আলোর দ্রুতি
শূন্য মাধ্যমে ভরহীন বস্তু ও তদসংশ্লিষ্ট অন্যান্য ক্ষেত্র তথা তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের দ্রুতি / From Wikipedia, the free encyclopedia
শূন্য মাধ্যমে আলোর যে দ্রুতি পাওয়া যায়, সেটি একটি সার্বজনীন ভৌত ধ্রুবক, যা পদার্থবিজ্ঞানের অনেক ক্ষেত্র ও শাখায় গুরুত্বপূর্ণ। একে সাধারণত c দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। শূন্যস্থানে আলোর দ্রুতি প্রতি সেকেন্ডে ঠিক ২৯,৯৭,৯২,৪৫৮ মিটারের সমান, যা প্রায় ৩ লক্ষ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড বা ১.৮৬ লক্ষ মাইল প্রতি সেকেন্ড বা ৬৭১০ লক্ষ মাইল প্রতি ঘণ্টার সমতূল্য।[Note 3] আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব অনুসারে c হচ্ছে চিরায়ত পদার্থ বা শক্তির দ্রুতির ঊর্ধ্ব সীমা এবং একইভাবে স্থান দিয়ে তথ্য বহনে সক্ষম কোনো সংকেতের দ্রুতির ক্ষেত্রেও এটি একটি ঊর্ধ্ব সীমা।[4][5][6]
সঠিক মান | |
---|---|
মিটার প্রতি সেকেন্ড | ২৯৯৭৯২৪৫৮ |
আনুমানিক মান | |
কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা | ১০৮০০০০০০০ |
মাইল প্রতি সেকেন্ড | ১৮৬০০০ |
মাইল প্রতি ঘণ্টা[1] | ৬৭১০০০০০০ |
জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক একক প্রতি দিন | ১৭৩[Note 1] |
পারসেক প্রতি বছর | ০.৩০৭[Note 2] |
বিভিন্ন দূরত্ব গমনে আলোর সংকেতের আনুমানিক সময় | |
দূরত্ব | সময় |
এক ফুট | ১.০ ন্যানোসেকেন্ড |
এক মিটার | ৩.৩ ন্যানোসেকেন্ড |
ভূস্থির কক্ষপথ থেকে পৃথিবীতে | ১১৯ মিলিসেকেন্ড |
পৃথিবীর নিরক্ষরেখার সমান দৈর্ঘ্য | ১৩৪ মিলিসেকেন্ড |
চাঁদ থেকে পৃথিবীতে | ১.৩ সেকেন্ড |
সূর্য থেকে পৃথিবীতে (১ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক একক | ৮.৩ মিনিট |
এক আলোকবর্ষ | ১.০ বছর |
এক পারসেক | ৩.২৬ বছর |
সূর্যের নিকটতম তারা থেকে (১.৩ pc) | ৪.২ বছর |
নিকটতম ছায়াপথ থেকে পৃথিবীতে | ২৫ হাজার বছর |
আকাশগঙ্গা ছায়াপথ জুড়ে | ১ লক্ষ বছর |
অ্যানড্রোমিডা ছায়াপথ থেকে পৃথিবীতে | ২৫ লক্ষ বছর |
দৃশ্যমান-আলোসহ সকল প্রকার তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণ আলোর দ্রুতিতে ভ্রমণ করে। দৈনন্দিনকার অনেক ঘটনায় অর্থাৎ বাস্তব অনেক প্রায়োগিক ক্ষেত্রেই, আলো এবং অন্যান্য তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গসমূহকে তাৎক্ষণিকভাবে সঞ্চালিত হতে দেখা গেলেও দীর্ঘ দূরত্ব এবং অত্যন্ত সংবেদনশীল পরিমাপের ক্ষেত্রে এদের সসীম গতির লক্ষণীয় প্রভাব বিদ্যমান। তাৎক্ষণিক মুহূর্তে ভূপৃষ্ঠ থেকে আমরা নক্ষত্রের যে আলোগুলো দেখি সেগুলো আমাদের চোখে দৃশ্যমান হওয়ার বহু বছর পূর্বে নক্ষত্র থেকে যাত্রা শুরু করেছে। এই ব্যাপারটি মানুষকে দূরবর্তী বস্তু দেখে মহাবিশ্বের ইতিহাস অধ্যয়ন করার সুযোগ করে দিয়েছে। দূরবর্তী স্পেস প্রোবের (কৃত্রিম উপগ্রহবিশেষ) সাথে যোগাযোগ করার সময়, পৃথিবী থেকে ঐ সব মহাকাশযানে এবং তদ্বিপরীতে সেগুলো থেকে পৃথিবীতে কোনো সংকেতের ভ্রমণ করতে কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা সময় পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। কম্পিউটিংয়ে দুটি কম্পিউটার মধ্যে, কম্পিউটার স্মৃতিতে এবং একটি সিপিইউয়ে যোগাযোগের যে চূড়ান্ত সর্বনিম্ন ডিলে (বিলম্ব) ঘটে, তা নির্ধারন করে দেয় আলোর গতি। অত্যন্ত উচ্চ নির্ভুলতার সাথে বড় দূরত্বের পরিমাপের ক্ষেত্রে ভ্রমণকালের পরিমাপে আলোর দ্রুতি ব্যবহার করা হয়।
সর্বপ্রথম ১৬৭৬ সালে ওলে রোমার বৃহস্পতির আইয়ো উপগ্রহের অধ্যয়নের মাধ্যমে দেখান যে, আলো তাৎক্ষণিকভাবে ভ্রমণ করে না, বরং একটি নির্দিষ্ট সসীম দ্রুতিতে ভ্রমণ করে। ক্রমান্বয়ে পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে আলোর দ্রুতির আরও সঠিক পরিমাপ উদঘাটিত হয়। ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল আলোকে একটি তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ হিসেবে এবং এটি তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ হওয়ায় c দ্রুতিতে ভ্রমণ করে বলে প্রস্তাব করেন।[7] যেকোনো জড় প্রসঙ্গ কাঠামোয় আলোর দ্রুতি c যে একটি ধ্রুবক, ১৯০৫ সালে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন তা স্বীকার করে নেন এবং আলোর দ্রুতি যে আলোর উৎসের গতির উপর নির্ভরশীল নয় সেটাও স্বীকার করে নেন।[8] তিনি আপেক্ষিকতার তত্ত্বের প্রতিপাদনের মাধ্যমে এই স্বীকার্যটির পরিণামসমূহ উদ্ভাবন করেন, আর এটি করতে গিয়ে দেখান যে, আলো এবং তড়িচ্চুম্বকত্বের প্রেক্ষাপটের বাইরেও c পরামিতিটির প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।
এছাড়াও, মহাকর্ষীয় তরঙ্গের মতো ভরহীন কণা এবং ক্ষেত্র- বিচলতাগুলোও শূন্যস্থানে c দ্রুতিতে ভ্রমণ করে। এই ধরনের কণা এবং তরঙ্গসমূহ উৎসের যেকোনো দ্রুতির সাপেক্ষে কিংবা পর্যবেক্ষকের যেকোনো জড় প্রসঙ্গ কাঠামোর সাপেক্ষে c দ্রুতিতে ভ্রমণ করে। অশূন্য স্থির ভরের কণাকে c দ্রুতির কাছাকাছি হওয়ার জন্য ত্বরান্বিত করা যেতে পারে, তবে দ্রুতিকে যে প্রসঙ্গ কাঠামোতেই পরিমাপ করা হোক না কেন কখনই এটা অর্জন করা সম্ভব নয়।
আপেক্ষিকতার বিশেষ এবং সাধারণ তত্ত্বগুলোতে c স্থান এবং কালের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন করে এবং ভর-শক্তি সমতুল্যতারভর-শক্তি সমতুল্যতার বিখ্যাত E = mc2 সমীকরণেও এর উপস্থিতি দৃশ্যমান।[9]
কিছু কিছু ক্ষেত্রে, বস্তু বা তরঙ্গ আলোর চেয়ে দ্রুত ভ্রমণ করতে পারে বলে মনে হতে পারে। এর উদাহরণের মধ্যে রয়েছে তরঙ্গসমূহের দশাবেগ, উচ্চ-গতিসম্পন্ন নির্দিষ্ট কিছু জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তুর উপস্থিতি এবং নির্দিষ্ট কিছু কোয়ান্টাম প্রভাব। হাবল সীমানার বাইরে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ আলোর দ্রুতিকে অতিক্রম করে বলে মনে করা হয়।
কাচ বা বায়ুর মতো স্বচ্ছ পদার্থের তৈরি মাধ্যমে আলোর সঞ্চালনের দ্রুতি c-এর চেয়ে কম; একইভাবে, তারের মধ্য দিয়ে তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের দ্রুতিও c-এর চেয়ে ধীর গতির। c এবং কোনো পদার্থের মধ্য দিয়ে আলোর দ্রুতি v-এর অনুপাতকে ঐ পদার্থের প্রতিসরাঙ্ক n বলা হয় (n = +c/v)। উদাহরণস্বরূপ, কাচের মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান আলোর প্রতিসরাঙ্ক সাধারণত ১.৫ এর কাছাকাছি হয়, যার অর্থ হলো কাচের মধ্য দিয়ে আলো +c/১.৫≈ ২০০০০০ km/s (১২৪০০০ mi/s) দ্রুতিতে ভ্রমণ করে। আবার, দৃশ্যমান আলোর জন্য পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের প্রতিসরাঙ্ক প্রায় ১.০০০২৯, ফলে বায়ুতে আলোর দ্রুতি প্রায় ২,৯৯,৭০৫ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড, যা শূন্যমাধ্যমে আলোর দ্রুতির থেকে খুব সামান্য পরিমাণেই কম।