একচ্ছত্রবাদ
একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্র সর্বব্যাপী কর্তৃত্ব বজায় রাখে / From Wikipedia, the free encyclopedia
একচ্ছত্রবাদ বলতে এমন ধরনের সরকার ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝায়, যাতে একটিমাত্র দল শাসনক্ষমতার অধিকারী হয়, অন্য সমস্ত বিরোধী দলকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়, রাষ্ট্র ও তার দাবীর বিরুদ্ধে সমস্ত ব্যক্তিগত ও দলগত বিরোধিতা বেআইনি করে দেওয়া হয় এবং নাগরিকদের জনজীবন ও ব্যক্তিগত জীবনের উপর অত্যন্ত উচ্চ মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ ও প্রবিধান প্রয়োগ করা হয়। এটিকে কর্তৃত্ববাদের চরম ও পূর্ণতম রূপ হিসেবে গণ্য করা হয়। একচ্ছত্রবাদী রাষ্ট্রগুলিতে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রায়শই স্বৈরাচারী শাসক যেমন একনায়ক বা পরম রাজপ্রধানদের হাতে কুক্ষিগত থাকে, যারা রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের সাহায্যে সর্বব্যাপী উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা অভিযান চালনা করেন যার উদ্দেশ্য নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ করা।[1] একচ্ছত্রবাদ ধারণাটি পশ্চিমা রাজনৈতিক আলোচনায় স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে গুরুত্ব অর্জন করে।[2][3][4][5][6] তবে এর আগেই ২০শ শতকের প্রথমার্ধে দুই বিশ্বযুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে এর বিকাশ ঘটেছিল। কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে একচ্ছত্রবাদী শাসনের পার্থক্য হল এই যে কর্তৃত্ববাদী শাসনে একক স্বৈরশাসক, সামরিক হুন্তা, কমিটি, বা অন্য কোনও রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণীর ছোট একটি দলের হাতে একচেটিয়া রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকে।[7] একচ্ছত্রবাদ কথাটি দিয়ে বোঝানো হয় যে এক্ষেত্রে স্বৈরশাসন কেবলমাত্র রাজনৈতিক বলয়েই সীমিত নয়, বরং একটি বিস্তারিত ভাবাদর্শ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, অর্থনীতি হয়ে নাগরিকদের ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠ পরিসর পর্যন্ত, সমাজ ও ভৌগোলিক অঞ্চলের সমগ্র এলাকা জুড়ে আষ্টেপৃষ্টে বিস্তৃত থাকে, যেখানে সব নাগরিকদেরকে একটিমাত্র মতাদর্শ অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়, এবং যার ব্যত্যয় হলে তাদেরকে রাষ্ট্র ও সমাজের শত্রু মনে করা হয়।[8] রাষ্ট্রটির শাসকেরা দেশের সমগ্র জনগণকে তাদের লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করতে পারে।[7]
একচ্ছত্রবাদের চরিত্রের একটি দিক হল ভাবাদর্শগত একচেটিয়া আধিপত্য, অর্থাৎ এমন কোনও কিছুকে সত্য বলে ধরে নেওয়া হয়, যার বিরুদ্ধে কোনও ধরনের সন্দেহ, সংশয় বা সমালোচনার অবকাশ নেই, যা সবার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় এবং যারা এর বিরোধিতা করে, তাদেরকে রাষ্ট্রের শত্রু গণ্য করা হয়। অন্য একটি দিক হল একটি মাত্র দল সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখে। তাদের হাতে গণমাধ্যম কুক্ষিগত থাকে যার সাহায্যে তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা অভিযান চালনা করে। তারা অর্থনীতিকে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। সাধারণত একক দলটিকে একজন মোহময়ী মনোমুগ্ধকর নেতা নেতৃত্ব দেন, যাকে ঘিরে এক ধরনের অনুরাগী গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। ফলে তিনি কেবল স্বৈরশাসক নয়, বরং জনগণের পথনির্দেশকের পরিণত হয়, কেননা কেবল তিনিই সত্যিকারের আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে জানেন। যদি কোনও সেনাশাসক এরূপ একচ্ছত্রবাদী শাসকে পরিণত হন, তাহলে দেশ একটি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে, যেখানে দেশের সর্বত্র গুপ্ত পুলিশ ছড়িয়ে থাকে ও জনগণের উপর নজরদারি করে। রাষ্ট্রের জন্য সম্ভাব্য সন্দেহভাজন, ক্ষতিকর, কিংবা মূল্যহীন ব্যক্তিদেরকে কারাবন্দীকরণ, নির্যাতন, গুম, হত্যা, নির্বাসন কিংবা বন্দীশিবিরে প্রেরণ করার মতো ঘটনা ঘটতে পারে।
রাজনৈতিক ভাবাদর্শ হিসেবে একচ্ছত্রবাদ পরিস্কারভাবেই একটি আধুনিক ঘটনা, তবে এর ঐতিহাসিক উৎসগুলি জটিল প্রকৃতির। দার্শনিক কার্ল পপার প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো (প্লাতোস), ১৯শ শতকের জার্মান দার্শনিক গেয়র্গ ভিলহেল্ম ফ্রিডরিখ হেগেlলের রাষ্ট্র বিষয়ক ধারণা ও অপর জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্ক্সের রাজনৈতিক দর্শনে এর শেকড়ের সন্ধান পেয়েছেন।[9] তবে পপারের একচ্ছত্রবাদ বিষয়ক ধারণাগুলি উচ্চশিক্ষায়তনে সমালোচিত হয়েছে এবং এখনও অতি-বিতর্কিত রয়ে গেছে।[10][11] অন্যান্য দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ যেমন টেওডোর আডোর্নো ও মাক্স হর্কহাইমার একচ্ছত্রবাদী মতবাদগুলির উৎস খুঁজে পান আলোকিত যুগের মধ্যে, বিশেষ করে নরকেন্দ্রিক এই ধারণাটি যা অনুযায়ী "মানুষ এখন বিশ্বের কর্তা, যে কর্তা আর প্রকৃতি, সমাজ ও ইতিহাসের সাথে তার সংযোগ দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়।"[12] ২০শ শতকে এসে পরম রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ধারণাটি প্রথমে ইতালীয় ফাশিবাদীরা প্রথম সৃষ্টি করে, এবং প্রায় একই সময়ে জার্মানির নাৎসি দলের এক আইনবিদ ও উচ্চশিক্ষায়তনিক ব্যক্তিত্ব কার্ল শ্মিট ভাইমার প্রজাতন্ত্রের সময় ১৯২০-এর দশকে এর উন্নয়ন ঘটান।
বিশেষজ্ঞ ও ইতিহাসবিদেরা সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা ভ্লাদিমির লেনিনকে[13][14][15][16][17][18] একটি একচ্ছত্রবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম প্রচেষ্টাকারী একজন হিসেবে গণ্য করেন।[19][20][21][22][23] ইতালীয় ফাশিবাদের প্রতিষ্ঠাতা বেনিতো মুসোলিনি স্বয়ং তাঁর শাসনকে একটি "একচ্ছত্রবাদী রাষ্ট্র" হিসেবে বর্ণনা করেন ও বলেন যে: "সবকিছুই রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত, রাষ্ট্রের বাইরে কিছুই নেই, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও কিছু নেই।"[24] নাৎসি তাত্ত্বিক শ্মিট ১৯২৭ সালে রচিত ডের বেগ্রিফ ডেস পোলিটিশেন (Der Begriff des Politischen, অর্থাৎ "'রাজনৈতিক' ধারণাটির স্বরূপ") নামের প্রভাবশালী গ্রন্থটিতে টোটালষ্টাট (Totalstaat, অর্থাৎ "একচ্ছত্রবাদী বা সর্বগ্রাসী রাষ্ট্র") পরিভাষাটি প্রথম ব্যবহার করেন, যে গ্রন্থে তিনি একটি সর্বক্ষমতাধর রাষ্ট্রের আইনি ভিত্তির বর্ণনা দেন।[25]