শীর্ষ প্রশ্ন
সময়রেখা
চ্যাট
প্রসঙ্গ
বাহাই ধর্ম
১৯ শতকে প্রতিষ্ঠিত ইব্রাহিমীয় একেশ্বরবাদী ধর্ম উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
Remove ads
বাহা'ই ধর্ম হলো উনবিংশ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত একটি ধর্ম, যা সব ধর্মের মৌলিক মূল্য ও সমগ্র মানবজাতির ঐক্য শিক্ষা দেয়। বাহা'উল্লাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত, এটি প্রথমে ইরান ও মধ্যপ্রাচ্য-এর কিছু অংশে বিকশিত হয়, যেখানে সূচনালগ্ন থেকেই এটি ধারাবাহিক নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছে।[১] এর অনুসারীরা, যাদের 'বাহা'ই' বলা হয়, বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে রয়েছে।

বাহা'ই বিশ্বাস অনুযায়ী, বিশ্বের সকল ধর্ম একই উৎস থেকে উদ্ভূত। বিশ্বাস করা হয় যে বিভিন্ন ব্যক্তি ঈশ্বরের বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছাতে বিভিন্ন সময়ে নতুন ধর্ম প্রবর্তন করেছেন, যা সেই সময় ও প্রেক্ষাপটের উপযোগী ছিল। বাহা'উল্লাহকে ঈশ্বরের এক প্রকাশরূপ হিসেবে গণ্য করা হয়, যিনি সমগ্র বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করতে এসেছেন; তাঁর উদ্দেশ্য ও বাণী হলো: “পৃথিবী একটাই দেশ, আর মানবজাতি তার নাগরিক।” ঈশ্বর এক, এবং মানবতাকে শিক্ষিত করার জন্য তিনি সময়ে সময়ে তাঁর প্রকাশসমূহকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন।
Remove ads
বাহা'ই ধর্ম
সারাংশ
প্রসঙ্গ
বাহা'উল্লাহ-এর শিক্ষাসমূহই বাহা'ই বিশ্বাসের ভিত্তি গঠন করে। এই শিক্ষার কেন্দ্রে তিনটি নীতি রয়েছে: ঈশ্বরের ঐক্য, ধর্মের ঐক্য এবং মানবতার ঐক্য। বাহা'ইরা বিশ্বাস করে যে ঈশ্বর সময়ে সময়ে ঐশ্বরিক দূতদের মাধ্যমে তাঁর ইচ্ছা প্রকাশ করেন, যার উদ্দেশ্য মানবজাতির চরিত্রকে রূপান্তরিত করা এবং ব্যক্তিদের মধ্যে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক গুণাবলি বিকশিত করা। ফলে যুগে যুগে ধর্মকে সুশৃঙ্খল, ঐক্যবদ্ধ ও প্রগতিশীল হিসেবে গণ্য করা হয়।[২]
ঈশ্বর
বাহা'ই ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী, ঈশ্বরকে একক, অনন্ত, সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপী, অবিনশ্বর এবং সর্বশক্তিমান এক সত্তা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা।[৩] ঈশ্বরের অস্তিত্বকে চিরন্তন হিসেবে ধরা হয়; এর কোনো শুরু বা শেষ নেই। যদিও ঈশ্বর সরাসরি মানুষের নাগালের বাইরে, তবুও তিনি তাঁর সৃষ্টির ব্যাপারে সচেতন এবং তাঁর একটি ইচ্ছা ও উদ্দেশ্য আছে, যা তিনি মানবজাতির নিকট তাঁর আবির্ভাবসমূহের মাধ্যমে ব্যক্ত করেন, যাঁদেরকে 'ঈশ্বরের আবির্ভাবসমূহ' বলা হয়।[৪] বাহা'ইদের ঈশ্বর-ধারণা হলো একটি 'অজ্ঞেয় সত্তা', যিনি সকল অস্তিত্বের উৎস এবং মানবীয় গুণাবলি অনুধাবনের মাধ্যমে পরিচিত হন। আরেক অর্থে, ঈশ্বর সম্পর্কে বাহা'ই শিক্ষা সর্বেশ্বরবাদীও; সমস্ত কিছুর মধ্যে ঈশ্বরের নিদর্শন দেখা হয়, যদিও ঈশ্বরের বাস্তবতা ভৌত জগতের ঊর্ধ্বে এবং তার সীমার বাইরে।
বাহা'ই শিক্ষায় বলা হয়েছে যে ঈশ্বর এতই মহান যে মানুষ তাঁকে সম্পূর্ণরূপে অনুধাবন করতে পারে না, এবং এর ভিত্তিতে মানুষ নিজেরাই ঈশ্বরকে নিয়ে একটি সম্পূর্ণ ও যথার্থ ধারণা গড়ে তুলতে সক্ষম নয়। অতএব, ঈশ্বর সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান কেবল তাঁর প্রকাশসমূহের মাধ্যমে লাভ করা যায়, এবং তাঁর উদ্দেশ্য ও ইচ্ছাকে বোঝাও কেবল তাঁর প্রকাশসমূহের মাধ্যমেই সম্ভব।[৫] বাহা'ই ধর্মে ঈশ্বরকে প্রায়ই বিভিন্ন উপাধি ও গুণবাচক বিশেষণে (যেমন, সর্বশক্তিমান বা সর্বপ্রেমময়) সম্বোধন করা হয়, এবং একেশ্বরবাদের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বাহা'ই শিক্ষার মতে, এই গুণাবলি সরাসরি ঈশ্বরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়; বরং ঈশ্বরত্বকে মানবীয় ভাষায় অনুবাদ করতে এবং ঈশ্বরের উপাসনায় মানুষকে নিজেদের গুণাবলির উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে সহায়তা করার জন্য এগুলি ব্যবহৃত হয়, যাতে তাদের আধ্যাত্মিক পথে তাদের সক্ষমতা বিকশিত হয়।[৬] বাহা'ই শিক্ষানুসারে, মানুষের উদ্দেশ্য হলো প্রার্থনা, চিন্তন এবং অপরের সেবার মতো উপায়ে ঈশ্বরকে জানা ও তাঁকে ভালোবাসতে শেখা। [৬]
ধর্ম
বাহা'ই ধর্মের ক্রমবর্ধমান প্রত্যাদেশের ধারণার ফলে, তারা বিশ্বের সুপরিচিত ধর্মসমূহের বৈধতাকে স্বীকার করে; যাদের প্রতিষ্ঠাতা ও কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বদের ঈশ্বরের প্রকাশরূপ হিসেবে দেখা হয়।[৭] ধর্মীয় ইতিহাসকে যুগের একটি ধারাবাহিকতা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়, যেখানে প্রত্যেক প্রকাশরূপ কোনো না কোনো মাত্রায় আরও বিস্তৃত ও উন্নত প্রত্যাদেশ নিয়ে আসে, যা পবিত্র গ্রন্থের রূপে উপস্থাপিত হয় এবং ইতিহাসের ধারায় কমবেশি নির্ভরযোগ্যতার সঙ্গে পরিবাহিত হয়েছে, তবে অন্তত তার মৌলিক সারবত্তায় সত্য,[৮] এবং যে সময় ও স্থানে তা প্রকাশিত হয়েছে, তার জন্য তা উপযোগী।[৯] কোনো ধর্মের নির্দিষ্ট সামাজিক শিক্ষাগুলি (যেমন, প্রার্থনার দিকনির্দেশ, বা খাদ্য-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ) সময় ও স্থানের উপযোগী বিধান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরবর্তী কোনো প্রকাশরূপ দ্বারা বাতিল করা হতে পারে। এর বিপরীতে, কিছু সাধারণ নীতি (যেমন, ভ্রাতৃত্ব, বা দানশীলতা) সর্বজনীন ও স্থায়ী হিসেবে বিবেচিত হয়। বাহা'ই ধর্মে এই ক্রমবর্ধমান প্রত্যাদেশের প্রক্রিয়াটি কখনো শেষ হবে না; তবে একে চক্রাকার বলে ধরা হয়।
অঙ্গীকার

বাহা'ইরা ঐক্যকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়, এবং বাহা'উল্লাহ সম্প্রদায়কে একত্রে রাখতে ও মতভেদ নিরসনে স্পষ্ট কিছু বিধান স্থাপন করেছেন। এই কাঠামোর মধ্যে, কোনো ব্যক্তিগত অনুসারী ধর্মগ্রন্থের 'অনুপ্রাণিত' বা 'আনুষ্ঠানিক' ব্যাখ্যা প্রস্তাব করতে পারেন না, এবং ব্যক্তিরা বাহা'ই লেখায় প্রতিষ্ঠিত কর্তৃত্বক্রমকে সমর্থন করতে সম্মত হন।[১০] এই প্রথা বাহা'ই সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করেছে এবং কোনো গুরুতর বিভক্তি ঘটতে দেয়নি। বাহা'ইদের মধ্যে যে কোনো বিরোধ মীমাংসার চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ হলো সার্বজনীন ন্যায় বিচারালয়, এবং ডজনখানেক বিভক্তির প্রচেষ্টা হয় বিলুপ্ত হয়েছে, নয়তো অত্যন্ত ক্ষুদ্র রয়ে গেছে।[১১] এ ধরনের বিভক্তির অনুসারীদের 'অঙ্গীকারভঙ্গকারী' বলে বিবেচনা করা হয় এবং তাদের পরিহার করা হয়।[১২]
সামাজিক নীতিসমূহ
১৯১১–১৯১২ সালে আব্দুল-বাহা প্রথমবার ইউরোপ ও আমেরিকা সফরকালে, তিনি বাহা'ই ধর্মের মৌলিক নীতিসমূহ স্পষ্ট করতে জনসমক্ষে বক্তৃতা দেন।[১৩] এসবের মধ্যে ছিল পুরুষ ও নারীর সমতা, জাতিগত ঐক্য, বিশ্বশান্তির অপরিহার্যতা এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর আরও কিছু প্রগতিশীল ধারণা। মানবজাতির একত্বের ধারণা, যা বাহা'ইদের নিকট এক প্রাচীন সত্য, বহু ধারণার সূচনাবিন্দু। উদাহরণস্বরূপ, জাতিগত সমতা এবং ধন-দারিদ্র্যের চরম বৈষম্য দূরীকরণ ওই একত্বেরই অনিবার্য পরিণতি।[১৪] এই ধারণার আরেকটি ফল হলো একটি ঐক্যবদ্ধ বিশ্ব ফেডারেশনের প্রয়োজন; এর বাস্তবায়নকে উৎসাহিত করতে যে কিছু ব্যবহারিক সুপারিশ দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে একটি সর্বজনীন ভাষা, একটি মানসম্মত অর্থনৈতিক ও মাপজোকের ব্যবস্থা, সর্বজনীন বাধ্যতামূলক শিক্ষা এবং বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি আন্তর্জাতিক সালিশি আদালত প্রতিষ্ঠা। বিশ্বশান্তির লক্ষ্যে, বাহা'উল্লাহ বিশ্বব্যাপী সমষ্টিগত নিরাপত্তার একটি ব্যবস্থার রূপরেখা দিয়েছিলেন।[১৫]
বাহা'ই সামাজিক নীতিসমূহের অন্যান্য দিক আধ্যাত্মিক ঐক্যকে ঘিরে আবর্তিত হয়। ধর্মকে যুগে যুগে প্রগতিশীল হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কিন্তু নতুন এক দিব্য প্রকাশকে স্বীকৃতি দিতে হলে পরম্পরা ত্যাগ করতে হবে এবং সত্যের স্বাধীন অনুসন্ধান করতে হবে। বাহা'ইদের শেখানো হয় ধর্মকে ঐক্যের উৎস হিসেবে দেখা এবং ধর্মীয় পক্ষপাতকে ধ্বংসাত্মক হিসেবে গণ্য করা। বিজ্ঞানকেও সত্য ধর্মের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে দেখা হয়।[১৬] যুদ্ধমুক্ত এক ঐক্যবদ্ধ বিশ্বের আহ্বান জানানোর পাশাপাশি, বাহা'উল্লাহ ও আব্দুল-বাহা আশা করেছিলেন যে দীর্ঘমেয়াদে এক স্থায়ী শান্তি (মহানতম শান্তি) প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ‘তীব্র অবক্ষয়’ পরিশুদ্ধ হবে। বস্তুগত সভ্যতাকে সম্পূরক করতে আধ্যাত্মিক গুণাবলি ও নৈতিকতার সমন্বয়ে গঠিত এক সার্বজনীন ধর্মের অধীনে বিশ্বের মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন।[১৫]
Remove ads
ইতিহাস
সারাংশ
প্রসঙ্গ
বাহা'ই ধর্মের উৎপত্তি বাবের ধর্ম ও তার পূর্ববর্তী শায়খি আন্দোলনে নিহিত। বাব একজন ব্যবসায়ী ছিলেন, যিনি ১৮৪৪ সালে ঘোষণা করতে শুরু করেন যে তিনি ঈশ্বরের দূত। তবে ইরানের অধিকাংশ ইসলামী ধর্মগুরু তাকে প্রত্যাখ্যান করেন, এবং ধর্মদ্রোহিতার অপরাধে তাকে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।[১৭] বাব শিক্ষা দেন যে ঈশ্বর শিগগিরই এক নতুন দূত প্রেরণ করবেন, এবং বাহা'ইরা বিশ্বাস করেন যে বাহা'উল্লাহ-ই ছিলেন সেই ব্যক্তি।[১৮] যদিও এগুলো পৃথক আন্দোলন, তবু বাব এমনভাবে বাহা'ই তত্ত্ব ও ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত যে বাহা'ইরা তাঁর জন্ম, মৃত্যু ও ঘোষণার দিবসকে পবিত্র দিন হিসেবে উদ্যাপন করে, তাঁকে তাদের তিনজন কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বের একজন হিসেবে গণ্য করে (বাহা'উল্লাহ ও আব্দুল-বাহা সহ), এবং বাবি আন্দোলনের ঐতিহাসিক বিবরণ “নব প্রভাত আনলো যারা” গ্রন্থটিকে এমন তিনটি বইয়ের একটি হিসেবে বিবেচনা করে, যা প্রত্যেক বাহা'ইকে "আয়ত্ত করা" এবং "বারবার" পড়া উচিত।[১৯]
১৮৯২ সালে বাহা'উল্লাহের মৃত্যুর পর, বাহা'ই সম্প্রদায় প্রধানত ইরান ও ওসমানীয় সাম্রাজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, যদিও সেই সময় এশিয়া ও আফ্রিকা জুড়ে ১৩টি দেশে তাদের অনুসারী ছিল।[২০] তাঁর পুত্র আব্দুল-বাহার নেতৃত্বে, ধর্মটি ইউরোপ ও আমেরিকায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং ইরানে সুসংহত হয়, যেখানে এখনও এটি তীব্র নির্যাতনের মুখোমুখি হয়।[১] ১৯২১ সালে আব্দুল-বাহার মৃত্যু বাহা'ই ধর্মের যে "বীরত্বময় যুগ" নামে পরিচিত তার সমাপ্তি নির্দেশ করে।[২১]
বাব

১৮৪৪ সালের ২২ মে সন্ধ্যায়, শিরাজের সাইয়্যেদ আলী-মুহাম্মাদ বিশ্ববাসীর উদ্দেশে নিজেকে ঘোষণা করে ‘বাব’ (الباب) উপাধি গ্রহণ করেন, যার অর্থ ‘দ্বার’; তাঁর মতে এটি ছিল শিয়া ইসলাম-এ প্রতীক্ষিত মাহদী হওয়ার দাবি।[১] ফলে তাঁর অনুসারীরা ‘বাবি’ নামে পরিচিত হয়। বাবের শিক্ষাগুলি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে, যা ইসলামী আলেমদের কাছে বিধর্মী হিসেবে বিবেচিত ছিল, তাঁর অনুসারীরা ক্রমবর্ধমান নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হন।[৯] এই সংঘাত তীব্রতর হয়ে নানা স্থানে শাহের সেনাবাহিনীর সামরিক অবরোধে রূপ নেয়। স্বয়ং বাবকে কারাবন্দি করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত ১৮৫০ সালে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।[২২]
বাহা'ইরা বাবকে বাহা'ই ধর্মের অগ্রদূত হিসেবে মনে করেন, কারণ বাবের রচনাবলীতে "যাঁকে ঈশ্বর প্রকাশ করবেন" ধারণাটি উপস্থাপিত হয়েছিল—একজন মসিহীয় ব্যক্তিত্ব, যার আগমনের কথা বাহা'ইদের মতে বিশ্বের সব প্রধান ধর্মের পবিত্র গ্রন্থে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।[৯] বাহা'ই ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বাহা'উল্লাহ নিজেকে এই ব্যক্তিত্ব বলে দাবি করেছিলেন। ইসরায়েলের হাইফায় অবস্থিত বাবের সমাধি বাহা'ইদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান। বাবের দেহাবশেষ গোপনে ইরান থেকে পবিত্র ভূমিতে আনা হয় এবং শেষ পর্যন্ত বাহা'উল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত স্থানে তাঁর জন্য নির্মিত একটি সমাধিতে তা সমাধিস্থ করা হয়।[২৩] বাবের রচনাবলি বাহা'ইদের কাছে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত, যদিও সেগুলো পরবর্তীতে বাহা'উল্লাহ-এর আইন ও শিক্ষার দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে।[২৪] বাবের ইংরেজিতে অনূদিত প্রধান রচনাবলি সিলেকশ্নস ফ্রম দা রাইটিংস অফ দা বাব (১৯৭৬) গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে, যা আনুমানিক ১৩৫টি রচনা থেকে নির্বাচিত।[২৫]
বাহা'উল্লাহ
মির্জা হুসাইন আলী নূরী ছিলেন বাবের প্রারম্ভিক অনুসারীদের একজন, এবং পরে ১৮৫২ সালের আগস্ট মাসে তিনি ‘বাহা'উল্লাহ’ উপাধি গ্রহণ করেন।[২৬] কিছু বাবি নাসের আল-দীন শাহ কাজারকে হত্যার একটি ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। প্রতিক্রিয়ায় শাহ তেহরানে প্রায় ৫০ জন বাবির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর ও নির্যাতনের আদেশ দেন।[২৭] অতঃপর সারা দেশে রক্তপাত ছড়িয়ে পড়ে, এবং অক্টোবর নাগাদ সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে শত শত মানুষের কথা উল্লেখ থাকে; আর ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ তা হাজারে পৌঁছে। [২৮] বাহা'উল্লাহ হত্যাচেষ্টায় জড়িত ছিলেন না; তবে তাঁকে তেহরানে কারাবন্দি করা হয় এবং চার মাস পরে রুশ রাষ্ট্রদূতের উদ্যোগে মুক্তির ব্যবস্থা হলে তিনি বাগদাদে নির্বাসনে থাকা অন্যান্য বাবিদের সঙ্গে যোগ দেন।[২৯]
এর কিছুদিন পরই তাঁকে ইরান থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং তিনি উসমানীয় সাম্রাজ্যের বাগদাদে যাত্রা করেন।[৩০] বাগদাদে, ইরানে নির্যাতিত বাবের অনুসারীদের তাঁর নেতৃত্ব পুনরুজ্জীবিত করে, ফলে ইরানি কর্তৃপক্ষ তাঁর অপসারণের অনুরোধ জানায়, যার ফলশ্রুতিতে উসমানীয় সুলতান তাঁকে কনস্টান্টিনোপলে (বর্তমান ইস্তাম্বুল) ডেকে পাঠান। ১৮৬৩ সালে বাগদাদ থেকে নির্বাসনের সময়, বাহা'উল্লাহ প্রথমবারের মতো তাঁর পরিবার ও অনুসারীদের কাছে নিজেকে ঈশ্বরীয় আবির্ভাব বলে ঘোষণা করেন—এমন এক প্রকাশ, যা তিনি বলেছিলেন বহু বছর আগে তেহরানের এক অন্ধকূপে তাঁর নিকট অবতীর্ণ হয়েছিল। তিনি কনস্টান্টিনোপলে চার মাসেরও কম সময় অতিবাহিত করেন। বাহা'উল্লাহ-এর একটি ভর্ৎসনামূলক পত্র পাওয়ার পর উসমানীয় কর্তৃপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং তাঁকে আদ্রিয়ানোপল (বর্তমান এদির্নে)-এ আবদ্ধ রাখে, যেখানে তিনি চার বছর ছিলেন, ১৮৬৮ সালে এক সাম্রাজ্যিক ফরমান জারি হয়ে সব বাবিদের সাইপ্রাস বা আক্কায় নির্বাসনে পাঠানো পর্যন্ত।
সে সময় ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সিরিয়া প্রদেশে অবস্থিত এবং বর্তমানে ইসরায়েল রাষ্ট্রের অন্তর্গত আক্কা ছিল এমন এক দেয়ালঘেরা শহর, যার স্থল ও সমুদ্রপথের ফটক দিয়ে সকল আগন্তুকের তল্লাশি করা হতো। ফলে বাহা'উল্লাহকে দর্শন করতে যাত্রারত ইরানি তীর্থযাত্রীদের আটকে দেওয়া খুবই সহজ ছিল; বিশেষত কারণ শহরে বন্দী আজালিরা (মির্জা ইয়াহ্যার অনুসারীরা) ফটকের প্রহরীদের ফাঁকি দিয়ে ঢুকতে সক্ষম যে-কোনও বাহা'ই সম্পর্কে সঙ্গে সঙ্গেই খবর দিত। রাজনৈতিক বন্দীদের কারাবাসের স্থান হিসেবে ওসমানীয় সরকার আক্কাকে ব্যবহার করত। শহরের পরিবেশ এতটাই অস্বাস্থ্যকর ছিল যে মনে করা হতো, এ ধরনের পরিবেশে অভ্যস্ত নন এমন ব্যক্তিরা শিগগিরই মৃত্যুবরণ করবেন।[৩১]
বর্তমান ইসরায়েলে অবস্থিত ওসমানীয় দণ্ড উপনিবেশ আক্কার ভেতরে বা তার নিকটে, বাহা'উল্লাহ তাঁর জীবনের বাকি সময় কাটিয়েছিলেন। প্রথমদিকে তাকে কঠোর ও নির্দয় কারাবাসে রাখা হয়েছিল; পরে যদিও তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে শহরের বন্দিই রয়ে গিয়েছিলেন, তাকে 'আক্কা'র কাছাকাছি একটি বাড়িতে বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয়।[৩২] তিনি ১৮৯২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। বাহা'ইরা বাহজীতে তাঁর সমাধিস্থলকে তাদের কিবলা হিসেবে গণ্য করে, যেদিকে মুখ করে তারা প্রতিদিন প্রার্থনা করে।[৩৩]
তাঁর জীবদ্দশায় তিনি আরবি ও ফারসি—উভয় ভাষায় ১৮,০০০-এরও বেশি রচনা করেছিলেন, যার মধ্যে মাত্র ৮% ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে।[৩৪] আদ্রিয়ানোপলে অবস্থানকালে, তিনি বিশ্বের ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ শাসকদের উদ্দেশে প্রেরিত পত্রাবলীতে ঈশ্বরের বার্তাবাহক হিসেবে তাঁর মিশন ঘোষণা করা শুরু করেন, যাদের মধ্যে ছিলেন পোপ পায়াস নবম, নেপোলিয়ন তৃতীয় এবং রানি ভিক্টোরিয়া।[৩৫]
আব্দুল-বাহা

আব্বাস ইফেন্দি ছিলেন বাহা'উল্লাহর জ্যেষ্ঠ পুত্র, যিনি আব্দুল-বাহা (“বাহার সেবক”) উপাধিতে পরিচিত ছিলেন। তাঁর পিতা একটি উইল রেখে যান, যাতে বাহা'ই সম্প্রদায়ের জন্য আব্দুল-বাহাকে চুক্তির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে মনোনীত করা হয়।[৩৬] আব্দুল-বাহা তাঁর পিতার দীর্ঘ নির্বাসন ও কারাবাস ভাগ করে নিয়েছিলেন, যা ১৯০৮ সালে ইয়াং তুর্ক বিপ্লবের ফলে তাঁর মুক্তি পর্যন্ত চলতে থাকে। মুক্তির পর তিনি জীবনের বাকিটা সময় ভ্রমণ, বক্তৃতা, শিক্ষা প্রদান, বাহা'ই ধর্মের নীতিমালা ব্যাখ্যা ও আলোকিত করা, এবং বিশ্বাসীদের সম্প্রদায় ও ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে পত্রালাপ রক্ষায় অতিবাহিত করেন।[৩০]
জীবনের শুরু থেকেই, ইরানে বাবি সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের কারণে এবং পরে তেহরান থেকে বাগদাদ, ইস্তানবুল, আদ্রিয়ানোপল ও আক্কায় তাঁদের নির্বাসনকালে, আব্দুল-বাহা তাঁর পিতার দুঃখ-কষ্ট ভাগ করে নিয়েছিলেন। তিনি বাহা'উল্লাহ-এর ঘনিষ্ঠ সঙ্গী, প্রধান সংগঠক, এবং অটোমান সাম্রাজ্যে বহির্বিষয়ক ক্ষেত্রে তাঁর বিশ্বস্ত প্রতিনিধি ছিলেন। বাহা'ইদের কাছে, তাঁর পিতার উক্তি অনুযায়ী, আব্দুল-বাহা ‘মাস্টার’, এবং বাহা'ই শিক্ষার পরিপূর্ণ আদর্শ।[৩৭]
২০২০ সালের হিসাবে, আব্দুল-বাহা-এর বাণীসমূহ সংবলিত বিদ্যমান নথির সংখ্যা ৩৮,০০০-এরও বেশি।[৩৮] এই নথিগুলোর কেবলমাত্র অল্প অংশ ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। সুপরিচিত রচনাগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘দা সিক্রেট অফ ডিভাইন সিভিলাইজেশন’, ‘কতিপয় প্রশ্নের উত্তর’, ‘দা টেব্লেট টু অগাস্টি-হেন্রি ফরেল’, ‘টেব্লেটস অফ দা ডিভাইন প্লান’, এবং টেব্লেটস অফ হেয়গ। [৩৮] এছাড়াও, পশ্চিমে ভ্রমণের সময় তাঁর প্রদত্ত বেশ কয়েকটি বক্তৃতার নোট বিভিন্ন সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছিল, যেমন ‘পেরিস টকস’।
শৌগী এফেন্দি
বাহা'উল্লাহর কিতাব-ই-আকদাস এবং আব্দুল-বাহার উইল এন্ড টেস্টামেন্ট বাহা'ই প্রশাসনিক ব্যবস্থার মৌলিক দলিল। বাহা'উল্লাহ নির্বাচিত সার্বজনীন ন্যায় বিচারালয় প্রতিষ্ঠার বিধান দেন এবং আব্দুল-বাহা মনোনীত বংশানুক্রমিক অভিভাবকত্ব প্রতিষ্ঠা করেন ও এই দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্পর্ক স্পষ্ট করেন।[৩৯] তার উইলনামায়, আব্দুল-বাহা তাঁর জ্যেষ্ঠ নাতি শৌগী এফেন্দিকে বাহা'ই ধর্মের অভিভাবক হিসেবে নিয়োগ করেন। শৌগী এফেন্দি তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ৩৬ বছর ধর্মের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।[৪০]
সারাজীবন শৌগী এফেন্দি বাহা'ই লেখনীসমূহ অনুবাদ করেন; বাহা'ই সম্প্রদায়ের সম্প্রসারণের জন্য বৈশ্বিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন; বাহা'ই বিশ্বকেন্দ্র উন্নয়ন করেন; সারা বিশ্বের সম্প্রদায় ও ব্যক্তিদের সাথে ব্যাপক পত্রালাপ করেন; এবং ধর্মের প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলেন, সার্বজনীন ন্যায় বিচারালয়ের নির্বাচন উপলক্ষে সম্প্রদায়কে প্রস্তুত করেন।[৩০] ১৯৫৭ সালের ৪ নভেম্বর, স্বল্পকালীন অসুস্থতার পর তিনি ইংল্যান্ডের লন্ডনে অপ্রত্যাশিতভাবে পরলোকগমন করেন, এমন পরিস্থিতিতে যা উত্তরসূরি নিয়োগের সুযোগ দেয়নি।[৪১]
১৯৩৭ সালে শৌগী এফেন্দি উত্তর আমেরিকার বাহা'ইদের জন্য একটি সাত-বছরের পরিকল্পনা শুরু করেন; এরপর ১৯৪৬ সালে তিনি দ্বিতীয় একটি পরিকল্পনা শুরু করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি প্রথম আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা, দশ-বছরের বিশ্ব ক্রুসেড, সূচনা করেন। এই পরিকল্পনায় অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য অন্তর্ভুক্ত ছিল, যেমন বাহা'ই সম্প্রদায় ও প্রতিষ্ঠানসমূহের সম্প্রসারণ, বাহা'ই গ্রন্থাবলিকে কয়েকটি নতুন ভাষায় অনুবাদ, এবং পূর্বে যেখানে বাহা'ইরা পৌঁছেনি এমন দেশসমূহে বাহা'ই অগ্রদূতদের প্রেরণ।[৪২] দশ-বছরের ক্রুসেড চলাকালে তিনি চিঠিপত্রে ঘোষণা করেন যে সার্বজনীন ন্যায় বিচারালয়ের নির্দেশনায় আরও পরিকল্পনা অনুসরণ করবে, যা ১৯৬৩ সালে ক্রুসেডের সমাপ্তিতে নির্বাচিত হয়।
শৌগী এফেন্দি বাহা'ই সম্প্রদায়ের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছিলেন, যা আজও গভীর প্রভাব বিস্তার করছে। বাহা'ই রচনাবলীর তাঁর ব্যাখ্যাগুলো কর্তৃত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়, ফলে বাহা'ই ধর্মতত্ত্ব ও আইনশাস্ত্র, তদুপরি বাহা'ই সামাজিক শিক্ষা বুঝতে এগুলো ভিত্তিমূলক। বাহা'ই প্রশাসন সম্পর্কে তাঁর রচনাসমূহ বাহা'ই প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে কাজ করা উচিত সে বিষয়ে দিকনির্দেশনার একটি প্রধান উৎস হিসেবে বিদ্যমান রয়েছে।[৩১]
সার্বজনীন ন্যায় বিচারালয়
১৯৬৩ সাল থেকে সার্বজনীন ন্যায় বিচারালয় বাহা'ই ধর্মের নির্বাচিত সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। এর সাধারণ কার্যাবলি বাহা'উল্লাহর রচনায় নির্ধারিত এবং আব্দুল-বাহা ও শৌগী এফেন্দির রচনায় ব্যাখ্যায়িত হয়েছে। এই কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, বাহা'ই আইন কার্যকর করা, সামাজিক বিষয়সমূহ মোকাবিলা করা, এবং দুর্বল ও দরিদ্রদের দেখভাল করা।[৪৩]

১৯৬৪ সালে শুরু হওয়া নয়-বছরের পরিকল্পনা থেকে সার্বজনীন ন্যায় বিচারালয় বহু-বছর মেয়াদি আন্তর্জাতিক পরিকল্পনার ধারাবাহিকতার মাধ্যমে বাহা'ই সম্প্রদায়ের কাজকে দিশা দিয়ে আসছে।[৪৪] ১৯৬৪ সালের নয়-বছরের পরিকল্পনা থেকেই বাহা'ই নেতৃত্ব একদিকে ধর্মের বিস্তার অব্যাহত রাখতে এবং পাশাপাশি নতুন সদস্যদের "একীভূত" করতে—অর্থাৎ বাহা'ই শিক্ষাবিষয়ে তাদের জ্ঞান বাড়াতে—প্রচেষ্টা চালায়।[৪৫] এই ধারাবাহিকতায়, ১৯৭০-এর দশকে কলোম্বিয়ার বাহা'ইরা বাহা'ই বিশ্বাসসমূহ নিয়ে সংক্ষিপ্ত কোর্স দেওয়ার উদ্দেশ্যে রুহি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন; এসব কোর্সের মেয়াদ ছিল এক সপ্তাহান্ত থেকে নয় দিন পর্যন্ত।[৪৫] সম্পর্কিত রুহি ফাউন্ডেশন, যার লক্ষ্য ছিল নতুন বাহা'ইদের পদ্ধতিগতভাবে "একীভূত" করা, ১৯৯২ সালে নিবন্ধিত হয়; এবং ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিক থেকে রুহি ইনস্টিটিউটের কোর্সসমূহ বিশ্বজুড়ে বাহা'ই শিক্ষার বোধ বাড়ানোর প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে।[৪৫] ২০১৩ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ৩০০-রও বেশি বাহা'ই প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ছিল, এবং ১,০০,০০০ জন এসব কোর্সে অংশ নিচ্ছিলেন। রুহি ইনস্টিটিউটের কোর্সসমূহের মাধ্যমে সম্প্রদায়গুলো শিশু ও তরুণদের আধ্যাত্মিক শিক্ষার জন্য স্বতন্ত্রভাবে ক্লাস আয়োজনসহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনার প্রশিক্ষণ পায়। সমসাময়িক বাহা'ই সম্প্রদায়ের কাজের জন্য যে ক্ষেত্রগুলো উৎসাহিত করা হয়, সেগুলোর পাশাপাশি সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ এবং চলমান সামাজিক আলোচনায় সম্পৃক্ততাও অন্তর্ভুক্ত।[৪৬]
প্রতি বছর এপ্রিল মাসে, সার্বজনীন ন্যায় বিচারালয় বিশ্বজুড়ে বাহা'ই সম্প্রদায়সমূহের কাছে ‘রিজওয়ান’ বার্তা পাঠায়, যাতে বাহা'ইদের চলমান অগ্রগতির বিষয়ে অবগত করা হয় এবং আসন্ন বছরের জন্য অতিরিক্ত দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়।[ক]
স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় স্তরে, বাহা'ইরা নয়-সদস্যবিশিষ্ট আধ্যাত্মিক পরিষদসমূহে সদস্য নির্বাচন করে, যেগুলো ধর্মীয় কার্যাবলি পরিচালনা করে। শিক্ষাসমূহ প্রচার এবং সম্প্রদায়কে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকসহ বিভিন্ন স্তরে ব্যক্তিদেরও নিয়োগ করা হয়। এই ব্যক্তিরা ধর্মযাজকদের মতো ভূমিকা পালন করেন না, কারণ বাহা'ই ধর্মে কোনো ধর্মযাজক শ্রেণি নেই।[৯][৪৭] সার্বজনীন ন্যায় বিচারালয় বাহা'ই ধর্মের সর্বোচ্চ পরিচালন সংস্থা, এবং এর ৯ জন সদস্যকে প্রতি পাঁচ বছরে সকল জাতীয় আধ্যাত্মিক পরিষদের সদস্যরা নির্বাচিত করেন।[৪৮] ২১ বছর বা তদূর্ধ্ব যে কোনো পুরুষ বাহা'ই সার্বজনীন ন্যায় বিচারালয়ে নির্বাচিত হওয়ার জন্য যোগ্য; অন্যান্য সকল পদ পুরুষ ও নারী উভয় বাহা'ইদের জন্য উন্মুক্ত।[৪৯]
তাঁর এক রচনায়, বাহা'উল্লাহ বলেছেন যে, "ঈশ্বরের ধর্ম ও তাঁর বিধানের প্রাণসঞ্চারী মৌলিক উদ্দেশ্য হলো মানবজাতির স্বার্থ সংরক্ষণ করা ও তাদের ঐক্যকে উন্নীত করা, এবং মানুষের মধ্যে প্রেম ও ভ্রাতৃত্বের চেতনাকে বিকশিত করা।" তাঁর চুক্তির মাধ্যমে, বাহা'উল্লাহ নিশ্চিত করেছেন যে বাহা'ই সম্প্রদায় সর্বদা একটি অভ্রান্ত কর্তৃত্বকেন্দ্র পাবে, যা সম্প্রদায়ের চিরস্থায়ী ও বিকাশমান ঐক্য নিশ্চিত করবে। বর্তমানে সার্বজনীন ন্যায় বিচারালয় কর্তৃত্বের কেন্দ্র, যা বাহা'উল্লাহ পরিকল্পিত বিশ্বব্যবস্থার বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়াবলি দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত। অতএব, এর নানাবিধ ক্ষমতা ও দায়িত্বের মধ্যে, এটি স্পষ্টকরণের প্রয়োজন এমন কিংবা বিরোধের কারণ হতে পারে এমন বিষয়সমূহ নিষ্পত্তি করে, কার্যক্রমের অগ্রগতি ও ব্যবস্থাপনা তত্ত্বাবধান করে, সমাজের ধারাবাহিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় আইন ও বিধান প্রণয়ন করে, এবং এমন ধারাবাহিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে যা মানবজাতির ঐক্য অগ্রসর করতে বাহা'ই ও তাঁদের সহযোগীদের প্রচেষ্টাকে অনুপ্রাণিত ও প্রস্তুত করে।[৩১]
Remove ads
শিক্ষা ও নীতিসমূহ
সারাংশ
প্রসঙ্গ
বাহা'ই ধর্মের প্রধান নীতিসমূহের মধ্যে রয়েছে -
- ঈশ্বর একত্ব
- সমস্ত ধর্মের উৎস এক[৩১]
- বিশ্বশান্তি ও বিশ্ব ঐক্য
- সবার জন্য ন্যায়বিচার
- নারী ও পুরুষের সমতা
- সবার জন্য বাধ্যতামূলক শিক্ষা[৩১]
- বিজ্ঞান ও ধর্মের সামঞ্জস্য
- চরম দারিদ্র্য ও অতিরিক্ত ঐশ্বর্যের সমাধান
- ভৌত সমস্যার আধ্যাত্মিক সমাধান [৩১]
বাহা'উল্লাহর ব্যক্তিগত আচরণ সংক্রান্ত শিক্ষাবলীর কিছু উদাহরণ, যা তাঁর অনুসারীদের জন্য আবশ্যক বা উৎসাহিত করা হয়েছে, নিম্নরূপ:
- ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে বাহা'ইরা নির্দিষ্ট শব্দ ও রূপ ব্যবহার করে প্রতিদিন ব্যক্তিগতভাবে একটি বাধ্যতামূলক প্রার্থনা পাঠ করতে হবে।[৫০]
- দৈনিক বাধ্যতামূলক প্রার্থনার পাশাপাশি, বাহা'ইদের প্রতিদিন প্রার্থনা করা, ধ্যান করা এবং পবিত্র ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়নে নিয়োজিত থাকা উচিত।[৫১]
- প্রাপ্তবয়স্ক বাহা'ইরা, কিছু ব্যতিক্রমসহ, প্রতি বছর মার্চ মাসে দিনের বেলায় উনিশ দিনের উপবাস পালন করতে বাধ্য।[৫২]
- বাহা'ই দাফনের জন্য নির্দিষ্ট বিধিবিধান রয়েছে, যার মধ্যে শেষকৃত্যের সময় পাঠ করার জন্য নির্ধারিত একটি প্রার্থনাও অন্তর্ভুক্ত। শব সংরক্ষণ (এম্বামিং) ও দাহক্রিয়া নিরুৎসাহিত করা হয়।[৫৩]
নিষেধাজ্ঞা
নিম্নে বাহা'উল্লাহর শিক্ষাবলি অনুযায়ী নিষিদ্ধ বা নিরুৎসাহিত কয়েকটি ব্যক্তিগত আচরণ দেওয়া হলো:
- পরনিন্দা ও পরচর্চা নিষিদ্ধ এবং নিন্দিত।[৫৪]
- অ্যালকোহল সেবন ও বিক্রয় নিষিদ্ধ।[৫৫]
- যৌনসংসর্গ কেবল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অনুমোদিত; ফলে বিবাহপূর্ব ও বিবাহবহির্ভূত যৌনসংসর্গ সবই নিষিদ্ধ।[৫৬]
- দলীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ।[৫৭]
- পেশা হিসেবে ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ।[৫৮]
ব্যক্তিগত বিধানসমূহের প্রতি আনুগত্য, যেমন প্রার্থনা বা উপবাস, সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তির নিজস্ব দায়িত্ব।[৫৯] তবে, এমন কিছু পরিস্থিতি আছে যখন আইনকে প্রকাশ্যে উপেক্ষা করা বা চরম অনৈতিকতার কারণে কোনো বাহা'ইকে প্রশাসনিকভাবে সম্প্রদায় থেকে বহিষ্কার করা হতে পারে। এ ধরনের বহিষ্কার জাতীয় আধ্যাত্মিক পরিষদ দ্বারা প্রশাসিত হয় এবং এতে ধর্মচ্যুতি জড়িত নয়।[৬০]
বিবাহ
বাহা'ই ধর্মে বিবাহের উদ্দেশ্য মূলত একজন পুরুষ ও একজন নারীর মধ্যে আধ্যাত্মিক সামঞ্জস্য, সহচর্য ও ঐক্যকে লালন করা, এবং সন্তানদের লালনপালনের জন্য স্থিতিশীল ও স্নেহময় পরিবেশ প্রদান করা।[৬১] বিবাহ সম্পর্কে বাহা'ই শিক্ষায় এটিকে কল্যাণ ও মুক্তির দুর্গ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং মানবসমাজের কাঠামোর ভিত্তি হিসেবে বিবাহ ও পরিবারকে স্থাপন করা হয়েছে।[৬২] বাহা'উল্লাহ বিবাহকে অত্যন্ত প্রশংসা করেছেন, বিবাহবিচ্ছেদ নিরুৎসাহিত করেছেন এবং বিবাহের বাইরে শুচিতা বজায় রাখার দাবি করেছেন; তিনি শিক্ষা দিয়েছেন যে স্বামী ও স্ত্রী একে অপরের আধ্যাত্মিক জীবন উন্নত করতে সচেষ্ট থাকবে।[৬৩] আন্তর্জাতিগত ও আন্তঃসাংস্কৃতিক বিবাহও বাহা'ই রচনাবলিতে উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে।[৬২]

বিবাহের ইচ্ছুক বাহা'ই ধর্মাবলম্বীদেরকে বিবাহের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে পরস্পরের চরিত্র সম্পর্কে গভীর বোঝাপড়া অর্জন করতে বলা হয়।[৬২] যখন দুই জন ব্যক্তি বিবাহের সিদ্ধান্ত নেন, তখন তারা বাহা'ই হোন বা না হোন, উভয় পক্ষের পিতামাতার সম্মতি নিতে হবে। বাহা'ই বিবাহ অনুষ্ঠানটি সহজ; অনুষ্ঠানের একমাত্র বাধ্যতামূলক অংশটি হলো বাহা'উল্লাহ নির্ধারিত অঙ্গীকারবচন পাঠ, যা কনে ও বর উভয়েই দুইজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে উচ্চারণ করেন।[৬২] অঙ্গীকারবচনটি হলো: "আমরা সবাই, নিশ্চয়ই, ঈশ্বরের ইচ্ছা মেনে চলব।"[৬২]
উপাসনালয়সমূহ
অধিকাংশ সম্প্রদায়ে, বাহা'ই ভক্তিমূলক সমাবেশ বর্তমানে মানুষের বাড়িতে বা বাহা'ই কেন্দ্রসমূহে অনুষ্ঠিত হয়, কিন্তু কিছু সম্প্রদায়ে বাহা'ই উপাসনালয় (যা বাহা'ই উপাসনালয় নামেও পরিচিত) নির্মিত হয়েছে।[৬৪] বাহা'ই উপাসনালয়সমূহ এমন স্থান যেখানে বাহা'ই ও অ-বাহা'ই উভয়েই ঈশ্বরের প্রতি তাঁদের ভক্তি প্রকাশ করতে পারেন।[৬৫] এগুলোকে মশরিকুল আজকার নামেও পরিচিত।
আরবি ভাষায় "ঈশ্বরের স্মরণের উদয়স্থান" অর্থে।[৬৬] ভিতরে শুধুমাত্র বাহা'ই ধর্ম ও অন্যান্য ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থসমূহ পাঠ বা আবৃত্তি করা যায়, এবং সঙ্গীতের জন্য নির্দিষ্ট পাঠ্য ও প্রার্থনাসমূহ কোরাস দল দ্বারা গাওয়া যেতে পারে, কিন্তু ভেতরে কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজানো যায় না।[৬৭] এছাড়াও, কোনো ধর্মোপদেশ দেওয়া যায় না, এবং কোনো আনুষ্ঠানিক আচার-অনুষ্ঠান পালন করা যায় না।[৬৭] সমস্ত বাহা'ই উপাসনালয়ই নয়-কোনা আকৃতির, এবং সেগুলোর বাইরে যাওয়ার জন্য নয়টি পথ ও চারদিকে নয়টি উদ্যান থাকে।[৬৮] বর্তমানে, আটটি "মহাদেশীয়" বাহা'ই উপাসনালয় এবং কিছু স্থানীয় বাহা'ই উপাসনালয় সম্পূর্ণ হয়েছে বা নির্মাণাধীন রয়েছে। বাহা'ই লেখাবলি আরও কল্পনা করে যে বাহা'ই উপাসনালয়ের চারদিকে মানবকল্যাণমূলক, বৈজ্ঞানিক ও শিক্ষামূলক কার্যক্রমের জন্য প্রতিষ্ঠানসমূহ থাকবে,[৬৬] যদিও এখনো সে মাত্রায় কোনোটি নির্মিত হয়নি।

সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বাহা'ই ধর্ম সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সম্পৃক্ত রয়েছে, যা শুরু হয়েছিল নারীর সমতা নিয়ে বাড়তি আলোচনা দিয়ে।[৬৯] নারীশিক্ষাকে অগ্রাধিকার হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।[৭০] এই সম্পৃক্ততা বিদ্যালয়, কৃষি সমবায় এবং ক্লিনিক স্থাপনের মাধ্যমে বাস্তবে প্রকাশ পেয়েছে।[৬৯]
১৯৮৩ সালের ২০ অক্টোবর সার্বজনীন ন্যায় বিচারালয় থেকে একটি বার্তা জারি করা হলে, বাহা'ই ধর্ম কার্যক্রমের একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে। যেসব সম্প্রদায়ে তারা বাস করতেন, সেসব সম্প্রদায়ের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অংশগ্রহণের জন্য বাহা'ই শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ উপায় খুঁজে বের করতে বাহা'ইদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। ১৯৭৯ সালে বিশ্বব্যাপী আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত বাহা'ই সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রকল্পের সংখ্যা ছিল ১২৯টি। ১৯৮৭ সালের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত উন্নয়ন প্রকল্পের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১,৪৮২-এ দাঁড়ায়।[৪৪]
বর্তমান সামাজিক উদ্যোগগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, শিক্ষা, লিঙ্গ সমতা, শিল্প ও গণমাধ্যম, কৃষি এবং পরিবেশের মতো ক্ষেত্রে কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত।[৭১] প্রকল্পগুলোর মধ্যে বিদ্যালয়ও রয়েছে, যা গ্রামীণ টিউটোরিয়াল বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বৃহৎ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং কিছু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিস্তৃত।[৭২] ২০১৭ সালের হিসাবে, বাহা'ই সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন কার্যালয় অনুমান করেছিল যে ৪০,০০০টি ক্ষুদ্র-পরিসরের প্রকল্প, ১,৪০০টি চলমান প্রকল্প এবং ১৩৫টি বাহা'ই-অনুপ্রাণিত সংস্থা ছিল।[৭১]
তদুপরি, বিশ্বজুড়ে বাহা'ইরা নিম্নলিখিত উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে এই নতুন বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখছেন। এই বৈশ্বিক কর্মসূচি মানুষ ও সমাজ সম্পর্কে এমন এক ধারণাকে কেন্দ্র করে, যা স্বভাবে আধ্যাত্মিক এবং যা ব্যক্তিদের আধ্যাত্মিক ও ভৌত উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় উৎকর্ষ সাধনে সক্ষম করে।
বাহা'ই ধর্মের অনুসারীরা নিম্নলিখিত কার্যক্রমের মাধ্যমে মানবতার কল্যাণে কাজ করেন:-
- প্রার্থনা সভাসমূহ
- শিশুদের নৈতিক শিক্ষা শ্রেণিসমূহ
- কিশোর-যুবদের ক্ষমতায়ন কর্মসূচি
- অধ্যয়ন চক্রের শ্রেণিসমূহ
জাতিসংঘ
মানবজাতির সমষ্টিগত জীবনের এই যুগে একটি বিশ্ব সরকারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বাহা'উল্লাহ লিখেছেন। এই গুরুত্ব আরোপের প্রেক্ষিতে, জাতিসংঘের বর্তমান কাঠামো ও সংবিধান সম্পর্কে কিছু আপত্তি থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক বাহা'ই সম্প্রদায়, জাতিপুঞ্জ ও জাতিসংঘের মতো সংস্থার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নত করার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার পথ বেছে নিয়েছে।[৭২] বাহা'ই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হাইফায় অবস্থিত বিশ্ব ন্যায়গৃহের নির্দেশনায় পরিচালিত একটি সংস্থা, এবং এর নিম্নলিখিত সংস্থাগুলোর সঙ্গে পরামর্শমূলক মর্যাদা রয়েছে:[৭৩]
- জাতিসংঘ শিশু তহবিল (UNICEF)
- নারীদের জন্য জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিল (UNIFEM)
- জাতিসংঘ অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ (ECOSOC)
- জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP)
- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)
বাহা'ই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জাতিসংঘে নিউ ইয়র্ক ও জেনেভায় অফিস রয়েছে এবং আদ্দিস আবাবা, ব্যাংকক, নাইরোবি, রোম, সান্তিয়াগো ও ভিয়েনায় জাতিসংঘের আঞ্চলিক কমিশন ও অন্যান্য কার্যালয়গুলোতেও তাদের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে।[৭৪] সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর জাতিসংঘ দপ্তরের অংশ হিসেবে পরিবেশ বিষয়ক একটি দপ্তর এবং নারীর অগ্রগতি বিষয়ক একটি দপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বাহা'ই ধর্ম জাতিসংঘের অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে যৌথ উন্নয়ন কর্মসূচিও পরিচালনা করেছে। জাতিসংঘের ২০০০ মিলেনিয়াম ফোরামে, শীর্ষ সম্মেলনের সময় অ-সরকারি বক্তাদের মধ্যে একজন হিসেবে একজন বাহা'ইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল[৭৫]।
Remove ads
নিপীড়ন ও অত্যাচার
সারাংশ
প্রসঙ্গ
কিছু সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশে বাহা'ইদের ওপর নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে, যেখানে তাদের নেতারা বাহা'ই ধর্মকে একটি স্বতন্ত্র ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি না দিয়ে ইসলাম থেকে ধর্মত্যাগ হিসেবে গণ্য করেন। সবচেয়ে গুরুতর নিপীড়ন ঘটেছে ইরানে, যেখানে ১৯৭৮ থেকে ১৯৯৮ সালের মধ্যে ২০০ জনেরও বেশি বাহা'ইকে হত্যা করা হয়েছে।[৭৬] বাহা'ইদের অধিকার বিভিন্ন মাত্রায় সীমিত করা হয়েছে আরও কয়েকটি দেশে, যার মধ্যে রয়েছে মিশর, আফগানিস্তান, যেমন ইরাক[৭৭], মরক্কো[৭৮], ইয়েমেন, এবং উপ-সাহারা আফ্রিকার বহু দেশ।[৪৪]
বাহা'ই ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী নিপীড়নটি ঘটেছে এই ধর্মের জন্মভূমি ইরানে।[৭৯] যখন বাব বিপুল সংখ্যক অনুসারী আকর্ষণ করতে শুরু করেন, তখন ইসলামী ধর্মযাজকরা
তারা দাবি করেছিল যে, অনুসারীদের ‘ঈশ্বরের শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করলে আন্দোলনের বিস্তার রোধ করা যাবে। ধর্মীয় এসব নির্দেশনার কারণে জনতা বাবিদের ওপর হামলা চালায়, এবং কিছুজনকে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।[১] ২০শ শতাব্দীর শুরুতে, স্বতন্ত্র বাহা'ইদের লক্ষ্য করে চালানো নির্যাতনের পাশাপাশি, সমগ্র বাহা'ই সম্প্রদায় ও তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে লক্ষ্য করে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত অভিযান শুরু করা হয়।[৮০] ১৯০৩ সালে ইয়াজদে এক ঘটনায় ১০০ জনেরও বেশি বাহা'ই নিহত হন।[৮১] তেহরানে তারবিয়াত বালক ও বালিকা বিদ্যালয়ের মতো বাহা'ই বিদ্যালয়গুলো ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে বন্ধ করে দেওয়া হয়, বাহা'ই বিবাহকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, এবং বাহা'ই সাহিত্য সেন্সর করা হয়।[৮০]
মোহাম্মদ রেজা পাহলভির শাসনামলে, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে মনোযোগ সরাতে ইরানে বাহা'ইদের বিরুদ্ধে একটি নিপীড়ন অভিযানের সূচনা করা হয়েছিল।[খ] ১৯৫৫ সালে বাহা'ই-বিরোধী একটি অনুমোদিত ও সমন্বিত অভিযান (বাহা'ইদের বিরুদ্ধে জনআবেগ উস্কে দেওয়ার উদ্দেশ্যে) শুরু হয়, যাতে জাতীয় রেডিও স্টেশনসমূহ ও সরকারি সংবাদপত্রে বাহা'ই-বিরোধী প্রচার-প্রচারণা ছড়িয়ে দেওয়া অন্তর্ভুক্ত ছিল।[৮০] মুল্লা মুহাম্মদ তাকি ফালসাফির উদ্যোগে শুরু হওয়া এই অভিযানের সময় তেহরানের বাহা'ই কেন্দ্রটি তেহরানের সামরিক গভর্নর জেনারেল তৈমুর বখতিয়ারের নির্দেশে ভেঙে ফেলা হয়।[৮৩] ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে, শাহের শাসনব্যবস্থা পাশ্চাত্যমুখী—এই সমালোচনার ফলে তা ক্রমাগত বৈধতা হারায়। বিরোধী-শাহ আন্দোলন শক্তি ও সমর্থন অর্জন করলে, বিপ্লবী প্রচারণায় ছড়ানো হয় যে শাহের কিছু উপদেষ্টা বাহা'ই ছিলেন।[৮৪] বাহা'ইদের অর্থনৈতিক হুমকি এবং ইসরায়েল ও পশ্চিমের সমর্থক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, এবং বাহা'ইদের বিরুদ্ধে সামাজিক বৈরিতা বৃদ্ধি পায়।[৮০]
১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে ইরানে বাহা'ইদের বাড়িঘর নিয়মিতভাবে ভাঙচুর করা হয়েছে, অথবা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ও সরকারি চাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, এবং তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে কয়েকশ মানুষকে কারাবন্দী করা হয়েছে; সাম্প্রতিক সময়ে পাঠচক্রে অংশ নেওয়ার জন্যও।[৭৬] বাহা'ইদের কবরস্থান অপবিত্র করা হয়েছে এবং তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, কখনও কখনও তা ভেঙেও ফেলা হয়েছে, এর মধ্যে রয়েছে বাহা'উল্লাহর পিতা মির্জা বুজুর্গের বাড়ি।[১] শিরাজে অবস্থিত বাবের গৃহ, যে তিনটি স্থানের একটি যেখানে বাহা'ইরা তীর্থযাত্রা করেন, এটি দুবার ধ্বংস করা হয়েছে।[১][৮৫] ২০১৮ সালের মে মাসে ইরানি কর্তৃপক্ষ একজন তরুণী শিক্ষার্থীকে ইসফাহান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে, শুধুমাত্র তিনি বাহা'ই হওয়ার কারণে।[৮৬] ২০১৮ সালের মার্চ মাসে জাঞ্জান ও গিলান শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে আরও দুজন বাহা'ই শিক্ষার্থীকে তাদের ধর্মের কারণে বহিষ্কার করা হয়।
১৪ মে ২০০৮-এ, “ইয়ারান” নামে একটি অনানুষ্ঠানিক সংস্থার সদস্যদের, যারা ইরানে বাহা'ই সম্প্রদায়ের প্রয়োজনীয়তা তদারকি করতেন, গ্রেপ্তার করা হয় এবং এভিন কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।[৮৭][৮৮] ইয়ারানদের মামলাটি কয়েকবার স্থগিত করা হয়েছিল, তবে শেষ পর্যন্ত ১২ জানুয়ারি ২০১০-এ কার্যক্রম শুরু হয়।[৮৯] আদালতে অন্যান্য পর্যবেক্ষকদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। প্রতিরক্ষা আইনজীবীরাও, যারা দুই বছর ধরে অভিযুক্তদের কাছে প্রায় কোনো প্রবেশাধিকার পাননি, আদালতকক্ষে প্রবেশ করতেও সমস্যায় পড়েন। মার্কিন আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা কমিশনের চেয়ারম্যান জানান, মনে হয় সরকার আগেই মামলার ফল নির্ধারণ করে রেখেছে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করছে।[৮৯] পরবর্তী অধিবেশনগুলি অনুষ্ঠিত হয় ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১০, ১২ এপ্রিল ২০১০ এবং ১২ জুন ২০১০-এ। ১১ আগস্ট ২০১০-এ জানা যায় যে আদালতের রায় অনুযায়ী সাতজন বন্দির প্রত্যেকের জন্য ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, যা পরে কমিয়ে ১০ বছরে আনা হয়।[৯০] সজা ঘোষণার পর তাদের গোহরদাশ্ত কারাগারে স্থানান্তর করা হয়।[৯১] মার্চ ২০১১-তে, সাজাগুলি আবার মূল ২০ বছরে পুনর্বহাল করা হয়।[৯২] ৩ জানুয়ারি ২০১০-এ, ইরানি কর্তৃপক্ষ বাহা'ই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আরও দশজন সদস্যকে আটক করে; প্রতিবেদন অনুযায়ী তাদের মধ্যে ছিলেন লেভা খানজানি, ২০০৮ সাল থেকে কারারুদ্ধ সাতজন বাহা'ই নেতার একজন জামালউদ্দিন খানজানির নাতনি; এবং ফেব্রুয়ারিতে তারা তার ছেলে নিকি খানজানিকেও গ্রেপ্তার করে।[৯৩]
ইরানি সরকার দাবি করে যে বাহা'ই ধর্ম কোনো ধর্ম নয়, বরং একটি রাজনৈতিক সংগঠন, এবং তাই এটিকে সংখ্যালঘু ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে।[৯৪] তবে, সরকার কখনোই বাহা'ই সম্প্রদায় সম্পর্কে তাদের এই আখ্যাকে সমর্থন করার মতো কোনো তাৎপর্যপূর্ণ প্রমাণ হাজির করতে পারেনি।[৯৫] ইরানি সরকার আরও অভিযোগ করে যে বাহা'ই ধর্মের সায়োনবাদের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। বাহা'ইদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণে কোনো ভিত্তি নেই বলে মনে হয়[৯৬][৯৭], এবং কেউ কেউ যুক্তি দেন যে ইরানি সরকার বাহা'ইদের "বলির পাঁঠা" বানাতে এগুলো মনগড়া করেছে।[৯৮] ২০১৯ সালে, ইরানি সরকার বাহা'ইদের ইরানি রাষ্ট্রের কাছে আইনত নিবন্ধিত হওয়া অসম্ভব করে তোলে। ইরানে জাতীয় পরিচয়পত্রের আবেদনপত্রে আর "অন্যান্য ধর্ম" নামের কোনো বিকল্প নেই, ফলে কার্যত বাহা'ই ধর্ম রাষ্ট্রের দ্বারা স্বীকৃত হবে না।[৯৯]
Remove ads
বাহা'ই উপাসনালয়
"বাহা'ই উপাসনালয় (পদ্ম মন্দির নামে সুপরিচিত)" নয়াদিল্লির নেহরু প্লেসের কালকাজিতে অবস্থিত। বিশ্বজুড়ে সাতটি বাহা'ই উপাসনালয় নির্মিত হয়েছে।
- পশ্চিম সামোয়া
- সিডনি - অস্ট্রেলিয়া
- কাম্পালা - উগান্ডা
- পানামা সিটি - পানামা
- ফ্রাঙ্কফুর্ট - জার্মানি
- উইলমেট - যুক্তরাষ্ট্র
- নয়াদিল্লি - ভারত
সূচীপত্র
তথ্যসূত্র
বহিঃসংযোগ
Wikiwand - on
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Remove ads