শীর্ষ প্রশ্ন
সময়রেখা
চ্যাট
প্রসঙ্গ
সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান
সমাজের প্রায় সবার কাছে প্রত্যাশিত ব্যবহারিক জীবনে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার স্বাভাবিক অভিজ্ঞতালব উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
Remove ads
সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান, স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞান বা সংক্ষেপে কাণ্ডজ্ঞান বলতে যুক্তিযুক্তভাবে ও সাবধানতার সাথে দৈনন্দিন জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ব্যবহারিক বিষয়াদির সরল অনুধাবনের উপরে ভিত্তি করে সেগুলি সম্পর্কে প্রাথমিক স্তরের জ্ঞান ও শুভবুদ্ধির অধিকারী হওয়া, সেই অনুযায়ী আচরণ করা এবং সুবিবেচক ও বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার এমন এক স্বাভাবিক ক্ষমতাকে বোঝায়, যা সমাজের প্রায় সমস্ত ব্যক্তির কাছে প্রত্যাশা করা হয়।[১]

সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান বিশেষায়িত জ্ঞান নয়, এটি কোনও বিশেষ প্রশিক্ষণ দ্বারা অর্জিত হয় না, বরং কোনও সমাজে বসবাসকারী সব ব্যক্তি বর্তমান ও অতীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে স্বাভাবিকভাবে এটি অর্জন করে থাকে। এর সাথে অতিরিক্ত তাত্ত্বিক বা দার্শনিক আলোচনা বা সংশয়ের সম্পর্ক নেই।
সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের অংশবিশেষ সমগ্র মানবজাতির জন্য বিশ্বজনীন হতে পারে, যেমন উত্তপ্ত ধাতব পাত্রে হাত দিলে যে হাত পুড়ে যাবে, তার জ্ঞান থাকা এক ধরনের বিশ্বজনীন কাণ্ডজ্ঞান। আবার কিছু কিছু সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান সমাজ, অঞ্চল, দেশ বা সম্প্রদায় নির্ভর হতে পারে। যেমন কোনও দেশে প্রচলিত বিশেষ ধর্মের প্রার্থনালয়ে প্রবেশ করতে হলে জুতা বাইরে রেখে আসতে হয়, সেটি ঐ দেশের নাগরিকদের জন্য সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান হলেও বিদেশী বা বহিরাগত কোনও ব্যক্তির জন্য সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান না-ও হতে পারে।
Remove ads
বিজ্ঞান ও সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান
কারও কারও মতে বিজ্ঞান ও সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান একে অপরের বিরোধী। তাদের মতে বিজ্ঞান বিশ্ব সম্পর্কে মানুষের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানজাত দর্শন সম্পূর্ণ পালটে দিয়েছে।
আবার অন্য কারও কারও মতে যদিও বিজ্ঞান বিশ্বের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে মানুষের অনেক গভীর বিশ্বাসের মর্মমূলে আঘাত হেনেছে, তার পরেও দৈনন্দিন জীবনে আজও সব মানুষ কাণ্ডজ্ঞানজাত সুপ্রমাণিত বিশ্বাসের প্রয়োগের মাধ্যমে সফলভাবে বহু ব্যবহারিক কাজ সমাধা করে চলেছে। কাণ্ডজ্ঞান তাই এখনও মানুষের মৌলিক ও দীর্ঘস্থায়ী অভিজ্ঞতার প্রতিফলন, এটি বর্জন করা সম্ভব নয়। বাস্তববাদী দিক থেকে বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠায় সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান তাই একটি সুদৃঢ় ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। বিজ্ঞান বহু কাণ্ডজ্ঞানজাত বিশ্বাসের ব্যাখ্যা প্রদান করে ও সেগুলি সংরক্ষণ করতে সাহায্য করে।[২]
Remove ads
সমালোচনা
সারাংশ
প্রসঙ্গ
আরিস্তোতলীয় দর্শনে সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান
প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক আরিস্তোতলের মতে মানুষ কেবল তার পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বহিঃস্থ পরিবেশের বিভিন্ন ঘটনা প্রত্যক্ষণ বা সংবেদন করে না, বরং নিয়মিত ও অনায়াসে এমন সব জটিল প্রত্যক্ষণমূলক ক্রিয়া সম্পাদন করে, যা পাঁচটি ইন্দ্রিয় দ্বারা আলাদা আলাদা করে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। যেমন একই ইন্দ্রিয় বা একাধিক ইন্দ্রিয় দ্বারা যুগপৎ প্রত্যক্ষণ (আকাশ যে নীল এবং মেঘ যে সাদা, তা একই সাথে দর্শনেন্দ্রিয় দ্বারা প্রত্যক্ষণ, কিংবা সাগরের দৃশ্য ও ঢেউয়ের শব্দ একই সাথে প্রত্যক্ষণ), সমন্বিত প্রত্যক্ষণ, বিচ্ছিন্ন প্রত্যক্ষণ, প্রত্যক্ষণ সম্পর্কে সচেতনতা, একটি ইন্দ্রিয়ের প্রত্যক্ষণ দিয়ে অপর একটি ইন্দ্রিয়ের প্রত্যক্ষকৃত ধর্ম অনুমান করা, ইত্যাদি। আরিস্তোতল বলেন যে অন্যান্য প্রাণীও বিভিন্ন ইন্দ্রিয় দিয়ে প্রত্যক্ষণ করে, কিন্তু মানুষ সেগুলির চেয়ে আলাদা এই কারণে যে মানুষের একটি উচ্চতর বর্গের প্রত্যক্ষণমূলক ক্ষমতা আছে যা পাঁচ ইন্দ্রিয়কে একত্রিত করে ও এগুলির উপর নজরদারি করে। আরিস্তোতল এই ক্ষমতার নাম দেন "সাধারণ ইন্দ্রিয়" (কোইনে আইস্থেসিস koinê aisthêsis বা সেনসুস কোমুনিস sensus communis)। তবে আরিস্তোতলের রচনায় এই ক্ষমতার প্রকৃতি নিয়ে বিক্ষিপ্ত ও অস্পষ্ট কিছু ব্যাখ্যা ছাড়া তেমন উল্লেখ পাওয়া যায় না।[৩] আরিস্তোতলীয় দর্শনে তাই সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান হল মৌলিক ইন্দ্রিয়নির্ভর প্রত্যক্ষণ (যা সব প্রাণীর মধ্যে আছে) এবং যুক্তিবাদী চিন্তনের (যা কেবল মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) মাঝামাঝি একটি ক্ষমতা।
স্কটীয় সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানভিত্তিক বাস্তববাদী দর্শন
১৮শ ও ১৯শ শতকে স্কটল্যান্ডের দার্শনিক টমাস রিড, অ্যাডাম ফার্গুসন, ডুগাল্ড স্টুয়ার্টসহ অন্যরা মত দেন যে গড়পড়তা অপরিশীলিত মানুষের প্রত্যক্ষণ কেবল কোনও ব্যক্তিনিষ্ঠ ধারণা নয়, বরং বহিস্থ বস্তুসমূহের বৈশিষ্ট্যসমূহের উপর বিশ্বাসের বাহক। তাদের মতে এই বিশ্বাসগুলি সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান ও মানবজাতির যৌক্তিক চিন্তাভাবনার অংশ। রিডের মতে শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত, দার্শনিক কিংবা দিনমজুর, সবাই সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের বিষয়ে একই তলে অবস্থিত।
রিডের মতে জ্ঞানতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানজাত বিশ্বাসসমূহ দুই ধরনের অগ্রাধিকার উপভোগ করে। প্রথমত, এগুলি হল সব জ্ঞানের ভিত্তিস্বরূপ। অন্য ভাষায়, কাণ্ডজ্ঞানজনিত বিশ্বাসগুলি এমন এক ধরনের প্রামাণিক মর্যাদার অধিকারী যেগুলির ভিত্তিমূলে আরও কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ নিষ্প্রয়োজন৷ দ্বিতীয়ত, কাণ্ডজ্ঞানজাত বিশ্বাস দার্শনিক তত্ত্বের সীমানা নির্ধারণেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। যেকোনও দার্শনিক তত্ত্বকে কাণ্ডজ্ঞানজাত বিশ্বাসগুলিকে প্রাক-তাত্ত্বিকভাবে মেনে নিয়ে ও শ্রদ্ধা করে চলতে হয়, যদি না সেগুলি বর্জন করার পেছনে ভাল যুক্তি থাকে।[৪]
মুরের দর্শন
২০শ শতকের বিশ্লেষণী দার্শনিক জর্জ এডওয়ার্ড মুর তাঁর আ ডিফেন্স অভ কমন সেন্স প্রবন্ধে এই যুক্তি দেন যে বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের এমন কিছু দৃঢ়বিশ্বাস আছে, যেগুলি প্রকৃতপক্ষেই সত্য এবং যেগুলিকে কোনও সন্দেহবাদী দার্শনিক যুক্তি দ্বারা খণ্ডন করা সম্ভব নয়। মুর এই বিশ্বাসগুলিকেই "সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান" নাম দেন। ডেভিড হিউমের সংশয়বাদ ও জর্জ বার্কলির ব্যক্তিনিষ্ঠ আদর্শবাদের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ এই সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানভিত্তিক দর্শনের উৎপত্তি হয়।
মার্ক্সবাদীদের দৃষ্টিতে সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান
মার্ক্সবাদীদের মতে সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান শাসক শ্রেণী থেকে উৎসারিত হয় এবং সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও অন্যান্য চিন্তাশীল নাগরিকদের সবসময় এগুলিকে প্রশ্ন করা ও দ্বন্দ্বে আহ্বান করা উচিত। যেমন ইতালীয় মার্ক্সবাদী দার্শনিক আন্তোনিও গ্রামশি তাঁর সাংস্কৃতিক আধিপত্য তত্ত্বে এই মত দেন যে সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান হল সাধারণ জনগণের অসংলগ্ন, গতানুগতিক প্রথানুসারী ও অপরীক্ষিত সব বিশ্বাসের সমষ্টি, যা সমাজের শাসক শ্রেণীর (রাষ্ট্র ও বুর্জোয়া পুঁজিবাদী) মনোভাব ও স্বার্থের ভিত্তিতে গৃহীত হবার পরে বৃহত্তর সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও স্বাভাবিকীকৃত হয় এবং যেগুলির কাজ আধিপত্যবাদী কাঠামোগুলি বজায় রাখা। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান তাই বলে যে বর্তমান সামাজিক অবস্থা বা স্ট্যাটাস কুও যেরকম আছে, সেরকমই থাকা উচিত। গ্রামশি-র মতে বুর্জোয়া শ্রেণী সহিংসতা, অর্থনৈতিক বল বা জোরপূর্বক বলপ্রয়োগ করে নয়, বরং মতাদর্শ ব্যবহার করে এক ধরনের আধিপত্যবাদী সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায়। এই আধিপত্যবাদী সংস্কৃতিটি তার নিজস্ব মূল্যবোধ ও সামাজিক আদর্শ এমনভাবে ছড়িয়ে দেয় যে সেগুলি সমাজের সবার জন্য "সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানে" পরিণত হয় এবং এভাবে সমাজের বর্তমান অবস্থা বজায় থাকে। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান একজন ব্যক্তিকে তার দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ব্যবহারিক সমস্যার মোকাবেলা করতে সাহায্য করে এবং ব্যক্তিটি সমাজের যে স্তরের যে ক্ষুদ্র খণ্ডে আটকা পড়ে আছে, সেখানে জীবনধারা যেরকম আছে, সেরকম বজায় রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু এই সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের কারণেই একই ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্তিগত বলয়ে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে এবং বৃহত্তর সমাজে কীভাবে সাংস্কৃতিক আধিপত্যের মাধ্যমে আর্থসামাজিক শোষণ সম্পাদিত হচ্ছে, সে সম্পর্কে তার উপলব্ধি ব্যাহত হয়। গ্রামশি-র মতে সমাজের প্রতিটি শ্রেণীতে স্বভাবগতভাবে উৎপন্ন চিন্তাশীল ব্যক্তি বা বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব হল তাদের রাজনৈতিক বলয়ের মধ্যে বিদ্যমান লোকজ বিচক্ষণতা বা সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের মধ্যে নিহিত অস্পষ্ট অনুশাসনগুলির বিরুদ্ধে কথা বলা।[৫][৬]
Remove ads
তথ্যসূত্র
Wikiwand - on
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Remove ads