১৮৮৩ ক্রাকাতোয়া অগ্ন্যুৎপাত
১৯শ শতকে ইন্দোনেশিয়ার মহাদুর্যোগময় আগ্নেয় বিস্ফোরণ / From Wikipedia, the free encyclopedia
১৮৮৩ সালের ক্রাকাতোয়া অগ্ন্যুৎপাত (ইন্দোনেশীয়: Letusan Krakatau 1883) ছিল ১৮৮৩ সালের ২০শে মে থেকে ২১শে অক্টোবর পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ার (তৎকালীন ওলন্দাজ পূর্ব-ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ) জাভা দ্বীপ ও সুমাত্রা দ্বীপের মধ্যে অবস্থিত সুন্দা সমুদ্রপ্রণালীর ক্রাকাতোয়া (স্থানীয় নাম ক্রাকাতাউ বা রাকাতা) আগ্নেয় দ্বীপের আগ্নেয়গিরিটির অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা। এটি স্মরণাতীতকালের অন্যতম ভয়ংকর মরণঘাতী আগ্নেয় বিস্ফোরণ হিসেবে বিখ্যাত।
১৮৮৩ সালের ক্রাকাতোয়া অগ্ন্যুৎপাত | |
---|---|
আগ্নেয়গিরি | ক্রাকাতোয়া |
ধরণ | প্লিনীয় অগ্ন্যুৎপাত[1] |
স্থান | ক্রাকাতোয়া দ্বীপপুঞ্জ, সুন্দা প্রণালী, ওলন্দাজ পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ (বর্তমান ইন্দোনেশিয়া) ৬.১০২° দক্ষিণ ১০৫.৪২৩° পূর্ব / -6.102; 105.423 |
VEI | ৬[2] |
প্রভাব | ২ কোটি টন গন্ধক (সালফার) নিঃসৃত হয়; পাঁচ বছরে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস হ্রাস। |
অগ্ন্যুৎপাতের পরে ভূগোলের পরিবর্তন |
ভূতাত্ত্বিকভাবে ইন্দোনেশিয়া ভূত্বকের একটি অধোগামী অঞ্চলে অবস্থিত, যেখানে ইন্দো-অস্ট্রেলীয় ভূত্বকীয় পাতটি এশীয় পাতটির সাথে উত্তরমুখী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। ইন্দো-অস্ট্রেলীয় মহাসামুদ্রিক পাতটি অপেক্ষাকৃত ভারী বলে এটি অপেক্ষাকৃত হালকা মহাদেশীয় এশীয় পাতটির নিচ দিয়ে পিছলে চলে গিয়েছে। ফলে দুই পাতের সন্ধিস্থলের ফাটল দিয়ে গলিত আগ্নেয় শিলা (ম্যাগমা) উপরে উঠে এসে বিভিন্ন আগ্নেয় দ্বীপের সৃষ্টি করে। ক্রাকাতোয়া দ্বীপটি বর্তমান জাকার্তা শহর থেকে ১৬০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত ছিল। খ্রিস্টীয় ৫ম বা ৬ষ্ঠ একটি বৃহৎ অগ্ন্যুৎপাতের মাধ্যমে ক্রাকাতোয়া ও এর আশেপাশের আগ্নেয় দ্বীপগুলির (লাং ও ভেরলাতান) সৃষ্টি হয়। আগ্নেয় জ্বালামুখটি সমুদ্রতলদেশে নিমজ্জিত ছিল। ১৬৮০ সালে একটি মধ্যম আকারের অগ্ন্যুৎপাত ঘটে এবং বেশির ভাগ মানুষ ধরে নিয়েছিল যে এটি মৃত আগ্নেয়গিরি হয়ে গেছে। ১৮৮৩ সালে এটিতে তিনটি শৃঙ্গ ছিল - উত্তরের সক্রিয় পেরবো-এওয়াতেন, মধ্যভাগের দানান এবং দক্ষিণ প্রান্তের সর্ববৃহৎ রাকাতা শৃঙ্গ। দ্বীপটির সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল সমুদ্রসমতল থেকে প্রায় ৮১৩ মিটার। ১৮৮৩ সালের ২০শে মে থেকে মানুষ পশ্চিম জাভা ও পরে সুমাত্রা দ্বীপে ভূকম্পন ও বিস্ফোরণের প্রতিবেদন করতে শুরু করে। এরপর সুন্দা প্রণালী অতিক্রমকারী জাহাজগুলিও আগ্নেয়গিরি থেকে উঠতে থাকা ১০ কিলোমিটার উঁচু ধোঁয়া ও ভস্মের মেঘ দেখার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয়। এসময় অনেক ইউরোপীয় পর্যটক ও বিজ্ঞানী জাহাজে করে এটি দেখতে আসে। স্থানীয়রা ভয় না পেয়ে এটিকে পটভূমিতে রেখে অনেক উৎসব পালন করে। এর পরে এটির আগ্নেয় কর্মকাণ্ডে সাময়িক বিরতি পড়ে। এরপর ১৯শে জুন আবারও আগ্নেয় সক্রিয়তা বৃদ্ধি পায় এবং মূলত ২৬শে আগস্টের দুপুর ১টা থেকে ২৭শে আগস্টের সকাল ১০টা পর্যন্ত প্রায় ২১ ঘণ্টা ধরে মূল অগ্ন্যুৎপাতগুলি ঘটে। ২৬শে আগস্ট প্রাথমিক বিরাট বিস্ফোরণগুলি ঘটে ও সংশ্লিষ্ট মহাজলোচ্ছ্বাস বা সুনামিগুলির সৃষ্টি হয়। ২৭শে আগস্ট সকালে একের পর এক চারটি বিশাল বিস্ফোরণ ঘটে। এর মধ্যে সকাল ১০টার দিকে সর্বশেষ প্রলয়ংকর বিস্ফোরণটি ঘটে, যাতে আগ্নেয় ভস্ম ও শিলা ৮০ কিলোমিটার ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত হয়। বিস্ফোরণের ফলে ৪৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ক্রাকাতোয়া দ্বীপটির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এবং চারপাশের ক্রাকাতোয়া দ্বীপপুঞ্জের বাকি ছোট দ্বীপগুলি ধ্বংস হয়ে ধসে গিয়ে একটি জ্বালামুখ গহ্বরের সৃষ্টি হয় ও সর্বশেষ একটি সুনামির সৃষ্টি হয়।
১৮৮৩ সালের ক্রাকাতোয়ার অগ্ন্যুৎপাতটির আগ্নেয় বিস্ফোরণ সূচক হল ৬। তাই এটি লিপিবদ্ধ ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী অগ্ন্যুৎপাতগুলির একটি হিসেবে স্বীকৃত। এটি দ্বারা নিঃসৃত শক্তির পরিমাণ ছিল ২০০ মেগাটন টিএনটির বিস্ফোরণের সমান। হিরোশিমাতে ফেলা পারমাণবিক বোমাটির তুলনায় এটি ১০ হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী ছিল। এর আগ্নেয় বিস্ফোরণের শব্দটি ছিল আক্ষরিক অর্থেই গগনবিদারী। হিসাব করা হয় যে উৎসের কাছে বিস্ফোরণের শব্দটির শক্তিমাত্রা ছিল ৩১০ ডেসিবেল, যা বিশ্বের লিপিবদ্ধ ইতিহাসের সবচেয়ে জোরালো প্রাকৃতিক শব্দ। তুলনায় ১৯৬১ সালে সোভিয়েত "ৎসার বোম্বা" নামক হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণের মাত্রা ছিল ২২৪ ডেসিবেল। এটি ক্রাকাতোয়া থেকে ৩১১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পার্থ শহরে এবং ৪৮০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভারত মহাসাগরের রদ্রিগেস দ্বীপে (মরিশাসের কাছে) শুনতে পাওয়া গিয়েছিল।[3] আগ্নেয় বিস্ফোরণের শব্দচাপ তরঙ্গটি গোটা পৃথিবীকে তিনবারের বেশি প্রদক্ষিণ করেছিল।[4]:৬৩ ধারণা করা হয় বিশ্বের জনসংখ্যার ১০% ব্যক্তি এই ক্রাকাতোয়ার আগ্নেয় বিস্ফোরণের শব্দটি নিজ কানে শুনতে পেয়েছিল। এটি ছিল মানব ইতিহাসের লিপিবদ্ধ সবচেয়ে জোরালো শব্দ, যা ১৬০ কিলোমিটার দূরে জার্কাতায় (তৎকালীন বাতাভিয়া) ১৭২ ডেসিবেল মাত্রায় শুনতে পাওয়া গিয়েছিল। অর্থাৎ জাকার্তার মানুষের কাছে মনে হয়েছিল তারা একটি রকেট উৎক্ষেপণ মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে আছে (১৮০ ডেসিবেল)। অগ্ন্যুৎপাত থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ব্রিটিশ নরহ্যাম ক্যাসেল জাহাজের নাবিকদের অর্ধেকের কানের পর্দা ফেটে গিয়েছিল; জাহাজের কাপ্তান তার দৈনন্দিন হিসাবের খাতায় (লগবুক) লেখেন যে মনে হচ্ছিল যেন শেষ বিচারের দিনের আবির্ভাব হয়েছে।
ক্রাকাতোয়া জনবসতিহীন ছিল বলে আগ্নেয় শিলা, গলিত ম্যাগমা প্রবাহ ও বিষাক্ত গ্যাসের কারণে মৃতের সংখ্যা ছিল হাজার চারেক। কিন্তু এটির দ্বারা সৃষ্টি সুনামি বা মহাজলোচ্ছ্বাসগুলি ছিল মূল ঘাতক। এগুলির উচ্চতা ৪০ মিটার (১৩১ ফুট) পর্যন্ত চলে গিয়েছিল, যেগুলি উপকূলীয় এলাকাগুলিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ও হতাহতের কারণ হয়। সুনামির ঢেউ বড় বড় জাহাজগুলিকে সমুদ্র সমতলের ১০ মিটার উচ্চতায় উঠিয়ে নিয়ে উপকূল থেকে ৩ কিলোমিটার অভ্যন্তরে সেগুলিকে আছড়ে ফেলে। সুনামিতে জাভা ও সুমাত্রা দ্বীপের ১৬৫টি (মতান্তরে ২৫০ থেকে ৪০০টি) উপকূলীয় গ্রাম সমুদ্রে তলিয়ে যায়। অগ্ন্যুৎপাত এবং সুনামির কারণে সর্বমোট কমপক্ষে ৩৬,৪১৭ ব্যক্তির মৃত্যু হয়। মৃতব্যক্তির সংখ্যার বিচারে এটি ছিল লিপিবদ্ধ ইতিহাসের ২য় সর্বোচ্চ প্রাণঘাতী ও বিধ্বংসী অগ্ন্যুৎপাত। কেবল ১৮১৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার তামবোরা অগ্ন্যুৎপাত এর চেয়ে বেশি মরণঘাতী ছিল। অগ্ন্যুৎপাতের পরের দিন ও সপ্তাহগুলিতে সারা বিশ্বব্যাপী এর তাৎপর্যপূর্ণ অতিরিক্ত প্রভাব অনুভূত হয়েছিল। আগ্নেয় বিস্ফোরণের ফলে বিপুল পরিমাণ (প্রায় ৬ ঘনকিলোমিটার আয়তনের) আগ্নেয় ভস্ম ও বায়বীয় বিক্ষেপ (অ্যারোসল) বায়ুমণ্ডলে উৎক্ষিপ্ত হয়। এটি প্রায় ৭ থেকে ৮ লক্ষ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে প্রায় ৩ দিন ধরে কালো ধূলিচাদরের অন্ধকারে ঢেকে রাখে, যা ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্তৃত । ঊর্ধ্ব বায়ুমণ্ডলে ভস্মমেঘের সূক্ষ্ম কণাগুলি পৃথিবীকে বেশ কয়েকবার প্রদক্ষিণ করে, ফলে পরবর্তী বেশ কয়েক বছর সূর্যালোকের প্রতিসরণের কারণে বিশ্বব্যাপী রঙবেরঙের সূর্যাস্ত দৃশ্যমান হয়, সূর্য ও চাঁদকে ঘিরে আপাতদৃষ্টিতে আলোকবলয়ের সৃষ্টি হয় এবং পৃথিবীর জলবায়ু সাময়িকভাবে শীতল হয়ে পড়ে। নিউ ইয়র্কে নভেম্বর মাসে এত রক্তিম সূর্যাস্ত হচ্ছিল, যে মানুষ মনে করেছিল কোথাও আগুন লেগেছে। ইংল্যান্ডে কবি গেরহার্ড ম্যানলি হপকিন্স সবজে-বেগুনি ও সোনালি রঙের ঝিলিমিলি মেঘ দেখার অভিজ্ঞতার কথা লিখে গেছেন। ভস্মগুলি সূর্যালোককে পৃথিবীতে পৌঁছাতে বাধা দেয়, ফলে পরবর্তী বছরে বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রায় অর্ধ ডিগ্রি সেলসিয়াস হ্রাস পায় এবং প্রায় ৫ বছরে পরে বৈশ্বিক তাপমাত্রা আবার স্বাভাবিক হয়।
ক্রাকাতোয়া আগ্নেয়গিরিটি ধ্বংস হয়ে গেলেও ১৯২৭ সালে জ্বালামুখ ধসগহ্বর থেকে আবার ধোঁয়া বের হতে শুরু করে এবং ১৯২৮ সালে সেখানে আবার একটি ছোট আগ্নেয় দ্বীপ জেগে ওঠে, যার স্থানীয় নাম দেওয়া হয় আনাক ক্রাকাতাউ (অর্থাৎ "ক্রাকাতোয়ার সন্তান")। বহু দশক ধরে এটি ছোট ছোট অগ্ন্যুৎপাত ঘটায়। এর বর্তমান উচ্চতা ২৬৬৭ ফুট। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ২২শে ডিসেম্বর একটি বৃহৎ আগ্নেয় বিস্ফোরণে আনাক ক্রাকাতাউয়ে অংশবিশেষ ধসে পড়ে এবং একটি স্থানীয় সুনামির সৃষ্টি হয়। সুনামির কারণে আশেপাশের দ্বীপগুলিতে ৪২৬ জনের বেশি ব্যক্তির ডুবে মৃত্যু হয়। ফলে আনাক ক্রাকাতোয়া ২১শ শতকের সবচেয়ে মরণঘাতী অগ্ন্যুৎপাতে পরিণত হয়।
ক্রাকাতোয়া ছিল প্রথম বৈশ্বিকভাবে প্রচারিত প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এর আগের দশকগুলিতে তারবার্তা (টেলিগ্রাফ) যন্ত্রের যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে সারা বিশ্ব সংযুক্ত হয়েছিল। তাই এটির অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা পরের দিনই সারা বিশ্বে প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল। এখান থেকেই এরকম মহাদুর্যোগের সংবাদ বিশ্বব্যাপী সম্প্রচারের প্রচলন শুরু হয়। এটিই ছিল আধুনিক যুগে বৈশ্বিক বিজ্ঞানী সম্প্রদায়ের দ্বারা ব্যাপকভাবে অনুসন্ধিত প্রথম বড় আকারের অগ্ন্যুৎপাত।