শীর্ষ প্রশ্ন
সময়রেখা
চ্যাট
প্রসঙ্গ
কবিগান
বাংলা লোকসংগীতের একটি বিশেষ ধারা উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
Remove ads
কবিগান বাংলা লোকসংগীতের একটি বিশেষ ধারা। এই ধারায় লোককবিরা প্রতিযোগিতামূলক গানের আসরে অংশগ্রহণ করে থাকেন। গায়ককে কবি হতে হয়। তিনি মুখে মুখে পদ রচনা করেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে সুরারোপ করে গেয়ে থাকেন। কবিগান পরিবেশনকারীদের বলা হয় কবিয়াল। কবিগান এর মূলত একাধিক দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা ("বাদাবাদি")। যেখানে একদল প্রশ্ন গান("চাপান") গাইবে এবং সেই গান শেষ হলে অপর দলটি তার জবাব গান("উতোর") গাইবে। শেষ পর্যন্ত গানের প্রশ্নোত্তরের টক্করে যে দল সবচেয়ে ভালো বিবেচিত হবে তারাই বিজয়ী হবে।
Remove ads
প্রকৃতি
কবিগান সাধারণত দুটি দলের দ্বারা গীত হয়। প্রত্যেকটি দলের নেতৃত্বে থাকেন একজন "কবিয়াল" বা "সরকার"। তার সহকারী গায়কদের বলা হয় "দোহার"। এঁরা সাধারণত নেতার কথাগুলিই পুনরাবৃত্তি করেন।[১] কবিগান শুরু হয় "বন্দনা" বা "গুরুদেবের গীত"-এর মাধ্যমে। "বন্দনা" অংশটি সরস্বতী, গণেশ, জনতা ও শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়। এটি কবিয়াল যেমন উপযুক্ত করেন, তেমনভাবে গান। এরপর রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক গান গাওয়া হয়। এটিকে কেউ কেউ "আগমনী" বলেন। এরপর চারটি বিষয়ভিত্তিক গান গাওয়া হয়ঃ "সখী সংবাদ", "বিরহ", "লহর" ও "খেউড়"। এরপর প্রতিযোগিতামূলক অংশটি শুরু হয়।[২] কবিগানের আসরে এই অংশটিকে "কবির লড়াই"-ও বলা হয়। এই অংশে একজন গীতিকার-সুরকার মুখে মুখে গান বেঁধে অপর গীতিকার-সুরকারকে আক্রমণ করেন এবং তিনিও গানের মাধ্যমে সেই আক্রমণের প্রত্যুত্তর দেন।[৩]
Remove ads
ইতিহাস
সারাংশ
প্রসঙ্গ
সজনীকান্ত দাশ তার বাংলার কবিগান গ্রন্থে লেখেন, বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে প্রচলিত বিভিন্ন সাংগীতিক ধারার মিলনে কবিগানের জন্ম। এই ধারাগুলির নাম বহু বিচিত্র – তরজা, পাঁচালি, খেউড়, আখড়াই, হাফ আখড়াই, ফুল আখড়াই, দাঁড়া কবিগান, বসা কবিগান, ঢপকীর্তন, টপ্পা, কৃষ্ণযাত্রা, তুক্কাগীতি ইত্যাদি।[২] ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ও ড. হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের মতো খ্যাতনামা সাহিত্য গবেষকগণ কবিগান নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন।[২]
ড. সুশীল কুমার দের মতে, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে, এমনকি সপ্তদশ শতাব্দীতেও কবিগানের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু কবিওয়ালাদের প্রকৃত বিকাশকাল হল ১৭৬০ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যবর্তী সময়।[২] এই সময় বাংলা কাব্যের ধর্মীয় ও আনুষ্ঠানিক উপাদানগুলি ফিকে হয়ে আসতে শুরু করেছিল। বাংলা কাব্যও বৈষ্ণব কবিতার ধারা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে মুদ্রণযন্ত্রের আবির্ভাব এই বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টাকে সার্থক করে তোলে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে পরবর্তী অর্ধশতাব্দীকাল নব্য কবিগান এবং পাঁচালি গান কলকাতা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে সাহিত্যের অন্যান্য ধারাগুলির অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়েছিল।[৪] পরবর্তীকালে কলকাতায় কবিগানের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেলেও গ্রামবাংলায় এর জনপ্রিয়তা কিছুমাত্র কমেনি।[২]
ময়মনসিংহের মুগ ভালো, খুলনার ভালো কই।
ঢাকার ভালো পাতাক্ষীর, বাঁকুড়ার ভালো দই।।
কৃষ্ণনগরের ময়রা ভালো, মালদহের ভালো আম।
উলোর ভালো বাঁদর পুরুষ, মুর্শিদাবাদের জাম।।
রংপুরের শ্বশুর ভালো, রাজশাহীর জামাই।
নোয়াখালির নৌকা ভালো, চট্টগ্রামের ধাই।।
দিনাজপুরের কায়েত ভালো, হাবড়ার ভালো শুঁড়ি।
পাবনা জেলার বৈষ্ণব ভালো, ফরিদপুরের মুড়ি।।
বর্ধমানের চাষী ভালো, চব্বিশ পরগণার গোপ।
গুপ্তিপাড়ার মেয়ে ভালো, শীঘ্র-বংশলোপ।।
হুগলির ভালো কোটাল লেঠেল, বীরভূমের ভালো বোল।
ঢাকের বাদ্য থামলেই ভালো, হরি হরি বোল।।
−ভোলা ময়রা
Banglapedia
ড. সুশীল কুমার দে কবিওয়ালাদের প্রশংসাই করেছেন। তার মতে, এঁরা ছিলেন সমাজের নিচু তলার মানুষ। সমাজের নিচু তলার মানুষদের মধ্যেই ছিল এঁদের জন্ম ও বিচরণ। তাই এই সমাজের চিন্তাভাবনা অনুভূতিগুলি তারা ভালই বুঝতেন। আধুনিক সাহিত্যকার সমাজের যে অংশকে অশিক্ষিত মনে করে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন, সেই অংশে এঁদের জনপ্রিয়তা ছিল অবিসংবাদী।[২]
Remove ads
শব্দ-ব্যবহার
মুখে মুখে রচিত হতো কবিগান যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি শ্রোতাদেরকে চমক লাগানো ও মনঃসংযোগের লক্ষ্যে এতে শব্দ-ব্যবহারের কলা-কৌশলও বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।[৫]
- একই শব্দ একাধিকবার অল্প ব্যবধান বা ব্যবধান ছাড়াই ব্যবহার করে ধ্বনিতরঙ্গ সৃষ্টি করা।
- একই শব্দ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা।
- ছন্দভঙ্গির পরিবর্তন করা।
কবিয়াল
সারাংশ
প্রসঙ্গ
একাধিক সংখ্যক কবিয়াল বা কবিওয়ালা জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। অষ্টাদশ থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তীকালে কেবলমাত্র বীরভূম জেলাতেই শ তিনেক খ্যাতনামা কবিয়াল বিদ্যমান ছিলেন। এঁদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন কবিয়াল ছিলেন গোঁজলা গুঁই (আনু. ১৭০৪ - ?)। তার রচিত একটিমাত্র গান ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। খুব সম্ভবত তিনি পেশাদার কবির দল গঠন করতে পেরেছিলেন। টপ্পা রীতিতে ও টিকারা-সংগীতে কবিগান করতেন। তার শিষ্য লালু–নন্দলাল, কেষ্টা মুচি, রঘুনাথ দাস ও রামজি থেকেই অষ্টাদশ শতাব্দী এবং পরবর্তীতে বিখ্যাত কবিয়ালদের উদ্ভব হয়। শোনা যায় রঘুনাথ দাস দাঁড়া-কবির প্রবর্তক।[৬] ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার বিখ্যাত কবিয়ালরা ছিলেন হরু ঠাকুর (১৭৪৯–১৮২৪), নিত্যানন্দ বৈরাগী (১৭৫১–১৮২১), রাম বসু (কবিয়াল) (১৭৮৬–১৮২৮), ভোলা ময়রা, যজ্ঞেশ্বরী দাসী,[৭] অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ও ভবানী বণিক[১][২]।
বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের কবিয়ালরা হলেন পণ্ডিত হরিনারায়ণ দে, বলহরি দে (১৭৪৩–১৮৪৯), শম্ভুনাথ মণ্ডল (১৭৭৩-১৮৩৩), তারকচন্দ্র সরকার (১৮৪৫–১৯১৪), রমেশচন্দ্র শীল (১৮৭৭–১৯৬৭), রাজেন্দ্রনাথ সরকার (১৮৯২–১৯৭৪), বিনয়কৃষ্ণ অধিকারী (১৯০৩–১৯৮৫), স্বরূপেন্দু সরকার (১৯৩৩-২০০৯) এবং গৌতম মজুমদার (১৯৭৪-২০১৯) সাতু রায়, ঠাকুরদাস চক্রবর্তী।[১][২][৮]
চারণকবি মুকুন্দ দাস প্রকৃতপক্ষে ছিলেন একজন কবিয়াল।[২] বালিকা বধূ নামে এক বাংলা চলচ্চিত্রে তার চরিত্রটি চিত্রিত হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে মুকুন্দ দাসের গান কীভাবে জনসাধারণকে প্রভাবিত করেছিল, তাও এই চলচ্চিত্রে প্রদর্শিত হয়েছে।[৯]
এক বিখ্যাত কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ছিলেন জন্মসূত্রে পর্তুগিজ। তার জীবনী অবলম্বনে দুটি জনপ্রিয় বাংলা চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। একটি ছবিতে 'অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি'র নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বিশিষ্ট বাঙালি অভিনেতা উত্তম কুমার।[১০] অপর ছবিটির নাম জাতিস্মর, তাতে কবিয়াল এন্টনির ভূমিকায় ছিলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় কবিয়াল ভোলা ময়রা গায়ক হিসেবে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তার গানে শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো হয়ে থাকত। এই জাতীয় জনপ্রিয় বিনোদন অনুষ্ঠানের গুরুত্ব অনুধাবন করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ভোলা ময়রার বিশেষ প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, "বাংলাকে জাগাতে যেমন রামগোপাল ঘোষের মতো বাগ্মী, হুতোম প্যাঁচার মতো আমুদে লোকের প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন ভোলা ময়রার মতো লৌকিক গায়কদের।"[১১] এঁর জীবন অবলম্বনেও ভোলা ময়রা নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।[১২]
Remove ads
মুদ্রণ জগতে প্রবেশ
কবিওয়ালাগণ মুখে মুখে কবিতা বলেছেন ঠিকই; কিন্তু কখনোই এগুলো লিখে রাখেননি। লক্ষ্যণীয় যে, ঐসময় কোন ছাপাখানাও ছিল না। তাছাড়াও তাদের সমর্থক কিংবা পৃষ্ঠপোষকগণও কখনো কবিগান সংগ্রহ করার কথা ভাবেননি বা চিন্তা করেননি। তৎকালীন সমাজ জীবনে উৎসব-আনন্দের প্রয়োজনে কবিগানের আসর বসতো। এবং এ আসর বসার মাঝেই ছিল কবিগানের সার্থকতা ও সফলতা।
১৮৫৪ সালে সর্বপ্রথম কবি ঈশ্বর গুপ্ত কবিগান সংগ্রহ করা আরম্ভ করেন। এগুলো পরবর্তীতে তিনি সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার পাতায় প্রকাশ করতে শুরু করেন। উল্লেখ্য, প্রাচীন সংবাদ প্রভাকর পত্রিকাটি ছিল কবি ঈশ্বর গুপ্তেরই সংবাদপত্র। এভাবেই পত্রিকাটির মাধ্যমে কবিগানের বিস্তৃতি ঘটতে শুরু করে।[৫]
Remove ads
আরো দেখুন
তথ্যসূত্র
Wikiwand - on
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Remove ads