Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ব্রিটিশ রাজের অধীনে ভারতবর্ষের অর্থনীতি (Indian economy under the British Raj) এর দ্বারা ১৮৫৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত অস্তিত্বশীল ব্রিটিশ রাজ এর অধীনে থাকা বস্থায় ভারতবর্ষের অর্থনীতি বোঝানো হয়। ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ এংগাস মেডিসন এর মতে, ব্রিটিশ শাসনাধীন সময়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতবর্ষের ভাগ ১৭০০ সালে ২৪.৪% থেকে কমে গিয়ে ১৯৫০ সালে ৪.২% তে পরিণত হয়। ভারত বর্ষ অবশিল্পায়ন এর অভিজ্ঞতা লাভ করে।[1] মুঘল যুগের তুলনায় ব্রিটিশ উপনিবেশী আমলে ভারতের মাথাপিচু আয় কমে যায়, সেকেন্ডারি সেক্টর বিশাল মাপে কমে যায়,[2] নগরায়নের মাত্রাও কম থাকে।[3]
ভারতবর্ষে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক প্রভাব বিতর্কিত। হুইগ রাজনীতিবিদ এডমান্ড বার্ক এই বিষয়টিকে প্রথম তুলে ধরেন যিনি ১৭৭৮ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে ৭ বছরের অভিশংসন বিচার শুরু করেছিলেন। ওয়ারেন হেস্টিংস ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের মধ্যে একটি ছিল ভারতের অর্থনীতির অব্যবস্থাপনা। সমসাময়িক ঐতিহাসিক রজত কান্ত রায় বলেন, অষ্টাদশ শতকে ইংরেজদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত অর্থনীতি ছিল মুঘল আমলের গতানুগতিক অর্থনীতির উপর লুঠতরাজ ও বিপর্যয়। এই সময়ে খাদ্য ও অর্থের মজুদকে নিঃশেষিত করা হয় এবং উচ্চ কর চাপানো হয়। এর ফলে ১৭৭০ এর দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয়, যার কারণে বাংলার এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়।[4] অপরপক্ষে ঐতিহাসিক নিয়াল ফারগুসন বলেন, ইংরেজ শাসনামলে গ্রামীণ অর্থনীতির কর-পরবর্তী মোট আয় ২৭% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৫৪% এ পরিণত হয় (এই গ্রামীণ অর্থনীতির সেক্টরটি ভারতবর্ষের সমগ্র জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশের প্রতিনিধিও করে)।[5] এছাড়া ফারগুসন বলেন, ভারতবর্ষের পরিকাঠামোভিত্তিক, কৃষিভিতিক ও শিল্পভিতিক উন্নয়নের জন্য ইংরেজরা ১৮৮০ এর দশক পর্যন্ত ২৭০ মিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগ করে, যা ইংরেজদের দেশের বাইরে মোট বিনিয়োগের এক পঞ্চমাংশ ছিল। ১৯১৪ সাল পর্যন্ত এই বিনিয়োগের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ৪০০ মিলিয়ন ডলারে। তিনি এও বলেন, ইংরেজরা ভারতবর্ষের সেচ জমির পরিমাণ আটগুণ বৃদ্ধি করে, মুঘলদের সময়ে এই জমির পরিমাণ ছিল মাত্র ৫%।[5]
পি. জে. মার্শাল বলেন, ইংরেজ শাসনে গতানুগতিক অর্থনীতির থেকে হুট করে কোন পরিবর্তন হয়নি, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল আঞ্চলিক শাসকদের হাতে। উন্নয়নের সাধারণ শর্তগুলো অনুসারেই অষ্টাদশ শতকের শেষ দিক পর্যন্ত অর্থনীতি স্থিতিশীল ছিল। ব্যতিক্রম হিসেবে কেবল দুর্ভিক্ষের হার বেড়ে যায় যার কারণ ছিল উচ্চ জন্মহার। মারশাল উল্লেখ করেন, ইংরেজরা স্থানীয় কর প্রশাসকদের দ্বারা রাজস্ব আদায় করত, এবং তারা করের ক্ষেত্রে মুঘলদের স্থির করা হারই বহাল রেখেছিল। মার্শাল এও বলেন, ইংরেজরা প্রাথমিকভাবে ভারতীয় সম্ভ্রান্তদের সাথে সহযোগিতামূলক আচরণের ভিত্তিতে স্থানীয়-নিয়ন্ত্রণের দ্বারা অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা করেছিল।[6]
ঐতিহাসিকগণ প্রশ্ন করেছেন যে কেন ঊনবিংশ শতকে ভারতবর্ষ ব্রিটেইনের মত শিল্পায়নের মধ্য দিয়ে যায়নি। সপ্তদশ শতকে ভারতবর্ষ ছিল প্রাণবন্ত রপ্তানি বাণিজ্যে এগিয়ে থাকা তুলনামূলকভাবে নগরায়িত এবং বাণিজ্যিক রাষ্ট্র, যা সূতিবস্ত্র শিল্প বা কটন টেক্সটাইলের দ্বারা ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিল, এবং সেইসাথে রেশম, মশলা এবং চালের উপরেও নির্ভরশীল ছিল। ভারতবর্ষ ছিল সূতীবস্ত্র বা কটন টেক্সটাইলের ক্ষেতে বিশ্বের প্রধান উৎপাদক, এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বারা ব্রিটেন সহ অন্যান্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রের সাথে ভারতের উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রপ্তানি বাণিজ্য ছিল। যদিও অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে ইংরেজ সূতীবস্ত্র শিল্প প্রযুক্তিগতভাবে বিপ্লব ঘটায়, ভারতবর্ষের শিল্প স্থিতিশীল থেকে যায় এবং অবশিল্পায়িত হয়।[1] অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধেও ভারতবর্ষ মুঘল সাম্রাজ্যের ভাঙ্গনের কারণে পরোক্ষভাবে অবশিল্পায়ন মধ্য দিয়ে যায়।[7]
১৭৭২ সালেও, হেনরি পাটুলো, তার বাংলায় অর্থনৈতিক সম্পদ নিয়ে মন্তব্যের ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে বলেন, ভারতীয় বস্ত্রের চাহিদা কখনই কমতে পারে না, কেননা আর কোন রাষ্ট্রই এর মানদণ্ডের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকতে পারবে না।[8] যাই হোক, ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে ভারতের বস্ত্রশিল্পের ও বস্ত্রের রপ্তানির পতনের লম্বা ইতিহাসের সূচনা পরিলক্ষিত হয়।[9]
ঊনবিংশ শতকের খুব পরিচিত একটি কিংবদন্তি হচ্ছে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় শত শত তাঁতীর হাত কেটে দেয়, যাতে ভারতবর্ষের দেশীয় তাঁতশিল্প ধ্বংস করে, ইংরেজ বস্ত্র আমদানি করা হয় (কোনো কাহিনী অনুসারে, ঢাকার তাঁতীদের বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে দেয়া হয়েছিল)। যাই হোক, এই কাহিনীর উদ্ভব ঘটে উইলিয়াম বোল্ট এর ১৭৭২ সালের ইতিহাস থেকে, যখন তিনি অভিযোগ করে বলেন, অনেক রেশম তাঁতী তাদের বাজে কর্ম পরিস্থিতির প্রতিবাদে নিজেদের বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে ফেলেছিলেন।[10][11]
অনেক ঐতিহাসিক বলেন, ভারতবর্ষে শিল্পায়নের অভাবের কারণ হচ্ছে, ভারতবর্ষ তখনও মূলত কৃষিভিত্তিক রাষ্ট্র ছিল, যেকানে কৃষকদের মজ্রি অনেক কম ছিল। এদিকে ব্রিটেনে মজুরি উচ্চ ছিল, তাই তুলা সূতী উৎপাদকগণ শ্রম বাচানোর জন্য নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও ক্রয়ের ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিতে সমর্থ হন, আর এই মজুরির মাত্রা ভারতে কম হওয়ায় উৎপাদকগণ প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ না করে আরও বেশি শ্রমিক নিয়োগ করে পণ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে চান।[12] আবার অনেক ঐতিহাসিকই এই যুক্তির সমালোচনা করেছেন। যেমন, প্রসন্নন পার্থসারথি উপার্জন উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রকৃতি মজুরির হিসাব দেখিয়ে বলেন, বাংলা ও মহীসূরে মজুরির পরিমাণ ব্রিটেনের চেয়ে বেশি ছিল। বাংলা ও মহিশুরের বস্ত্রশিল্পের শ্রমিকেরা যে পরিমাণ মজুরি পেতে, একই পরিমাণ মজুরির জন্য ব্রিটেনের শ্রমিকদের বেশি সময় ধরে কাজ করতে হত।[7][13] অর্থনৈতিক ঐতিহাসিক ইমানুয়েল ওয়ালারস্টাইন, ইরফান হাবিব, পারসিভাল স্পিয়ার এবং অশোক দেসাই এর দেয়া সাক্ষ্যপ্রমাণ অনুসারে সপ্তদশ শতকের মুঘল ভারতের মাথাপিচু কৃষি উৎপাদন এবং ভোগের মান ছিল সপ্তদশ শতকের ইউরোপ এবং বিংশ শতকের প্রথম দিকের ব্রিটিশ ভারতের তুলনায় বেশি।[14]
বাণিজ্যে ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণ, এবং সস্তা ম্যানচেস্টারের সূতীবস্ত্রের রপ্তানিকেও ভারতবর্ষের অবশিল্পায়নের উল্লেখযোগ্য নিয়ামক হিসেবে উল্লেখ করা হয়, যদিও উনিশ শতক পর্যন্ত ব্রিটিশ বস্ত্রের তুলনায় ভারতীয় বস্ত্রের মূল্য কম ছিল।[15] বিভিন্ন ঐতিহাসিক বলেন, ভারতবর্ষে উপনিবেশ স্থাপনই ছিল ভারতবর্ষের অবশিল্পায়ন এবং ব্রিটেনের শিল্প বিপ্লবের প্রধান কারণ।[16][17][18] ইংরেজ উপনিবেশীকরণের কারণে ভারতে ইংরেজ পণ্যের বিশাল বাজার উন্মুক্ত হয়ে যায়, যেখানে যেকোন ইংরেজ পণ্য কোনরকম শুল্ক ও মাশুল ছাড়াই বিক্রয় করা যায়। অন্যদিকে স্থানীয় ভারতীয় উৎপাদকদের উপর ভারি করের বোঝা ছিল। ব্রিটেনের সংরক্ষণবাদী নীতিমালাও এর একটি কারণ ছিল। যেমন, ভারতীয় বস্ত্র সেখানে বিক্রি যাতে না হতে পারে সেজন্য নিষেধাজ্ঞা ও উচ্চ শুল্ক চাপানো হয়। এদিকে, বস্ত্রশিল্পের কাচামাল (তুলা) কোন রকম শুল্ক ছাড়াই ভারত থেকে আমদানি করে ম্যানচেস্টারের ইংরেজ বস্ত্রকলে দেয়া হত। ইংরেজ অর্থনৈতিক নীতিমালার কারণে তারা ভারতের বিশাল বাজার ও কাচামাল তুলার উপর একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।[1][15][19] ইংরেজ উৎপাদকদের জন্য ভারত একই সাথে কাচামাল তুলার একটি উল্লেখযোগ্য সরবরাহকারী এবং ইংরেজ উৎপাদিত পণ্যের বিশাল বন্দী বাজারে পরিণত হয়।[20]
এখানে কোন সন্দেহ নেই যে ইংরেজদের প্রতি ক্ষোভের একটি যুক্তিসংগত ভিত্তি রয়েছে। কেম্ব্রিজের ঐতিহাসিক এংগাস মেডিসন এর যত্নশীল পরিসংখ্যানগত কাজ বলছে যে বৈশ্বিক জিডিপিতে ১৭০০ সালে ভারতের অংশ ছিল ২২.৬%, যা ইউরোপের অংশ ২৩.৩% এর প্রায় সমান। ১৯৫২ সালে এটা নেমে আসে ৩.৮% এ। প্রকৃতপক্ষে বিংশ শতকের শুরুর দিকে, "ইংরেজ মুকুটের উজ্জ্বলতম রত্ন" ছিল মাথাপিচু আয়ের দিক থেকে বিশ্বের সব থেকে দরিদ্র রাষ্ট্র।
ইংরেজ অর্থনীতিবিদ এংগাস মেডিসন অনুসারে, ১৭০০ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ভারতের ভাগ ছিল ২৪.৪%। ১৯৫০ সালে সেটা গিয়ে পৌঁছায় ৪.২% এ। ভারতের মাথাপিচু আয় (পিপিপি) মুঘল সাম্রাজ্যে স্থির ছিল। এবং ইংরেজ শাসনামল শুরু হবার পূর্বে কমতে শুরু করে।[23] বৈশ্বিক শিল্প পণ্যের মধ্যে ভারতের ভাগ ১৭৫০ সালে ২৫% ছিল। সেটা ১৯৯০ সালে গিয়ে ঠেকে ২% এ।[7] এদিকে ১৭০০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে যুক্তরাজ্যের ভাগ ছিল ২.৯%, ১৮৭০ সালে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৯% এ।[23] ব্রিটেইন বিশ্বের সর্ববৃহৎ বস্ত্র উৎপাদনকারী হিসেবে ঊনবিংশ শতকে ব্রিটেইন ভারতকে প্রতিস্থাপন করে।[15] মুঘল ভারতে ষোড়শ শতকের শেষের দিকে যে মাথাপিচু আয় ছিল তা বিংশ শতকের ব্রিটিশ ভারতের মাথাপিচু আয়ের চেয়ে বেশি ছিল। মুঘল অর্থনীতিতে সেকেন্ডারি সেক্টর এর শৎকরা হার ছিল ১৮.২% সেটা বিংশ শতকের ব্রিটিশ ভারতে কমে গিয়ে দাঁড়ায় ১১.২% এ।[2] নগরায়নের ক্ষেত্রেও মুঘল ভারতই এগিয়েছিল। ১৬০০ সালে ভারতের নগর কেন্দ্রগুলোতে ভারতের সর্বমোট জনসংখ্যার ১৫% বসবাস করত, এই শৎকরা হার ১৯ শতকের ব্রিটিশ ভারতে নগরে বসবাসকারী জনসংখ্যার শৎকরা হারের তুলনায় বেশি ছিল।[3]
আধুনিক অর্থনৈতিক ঐতিহাসিকদের অনেকেই ভারতের অর্থনীতির বেদনাদায়ক অবস্থার জন্য উপনিবেশী শাসনকে দায়ী করেন। ভারত উপনিবেশে পরিণত হওয়ায় ভারতীয় শিল্পে বিনিয়োগ সীমিত হয়ে যায়।[24][25] ইংরেজ শাসনামলে ভারতে অবশিল্পায়ন হয়, তাতে ভারতবর্ষের আঞ্চলিক উৎপাদনমূলক শিল্প হ্রাস পায়।[1][15][19] ব্রিটিশ রাজ এর অর্থনৈতিক নীতিমালার কারণে হস্তশিল্প ও তাঁত খাত প্রচণ্ড হ্রাস পায়। সেই সাথে চাহিদা এবং চাকরিও কমে যায়।[26] উদাহরণস্বরূপ, ভারতে তাঁত থেকে তৈরি হওয়া সুতার (yarn) পরিমাণ ছিল ১৮৫০ সালে ৪১৯ মিলিয়ন পাউন্ড, সেটা ১৯০০ সালে কমে গিয়ে দাঁড়াল ২৪০ মিলিয়ন পাউন্ডে।[7] ইংরেজদের উপনিবেশী নীতিমালার কারণে, ভারত থেকে যুক্তরাজ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে মূলধন প্রবাহিত হয়, যেগুলোকে ভারতবর্ষের অর্থনীতির আধুনিকীকরনের পদ্ধতিগত প্রচেষ্টায় কাজে লাগানো যেত।[27]
সন | ভারতবর্ষে মাথাপিচু আয় (পিপিপি) (যুক্তরাজ্যের মাথাপিচু আয় এর শৎকরা হিসেবে) |
---|---|
১৮২০ | ৩১.২৫ |
১৮৭০ | ১৬.৭২ |
১৯১৩ | ১৩.৬৮ |
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.