Loading AI tools
ভারতের নীলগিরি পর্বতের উপজাতি উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
টোডা জাতি বা জনগোষ্ঠী হলো একটি ছোট চারণ উপজাতি যারা দক্ষিণ ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে বিচ্ছিন্ন নীলগিরি পাহাড়গুলোয় বসবাস করে। ১৮ শতকের ইংরেজদের উপনিবেশ স্থাপনের পূর্বে টোডারা স্থানীয় অন্যান্য উপজাতি যেমন কোটা এবং কুরুবাদের সাথে থাকতো এক দুর্বল জাতিভিত্তিক সমাজে যেখানে টোডারা ছিল প্রথম সারিতে।[1] ২০ শতকে টোডাদের জনসংখ্যা ছিল মোটামুটি ৭০০ থেকে ৯০০ জন।[1] ভারতের মোট জনসংখ্যার নগণ্য অংশ হলেও ১৮শ শতক থেকেই টোডারা "তাদের প্রতিবেশীদের থেকে ভিন্ন রূপ, প্রথা ও রীতিনীতি"[1] এবং "অসামাজিক জাতিগত সংস্কৃতির কারণে অসমঞ্জস মনোযোগ" আকর্ষণ করেছে।[1] নৃতত্ববিদ ও ভাষাবিদেরা সামাজিক নৃবিজ্ঞান ও জাতিসঙ্গীতত্বের ক্ষেত্রে টোডাদের সংস্কৃতি নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ গবেষণা করেছেন।
ভাষা | |
---|---|
টোডা ভাষা | |
ধর্ম | |
হিন্দুধর্ম এবং বিচ্ছিন্ন বিশ্বাস | |
সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী | |
কোটা, তামিল, মালায়লী |
টোডারা ঐতিহ্যগতভাবে মান্ড নামক বসতিতে থাকে। তিন থেকে সাতটি খড়-ছাওয়া বাড়ি নিয়ে একটি মান্ড গঠিত হয়। বাড়িগুলো অর্ধ-ব্যারেল আকৃতির এবং সেগুলো সাধারণত বানানো হয় তাদের মহিষ-চারণভূমির ঢালে আড়াআড়ি করে।[2] তাদের অর্থনীতি ছিল চারণভূমিভিত্তিক, মহিষ-নির্ভর, যেহেতু মহিষের দুগ্ধজাত খাদ্য তারা নীলগিরি পাহাড়ের অন্য লোকদের কাছে বিক্রি করতো।[2] টোডা ধর্মে পবিত্র মহিষের কথা বর্ণিত আছে; তাই মহিষ পালন, দুধদোহন বা গোয়ালা-যাজকের অভিষেক - সবকাজেই তারা ধর্মপ্রথা পালন করে। ধর্মীয় এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সমাধেশে সামাজিক নীতি অনুসারে, মহিষের প্রশংসায় কাব্যগান লেখা ও গাওয়া হয়।[2]
ঐতিহ্যবাহী টোডা সমাজে কয়েক ভাইকে একসাথে বিয়ে করা ছিল বেশ সাধারণ ব্যাপার; তবে কন্যাশিশু হত্যার মতো এই আচারটিও বর্তমানে পরিত্যক্ত হয়েছে। ২০ শতকের শেষ চতুর্ভাগে, টোডাদের কিছু গোচারণভূমি বহির্গতরা বেদখল করে চাষাবাদ শুরু করে[2] বা তামিলনাড়ু সরকার সেখানে গাছ লাগায়। এতে মহিষপালন কমে যাওয়ায় টোডা সংস্কৃতি হুমকির মুখে পড়বে। ২১ শতকের শুরু থেকেই টোডা সমাজ ও সংস্কৃতিতে আন্তর্জাতিক আলোকপাত হয় সাংস্কৃতিকভাবে সংবেদনশীল পরিবেশগত পুনর্জীবনের ক্ষেত্রে।[3] টোডাদের জমিগুলো এখন ইউনেস্কো-মনোনীত নীলগিরি বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের অংশ এবং তাদের অঞ্চলটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের অন্তর্ভুক্ত।[4]
এম বি ইমেনিয়াওয়ের মতে, টোডাদের ধারাবাহিক দশমিক ভারতের জনপরিসংখ্যান হলো: ১৮৭১ (৬৯৩), ১৮৮১ (৬৭৫), ১৮৯১ (৭৩৯), ১৯০১ (৮০৭), ১৯১১ (৬৭৬) (৭৪৮ থেকে সংশোধিত), ১৯৫১ (৮৭৯), ১৯৬১ (৭৫৯), ১৯৭১ (৮১২)। তার সিদ্ধান্ত হলো, এই রেকর্ডগুলো
"দেখাচ্ছে যে ৭০০ থেকে ৮০০-র মধ্যে সংখ্যাটি অনেকটা আদর্শ, এবং তা কম-বেশি হয় একদিকে মহামারী বিপর্যয় এবং সুস্থ হতে সময় লাগা (১৯২১ (৬৪০), ১৯৩১ (৫৯৭), ১৯৪১ (৬৩০)), অন্যদিকে লোকদের দুবার গণনার ফলে (আদমশুমারি কর্মকর্তারাও যার সম্ভাবনা স্বীকার করেছেন ১৯০১ ও ১৯১১ এবং সম্ভবত ১৯৫১-র শুমারিতে)। উপাত্তগুলোয় অনিশ্চয়তার ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় হলো বিভিন্ন শুমারিতে ঘোষিত বা অঘোষিতভাবে খ্রিস্টধর্মীদের অন্তর্ভুক্ত বা বর্জন করা ... ৭০০ থেকে ৮০০-র মধ্যে একটা সংখ্যা বলে দেয়াটা খুবই ঘোলাটে, এবং হয়তো আশু বর্তমান বা ভবিষ্যতের জন্য হতাশাপূর্ণ, যেহেতু জনস্বাস্থ্য কার্যক্রমের ফলে জন্মাহার বৃদ্ধি এবং তার ফলে জনসংখ্যাও বৃদ্ধি পাবার কথা। আর যাইহোক, এই সম্প্রদায়টি ক্ষয়ে যাচ্ছে এরকম ভবিষ্যদ্বাণীগুলো ছিল খুব বেশি নৈরাশ্যবাদী এবং সম্ভবত কখনোই সুপ্রতিষ্ঠিত নয়।"[1]
২১ শতকের শুরুতে ডিএনএ গবেষণা করে দেখা গেছে টোডা এবং কোটাদের জিনে সাদৃশ্য আছে যা নীলগিরির অন্য উপজাতিদের থেকে পৃথক।[5]
জাতিগতভাবে এবং ভাষার দিক থেকে টোডারা কোটাদের খুব নিকট-সম্পর্কিত।
টোডা পোশাক হলো একপ্রস্থ কাপড়, যা পুরুষেরা শালের মতো করে ধুতির ওপর গায়ে জড়িয়ে নেয় এবং নারীরা নেয় স্কার্টের মতো করে এবং শাল জড়িয়ে। এখনো টিকে থাকা ঐতিহ্যবাহী পোশাকে ব্যবহৃত চিহ্নগুলো অনেক পুরনো এবং দেখতে প্রাচীন ভারতীয়দের মতো।
তাদের একমাত্র পেশা হলো পশুপালন এবং দুগ্ধজাত খাদ্য উৎপাদন। মহিষের দুধ সংরক্ষণের জন্যে পবিত্র ডেইরি তৈরি করা হয়।
টোডারা একসময় ভ্রাতৃ-বহুবিবাহ করতো, অর্থাৎ একজন নারী কোনো পরিবারের সব ভাইকে বিয়ে করতো।[6][7] এক্ষেত্রে সন্তানেরা সামাজিকভাবে বড়ভাইয়ের বলে গণ্য করা হতো। এই প্রথা এখন বাতিল হয়ে গেছে। টোডাদের মধ্যে নারী ও পুরুষের অনুপাত তিন অনুপাত পাঁচ। তাদের সমাজে আগে মেয়েশিশুদের হত্যা করা হতো। আর এখনো তারা দুই পরিবারের শিশুদের বিয়ের আয়োজন করে থাকে।
টোডারা মান্ড নামক ছোট ছোট পল্লীতে বসবাস করে। তাদের কুঁড়েঘরগুলোকে বলে ডগল যা ডিম্বাকৃতির ঢালু ছাদ দেয়া। এগুলো সাধারণত ১০ ফুট (৩ মি) উঁচু, ১৮ ফুট (৫.৫ মি) লম্বা এবং ৯ ফুট (২.৭ মি) চওড়া। এগুলো বাঁশ দিয়ে তৈরি করে রাতান দিয়ে বাঁধা হয় এবং খড় ছাওয়ানো হয়। মোটা বেত বাঁকিয়ে ঘরটির ঢালু কাঠামো দেয়া হয়। তারপর চিকপ বেত (রাতান) কাঠামোর উপরে পাশাপাশি করে দিয়ে বেড়া বানানো হয় যা পরে শুকনো ঘাস দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। কিছু আলগা পাথর দিয়ে প্রতিটি ঘর ঘিরে রাখা হয়।
কুটিরের সামনে ও পিছনে অলঙ্কৃত পাথর ব্যবহার করা হয়। সামনে থাকে ছোট্ট একটি দরজা- প্রায় ৩ ফুট (৯০ সেমি.) চওড়া ও ৩ ফুট (৯০ সেমি.) উঁচু; লোকেরা হামাগুড়ি দিয়ে ভেতরে ঢোকে। এই অস্বাভাবিক রকমের ছোট দরজা আসলে বন্য প্রাণীদের থেকে নিরাপদ থাকার জন্যে করা হয়। আর সামনের দেয়াল টোডাদের পাথুরে মুরালজাতীয় চিত্রকর্ম দিয়ে সাজানো থাকে।
টোডারা নিরামিশাষী, তারা গোশত, ফুটতে পারে এমন ডিম এবং মাছ খায়না (তবে কিছু গ্রামবাসী মাছ খায়)। পবিত্র দুগ্ধশালায় মহিষের দুধ দোহন করা হয় যেখানে গোয়ালা/যাজক তাদের জন্যে উপহার বানিয়ে রাখে। মহিষের দুধ বিভিন্নরূপে ব্যবহার করা হয়: মাখন, ঘোল, দই, পনীর এবং পানীয়। তাদের মূল খাদ্য ভাত তারা নানাপদের তরকারি ও দুধ দিয়ে আহার করে
টোডাদের বিশ্বাসমতে, দেবী টাইকির্শি ও তার ভাই প্রথম সৃষ্টি করেন পবিত্র মহিষ এবং তারপর প্রথম টোডা মানব। প্রথম টোডা মানবের পাঁজরের ডানপাশের হাড় থেকে সৃষ্টি কথা হয় প্রথম টোডা নারী। বহু আচার-অনুষ্ঠানে মহিষের বর্ণনা ঔআকে, যেহেতু এর দুধ এবং দুগ্ধজাত খাবারই তাদের প্রধান খাদ্য।
টোডা ধর্মে উঁচু-স্তরের লোকদেরকে পবিত্র দুধওয়ালা বলে সম্মান দিয়েছে, তারা পবিত্র দুগ্ধশালার যাজকের মর্যাদা পেয়ে থাকেন। স্যার জেমস ফ্র্যাজারের বর্ণনামতে, ১৯২২ সালে পবিত্র দুধওয়ালাকে সেতু ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে। সে হেঁটে বা সাঁতরে নদী পার হবে। সাধারণ ব্যক্তিদের জন্য জুতো বা পায়ের কোনো আবরণী পরা নিষিদ্ধ।
টোডা মন্দির নির্মাণ করা হয় পাথর-সারিবদ্ধ একটি গোল গর্তের ওপর। এগুলো নির্মাণপদ্ধতি এবং দেখতে টোডা কুটিরগুলোর অনুরূপ। মনদির হিসেবে মনোনীত কুটিরে নারীদের ঢোকার বা কাছে যাবার অনুমতি নেই।
ফ্র্যাজারের গোল্ডেন বো (১৯২২) থেকে:
"দক্ষিণ ভারতের টোডাদের মধ্যে পবিত্র দুধওয়ালা, যিনি পবিত্র দুগ্ধশালার পুরোহিত হিসেবে কাজ করেন, তিনি বহুরকম ভোগান্তি ও কড়াকড়ির শিকার হন তার পুরো কর্মজীবনে, যা অনেক বছর ধরে চলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, তাকে বাধ্যতামূলকভাবে পবিত্র দুগ্ধশালায় থাকতে হয় এবং কখনোই তিনি নিজের বাড়ি বা সাধারণ কোনো গ্রামে যেতে পারেন না।তাকে অবিবাহিত থাকতে হয়, আগে বিয়ে করলে স্ত্রীকে পরিত্যাগ করতে হয়। কোনো সাধারণ লোক কোনো কারণেই পবিত্র দুধওয়ালা বা দুগ্ধশালা ছুঁতে পারবে না; তার স্পর্শে দুধওয়ালার পবিত্রতা এতো কলুষিত হবে যে তিনি বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করবেন। সপ্তাহে কেবল দুই দিন, সোমবার ও বৃহস্পতিবার, কোনো সাধারণ লোক তার কাছে যেতে পারবে; অন্যান্য দিন যদি তার সাথে কাজ থাকে তবে তাকে দূরে দাঁড়িয়ে (কেউ কেউ বলেন সোয়া মাইল) চিৎকার করে কথাবার্তা বলতে হবে। এছাড়াও, পবিত্র দুধওয়ালা কর্মজীবনে কখনো চুল বা নখ কাটেন না; কখনো সেতু দিয়ে নদী পেরোন না, বরং নদীর নির্দিষ্ট কিছু অগভীর জায়গা দিয়ে হেঁটে পেরোন; তার গোত্রে কেউ মারা গেলে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে পারেন না যতদিন না তিনি সমুচ্চ দুধওয়ালার দায়িত্ব ছেড়ে মরণশীল মানুষের কাতারে নেমে আসেন। দেখা যাচ্ছে আগেকার দিনে তার গোত্রে কারো মৃত্যু হলে তাকে সীলমোহর বা দুধদোহন পাত্র রেখে পদত্যাগ করতে হতো। যাইহোক, এসব ভারী বাধানিষেধ কেবল সমাজে এতো উঁচুস্তরের দুধওয়ালাদের ওপরই চাপানো হয়"।
টোডা ভাষা দ্রাবিড় ভাষা পরিবারের সদস্য। ভাষাটি অক্ষরগতভাবে অপভ্রষ্ট এবং উচ্চারণ দুরূহ। ভাষাবিদেরা টোডা ভাষাকে (প্রতিবেশী কোটা ভাষাসহ) ঐতিহাসিক প্রোটো-দক্ষিণ-দ্রাবিড় পরিবারের দক্ষিণ উপগোষ্ঠীতে অন্তর্ভুক্ত করেন। কানাড়া ও তেলেগুর পর কিন্তু মালায়লামের পূর্বে এটি দক্ষিণ দ্রাবিড় থেকে উৎসৃষ্ট হয়। আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিক পরিভাষায়, টোডার সংক্ষেপন হয়েছে প্রাচীন ও সাম্প্রতিক উদ্ভূত অনানুপাতিক উচ্চ-সংখ্যক অন্বয় ও সংস্থান নিয়মের কারণে যেগুলো অন্য দ্রাবিড় ভাষাসমূহে অনুপস্থিত (কোটাতে অল্পকিছু বাদে)।[1]
অন্যান্য জনগোষ্ঠী এবং প্রযুক্তির সংস্পর্শে আসতে বাধ্য হয়ে টোডাদের জীবনযাত্রায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আগে তারা কেবল পশুপালনে রত থাকলেও এখন তারা কৃষি ও অন্যান্য পেশায় এগিয়ে আসছে। পূর্বে কঠোরভাবে নিরামিশাষী হলেও বর্তমাপে কিছু টোডা অ-নিরামিষ খাদ্য গ্রহণ করে।
যদিও অনেক টোডাই তাদের স্বতন্ত্র ঐতিহ্যবাহী কুটির ছেড়ে কংক্রিটের বাড়িতে উঠেছিল,[6] ২১ শতকের শুরুতে আবার সেসব পিপা-আকৃতির ছাদওয়ালা ঘর তৈরির আন্দোলন সৃষ্টি হয়। ১৯৯৫ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত এই পদ্ধতিতে চল্লিশটি নতুন কুটির বানানো হয়েছে এবং অনেক পবিত্র দুগ্ধশালা সংস্কার করে চালু করা হয়েছে। সেসবের চারপাশে নিচু পাথুরে খাদ থাকে এবং ছোট্ট দরজাটি ভারী পাথর দিয়ে আটকানো হয়। শুধুমাত্র যাজক এতে প্রবেশ করতে পারেন আর এখানে পবিত্র মহিষের দুধ সংরক্ষণ করা হয়[8]
রেজিস্টার অফ জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশন টোডাদের অনন্য সূচিকর্মের জিআই স্বীকৃতি দিয়েছে। এর ফলে টোডাদের সেলাই করা পণ্য ও এমব্রয়ডারির মূল্য পাওয়া নিশ্চিত হবে এবং সেসবের নিম্নমানের অনুকরণ করা বন্ধ হবে।[9]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.