অংশগ্রহণভিত্তিক গণতন্ত্র
From Wikipedia, the free encyclopedia
অংশগ্রহণভিত্তিক গণতন্ত্র বা অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র (ইংরেজি: Participatory democracy) বলতে আধুনিক যুগের গণতন্ত্রের একটি বিশেষ রূপকে বোঝায়, যেখানে রাজনৈতিক ব্যবস্থাসমূহের দিকনির্দেশনা ও কর্মপদ্ধতিতে জনগণের ব্যাপক ও সক্রিয় অংশগ্রহণের উপর জোর দেওয়া হয়। যদিও গণতন্ত্র কথাটির অর্থই হচ্ছে "জনগণের শাসন", কিন্তু কার্যত চিরায়ত প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে নাগরিকদের অংশগ্রহণ বেশ সীমিত থাকে বলেই অংশগ্রহণভিত্তিক গণতন্ত্রে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি অংশগ্রহণ ও বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের পক্ষে বলা হয়। অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র মূলত প্রাচীন গ্রিকদের বর্ণিত আদর্শ গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার ২০শ শতকের পুনরুজ্জীবিত রূপ। এটি এক ধরনের প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র, কেননা সমস্ত নাগরিক সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।[1]
ব্যক্তিগত অধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে নির্মিত প্রতিনিধিত্বমূলক বা "হালকা" গণতন্ত্রে গণতান্ত্রিক সুশাসনে নাগরিকদের ভূমিকা হ্রাস পায়।[2] বর্তমান যুগে আধুনিক রাষ্ট্রগুলিতে বৃহৎ জনসংখ্যা, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, আমলাতন্ত্র, ইত্যাদি কারণে সাধারণ জনগণ বা নাগরিকবৃন্দ গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ তেমন পান না। বরং জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দীর্ঘ সময়ের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার অধিকারী হন। এর কারণ হিসেবে জনগণের সময়, জ্ঞান ও ইচ্ছার অভাবকে দায়ী করা হয়।[3] অংশগ্রহণভিত্তিক গণতন্ত্রের প্রবক্তারা এই বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তে কী করে জনগণ অধিকতর সক্রিয়ভাবে দেশের শাসনব্যবস্থায় অংশ নিতে পারে, সে ব্যাপারে আগ্রহী। সমাজের সকল স্তরের প্রতিটি মানুষ যেন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগ্রহণে অর্থবহ অবদান রাখার সুযোগ পান, সেটাই হল অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের চূড়ান্ত লক্ষ্য। অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রে সাধারণ জনগণ বা নাগরিকেরা নিজেরাই নিজেদেরকে যথাসর্বোচ্চ শাসন করতে পারে। তারা তাদের ক্ষমতা ও দায়িত্ব প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তর করে না। এর ফলে রাজনীতিকে পেশা, ক্রীড়া, ইত্যাদি হিসেবে দেখার কোনও অবকাশ থাকে না, বরং প্রতিটি নাগরিকের দৈনন্দিন জীবনে "বাবা-মা" বা "প্রতিবেশী"র ভূমিকার মতো রাজনীতিও একটি স্বাভাবিক ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাতে পরিণত হয়।[4]
কেউ কেউ মনে করেন আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি যেমন ইন্টারনেট জনগণের কাছে জ্ঞান পৌঁছে দেওয়া ছাড়াও জনগণের রাজনৈতিক মতামত দ্রুত ব্যক্ত করার সুযোগ করে দিতে সাহায্য করতে পারে।[5] আবার অন্যরা মুখোমুখি কথোপকথনের উপরে বেশি জোর দিয়েছেন কারণ তাদের মতে প্রযুক্তির উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা ক্ষতিকর হতে পারে।[6] অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের আরেকটি দিক হল রাজনৈতিক দলের সংগঠনগুলিকেও প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক আদর্শ মেনে গড়ে তুলতে হবে এবং দলগুলিকে স্থানীয় জনগণের সাথে তৃণমূল পর্যায়ে জড়িত থাকতে হবে। আবার কোনও কোনও পণ্ডিতের মতে সরকার রাজনৈতিক বৃত্তের বাইরে কিন্তু সুশীল সমাজের বৃত্তের ভেতরে জনগণের ব্যাপকতর অংশগ্রহণ একটি শক্তিশালী উদারপন্থী গণতন্ত্র উদ্ভব হবার অন্যতম পূর্বশর্ত। [7][8]
১৯৬২ সালে মার্কিন ছাত্র আন্দোলন স্টুডেন্টস ফর আ ডেমোক্র্যাটিক সোসাইটি রচিত বিখ্যাত পোর্ট হুরন বিবৃতিটি সাধারণ জনগণের কাছে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের ধারণাটি প্রথমবারের মত উপস্থাপন করে।[9] মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিক অধিকার আন্দোলন, ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন এবং মুক্ত তথ্য অধ্যাদেশের পেছনে এই বিবৃতিটির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬০-এর দশকে ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশের যুব ও ছাত্র আন্দোলনগুলি এই প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সাদরে গ্রহণ করে। ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্ত বিতর্ক ও সিদ্ধান্তগ্রহণ একটি দলের সব সদস্যের উপস্থিতিতে মুখোমুখি সভাতে অনুষ্ঠিত হয়। মার্কিন নব্য বামপন্থী আন্দোলন, ফরাসি ও ব্রিটিশ ছাত্র আন্দোলন, শুরুর দিকের নারী আন্দোলন এবং আণবিক অস্ত্রবিরোধী শান্তিকামী আন্দোলনগুলিতে ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে এই প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র বিরাট ভূমিকা রাখে। এছাড়া ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকের পরিবেশবাদী ও সম্প্রদায়ভিত্তিক আন্দোলনগুলিরও একটি বৈশিষ্ট্য ছিল এর অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক প্রকৃতি।[1] ২০১১ সালের শেয়ারবাজারের ক্ষতিকর পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে "অকিউপাই ওয়াল স্ট্রিট" বা "ওয়াল স্ট্রিট দখল" আন্দোলনটিকে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ হিসেবে গণ্য করা যায়।[9]