শীর্ষ প্রশ্ন
সময়রেখা
চ্যাট
প্রসঙ্গ
পিএনএস গাজী
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
Remove ads
পিএনএস গাজী (পূর্বে ইউএসএস দিয়াবলো (এসএস-৪৭৯); রিপোর্টিং নাম: গাজী), সিতারা-ই-জুরাত, ছিল পাকিস্তান নৌবাহিনীর টেঞ্চ শ্রেনীর ডিজেল-তড়িৎ চালিত প্রথম দ্রুতগামী আক্রমণকারী ডুবোজাহাজ। ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট হতে ডুবোজাহাজটি ইজারা নেয়।:৬৮[৯]
ডুবোজাহাজটি ১৯৪৫ হতে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীকে সেবা প্রদান করে। পরবর্তীতে আইয়ুব প্রশাসন এবং কেনেডি প্রশাসনের মধ্যে একটি সফল মধ্যস্থতার ফলে সিকিউরিটি এসিস্টেন্স প্রোগ্রাম (এসএপি)-এর মাধ্যমে পাকিস্তান ডুবোজাহাজটিকে ধার নেয়।[১০] ১৯৬৪ সালে জাহাজটি পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগদান করে এবং ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালে পাকিস্তান-ভারতের মধ্যকার যুদ্ধের সাক্ষী হয়।[৩]
১৯৬৮ সালে মেরামত এবং আধুনিকায়নের জন্য গাজীকে তুরস্কের গল্কুক শিপইয়ার্ডে নেয়া হয়। সেসময়ে ছয় দিনের যুদ্ধের কারণে সুয়েজ খাল বন্ধ থাকায় গাজী ভারত ও আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যদিয়ে নিমজ্জিতভাবে সম্পূর্ণ আফ্রিকা ও ইউরোপ মহাদেশের দক্ষিণাংশ অতিক্রম করে তুরস্কে পৌছায়। ডুবোজাহাজটি মোট ২৮টি এমকে ১৪ টর্পেডো বহনে সক্ষম ছিলো, পরবর্তীতে একে মেরামত করে এটিকে মাইন স্থাপনের উপযোগী বানানো হয়।[১১]
১৯৬৫ সালের যুদ্ধ থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালে ডুবে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত গাজীই ছিল ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ব্যবহৃত একমাত্র ডুবোজাহাজ। ১৯৭১ সালের ইন্দো-পাক যুদ্ধের সময় ভারতের পূর্ব উপকূলে বঙ্গোপসাগরে একটি নৌ অপারেশন পরিচালনার সময় রহস্যজনকভাবে গাজী ডুবে যায়।[১২] ভারতীয় নৌবাহিনী দাবী করে তাদের ডেস্ট্রয়ার আইএনএস রাজপুতের গোলার আঘাতে গাজী নিমজ্জিত হয়েছে।[৪][৫][৬][১৩][১৪] অপরদিকে, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ভাষ্যমতে ডুবোজাহাজটি হয়তো অভ্যন্তরীণ কোন বিস্ফোরণের ফলে অথবা বিশাখাপত্তম পোতাশ্রয়ে পুতে রাখা কোন মাইন বিস্ফোরণের ফলে নিমজ্জিত হয়েছে। নিরপেক্ষ সূত্র সমূহ এই বিষয়টি নিশ্চিত করে যে গাজী দুর্ঘটনা কবলিত হবার সময় আইএনএস রাজপুত ঐ স্থানে ছিল না এবং সেটি বন্দরেই অবস্থান করছিল।[৭][১৫][১৬][১৭][১৮]
ভারতীয় ঐতিহাসিকরা গাজীর ডুবে যাওয়াকে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তারা এই ডুবে যাওয়াকে '১৯৭১ সালের যুদ্ধের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে বড় অমীমাংসিত রহস্যময় ঘটনা' হিসেবে বর্ণনা করেছেন।'[১৮][১৯]
Remove ads
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর অধীনে সেবাদান
সারাংশ
প্রসঙ্গ
দিয়াবলো ছিল একটি টেঞ্চ শ্রেণীর দূরবর্তী অবস্থানে দ্রুতগতিতে আক্রমণ করতে সক্ষম একটি ডুবোজাহাজ, যেটি ১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন ভি. ডি. চ্যাপলিনের স্ত্রী ১৯৪৫ সালের ৩১ মার্চ ডুবোজাহাজটিকে স্পন্সর করেন এবং লেফটেন্যান্ট কমান্ডার গরডন গ্রাহাম ম্যাথিসন ছিলেন জাহাজটির প্রথম কমান্ডিং অফিসার।[২০][২১][২২][২৩]
এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর একমাত্র জাহাজ যার নামকরণ করা হয় দিয়াবলো। শব্দটি স্প্যানিশ ভাষা থেকে এসেছে, যার অর্থ শয়তান।:১৩৪–১৩৫[২৪] ডুবোজাহাজটির জন্য নির্বাচিত এবং ইস্যুকৃত পদচিহ্নে যে চিত্র অঙ্কিত রয়েছে তা লখ্য করলে দেখা যায়, একটি শয়তান টর্পেডো নিয়ে সমুদ্রে বিচরণ করছে।[২৫]
প্রথমে এটি পোর্টসমাউথ নৌবন্দরে অবস্থান করছিল, পরবর্তীতে ডুবোজাহাজটি ১৯৪৫ সালের ২১ জুলাই কানেটিকাট নিউ লন্ডন হতে পার্ল হারবারে আগমন করে। ১০ আগস্ট তারিখে ডুবোজাহাজটি তাঁর প্রথম যুদ্ধকালীন পেট্রোলে বেড়িয়ে পরে এবং তাকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সাইপানে অবস্থান করতে বলা হয়।[২৩] যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলে ডুবোজাহাজটি তার গন্তব্যস্থল পরিবর্তন করে ১৯৪৫ সালের ২২ আগস্ট গুয়ামে পৌছায়।[১] ঐ মাসের শেষ দিনে জাহাজটি পার্ল হারবারের উদ্দেশ্যে রওনা হয় এবং ১১ অক্টোবর তারিখে পূর্ব উপকূলে নিউইয়র্ক সিটিতে পৌছায়। দক্ষিণ ক্যারোলাইনার চ্যারিস্টনে একটি ভ্রমণ ব্যতীত ডুবোজাহাজটি ১৯৪৬ সালের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত নিউইয়র্কেই অবস্থান করে।[২২]
১৫ জানুয়ারি ১৯৪৬ হতে ২৭ এপ্রিল ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত দিয়াবলো পানামা খাল অঞ্চলে ঘাঁটি গাড়ে এবং সেখানে একটি নৌ মহড়ায় অংশ নেয়। এসময়ে ডুবোজাহাজটি ক্যারিবিয়ান সাগরের স্থল বিভাগকে সেবা প্রদান করে।[২] ১৯৪৭ সালের ২৩ আগস্ট হতে ২ অক্টোবর পর্যন্ত দিয়াবলো ইউএস নৌবাহিনীর অন্য দুইটি ডুবোজাহাজ কাটলাস এবং কঙ্গারের সাথে একত্রে দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে তিয়েররা দেল ফুয়েগার নিকট একটি কৃত্রিম যুদ্ধকালীন নৌ মহড়ায় অংশ নেয়।[৮] দেশে ফেরার পথে তিনটি ডুবোজাহাজকে চিলির ভালপারাইসোতে নিয়ে আসা হয়। দিয়াবলো ফ্লোরিডার পশ্চিম উপকূলে যাত্রা করে সেখানে ১৯৪৭ সালের ১৬ নভেম্বর হতে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি ডূবোজাহাজ প্রতিরোধী যুদ্ধ মহড়ায় অংশ নেয়। ১৯৪৮ সালে মার্চ মাস পর্যন্ত নৌবাহিনীর রিজার্ভ সৈন্যদের প্রশিক্ষণের জন্য ডুবোজাহাজটিকে লুইজিয়ানার নিউ অরলিন্স থেকে পরিচালনা করা হয়।[৮]
১৯৪৯ সালের ৫ জুন তারিখে দিয়াবলো তার নতুন ঘাঁটি ভার্জিনিয়ার নরফোল্ক নৌবন্দরে পৌছায় এবং সেখানে ১৯৫১ সালে অপারেশন কনভেক্সে অংশগ্রহণ করে।[১] ১৯৫২ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর দিয়াবলো ভার্জিনিয়া থেকে যাত্রা করে তার নতুন ঘাঁটি নিউ লন্ডনে পৌছায় এবং সেখানে অবস্থিত সাবমেরিন স্কুলের প্রশিক্ষণ কাজে যোগদান করে।[২০]
১৯৫৪ সালের ৩ মে হতে ১ জুন পর্যন্ত ডুবোজাহাজটি পশ্চিম উপকূলের অপারেশনার উন্নয়নের সাথে সংযুক্ত ছিল এবং এর দ্বারা বিভিন্ন নতুন অস্ত্র এবং যন্ত্রাংশের পরীক্ষা করা হতো।[২০] ১৯৫৫ সালের ২৮ মার্চ এটি ক্যারিবিয়ানে অপারেশন স্প্রিংবোর্ডে অংশগ্রহণ করে এবং পাশাপাশি সাবমেরিন স্কুলের ডুবোজাহাজ প্রতিরোধী যুদ্ধ এবং নৌমহড়ায় সেবা প্রদান করতে থাকে।[২২] ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারি হতে এপ্রিলের মধ্যে দিয়াবলো পানামা খাল অতিক্রম করে কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, পেরু ও চিলির উপকূলে পরিভ্রমন করে এবং দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন নৌবাহিনীর সাথে নৌ মহড়ায় অংশগ্রহণ করে।[২০] ১৯৬০ সালের ২৭ মে মেরামত করার জন্য ডুবোজাহাজটিকে ফিলাডেলফিয়া নেভাল শিপইয়ার্ডে নিয়ে আসা হয় এবং সেখানে সেটি অক্টোবর মাস পর্যন্ত অবস্থান করে।[২৩]
১৯৬২ সালে তার শ্রেণীকরণ প্রতিকটি পরিবর্তন করে এজিএসএস-৪৭৯ করা হয়।[২]
Remove ads
পাকিস্তান নৌবাহিনীর অধীনে সেবাদান
সারাংশ
প্রসঙ্গ

পাকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের মধ্যে একটি দীর্ঘ ও জটিল আলোচলার ফলস্বরূপ পাকিস্তান গাজী ক্রয় এবং অধিগ্রহণ করে।:৫৭–৬০[২৬] ১৯৫০ এর দশক থেকেই পাকিস্তান নৌবাহিনী একটি ডুবোজাহাজ ক্রয়ের পরিকল্পনা করতে থেক। সেই লক্ষ্যে পাকিস্তান সর্বপ্রথম যুক্তরাজ্যের নৌবাহিনীর সাথে আলোচনা শুরু করে এবং পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর সাথেও আলোচনা শুরু হয়।:৫৮[২৬]
১৯৬০ সালের দিকে আইয়ুব প্রশাসন আইজেনহাওয়ার প্রশাসনের সাথে সম্পর্ক মজবুত করে তোলে। এর ফলে কেনেডি প্রশাসনের সময় সিকিউরিটি এসিস্টেন্স প্রোগ্রামের (এসএপি) আওতায় পাকিস্তান চার বছরের জন্য গাজীকে ইজারা নেয় এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৬৩ সালে সম্পূর্ণরূপে ক্রয় করে।[১১]
গাজী ছিল দক্ষিণ এশিয়ার কোন নৌবাহিনী স্বারা পরিচালিত প্রথম ডুবোজাহাজ, যেটি ছিল ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ।[২৬][২৭]:৬০ জনপ্রিয় ধারণা অনুযায়ী, ফিলাডেলফিয়া নেভাল শিপইয়ার্ডে মেরামতের পূর্বে গাজীর প্রযুক্তিগত কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী একে ব্যাপক মাত্রায় মেরামত করে। তবে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগদানের সময় এটি অনেকটাই পুরাতন হয়ে গিয়েছিল এবং তাতে কোন আধুনিকতা ছিল না।[২৬] নৌ ইতিহাসবিদেরা গাজীকে একটি নিরস্ত্র ক্লকওয়ার্ক মাউস বলে বর্ণনা করেছেন, যেটি শুধুমাত্র প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হতো।:৬১[২৪][২৬]:১৩৫–১৩৬ তবুও সে সময়ে ভারতীয় নৌবাহিনী ধারণা ছিল, গাজী একটি আধুনিক সামরিক ডুবোজাহাজ, যেটি তাদের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে উঠতে পারে।:৫৯[২৬]
ডুবোজাহাজটিকে ১৪টি ভিনটেজ মার্ক-১৪ টর্পেডো বহনের উপযোগী করে তৈরি করা হয়, যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এতে বিভিন্ন সমস্যা পরিলক্ষিত হয়, যা ডুবোজাহাজটির সুনামক্ষুন্ন করে। ১৯৬৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ডুবোজাহাজটি করাচির নেভাল ডকইয়ার্ডে পৌছায় এবং পাকিস্তান নৌবাহিনীতে দূরবর্তী অবস্থানে দ্রুত আক্রমণে সক্ষম প্রথম ডুবোজাহাজ হিসেবে যোগদান করে।[২৮] ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনী ডুবোজাহাজটিকে গাজী (পবিত্র যোদ্ধা) নামে নামকরণ করে।:১৩৬[২৪]
১৯৬৫ সালের ইন্দো-পাকিস্তান যুদ্ধে পশ্চিম রণাঙ্গন
১৯৬৫ সালের ৫ আগস্ট ভারতীয় কাশ্মীরে গোপন অনুপ্রবেশের ফলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। এইসময়ে গাজীর কমান্ডার ছিলেন কেরামত রহমান নিয়াজি, যিনি পরবর্তীতে নৌবাহিনীর চার তারকা এডমিরাল পদে অধিষ্ঠিত হন।[২৮] সে সময়ে গাজিতে কর্মরত অন্যান্য কর্মকর্তাগণ হলেন লেফটেন্যান্ট-কমান্ডার আহমেদ তাসনিম (পরবর্তীতে ভাইস এডমিরাল), সাব-লেফটেন্যান্ট ফাসিহ বোখারি এবং লেফটেন্যান্ট জাফর মুহাম্মদ খান। জাফর মুহাম্মদ খান ১৯৭১ সালে গাজীর কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ পান।[২৯]
গাজী ছিল ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ব্যবহৃত একমাত্র ডুবোজাহাজ, যার লক্ষ্য ছিলো ভারতীয় নৌবাহিনীর বৃহদাকার ও প্রধান যুদ্ধজাহাজগুলোকে আক্রমণ করা।[৩০] তবে, ভারতের গুজরাটের দ্বারকায় অবস্থিত একটি রাডার স্টেশনে আক্রমণের জন্য কমোডর এস. এম. আনোয়ারের নেতৃত্বে একটি ক্ষুদ্র নৌবহর পাঠানো হলে সেই অভিযানে গাজী সহযোগিতা করে।[২৮] এছাড়াও, যুদ্ধকালীন সময়ে ভারতের একমাত্র বিমানবাহী রণতরী আইএনএস বিক্রান্তকে আক্রমণের জন্য গাজী ভারত মহাসাগরে টহল দিতে থাকে, কিন্তু যুদ্ধকালীন সময়ে সে তার লক্ষ্যকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়নি। ১৯৬৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ আইএনএস বিয়াস গাজীকে লক্ষ্য একটি গভীর আক্রমণ করে, যদিও তা লক্ষবস্তুতে আঘাত হানতে ব্যর্থ হয়।
১৯৬৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর গাজী ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ আইএনএস ব্রহ্মপুত্রকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়। এদময় গাজী আই আইএনএস ব্রহ্মপুত্রকে লক্ষ্য করে তিনটি মার্ক-১৪ শ্রেণীর টর্পেডো নিক্ষেপ করে এবং পালটা আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য সমুদ্রের আরো গভীরে চলে যায়।ডুবোজাহাজটির যুদ্ধকালীন নথি থেকে জানা যায়, টর্পেডো গুলো ছোড়ার পরে গাজীতে অবস্থানকারী সৈন্যরা তিনটি বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান। তবে, এই আক্রমণে ব্রহ্মপুত্রের কোন ক্ষতি হয়নি, এমনকি ভারতীয় জাহাজটি আক্রমণ সম্পর্কে অবগতই ছিলো না এবং কোন পাল্টা আক্রমণও চালায় নি সেসময়ে ঐ অঞ্চলে কোন যুদ্ধজাহাজের ডুবে যাওয়া বা ক্ষয়ক্ষতির কোন সংবাদ পাওয়া যায় নি। এই অভিযান শেষে গাজী নিরাপদে তার ঘাঁটিতে ফিরে আসে।
অভিযান শেষে ফিরে আসার পরে গাজী মোট দশটি পদকে ভূষিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে দুইটি সিতারা-ই-জুরাত, একটি তামঘা-ই-জুরাত, রাষ্ট্রপতি পদক এবং ছয়টি ইমতিয়াজি সনদ। গাজীর কমান্ডার কেরামত রহমান নিয়াজি সিতারা-ই-জুরাত পদক এবং প্রধান কর্মকর্তাবৃন্দ তামঘা-ই-জুরাত পদকে ভূষিত হন।[২৮][২৯] যদিও, গাজীর মূল লক্ষ্য কি ছিল এবং সেই তিনটি রহস্যাবৃত বিস্ফোরণ কিসের ছিল সে সংক্রান্ত কোন তদন্ত প্রতিবেদন কখনোই প্রকাশ করা হয়নি।

যুদ্ধের পরে ১৯৬৫-৬৬ সালে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের উপরেই অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এই সময়ে গাজীকে জরুরী ভিত্তিতে মেরামতের প্রয়োজন পরে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র নগদ অর্থ ছাড়া কোন প্রকার মেরামতে করতে অপারগতা প্রকাশ করে। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনী ডুবোজাহাজটি পুনরায় চার বছরের জন্য ইজারা নেবার আবেদন করে। যা পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার এবং তাদের নৌবাহিনী অনুমোদন করে। তবে এসময়ে গাজীর যন্ত্রাংশগুলোর গুণগত মান খারাপ হতে থাকে।:১০৮[১০] ফলশ্রুতিতে, পাকিস্তান নৌবাহিনী ডুবোজাহাজটির মেরামত এবং অর্ধ বয়সকালীন হালনাগাদের জন্য তুরস্কের নৌবাহিনীর সাথে চুক্তি করে। যার ফলে, গাজীকে মেরামতের জন্য তুরস্কের গোল্কুক নেভাল শিপইয়ার্ডে প্রেরণ করা হয়।
মধ্যপ্রাচ্যে ছয় দিনের যুদ্ধের কারণে ১৯৬৭ সালে মিশরীয় নৌবাহিনী সুয়েজ খাল অবরোধ করে। ফলে ১৯৬৮ মারমারা সাগরের তীরে অবস্থিত গোল্কুক নেভাল শিপইয়ার্ডে পৌঁছাতে গাজীকে সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশ এবং দক্ষিণ ইউরোপকে নিমজ্জিত অবস্থায় প্রদক্ষিণকরতে হয়। এসময়ে গাজী করাচি উপকূল হতে উত্তমাশা অন্তরীপ, দক্ষিণ আফ্রিকা ও আটলান্টিক মহাসাগর হয়ে দক্ষিণ ইউরোপ ঘুরে তুরস্কে পৌছায়। এই অভিযানে গাজীর কমান্ডার ছিলেন আহমেদ তাসনিম।:১০৮[১০][১১] এছাড়াও, নেভাল স্টাফ প্রধান এডমিরাল সৈয়দ মুহাম্মদ আহসান স্থানীয় বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে গাজীর কম্পিউটারের জরুরী মেরামতের ব্যবস্থা করেন।[১১]
নিমজ্জিত প্রদক্ষিণ অভিযানকালে গাজী জ্বালানী নিতে স্বল্প সময়ের জন্য কেনিয়ার মোম্বাসা এবং মোজাম্বিকের মাপুতুতে যাত্রাবিরতি করে এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সাইমন্স শহরে একটি বিদায়ী ভ্রমণ করে।[১১] উত্তমাশা অন্তরিপকে অতিক্রমকালে গাজী খাদ্য সরবরাহের জন্য এঙ্গোলার লুয়ান্ডাতে স্বল্পসময়ের জন্য যাত্রাবিরতি করে এবং পুনরায় পশ্চিম ইউরোপের দিকে যাত্রা করে। পশ্চিম ইউরোপে ফ্রান্সের তৌলন বন্দরে যাত্রাবিরতিকালে ফ্রান্সের নৌবাহিনী গাজীকে অভিবাদন জানায়।[১১] গাজীর শেষ বারের মতো তুরস্কের ইজমিরে যাত্রাবিরতি করে এবং নিমজ্জিতভাবে মারমারা সাগরের পূর্ব উপকূল দিয়ে গোল্কুক নেভাল শিপইয়ার্ডে পৌছায়। এখানে ডুবোজাহাজটিতে টেঞ্চ শ্রেণীর কম্পিউটার এবং অন্যান্য বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ সংযুক্ত করা হয়।[১১] আফ্রিকা ও ইউরোপের প্রদক্ষিণ অভিযান সম্পন্ন করতে গাজীর দুইমাস সময় লাগে।[১১]
গাজীর মেরামত, অর্ধ বয়সকালীন হালনাগাদ এবং সামরিক কম্পিউটারের মান উন্নয়নের জন্য খরচ হয় প্রায় ১.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রকল্পটি ১৯৬৮ সালের মার্চে শুরু হয়ে ১৯৭০ সালে এপ্রিল মাসে শেষ হয়। ধারণা করা হয়, এই সময়ে তুরস্ক এতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি এমকে.১৪/এমকে.১০ নেভাল মাইন যুক্ত করে।
১৯৭১ সালে ইন্দো-পাকিস্তান যুদ্ধের পূর্ব রণাঙ্গন
প্রয়োজনীয় মেরামত ও মান উন্নয়নের পরে কমান্ডার ইউসুফ রাজার নেতৃত্বে গাজী পুনরায় আফ্রিকা মহাদেশ নৌ প্রদক্ষিণ করে ১৯৭০ সালের ২ এপ্রিল পাকিস্তানের করাচি উপকূলে পৌছায়।:১১০৮[১০][১১]
১৯৭১ সালের আগস্টে ভারতীয় নৌবাহিনী তাদের বিমানবাহী রণতরী আইএনএস বিক্রান্তকে পূর্বাঞ্চলীয় নৌ কমান্ডের অধীনে বিশাখাপত্তনমে স্থানান্তর করে। যার ফলে পাকিস্তান নৌবাহিনী তাদের ডুবোজাহাজের অভিযান পরিকল্পনা নতুন করে সাজাতে বাধ্য হয়। ১৯৭১ সালের পূর্বে আইয়ুব প্রশাসনের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের নৌ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদারের জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব পেশ করা হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এর কোনটিই কার্যকর হয়নি। যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে নৌবাহিনী ভারতীয় নৌবাহিনীর মোকাবেলায় খুবই দুর্বল হয়ে পরে।[২৮] পূর্ব পাকিস্তান নৌবাহিনীর বিদ্রোহী কর্মকর্তা ও নাবিকদের দ্বারা পরিচালিত অপারেশন জ্যকপট সফলভাবে সম্পন্ন হলে পাকিস্তান নৌবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড মারাত্মক চাপের সম্মুখীন হয়। এই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের তিনটি রণাঙ্গনে ভারতীয় নৌবাহিনীর অগ্রগতি পাকিস্তান নৌবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডকে আরো চাপে ফেলে।[২৮] ইয়াহিয়া প্রশাসন পাকিস্তান নৌবাহিনীকে পূর্ব পাকিস্তানে নৌ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য চাপ দিতে থাকে। যার ফলে পাকিস্তান নৌবাহিনী সদরদপ্তরকে তাদের মূল পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে হয় এবং কোন প্রকার বন্দর সুবিধা ছাড়াই গাজীকে যুদ্ধে মোতায়ন করা হয়।[২৮] অনেক জ্যেষ্ঠ কমান্ডার অনুভব করেছিলেন, গাজীকে শত্রু সীমার ভেতরে কোন অভিযানে প্রেরণ করা হবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটি কাজ এবং একটি মাত্র অপ্রচলিত ডুবোজাহাজের পক্ষে লক্ষ্য অর্জন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে গাজীকে দিয়ে অভিযান পরিচালনা করা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়।[২৮]
অভিযানে প্রেরণের পূর্বেই গাজীর বিভিন্ন যন্ত্রাংশে সমস্যা দেখা দিতে থাকে এবং অনেক পুরাতন ডুবোহাজাজ হওয়ায় তাতে বয়সজনিত সমস্যা দেখা দেয়। সেসময়ে গাজীই ছিল পাকিস্তানের একমাত্র ডুবোজাহাজ যেটি দূরবর্তী অবস্থানে গিয়ে শত্রু সীমার ভেতরে আক্রমণ করতে সক্ষম ছিল। তাই গাজীকে বাধ্য হয়েই অভিযানে প্রেরণ করা হয়, যার লক্ষ্য ছিল ভারতীয় নৌবাহিনীর বিমানবাহী রণতরী বিক্রান্তকে ধ্বংস বা ক্ষতিসাধন করা।[৩১] ১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর গাজী ১০ জন কর্মকর্তা এবং ৮২ জন নাবিক নিয়ে আরব সাগরের ভারতীয় অংশ দিয়ে গোপনে ৩,০০০ মাইল (৪,৮০০ কিলোমিটার) পথ পাড়ি দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পৌছায়। এই অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন কমান্ডার জাফর মুহাম্মদ, যিনি প্রথমবারের মতো একটি ডুবোজাহাজের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করছিলেন।[২৮] গাজীর এই অভিযানের দুইটি লক্ষ্য ছিল। প্রধান লক্ষ্য ছিল, ভারতীয় রণতরী বিক্রান্তকে খুজে বের করা এবং ধ্বংস করা এবং প্রথম লক্ষ্য সফল হলে ভারতের পূর্ব উপকূলে মাইন পেতে রেখে আসা।
Remove ads
পরিণতি
সারাংশ
প্রসঙ্গ
১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর বিক্রান্তে হামলা বা বঙ্গোপসাগরের বিশাখাপত্তনম বন্দর মাইন পাতার সময় রহস্যজনকভাবে গাজী ডুবে যায়।[৩১] গাজীর ডুবে যাওয়ার ঘটনাটিকে ভারতীয় এবং পাকিস্তানি সুত্রগুলো ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করে, তবে গাজীর ডুবে যাওয়ার প্রকৃত কারণ এখনো অজানা থেকে গেছে।
নভেম্বরের ১৬ তারিখে গাজী পাকিস্তান নৌবাহিনীর সদরদপ্তরের সাথে যোগাযোগ করেছিল এবং সে সময় কমান্ডার খান রিপোর্ট করেন যে, গাজী বম্বে থেকে ৪০০ কিলোমিটার (২৫০ মাইল) দূরত্বে অবস্থান করছে।:৮২[৩২] নভেম্বরের ১৯ তারিখে শ্রীলঙ্কা ত্যাগ করে ডুবোজাহাজটি ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে।:৮২[৩২] সেসময়ে নির্দেশনা অনুযায়ী গোপন নথিপত্র গুলো খোলা হয় এবং বিক্রান্তকে খোজার প্রক্রিয়া শুরু হয় ২৩ নভেম্বর। গাজী ভারতীয় বিমানবাহী রণতরীর খোঁজে মাদ্রাজ উপকূলে প্রবেশ করে, যেটি ছিল বিক্রান্তের ঘাঁটি। কিন্তু গাজীর সেখানে পৌঁছাতে প্রায় ১০ দিন বিলম্ব হয় এবং ততদিনে বিক্রান্ত প্রকৃতপক্ষে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের নিকটে অবস্থান করছিলো।:৮২[৩২][৩৩] লক্ষ্যবস্তুকে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হলে গাজীর কমান্ডারগন বিক্রান্তকে খোঁজার বদলে বিশাখাপত্তনমে মাইন পাতার প্রতি অধিক গুরুত্ব দেন এবং ১৯৭১ সালে ২-৩ ডিসেম্বর রাতে বিশাখাপত্তনমে ফিরে এসে মাইন পাতা শুরু করেন। তারা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, বিক্রান্ত অথবা ভারতের এই প্রধান নৌ ঘাঁটিতে অবস্থানরত কোন বড় যুদ্ধজাহাজ তাদের পাতা মাইনে ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।"[২৮]
১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর ভারতীয় নৌবাহিনীর ভাইস এডমিরাল নিলাকান্ত কৃষ্ণান আইএনএস রাজপুতের কমান্ডিং অফিসার ইন্দর সিংকে অবহিত করেন যে, শ্রীলঙ্কার উপকূলে একটি পাকিস্তানি ডুবোজাহাজের দেখা পাওয়া গেছে এবং নিশ্চিতভাবেই সেটি বর্তমানে মাদ্রাজ বা বিশাখাপত্তনমের নিকটে কোথাও অবস্থান করছে।[৩৪] তিনি এটি স্পষ্ট করে বলেন যে, রাজপুতের জ্বালানী গ্রহণ শেষ হলেই যেন তা পোতাশ্রয় ত্যাগ করে এবং সেখানে যেকোন প্রকার নৌ সাহায্য আসার পথে বন্ধ করে দেয়।[৩৪]
ভারতীয় দাবী অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর রাত ১৩ঃ৪০ মিনিটে রাজপুত প্রনালীর মধ্য দিয়ে বিশাখাপত্তনম ত্যাগ করে চলে যায়।[৩৪][৩৫]
ঠিক মধ্যরাতে, বন্দরের প্রবেশপথ অতিক্রম করার সময় যুদ্ধজাহাজের ডানদিকের লক্ষ্যকারি নাবিকেরা পানির একটি অংশে উপরিতলকে বিভাজিত হতে দেখেছে বলে রিপোর্ট করে। ভারতীয় নৌবাহিনীর দাবী অনুযায়ী, ক্যাপ্টেন সিং তৎক্ষণাৎ জাহাজের গতিপথ পরিবর্তন করেন এবং ঐ স্থানে গিয়ে পানির গভীর আঘাত করার নির্দেশ দেন।[৩৪] বোমার আঘাতের প্রতিক্রিয়ায় মারাত্নক বিস্ফোরণ হয় এবং তার ফলে রাজপুতের কাঠামো ও বিভিন্ন যন্ত্রাংশের মারাত্মক ক্ষতি হয়। যদিও, এই আক্রমণের ফলে কোন দৃশ্যমান ফলাফল পাওয়া যায়নি।[৩৪] রাজপুত কিছু সময় এলাকা পর্যবেক্ষণ করে এবং বোমা নিক্ষেপ করে। কিন্তু, কোন প্রকার শব্দ বা দৃশ্য দেখতে পায়নি। সেখানে কয়েক মিনিট অবস্থানের পরে রাজপুত পুনরায় পূর্ব পাকিস্তান উপকূলের দিকে চলতে শুরু করে।[৩৪][৩৫]
১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর অজানা এবং রহস্যাবৃত কারণে গাজী তার ৯২ জন নাবিক সহ বিশাখাপত্তনম উপকূলে ডুবে যায়।:১৫৭[৩১][৩৬] এর ফলে ভারতীয় নৌবাহিনী পূর্ব পাকিস্তান উপকূলে (বর্তমান বাংলাদেশ) একটি কার্যকারী নৌ অবরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।:১৫৭[৩৬]
গোয়েন্দা তথ্য ও প্রতারণা
ভারতীয় নৌবাহিনীর পরিচালক রিয়ার এডমিরাল মিহির কে. রয়ের মতে, গাজীর উপস্থিতি তাদের কাছে প্রকাশ পায় যখন তারা চট্টগ্রাম নৌ কর্তৃপক্ষের একটি সংকেতে আড়ি পাততে সক্ষম হন। ঐ সংকেতে এক ধরনের লুব্রিকেন্ট তেলের বিষয়ে তথ্য চাওয়া হচ্ছিলো, যেটা শুধু মাত্র ডুবোজাহাজ এবং খনিশ্রমিকেরা ব্যবহার করে।[৩১][৩৭]
ভারতীয় নৌবাহিনীর গোয়েন্দারা গাজীর সাংকেতিক নাম দেন কালী দেবী।[৩৮] ভারতীয় নৌবাহিনী এটা উপলব্ধি করতে শুরু করেছিলো যে, পাকিস্তান তার ডুবোজাহাজ গাজীকে বঙ্গোপসাগরে পাঠাতে বাধ্য হবে, কারণ পূর্ব পাকিস্তান উপকূলে ডুবোজাহাজ ছাড়া অন্য কোন জাহাজ পরিচালনা করা সেসময়ে পাকিস্তানের পক্ষে সম্ভব ছিলনা।[৩৮]
ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় নৌ কমান্ডের ভাইস এডমিরাল নীলাকান্ত কৃষ্ণান এর মতে, এটা নিশ্চিত ছিল যে পাকিস্তান ভারতের বিমানবাহী রণতরী বিক্রান্তকে ডুবিয়ে দেবার জন্য পরিকল্পনা করবে এবং সেই লক্ষ্যে গাজীকে বঙ্গোপসাগরে প্রেরণ করবে। সেই সময়ে বিমানবাহী রণতরীর প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে শত্রুকে বিভ্রান্ত করার জন্য সমন্বিতভাবে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং শত্রুকে এই তথ্যের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী করে তোলা হয় যে, বিমানবাহী রণতরীটি বিশাখাপত্তনমেই অবস্থান করছে।[৩৪]
এই সকল প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড সফল হয় যখন, ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর পাকিস্তান নৌবাহিনী সদরদপ্তর গাজীকে এই বার্তা প্রেরণ করে যে, গোয়েন্দা সূত্রমতে বিমানবাহী রণতরী বিশাখাপত্তনম বন্দরে রয়েছে।[৩৫]
Remove ads
ফলাফল
সারাংশ
প্রসঙ্গ
১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর নৌ সদরদপ্তরের সাথে যোগাযোগ ও অভিযানের প্রতিবেদন দাখিলের কথা থাকলেও গাজী ঐদিন তার নৌ ঘাঁটির সাথে যোগাযোগ করেনি।[৩৯] নৌ সদরদপ্তর বারংবার গাজীর সাথে যোগাযোগ করার প্রবল চেষ্টা করতে থাকে এবং ঘাঁটিতে ফিরে আসার নির্ধারিত দিনের একদিন পরেও গাজীর কোন খোঁজ পাওয়া না গেলে উদ্বেগ বাড়তে থাকে।[৩৯] Before the ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান নৌযুদ্ধ শুরুর পূর্বে কমান্ডিং অফিসারগণ গাজীর পরিণতি নিয়ে মারাত্মক চিন্তিত হয়ে ওঠেন। যদিও, নৌ সদরদপ্তর তাদের জুনিয়র কর্মকর্তাদেরকে এই বলে সান্ত্বনা দিতে থাকে যে, এমন অনেক কারণ ঘটতে পারে যার ফলে হয়তো গাজী নৌ সদরদপ্তরের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হচ্ছে না।[৩৯]
৯ ডিসেম্বর ভারতীয় নৌবাহিনী হঠাত করেই গাজীর পরিণতি সম্পর্কে একটি বিবৃতি জারি করে। গাজীর ডুবে যাওয়ার ব্যাপারে প্রথম ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যখন ভারতীয় নৌ সদরদপ্তর দাবী করে যে ৩ ডিসেম্বর রাতে একটি আক্রমণে গাজী ডুবে গেছে।[৩৯] আইএনএস খুকরী ডুবে যাওয়া কয়েকঘণ্টা পূর্বে ভারতীয় নৌ সদরদপ্তর এই বার্তাটি জারি করে এবং এর কিছুক্ষন পরেই করাচি বন্দরে দ্বিতীয় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়।[৩৯]
ভারতীয় ব্যাখ্যা
১৯৭১ সালে যুদ্ধবিরতির পরে ভারত সরকার একটি তদন্ত পরিচালনা করে এবং তৎক্ষণাৎ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ভারতীয় নৌবাহিনীর আক্রমণের ফলেই গাজী ডুবে গেছে।[৩৯] ডুবোজাহাজের ধ্বংসাবশেষ পরীক্ষার জন্য সেখানে ভারতীয় নৌবাহিনীর ডুবোজাহাজ উদ্ধারকারী জাহাজ আইএনএস করঞ্জকে পাঠানো হয় এবং ঠিক যেখানে গাজী ডুবে গেছে সেখানে একটি বিজয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়।[৪০] ভারত গাজীকে ডুবিয়ে দেবার কৃতিত্ব আইএনএস রাজপুতকে দেয় এবং ঐ রণতরীর সকল নাবিককে সম্মাননা স্বরূপ সামরিক পদক প্রদান করা হয়। তবে যুদ্ধের পরে গাজীর ডুবে যাওয়ার প্রকৃত বিবরণ দ্রুতই বেড়িয়ে আসতে থাকে।[২]
গাজীর ডুবে যাওয়া সম্পর্কে প্রদান করা তথ্য ভারতীয় লেখকদের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি করে এবং তারা গাজীর রহস্যাবৃত ডুবে যাওয়ার পেছনে যে তত্ত্ব প্রদান করা হয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করতে থাকে।[৩৯] কমোডোর রঞ্জিত রয় এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সমুদ্রের পানির গভীরে ঘটে যাওয়া একটি প্রবল বিস্ফোরণের শব্দ সৈকত হয়ে শুনতে পাওয়া যায়।"[৩৯] কমোডোর রয় শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ...গাজী কীভাবে ডুবেছে তা আজ পর্যন্ত অস্পষ্ট।"[৩৯]
অবসরপ্রাপ্ত ভাইস এডমিরাল জি. এম. হিরানান্দানি ভারতীয় নৌবাহিনীর দাপ্তরিক ইতিহাসঃ ‘ট্রাঞ্জিশন টু ট্রায়ামপ্ফ’ গ্রন্থে গাজীর ডুবে যাওয়ার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। তিনি নৌবাহিনীর নথিপত্র এবং ঘটনার সময় পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলে কর্মরত কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি করে বলেছেন, গাজীকে খুজে বের করার জন্য বিশাখাপত্তনম বন্দর হতে আইএনএস রাজপুতকে পাঠানো হয়েছিলো। তিনি বইয়ে আরো উল্লেখ করেন, রাজপুত থেকে বোমাবর্ষণের পরে বিশাখাপত্তনমের অধিবাসীরা যে সময় বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনেছিল, পরবর্তীতে গাজীর ধ্বংসাবশেষ পরীক্ষা করে দেখা যায় বিস্ফোরণ ঠিক সে সময়েই হয়েছিলো।[৪১] যদিও, এডমিরাল হিরানান্দানি এটাও উল্লেখ করে যে, ডুবোজাহাজটি নিশ্চিতভাবেই একটি অভ্যন্তরীণ বিস্ফোরণের শিকার হয়েছিলো এবং তা ঠিক কি কারণে ঘটেছে তা সন্দেহজনক।[১৮]
এডমিরাল রয়ের মতে, প্রথমদিকে যুদ্ধের সময় শত্রুকে বোকা বানানোর জন্য কিছু গল্প ফাঁদা হয়, যেখানে ভারত মহাসাগরে প্রথম কোন ডুবোজাহাজ ডুবিয়ে দেবার কৃতিত্ব ভারতীয় নৌবাহিনীকে দেয়া হয়।[৩৭]
যুদ্ধের সময়ে ভারতীয় নৌবাহিনীর নেভাল স্টাফের প্রধান এডমিরাল এস. এম. নান্দা বলেন, মারাত্মক যুদ্ধের সময় যুদ্ধজাহাজগুলো সরু চ্যানেলে ডুবোজাহাজকে প্রতিহত করার জন্য ঘন ঘন বোমা হামলা করে। সম্ভবত, তার মধ্যেই কোন একটি বোমা গাজীকে ধ্বংস করেছে। তবে জেলেরা লাইফ জ্যাকেট পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কেউই এই বিষয়ে অবগত ছিলনা।[৪২]
২০০৩ সালে ভারতীয় নৌবাহিনী তদন্ত করার জন্য পুনরায় কিছু ডুবুরিকে সাগরতলে পাঠায়। ডুবুরিরা ধ্বংসাবশেষ হতে কিছু জিনিস উদ্ধার করেন, যার মধ্যে রয়েছে যুদ্ধ সংক্রান্ত নথি, কমিউটার হতে পাওয়া যায় অফিসিয়াল ব্যাপআপ টেপ এবং অভিযানের নথিপত্র, পরবর্তীতে এগুলোকে ভারতীয় নৌবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের হাতে হস্তান্তর করা হয়। তবে, ধ্বংসাবশেষের মধ্যে ঘুরে আসা ডুবুরিরা এটা নিশ্চিত করেন যে, ডুবোজাহাজটি একটি অভ্যন্তরীণ বিস্ফোরণের শিকার হয়েছিলো, যার ফলে এর ভেতরের মাইন এবং টর্পেডোগুলোতে বিস্ফোরণ ঘটে।[৪৩] আরেকটি তত্ত্ব অনুযায়ী দাবী করা হয় যে, ডুবোজাহাজটি হয়তো হাইড্রোজেন গ্যাসের বিস্ফোরণের ফলে ডুবে গিয়েছিলো।[১৮]
২০১০ সালে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে. এফ. আর. জ্যাকব একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন এবং সেখানে উল্লেখ করেন যে, একটি দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে গাজীর সমাপ্তি হয়েছে এবং ধ্বংসাবশেষের নথিপত্র দেখলে বোঝা যায় তার ডুবে যাওয়ার সাথে ভারতীয় নৌবাহিনীর কোন সম্পর্ক ছিল না।[৪৪] এছাড়াও, এমন আরো অনেক লেখক রয়েছেন যারা ভারতীয় নৌবাহিনী গাজীর ডুবে যাওয়া সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ পোষন করেছেন।[৪৪]
২০১১ সালে সাবেক ভারতীয় নৌ প্রধান অরুন প্রকাশ জাতীয় নিরাপত্তা সম্মেলনে মন্তব্য করে যে, গাজী কোন একটি রহস্যজনক কারণে ডুবে গিয়েছিলো এবং নৌবাহিনী দাবী করলেও বাস্তবে গাজীর ডুবে যাওয়ার সাথে আইএনএস রাজপুতের কোন সম্পর্ক নেই।[৪৫]
পাকিস্তানি ব্যাখ্যা

১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতার মূল্যায়নের জন্য ১৯৭২ সালে গঠিত হামুদুর রহমান কমিশন, কিন্তু এই কমিশন গাজীর ডুবে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে কোন প্রকার অনুসন্ধান করেনি।[৪৬]
১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার গাজীর ডুবে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে এবং প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো গাজীতে দায়িত্ব পালনকারী নাবিকদের পরিবার ও প্রিয়জনদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাদের বলেন যে হয়তো এই দুর্ঘটনায় গাজীতে দায়িত্ব পালনাকারী সকল নাবিক নিহত হয়েছেন। সেসময়ে নিহত সদস্যদের পরিবার পাকিস্তান সরকারের উপরে চাপ সৃষ্টি করেছিল এবং তারা আশায় ছিল যে গাজী দুর্ঘটনা কবলিত হবার পরে ভারত হয়তো তাদের উদ্ধার করেছে।[৩৯]
পাকিস্তানের নৌবাহিনীর গোয়েন্দাবিভাগ ঘটনাটি নিয়ে নিজস্ব তদন্ত চালায় এবং সামরিক বিভাগ থেকে বলা হয়, সমুদ্র তলে মাইন পাতার সময় ঘটনাক্রমে সেটার বিস্ফোরণ হলে গাজি ডুবে যায়।[৪৭] এই ঘটনাটি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে ছিল না, অন্যদিকে নৌবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগ তদন্ত শেষ করে সমাধানে পৌঁছাতে বেশ কয়েক বছর সময় নেয়। কয়েক দশক ধরে সামরিক তদন্ত প্রতিবেদন গুলোকে গোপন রাখা হয় এবং ১৯৯০ এর নৌবাহিনী গাজীর ডুবে যাওয়ার ঘটনার ব্যাপারে ঘোষণা দেবার পূর্ব পর্যন্ত তা সাধারন লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল।[২৮] সেই ঘোষণা থেকে পাকিস্তান যে সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করেছে তার মধ্যে রয়েছে তড়িৎযন্ত্র প্রকৌশলগত ত্রুটি, কম্পিউটারের সমস্যা এবং মার্ক ১৪ টর্পেডোর অভ্যন্তরীণ বিস্ফোরণের ফলে ডুবোজাহাজটি ধ্বংস হয়।
পাকিস্তান গাজীর ডুবে যাওয়া প্রসঙ্গে ভারতীয় নৌবাহিনীর দেয়া ব্যাখ্যা গ্রহণ করেনি এবং বিকল্প ব্যাখ্যা প্রদান করে। তারা মূলত মার্ক ১৪ টর্পেডো এবং ঐ ডুবোজাহাজে সংযোজনকৃত পুরাতন সরঞ্জামাদির উপরে তদন্ত করে সিদ্ধান্তে পৌঁছঁছায়। পাকিস্তান নৌবাহিনীর তদন্ত অনুযায়ী, এই k . 94 সাথে যুক্ত দুটি সম্ভাব্য কারণ রয়েছে:
- *চৌম্বক বিস্ফোরণ/হাইড্রোজেন বিস্ফোরণ: একটি সারগো শ্রেণীর লেড-এসিড ব্যাটারি হয়তো ডুবোজাহাজের ব্যাটারিয়া চার্জ করার সময় অধিক মাত্রায় হাইড্রোজেন গ্যাসের সৃষ্টি করেছে, যার ফলে হয়তো অভ্যন্তরীণ বিস্ফোরণ ঘটেছে।[৩৮]
- *ডুবোজাহাজের ভেতরে মাইন বিস্ফোরণ: পাকিস্তান নৌবাহিনী প্রায়ই উদ্ধৃত করে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের এমকে.১০/এমকে.১৪ ধরনের মাইন সাগরের তলদেশে পাতার সময় হয়তো সেটাতে বিস্ফোরণ ঘটেছে, যার প্রতিক্রিয়ায় গাজী বিধ্বস্ত হয়।[২৮][৪৭][৪৮][৪৯]
বিদেশী বিশেষজ্ঞদের দ্বারা আরেকটি সাম্ভাব্য তত্ত্ব যেটি পাকিস্তানের দাবীকে সমর্থন করে তা হলো, গভীর বোমা আক্রমণের ফলে সৃষ্ট শক ওয়েভে হয়তো ডুবোজাহাজের বাইরে নিয়োজিত টর্পেডোতে বিস্ফোরণ ঘটায়, যার ফলে ডুবোজাহাজটি ধ্বংস হয়।[৩৪][৩৯] পাকিস্তান নৌবাহিনীর আরেকটি ধারণা অনুযায়ী, গাজী বিশাখাপত্তমন উপকূলে মাইন বসানোর সময় হয়তো অসাবধানতাবশত নিজেই আগে থেকে পেতে 9রাখা মাইনের বিস্ফোরণের স্বীকার হয় অথবা ভারতীয় নৌবাহিনীর টহল জাহাজের আক্রমণে হয়তো সমুদ্রের গভীরের পেতে রাখা মাইন বিস্ফোরিত হয়, যার ফলশ্রুতিতে গাজী বিধ্বস্ত হয়।[৩৯] ২০০৩ সালে ভারতীয় উপকূলরক্ষী বাহিনীর অভিযানের পরে এই তত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়, কারণ তখন দেখা যায় যে গাজীর ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলো ভেতরের দিক থেকে ধ্বংস হয়েছে।[৩৪][৫০]
উপরন্তু, পাকিস্তানের নৌ গোয়েন্দা বিভাগের তদন্তে প্রকাশিত হয় যে, দুর্ঘটনার সময় গাজীতে কর্মরত সেনারা পূর্বে কখনোই কীভাবে মাইন পাততে হয় সে বিষয়ক প্রশিক্ষণ নেয়নি, ফলে গাজীকে এই অভিযানে পাঠানো একটি অবিবেচনা প্রসূত সিদ্ধান্ত ছিল।
২০০৬ সালে পাকিস্তান তাদের প্রমাণের উদ্ধৃতি দিয়ে গাজীর ডুবে যাওয়ার বিষয়ে ভারতীয় দাবীকে জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করে এবং ভারতের দাবীকে "মিথ্যা এবং নিতান্তই অদ্ভুত" বলে অভিহিত করে।[৫১]
নিরপেক্ষ সাক্ষী ও মূল্যায়ন
মিশরীয় নৌবাহিনীর একজন নিরপেক্ষ কর্মকর্তা উল্লেখ করেন যে, গাজী ডুবে যাওয়া সময়ে ভারতীয় যুদ্ধজাহাজগুলো বিশাখাপত্তনম বন্দরের ডকইয়ার্ডে ছিল।[১৫]
বিভিন্ন স্বাধীন লেখন এবং তদন্তকারী উল্লেখ্ করে করেন যে, গাজী রহস্যজনকভাবে ধ্বংস হয়েছে, তবে এটি কোন শত্রু জাহাজের গভীর আক্রমণের ফলে ধ্বংস হয়নি। তাদের মতে, ব্যাটারি চার্জ হবার সময় হাইড্রোজেন বিস্ফোরণ বা মাইন বিস্ফোরণ বা আইএনএস রাজপুতের আক্রমণ থেকে এড়ানোর সময় সমুদ্র তলের প্রতিক্রিয়ায় গাজী বিধ্বস্ত হয়।[১৮][৩৮]
২০১২ সালে পাকিস্তানি পত্রিকা দা এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক দিয়াবলো অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ সাবেক মার্কিন নৌবাহিনী সদস্যদের সংস্পর্শে আসতে সক্ষম হন। তারা ডুবে যাওয়া জাহাজের সোনার চিত্র এবং স্কেচ ম্যাপ পর্যালোচনা করতে রাজি হন এবং শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, সম্মুখভাগের টর্পেডো কক্ষে কোন একটি বিস্ফোরণের ফলে হয়তো গাজী বিধ্বস্ত হয়।[৪৪] সামরিক ও কৌশলগত বিশ্লেষণে দক্ষ ভারতীয় সাংবাদিক সন্দ্বীপ উন্নিথানও একই ধারণা পোষন করেন।[৪৪]
Remove ads
নিমজ্জিত জাহাজ পুনরুদ্ধার
১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়েই তাদের নিজস্ব অর্থায়নে বিধ্বস্ত ডুবোজাহাজটি উত্তোলনের প্রস্তাব দেয়।[৩৭] যদিও, ভারতীয় সরকার এসকল প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং ডুবোজাহাজটিকে বিশাখাপত্তনম বন্দরের পানির নিচে কাদায় নিমজ্জিত হবার জন্য ফেলে রাখে।[৩৭]
২০০৩ সালে ভারতীয় নৌবাহিনীর ডুবুরিরা ডুবোজাহাজটি থেকে কিছু দ্রব্য সামগ্রী উদ্ধার করে এবং পাশাপাশি ছয়জন পাকিস্তানি নাবিকের পুড়ে যাওয়া লাশ উপরে তুলে আনে, যারা ডুবোজাহাজটির ভেতরের বিস্ফোরণে মৃত্যুবরণ করেছিল।[১৮] ভারতীয় নৌবাহিনী ছয়জন পাকিস্তানি সৈন্যের লাশ যথাযথ সামরিক সম্মানের সহিত দাফন করে। পুনরুদ্ধারকৃত দ্রব্যগুলোর মধ্যে ছিল ডুবোজাহাজের কম্পিউটারের ব্যাপ আপ টেপ, যুদ্ধ নথি, ভাঙা উইন্ডশিল্ড, অত্যন্ত গোপনীয় নথিপত্র ইত্যাদি। এছাড়াও একজন যন্ত্র প্রকৌশল কর্মকর্তার দেহ উদ্ধার করা হয়, যিনি একটি হুইল স্প্যানারকে তার মুষ্ঠিতে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে ছিলেন।[১৮] আরেকজন নাবিকের পকেট হতে উর্দুতে লেখা একটি প্রেমপত্র পাওয়া যায়, যেটা তিনি তার বাগদত্তার জন্য লিখেছিলেন।[১৮]
২০০৩ সালে ভারতীয় নৌবাহিনী ডুবোজাহাজটির আরো কিছু ছবি প্রকাশ করে।[১৮]
Remove ads
উত্তরাধিকার
সারাংশ
প্রসঙ্গ
স্মৃতি
১৯৭২ সালে গাজী এবং তাতে দায়িত্বরত কর্মকর্তা এবং নাবিকদেরকে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক সাহসিকতার জন্য সম্মাননা স্বরূপ সামরিক পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।[৫২][৫৩] যুদ্ধের পরে মার্কিন নৌবাহিনীর সিএনও এডমিরাল এলমো জুমাওয়াল্ট কলকাতায় এডমিরাল মোহাম্মদ শরীফের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তার ফলশ্রুতিতে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন গাজীর বিক্রয় বাবদ পাকিস্তানের কাছ থেকে পাওনা অবশিষ্ট অর্থ মওকুফ করেন।:২১৯–২২৬[৩৭] এখন পর্যন্ত গাজীই হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি একমাত্র ডুবোজাহাজ, যেটি পাকিস্তান নৌবাহিনীকে সেবা প্রদান করেছে। যদিও, পরবর্তীতে পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিছু ভাসমান যুদ্ধজাহাজ ক্রয় করে এবং নিজ দেশেই দূরবর্তী আক্রমণে সক্ষম ডুবোজাহাজ নির্মাণ প্রকল্পে হাত দেয়। এসময়ে পাকিস্তান ফ্রান্সের সাথে প্রযুক্তি হস্তান্তর চুক্তির মাধ্যমে অগস্তা ৯০বি শ্রেণীর ডুবোজাহাজ তৈরি প্রকল্পের সূচনা করে।[৫৪]
গাজীতে সেবাদানকারী ৯৩ জন শহীদের স্মৃতি ধরে রাখতে করাচির নেভাল ডকইয়ার্ডে একটি গাজী স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলা হয়।[৫৫] ১৯৭৪ সালে কমান্ডার জাফর মুহাম্মদ খানের স্মৃতিতে পিএনএস জাফর নৌ ঘাঁটি গড়ে তোলা হয় এবং এটি বর্তমানে পাকিস্তান নৌবাহিনীর উত্তরাঞ্চলীয় কমান্ডের সদরদপ্তর।[৫৫] ১৯৭৫ সালে পাকিস্তান পর্তুগীজ নৌবাহিনীর কাছ থেকে আলবাকোরা শ্রেণীর একটি ডুবোজাহাজ অধিগ্রহণ করে এবং পিএনএস গাজীর স্মরণে তার নামকরণ করে গাজী (এস-১৩৪)।[৫৬]
১৯৯৮ সালে ইন্টার-সার্ভিস পাবলিক রিলেশন একটি টেলিফিল্ম প্রযোজনা করে, যার না ছিল গাজী শহীদ। চলচ্চিত্র তারকা শাব্বির খান এতে গাজীর কমান্ডারের ভূমিকায় অভিনয় করেন এবং মিশি খান কমান্ডারের স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেন। এই টেলিফিল্মে গাজীর অভিযান সম্পর্কিত বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরা হয় এবং সেসব সৈন্য গাজীতে নিহত হয়েছে তাদের জীবন তুলে ধরা হয়।[৫৭] ২০১৫ সালে আইএসপিআর কর্তৃক স্পন্সর ও পরিবেশনকৃত আরেকোটি চলচ্চিত্র আনটোল্ড স্টোরিঃ গাজী এন্ড হাঙর প্রকাশিত হয়, যেখানে ১৯৭১ সালে গাজী এবং তার শহীদ সৈন্যদের স্মরণ করা হয়।[৫৩] ২০১৭ সালে এই ডুবোজাহাজের আক্রমণের উপর ভিত্তি করে দা গাজী এটাক নামে একটি ভারতীয় চলচ্চিত্র মুক্তি পায়।
২০১৬ সালে পিএনএস হামিদকে কমিশন প্রদান করা সময় গাজীকে সম্মান জানানো হয় এবং গাজীর প্রথম কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট পারভেজ হামিদের নামে নতুন যুদ্ধজাহাজটির নামকরণ করা হয়।[৫৮]
উল্ল্যখযোগ্য অধিনায়কগণ
- কমান্ডার গর্ডন গ্রাহাম ম্যাথিসন-মার্কিন নৌবাহিনীর কর্মকর্তা এবং ডুবোজাহাজটির প্রথম কমান্ডিং অফিসার (১৯৪৫-১৯??)।
- কমান্ডার কেরামত রহমান নিয়াজি- পরবর্তীতে চার-তারকা র্যাংক বিশিষ্ট এডমিরাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৬৪ হতে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত গাজীর কমান্ডার ছিলেন।
- কমান্ডার আহমেদ তাসনিম- ১৯৭১ সালে পিএনএস হাঙ্গরের কমান্ডার ছিলেন এবং পরবর্তীতে ভাইস-এডমিরাল হন। তিনি ১৯৬৬-১৯৬৯ সাল পর্যন্ত গাজীর নেতৃতে ছিলেন।
- লেফটেন্যান্ট কমান্ডার ইউসুফ রাজা- ১৯৬৯ হতে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত গাজীর কমান্ডার ছিলেন।
- কমান্ডার জাফর মুহাম্মদ খান- ১৯৭১ সালে ডুবে যাওয়ার সময় পর্যন্ত গাজীর সর্বশেষ কমান্ডার।
সম্মাননা ও পুরস্কার
![]() |
![]() | |||
সিতারা-ই-জুরাত (১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালে পুরস্কৃত) |
রাষ্ট্রপতি পদক (১৯৬৫) |
তামঘা-ই-জুরাত (১৯৬৫ সালে পুরস্কৃত) |
Remove ads
তথ্যসূত্র
বহিঃসংযোগ
Wikiwand - on
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Remove ads