Loading AI tools
প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
কৌটিল্য বা চাণক্য (সংস্কৃত: चाणक्य; ) বা চানক্যসেন[2] বিষ্ণুগুপ্ত (খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০-২৮৩ অব্দ)[1][3] একজন প্রাচীন ভারতীয় অর্থনীতিবিদ, দার্শনিক ও রাজ-উপদেষ্টা এবং অর্থশাস্ত্র নামক রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ক বিখ্যাত গ্রন্থের রচয়িতা ছিলেন।[4] চাণক্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি বিষয়ে প্রাচীন ভারতের একজন দিকপাল ছিলেন এবং তাঁর তত্ত্বগুলি চিরায়ত অর্থনীতির বিকাশ লাভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।[5][6][7][8] রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তার পাণ্ডিত্যের জন্য চাণক্যকে ভারতের মেকিয়াভেলি বলা হয়।[9] চাণক্যের রচনা গুপ্ত সাম্রাজ্যের শাসনের শেষ দিকে অবলুপ্ত হয় এবং ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে পুনরাবিষ্কৃত হয়।[6] প্রাচীন তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রনীতির অধ্যাপক চাণক্য পরবর্তীকালে মৌর্য্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের উত্থানে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেন। চাণক্য চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য ও তাঁর পুত্র বিন্দুসারের রাজ-উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
চাণক্য | |
---|---|
জন্ম | খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০ অব্দ[1] গোল্লা অঞ্চল (জৈন মত) তক্ষশীলা (বৌদ্ধ মত) |
মৃত্যু | খ্রিস্টপূর্ব ২৮৩ অব্দ[1] |
অন্যান্য নাম | কৌটিল্য, বিষ্ণুগুপ্ত |
মাতৃশিক্ষায়তন | তক্ষশীলা |
পেশা | চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের উপদেষ্টা |
উল্লেখযোগ্য কর্ম | অর্থশাস্ত্র, চাণক্যনীতি |
চাণক্য সম্বন্ধে খুব সামান্যই ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়, অধিকাংশ উৎসে ঐতিহাসিকতার তুলনায় কল্প কথা স্থান করে নিয়েছে। থমাস ট্রটমান চাণক্য ও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের সম্পর্ক নিয়ে চারটি উৎস চিহ্নিত করেছেন।[10] এগুলি হল সিংহলী বৌদ্ধ গ্রন্থ মহাবংশ ও তার পালি টীকা বংসট্ঠপ্পকাসিনি, হেমচন্দ্র রচিত জৈন গ্রন্থ পরিশিষ্টপর্ব, সোমদেব রচিত কথাসরিৎসাগর ও ক্ষেমেন্দ্র রচিত বৃহৎকথামঞ্জরী নামক দুইটি কাশ্মীরি গ্রন্থ এবং বিশাখদত্ত রচিত সংস্কৃত নাটক মুদ্রারাক্ষস।
প্রাচীন ভারতীয় পণ্ডিত, দার্শনিক, ও রাজউপদেষ্টা কৌটিল্য বা বিষ্ণু গুপ্ত ( খ্রি. ৩৭১-২৮৩)। তিনি চাণক্য নামে অধিক পরিচিত। তাঁর জন্ম নিয়ে রয়েছে মতান্তর। কারো মতে তাঁর জন্ম পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের তক্ষশীলায়। আবার কারো মতে কৌটিল্য বা চাণক্যের জন্ম চণক নামে একটি গ্রামে, ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।[11] তাঁর জন্মস্থান সম্বন্ধে বেশ কয়েকটি মতবাদ প্রচলিত রয়েছে।[1] বৌদ্ধ গ্রন্থ মহাবংশটীকা অনুসারে, তক্ষশীলায় তাঁর জন্ম হয়।[12] জৈন পুঁথি অদ্বিধন চিন্তামণি চাণক্যকে অভিহিত করেছে দ্রমিলা নামে , যার অর্থ তিনি দক্ষিণ ভারতের অধিবাসী ছিলেন।[12][13] হেমচন্দ্র রচিত পরিশিষ্টপর্ব গ্রন্থানুসারে, চাণক্য চণক নামক গ্রামে চণিন নামক এক ব্রাহ্মণ ও তাঁর পত্নী চণেশ্বরীর গৃহে জন্মগ্রহণ করেন।[14] অন্য উৎস মতে, চণক তার পিতার নাম ছিল।[15]
চাণক্য প্রাচীন ভারতের অন্যতম বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষালাভ করেন ও পরবর্তীকালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আচার্য্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বেদ সম্বন্ধে একজন পণ্ডিত ছিলেন[16] এবং বিষ্ণুর উপাসক ছিলেন।.[17]
বিশাখদত্ত রচিত মুদ্রারাক্ষস নামক সংস্কৃত নাটকে নন্দ সাম্রাজ্য পতনে চাণক্যের ভূমিকা বর্ণিত রয়েছে। এই গ্রন্থানুসারে, হিমালয়ের একটি পার্বত্য রাজ্যের অধীশ্বর পর্বতেশ্বরের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা চাণক্য কূটনৈতিক মিত্রতা স্থাপন করে নন্দ সাম্রাজ্যকে পরাজিত করতে সক্ষম হন। কিন্তু এই সময়, পর্বতেশ্বরকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হলে মলয়কেতু তার স্থানে সিংহাসনে আরোহণ করেন। নন্দ সাম্রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী রাক্ষসের সঙ্গে মিলিত ভাবে মলয়কেতু নন্দ সাম্রাজ্যের অধিকৃত এলাকা দাবি করেন। শেষ নন্দ সম্রাট ধননন্দের হত্যার প্রতিশোধ নিতে মলয়কেতুর সহায়তায় রাক্ষস রাজধানী আক্রমণ করে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। এই পরিস্থিতিতে চাণক্য যেন তেন প্রকারে রাক্ষসকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করাতে চেয়েছিলেন। রাক্ষসের প্রতীক মুদ্রাটি হস্তগত করে চাণক্য চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যকে উদ্দেশ্য করে একটি নকল চিঠি প্রস্তুত করেন। এই চিঠিতে রাক্ষসের মুদ্রার ছাপ (সীলমোহর) দিয়ে লেখা হয় যে তিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের শিবিরে যোগ দিতে ইচ্ছুক। চাণক্য প্রথমেই মলয়কেতুর নিকট এই চিঠির বিষয়ে বার্তা পাঠালে তাতে বিশ্বাস করে মলয়কেতু রাক্ষসের সঙ্গত্যাগ করেন। এই ভাবে চাণক্য রাক্ষসকে তার সঙ্গীদের থেকে দূরে সরিয়ে দেন। পরবর্তী কৌশল হিসেবে তিনি রাক্ষসের বন্ধু চন্দনদাসের মৃত্যুদণ্ড দিলে রাক্ষস তাকে বাঁচাতে, আত্মসমর্পণে ও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনে বাধ্য হন।
জৈন প্রবাদানুসারে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের উপদেষ্টা চাণক্য শত্রু দ্বারা বিষপ্রয়োগে হত্যা করার চেষ্টার বিরুদ্ধে শারীরিক প্রতিষেধক তৈরী করার উদ্দেশ্যে প্রতিদিন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যকে তাঁর অজান্তে অল্প মাত্রায় বিষ পান করাতেন।[18] একদিন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য তাঁর বিষযুক্ত খাবার অন্তঃসত্ত্বা দুর্ধরার সঙ্গে ভাগ করে খেলে, দুর্ধরার মৃত্যু হয়। তাঁর সন্তানকে বাঁচাতে চাণক্য সদ্যমৃত দুর্ধরার পেট কেটে তাকে বের করে আনলে বিন্দুসারের জন্ম হয়।[19][20] পরবর্তীকালে বিন্দুসার মৌর্য্য সম্রাট হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করলে চাণক্য তাঁর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। হেমচন্দ্রের পরিশিষ্টপর্ব অনুসারে, বিন্দুসারের একজন মন্ত্রী সুবন্ধু চাণক্যকে অপছন্দ করতেন। তিনি বিন্দুসারকে জানান যে তার মাতা দুর্ধরার মৃত্যুর জন্য চাণক্য দায়ী ছিলেন। এই ঘটনার কথা জানতে পেরে বিন্দুসার প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হলে বৃদ্ধ চাণক্য জৈন আচার সল্লেখনা বা স্বেচ্ছা-উপবাস করে দেহত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এই সময় চাণক্য যে তার মাতার মৃত্যুর জন্য সরাসরি দায়ী ছিলেন না, তা অনুসন্ধান করে বিন্দুসার জানতে পেরে নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং সুবন্ধুকে চাণক্যের নিকট পাঠান যাতে, চাণক্য তার মৃত্যু সঙ্কল্প ত্যাগ করেন। কিন্তু সুযোগসন্ধানী সুবন্ধু এই সময় চাণক্যকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেন।[21]
অর্থশাস্ত্র এবং চাণক্য নীতি নামক দুইটি গ্রন্থ চাণক্য রচনা করেছিলেন বলে মনে করা হয়।[22] অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে অর্থনীতি, রাষ্ট্রের কল্যাণকারী ভূমিকা, পররাষ্ট্রনীতি, সামরিক কৌশল, শাসকের ভূমিকা সম্বন্ধে বিশদে বর্ণনা করা হয়েছে।[23] অর্থশাস্ত্রের অধিকাংশ শ্লোকের রচয়িতা হিসেবে কৌটিল্যের নাম পাওয়া যায়, একটি শ্লোকে বিষ্ণুগুপ্তের নাম পাওয়া যায়। থমাস ট্রটমানের মতে, অর্থশাস্ত্রের রচয়িতার প্রকৃত নাম বিষ্ণুগুপ্ত ও গোত্র নাম কৌটিল্য।[15] বিষ্ণুশর্মা রচিত পঞ্চতন্ত্র গ্রন্থে চাণক্য ও বিষ্ণূগুপ্ত যে একই ব্যক্তির বিভিন্ন নাম, তা বলা হয়েছে।[4] থমাস বারো ইত্যাদি কয়েকজন ঐতিহাসিকের মতে, অর্থশাস্ত্র আসলে বেশ কিছু পুরনো রচনার সঙ্কলন এবং চাণক্য এই গ্রন্থের বেশ কয়েকজন লেখকের একজন, অর্থাৎ তাঁদের মতে চাণক্য ও কৌটিল্য ভিন্ন ব্যক্তি।[24]
চাণক্য যেসব শ্লোক রচনা করেছেন তার প্রাসঙ্গিকতা এখনো হারিয়ে যায়নি। বর্তমান কালের পরিপ্রেক্ষিতে এইসব শ্লোক গুলি খুবই কার্যকর। মানুষের মননে চাণক্য সত্যিই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন বলে মনে হয়। অনেকেই মনে করেন চাণক্য শ্লোকের সংখ্যা প্রায় ৬০০০ হবে। এইসব শ্লোক গুলি যে কেবলমাত্র চাণক্যের রচনা সে বিষয়ে সঠিক তথ্য জানা যায়নি। এখানে কয়েকটি শ্লোক তুলে ধরা হলো যা বর্তমান দিনেও প্রাসঙ্গিক এবং বাস্তবধর্মী।
অর্থাগমো নিত্যমরোগিতা চ
প্রিয়া চ ভার্যা প্রিয়বাদিনী চ।
বশ্যশ্চ পুত্রোহর্থকরী চ বিদ্যা
ষড় জীবলোকেষু সুখানি রাজন।।
সান্বয় শব্দার্থ
রাজন (হে রাজা) নিত্যম্ (প্রতিদিন) অর্থাগমঃ (যার টাকাপয়সা অর্জিত হয়) চ (এবং) অরোগিতা (রোগশূন্যতা) ভার্যা (স্ত্রী যার) চ (এবং) প্রিয়া (প্রিয়) চ (এবং) প্রিয়বাদিনী (মধুরভাষিণী) পুত্রঃ (পুত্র) বশ্যঃ চ (যার বশে থাকে) বিদ্যা চ (এবং বিদ্যা) অর্থকরী (অর্থ এনে দেয়) জীবলোকেষু (মর্ত্যভূমিতে) ষট্ (এই ছ'টি) সুখানি (সুখের নিদান)।
বঙ্গানুবাদ
হে রাজন! প্রতিদিন যদি অর্থাগম হয়, শরীর যদি নীরোগ হয়, স্ত্রী যদি প্রিয় এবং মধুরভাষিণী হয়, পুত্র যদি পিতা-মাতার বশে থাকে এবং বিদ্যা যদি অর্থ প্রদান করে- তবে এই ছটি মর্ত্যভূমিতে সুখের নিদান হয়।
অবিদ্যং জীবনং শূন্যং দিশূন্যা চেদবান্ধবাঃ। পুত্রহীনং গৃহং শূন্যং সর্বশূন্যা দরিদ্রতা।।
সান্বয় শব্দার্থ
অবিদ্যম্ (বিদ্যা নেই এমন) জীবনম্ (জীবন) শূন্যম্ (শূন্য) চেৎ (যদি) অবান্ধবাঃ (বন্ধু না থাকে তাহলে তার) দিশূন্যা (সর্বদিক শূন্য), পুত্রহীনম্ (পুত্র নেই এমন) গৃহম (গৃহ) শূন্যম্ (শূন্য) দরিদ্রতা (যে দরিদ্র, তার) সর্বশূন্যা (সবই শূন্য)।
- বঙ্গানুবাদ
যার বিদ্যা নেই, তার জীবন শূন্য। যদি বন্ধুবান্ধব না থাকে তবে তার সকল দিক শূন্য। যে গৃহে পুত্র নেই, সেই গৃহ শূন্য। যে দরিদ্র, তার সবকিছুই শূন্য।
আলোচনা
কবি এখানে দারিদ্র্যকেই সবচেয়ে বড়ো অভিশাপ বলে তুলে ধরেছেন। বিদ্যা, বন্ধুবান্ধব, পুত্র-এগুলির প্রয়োজনীয়তা মনুষ্যজীবনে অপরিহার্য; কিন্তু ধন-সম্পদের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।
ন চ বিদ্যাসমো বন্ধু র্ন চ ব্যাধিসমো রিপুঃ।
ন চাপত্যসমঃ স্নেহো ন চ দৈবাৎ পরং বলম্।।
সান্বয় শব্দার্থ
বিদ্যাসমঃ (বিদ্যার তুল্য) বন্ধুঃ (বন্ধু) ন (নেই), ব্যাধিসমঃ (ব্যাধির তুল্য) রিপুঃ (শত্রু) ন (নেই) চ (এবং) অপত্যসমঃ (সন্তানস্নেহের তুল্য) স্নেহঃ (স্নেহ) ন (নেই), দৈবাৎ (দৈব অপেক্ষা) পরম্ (শ্রেষ্ঠ) বলম্ (বল) ন (নেই)।
বঙ্গানুবাদ
বিদ্যার তুল্য বন্ধু নেই, ব্যাধির তুল্য শত্রু নেই, সন্তান-স্নেহের তুল্য স্নেহ নেই, দৈব অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বল নেই।
ন বিশ্বসেদবিশ্বস্তে ন মিত্রেহপ্যতি বিশ্বসেৎ। কদাচিৎ কুপিতং মিত্রং সর্বদোষং প্রকাশয়েৎ।।
সান্বয় শব্দার্থ
অবিশ্বস্তে (অবিশ্বাসীকে) ন বিশ্বসেৎ (বিশ্বাস করা উচিত নয়)। মিত্রে অপি (বন্ধুকেও) ন অতিবিশ্বসেৎ (খুব বেশি বিশ্বাস করা উচিত নয়)। মিত্রম্ (বন্ধু) কদাচিৎ (কোনো কারণে) কুপিতম্ (রেগে গেলে) সর্বদোষম্ (তোমার সকল দোষ) প্রকাশয়েৎ (প্রকাশ করে দিতে পারে)।
বঙ্গানুবাদ
অবিশ্বাসীকে বিশ্বাস করা উচিত নয়। বন্ধুকেও অতিবিশ্বাস করা উচিত নয়। (কারণ) বন্ধু কোনো কারণে রেগে গেলে তোমার সকল দোষ প্রকাশ করে দিতে পারে।
বিদ্বত্বং চ নৃপত্বং চ নৈব তুল্যং কদাচন। স্বদেশে পূজ্যতে রাজা বিদ্বান্ সর্বত্র পূজ্যতে।।
সান্বয় শব্দার্থ
বিদ্বত্ত্বম্ (বিদ্বান) চ (এবং) নৃপত্বম্ (রাজার) চ (এবং) কদাচন (কখনও) তুল্যম্ ন এব (তুলনাই করা যায় না)। রাজা (রাজা) স্বদেশে (কেবল নিজের দেশে) পূজ্যতে (পূজিত হন) বিদ্বান্ (বিদ্বান) সর্বত্র (সব জায়গায়) পূজ্যতে (পূজিত হন)।
বঙ্গানুবাদ
বিদ্বানের সঙ্গে রাজার কখনোই তুলনা করা যায় না। কারণ রাজা কেবল নিজের রাজ্যেই পূজা পান, বিদ্বান্ সর্বত্র পূজিত হন।
বিদ্যা মিত্রং প্রবাসেবু মাতা মিত্রং গৃহেষু চ। ব্যাধিতস্যৌষধং মিত্রং ধর্মো মিত্রং মৃতস্য চ।।
সান্বয় শব্দার্থ
প্রবাসেষু (বিদেশে) বিদ্যা (বিদ্যা) মিত্রম্ (বন্ধু)। গৃহেষু (গৃহে) চ (এবং) মাতা (মা) মিত্রম্ (বন্ধু)। ব্যাধিতস্য (রোগগ্রস্ত ব্যক্তির) ঔষধম্ (ঔষধ) মিত্রম্ (বন্ধু) চ (এবং) মৃতস্য (মৃত ব্যক্তির) ধর্মঃ (ধর্ম) মিত্রম্ (বন্ধু)।
বঙ্গানুবাদ
বিদেশে বিদ্যাই হল বন্ধু। গৃহে মা বন্ধু। পীড়িত ব্যক্তির ঔষধই হল বন্ধু। আর ধর্ম হল মৃতের বন্ধু।[25]
ভারতবর্ষের মধ্যে চাণক্য ছিলেন একজন অসাধারণ পণ্ডিত। মানুষের কর্তব্য, সঠিক ধর্মপথে চালনা, সমাজকল্যাণ, উপযুক্ত বিদ্যা ও শিক্ষা বিষয়ে তিনি অনেক শ্লোক রচনা করেছেন। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, চণকের পুত্র বা চণক বংশীয় সন্তান বলে তাঁর নাম চাণক্য। তিনি আবার কৌটিল্য, বিষ্ণুগুপ্ত এমনকি বিষ্ণু শর্মা নামেই পরিচিত ছিলেন। অবশ্য এই বিষয়ে অনেক মতভেদ আছে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে চাণক্যের আর্বিভাব।
চন্দ্রগুপ্তকে মগধের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে চাণকোর অবদান খুবই উল্লেখযোগ্য। খ্রিস্টপূর্ব ৩২১-এ চন্দ্রগুপ্ত রাজা ধননন্দকে যুদ্ধে হারিয়ে রাজধানী পাটলিপুত্র দখল করেন। চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন চাণক্য।
মহামতি চাণক্য তাঁর প্রতিভা বলে যে শ্লোক রচনা করেছেন তার সামাজিক মূল্য বিরাট। চাণক্য শ্লোক বর্তমানেও মনে হয় খুবই প্রাসঙ্গিক। চাণক্য শ্লোকের ভাববস্তু আমাদের জীবনের সাথে এমন ভাবে জড়িয়ে আছে তা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসার কোনো উপায় নেই। চাণক্যের শ্লোকগুলি অধিকাংশই বাস্তবধর্মী।
শিক্ষা ও বিদ্যা বিষয়ে চাণক্য শ্লোক আমাদের জীবনে কতটা অপরিহার্য তা শ্লোকের বিষয়বস্তুর মধ্যে পরিষ্কার ভাবে ফুটে উঠেছে। আমাদের জীবন প্রবাহে চাণক্য শ্লোকের উপদেশ ঠিকমতো গ্রহণ করলে মানব সমাজের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব। বিদ্যা ও শিক্ষা বিষয়ে কয়েকটি শ্লোক উল্লেখ করলাম।
শ্লোক-১
অধনস্য কুতো মিত্রম্ অমিত্রস্য কুতঃ সুখম্।।
যারা অলস তাদের বিদ্যা হয় না। বিদ্যা না থাকলে ধন হয় না। যার ধন নেই তার বন্ধু জোটে না, যার বন্ধু নেই তার সুখ নেই।
শ্লোক-২: অনভ্যাসে বিষং বিদ্যা বৃদ্ধস্য
তরুণী বিষম্।
আরোগে তু বিষং বৈদ্যঃ অজীর্ণে ভোজনং
বিষম্।।
ঠিকমতো অভ্যাস না করলে বিদ্য বিষ তুল্য বুড়োমানুষের তরুণী স্ত্রী বিষতুল্য, রোগ দূর হলে চিকিৎসক বিষতুল্য,
খাবার ঠিকমতো হজম না হলে ভোজন বিষবৎ হয়।
শ্লোক-৩:
অবিদ্যঃ পুরুষঃ শোচ্যঃ শোচ্যা নারী চানপত্যা।
নিরাহারাঃ প্রজাঃ শোচ্যাঃ শোচ্যং রাষ্ট্রমরাজকম্।।
যে পুরুষের বিদ্যা নেই, যে নারীর সন্তান নেই, যে প্রজা অনাহারে থাকে, যে রাষ্ট্র রাজাহীন-এগুলোর জন্য শোক করা উচিত।
শ্লোক-৪: ন চ বিদ্যসমো বন্ধু র্ন চ ব্যাধিসম রিপুঃ।
ন চাপত্য সম স্নেহো র্ন চ দৈবাং পরং বলম্।।
বিদ্যার মতো তুল্য বন্ধু নেই, ব্যাধির মতো শত্রু নেই, সন্তান স্নেহের তুল্য স্নেহ নেই, দৈব অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কোনো বল নেই।
শ্লোক-৫: বিদ্যা মিত্রং প্রবাসেষু, মাতা মিত্রং গৃহেসু চ।
ব্যাধিত সৌষধং মিত্রং ধর্মে মিত্রং মৃতস্য চ।।
প্রবাসে বিদ্যা হল বন্ধু, বাড়িতে মা বন্ধু, ব্যাধিগ্রস্থ ব্যক্তির ঔষধ হল বন্ধু, ধর্ম হল মৃতের বন্ধু।
শ্লোক-৬: ধনং ক্ষীণং ভবেদানাদ বিদ্যাদানাদ্বিবর্ধতে। তস্মান্মান্যে ধ্রুবং বিদ্যা ধনাদপি গরিয়সী।।
ধন দান করলে তা কমে যায়, বিদ্যা দান করলে তা বাড়ে, সেইজন্য নিশ্চিন্ত মনে করি-ধনের থেকে বিদ্যাই শ্রেষ্ঠ।
শ্লোক-৭: জ্ঞাতিভির্বণ্টা নৈব চৌরেনাপি ন নীয়তে।
দানেন ন ক্ষয়ং যাতি বিদ্যারত্বং মহাধনম।।
বিদ্যা হল এমন রত্ন বা মূল্যবান ধন যার ভাগ জ্ঞাতিরা নিতে পারে না, চোরে যাকে চুরি করতে পারে না। দান করলে যার ক্ষয় হয় না।
শ্লোক-৮: কামং ক্রোধং তথা লোভং স্বাদং শৃঙ্খার কৌতুকম্। অতি নিদ্রাতি সেবা বিদ্যার্থী হাষ্ট বর্জয়েৎ।।
বিদ্যার্থী তথা ছাত্রের কাম, ক্রোধ, লোভ, সুস্বাদু খাবার, শৃঙ্গার, কৌতুক, অতিরিক্ত ঘুম, অতিরিক্ত ভোজন এট আটটি বর্জন করা উচিত।
শ্লোক-৯: অবিদ্যং জীবনং শূন্যং দিক্ শূন্যা চেদবান্ধবাঃ। পুত্রহীনং গৃহং শূন্যং সর্বশূন্যা দরিদ্রতা।।
বিদ্যা না থাকলে জীবন শূন্য, বন্ধুবান্ধব না থাকলে সবদিক শূন্য, গৃহে পুত্র না থাকলে তা শূন্য, দরিদ্র ব্যক্তির সবকিছুই শূন্য।
শ্লোক-১০: রূপযৌবনসম্পন্না বিশাল কুলসম্ভবাঃ। বিদ্যাহীনা ন, শোভন্তে নির্গন্ধা ইব কিংশুকাঃ।।
রূপ যৌবন সম্পন্ন হলেও, উচ্চকুলে জন্ম নিলেও বিদ্যাহীন ব্যক্তি গন্ধহীন পলাশ ফুলের মতো।
শ্লোক-১১: ক্ষময়া দয়য়া প্রেমা সুনুতেনার্জবেন চ। বশী কুযাৎ জগৎ সবং বিনয়েন চ সেবয়া।।
, দয়া, প্রেম, সত্য, সরলতা, বিনয় এবং সেবা দ্বারা সকল জগৎকে বশীভূত করবে।
ক্ষমা সিংহাদেকং বকাদেকং যশুনন্ত্রীণি গর্দভাৎ।
শ্লোক-১২: বায়সাৎ পঞ্জ শিক্ষেৎ চত্বারি কুকুটাদপি।।
সিংহের কাছ থেকে একটি, বকের কাছ থেকে একটি, কুকুরের কাছ থেকে ছয়টি, গর্দভের কাছ থেকে তিনটি, কাকের কাছ থেকে পাঁচটি, মোরগের কাছ থেকে চারটি গুণ শিক্ষা করা উচিত।
সিংহ বীর বিক্রমে শিকার ধরে। কাজ সহজ বা কঠিন হোক তা বীর বিক্রমে করা দরকার। বকের কাছ থেকে যে শিক্ষা আমরা নিতে পারি তা হল, সকল ইন্দ্রিয়কে সংযত করার শিক্ষা।
কুকুরের কাছ থেকে যে ছয়রকম শিক্ষা আমরা নিতে পারি। তা হল, বিভিন্ন আহার, অল্পে সন্তোষ, শীঘ্র ঘুম, সামান্য শব্দে জেগে ওঠা, প্রভুভক্তি এবং শত্রুকে আক্রমণ।
গর্দভের কাছ থেকে যে তিনটি শিক্ষা আমরা পাই সেগুলি হল, ভার বহন, শীত গ্রীষ্ম উপেক্ষা, সবসময় সন্তোষ।
কাকের কাছ থেকে পাঁচটি শিক্ষা হল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, আচরণ, সময়ে আহার, পরিশ্রম ও সতর্কতা। মোরগের কাছ থেকে আমরা চার রকম শিক্ষা পাই-ভোরে ওঠা, যুদ্ধবিদ্যা, একসাথে ভাগ করে খাওয়া, বিপদে স্ত্রীকে রক্ষা করা।
চাণক্যের শ্লোকে যে উপদেশ দেওয়া হয়েছে তা সর্বকালীন ও যুগজয়ী। আমাদের জীবনে চলার পথে যদি চাণক্যের উপদেশ কিছুটা গ্রহণ করি তাহলে আমাদের অশেষ উপকার হবে বলেই মনে হয়। - তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী [26]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.