রাজশেখর বসু

বাঙালি সাহিত্যিক, অনুবাদক, রসায়নবিদ ও অভিধান প্রণেতা উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ

রাজশেখর বসু

রাজশেখর বসু (মার্চ ১৬, ১৮৮০ - এপ্রিল ২৭, ১৯৬০)[] ছিলেন একজন বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক, অনুবাদক, রসায়নবিদ ও অভিধান প্রণেতা। তিনি পরশুরাম ছদ্মনামে তাঁর ব্যঙ্গকৌতুক ও বিদ্রুপাত্মক কথাসাহিত্যের জন্য প্রসিদ্ধ। গল্পরচনা ছাড়াও স্বনামে প্রকাশিত কালিদাসের মেঘদূত, বাল্মীকি রামায়ণ (সারানুবাদ), কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসকৃত মহাভারত (সারানুবাদ), শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতা ইত্যাদি ধ্রুপদি ভারতীয় সাহিত্যের অনুবাদগ্রন্থগুলিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। চলন্তিকা অভিধান প্রণয়নের জন্য তিনি সর্বাধিক পরিচিতি। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে রবীন্দ্র পুরস্কারেভারত সরকার পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করে। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে আনন্দীবাঈ ইত্যাদি গল্প গ্রন্থের জন্য তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেছিলেন।

দ্রুত তথ্য রাজশেখর বসুপরশুরাম, জন্ম ...
রাজশেখর বসু
পরশুরাম
Thumb
জন্ম(১৮৮০-০৩-১৬)১৬ মার্চ ১৮৮০
বামুনপাড়া গ্রাম, বর্ধমান জেলা, বাংলা প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (অধুনা পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) (মাতুলালয়)
মৃত্যুএপ্রিল ২৭, ১৯৬০(1960-04-27) (বয়স ৮০)
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
ছদ্মনামপরশুরাম
পেশারম্যরচনাকার, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, অভিধান প্রণেতা, রসায়নবিদ
জাতীয়তাভারতীয়
সময়কাল১৯২২-১৯৬০
উল্লেখযোগ্য রচনাবলিচলন্তিকা অভিধান, গড্ডলিকা, কজ্জলী, হনুমানের স্বপ্ন, গল্পকল্প, ধুস্তরীমায়া ইত্যাদি গল্প, কৃষ্ণকলি ইত্যাদি গল্প, নীলতারা ইত্যাদি গল্প, আনন্দীবাঈ ইত্যাদি গল্প, চমৎকুমারী ইত্যাদি গল্প, কালিদাসের মেঘদূত, বাল্মীকি রামায়ণ (সারানুবাদ), কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসকৃত মহাভারত (সারানুবাদ), শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতা
উল্লেখযোগ্য পুরস্কারজগত্তারিণী স্বর্ণপদক
রবীন্দ্র পুরস্কার
সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার
পদ্মভূষণ
দাম্পত্যসঙ্গীমৃণালিনী দেবী
সন্তান১ মেয়ে
বন্ধ

ব্যক্তিগত জীবন

রাজশেখর বসু ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মার্চ[] অধুনা পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার বামুনপাড়া গ্রামে তাঁর মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার বীরনগর (উলা) গ্রামে।[] তাঁর পিতা দার্শনিক পণ্ডিত চন্দ্রশেখর বসু ছিলেন দ্বারভাঙ্গা রাজ-এস্টেটের ম্যানেজার। রাজশেখর বসু ছিলেন চন্দ্রশেখর বসু ও লক্ষ্মীমণি দেবীর ছয় সন্তানের (শশিশেখর, গিরীন্দ্রশেখর প্রমুখ) মধ্যে দ্বিতীয়। দ্বারভাঙ্গায় তিনি শৈশবকাল অতিবহিত করেন ও বাংলা ভাষার তুলনায় হিন্দী ভাষায় পারদর্শীতা অর্জন করেন। তিনি ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে দ্বারভাঙ্গা রাজস্কুল থেকে এন্ট্রাস, ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে পাটনা কলেজ থেকে এফ.এ পাশ করেন। ফার্স্ট আর্টস পাস করার পর শ্যামাচরণ দে'র পৌত্রী মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন।[] ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ বি.এ পাশ করেন।[] তখনও এম.এস-সি কোর্স চালু না হওয়ায় ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে রসায়নে এম.এ পরীক্ষা দেন এবং প্রথম হন।[]

কর্মজীবন

সারাংশ
প্রসঙ্গ

১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বি.এল পাশ করে মাত্র তিনদিন আইন ব্যবসায় করেছিলেন। আইন ব্যবসার তুলনায় বিজ্ঞান চর্চাতেই অধিকতর সফলতা লাভের লক্ষ্যে আচার্য স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস কোম্পানীতে ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে রাজশেখর তাঁর চাকরি-জীবনের শুরু করেন। সেখানে তিনি একজন রাসায়নিক হিসেবে সামান্য বেতনে নিযুক্ত হন । স্বীয় দক্ষতায় অল্পদিনেই তিনি আচার্য স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও তৎকালীন ম্যানেজিং ডিরেক্টর ডাঃ কার্তিক বসুর প্রিয়ভাজনর হন। ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঐ কোম্পানীর পরিচালক পদে উন্নীত হন।[][] একদিকে গবেষণার কাজ, অন্যদিকে ব্যবসায় পরিচালনা -- উভয়ক্ষেত্রেই তিনি অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দেন। কেমিস্ট্রি ও ফিজিওলজির মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে তিনি এক নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। স্বাস্থ্যহানির কারণে এখান থেকে অবসর নিলেও উপদেষ্টা এবং পরিচালক পদে আমৃত্যু এই কোম্পানীর সাথে যুক্ত ছিলেন।[] নিয়মানুবর্তিতা ও সুশৃঙ্খল অভ্যাসের জন্য তার জীবন-যাপন-পদ্ধতি কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিল।

১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত ভারতে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হলে তিনি তাতে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন।

লুম্বিনি পার্ক মানসিক হাসপাতাল

গিরীন্দ্রশেখরই এই লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা। জমিটি দান করেছিলেন রাজশেখর বসু। এর আগে কলকাতায় মানসিক রোগের চিকিৎসাও শুরু করেন গিরীন্দ্র। প্রথমে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে এর আউটডোর খোলার জন্যে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার সেই আবেদন নাকচ করে দেয়। তখন তিনি কারমাইকেল হাসপাতালে (আজকের আর জি কর হাসপাতাল) যোগাযোগ করেন। কারমাইকেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁকে একটি ঘরের খানিকটা অংশ, বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা, কয়েকটি আসবাবপত্রও দেন। গিরীন্দ্রের অধীনে সহযোগী ডাক্তার ছিলেন ভূপতিমোহন ঘোষ ও কামাখ্যাচরণ মুখোপাধ্যায়। সে কালে ভারত তথা এশিয়াতে এক মাইলস্টোন হয়ে ছিল এ‌ই ঘটনা। গিরীন্দ্র এর পরে একটি সম্পূর্ণ হাসপাতালের কথা ভাবেন। কিন্তু টাকা কোথায়, জায়গাই বা দেবে কে। বাড়িতে আলোচনা করেন এই নিয়ে। রাজশেখর বসু তাঁর তিলজলার জমি দিয়ে দেন। অর্থের ব্যবস্থাও হয়ে যায়। ১৯৩৮ সালে তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪০-এর ৫ ফেব্রুয়ারি।[]

সাহিত্যকর্ম

সারাংশ
প্রসঙ্গ

রাজশেখর বসুর সাহিত্যিক কর্মজীবন শুরু হয় ১৯২০-এর দশকে। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ‘পরশুরাম’ ছদ্মনামে তিনি একটি মাসিক পত্রিকায় 'শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড' নামে ব্যঙ্গ রচনা প্রকাশ করেন। সেখানে অনেকগুলো রসরচনামূলক গল্পগ্রন্থ রচনা প্রকাশ করেন, যা তাঁকে প্রভূত জনপ্রিয়তা প্রদান করেছিল। শনিবারের চিঠি পত্রিকাতেও তিনি নিয়মিত লিখেছেন। গল্পরচনা ছাড়াও স্বনামে প্রকাশিত কালিদাসের মেঘদূত, বাল্মীকি রামায়ণ (সারানুবাদ), কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসকৃত মহাভারত (সারানুবাদ), শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতা ইত্যাদি ধ্রুপদি ভারতীয় সাহিত্যের অনুবাদগ্রন্থগুলিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তাঁর গল্পের চিত্রাঙ্কন করতেন তাঁর বন্ধু, চিত্রশিল্পী, কার্টুনিস্ট যতীন্দ্রকুমার সেন[] ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় রাজশেখর বসু বিরচিত বাংলা অভিধান চলন্তিকা। এগুলি ছাড়াও লঘুগুরু, বিচিন্তা, ভারতের খনিজ, কুটির শিল্প প্রভৃতি প্রবন্ধগ্রন্থও রচনা করেছিলেন তিনি। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা মোট ২১টি।[] রাজশেখর বসুর সম্পূর্ণ গ্রন্থতালিকা নিচে প্রদত্ত হল:[]

আরও তথ্য গ্রন্থনাম, বর্গ ...
গ্রন্থনাম বর্গ প্রকাশক প্রথম প্রকাশ (বঙ্গাব্দ)
গড্ডলিকা গল্পগ্রন্থ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৩৩১
কজ্জলী গল্পগ্রন্থ ১৩৩৫
চলন্তিকা অভিধান সুধীরচন্দ্র সরকার(এম. সি. সরকার অ্যান্ড সনস লিমিটেড) ১৩৩৭
হনুমানের স্বপ্ন গল্পগ্রন্থ এম. সি. সরকার অ্যান্ড সনস লিমিটেড ১৩৪৪
লঘুগুরু (১৯১২) [] প্রবন্ধ-সংগ্রহ রঞ্জন পাবলিশিং হাউজ ১৩৪৬
কুটিরশিল্প জ্ঞান-বিজ্ঞান সংক্রান্ত গ্রন্থ বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ (বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ - ২) ১৩৫০
কালিদাসের মেঘদূত অনুবাদ গ্রন্থ বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ ১৩৫০
ভারতের খনিজ জ্ঞান-বিজ্ঞান সংক্রান্ত গ্রন্থ বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ (বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ - ৭) ১৩৫০
বন্ধ

সম্মাননা ও স্বীকৃতি

১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ কৃষ্ণকলি ইত্যাদি গল্প গ্রন্থের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত করে। আনন্দীবাঈ ইত্যাদি গল্প বইটির জন্য তিনি ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেছিলেন। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গঠিত বানান-সংস্কার সমিতি ও ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিভাষা সংসদের সভাপতিত্বও করেন রাজশেখর। ১৯৫৭-৫৮ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি উদ্‌যাপন উপলক্ষে ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত হন তিনি। এছাড়াও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডক্টরেট উপাধি প্রদান করে। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ উপাধি প্রদান করে।[] ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে জগত্তারিণী পদক এবং ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে সরোজিনী পদকেও ভূষিত হন।

বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় রাজশেখর বসুর দু'টি ছোটগল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। সেগুলো হলো পরশ পাথর এবং বিরিঞ্চি বাবা অবলম্বনে নির্মিত'মহাপুরুষ

জীবনাবসান

রাজশেখর বসু মৃণালীনি দেবীকে বিবাহ করেন। বসু দম্পতির এক কন্যা ছিল। তাঁর মেয়ের জামাই খুব অল্প বয়সে অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করে; শোকে কাতর হয়ে মেয়েও একই দিনে মারা যায়। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তার স্ত্রী মৃণালীনি দেবীও লোকান্তরিত হন। পরবর্তী ১৮ বছর স্ত্রীবিহীন একাকী জীবনে রচিত হয় তাঁর অমূল্য সাহিত্য কর্মসমূহ। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ-দূর্দশার কথা তার লেখনিতে পাওয়া যায়নি। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেও তিনি লেখালেখি চালিয়ে যেতে থাকেন। অবশেষে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ২৭ এপ্রিল দ্বিতীয় দফা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁর জীবনাবসান হয়।

তথ্যসূত্র

গ্রন্থপঞ্জি

Loading related searches...

Wikiwand - on

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.