ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক ব্যবস্থা অথবা Geographic Co-ordinate System সংক্ষেপে GCS হল তিনটি স্থানাঙ্ক মানের সাহায্যে পৃথিবীর যেকোন স্থানের অবস্থান সুনির্দিষ্ট করার একটি ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার ফলে পৃথিবীর যেকোন স্থানের একটি অনন্য স্থানাঙ্ক থাকে। স্থানাঙ্ক ব্যবস্থার তিনটি মাত্রা হচ্ছে অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা বা গভীরতা।

পৃথিবীর মানচিত্রে অক্ষাংশ (অনুভূমিক রেখা) এবং দ্রাঘিমাংশ (উল্লম্ব রেখা) দেখানো হয়েছে, Eckert VI projection; বড় সংস্করন (পিডিএফ, 1.8MB)

ইতিহাস

ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক ব্যবস্থা উদ্ভাবনের কৃতিত্ব সাইরিনের অধিবাসী 'ইরাটোসথেনিস' এর, যিনি খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীতে আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিতে 'জিওগ্রাফী' বইটি রচনা করেন।[1] এক শতাব্দী পরে, নিসিয়ার অধিবাসী 'হিপারকাস' সৌর উচ্চতার পরিবর্তে নাক্ষত্রিক পরিমাপ থেকে অক্ষাংশ নির্ধারণ করেন এবং চন্দ্রগ্রহণের সময় দ্বারা দ্রাঘিমাংশ নির্ধারণ করে এই সিস্টেমে উন্নতি সাধন করেন।

১ম বা ২য় শতাব্দীতে, টায়ারের অধিবাসী 'মারিনাস' একটি বিস্তত গেজেটিয়ার এবং প্রাইম মেরিডিয়ান থেকে পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে ক্যানারি বা কেপ ভার্দে এবং এশিয়া মাইনর এর রোডস দ্বীপের উত্তরে বিস্তৃত বিশ্বের মানচিত্র সংকলন করেছিলেন, যা গাণিতিকভাবে প্লট করা। টলেমি 'গ্রীষ্মের দিনের মাঝামাঝি সময়ে দৈর্ঘ্যের পরিপ্রেক্ষিতে' অক্ষাংশ পরিমাপের পরিবর্তে দ্রাঘিমাংশ এবং অক্ষাংশ উভয় বিবেচনার জন্য মারিনাসকে কৃতিত্ব দেন। টলেমি নিরক্ষরেখা থেকে অক্ষাংশ পরিমাপ করেন। [2]

৯ম শতাব্দীতে টলেমির কাজটি আরবি ভাষায় অনূদিত হবার পর, আল-খোয়ারিজমি 'বুক অফ দ্য ডেসক্রিপশন অফ দ্য আর্থ' এ ভূমধ্যসাগরের দৈর্ঘ্য সম্পর্কে মারিনাস এবং টলেমির ভুল সংশোধন করেন, যার ফলে মধ্যযুগীয় আরবি মানচিত্র টলেমির লাইনের ১০° পূর্বে 'প্রধান মেরিডিয়ান' লাইন ব্যবহার করত॥ ১৩০০সালে টলেমির লেখা 'ম্যাক্সিমাস প্ল্যানুডস' পুনরুদ্ধারের পর ইউরোপে গাণিতিক কার্টোগ্রাফি পুনরায় শুরু হয়। ১৪০৭ সালের দিকে জ্যাকোপো ডি'অ্যাঞ্জেলো ফ্লোরেন্সে পাঠ্যটি ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেন।

১৮৮৪ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক মেরিডিয়ান সম্মেলনের আয়োজন করে, যেখানে পঁচিশটি দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করে। তাদের মধ্যে বাইশ জন ইংল্যান্ডের গ্রিনউইচের রয়্যাল অবজারভেটরির দ্রাঘিমাংশকে শূন্য-রেফারেন্স লাইন হিসেবে গ্রহণ করতে সম্মত হয়। ডোমিনিকান রিপাবলিক, প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেয়, ফ্রান্স এবং ব্রাজিল বিরত থাকে।[3]

প্রথম ও দ্বিতীয় মাত্রা: অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমাংশ

Thumb
অক্ষাংশ ফাই (φ) এবং দ্রাঘিমাংশ ল্যাম্বডা (λ)

প্রাচীন ব্যাবিলিয়ন তত্ত্ব, যা পরে গ্রিক দার্শনিক ভুগোলবিদ টলেমি পরিবর্ধিত করেছেন, অনুসারে পূর্ণ বৃত্ত ৩৬০ ডিগ্রীতে (৩৬০°) বিভক্ত।

  • অক্ষাংশ (latitude) হচ্ছে স্থানাঙ্ক ব্যবস্থায়, কোন স্থান বিষুবীয় তলের কেন্দ্রের সাথে যে কোণ উৎপন্ন করে তার পরিমাপ। একই অক্ষাংশ বিশিষ্ট সকল বিন্দুকে যোগ করে যে রেখা পাওয়া যায় সেটি ভূপৃষ্ঠের উপরে অবস্থিত একটি বৃত্ত এবং বিষুবীয় অঞ্চলের পরিধির সাথে সমান্তরাল। পৃথিবীর দু মেরুতে এই রেখাগুলো বিন্দুবৃত্ত গঠন করে। প্রতিটি মেরুর অক্ষাংশের পরিমাপ হচ্ছে ৯০ ডিগ্রী: উত্তর মেরু ৯০° উ; দক্ষিণ মেরু ৯০° দ। ০° সমান্তরাল অক্ষাংশকে বিষুব রেখা বলা হয়। এই রেখাটিই পৃথিবীকে উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে বিভক্ত করেছে
  • দ্রাঘিমাংশ (longitude) স্থানাঙ্ক ব্যবস্থার কেন্দ্রে পূর্বে বা পশ্চিমে, ভূপৃষ্ঠের কোন বিন্দু বিষুব রেখার সাথে উল্লম্ব কোন পরিধির (যা উত্তর ও দক্ষিণ মেরুকে ছেদ করেছে) সাথে যে কোণ উৎপন্ন করে তার পরিমাপ। একই দ্রাঘিমাংশের সমস্ত বিন্দুকে নিয়ে যে রেখা পাওয়া যায় তাদের বলে মেরিডিয়ান বা ভূ-মধ্য রেখা। প্রতিটি ভূ-মধ্য রেখা একটি অর্ধবৃত্ত কিন্তু কেউ কারো সমান্তরাল নয়। সংজ্ঞানুসারে প্রতিটি রেখা উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে মিলিত হয়। ঐতিহাসিকভাবে যে ভূ-মধ্য রেখাটি রয়াল অবজারভেটরি, গ্রীনউইচ (যুক্তরাজ্যের লন্ডনের কাছে) এর মধ্যে দিয়ে গেছে সেটিকে শূন্য-দ্রাঘিমাংশ বা প্রামাণ্য ভূ-মধ্য রেখা ধরা হয়।

এই দুটি কোণের মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠের যেকোন স্থানের আনুভূমিক অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব।

উদাহরণস্বরুপ ঢাকার অক্ষাংশ ২৩°৪২′০″ উত্তর এবং দ্রাঘিমাংশ ৯০°২২′৩০″ পূর্ব (২৩°৪২′০″ উত্তর ৯০°২২′৩০″ পূর্ব)। সুতরাং পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে বিষুবরেখার ২৩°৪২′০″ উত্তরে ও গ্রীনউইচ থেকে ৯০°২২′৩০″ পূর্বে অঙ্কিত কোন ভেক্টর রেখা ঢাকার মাঝ দিয়ে যাবে।

সাধারণত ডিগ্রীকে মিনিটে (এক ডিগ্রীর ৬০ ভাগের একভাগ, সংকেত ′ অথবা "m") এবং সেকেন্ডে (এক মিনিটের ৬০ ভাগের একভাগ, সংকেত ″ অথবা "s") ভাগ করেও প্রকাশ করা হয়। ডিগ্রী প্রকাশের কয়েকটি রীতি রয়েছে:

  • DMS ডিগ্রী:মিনিট:সেকেন্ড (49°30'00"-123d30m00s)
  • DM ডিগ্রী:মিনিট (49°30.0'-123d30.0m)
  • DD দশমিক ডিগ্রী (49.5000°-123.5000d), সাধারণত দশমিকের পর ৪ ঘর পর্যন্ত।

DM অথবা DMS থেকে DD তে পরিনত করতে ব্যবহার করতে হয়, দশমিক ডিগ্রী = ডিগ্রীর পূর্ণসংখ্যা + মিনিটকে ৬০ দিয়ে ভাগ করে প্রাপ্ত ভাগফল + সেকেন্ডকে ৩৬০০ দিয়ে ভাগ করে প্রাপ্ত ভাগফল। DMS সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় এবং মানচিত্র, গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা জিপিএস প্রভৃতিতে এটি দেখা যায়।

অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ বিভিন্ন স্থানাঙ্ক ব্যবস্থার জন্য বিভিন্ন হতে পারে। এরকম ভিন্ন স্থানাঙ্ক ব্যবস্থার উদাহরণ হচ্ছে WGS 84 যা সকল জিপিএস যন্ত্রপাতিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। সহজ ভাষায়, বিভিন্ন স্থানাঙ্ক ব্যবস্থার জন্য একই স্থানের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশের মান আলাদা হতে পারে।

তথ্যসূত্র

  1. McPhail, Cameron (2011), Reconstructing Eratosthenes' Map of the World (PDF), Dunedin: University of Otago, pp. 20–24, archived (PDF) from the original on 2 April 2015, retrieved 14 March 2015.
  2. Evans, James (1998), The History and Practice of Ancient Astronomy, Oxford, England: Oxford University Press, pp. 102–103, ISBN 9780199874453, archived from the original on 17 March 2023, retrieved 5 May 2020.
  3. Greenwich 2000 Limited (9 June 2011). "The International Meridian Conference". Wwp.millennium-dome.com. Archived from the original on 6 August 2012. Retrieved 31 October 2012

বহিঃসংযোগ

Wikiwand in your browser!

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.

Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.

Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.