মঙ্গল গ্রহে জল
From Wikipedia, the free encyclopedia
বর্তমানে মঙ্গল গ্রহে জল প্রায় পুরোটাই বরফের আকারে রয়েছে। যদিও এই গ্রহের বায়ুমণ্ডলেও অল্প পরিমাণে জল রয়েছে বাষ্পের আকারে।[5] অতীতে যাকে মঙ্গলের অগভীর মাটিতে অবস্থিত কম ঘনত্বের তরল ব্রাইন মনে করা হত (যার অপর নাম ছিল মঙ্গল গ্রহের উষ্ণ ঢালে মরসুমি প্রবাহ),[6][7] তা সম্ভবত ঢালু জমিতে নেমে এসে কালো আঁকাবাঁকা ডোরা দাগ সৃষ্টি করা প্রবহমান বালি ও ধুলোর কণা।[8] মঙ্গলের ভূপৃষ্ঠে শুধুমাত্র উত্তর মেরুস্থ হিমমুকুটেই জলীয় বরফের উপস্থিতি লক্ষিত হয়।[9] মঙ্গল গ্রহের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে স্থায়ী কার্বন ডাইঅক্সাইড হিমমুকুটের তলায় এবং অধিকতর নাতিশীতোষ্ণ অবস্থায় অগভীর অন্তঃভূপৃষ্ঠে প্রচুর পরিমাণে জলের অস্তিত্ব রয়েছে।[10][11][12] গ্রহের পৃষ্ঠভাগে অথবা পৃষ্ঠভাগের কাছাকাছি স্থানে ২ কোটি ১০ লক্ষ ঘন কিলোমিটারেরও বেশি পরিমাণ বরফ শনাক্ত করা গিয়েছে। এই বরফ সমগ্র গ্রহটিকে ৩৫ মিটার গভীর জলের তলায় নিমজ্জিত দিতে পারে।[13] এমনকি সম্ভবত আরও বরফ গভীর অন্তঃভূপৃষ্ঠে আবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে।[14]
কিছুটা তরল জল হয়তো বর্তমানে মঙ্গল গ্রহের পৃষ্ঠভাগে ক্ষণস্থায়ীভাবে বিদ্যমান। কিন্তু বায়ুমণ্ডলের দ্রবীভূত আর্দ্রতার চিহ্ন ও ঘনত্বহীন আবরণীর মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ।[7][15][16] গ্রহের পৃষ্ঠভাগে তরল জলের কোনও বৃহৎ স্থায়ী আধার নেই। কারণ সেখানে বায়ুমণ্ডলীয় চাপ গড়ে মাত্র ৬০০ pascal (০.০৮৭ psi), যা গলনাঙ্কে জলের বাষ্পীয় চাপের সামান্য নিচে; মঙ্গল গ্রহের সাধারণ পরিস্থিতিতে এই গ্রহের পৃষ্ঠভাগে বিশুদ্ধ জল হয় জমে যাবে অথবা, গলনাঙ্কের উপর উত্তপ্ত হয়, তবে উর্ধ্বপাতিত হয়ে বাষ্পে পরিণত হবে। প্রায় ৩৮০ কোটি বছর আগে মঙ্গল গ্রহের বায়ুমণ্ডল সম্ভবত অধিকতর ঘন ছিল এবং এই গ্রহের পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রাও সম্ভবত বেশি ছিল।[17][18] যার ফলে হয়তো গ্রহের পৃষ্ঠতলে প্রচুর পরিমাণে তরল জলও ছিল।[19][20][21][22] যার মধ্যে সম্ভবত একটি বৃহৎ মহাসাগরও ছিল।[23][24][25][26] এই মহাসাগরটি সম্ভবত গ্রহের এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে ছিল।[27][28][29] মঙ্গলের সাম্প্রতিক ইতিহাসেও একাধিক বিরতিতে অল্প সময়ের জন্য গ্রহের পৃষ্ঠতলে জলপ্রবাহ ছিল বলে স্পষ্ট বোঝা যায়।[30][31][32] ২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর নাসা জানায় যে, কিউরিওসিটি রোভার কর্তৃক এইলিস প্যালাস অঞ্চল পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে বোঝা গিয়েছে গেল অভিঘাত খাদের মধ্যে একটি প্রাচীন মিষ্টিজলের হ্রদ ছিল, যা হয়ত অনুজীব জীবনের পক্ষে সহায়ক ছিল।[33][34]
একাধিক প্রমাণ নির্দেশ করে যে, মঙ্গল গ্রহে প্রচুর পরিমাণে জলীয় বরফ বিদ্যমান এবং এই গ্রহের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসে সেই জলীয় বরফ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।[35][36] মহাকাশযান থেকে গৃহীত চিত্র, রিমোট সেন্সিং কৌশল (বর্ণালিসংক্রান্ত পরিমাপ,[37][38] র্যাডার,[39] ইত্যাদি) এবং ল্যান্ডার ও রোভারগুলির পৃষ্ঠতল অনুসন্ধানের মাধ্যমে মঙ্গল গ্রহে বর্তমানে বিদ্যমান জলের একটি আনুমানিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়।[40][41] অতীতে জলের অস্তিত্বের ভূতাত্ত্বিক প্রমাণগুলির মধ্যে আছে বন্যার ফলে সৃষ্ট বহুসংখ্যক বহিঃপ্রবাহ প্রণালি[42] প্রাচীন নদী উপত্যকা জালক,[43][44] বদ্বীপ,[45] ও হ্রদতল।[46][47][48][49] এছাড়া পৃষ্ঠভাগের উপর এমন কিছু পাথর ও খনিজ শনাক্ত করা গিয়েছে, যেগুলি শুধুমাত্র তরল জলের দ্বারাই গঠিত হওয়া সম্ভব।[50] অসংখ্য ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য সাম্প্রতিক অতীতে[51][52][53][54] এবং বর্তমানে[55] এই গ্রহে ভূগর্ভস্থ বরফ (পার্মাফ্রস্ট) ও হিমবাহগুলিতে বরফের সঞ্চলনের কথা ইঙ্গিত করে।[56] সংকীর্ণ নালিকা এবং খাড়া পাড় ও অভিঘাত গহ্বরের প্রাচীরগুলির গায়ে রৈখিক ঢাল ইঙ্গিত করে যে, প্রবহমান জল মঙ্গল গ্রহের ভূপৃষ্ঠকে রূপ দেওয়ার কাজটি চালিয়ে যায়, যদিও সুপ্রাচীন কালের তুলনায় অনেক কম হারে।
কয়েক কোটি বছর আগে মঙ্গল গ্রহের পৃষ্ঠভাগ পর্যায়ক্রমে আর্দ্র হয়েছিল এবং সেই সময় হয়তো এই গ্রহ অনুজৈব জীবনের পক্ষে সহায়কও ছিল।[57] কিন্তু মঙ্গল-পৃষ্ঠের বর্তমান পরিবেশটি শুষ্ক ও প্রায় হিমায়িত, যা সম্ভবত জীবনধারণের ক্ষেত্রে অনতিক্রমণীয় বাধার সৃষ্টি করে। সেই সঙ্গে আবার মঙ্গল গ্রহে একটি ঘন বায়ুমণ্ডল, ওজন স্তর ও চৌম্বক ক্ষেত্র না থাকায় সৌর ও অন্যান্য মহাজাগতিক রশ্মিগুলি সরাসরি মঙ্গল-পৃষ্ঠে আঘাত করে। কোষবিশিষ্ট শরীরের উপর আয়নায়িত রশ্মিবিচ্ছুরণের ক্ষতিকারক প্রভাব হল মঙ্গল-পৃষ্ঠে জীবনের উদ্বর্তনের পথে অন্যতম প্রধান সীমাবদ্ধতা।[58][59] তাই মঙ্গলে জীবন আবিষ্কারের শ্রেষ্ঠ সম্ভাব্য স্থান হল অন্তর্ভূপৃষ্ঠের পরিবেশগুলি।[60][61][62] ২০১৬ সালের ২২ নভেম্বর নাসা জানায় যে, মঙ্গল গ্রহের এক স্থানে প্রচুর পরিমাণে ভূগর্ভস্থ বরফের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এখানে জলের পরিমাণ যা শনাক্ত করা হয়েছে, তা সুপিরিয়র হ্রদের সমগ্র জলরাশির সমান।[2][3][4] ২০১৮ সালের জুলাই মাসে ইতালিয়ান বৈজ্ঞানিকেরা জানান যে, মঙ্গল গ্রহে একটি উপহিমবাহ হ্রদ আবিষ্কৃত হয়েছে। ১.৫ কিমি (০.৯৩ মা) আয়তনের এই হ্রদটির অবস্থান দক্ষিণ মেরুস্থ হিমছত্রের তলদেশে। পাশের দিকে এই হ্রদের প্রসার প্রায় ২০ কিমি (১২ মা)। এটিই এই গ্রহের প্রথম আবিষ্কৃত সুস্থিত জলাশয়।[63]
মঙ্গল গ্রহে জলের আয়তন ও অবস্থা খতিয়ে দেখা এই গ্রহের জীবন বিকাশের সম্ভাবনা পর্যালোচনা এবং ভবিষ্যৎ অভিযানের জন্য ব্যবহারযোগ্য সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই জন্য ২১শ শতাব্দীর প্রথম দশকে নাসার মার্স এক্সপ্লোরেশন প্রোগ্রামের (এমইপি) বিজ্ঞান-সংক্রান্ত থিম ছিল "ফলো দ্য ওয়াটার"। ২০০১ মার্স ওডিসি, মার্ক্স এক্সপ্লোরেশন রোভারসমূহ (এমইআর), মার্স রিকনসঁস অরবিটার (এমআরও) ও মার্স ফিনিক্স ল্যান্ডারের আবিষ্কারগুলি এই গ্রহে জলের অতিপ্রাচুর্য ও বণ্টন-সংক্রান্ত প্রধান প্রশ্নগুলির উত্তরদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ইএসএ) মার্স এক্সপ্রেস অরবিটারও এই অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য-পরিসংখ্যান সরবরাহ করেছে।[64] মার্স ওডিসি, মার্স এক্সপ্রেস, এমআরও ও মার্স সায়েন্স ল্যান্ডার কিউরিওসিটি রোভার এখনও মঙ্গল গ্রহ থেকে তথ্য-পরিসংখ্যান পাঠাচ্ছে এবং নতুন নতুন আবিষ্কারের ঘটনা ঘটে চলেছে।