিকার সাহারা মরুভূমিরই একটি প্রসারিত অংশ রূপে গণ্য করা হয়। স্পেনের দক্ষিণ-পূর্বের ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল অঞ্চলটিতে পামবৃক্ষের সারি, সুগন্ধী রোজমেরির ঝাড় ও অন্যান্য ক্রান্তীয় উদ্ভিদের দেখা মেলে। মৃদু জলবায়ুর সুবাদে বালেয়ারীয় দ্বীপপুঞ্জ ও এই অঞ্চলটিতে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক ও অবসরপ্রাপ্ত (বিশেষত উত্তর ইউরোপ থেকে) মানুষ বেড়াতে আসে।
স্পেনের প্রস্তরনির্মিত দুর্গপ্রাসাদ, হিমাবৃত পর্বতমালা, বিশালাকার সৌধ এবং আধুনিক ও পরিশীলিত নগরগুলির গল্প মুখে মুখে ফেরে। দেশটি তাই পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় গন্তব্যস্থল। স্পেন ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ একটি দেশ। স্পেনের গ্রামাঞ্চল আকর্ষণীয় সব দুর্গবেষ্টিত প্রাসাদ, প্রাচীন জল সংগ্রহের নালা এবং প্রাচীন ধ্বংসাবশেষে পরিপূর্ণ, কিন্তু নগরগুলি সন্দেহাতীতভাবে আধুনিক। আন্দালুসিয়া অঞ্চলের রাজধানী সেবিইয়া তার সঙ্গীতের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যবাহী জীবনযাপনের জন্য বিখ্যাত। কাতালুনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনা তার ধর্মনিরপেক্ষ স্থাপত্য এবং নৌপরিবহন শিল্পের জন্য সুবিদিত। আর জাতীয় রাজধানী মাদ্রিদের আঁকাবাঁকা সরু পথ, জাদুঘর, গ্রন্থাগার এবং দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা ধরে সক্রিয় জীবনধারার কথাও সবার জানা। মাদ্রিদ স্পেনের বৃহত্তম শহর এবং বহু শতাব্দী ধরে দেশটির আর্থিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
স্পেন,পর্তুগাল ব্যতীত ইউরোপের অন্য সমস্ত দেশ থেকে পিরিনীয় পর্বতমালার মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন, ফলে দেশটির ইতিহাসও ঐসব দেশের তুলনায় অনেক ভিন্ন। প্রাচীনকালে ফিনিসীয়, কার্থেজীয় ও সবশেষে রোমানরা অঞ্চলটি দখল করেছিল। ৫ম শতকে উত্তর ইউরোপ থেকে আগত ভিজিগথ জাতির লোকেরা দেশটিকে শাসন করা শুরু করে। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক সাংগঠনিক দুর্বলতার সুযোগে ৮ম শতকে উত্তর আফ্রিকা থেকে আগত আরবভাষী মুসলিম আরব ও উত্তর বার্বার জাতি কেরা ইবেরীয় উপদ্বীপের অধিকাংশ দখলে নিয়ে নিতে সক্ষম হয়। মধ্যযুগের প্রায় পুরোটা জুড়েই মুসলিমরা স্পেনের মূল শাসক ছিল; তাদের রাজ্যের নাম ছিল আল আন্দালুস। ৯ম ও ১০ম দশকে শিক্ষা, গণিত, ভূগোল, স্থাপত্য, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও কাব্যচর্চায় কর্দোবা ছিল গোটা ইউরোপের শীর্ষস্থানীয় শহর। ১৫শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এসে উত্তর স্পেনের খ্রিস্টান রাজ্যগুলি একত্র হয়ে মুসলিম আরব আফ্রিকান কাছ থেকে হৃত ইবেরীয় উপদ্বীপ ফেরত নেবার জন্য যুদ্ধ করে এবং ১৪৯২ সালে স্পেন থেকে শেষ মুসলিম আফ্রিকান গোত্রীয় শাসনকর্তাকে বিতাড়িত করা হয়। খ্রিস্টানরা স্পেন থেকে সেখানে বসবাসরত মুসলমানদের নারকীয় ভাবে হত্যা ও বিতাড়িত করে এবং মুসলিম সভ্যতার স্থাপত্য নিদর্শনাবলী গুলো দখল করে নেয়।মুসলিমদের এই ভূখণ্ডটি ধীরে ধীরে খ্রিস্টান রাজ্যে পরিণত হয়। শেষ হয়ে যায় ৮০০ বছরের আল আন্দালুস (স্পেন) ইসলামী রাষ্ট্রের।খ্রিস্টান পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার এই সমাপনীমূলক বছরটিতেই অর্থাৎ ১৪৯২ সালে অভিযাত্রী নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাসের নেতৃত্বে স্পেনের রাজার রণপোতসমূহ আমেরিকা মহাদেশে পদার্পণ করে। এরপরে প্রায় ৩০০ বছর ধরে স্পেনীয় অভিযাত্রী এবং যোদ্ধারা বিশ্বের আনাচে কানাচে ভ্রমণ করে এবং স্পেনীয় রাজার জন্য বিশাল আয়তনের ভূখণ্ড অধিকার করে। আমেরিকা মহাদেশ থেকে লুটকৃত ধনসম্পদের জন্য স্পেন ইউরোপের সবচেয়ে ক্ষমতাধর শক্তিতে পরিণত হয়। স্পেনীয় সৈনিক এবং ধর্মযাজকেরা বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশবিশেষ ও মেক্সিকো থেকে শুরু করে এবং দক্ষিণে চিলি পর্যন্ত স্পেনের উপনিবেশ স্থাপন করে এবং সেখানে স্পেনীয় ভাষা ও সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়। ইউরোপে স্পেনের মূল ভূখণ্ডে সেসময় পর্যায়ক্রমে কাস্তিলীয়, আরাগোনীয়, হাবসবুর্গীয় এবং বুর্বোঁ বংশের বিভিন্ন রাজা দেশটির শাসনের দায়িত্ব পালন করেন। বহু প্রজন্ম ধরে স্পেন ছিল গোটা বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ; এর সাম্রাজ্য বিশ্বের সমস্ত জায়গায় ছড়িয়ে ছিল। ১৭শ শতকেই স্পেনের অর্থনীতিতে স্থবিরতা দেখা দেয়। ১৮শ ও ১৯শ শতকে ইউরোপ মহাদেশ এবং সারা বিশ্বজুড়ে স্পেনের ক্ষমতা অবিরত হ্রাস পেতে থাকে এবং বিশ্বের ঘটনাবলিতে এর ভূমিকা তেমন ছিল না বললেই চলে। বিংশ শতাব্দীতে এসে ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত মতাদর্শের সংঘাতের উপর ভিত্তি করে সংঘটিত স্পেনের গৃহযুদ্ধ দেশটিকে আবার আন্তর্জাতিক অঙ্গনের কেন্দ্রে ফেরত নিয়ে আসে। কিন্তু যুদ্ধশেষে স্বৈরশাসক ফ্রানসিস্কো ফ্রাংকোর চার দশকব্যাপী শাসনের সময়ে স্পেন আরও বেশি একাকী হয়ে পড়ে। ১৯৭৫ সালে ফ্রাংকোর মৃত্যুর পর হুয়ান কার্লোস নামক বুবোঁ বংশের রাজা আবার সিংহাসনে ফেরত আসেন এবং দেশটিতে একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। সেসময় স্বৈরাচার থেকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় দেশটির ঝঞ্ঝাটহীন রূপান্তর উল্লেখ করার মত। তখন থেকে দেশটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত অনেকগুলি সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে, যাদের কেউ সমাজতন্ত্রবাদী, কেউ বা রক্ষণশীল।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের দৃষ্টিকোণ থেকে স্পেনে অনেক দেরিতে আধুনিকতার আগমন ঘটে। ১৯৬০-এর দশকের আগ পর্যন্ত স্পেনের সমস্ত শিল্পকারখানাগুলি উত্তরের কাতালুনিয়া ও বাস্ক অঞ্চলগুলিতে সীমাবদ্ধ ছিল। তখন থেকে স্পেনের অর্থনীতি দ্রুত প্রবৃদ্ধি লাভ করেছে। বিশেষ করে হালকা শিল্পগুলি (যেমন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যদ্রব্য) স্পেনকে অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করে; এছাড়া সেবা খাত, বিশেষ করে পর্যটন খাতও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রেখেছে। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক স্পেনে বেড়াতে আসেন এবং এখানকার রৌদ্রোজ্জ্বল জলবায়ু, সমুদ্রসৈকত এবং ঐতিহাসিক শহরগুলিতে ভ্রমণ করেন।
স্পেনের আছে গভীর সাংস্কৃতিক ও শিল্পকলাগত ঐতিহ্য। ঐতিহাসিকভাবে স্পেনের মূল সাংস্কৃতিক অবদান দুইটি ক্ষেত্রে অধিক পরিলক্ষিত হয়: চিত্রকর্ম ও সাহিত্য। সাম্প্রতিককালে ঐ দুই ক্ষেত্রে নিজের উপস্থিতি বজায় রেখে স্পেন চলচ্চিত্র নির্মাণ, স্থাপত্য এবং সঙ্গীতে অনেক বড় মাপের শিল্পী ও শিল্পকলা বিশ্বকে উপহার দিয়েছে। কোররিদা বা ষাঁড়ের লড়াই এবং ফিয়েস্তা বা উৎসব স্পেনের সংস্কৃতির অন্যতম দুই অনুষঙ্গ। বহু বিচিত্র সংস্কৃতির মিলনে স্পেনের সংস্কৃতি গঠিত হয়েছে। কাস্তিলীয়, কাতালুনীয়, লুসিতানীয়, গালিথীয়, বাস্ক, রোমান, বিশেষ করে আরব মুসলিম, ইহুদী এবং জিপসিসহ আরও অনেক জাতি ও উপজাতিরা তাদের রন্ধনশৈলী ও রীতিনীতির জন্য বিখ্যাত এবং তারা বিশ্বের শিল্পকলার ঐতিহ্যে প্রচুর অবদান রেখেছে। রোমান শাসনের সময় রোমানদের ভাষা, সড়কব্যবস্থা ও সৌধগুলি স্পেনে গভীর প্রভাব ফেলে এবং অনেক রোমান সম্রাটও স্পেনীয় বংশোদ্ভূত ছিলেন যাদের মধ্যে ত্রাজান, হাদ্রিয়ান এবং মার্কুস আউরেলিউসের নাম উল্লেখযোগ্য। উত্তর আফ্রিকা থেকে আগত মুসলমান বার্বার জাতির লোকেরা প্রায় ৮০০ বছর ধরে স্পেন শাসন করে এবং সূক্ষ্ম স্থাপত্য, গীতিকবিতা এবং জ্ঞানবিজ্ঞানে তারা ব্যাপক অবদান রেখে যায়।যা তৎকালীন অন্ধকার অসভ্য-বর্বর ইউরোপীয়দের মধ্যে জ্ঞানের বিস্তার করেছে।স্পেনের ইসলামী শাসন এই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্র ছিল যা পুরো বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে। এছাড়া জিপসি জাতির লোকেরা কান্তে হোন্দো নামের একধরনের ফ্লামেংকো ঘরানার গা-ছমছম-করা সঙ্গীতের উদ্ভাবন করে এমনকি রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর স্পেনকে আক্রমণকারী ভ্যান্ডাল, হুন এবং ভিজিগথ জাতির লোকদেরকেও স্পেনের সাহিত্যে ও সৌধে স্মরণ করা হয়।
স্পেনের প্রদেশগুলি আজও নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে। বাস্ক প্রদেশ ও কাতালুনিয়ার লোকেরা নিজেদেরকে স্পেনীয়-র পরিবর্তে বাস্কগোত্রীয় ও কাতালুনীয় ভাবতেই বেশি পছন্দ করে। মাদ্রিদ নামে দেশের রাজধানী হলেও অর্থনীতি, ব্যবসাবাণিজ্য, শিল্পকলা ও ক্রীড়াক্ষেত্রে কাতালুনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনা এর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। স্পেনে স্পেনীয় ভাষা ছাড়াও প্রদেশভেদে আরও ৪টি ভাষাকে সহসরকারী ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে; এগুলি হল কাতালান, গালিসীয়, বাস্ক এবং অক্সিতঁ ভাষাসমূহ।
ইতিহাস
স্পেন এর প্রথম দিকের আধিবাসীরা মূলত কেল্ট ও আইবেরিয়রা। এক দীর্ঘমেয়াদী ও প্রবল যুদ্ধের পর আইবেরিয় উপদ্বীপ (Iberian Peninsula) রোমান রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং পরিচিত হয় হিসপিনিয়া (Hispinia) নামে। মধ্যযুগের প্রথমদিকে এটি জার্মান শাসনাধীনে গেলেও পরবর্তীকালে মুসলিমগণ দেশটি জয় করেন। শুরু হয় মুসলিম শাসন অবসানের জন্য উত্তরের খ্রিস্টান রাজ্যসমূহের এক এলোমেলো এবং অত্যন্ত দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া। অবশেষে সফল হয় খ্রিস্টানরা। ১৪৯২ সালে, কলম্বাস যখন অজানা দ্বীপ আমেরিকায় পৌঁছেন, তখন মুসলিম শাসনের শেষ চিন্হটুকু নিশ্চিন্হ হয়ে যায় গ্রানাডা থেকে। নতুন সাম্রাজ্য স্পেনকে ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত করে এবং ১৬শ শতাব্দী থেকে ১৭শ শতাব্দীর অর্ধভাগ পর্যন্ত স্পেন ছিল পৃথিবীর অন্যতম প্রধান পরাশক্তি।
স্পেনের এ স্বর্ণযুগ বিভিন্ন কোন্দল এবং অন্যান্য সমস্যার কারণে একসময় ম্লান হতে শুরু করে। উপরন্তু ঊনবিংশ শতাব্দিতে ফরাসিদের আক্রমণ দেশটিতে তৈরি করে ভীষণ বিশৃঙ্খল অবস্থা। ফুঁসে উঠা স্বাধীনতা আন্দোলন অধিকাংশ রাজ্যকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং রাজনৈতিকভাবে দেশটিতে অস্থিরতা সৃষ্ট করে। বিংশ শতাব্দীতে এক ধ্বংসাত্বক গৃহ যুদ্ধ ও পরবর্তীকালে স্বৈর শাসন এর ফলে দেশটিতে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করে যদিও তা শেষ হয় অর্থনৈতিক গতিশীলতার মধ্য দিয়ে। ১৯৭৮ সালে দেশটিতে গণতন্ত্র ফিরে আসে। এক সাংস্কৃতিক নবজাগরণ ও অর্থনৈতিক উন্নতির পর ১৯৮৬ সালে দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়।
রাজনীতি
স্পেনের রাজনীতি একটি সংসদীয় প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের কাঠামোতে পরিচালিত হয়। এই ব্যবস্থায় স্পেনের রাজা হলেন রাষ্ট্রপ্রধান এবং রাষ্ট্রপতি হলেন একটি বহুদলীয় ব্যবস্থাতে সরকারি নেতা। সরকারের হাতে নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত। কেন্দ্রীয় আইন প্রণয়ন ক্ষমতা সংসদের দুইটি কক্ষের হাতে ন্যস্ত। বিচার বিভাগ নির্বাহী ও আইন প্রণয়নকারী বিভাগ থেকে স্বাধীন।
২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে হোসে লুইস রদ্রিগেস থাপাতেরো ও তার নেতৃত্বধীন স্পেনীয় সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক পার্টি নির্বাচনে জয়লাভ করেন।
বৈদেশিক সম্পর্ক
দেশটির সঙ্গে অন্যান্য দেশের সুসম্পর্ক রয়েছে। এই দেশের পাসপোর্টে ১২৩টি দেশে বিনা ভিসায় ভ্রমণ করা যায়, যা পাসপোর্ট শক্তি সূচকে ৩য় স্থানে রয়েছে। [10]
প্রশাসনিক অঞ্চলসমূহ
স্পেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল কাতালোনিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার পর দেশটি এক গভীর সাংবিধানিক সংকটের মধ্যে পড়েছে। কাতালোনিয়ার আঞ্চলিক পার্লামেন্ট স্বাধীনতার ঘোষণার পক্ষে ভোট দেয়ার পর পরই স্পেনের পার্লামেন্ট সেখানে কেন্দ্রের প্রত্যক্ষ শাসন জারির প্রস্তাব পাশ করে।[11]
ভূগোল
৫ লক্ষ ৫ হাজার ৯ শত বর্গকিলোমিটার (১৯৪,৮৯৭ বর্গমাইল) আয়তনবিশিষ্ট স্পেন আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের ৫১তম দেশ| দেশটি দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের ইবেরীয় উপদ্বীপে অবস্থিত। স্পেন পশ্চিম দিকে পর্তুগাল এবং উত্তর-পূর্ব দিকে ফ্রান্স ও অ্যান্ডোরার সঙ্গে সংলগ্ন। দেশটির উত্তরে বিস্কায়া উপসাগর, দক্ষিণ দিকে জিব্রাল্টার প্রণালী, প্রণালীর দক্ষিণে মরক্কো, পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে আটলান্টিক মহাসাগর। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ভূমধ্যসাগর। স্পেনের সমুদ্র সীমা প্রায় ৭ হাজার ৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ। দেশের সর্বোচ্চ পর্বত তেইদে পর্বতের উচ্চতা ৩,৭১৮ মিটার।
অর্থনীতি
স্পেনের জিডিপি ১.৩১১ ট্রিলিয়ন USD। স্পেনের মাথাপিছু আয় ২৮,১৫৬.৮২ USD।
জনসংখ্যা
স্পেনের জনসংখ্যা ৮ কোটি ২৭ লাখ ১৭ হাজার। এরা মূলত কাস্তিলীয় স্পেনীয় জাতের মানুষ।
সংস্কৃতি
দেশটির সরকারী ভাষা কাস্তিলীয় স্পেনীয় ভাষা। তাছাড়া স্পেনে বাস্ক, আস্তুরীয়, কাতালান ও গালিসীয় ভাষাভাষীও রয়েছে। সারা দেশে ৯৬% নাগরিক ক্যাথলিক খ্রিস্টান।
খেলাধুলা
ফুটবল স্পেনের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। স্পেন একবার ফিফা বিশ্বকাপ জিতেছে।
যোগাযোগ
এডলফ সুয়ারেজ মাদ্রিদ - বারাজাস বিমানবন্দর এই দেশের মুখ্য আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এটি ইউরোপের বৃহত্তম বিমানবন্দর। এর নিকটবর্তী ট্র্রেজন বিমানঘাঁটিতে ইউরোপের দীর্ঘতম রানওয়ে অবস্থিত।
আরও দেখুন
তথ্যসূত্র
বহিঃসংযোগ
Wikiwand in your browser!
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.