শীর্ষ প্রশ্ন
সময়রেখা
চ্যাট
প্রসঙ্গ

ইয়ান ফ্লেমিং

উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ

ইয়ান ফ্লেমিং
Remove ads

ইয়ান ফ্লেমিং (ইংরেজি: Ian Fleming, পুরোনামঃ ইয়ান ল্যাংকেষ্টার ফ্লেমিং) (জন্মঃ ২৮ মে, ১৯০৮- মৃত্যুঃ ১২ অগাষ্ট ১৯৬৪) একজন বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখক, সাংবাদিক ও নৌ-গোয়েন্দা। ব্রিটিশ কাল্পনিক গোয়েন্দা চরিত্র জেমস বন্ড চরিত্রটি সৃষ্টির জন্য বিখ্যাত ছিলেন ফ্লেমিং। জেমস বন্ডের উপর মোট ১২ টি উপন্যাস লিখেন তিনি। ২০০৮ সালে টাইমস পত্রিকা অনুসারে ইয়ন ফ্লেমিংক “১৯৪৫ সালের পর সেরা ৫০ ব্রিটিশ লেখক”দের একজন।

দ্রুত তথ্য ইয়ান ফ্লেমিং, জন্ম ...

পুরো নাম ইয়ান ল্যাংকেস্টার ফ্লেমিং। জন্মেছিলেন খুব নাম করা ধনী পরিবারে। পারিবারিক ভাবে যোগসূত্র ছিল রবার্ট ফ্লেমিং এন্ড কোং নামের একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সাথে। তার বাবা ১৯১০ সাল থেকে হেনলে এর সংসদ সদস্য ছিলেন এবং পরবর্তীতে ১৯১৭ সালে পশ্চিম ফ্রন্টের যুদ্ধে মৃত্যু বরণ করেন। পড়াশোনা করেছেন ইটন, স্যান্ডহার্স্ট কলেজে এবং মিউনিখজেনেভার মত বিশ্ব বিদ্যালয়ে। লেখা লেখি শুরু করার আগে বেশ কয়েকটি চাকরিও করেছেন ফ্লেমিং।

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় ব্রিটেনের নৌ বিভাগের গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করতেন। তখনই ফ্লেমিং গোল্ডেন আই অপারেশনের পরিকল্পনাতে অংশ গ্রহণ করেন এবং পাশাপাশি নেতৃত্ব দেন ৩০ এসাল্ট ইউনিট এবং টি-ফোর্স নামের দুটি গোয়েন্দা বিভাগের। যুদ্ধের সময় এই সব কাজের অভিজ্ঞতা এবং সাংবাদিকতার পেশা তার জেমস বন্ড উপন্যাসে লেখার ক্ষেত্রে ব্যাপক সহায়ক হয়েছিল।

১৯৫২ সালে ফ্লেমিং বন্ডের প্রথম উপন্যাসটি লিখেন যার নাম ছিল ক্যাসিনো রয়্যাল বইটি ব্যাপক ভাবে সফলতা পায় এবং পাঠকদের চাহিদা পূরণের জন্য তিন তিনবার মুদ্রণে পাঠাতে হয়। ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৬৬ সালের মধ্যে তিনি একে একে লিখে ফেলেন বন্ড সিরিজের ১১ টি উপন্যাস এবং দুটি ছোট গল্পের সমগ্র। উপন্যাসের গল্প গুলো জেমস বন্ড নামের এক চরিত্র ঘিরে যে একটি গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করতো। যাকে আড়ালে আবড়ালে সবাই এম আই সিক্স নামেই চিনে। এছাড়াও ০০৭ (ডাবল ও সেভেন) বিশেষ কোডেও বন্ড সবার কাছে পরিচিত ছিল। আর পেশাগত পরিচয়ে সে ছিল রয়েল নেভাল ভলান্টিয়ার রিজার্ভ -এর কমান্ডার হিসেবে। সারা বিশ্বে প্রায় ১০ কোটি সংখ্যক বিক্রিত হওয়া বন্ড সিরিজের গল্প গুলো কাল্পনিক উপন্যাসের বইয়ের তালিকায় বেস্ট সেলিং সিরিজ। ফ্লেমিং চিট্টি-চিট্টি-ব্যাং-ব্যাং নামে বাচ্চাদের গল্পের বই এবং দুটি নন ফিকশন বই নিয়েও কাজ করেছেন। ২০১৮ সালেদ্যা টাইমস এর ক্রম অনুসারে ১৯৪৫ সাল থেকে "৫০ জন সেরা ব্রিটিশ লেখকের" মধ্যে ফ্লেমিং এর নাম ১৪ তম স্থানে জায়গা করে নেয়। ফ্লেমিং এর সৃষ্ট চরিত্রটি সিনেমার পর্দায় আসে ২৬ বার আর সে গুলোতে অভিনয় করেছেন ৭ জন নামকরা অভিনেতা।

অ্যান চার্টেলিস নামক এক মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন ফ্লেমিং। তবে আগে থেকেই লেখকের সাথেই প্রণয় সম্পর্কের কারণে দ্বিতীয় ভিসকাউন্ট রোদারমিয়ার তাকে তালাক দিয়েছিলেন। ফ্লেমিং এবং চার্টেলিসের একটি পুত্র সন্তান হয়। তার নাম ছিল ক্যাস্পার। ব্যক্তিগত জীবনে ফ্লেমিং ছিলেন অতিমাত্রায় ধূমপায়ী এবং মদ্যাসক্ত। আর এ বদ অভ্যাসের কারণেই হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে ৫৬ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন ১৯৬৪ সালে। জেমস বন্ডের দুটি বই তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় তত দিনে অন্যন্য লেখকরাও বন্ড উপন্যাস লেখা শুরু করে দিয়েছিল।

Remove ads

জীবনী

সারাংশ
প্রসঙ্গ

জন্ম এবং পরিবার

Thumb
গ্লেনেলগ এ যুদ্ধের স্মৃতি স্মারকে ভ্যালেন্টাইন ফ্লেমিংএর তালিকা ভুক্ত নাম

ইয়ান ল্যাংকেষ্টার ফ্লেমিং জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৮ সালের ২৮ মে লন্ডন শহরের অভিজাত এলাকা মেফেয়ারের ২৭ নাম্বার গ্রিন স্ট্রিটে[] তার মায়ের নাম ছিল ইভেলিন সেন্ট ক্রোইক্স এবং বাবার নাম ছিল ভ্যালেন্টাইন ফ্লেমিং। যিনি ১৯১০ থেকে ১৯১৭ পর্যন্ত ছিলেন হেনলের সংসদ সদস্য[][] ছোটবেলায় তিনি অক্সফোর্ডশায়ারের ব্রাজিয়ার্স পার্কে তাঁর পরিবারের সাথে খুবই অল্প সময়ের জন্য বসবাস করেছিলেন।[] তার দাদা ছিল স্কটিশ ফিন্যান্সার রবার্ট ফ্লেমিংয়, যিনি স্কটিশ আমেরিকান ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি এবং মার্চেন্ট ব্যাংক রবার্ট ফ্লেমিং এন্ড কোং-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা।[][]

১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হলে কুইনস অউন অক্সফোর্ডশায়ার হুসরস এর "সি" স্কোয়ার্ডন এ যোগ দিয়ে মেজর পদে উন্নীত হন ভ্যালেন্টাইন ফ্লেমিং[] ১৯১৭ সালের ২০ মে পশ্চিম ফ্রন্টে জার্মানদের গোলা বর্ষণের সময় তিনি নিহত হন। তার মৃত্যু সংবাদ লিখেছিলেন উইনস্টন চার্চিল যেটি দ্যা টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।[] কারণ আর্নিডালে এই পরিবারের বিশাল সহায় সম্পত্তি ছিল যার কারণে ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যু গ্লেনেলগ -এ যুদ্ধের শোক স্মৃতি হিসেবে স্মরণ করা হয়।[]

ফ্লেমিং এর বড় ভাই পিটার (১৯০৭-১৯৭১) একজন ভ্রমণ লেখক ছিলেন এবং অভিনেত্রী সেলিয়া জনসন- কে বিয়ে করেন।[] পিটার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গ্রেনাডিয়ার গার্ডদের সাথে কাজ করতেন। যাকে পরবর্তীকালে সহায়ক ইউনিট স্থাপনে সহায়তা করার জন্য কলিন গবিন্সের অধীনে পাঠানো হয়। এর পর নরওয়ে এবং গ্রীসে যুদ্ধ চলাকালে পরোক্ষভাবে অপারেশন গুলোতে অংশ নেন।[]

ফ্লেমিং এর ছোট আরো দুটি ভাই ছিল, মাইকেল (১৯১৩-১৯৪০) এবং রিচার্ড (১৯১১-১৯৭৭)। ১৯৪০ সালের অক্টোবরে নরম্যান্ডিতে বন্দী হওয়ার পর মাইকেল আঘাত পেয়ে মারা যান। তখন তিনি অক্সফোর্ডশায়ার এবং বাকিংহামশায়ার লাইট ইনফ্যান্ট্রির হয়ে কাজ করছিলেন।[১০] বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার পর ফ্লেমিং এর মায়ের পক্ষের আরো একটি ছোট বোনের জন্ম হয়। তার নাম আম্রেলিস ফ্লেমিং (১৯২৫-১৯৯৯) তিনি ছিলেন সেলো বাদক। তার বাবা আগস্টাস জন ও ছিলেন একজন শিল্পী।[১১] জন এবং ইভেলিনের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের কারণেই আম্রেলিনের জন্ম হয় যেটি শুরু হয়েছিল ১৯২৩ সালে ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুর প্রায় ৬ বছর পর।[১২]

শিক্ষা এবং শুরুর দিকের জীবন

১৯১৪ সালে ফ্লেমিং ডার্নফোর্ড স্কুলে শিক্ষা জীবন শুরু করেন, যেটি ছিল ডোরসেট এ অবস্থিত আইল অফ পুর্বেকের একটি প্রিপারেটরি স্কুল[১৩][] ডার্নফোর্ডের জীবন তিনি খুব একটা সয়ে নিতে পারেন নি। সেখানের খাবার দাবারেও তার রুচি ছিল না যার ফলে শারীরিক সমস্যা সহ নানা ধরনের জটিলতার সম্মুখীন হন তিনি।[১৩]

Thumb
ইটন কলেজ, ফ্লেমিং এর প্রাক্তণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১৯২১ থেকে ১৯২৭।

১৯২১ সালে ফ্লেমিং ইটন কলেজে উত্তীর্ণ হন। একাডেমিক পড়াশোনায় তেমন ভাল ফলাফল না পেলেও খেলাধুলায় ছিলেন দক্ষ এবং ১৯২৫ এবং ১৯২৭ পর পর দু বছর ধরে তিনি ভিক্টর লর্ডোরাম ("খেলাধূলার বিজয়ী") উপাধী ধরে রাখেন।[১৫] সে সময়ে তিনি দ্যা ওয়েভার্ন[] নামের একটি স্কুল ম্যাগাজিনও সম্পাদনা করতেন। ইটনে তার চালচলন এবং মানসিকতার সাথে অমিলের কারণে গৃহকর্তা ই.ভি. স্লাটারের সাথে শুরু হয় তার মনোমালিন্য। এমনকি তার চুলের তেল থেকে শুরু করে গাড়ির মালিক হওয়া এবং নারী সঙ্গ কোন কিছুই পছন্দ ছিল না তার।[১৩]

স্লাটার ফ্লেমিং এর মা কে রাজি করিয়ে এক টার্ম বাকি থাকতেই ক্যারামার কোর্সের জন্য তাকে ইটন থেকে সরিয়ে দিলেন। যাতে করে স্যান্ডহার্স্ট এর রয়্যাল মিলিটারি কলেজে পড়ার সুযোগ পাওয়া সহজ হয়।[][১৩] এক বছরেরও কম সময়ে তিনি সেখানে ছিলেন এবং ১৯২৭ সালে গনোরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে খালি হাতেই সেখান থেকে চলে আসেন।[১৫]

১৯২৭ সালে ফ্লেমিংকে পররাষ্ট্র দপ্তরেসম্ভাব্য প্রবেশের প্রস্তুতির জন্য তার মা তাকে অস্ট্রিয়ার কিটজবুহেলের টেনারহফে পাঠিয়ে দেন। এটি ছিল অ্যাডলারিয়ান শিষ্য এবং প্রাক্তন ব্রিটিশ গুপ্তচর এরনান ফোর্বস ডেনিস এবং তার ঔপন্যাসিক স্ত্রী ফিলিস বটম দ্বারা পরিচালিত একটি ছোট বেসরকারি স্কুল।[১৬] সেখানে কিছুটা ভষা রপ্ত করে তিনি মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় এবং জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করেন।[] জেনেভায় থাকাকালীন ফ্লেমিং মনিক পঞ্চুদ ডি বোটেন্সের সাথে একটি প্রণয়ে আবদ্ধ হন এবং ১৯৩১ সালে ছোট পরিসরে দাম্পত্য জীবন শুরু করেন।[১৭][] তবে এতে তার মা বাঁধ সাধেন এবং সম্পর্কটি ছিন্ন করতে বাধ্য করেন।[১৯] এর পর পররাষ্ট্র দপ্তরে আবেদন করলে সে পরীক্ষায়ও পাশ করতে পারেন নি তিনি। তার মা আবারও তার কাজে হস্তক্ষেপ করেন এবং রয়টার্স সংবাদ সংস্থার প্রধান স্যার রোডেরিক জোন্সকে হাত করেন। ১৯৩১ সালে অক্টোবরে তাকে কোম্পানির উপ-সম্পাদক এবং সাংবাদিক পদ নিয়োগ দেওয়া হয়।[] ১৯৩৩ সালে ফ্লেমিং মস্কোতে থাকাকালীন ব্রিটিশ কোম্পানি মেট্রোপলিটন-ভিকার্স থেকে ছয় প্রকৌশলীর স্তালিনবাদী শো ট্রায়াল এর সংবাদ সংগ্রহের কাজ করেন।[২০] সে সময়েই তিনি সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী জোসেফ স্তালিনের সাথে সাক্ষাৎকারের জন্য আবেদন করেন এবং ব্যক্তিগতভাবে স্বাক্ষরিত একটি নোট পান যেটিতে তিনি উপস্থিত থাকছেন না বলে দুঃখ প্রকাশ করেন। যা তাকে বেশ বিস্মিত করেছিল।[২১]

১৯৩৩ সালের অক্টোবরের দিকে ফ্লেমিং পারিবারিক চাপে ভেঙ্গে পড়েন এবং ফাইন্যান্সিয়ার্স কুল অ্যান্ড কোং নামক একটি প্রতিষ্ঠানে হয়ে ব্যংকিং পেশা শুরু করেন।[২০] ১৯৩৫ সালের দিকে তিনি বিশপসগেটের রো এবং পিটম্যানে স্টকব্রোকার হিসেবে চলে যান।[২১] ফ্লেমিং এ দুটি পেশার একটিতেও সফল হতে পারেননি।[২২][২০] ১৯৩৯ সালের শুরুর দিকে ফ্লেমিং অ্যান ও'নীলের (নি চার্টারিস) সাথে একটি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। তিনি তৃতীয় ব্যারন ও'নীল[./ইয়ান_ফ্লেমিং#cite_note-FOOTNOTELycett199696-27 [24]] এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন এবং একই সাথে ডেইলি মেইলের মালিক লর্ড রথারমেরের উত্তরাধিকারী এসমন্ড হারমোসওয়ার্থের সাথেও তার প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল।[২৩]

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ

Thumb
দ্যা এডমিরালটি, যেখানে ফ্লেমিং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নৌ গোয়েন্দা বিভাগের হয়ে কাজ করতেন

১৯৩৯ সালের মে মাসের দিকে রয়্যাল নেভীর নৌ গোয়েন্দা পরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল জন গডফ্রের তাকে তার ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করেন। ১৯৩৯ সালের আগস্ট মাসের মধ্যে তিনি প্রতিষ্ঠানের হয়ে পুরো দমে কাজ শুরু করেন।[২৪] তার সাংকেতিক নাম ছিল "১৭এফ"[২৫] এবং অ্যাডমিরালটির ৩৯ নাম্বার রুমে কাজ করতেন যেটি এখন রিপলি ভবন নামে পরিচিত।[২৬] ফ্লেমিং এর আত্মজীবনী লেখক অ্যান্ড্রু লিসেট উল্লেখ করেছিলেন যে এই পদটির জন্য ফ্লেমিং এর "আহামরি কোন যোগ্যতা" ছিল না।[] এই চাকরির সুবাদেই ১৯৩৯ সালের জুলাইতে[২৪] ফ্লেমিং রয়্যাল নেভাল ভলান্টিয়ার রিজার্ভ এ প্রাথমিকভাবে লেফটেন্যান্ট[./ইয়ান_ফ্লেমিং#cite_note-FOOTNOTELycett1996101-31 [28]] হিসেবে সুপারিশ প্রাপ্ত হন এবং কয়েক মাসের মধ্যেই লেফটেন্যান্ট কমান্ডার হিসেবে উত্তীর্ণ হন।[২৭]

গডফ্রের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে ফ্লেমিং এর মূল্যায়ন অসাধারণ হওয়ায় প্রশাসনে চোখে সে ছিল সেরা।[] গডফ্রের চরিত্র কিছুটা সমালোচিত ছিল কারণ তিনি সরকারি গন্ডির মধ্যেই নিজের শত্রু তৈরি করে ফেলেছিলেন।

তিনি প্রায়ই ফ্লেমিংকে সরকারের যুদ্ধকালীন প্রশাসনের অন্যান্য অংশের সাথে সমঝোতা করতে ব্যবহার করতেন। যেমন গোপন গুপ্তচর বৃত্তি, পলিটিক্যাল ওয়ারফেয়ার এক্সিকিউটিভ, স্পেশাল অপারেশন এক্সিকিউটিভ (এসওই), যৌথ গোয়েন্দা কমিটির কাজ সহ প্রধানমন্ত্রীর কর্মচারীদের সাথে যোগাযোগ ইত্যাদি কাজের ক্ষেত্রে।[২৮]

১৯৩৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর যুদ্ধ শুরুর পর পরই গডফ্রে একটি স্মারক লিপি ছাপান যেটি ঐতিহাসিক বেন ম্যাকিনটায়ারের মতে "হলমার্কের সবাই লেফটেন্যান্ট কমান্ডার ইয়ান ফ্লেমিং এর উপর ক্ষিপ্ত।[২৯] এটাকে ট্রুট মেমো বলা হয় এবং যুদ্ধকালীন সময়ে শত্রুর সাথে প্রতারণার একটি কৌশল ফ্লাই ফিশিং এর সাথে তুলনা করা হয়।[২৯] মেমোতে এমন কিছু পরিকল্পনা ছিল যেগুলো এক্সিস শক্তিকে ইউ বোট এবং জার্মান জাহাজগুলোকে মূল্যবান খনির দিকে যেতে উষ্কে দিচ্ছিল।[৩০] তালিকার ২৮ নাম্বারে এমন একটি বিষয় ছিল যে মৃতদেহের উপর কিছু বিভ্রান্তকর কাগজ পত্র লাগানোর কথা ছিল যে গুলো খুঁজে পাবে শত্রু পক্ষ। এই পরামর্শটি অনেকটা অপেরাশন মিনস মিট এর মত ছিল যেটি ১৯৪৩ সালের দিকে উত্তর আফ্রিকার কাছে ইতালির উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অগ্রাসন আড়াল করার জন্য চার্লেস চোলমন্ডোলি ১৯৪২ সালের অক্টোবরে করেছিল।[৩১] ট্রাউট মেমোটির সুপারিশ পত্রের শিরোনাম ছিল: "একটি পরামর্শ (যেটি খুব একটা সুবিধার নয়)"[৩১] এবং এটিতে এভাবে বলা ছিল "নিম্নলিখিত পরামর্শটি বাসিল থমসনের একটি বইয়ে ব্যবহার করা হয়েছে: "একটি বিমানকর্মীর মৃতদেহ যার পকেটে পরিচয় পত্র আছে এমন কাউকে নষ্ট প্যারাসুটে করে উপকূলের কাছে ফেলে দেওয়া যেতে পারে। আমি জানি যে নেভাল হাসপাতালে লাশ পেতে কোনও অসুবিধা হবে না, তবে অবশ্যই এটি বেশি দিনের পুরানো হওয়া যাবে না।"[৩১]

১৯৪০ সালের দিকে ফ্লেমিং এবং গডফ্রে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের অধ্যাপক কেননেথ ম্যাসনের সাথে যোগাযোগ করেন এবং যে সব দেশ মিলিটারি অপারেশনের সাথে যুক্ত তাদের ভোগলিক প্রতিবেদন তৈরি করেন। আর এই প্রতিবেদনগুলিই নৌ গোয়েন্দা বিভাগ ভৌগোলিক হ্যান্ডবুক সিরিজের মূল ভিত ছিল যে গুলো ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যে তৈরি করা হয়েছিল।[৩২]

অপারেশন রুথলেস এমন একটি পরিকল্পনা যার উদ্দেশ্য ছিল জার্মান নেভিদের ব্যবহার করা এনিগমা কোডের খুঁটিনাটি বের করা। যার উৎস খুঁজে পাওয়া যায় একটি মেমো থেকে যেটি ফ্লেমিং লিখেছিল গডফ্রে কে ১৯৪০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। পরিকল্পনাটি ছিল এরকম একটি নাৎসি বোমারু বিমান "দখল" করা যার ভেতরে লুফটওয়াফের ইউনিফর্ম পরিহিত জার্মান-ভাষী বিমান কর্মী থাকবে এবং ইংলিশ চ্যানেলে এটিকে ক্র্যাশ করা। এরপর জার্মান উদ্ধারকারী আসলে বিমান কর্মীরা আক্রমণ করে তাদের নৌকা ও এনিগমা মেশিন ইংল্যান্ডে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে।[৩৩] কিন্তু ব্ল্যাচলে পার্কে অ্যালান টিউরিং এবং পিটার টোইনকে বিপদজ্জনক ভেবে এই মিশনটি আর চালানো হয়নি। ফ্লেমিং এর ভাতিজি লুসি যে ছিল রয়্যাল এয়ার ফোর্সের অফিসার, খুঁজে বের করল যে ইংলিশ চ্যানেলের হেইনকেলে বোমারু বিমান ফেলে দিলে খুব সম্ভবত সেটি অসম্ভব দ্রুততার সাথে ডুবে যেতে পারে।[৩৪]

ফ্লেমিং কর্নেল "ওয়াইল্ড বিল" ডোনভান, লন্ডন এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে গোয়েন্দা সহযোগিতা সম্পর্কিত রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের বিশেষ প্রতিনিধি এর সাথেও কাজ করেছিলেন।[৩৫] ১৯৪১ সালের মে মাসে ফ্লেমিং গডফ্রেকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসেন, যেখানে তিনি তথ্য সমন্বয়কারী অফিস, যে বিভাগটি স্ট্র্যাটেজিক সার্ভিসেস অফিসে পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত সিআইএ হয়ে যায় সে বিভাগের নীল নকশা তৈরির কাজে সহায়তা করেছিলেন।[৩৬]

অ্যাডমিরাল গডফ্রে ১৯৪১ এবং ১৯৪২ সালের মধ্যে ফ্লেমিংকে অপারেশন গোল্ডেন আই এর দায়িত্বে নিযুক্ত করেন। গোল্ডেন আই এর পরিকল্পনাটি ছিল জার্মান এলাকা দখল করার জন্য স্পেনীয় একটি গোয়েন্দা অবকাঠামো বজায় রাখা।[৩৭] ফ্লেমিংয়ের পরিকল্পনা ছিল জিব্রালটারের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা এবং নাৎসিদের বিরুদ্ধে নাশকতা মূলক অভিযান চালানো।[৩৮] ১৯৪১ সালে তিনি ডোনভানের সাথে সাথে সমঝোতা করেন যাতে করে জার্মানরা সমুদ্র উপকুলে প্রভাব খাটাতে না পারে। [৩৯]

৩০ সদস্যের এসাল্ট ইউনিট

১৯৪২ সালের দিকে ফ্লেমিং কমান্ডোদের একটি দল গঠন করেন যেটি ৩০ জনের কমান্ডো দল বা ৩০ এসাল্ট ইউনিট (30AU) নামে পরিচিত। এটি ছিল বিশেষজ্ঞ গোয়েন্দা সেনাদের সমন্বিত একটি বিশেষ দল।[৪০] 30AU এর কাজ ছিল আক্রমণের প্রথম ভাগে থাকা, কখনো কখনো একদম সামনে আগে থেকে টার্গেট করা শত্রু পক্ষের হেডকোয়ার্টার থেকে নথিপত্র দখল করে নেয়া।[৪১] এই দলটির ভিত্তি ছিল অন্য একটি জার্মান দল যার নেতৃত্ব দিচ্ছিল অটো স্কোরজেনি। যিনি এর আগে ১৯৪১ সালের মে মাসে সংঘটিত হওয়া ক্রেরেটের যুদ্ধেও এই ধরনের কাজে অভিজ্ঞ ছিলেন।[৪২] এই জার্মান সৈন্যদল ফ্লেমিং এর শেখানো সব থেকে সেরা জার্মান গোয়েন্দা দলের মধ্যে অসাধারণ ছিল।[৪৩]

ফ্লেমিং সদস্য দলটির সাথে মাঠে নেমে যুদ্ধ করেননি, কিন্তু নির্বাচিত কিছু লক্ষ্যে এবং পিছন থেকে অপারেশন পরিচালনা করে গেছেন।[৪২] এটি গঠনের সময় ৩০ সদস্যই যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে এটি প্রায় পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পায়।[৪৩] ইউনিটটি অন্যান্য কমান্ডো ইউনিটের লোক দ্বারা পূর্ণ ছিল, এবং এসওই সুবিধায় কোন ধরনের অস্ত্র ছাড়া যুদ্ধ, নিরাপদ ক্র্যাকিং এবং লক-পিকিং- এ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ছিল।[৪২] ১৯৪২ সালের শেষের দিকে ক্যাপ্টেন (পরে রিয়ার-অ্যাডমিরাল) এডমন্ড রাশব্রুক নৌ গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হিসেবে গডফ্রের স্থানে নিযুক্ত হন, এবং সংগঠনটিতে ফ্লেমিং এর প্রভাব কমে যায়। যদিও তিনি 30AU -এর উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখেন।[] ফ্লেমিং ইউনিটের সদস্যদের কাছে জনপ্রিয়তা পান নি, কারণ তারা তার মত করে নিজেদের "রেড ইন্ডিয়ান" বলে পরিচয় দিতে তারা খুব একটা পছন্দ করত না।[৪৪]

১৯৪৪ সালে নরম্যান্ডিতে অবতরণের আগে, 30AU এর অধিকাংশ অপারেশন ছিল ভূমধ্যসাগরে। সেই সাথে এটা সম্ভব ছিল যে এনিগমা মেশিন এবং এর অন্যন্য উপাদানের জন্য তারা গোপনে একটি ব্যর্থ ডিপে অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিল। ফ্লেমিং ৭০০ গজ দূরে তীরে এইচএমএস ফার্নিতে বসে এই অভিযানের উপর নজর রাখছিল।[৪৫] সিসিলি এবং ইতালিতে তাদের সাফল্যের কারণে 30AU নৌ গোয়েন্দাদের কাছে তারা ব্যাপকভাবে বিশ্বস্ত হয়ে উঠে।[৪৬][৪৭]

১৯৪৪ সালের মার্চ মাসে অপারেশন ওভারলর্ড এর জন্য রয়েল নেভি ইউনিট গোয়েন্দাদের প্রস্তুতি তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ফ্লেমিং কে দেয়া হয়।[৪৮] ১৯৪৪ সালের ৬ জুলাই তাকে 30AU এর প্রধাণ করে দেওয়া হলেও তিনি পুরোপুরি নিজেকে এর সাথে জড়াননি।[৪৯] ওভারলর্ড এর পরে এবং মধ্যবর্তী সময়টাতেই তিনি 30AU পরিদর্শন করে। বিশেষ করে চেরবুর্গে একটি হামলার পর তিনি কিছুটা উদ্বিগ্ন ছিলেন যে এই বিশেষ সদস্যের দলটিকে বিশেষ গোয়েন্দা দল হিসেবে ব্যবহারের পরিবর্তে নিয়মত কমান্ডোর মত ব্যবহার করা হচ্ছিল। এই জিনিসটি দলটির বিশেষ দক্ষতাকে নষ্ট করছিল সেই সাথে অপারেশনে তাদের নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছিল। এই দক্ষ দলটিকে এই ধরনের কাজে ব্যবহার করা যুক্তিসঙ্গত নয় এবং গোয়েন্দা কার্যক্রমে তাদের সংগ্রহিত তথ্য গুলোকেও হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছিল। এরপরে, এই ইউনিটগুলির পরিচালনা সংশোধন করা হয়।[৪৬] তিনি এই দলটির উপর জার্মানির তাম্বাচ ক্যাসলে স্থানান্তরের পরেও চোখ রাখেন যা পরবর্তীটে ১৮৭০ সালে জার্মান নৌ বাহিনীর হাতে চলে যায়।[৫০]

১৯৪৪ সালের ডিসেম্বরের দিকে ফ্লেমিং নৌ-গোয়েন্দা পরিচালকের পক্ষ হয়ে সুদূর পূর্ব দিকে গুপ্তচর হিসেবে ভ্রমণ করেন।[৫১] ভ্রমণের বেশিরভাগ সময় প্রশান্ত মহাসাগরে 30AU এর জন্য সুযোগ সুবিধা খোঁজার কাজে ব্যয় করা হয়। জাপানিজদের আত্মসমর্পণের কারণে দলটির কার্যক্রম অনেকটা সীমিত হয়ে আসছিল।[৫২]

টি-ফোর্স

Thumb
গোল্ডেনআই, এখানেই ফ্লেমিং বন্ড সিরিজের সব গুলো গল্প লিখেছেন

30AU এর অভূত সাফল্যের কারণে ১৯৪৪ সালের আগস্ট মাসে আরেকটি "টার্গেট ফোর্স" প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যেটি টি-ফোর্স হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। লন্ডনের দ্য ন্যাশনাল আর্কাইভসে আয়োজিত সরকারী স্মারকলিপিতে এই ইউনিটের প্রাথমিক ভূমিকার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এভাবে: "টি-ফোর্স = টার্গেট ফোর্স, এর কাজ হচ্ছে- বড় শহর, বন্দর ইত্যাদির দখলের পরে যুদ্ধ ও গোয়েন্দা কর্মীদের সমন্বিত নথি, ব্যক্তি, সরঞ্জামাদি রক্ষা করা এবং সুরক্ষিত করা। এমনকি সেটা স্বাধীন দেশ কিংবা শত্রুপক্ষের দেশ হলেও।[৫৩]

ফ্লেমিং সেই কমিটির দায়িত্ব নিয়ে টি-ফোর্স ইউনিটের জন্য লক্ষ্য অর্জনের জন্য সদস্য বাছাই করেন এবং তাদের নাম "ব্ল্যাক বুকস" নামক একটি বইতে তালিকাভুক্ত করেন। যেটি ইউনিটের কর্মকর্তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। টি-ফোর্সের পদাতিক অংশটি গঠন হয়েছিল ৫ম ব্যাটালিয়ন, কিংস রেজিমেন্ট নিয়ে, যা দ্বিতীয় সেনাবাহিনীকে সমর্থন করেছিল।[৫৪] পারমাণবিক গবেষণাগার, গ্যাস গবেষণা কেন্দ্র এবং বিভিন্ন রকেট বিজ্ঞানী সহ ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর আগ্রহের লক্ষ্য অর্জনের দায়িত্ব ছিল দলটির। জার্মান কেইল বন্দরের দিকে অগ্রসরের সময় ইউনিটটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারের মধ্যে ছিল ভি-২ রকেটে ব্যবহৃত জার্মান ইঞ্জিনগুলির গবেষণা কেন্দ্রে মেসসরমিট মি ১৬৩ ফাইটার এবং উচ্চ-গতির ইউ-বোট।[৫৫] টি ফোর্সের ব্যবহৃত কলাকৌশল ফ্লেমিং পরবর্তীতে তার লেখায় ব্যবহার করে বিশেষ করে ১৯৫৫ সালের বন্ড উপন্যাস মুনার্কারে এর উল্লেখ পাওয়া যায়।[৫৬]

১৯৪২ সালে ফ্লেমিং জ্যামাইকার একটি অ্যাংলো-আমেরিকান গোয়েন্দা শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেন এবং সে সময়ে তার সফরকালে অবিচ্ছিন্ন ভারী বৃষ্টি সত্ত্বেও তিনি দ্বীপে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যাতে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়।[৫৭] তার বন্ধু ইভার ব্রাইস সেন্ট মেরি প্যারিশে একটি জমির জায়গা খুঁজে দিয়েছিলেন, যেখানে ১৯৪৫ সালে ফ্লেমিংয় একটি বাড়ি নির্মাণ করেন আর তার নাম দিয়েছিলেন গোল্ডেন আই।[৫৮] এই বাড়িটির নাম এবং যেখানে বসে তিনি উপন্যাস গুলো লিখতেন সেখানে ঘুরে ফিরে এসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। ফ্লেমিং তাঁর যুদ্ধকালীন অপারেশন গোল্ডেন আই[৫৯] এবং কারসন ম্যাককুলারসের এর কথা ১৯৪১ সালের উপন্যাস রিফ্লেকশন ইন দ্য গোল্ডেন আইয়ে উল্লেখ করেছিলেন। যেখানে আমেরিকান নৌবাহিনী দ্বারা ক্যারিবিয়ায় ব্রিটিশ নৌ ঘাঁটিগুলির ব্যবহারের বর্ণনা পাওয়া যায়।[৫৮]

১৯৪৫ সালের মে মাসে ফ্লেমিং কে চাকরি থেকে অবসরে পাঠানো হয়। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে আর এন ভি আর- এ ছিলেন এবং ১৯৪৭ সালের ২৬ জুলাই অন্য একটি পদে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) পদে পদোন্নতি পান। ডেনমার্ক দখলের সময় ডেনমার্ক থেকে ব্রিটেনে পালিয়ে যাওয়া ড্যানিশ কর্মকর্তাদের সহায়তায় তার অবদানের জন্য একই বছর (১৯৪৭) অক্টোবরে তাকে কিং ক্রিস্টিয়ান এক্স'স লিবার্টি মেডেল প্রদান করা হয়।[][৬০] অবশেষে লেফটেন্যান্ট পদমর্যাদায় আরএনভিআর এর তালিকা থেকে তার নাম অপসারণ করা হলে ১৯৫২ সালের ১৬ ই আগস্ট তার কর্মজীবন পুরোপুরি ভাবে শেষ হয়।[৬১]

যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থা

১৯৪৫ সালের মে তে ফ্লেমিং এর অবসরের শুরুতেই তিনি কেমসলে সংবাদ পত্র গ্রুপের বিদেশি ম্যানাজার হন তাদেরই একটি সংবাদ পত্র হচ্ছেদ্যা সানডে টাইমস।তার দায়িত্ব ছিল বিশ্বব্যাপী সংবাদ দাতাদের নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণ করা। এই চাকরীর চুক্তি মোতাবেক তিনি প্রতি শীতে তিন মাসের বিশাল একটা ছুটি পেতেন আর সে সময়টা তিনি কাটাতেন জ্যামাইকাতে।[] ১৯৫৯ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত পুরো দমে এই সংবাদ পত্রের জন্য কাজ করেন ফ্লেমিং,[৬২] কিন্তু এসবের পাশাপাশি প্রায় ১৯৬১ সাল পর্যন্ত তিনি নিবন্ধ লিখতেন এবং প্রতি মঙ্গলবারে সাপ্তাহিক আলোচনায় অংশ নিতেন।[৬৩][৬৪]

অ্যান চার্টারিসের প্রথম স্বামী যুদ্ধে মারা যাওয়ার পর তিনি আশা করেছিল ফ্লেমিং তাকে বিয়ে করবে কিন্তু ফ্লেমিং বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেন।[] ১৯৪৫ সালের ২৮ জুন, তিনি দ্বিতীয় ভিসকাউন্ট রোদারমেরেকে বিয়ে করেন।[২৩] তবুও চার্টারিস ফ্লেমিংয়ের সাথে তার সম্পর্ক চালিয়ে যান এবং তার বন্ধু এবং প্রতিবেশী নোল কাওয়ার্ডের সাথে দেখা করার অজুহাতে তার সাথে দেখা করতে জ্যামাইকাতে যেতেন। ১৯৪৮ সালে তিনি ম্যারি নামক এক মৃত কন্যা সন্তান প্রসব করেন। আর সে ছিল ফ্লেমিং এর প্রথম কন্যা সন্তান। ফ্লেমিং এর সাথে এই অবৈধ সম্পর্কের কারণে ১৯৫১ সালে রোদারমেরে চার্টারিস কে তালাক দিয়েছিল।[২৩] আর পরের বছর ১৯৫২ সালের ২৪ মার্চ এই দম্পতি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন জ্যামাইকাতে।[৬৫] বিয়ের ঠিক কয়েক মাস আগে তাদের ছেলে সন্তান ক্যাসপারের জন্ম হয় আগস্টে। বিয়ের সময় তারা দুজনেই ভিন্ন ভিন্ন প্রণয়ের সম্পর্কে জড়িত ছিলেন। ফ্লেমিং হিউ গাইটসেল নামক এক মহিলার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। তিনি ছিলেন শ্রমিক পার্টি এবং বিরোধী দলের নেতৃ[৬৬] এছাড়াও জ্যামাইকাতে তিনি ব্ল্যান্সে ব্ল্যাকওয়েল নামের এক প্রতিবেশীর সাথেও লম্বা সময় ধরে প্রণয়ের সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন। তিনি ছিলেন বিখ্যাত আইল্যান্ড রেকর্ড এর ক্রিস ব্ল্যাকঅয়েল এর মা।[৬৭]

১৯৫০

ক্যাসিনোর সুগন্ধীর ঘ্রাণ এবং ধোঁয়া এবং ঘাম ভোর তিনটায় মাথা ধরিয়ে দেয়। এর পরে তৈরি হয় জুয়ার নেশায় আসক্ত আত্মার ক্ষয় - লোভ এবং ভয় এবং স্নায়বিক উত্তেজনার একটি মিশ্র অনুভুতি - ধীরে ধীরে অসহনীয় হয়ে ওঠে এবং ইন্দ্রিয়গুলি জাগ্রত হয় এবং এ থেকে কেবলই মুক্তি পেতে চায়।

বইয়ের কয়েকটি লাইন ক্যাসিনো রয়্যাল

যুদ্ধ চলাকালীন সময় ফ্লেমিং সর্বপ্রথম বন্ধুদের সাথে রোমাঞ্চকর উপন্যাস লেখার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন[] আর ক্যাসিনো রয়্যাল লেখার দুমাসের মধ্যেই তার সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়।[৬৮] ১৯৫২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তিনি গোল্ডেন আই বইটি লেখার কাজে হাত দেন। তার সারাজীবনের অর্জিত অভিজ্ঞতা আর অসাধারণ কল্পনা শক্তিই ছিল তার অনুপ্রেরণা। পরে তিনি অবশ্য বলেছিলেন যে তার গর্ভবতী চার্টারিসের সাথে আসন্ন বিবাহের দুশ্চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতেই উপন্যাসটি লিখেছিলেন।[৬৯] আর এটিকেই তার সেরা কাজ বলে অভিহিত করেছিলেন।[৭০] তার পাণ্ডুলিপিটি লন্ডনে টাইপ করেছিলেন জোয়ান হাউয়ে (ট্র্যাভেল লেখক ররি ম্যাকলিনের মা), এবং দ্যা টাইমসে ফ্লেমিংয়ের এক লাল চুলের সেক্রেটারির উপরেই ভিত্তি করে মিস মানিপেনি চরিত্রটি আংশিকভাবে চিত্রিত হয়।[৭১] ক্লেয়ার ব্লানচার্ড নামক ফ্লেমিং এর এক প্রাক্তন বান্ধবী তাকে বইটি প্রকাশ না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন অন্তত প্রকাশ করলেও যাতে ছদ্মনামে করে।[৭২]

ক্যাসিনো রয়েলের চূড়ান্ত খসড়া পর্যায়ে, ফ্লেমিং তার বন্ধু উইলিয়াম প্লমারকে একটি কপি দেখতে দিয়েছিলেন এবং তিনি সেটিতে মন্তব্য করেছিলেন "আমি যতটুকু দেখেছি এখানে কোন রোমাঞ্চকর উত্তেজনার ছিটে ফোঁটাও নেই"।[৭৩] তারপরেও প্লমার বইটি পাঠক প্রিয়তা পেতে পারে ভেবে এর একটি কপি জনাথন কেপ প্রকাশনিতে পাঠিয়ে দিল। প্রথমে তারা উপন্যাসটি নিয়ে খুব একটা আগ্রহী ছিল না কিন্তু ফ্লেমিং এর ভাই পিটার প্রতিষ্ঠানটিকে বইটি প্রকাশের জন্য রাজি করান। পিটারের ভাইয়ের বই নিয়মিত এই প্রকাশনি থেকেই প্রকাশিত হয়।[৭৩] ১৯৫৩ সালের ১৩ এপ্রিল ক্যাসিনো রয়্যাল যুক্তরাজ্যে হার্ড কভারে প্রকাশিত হয়, যার দাম ছিল সেময়ের ১০ সিলিং এবং ৬ পেনি[৭৪] এর সাথে ফ্লেমিং এর নিজের হাতে করা একটি প্রচ্ছদও ছিল।[৭৫] এটি ব্যাপক ভাবে জনপ্রিয়তা পায় এবং তিন বার করে মুদ্রণে পাঠাতে হয় পাঠক চাহিদা মিটাতে।[৭৪][৭৫][৭৬]

উপন্যাসের মূল কেন্দ্রীয় চরিত্র হচ্ছে জেমস বন্ড যিনি MI6 নামক একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করে। বন্ড 007 নামক বিশেষ সংকেতেও পরিচিত ছিল আর তার পোষাকি পদবি ছিল রয়্যাল নেভাল রিজার্ভ এর একজন কমান্ডার। ফ্লেমিং তার চরিত্রটির নামটি একজন আমেরিকান পাখি বিশারদ জেমস বন্ড এর নামানুসারে করেন। তিনি ছিলেন ক্যারাবিয়ান পাখির উপর বিশেষজ্ঞ এবং বার্ডস অফ ওয়েস্ট ইন্ডিজ নামে তার একটি বিখ্যাত বইও আছে। ফ্লেমিং নিজেও পক্ষী প্রেমী ছিলেন।[৭৭] তার কাছে বন্ডের সেই বিখ্যাত বইয়ের একটি কপিও ছিল। পরবর্তী একটা সময়ে সেই পক্ষী বিশারদের স্ত্রীর কাছে এমনটাও বলেছিলেন যে এই এংলো ভাব আবেগ হীন কিন্তু পৌরষিক নামটি তার দরকার ছিল আর এরই ফলশ্রুতিতে উপন্যাসে জেমস বন্ড চরিত্রটির জন্ম দেন তিনি।[৭৮] ১৯৬২ সালের নিউ ইয়োর্কার এ দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এমটাও বলেছেন যে, "১৯৫৩ সালে যখন আমি প্রথম লেখাটি লেখি আমি চেয়েছিলাম বন্ড চরিত্রটি হবে অতি মাত্রায় ভাব আবেগ হীন, যার মধ্যে মজার কোন কিছুই থাকবে না। আমি তাকে একেবারেই কাঠ খোট্টা হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছিলাম যার ফলে যখন আমি গল্পের নায়কের নাম খুঁজছিলাম আমি ভেবেছি জেমস বন্ড নামটাই আমার শোনা সব থেকে রস কষ হীন নাম।"[৭৯]

ফ্লেমিং তার নেভাল গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত অবস্থায় যাদের সাথে কাজ করেছেন তাদের উপর ভিত্তি করেই তার চরিত্রটি বানিয়েছেন এবং এটা তিনি স্বীকারও করেছেন, "যুদ্ধের সময় আমি যত গুলো সিক্রেট এজেন্ট এবং কমান্ডোর সাথে কাজ করেছি তাদের সংমিশ্রণেই চিত্রিত করার চেষ্টা করেছি বন্ড চরিত্রটিকে।"[৮০] তাদের মধ্যে তার ভাই পিটার ও ছিল যাকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন।[৮০] তিনি যুদ্ধ চলাকালীন সময় নরওয়ে এবং গ্রিসে লাইনের পেছনে থেকে যুদ্ধ করেছিলেন।[] ফ্লেমিং ভাবতেন বন্ড চরিত্রটি সুরকার, সংগীতশিল্পী এবং অভিনেতা হোয়াজি কারমাইকেলের মত হবে কিন্তু অন্যান্যরা বিশেষ করে লেখক এবং ইতিহাসবিদ বেন ম্যাকিন্টায়ার এর মতে ফ্লেমিং এর নিজস্ব ব্যক্তিত্বই ফুটে উঠেছে বন্ড চরিত্রে।[৮১][৮২] উপন্যাসের বিশ্লেষণে বন্ডের নিষ্ঠুর কিন্তু সুদর্শন চেহারার থেকে বরং কালো চেহারারই প্রমান পাওয়া যায়। [৮৩]

ফ্লেমিং অবশ্য বাস্তব জীবনে ১৯৩০ সালে কিটজবহেল এ স্কিইং করতে করতে গুপ্তচর কনরাড ও'ব্রায়ান-ফ্রেঞ্চ, 30AU দলের সাথে কাজ করা প্যাট্রিক ডালজেল-জব এবং M16 এর প্যারিস শাখার স্টেশন প্রধান বিল "বিফাই" ডান্ডারডেল, যিনি সব সময় কাফ লিংক এবং হাতে সেলাই করা স্যুট পরে রোলস রয়েসে করে প্যারিসে ঘুরে বেড়াতেন প্রভৃতি ব্যক্তির মধ্যে বন্ডের ছায়া খুঁজে পেতেন।[৮০][৮৪] স্যার ফিটৎসর ম্যাকলিয়ান ও হতে পারেন বন্ডের অন্য একটি বাস্তব রুপ। তিনি যুদ্ধের সময় বালকানস -এ তার সাথেই M16 এর ডাবল এজেন্ট দুস্কো পপভ নামে কাজ করছিলেন।[৮৫] ফ্লেমিং অবশ্য তার নিজের অনেক বৈশিষ্ট বন্ডের চরিত্রে ফুটিয়ে তুলেছেন। যেমন গলফ খেলা, ভাঁজা ডিম খাওয়ার অভ্যাস, জুয়ার নেশা এবং একই ধরনের প্রসাধনীর ব্যবহার।[৪৩][৮৬]

ক্যাসিনো রয়্যাল প্রকাশিত হওয়ার পর ফ্লেমিং তার ছুটির দিন গুলো জ্যামাইকাতে কাটাতেন এবং সময়টাকে আরো একটি বন্ডের গল্প লেখার কাজে লাগাতেন।[] ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৬৬ সালের মধ্যে ১২ টি বন্ড উপন্যাস এবং দুটি ছোট গল্পের সংকলন প্রকাশিত হয়। শেষ দুটি (দ্যা ম্যান উইথ দ্যা গোল্ডেন গান এবংঅক্টোপুসি এন্ড দ্য লিভিং ডেলাইটস) প্রকাশিত হয় তার মৃত্যুর পর।[৮৭] গল্পের বেশিরভাগ পটভূমি ছিল ফ্লেমিং এর নেভাল ইন্টেলিজেন্স বিভাগের কাজের অভিজ্ঞতা বা স্নায়ু যুদ্ধের ঘটনা যে গুলো তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন।[৮৮] ফ্রম রাশিয়া, উইথ লাভ এর পটভূমিতে সোভিয়েত স্পেক্টর ডিকোডিং মেশিন ব্যবহার করে বন্ডকে ফাঁদে ফেলতে দেখা যায়। এই স্পেক্টরের এর যোগ সূত্র যুদ্ধের সময় জার্মান ইনিগমা মেশিনের সাথে সম্পর্কিত ছিল।[৮৯] অরিনেট এক্সপ্রেসের গুপ্তচরবৃত্তির গল্পটি ইউজিন কার্প এর একটি গল্প থেকে অনুপ্রাণিত। তিনি মার্কিন নৌ বিভাগের সাথে জড়িত ছিলেন এবং বুদাপোস্টের দিকে নজরদারি রাখতেন। তিনিই অরিয়েন্ট এক্সপ্রেস কে বুদাপোস্ট থেকে প্যারিসে নিয়ে আসেন ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারির দিকে। আর তার সাথে ছিল ইস্টার্ণ ব্লকে মার্কিন গোয়েন্দাগিরি ফাঁস করার মত মূল্যবান কিছু নথিপত্র। ইতোমধ্যে ট্রেনে থাকা সোভিয়েত ঘাতকরা কন্ডাক্টরকে নেশাগ্রস্থ করে এবং কার্পের মরদেহ সল্জবার্গের দক্ষিণে একটি রেলওয়ের সুড়ঙ্গ থেকে পাওয়া যায়।[৯০]

Thumb
হোয়াগি কারমাইকেল, যার ব্যক্তিত্বের মত করে বন্ড চরিত্রটি ফোটাতে চেয়েছিলেন ফ্লেমিং

ফ্লেমিং এর ব্যক্তি জীবনের পরিচিত নাম গুলোই বন্ডের গল্পে ব্যবহার করতেন। যেমন- স্কারামাঙ্গা, যে ছিল দ্যা ম্যান উইথ দ্যা গোল্ডেন গান এর প্রধান খলনায়ক। সে ছিল ইটনে ফ্লেমিং এর সহপাঠি আর তার সাথে ফ্লেমিং এর বেশ কয়েকবার মারামারিও হয়েছিল।[৮৮] গোল্ডফিঙ্গার, নামটি নেয়া হয়েছে মার্কিন স্থপতিবিদ এরনো গোল্ডিঙ্গারের নামানুসারে। তার কাজ কর্ম ফ্লেমিং একদমই সহ্য করতে পারতেন না।[৮৮] মুনওয়াকারের খলনায়ক স্যার হুগো ড্র্যাক্স এর নামটি ফ্লেমিং এর পরিচিত এডমিরাল স্যার রেজিনাল্ড আয়লমার রানফুরলি প্লাঙ্কেট-আর্নলে-এরলে-ড্রাক্স এর নামানুসারে রাখা হয়।[৯১] ড্রাক্সের সহকারী ক্রেবস হিটলারের শেষ চীফ অফ স্টাফের[৯২] নামেই নাম; এবং ডায়মন্ডস আর ফর এভার-এর একজন সমকামী খলনায়ক, "বুপি" কিড, ফ্লেমিং এর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং তার স্ত্রীর এক আত্মীয়- আর্থার গোর, অ্যারানের ৮ম আর্ল, যে তার বন্ধুদের কাছে বুপি নামে পরিচিত ছিল।[৮৮]

ফ্লেমিং এর প্রথম নন ফিকশন প্রবন্ধ ডায়মন্ড স্মাগলার্স প্রকাশিত হয় ১৯৫৭ সালের দিকে আর এটিই তার বন্ড উপন্যাস ডায়ামন্ডস আর ফর এভার এর মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।[৯৩] এর অনেকগুলোই ফ্লেমিং এর সাথে জন কোলার্ড এর সাক্ষাৎকার রূপে দ্যা সানডে টাইমস পত্রিকাতে উঠে এসেছে। তার আন্তর্জাতিক ডায়ামন্ড নিরাপত্তা সংস্থার একজন সদস্য হিসেবে আগে MI5 এর সাথে কজ করার অভিজ্ঞতা ছিল।[৯৪] বইটি যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র দু দেশেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।[৯৫]

প্রথম পাঁচটি বই (ক্যাসিনো রয়্যাল, লিভ এন্ড লেট ডাই, মুনার্কার, ডায়ামন্ডস আর ফর এভার এবং ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ)- এর জন্য ফ্লেমিং ব্যাপক ভাবে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছিলেন।[৯৬] কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালের মার্চের দিকে এটি নেতিবাচক রুপ নিতে থাকে। বিশেষ করে যখন বার্নার্ড বার্গনজি টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি নামক একটি ম্যাগাজিনে ফ্লেমিং এর কাজ কে যৌন উষ্কানি মূলক বলে আক্রমণ করেন।[৯৭] সেই সাথে এটাও লিখেন যে "বই গুলোতে কোন নৈতিকতা নেই"।[৯৭] প্রবন্ধটিতে ফ্লেমিংকে জন বুকান এবং রেমন্ড চ্যান্ডালের সাথে নৈতিক এবং সাহিত্যিক দিক থেকে তুলনা করা হয়েছে।[৯৮] এর ঠিক এক মাস পরেই ডঃ নো প্রকাশিত হয় এবং ফ্লেমিং সমালোচকদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন। বেন ম্যাকিনটায়ারের ভাষায় "তারা এক প্রকারে ফ্লেমিংকে ঘিরে ধরেন।"[৯৯] সবচেয়ে তীব্র সমালোচনাটি এসেছে নিউ স্টেটম্যান ম্যাগাজিনের পল জনসনের কাছ থেকে। যিনি তার বই নিয়ে মন্তব্য করেন "যৌনতা, অহংকারী মনোভাব এবং মানসিক বিকার" এবং এটাও বলেন যে "নিঃসন্দেহে বই গুলো আমার পড়া সবথেকে নোংরা বই।"[১০০] জনসন এটাও বলেছেন যে, "এক তৃতীয়ংশ পড়তেই বইটি হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলার তীব্র ইচ্ছা দমন করতে হয়েছে আমাকে।"[১০০] তবে জনসন স্বীকার করেছিলেন যে বন্ডের বইগুলোতে "কিছু বিষয় ছিল যে গুলোর সামাজিক গুরুত্ব আছে"। কিন্তু ডঃ নো-এর বর্ণিত জিনিস গুলো যেমন অস্বাস্থ্যকরতা, সম্পূর্ণ ইংরেজি এবং স্কুল ছাত্রের বেদনাদায়কতা, যান্ত্রিকতা, দু মুখো যৌন আকাঙ্ক্ষা সবকিছু সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।[১০০] জনসের মতে ডঃ নো তে তিনি মঙ্গল জনক কিছু খুঁজে পাননি। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "ফ্লেমিং সাহেবের কোন সাহিত্যিক দক্ষতাই নেই, বইয়ের গঠনগত দিক খুব একটা সুবিন্যাস্ত ছিল না এবং ঘটনা গুলো হুট হাট ভাবেই কাহিনীতে ঢুকানো হয়েছে এবং সে গুলো খাপছাড়া ভাবেই উপেক্ষিত হয়েছে।[১০০]

লিসেট এক প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছিলেন যে, বৈবাহিক সমস্যা এবং তার কাজ নিয়ে আক্রমনাত্মক মন্তব্যের পর ফ্লেমিং তার "ব্যক্তিগত এবং সৃজনশীল কাজ থেকে এক প্রকার দূরে সরে যান"।[] ডঃ নো প্রকাশিত হওয়ার আগে আগেই গোল্ড ফিঙ্গার লিখে ফেলেছিলেন। সমালোচনার পর পরই ফ্লেমিং ছোট গল্পের একটি সংকলণ ফর ইয়োর আইজ অনলি প্রকাশ করেন। যেটি কোন এক টিভি সিরিজের রুপরেখার আলোকে করা হলেও এটি ফলপ্রসূ হয়নি।[১০১] লিসেট এটাও উল্লেখ করেছিলেন যে ফ্লেমিং যখন টেলিভেশনের জন্য স্ক্রিপ্ট এবং ছোট গল্প লিখছিলেন তখন "ক্লান্তি এবং অবসাদ তার লেখার উপরে প্রভাব ফেলছিল"। আর এই খাপ ছাড়া ভাব বন্ডের গল্প গুলোতেও বেশ স্পষ্ট হয়।[১০২]

১৯৬০

১৯৬০ সালের দিকে কুয়েত তেল সংস্থা ফ্লেমিংকে দেশটির তেল শিল্প নিয়ে একটি বই লেখার সুপারিশ করেন। ফ্লেমিং এর লেখা স্টেট অব এক্সসাইটমেন্টঃ ইম্প্রেশন অব কুয়েত এর পান্ডুলিপিটি কুয়েত সরকার অনুমোদন দেননি এবং এটা প্রাকশিতও হয়নি। ফ্লেমিং এর মতে, "তেল সংস্থাটি বইটির অনুমোদন দিয়েছিল তবে তারা এর একটি মুদ্রিত স্ক্রিপ্ট কুয়েত সরকারের অনুমোদনের জন্য পাঠানো কর্তব্য মনে করেছিল। সংশ্লিষ্ট শেখ রা কিছুটা অপ্রত্যাশিত হালকা মন্তব্য এবং সমালোচনা করেছিলেন যে দেশটির সাহসিক অতীতের কথা উল্লেখ করেছেন বইতে সে গুলো তারা সভ্যতার খাতিরে এবং এর মূল উৎস তারা ভুলে যেতে চান।[১০৩]

ফর ইয়োর আইজ অনলি এর সাথে সাথেথান্ডারবল নিয়ে ফ্লেমিং কিছুটা হতাশায় পড়ে যান কারণ এগুলোর উপন্যাস থেকে স্ক্রিপ্ট নিয়ে বাকিদের সাথে মত্রই কাজ শেষ করেছেন তিনি। এই কাজটি শুরু হয়েছিল ১৯৫৮ সালের দিকে যখন ফ্লেমিং এর বন্ধু ইভার ব্রাইস তাকে তরুণ লেখক সিনেমা পরিচালক কেভিন মেকক্লোরির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। আর এই তিনজন মিলে ফ্লেমিং সহ ব্রাইস এর বন্ধু এরনেস্ট কুনিও মিলে আগে একটি স্ক্রিপ্টে কাজ করেছিলেন।[৯৫] অক্টোবরের দিকে মেক ক্লোরি অভিজ্ঞ চিত্রনাট্যকার জ্যাক হোয়াইটিংহামকে নব গঠিত দলটির সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।[১০৪] এবং ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বরের দিকে মেক ক্লোরি এবং হোয়াইটিংহাম ফ্লেমিং এর লেখা স্ক্রিপ্টটি পাঠিয়ে দেন।[১০৫] ম্যাকক্লোরির সাথে কাজ করার ব্যাপারে ফ্লেমিংয়ের অন্যরকম চিন্তা ভাবনা ছিল এবং ১৯৬০ এর জানুয়ারিতে এমসিএতে চিত্রনাট্য জমা দেওয়ার ব্যাপারে তার অভিপ্রায়টি ব্যাখ্যা করেন। তিনি এবং ব্রাইস সুপারিশ করেন ম্যাক ক্লোরি যাতে প্রযোজক হিসাবে কাজ করে।[১০৬] সেই সাথে তিনি মেক ক্লোরিকে এটাও বলেছেন যে এমসিএ যদি তার জড়িত থাকার কারণে সিনেমাটি প্রত্যাখ্যান করে তবে মেক ক্লোরির উচিত নিজেকে তাদের কাছে বিক্রি করে দেয়া, চুক্তি থেকে বেরিয়ে অথবা এর জন্য একটি মামলা করা।[১০৬]

১৯৬০ এর জানুমারি থেকে মার্চের মধ্যে গোল্ডেন আইতে কাজ করার সময় ফ্লেমিং থান্ডার বল উপন্যাসটি লিখে ফেলেন। যেটির চিত্র নাট্য আগেই তিনি, হোয়াইটিংহাম এবং মেক ক্লোরি মিলে আগেই লিখে ফেলেছিলেন।[১০৭] কিন্তু ১৯৬১ সালের মার্চে মেক ক্লোরি আগে আগেই লেখাটি পড়ে ফেলেন যার ফলে তিনি এবং হোয়াইটিংহাম অতিদ্রুত লন্ডনের উচ্চ আদালতে এটি অপ্রকাশিত রাখার আবেদন করেন।[১০৮] সে বছরেই নভেম্বরের দিকে আদালতের দুটি শুনানির পর ফ্লেমিং মেক ক্লোরিকে নিজেদের মধ্যে চুক্তি করার প্রস্তাব জানান এবং এটি আদালতের বাইরেই মীমাংসিত হয়। চিত্রনাট্যটির জন্য মেক ক্লোরি সাহিত্য এবং চলচ্চিত্রের অধিকার স্বত্ব লাভ করেন ফ্লেমিংকে দেয়া হয় উপন্যাসটির স্বত্ব। সেই সাথে জ্ঞাতার্থে এটিও ঘোষিত হয় যে "পুরো কাজটি মেক ক্লোরি, জ্যাক হোয়াইটিংহাম এবং লেখকের দ্বারা সৃষ্টি।"[১০৯]

ফ্লেমিং এর বইয়ের কাটতি বরাবরই ভাল ছিল তবে ১৯৬১ সালের দিকে কাকতালীয় ভাবে বইয়ের বিক্রি নাটকীয় ভাবে বাড়তে লাগলো। প্রকাশনার প্রায় ৪ বছর এবং ডঃ নোঃ এর সমালোচনার ৩ বছর পর ১৯৬১ সালের ১৭ মার্চের দিকে লাইফ নামক একটি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডির ১০টি পছন্দের বইয়ের একটি হচ্ছে ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ[১১০] কেনেডির সাথে ফ্লেমিং এর পূর্বে একবার ওয়াশিংটনে সাক্ষাৎ হয়েছিল।[৭৯] এই ধরনের প্রচার ফ্লেমিং এর বইয়ের বিক্রি এতই বেড়ে গেল যে ফ্লেমিং কে যুক্তরাষ্ট্রের সেরা থ্রিলার লেখক বানিয়ে দিল।[১১১][১১২] ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ কে ফ্লেমিং তার সেরা উপন্যাস মনে করেন এবং বলেন যে, "মজার ব্যাপার হচ্ছে আমার প্রতিটি বই সমাজের কেউ না কেউ পছন্দ করছে এবং কোন বই পুরোপুরো ফেলনা নয়।"[৮৯]

১৯৬১ সালের এপ্রিলের দিকে থান্ডার বলের দ্বিতীয় সংক্ষিপ্ত শুনানির ঠিক আগে আগে সানডে টাইমস এর নিয়মিত একটি সাক্ষাৎকারে থাকাকালীন ফ্লেমিং এর এর

ফ্লেমিং এর হার্ট এটাক হয়।[৬৩] যখন তিনি ধীরে ধীরে কিছুটা সুস্থ হলেন তখন ডাফ ডানবার নামক তার এক বন্ধু তাকে বিট্রিক্স পটার এর লেখা দ্যা টেল অফ স্কুইরেল নাটকিন এর একটি কপি পড়তে দেন এবং পরামর্শ দেন যে ফ্লেমিং প্রতিদিন সন্ধ্যায় তার ছেলে ক্যাসপারকে যে সব গল্প শোনায় সে গুলো ঘুমানোর আগে আগে লিখে ফেলতে পারে।[৬৩] পরামর্শটি ফ্লেমিং এর পছন্দ হলো এবং কাজটি হাতে নিয়ে তার প্রকাশক জোনাথন কেপ প্রতিষ্ঠানের মাইকেল হাওয়ার্ড কে মজা করে একটি চিঠি লিখেন। চিঠিতে লেখা ছিল যে, " এমন কোন সময় নেই যে আমি তোমার জন্য খাটছি না, এমনকি কবরের পাশে দাঁড়িয়েও আমি তোমার দাসত্ব করছি।" [১১৩] আর এর ফলস্বরূপ ফ্লেমিং এর বাচ্চাদের জন্য লেখা এক মাত্র উপন্যাস চিট্টি-চিট্টি-ব্যাং-ব্যাং। যেটি তার মৃত্যুর দু মাস পর ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয়।[১১৪]

১৯৬১ সালের জুনের দিকে ফ্লেমিং হ্যারি সাল্টজম্যান নামক এক ব্যক্তির কাছে ছয় মাসের জন্য তার চ্চলচিত্র, প্রকাশিত এবং সম্ভাব্য প্রকাশিত জেমস বন্ড উপন্যাস এবং ছোট গল্পের স্বত্বাধিকার বিক্রি করেছিল।[১০৮] সাল্টজম্যান আল্বার্ট আর. "কাবি" ব্রকোলির সাথে ইয়োন প্রোডাকশনস নামে একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গ ঠন করেন। যার সাহায্যে তারা কঠোর অনুসন্ধান চালিয়ে শন কনারি কে নিয়োগ করেন ছয়টি ছবির জন্য। পরে অবশ্য চুক্তি পাল্টিয়ে পাঁচটিতে আনা হয় তবে ঠিক হয় যে শুরুটা হবে ডঃ নো (১৯৬২) দিয়ে।[১১৫][১১৬] কনরির প্রদর্শন গুলো সাহিত্যেও বন্ড চরিত্রটির উপর প্রভাব ফেলে। ডঃ নো প্রকাশিত হওয়ার পর প্রথম বই ইউ অনলি লিভ টোয়াইস - ফ্লেমিং বন্ড চরিত্রটিতে কিছুট হাস্যরস বোধ যোগ করেন যেতি এর আগের গল্প গুলোতে ছিল না।[১১৭]

১৯৬৩ সালের নভেম্বর নাগাদ থ্রিলিং সিটিস[১১৮] নামক ফ্লেমিং এর আরো একটি নন ফিকশন বই প্রকাশিত হয়। এটি মূলৎ সানডে টাইমসে তার প্রকাশিত নিবন্ধ গুলোর পুনঃমুদ্রণ ছিল যে গুলোতে ফ্লেমিং ১৯৫৯ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত যেসকল শহরে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিশ্বের সে সব শহর[১১৯] সম্পর্কে নিজস্ব চিন্তাধারা তুলে ধরেন।[১২০] ১৯৬৪ সালের দিকে প্রযোজক নরম্যান ফেল্টন তার সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে টিভি সিরিজের জন্য একটি গোয়েন্দা সিরিজ লেখার অনুরোধ জানালে তিনি তাকে বিভিন্ন ধরনের ধারণা দিন। দ্যা ম্যান ফ্রম আ.ঙ্কে.ল সিরিজের জন্য দুটি চরিত্রের নাম ন্যাপোলিয়ন সলো এবং এপ্রিল ড্যান্সার ফ্লেমিং এর দেয়া ছিল।[১২১] যাইহোক, ইয়োন প্রোডাকশনস এর অনুরোধে ফ্লেমিং এই প্রজেক্ট থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন অন্যথায় বন্ডের চলচ্চিত্রের কাজে ব্যাঘাত ঘটতে পারে বা আইনী জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।[১২২]

১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে ফ্লেমিং তার সর্বশেষ ছুটি কাটাতে গোল্ডেন আই তে যান এবং সেখানেই দ্যা ম্যান উইথ দ্যা গোল্ডেন গানের প্রথম খসড়াটি লিখে ফেলেন।[১২৩] তবে এই বার তিনি তার লেখায় খুব একটা সন্তুষ্ট হলেন না এবং তার উপন্যাসের সম্পাদক উইলিয়াম প্লোমারকে এটি পুনঃরায় লেখার অনুরোধ জানান।[১২৪] বইটি নিয়ে ফ্লেমিং এর অসন্তুষ্টি ক্রমশই হতাশর দিকে রূপ নিতে থাকে এবং এটি পুনঃরায় লেখার কথা বিবেচনা করেন তিনি। কিন্তু প্লোমার তাকে আশ্বস্ত করে যে এটি প্রকাশ করা যাবে এবং পুনঃরায় লেখার কোন প্রইয়োজন নেই।[১২৫]

মৃত্যু

Thumb
ফ্লেমিংয়ের কবর ও স্মৃতিসৌধ, সেভেনহ্যাম্পটন, উইল্টশায়ার

প্রাপ্ত বয়স্ক হবার পর থেকেই ফ্লেমিং ছিলেন অতি মাত্রায় ধূমপায়ী এবং মদ্যপানে আসক্ত। আর এর ফলে হৃদ রোগেও ভুগছিলেন তিনি।[] ১৯৬১ সালের দিকে মাত্র ৫৩ বছর বয়সে হৃদ রোগে আক্রান্ত হন এবং সেরে উঠার চেষ্টাও করেন।[১২৮] ১৯৬৪ সালের ১১ আগস্ট, ক্যান্টারব্যারি হোটেলে থাকাকালীন রয়্যাল এস টি জর্জেস গলফ ক্লাবে দুপুরের খাবার খেতে যান এবং বন্ধুদের সাথে রুমে ফিরে আসার পর পরই তার মৃত্যু হয়। সে দিনটি তার জন্য অশুভই ছিল। কারণ খাবারের পর পরই খুব দ্রত সেদিন তার আরেকটি হার্ট এটাক হয়। অবশেষে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে ১৯৬৪ সালের ১২ আগস্ট ভোরের দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। সে দিনটিতেই ছিল তার ছেলে ক্যাসপারের ১২ তম জন্মদিন।[১২৯][১৩০] মৃত্যুর আগে শেষ কথা গুলো রেকর্ড করা ছিল সে গুলো ছিল এমবুলেন্স ড্রাইভারের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার।[১৩১] তিনি বলছিলেন, "আমি দুঃখিত তোমাদের কে ঝামেলায় ফেলে দেওয়ার জন্য। আমি জানিনা ইদানীং এত জানজটের মধ্যেও তোমরা কীভাবে এত দ্রুত গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছ।"[১৩২] ফ্লেমিংকে সুইন্ডনের নিকটে সেভেনহ্যাম্পটনের গির্জার সামনে কবর দেওয়া হয়েছিল।[১৩৩] তার উইলকৃত সম্পত্তির পরিমান ছিল প্রায় ৩,০২,১৪৭ পাউন্ড (২০১৯ সালের বর্তমান হিসাব মতে প্রায় ৬০,১্‌২৩৯ পাউন্ড[১৩৪])।[১৩৫]

ফ্লেমিং এর শেষ দুটি বই দ্যা ম্যান উইথ গোল্ডেন গান এবং অক্টোপুশি এবং দ্যা লিভিং ডে লাইটস তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়।[৮৭] দ্যা ম্যান উইথ দ্যা গোল্ডেন গান প্রকাশিত হয় ফ্লেমিং এর মৃত্যুর প্রায় ৮ মাস পর এবং এর পুরোটা ফ্লেমিং নিজে সম্পাদনা করে যেতে পারেননি।[১৩৬] এ কারণেই প্রকাশনা সংস্থা জনাথন কেপ বইটিকে খুব একটা বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি।[১৩৭] তবে প্রকাশকরা এর পাণ্ডুলিপি কিংসলে এমিস এর কাছে পাঠান যাতে করে অবসরে তিনি এটি পড়ে দিতে পারেন। তবে তার পরামর্শ অনুযায়ী এটি সংশোধিত হয়নি।[১৩৭] ফেল্মিং এর আত্মজীবনী লেখক হেনরি চ্যান্ডলার খেয়াল করে দেখলেন যে উপন্যাসটি খুব একটা ভাল ভাবে সমাদৃত হচ্ছে না বরং দুঃখজনক ভাবে সমালোচিত হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেন যে বইটি অর্ধ সমাপ্তিত আর সেই সাথে এর উপরে ফ্লেমিং এর নাম ছিল না।[১৩৮] অবশেষে বন্ড সিরিজের শেষ বই দুটি ছোট গল্প অক্টোপুশি এবং দ্যা লিভিং ডে লাইটস নিয়ে ১৯৬৬ সালের জুনের ২৩ তারিখ ব্রিটেনে প্রকাশিত হয়।[১৩৯]

১৯৭৫ সালের অক্টোবরে ফ্লেমিং এর ছেলে ক্যাসপার ২৩ বছর বয়সে অতি মাত্রায় ওষুধ সেবন করে আত্মহত্যা করে।[১৪০] তাকেও তার বাবার পাশের কবরে সমাদিত করা হয়।[১৩৩] ফ্লেমিং এর বিধবা স্ত্রী ১৯৮১ সালে মৃত্যু বরণ করে এবং তাকেও তার স্বামী এবং ছেলের পাশে সমাদিত করা হয়।[২৩]

Remove ads

লেখালেখি

সারাংশ
প্রসঙ্গ

জেমস বন্ড ধারাবাহিকের পরবর্তী লেখক রেমন্ড বেনসন উল্লেখ করেছিলেন যে ফ্লেমিং এর লেখা বই গুলোতে লেখা গুলো দুটি সময়ে দুটি বিশেষ ধাচে লেখা হয়েছে। ১৯৫৩ থেকে ১৯৬০ সালের বই গুলোতে "ভাব, চরিত্র, গল্পের প্লট এগুলোতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে আর ১৯৬১ থেকে ১৯৬৬ সালের বই গুলোতে দর্শকদের কল্পনা শক্তিকে কাজে লাগাতে উদ্ধুদ্ধ করেছে। বেনসনের যুক্তিতে ১৯৬১ সালের থান্ডার বল লেখার সময় ফ্লেমিং " গল্পকার গুরু" তে পরিণত হন।[১৪১]

জেরেমি ব্ল্যাক ফ্লেমিং এর সৃষ্ট বন্ড ধারাবাহিকটিকে এগুলোর খলনায়কের ভিত্তিতে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেন। আর এটিতে তিনি ফ্লেমিং এর সহপাঠী ক্রিস্টোফার লিন্ডার সমর্থন করেছিলেন।[১৪২] প্রথম দিকেরক্যাসিনো রয়্যাল থেকে শুরু করে ফর ইয়োর আইজ অনলি বই গুলোকে তিনি "ঠান্ডা স্নায়ু যুদ্ধের গল্প" হিসেবে শ্রেণী ভুক্ত করেন যে গুলোর প্রধান বিপরীত চরিত্র ছিল ছিল স্মার্শ[১৪৩] পূর্ব-পশ্চিমের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর আরো তিনটি উপন্যাস থান্ডার বল, অন হার ম্যাজেস্ট্রি সিক্রেট সার্ভিস এবং ইউ অনলি লিভ টোয়াইস এও একই জিনিস দেখা যায় যেখানে তার বিপরীত চরিত্র ছিল ব্লোফিল্ড এবং স্পেক্টার।[১৪৪][] অবশিষ্ট— দ্যা ম্যান উইথ দ্যা গোল্ডেন গান, অক্টোপুশি এন্ড দ্যা লিভিং ডে লাইটস এবং দ্যা স্পাই হু লাভ মি —বই গুলোকে ব্ল্যাক এবং লিন্ডার "ফ্লেমিং এর পরবর্তী গল্পের" বিভাগ হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করেন।[১৪৬]

ধরন এবং কৌশল

ফ্লেমিং তার নিজের লেখা নিয়ে এক মন্তুব্যে বলেছিলেন যে, "রহস্য গল্প হয়তো সাহিত্যের মধ্যে নাও পড়তে পারে তবে আমার লেখা দিয়ে এটি সম্ভব করেছি যে 'রহস্য গল্প সাহিত্য হিসেবেও পড়া যেতে পারে'।" এর উদাহরণ হিসেবে তুনি রেমন্ড চ্যান্ডলার, ড্যাশিয়েল হ্যামেট, এরিক এমব্লার এবং গ্রাহাম গ্রিনি এর নাম উল্লেখ করেন।[১৪৭] নিউ স্টেটসম্যানের উইলিয়াম কুক জেমস বন্ডের সমাপ্তি কে মনে করেন "ইংরেজি সাহিত্যের হালকা বিকৃত হলেও গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যের সমাপ্তি"। ছোটবেলায় ফ্লেমিং লেফটেন্যান্ট কর্নেল এইচ.সি ম্যাকনেইল (ওরফে "স্যাপার") এর রূপকথা বুলডগ ড্রামন্ড এবং জন বুকানের রিচার্ড হ্যানাই গল্পের খুব ভক্ত ছিলেন। এক সময় তিনি যুদ্ধ পরবর্তী ব্রিটেনের ফ্যাশনের সাথে তাল মিলিয়ে এইসব প্রাচীন অভিযানের গল্পের বই বাঁধাই এ বেশ পটু ছিলেন। বন্ডের গল্পেও তিনি জেট যুগের জন্য একটি বুলডগ ড্রামন্ড তৈরি করেছিলেন।[৮৬] আমবারটো ইকো মনে করেন মাইকি স্পিলেন এর আরো একটি প্রধান কারণ।[১৪৮]

১৯৬৩ সালের মে তে ফ্লেমিং বুকস এন্ড বুকমেন নামক এক ম্যাগাজিনে বন্ডের বই গুলোর লেখার পদ্ধতি সম্পর্কে লিখেছিলেনঃ " আমি সকালের দিকে টানা তিন ঘণ্টা লিখি এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে আরো এক ঘণ্টা লেখার কাজে ব্যয় করি। এই লেখার সময় টাকে আমি কোন কিছুই সংশোধন করিনা এমনকি দেখতেও যাই না আমি কি লিখেছি। আমার এই পদ্ধতি অনুসরণ করে আপনি দিনে ২,০০০ শব্দের মত লিখে ফেলতে পারবেন।" [১৪৯] বেনসন "ফ্লেমিং এর নিপুণতা" নিয়ে বলেছিলেন যে তিনি প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে এক ধরনের আখাংকা কে "হুক" হিসেবে ব্যবহার করেন যেটি পাঠকের উত্তেজনা বাড়ায় এবং সমনের দিকে টেনে নিয়ে যায়।[১৫০] এনথনি বারগেস এর মতে এই "হুক" জিনিস টি এক ধরনের সাংবাদিকতার ধরন যা "কোন কিছু বর্ণনা করতে গতিশীল করে" এবং পাঠককে খুব দ্রুত টানটান উত্তেজনার ঘটনা গুলো পড়ে ফেলতে উদ্বুদ্ধ করে।"[১৫১]

আমবার্তো ইকো কাঠামোগত দৃষ্টিকোণ থেকে ফ্লেমিং এর কাজ গুলোকে বিশ্লেষণ করেছেন, এবং এক ধরনের ধারাবাহিক বিপরীত দিককে চিহ্নিত করেছেন। যে গুলো তার গল্পের কাঠামো এবং আখ্যান তৈরি করে। এগুলোর মধ্যেঃ

ইকো আরো একটি জিনিস লক্ষ্য করেছিলেন আর সেটি হচ্ছে বন্ডের বিপরীত চরিত্র বা খলনায়ক গুলোর বেশির ভাগ ইউরোপীয়, স্লাভিক বা ভূমধ্যসাগরীয় আর সেই সাথে তারা মিশ্র সংস্কৃতির হয়ে থাকে তাদের উৎস নিয়ে কিছুটা জটিলতা থাকে।[১৫৩] ইকো এটাও খুঁজে বের করেছেন যে বিপরীত চরিত্র গুলো বেশীর ভাগই যৌন-আকাঙ্ক্ষা হীন অথবা সমকামী আর না হয় কোন সাংগঠনিক দলের নেতা অথবা ধনী।[১৫৩] এই একই জিনিসটি ব্ল্যাকের চোখেও ধরা পড়েছিল, " ফ্লেমিং তার লেখায় আহামরি কোন শত্রু ব্যবহার করেননি তার পরিবর্তে তিনি শারীরিক ভাবে বিকৃত অথবা ভিন্ন জাতি গোষ্টির কাউকে ব্যবহার করেছেন। এছাড়াও ব্রিটেনের ভিনদেশী এবং সেখানের কর্মচারী কাউকে বিপরীত চরিত্রে তুলে ধরেছেন। এই বর্ণবাদ কেবল বুচনের উপন্যাসের মতো দেশীয় রোমাঞ্চকর লেখালেখিতে একটি উল্লেখিত ধরণই প্রতিফলিত করে নি, সেই সাথে বিস্তৃত সাহিত্য সংস্কৃতিও তুলে ধরেছেন বটে।"[১৫৪] লেখক লুইস ওয়েলশকে লাইভ অ্যান্ড লেট ডাই উপন্যাসটিকে " শ্বেতাঙ্গ সমাজের কিছু বিড়ম্বনা হিসেবে" দেখেছেন। কারণ এতে নাগরিক অধিকার আন্দোলন কুসংস্কার এবং বৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল।[১৫৫]

ফ্লেমিং তার লেখায় খুব চেনা পরিচিত ব্র্যান্ডের নাম গুলো ব্যবহার করতেন এবগ্ন সেই সাথে প্রতিদিনের খুটি নাটি বিষয় গুলো ফুটিয়ে তুলে বাস্তবিক পরিবেশটি উপস্থাপন করতেন।[১৪৯]

কিংসলে অ্যামিস এটিকে "ফ্লেমিং এফেক্ট" হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন এবং এটিকে "তথ্যের কল্পনাপ্রসূত ব্যবহার" হিসাবে বর্ণনা করেছেন। যার মাধ্যমে বন্ডের বিশ্বের বিস্ময়কর চমকপ্রদ প্রকৃতি ... [কিছু] বাস্তবতার পরিচয় পাওয়া যায় অন্তত পক্ষে বাস্তবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। "[১৫৬]

মৌলিক ধরন

বিশ্বে ব্রিটেনের অবস্থান

বন্ডের নই গুলো যুদ্ধ পরবর্তী ব্রিটেনে লেখা তখনো সেখানে একটি সাম্রাজ্যবাদ শক্তি বিরাজমান।[১৫৭] ধারাবাহিকটি যখন ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ক্রমশ পড়ে আসছিল। সাংবাদিক উইলিয়াম কুক পর্যবেক্ষণ করেছিলেন যে "বন্ড ব্রিটেনের স্ফীত ও ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীন স্ব-প্রতিচ্ছবিতে প্রেরণা জাগিয়ে তোলে এবং ব্রিটানিয়া এখনও কিছুটা প্রভাব খাটাতে পারে এমন ভাবনা আমাদের আনন্দিত করে তোলে।"[৮৬] বেশ কয়েকটি উপন্যাসে ব্রিটিশ শক্তির এই অবক্ষয়কে তুলে ধরা হয়েছিল; বিশেষ করে ফ্রম রাশিয়া, উইথ লাভ উপন্যাসটিতে ডার্কো কেরিমের সাথে বন্ডের কথোপকথনে এমনটাই প্রকাশ পায়। যখন বন্ড ইংল্যান্ডে স্বীকার করে যে, "আমরা আর দাঁত দেখাই না - কেবল মাড়ি দেখা যায়।"[১৫৮][১৫৯] এই জিনিসটি আরো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠে ধারাবাহিকটির পরবর্তী বই গুলোতে। যেমন ১৯৬৪ সালের ইউ অনলি লিভ টোয়াইস উপন্যাসটির বন্ড এবং জাপানের গোপনীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান টাইগার তানাকার সাথে কথোপকথনে। ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ এর গোড়ার দিকে ফ্লেমিং ব্রিটিশ ব্রিটিশ প্রতিপত্তি হ্রাস সম্পর্কে বেশ সচেতন ছিলেন। বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়ার সংঘর্ষের সময় যখন তিনি তানাকার কাছে অভিযোগ করেছিলেন এই বলে যে যে ব্রিটেন "দু হাত থেকেই সাম্রাজ্য ছেড়ে দিয়েছে"।[১৫৯][১৬০][১৬১]

ব্ল্যাকের মতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার ব্রিটেনকে এই ভাবে পর্যবেক্ষণের কারণ এম আই সিক্স এর চার সদস্য কে সোভিয়েত ইউনিয়নে সরানোর ফলে খুব বেশি মাত্রায় প্রভাব ফেলেছিল।[১৬২] সর্বশেষ ভুলটি ছিল ১৯৬৩ সালের জানুয়ারিতে কিম ফিলবির ঠিক যখন ফ্লেমিং তার ইউ অনলি লিভ টোয়াইসের খসড়া তৈরি করছিলেন কেবল।[১৬৩] বন্ড এবং M এর প্রথমবারের মত সংক্ষিপ্ত আলোচনা হয় ১২ তম বইয়ে, যেটিতে ফ্লেমিং স্বীকার করে নেয় এই ভুল সম্পর্কে তিনি ইতি মধ্যে জ্ঞাত হয়েছেন।[১৬৪] ব্ল্যাক অবশ্য কিছুটা দ্বিমত করে বলেছিলেন যে M এবং বন্ডের সংলাপের মাধ্যমেই ফ্লেমিং ব্রিটেনের পতনটি তুলে ধরেছিলেন, সেই সাথে ভুল ভ্রান্তি এবং ১৯৬৩ সালের প্রুফুমো এফেয়ারকে পটভূমি হিসেবে টানেন।[১৬১] ফ্লেমিং এর ক্যাসিনো রয়েল লেখা শেষের আগেই দুটি ভুল দ্রুতই ঘটে যায়[১৬৫] এবং লিসেট মনে করেন বইটি লেখকের "যুদ্ধোত্তর বিশ্বে যেখানে বুরগেস এবং ম্যাকলেন এর মত বিশ্বাস ঘাতক তৈরি হতে পারে এবং বিভ্রান্তিকর নৈতিক দ্বিধা প্রকাশ করার চেষ্টা হিসাবে দেখা যেতে পারে"।[১৬৬]

সিরিজটির শেষের দিকে ১৯৬৫ সালের উপন্যাস দ্যা ম্যান উইথ দ্যা গোল্ডেন গান সম্পর্কে ব্ল্যাক উল্লেখ করেছিলেন যে, জামায়িকান বিচার বিভাগ দ্বারা একটি স্বাধীন তদন্ত করা হয়েছিল যেটি সিআইএ এবং এমআই 6 এর গভীর যোগাযোগ ও নির্দেশনায় "অভিনয় হিসাবে রেকর্ড করা হয়েছিল" জ্যামাইকান সিআইডি ": এটি ছিল একটি উপনিবেশিক, স্বাধীন জামাইকার নতুন বিশ্ব যা আরও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনকে নির্দেশ করে।[১৬৭] এই পতনটি বিভিন্ন উপন্যাসে বন্ডের মার্কিন সরঞ্জাম ও কর্মীদের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়েছিল।[১৬৮] অনিশ্চিত ও স্থানান্তরিত ভূ-রাজনীতির ফলে ফ্লেমিংয় রাশিয়ার সংস্থা এসএমআরএসকে "থার্ডারবলের আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী দল স্পেক্টর" এ বদলে দেন থান্ডারবলে, যেটি অনেকটা "ভাল দিয়ে খারাপ কে নিয়ন্ত্রণে উৎসাহিত করার মত।[১৬৯] ব্ল্যাক এখানেও যুক্তি দেখিয়েছিল যে স্পেক্টার এর ফলে গল্পে ধারাবাহিকতা আসে।[১৪৩]

যুদ্ধের প্রভাব

পুরো ধারাবাহিকটি জুড়ে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের একটি আবহ বিরাজমান ছিল।[১৭০] দ্যা টাইমসের সাংবাদিক বেন ম্যাকিনটায়ারের বন্ড সম্পর্কে মনে করেন যে "এটি ছল ব্রিটেনের যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থার মৃতব্যয়ীতা, রেশন এবং হারানো শক্তির[১৭১] বিবেচনায় জন্য সব থেকে উপযোগী জিনিস। কারণ যুদ্ধ পরবর্তীতে এমন একটা সময় চলছিল যে তখন কয়লা এবং আরো কিছু খাদ্য দ্রব্য রেশন হিসেবে দেয়া হতো।[৮৬] ফ্লেমিং তার লেখায় খারাপ বা ভাল চরিত্র তৈরিতে যুদ্ধের কথা আভাষ হিসেবে ব্যবহার করতেন।[৯২][১৭২] যেমন ফর ইয়োর আইস অনলি তে বিপরীত চরিত্রের হ্যামারস্টেইন ছিলেন একজন প্রাক্তন গেস্টাপো অফিসার যেখানে রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড এর সহানুভূতিশীল পুলিশ অফিসার কর্নেল জনস অষ্টম সেনাবাহিনীতে মন্টগোমেরির অধীনে ব্রিটিশদের সাথে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।[১৭৩] একই ভাবে মুনার্কারে ড্রাক্স (গ্রাফ হুগো ভন ডার ড্রাচে) হলেন একজন "মেজালোম্যানিয়াক জার্মান নাৎসি, যিনি একজন ইংরেজ ভদ্রলোক হিসাবে ছদ্মবেশ ধরেছিল" এবং তার সহকারী ক্রেবস আর হিটলারের শেষ চিফ অফ স্টাফের নাম একই ছিল।[৯২] এখানে ফ্লেমিং ১৯৫০ এর দশকের আরো একটি ব্রিটিশ সাংস্কৃতিক বিদ্বেষ কাজে লাগিয়েছিল। যেখানে জার্মানদের দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের চাল চলন তাদের কে আরো তীব্র ভাবে সমালোচনার পাত্র বানিয়ে দেয়।[১৭৪] ধীরে ধীরে ধারাবাহিকটি আগাতে থাকলে জার্মানদের স্নায়ু যুদ্ধের পুনঃরায় টেনে আনা এই হুমকি কাটিয়ে উঠে এবং সেই মোতাবেক তার উপন্যাস গুলো মোড় নিয়ে আগাতে থাকে।[১৭৫]

কমরেডশিপ

পর্যায়ক্রমে সিরিজটিতে, কমরেডশিপ বা বন্ধুত্বের বিষয়টি উঠে আসে, একজন পুরুষ সহযোগী যিনি তাঁর মিশনে বন্ডের সাথে কাজ করেন।[১৭৬] রেমন্ড বেনসন বিশ্বাস করেন যে "বন্ডের সাথে তার সহযোগীদের সাথে সম্পর্কগুলো বন্ডের চরিত্রের আরও একটি নতুন মাত্রা যোগ করে করে, এবং শেষ পর্যন্ত উপন্যাসগুলির মূল ভাবের সাথে ধারাবাহিকতা বজায় রাখে"।[১৭৭] লাইভ এন্ড লেট ডাই তে এজেন্ট কুয়ারেল এবং লেইটার নামক দুজন পুরুষ সহযোগী তার বন্ধু হয়ে উঠে। বিশেষ করে লেইটারের উপর হাঙ্গরের আক্রমণে বন্ডের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করার মত ছিল। বেনসন এটাও লক্ষ্য করেছিলেন যে, " বন্ড তার কাজের প্রতি যেমন প্রতিশ্রুতি বদ্ধ তেমনি তার বন্ধুদের কাছেও বিশ্বস্ত ও অনুগত।[১৭৮] ডঃ নো তে কুয়ারেল ছিল "অপরিহারয্য সহচর"।[১৭৯] বেনসন তাদের বন্ধুত্বে কোন কিছুর কমতি দেখেননি[১৮০] এবং কুয়ারেলের মৃত্যুতে বন্ডের প্রকৃত দুঃখবোধ এবং অনুশোচনার কথাও তিনি উল্লেখ করেন।[১৮১]

"ভিতরে বিশ্বাসঘাতক"

ধারাবাহিকটির প্রথম দিকের উপন্যাস গুলো থেকেই "বিশ্বাসঘাতকতার" মূল ভাবটি খুব প্রবল ছিল। ক্যাসিনো রয়ালে, লে চিফ্রে নামক এক ফরাসী কমিউনিস্ট ট্রেড ইউনিয়নের পে মাস্টার ছিল বন্ডের টার্গেট এবং পঞ্চম কলামের ওভারটোনগুলি মূলত ব্রিটিশ পাঠকগণের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। যেহেতু ট্রেড ইউনিয়নগুলিতে কমিউনিস্টদের প্রভাব ছিল মিডিয়া এবং সংসদের মাথা ব্যাথার বিষয়। বিশেষত ১৯৫১ সালে বার্গেস এবং ম্যাকলিনের অপসারণের পরে।[১৬৬] "ভিতরে বিশ্বাসঘাতক" এর মূল ভাবটি লাইভ এন্ড লেট ডাই এবং মুনার্কারেও ছিল।[১৮২]

ভালর বিপরীতে মন্দ

রেমন্ড বেনসন সিরিজটির আরো একটি সস্পষ্ট মূল বিষয় লক্ষ্য করেন। সেটি হচ্ছে ভালর বিপরীতে মন্দ।[১৭৬] এই জিনিসটি গোল্ডফিঙ্গারে স্বচ্ছ ভাবে উঠে এসেছে সেইন্ট জর্জের শিপ্লটির সাথে। যেটি বইতে বর্ণনা করা হয়েছে এইভাবেঃ[১০৫] "বন্ড ক্লান্তভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। আরও একবার লঙ্ঘনের জন্য, প্রিয় বন্ধু! এবার এটি করেছে সেন্ট জর্জ এবং ড্রাগন। সেই সাথে সেন্ট জর্জ আরও কিছুটা চাল চালতে পারে এবং কিছু একটা করে বসতে পারে"। ব্ল্যাকের বক্তব্য অনুসারে এখানে সেন্ট জর্জের চরিত্রে ব্রিটিশ নয় বরং একজন ইংরেজ হিসেবে চিত্রিত হয়েছেন।[১৮৩]

অ্যাংলো-আমেরিকান সম্পর্ক

বন্ড উপন্যাসগুলিতেও অ্যাংলো-আমেরিকান সম্পর্কের প্রশ্নটি উঠে আসে, যা পশ্চিমের প্রতিরক্ষায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ভূমিকা প্রতিফলিত করে।[১৮৪] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধাবস্থার পরে, ব্রিটিশ সরকার তার সাম্রাজ্য বজায় রাখার চেষ্টা এবং পুঁজিবাদী নতুন বিশ্বব্যবস্থার জন্য আমেরিকান আকাঙ্ক্ষার উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু ফ্লেমিং সরাসরি এদিকে মনোনিবেশ করার পরিবর্তে "ব্রিটিশদের সাম্রাজ্য শাসন এবং কাজ কর্মে সহজাত স্বাভাবিকতার ছাপ ফুটিয়ে তোলে"।[১৭০] লেখক ও সাংবাদিক ক্রিস্টোফার হিচেনস পর্যবেক্ষণে উঠে আসে যে "ক্ল্যাসিক বন্ডের গল্পগুলির মূল প্যারাডাক্সটি হ'ল যদিও সাম্প্রদায়িকভাবে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে অ্যাংলো-আমেরিকান যুদ্ধে উত্সর্গীকৃত, তারা আমেরিকা এবং আমেরিকানদের প্রতি অবজ্ঞা এবং অসন্তোষ পোষণ করে"।[১৮৫] ফ্লেমিং উভয় দেশের মধ্যে এই উত্তেজনা সম্পর্কে অবগত ছিলেন, তবে এটি নিয়ে খুব একটা ঘাটা ঘাটি করেননি।[১৭০] কিংসলে অ্যামিস তার বন্ড নিয়ে অনুসন্ধানে দ্য জেমস বন্ড ডজিয়ারে কথা উল্লেখ করে বলেন ""লেইটার, চরিত্রায়নের অংশ হিসাবে খুবই নগ্ণ্য ... তিনি আমেরিকান হয়েও বন্ড এবং ব্রিটিশদের আদেশ মেনে কাজ করতেন এবং বন্ড ক্রমাগত তার থেকে ভাল করে যাচ্ছিল "।[১৮৬]

গোল্ডফিংগার, লাইভ এবং লেট ডাই এবং ডঃ নো তে দেখা যায় যে বন্ড একজন ব্রিটিশ গুপ্তচর হয়ে আমেরিকানদের সমস্যা সমাধানে নামেন এবং ব্ল্যাক উল্লেখ করে যে যদিও ডঃ নো তে যে হুমকি ছিল সেটি আমেরিকান সম্পদ। একজন ব্রিটিশ গুপ্তচর এবং উপন্যাসটির শেষে ব্রিটিশ যুদ্ধ জাহাহ এইচ এম এস নার্ভিক সহ ব্রিটিশ সৈন্য দ্বীপে পাঠানো হয় সমস্যাটি সমাধানে।[১৮৭] ফ্লেমিং আমেরিকা সম্পর্কে ক্রমশঃ মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল এবং শেষের দিকের উপন্যাস ইউ ওনলি লাইভ টোয়াইসে তাঁর মন্তব্যগুলি এর প্রতিফলন ঘটায়[১৮৮]; তনাকার মন্তব্যে বন্ডের প্রতিক্রিয়া ব্রিটেন এবং আমেরিকার মধ্যকার পতনশীল সম্পর্কের প্রতিফলন ঘটায় যেটি পূর্ববর্তী বইগুলিতে বন্ড ও লিটারের মধ্যকার উষ্ণ, সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের একদমই বিপরীত।[১৬১]

Remove ads

উত্তরাধিকার

সারাংশ
প্রসঙ্গ
Thumb
Bronze bust of Fleming by sculptor Anthony Smith, commissioned by the Fleming family in 2008 to commemorate the centenary of the author's birth.[১৮৯]

১৯৫০ এর দশকের শেষের দিকে লেখক জেফ্রি জেনকিনস ফ্লেমিংকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা ভিত্তিক একটি বন্ড উপন্যাস লিখছেন এবং সেই মোতাবেক তার আইডিয়া এবং গল্পের প্লট ফ্লেমিংকে পাঠান। জেনকিসের মতে ফ্লেমিং ভেবেছিল যে এর সমূহ সম্ভাবনা ছিল।[১৯০] ফ্লেমিং এর মৃত্যুর পর বন্ডের প্রকাশনি গ্লিডরোজ প্রোডাকশনস জেনকিসকে অনুমতি দেয় বন্ড নোভেল পার ফাইন আউন্সের লেখা চালিয়ে যেতে। যদিও এটি পরবর্তীতে আর প্রকাশিত হয়নি।[১৯১] ১৯৬৮ সালে কিংসলে অ্যামিস এর কর্নেল সান "রবার্ট মার্খাম"[১৯২] ছন্মনামে বিভিন্ন লেখককে বন্ড উপন্যাস লেখার জন্য অন্যমোদন করা হয়। তার মধ্যে সেবাস্টিন ফল্কস যাকে ইয়ান ফ্লেমিং পাব্লিকেশনস নিজেই ২০০৮ সালে ফ্লেমিং এর ১০০ তম জন্মদিনে বন্ড উপন্যাস লেখার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল।[১৯৩]

ফ্লেমিং বেঁচে থাকা কালিন প্রায় ত্রিশ মিলিয়ন বই বিক্রি করেছিল আর তার তার মৃত্যুর দু বছরের মধ্যে এটি প্রায় দিগুণ হয়ে যায়।[] ২০০৮ সালে দ্যা টাইমস এর "১৯৪৫ সাল থেকে ৫০ জন সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রিটিশ লেখকের" তালিকায় ফ্লেমিংকে চৌদ্দতম স্থানে রেখেছিল।[১৯৪] ২০০২ সালে ইয়ান ফ্লেমিং পাবলিকেশনস সিইডব্লিউএ আইয়ান ফ্লেমিং স্টিল ড্যাগার পুরস্কার প্রবর্তনের ঘোষণা করেছিল, এটি মূলত যুক্তরাজ্যে প্রকাশিত সেরা থ্রিলার, অ্যাডভেঞ্চার বা গোয়েন্দা উপন্যাসের জন্য ক্রাইম রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন দ্বারা উপস্থাপিত হয়েছিল।[১৯৫]

ইয়ন প্রোডাকশন বন্ডের চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করে ১৯৬২ সালে ডঃ নো দিয়ে, যেটি ফ্লেমিং এর মৃত্যুর পরেও তারা অব্যাহত রাখে। ইয়ন প্রোডাকশনের প্রযোজনায় দুটি ছাড়া ২৪ টি সিনেমা রয়েছে। তার মধ্যে সর্বশেষ স্পেকটার প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালের অক্টোবরে।[১৯৬] ইয়ন প্রোডাকশন প্রযোজিত এই ধারাবাহিকটি বিশ্বব্যাপী ৬.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে আর এর মাধ্যমেই এই ধারাবাহিকটি সর্বাধিক উপার্জিত চলচ্চিত্র সিরিজের একটি।[১৯৭]

সিনেমা এবং সাহিত্য হিসেবে বন্ড সিরিজের প্রভাব অস্টিন পাওয়ার সিরিজ[১৯৮], ক্যারি অন স্পাইয়িং[১৯৯] এবং জেসন বোর্ন চরিত্র[১৯৫] সহ আরো অনেক বই এবং চলচ্চিত্রে বেশ স্পষ্ট। ২০১১ সালে ফ্লেমিং সর্ব প্রথম ইংরেজী ভাষার লেখক যার নামানুসারে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর স্থাপন করা হয়: জ্যামাইকার ওরাকাবাসার নিকটে ইয়ান ফ্লেমিং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি ১২ জানুয়ারী ২০১১ আনুষ্ঠানিকভাবে জামাইকার প্রধানমন্ত্রী ব্রুস গোল্ডিং এবং ফ্লেমিংয়ের ভাগ্নী লুসি দ্বারা আনুষ্ঠানিক ভাবে চালু করা হয়।[২০০]

Remove ads

কর্ম

Remove ads

জীবনী ছায়াছবি

  • Goldeneye: The Secret Life of Ian Fleming, 1989. A television film starring Charles Dance as Fleming. The film focuses on Fleming's life during the Second World War, his love life and the writing of James Bond.[২১০]
  • Spymaker: The Secret Life of Ian Fleming, 1990. A television film starring Jason Connery (son of Sean) as Fleming in a Bond-like adventure set during World War II.[২১১]
  • Ian Fleming: Bondmaker, 2005. A television drama-documentary, first broadcast on BBC on 28 August 2005. Ben Daniels portrayed Fleming.[২১২]
  • Ian Fleming: Where Bond Began, 2008. Television documentary about the life of Ian Fleming, broadcast 19 October 2008 by the BBC. Presented by former Bond girl, Joanna Lumley.[২১৩]
  • The film Age of Heroes is based on the exploits of 30 Commando; James D'Arcy played Fleming.[২১৪]
  • Fleming: The Man Who Would Be Bond, a BBC America television four-episode mini-series, broadcast in January and February 2014, starring Dominic Cooper in the title role.[২১৫][২১৬]
Remove ads

লেখালেখি

১৯৫২ সালে ফ্লেমিং তার প্রথম উপন্যাস ক্যাসিনো রয়াল লেখা শুরু করেন।

মৃত্যু

মাত্রাতিরিক্ত ধূমপান ও মাদকাসক্তির জন্য ১৯৬১ সালে হার্ট অ্যাটাকের স্বীকার হন ফ্লেমিং। ১৯৬৪ সালে পুনরায় হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

উৎস

Remove ads

তথ্যসূত্র

আরও দেখুন

বহিঃসংযোগ

Loading related searches...

Wikiwand - on

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.

Remove ads