Loading AI tools
জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতামোচন প্রক্রিয়া উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
জ্ঞানের বিউপনিবেশায়ন হল একটি জ্ঞানতত্ত্বীয় ধারণা এবং একটি বৌদ্ধিক প্রকল্প যা অন্যান্য জ্ঞানব্যবস্থার উপর প্রভুত্ব বিস্তারকারী পশ্চিমা জ্ঞানব্যবস্থার সর্বজনীনতার দাবিকে নাকচ করে। এটি উপনিবেশবাদের কারণে উপেক্ষিত জ্ঞানব্যবস্থাগুলোর জন্য স্থান ও বৈধতা দাবির পাশাপাশি এগুলোর মাঝে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়।[3][4] বৃহত্তর অর্থে প্রকল্পটিকে পশ্চিমা ব্যবস্থার বাইরে থাকা অন্য জ্ঞানব্যবস্থাগুলোর জন্য ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম হিসাবে দেখা হচ্ছে।[4] আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েক দশক ধরে জ্ঞানের বিউপনিবেশায়ন সম্পর্কিত বিতর্ক চলছে।[5]
জ্ঞানের বিউপনিবেশায়নের ধারণাটি জ্ঞান উৎপাদনের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া এবং এর ঔপনিবেশিক ও নৃতাত্ত্বিক ভিত্তিগুলিকে খতিয়ে দেখে।[7] এই মর্মে যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে, জ্ঞান ও জ্ঞানের বৈধতা নির্ধারণকারী মানদন্ডগুলি পশ্চিমা মহাবিশ্বতত্ত্ব ও চিন্তাধারা দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। নবজাগরণ ও আলোকায়নের যুগে ইউরোপে যে জ্ঞানব্যবস্থা বিকশিত হয়েছিল সেটিকে পরবর্তীতে ইউরোপের ঔপনিবেশিক প্রয়াসের বৈধতা প্রমাণের কাজে ব্যবহার করা হয়। ফলশ্রুতিতে, এই জ্ঞানব্যবস্থা ঔপনিবেশিক শাসন ও উপনিবেশক সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। তাছাড়া পাশ্চাত্য ব্যবস্থায় উৎপাদিত জ্ঞানকে সর্বজনীন হিসাবেও চিহ্নিত করা হয়েছে এবং অন্যান্য জ্ঞানব্যবস্থার চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করা হয়েছে। উপনিবেশবিরোধী পণ্ডিতেরা একমত হয়েছেন যে, পশ্চিমা জ্ঞানব্যবস্থা এখনও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের মানদণ্ড নির্ধারণ করে চলেছে এবং ভিন্ন জ্ঞান, দক্ষতা ও জীবনদর্শন পোষণকারী মানুষকে বর্জন ও প্রান্তিকীকরণের পাশাপাশি অমানবিক দৃষ্টিতে দেখা অব্যাহত রেখেছে।[5] এনিবা কিহানোর মতে:
ফলস্বরূপ, সমস্ত অভিজ্ঞতা, ইতিহাস, সংস্থান ও সাংস্কৃতিক পণ্য ইউরোপীয় বা পশ্চিমা আধিপত্যের চারদিকে ঘুরে একটি একক বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক রূপ পরিগ্রহ করে। বৈশ্বিক শক্তি বিস্তারের নতুন এই ধারায় সকল ধরনের জ্ঞান, সংস্কৃতি ও আত্মমাত্রিকতার উপর ইউরোপের আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রক্রিয়া চলাকালীন উপনিবেশ স্থাপনকারীরা...যথাসম্ভব উপনিবেশায়নের শিকার জনগোষ্ঠীর জ্ঞান উৎপাদন ও অর্থ নিরূপণের মাধ্যম, তাদের প্রতীকী জগৎ ও অভিব্যক্তি প্রকাশের উপায়, তাদের ভাব ও বস্তুর রুপায়নের ধরন ও আত্মমাত্রিকতার আদর্শকে ব্যাপকভাবে দমন করে।[8]
জ্ঞানের বিউপনিশায়নের ধারণাটি নতুন নয়। ১৪৯২ সালের দিকে উপনিবেশবাদ বিস্তারের সময় থেকেই আমেরিকার সম্প্রদায়গত গোষ্ঠী ও সামাজিক আন্দোলনে উপনিবেশবাদ বিরোধী তৎপরতার মাঝে এর উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়।[9] একাডেমিক বিষয় হিসাবে এর উত্থান বরং সাম্প্রতিক ঘটনা। এনরিক ডাসেলের মতে, জ্ঞানতত্ত্বের বিউপনিবেশায়নের ধারণাটি লাতিন আমেরিকার একদল চিন্তাবিদের লেখনি থেকে উদ্ভূত হয়েছে।[10] যদিও সত্তরের দশক থেকেই একাডেমিক পর্যায়ে জ্ঞানের বিউপনিবেশায়ন বিষয়ে আলোচনা চলছে, ওয়াল্টার মিনিওলোর মতে, পেরুর সমাজতাত্ত্বিক এনিবা কিহানোর অসামান্য দার্শনিক অবদান এই বিষয়ে বিস্তর আলোচনার দুয়ার খুলে দেয়। তার মতে কিহানো ‘রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতার ঔপনিবেশিকতার সাথে জ্ঞানের ঔপনিবেশিকতাকে স্পষ্টভাবে যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন’।[11] জ্ঞানতত্ত্বের বিউপনিবেশায়নের ধারণাটি বিকশিত হয়েছে ‘সংশয়ের একটি বিবরণ’ হিসাবে যা উত্তর-উপনিবেশবাদ, সাবঅল্টার্ন অধ্যয়ন ও উত্তর-আধুনিকতাবাদের মতো বেশ কয়েকটি সমালোচনামূলক অবস্থানের কারণে শুরু হয়। ডাসেলের মতেও জ্ঞানের বিউপনিবেশায়নের ধারণাটি ‘ক্ষমতার ঔপনিবেশিকতা’ ও ‘বহুজাতিক-আধুনিকতার’ ধারণাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে যার তাত্ত্বিক ভিত্তি মেলে হোসে কার্লো মারিয়াতেগি, ফ্রঁৎস ফানঁ ও ইমানুয়েল ওয়ালারস্টেইনের মতো দার্শনিকদের চিন্তাধারায়।[10] সাবেলো গাতসেনি যুক্তি দিয়েছেন যে, বিউপনিবেশায়নের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক দিকগুলি একটা আরেকটার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকলেও ‘উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের বাস্তব কৌশলগত যুক্তি’ হিসাবে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব অর্জনকে প্রাথমিকভাবে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল। সে কারণে বিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক বিউপনিবেশায়ন জ্ঞানের জটিল বিষয়গুলোতে ব্যাপকভাবে অনুসন্ধান করার সুযোগ পায় নি এবং শেষ পর্যন্ত জ্ঞানতত্ত্বের বিউপনিবেশায়নও গত শতকে তাই সম্ভবপর হয়ে উঠেনি।[12]
জ্ঞানের বিউপনিবেশায়নের ধারণার মূল কথা হলো পশ্চিমা জ্ঞানব্যবস্থা বৈশ্বিক জ্ঞানের আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং পশ্চিমা জ্ঞান তৈরির পদ্ধতিগুলি নির্ভুল জ্ঞানের একমাত্র রূপ হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। অন্যান্য জ্ঞানব্যবস্থার প্রতি আধিপত্যবাদী এই মনোভাবের ফলে একদিকে যেমন জ্ঞানব্যবস্থার বৈচিত্র্য হ্রাস পেয়েছে তেমনি এটি ইউরোপে জ্ঞানের নতুন কেন্দ্র স্থাপন করতে সহায়তা করেছে যা শেষ পর্যন্ত বৈশ্বিক জ্ঞানের অন্যান্য রূপকে কঠোরভাবে দমন করেছে।[13] বোয়াভেন্তরা ডি সোসা সান্টোস যুক্তি দেখিয়েছেন যে, ‘বিশ্বজুড়েই একদিকে পদার্থ, সমাজ, জীবন ও আত্মা সম্পর্কিত জ্ঞান যেমন বিভিন্ন ধরনের তেমনি সেগুলো যাচাই করার মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত ধারণাগুলিও বিচিত্র’।[14] জ্ঞানব্যবস্থাগুলোর এই বৈচিত্রময় রূপটি অবশ্য খুব বেশি স্বীকৃতি অর্জন করতে পারেনি।[15] লুইস গর্ডন স্বীকার করেছেন যে ইউরোপীয় আধুনিকতার উত্থানের পূর্বে একক রূপে জ্ঞানের বর্তমান অস্তিত্বটিই মূলত অজানা ছিল। জ্ঞান উৎপাদনের পদ্ধতি ও জ্ঞান সম্পর্কিত ধারণাগুলি এতই বিচিত্র ছিল যে তাঁর মতে জ্ঞানকে সব সময়ই বহু রূপে পরিগণনা করা হতো।[16] ওয়াল্টার মিনিওলোর মতে, জ্ঞানের আধুনিক ভিত্তিটি তাই অঞ্চল-কেন্দ্রিক ও সাম্রাজ্যবাদী। এই ভিত্তিটি ‘ঢালাওভাবে ইউরোপীয় আখ্যানের উপর প্রতিষ্ঠিত শ্রেণিবদ্ধ বিশ্বের সামাজিক-ঐতিহাসিক সংগঠন এবং এর পাশাপাশি জ্ঞানের কিছু নির্দিষ্ট ধারণা ও নীতির উপর দাঁড়িয়ে আছে’। এই ধারণাগুলো ইউরোপীয় আধুনিকতার থেকে উদ্ভূত বলে মিনিওলো মনে করেন।[17] তিনি জ্ঞানের বিউপনিবেশায়নকে একটি বিস্তৃত আন্দোলন হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন যা ‘ধর্মতত্ত্ব, ধর্মনিরপেক্ষ দর্শন ও বৈজ্ঞানিক কারণসমূহের’ ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানকে চিহ্নিত করে এবং একই সাথে জ্ঞানের যে পদ্ধতি ও নীতিগুলিকে খৃষ্টধর্ম, সভ্যতা, অগ্রগতি, উন্নয়ন ও বাজার গণতন্ত্রের নামে অস্বীকার করা হয়েছিল সেগুলোর বৈধতা প্রদান করে।"[12] আশিল এমবেম্বের মতে, জ্ঞানের বিউপনিবেশায়নের অর্থ হলো পশ্চিমা কর্তৃত্ববাদী জ্ঞানবিজ্ঞানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যা পশ্চিমা জ্ঞানব্যবস্থার বাইরে থেকে আগত কল্পনা এবং তার বাইরে সূচিত ও সূত্রবদ্ধকৃত যেকোন চিন্তাধারাকে কঠোরভাবে দমন করে।[18] সাভো হেলেটার মতে, জ্ঞানের বিউপনিবেশায়ন বলতে ‘চাপিয়ে দেয়া জ্ঞান, তত্ত্ব ও ব্যাখ্যার উপর নির্ভরতা বন্ধ করে নিজস্ব অভিজ্ঞতা, বিশ্লেষণ-পদ্ধতি ও বিশ্ব-দর্শনের ভিত্তিতে কোনো কিছুর তত্ত্বায়নকে বোঝায়’।[5]
এনিবা কিহানোর মতে আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতা ও সংজ্ঞার্থ বিনিময়ের নতুন উপায় খুঁজে বের করার জন্য জ্ঞানের বিউপনিবেশায়ন প্রয়োজন যা জ্ঞানজগতে এমন এক যুক্তিসিদ্ধ পন্থার জন্ম দেবে যুক্তিসঙ্গতভাবে যা কিছুটা সর্বজনীনতার দাবি করতে পারে।[19] সাবেলো গাতশেনি যুক্তি দিয়েছেন যে ‘শ্রমের অপ্রতিসম বৈশ্বিক বৌদ্ধিক বিভাগের’ মোকাবেলার জন্য জ্ঞানতত্ত্বের বিউপনিবেশায়ন অত্যন্ত জরুরি। এই ব্যবস্থায় ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা সমগ্র বিশ্বের জন্য শিক্ষকের ভূমিকায়ই শুধু অবতীর্ণ হয়নি বরং ‘তত্ত্ব ও ধারণা তৈরির স্থানে’ পরিণত হয়েছে এবং পুরো মানবজাতির জ্ঞানের খোরাক যোগান দিচ্ছে।[20]
জ্ঞানের বিউপনিবেশায়ন অবশ্য পশ্চিমা সভ্যতা, পশ্চিমা বিজ্ঞান বা পশ্চিমা জ্ঞানব্যবস্থাকে পুরোপুরি অস্বীকার করার বিষয়ে নয়। কারণ লুইস গর্ডনের যুক্তি অনুসারে, জ্ঞানের বিউপনিবেশায়ন জ্ঞানজগতে বিপরীত শত্রুর ধারণার প্রতিশ্রুতি থেকে বের হয়ে আসার কথা বলে।[21] ধারণাটি বরং ‘পূর্বে অস্বীকৃত বা অবদমিত জ্ঞানের ঐতিহ্যগুলির’ জন্য আপেক্ষিক জ্ঞানবাদী স্বায়ত্তশাসন এবং সেগুলোর মাঝে সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য জ্ঞানের সকল উৎসের সদ্ব্যবহারের উপর জোর দেয়।[22] রাইয়ান কনেল এর মতে:
আধুনিক যুগে ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক বিশ্ব [..] প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানের প্রভাবশালী রূপ তৈরিতে ব্যাপকভাবে অবদান রেখেছে যাকে আমরা খুব সহজেই 'পশ্চিমা বিজ্ঞান' বলে অভিহিত করি। সমস্যাটি সেকারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশ্বের অনুপস্থিতি নয়। তবে এটি জ্ঞানের মূলধারার অর্থনীতিতে এক ধরনের জ্ঞানতাত্ত্বিক অধস্তনতার জন্ম দিয়েছে যাকে পেরুর সমাজবিজ্ঞানী এনিবা কিহানো (২০০০) ‘ক্ষমতার ঔপনিবেশিকতা’ বলে অভিহিত করেছেন। ফলস্বরূপ, ঔপনিবেশিক ও উপনিবেশ পরবর্তী সমাজে উৎপাদিত জ্ঞান-সম্পদকে কখনই মূলধারার জ্ঞান-অর্থনীতিতে সংযুক্ত করা হয়নি কিংবা কেবলমাত্র প্রান্তিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।[23]
জ্ঞানের বিউপনিবেশায়ন তাই জ্ঞানের সেইসব অস্বীকৃত বা প্রান্তিক রূপগুলিকে স্বীকৃতি দিতে চায়। প্রথমত, এর মধ্যে রয়েছে আদিবাসী জ্ঞান যা উপনিবেশবাদী আদর্শ দ্বারা প্রত্যাখাত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, এটি বিকল্প সর্বজনীনতার কথা বলে। সেইসব জ্ঞান ব্যবস্থা এর মাঝে অন্তর্ভুক্ত যার কেবল স্থানীয় নয় বরং সাধারণ প্রয়োগ রয়েছে এবং যা ইউরোপীয় জ্ঞান-অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে নি। এগুলির মধ্যে যথেষ্ট পরিচিত ব্যবস্থা হল ইসলামী জ্ঞানব্যবস্থা। এটি অবশ্য একমাত্র বিকল্প সর্বজনীনতা নয়। ভারতীয় জ্ঞানব্যবস্থাকেও জ্ঞানের বর্তমান অর্থনীতির বিকল্প হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তৃতীয়ত, এটি দক্ষিণ তত্ত্ব সম্পর্কিত, অর্থাৎ ঔপনিবেশিক লড়াইয়ের সময় গড়ে ওঠা জ্ঞানের সেই কাঠামো যা প্রচলিত অনুমানকে ভুল প্রমাণ করে এই দাবি করে যে, ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক বিশ্ব সর্বদাই তাত্ত্বিক চিন্তায় সমৃদ্ধ ছিল এবং ঔপনিবেশিক সমাজ সর্বদাই ধারণা, বিশ্লেষণ ও সৃজনশীল চিন্তার বিকাশে অবদান রেখেছে।[23]
জ্ঞানের বিউপনিবেশায়ন বিষয়ে আফ্রিকার সম্ভাব্য পদ্ধতি বর্ণনা করে আশিল এমবেম্বে লিখেছেন:
পশ্চিমা [জ্ঞান]-সংরক্ষণাগারটি এককভাবে বেশ জটিল। এর মধ্যেই একে খন্ডনের উপাদান নিহিত রয়েছে। এর কাঠামো অত্যন্ত জটিল এবং এটি পশ্চিমা বিশ্বের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। আফ্রিকা ও তার প্রবাসীরা নির্ধারিতভাবে এই জ্ঞান তৈরি ও এর বিকাশে অবদান রেখেছে। তাদের তাই বৈধভাবে এই জ্ঞানের উপর ভিত্তিমূলক দাবি উত্থাপন করা উচিত। জ্ঞানের বিউপনিবেশায়ন তাই শুধু পশ্চিমা সভ্যতার বিরোধিতা করা নয়।[24]
ভারতবর্ষে জ্ঞানের বিউপনিবেশায়ন তৎপরতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। জ্ঞানের বিউপনিবেশায়ন প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,
আমাদিগকে ইহা মনে রাখিতেই হইবে যে, য়ুরোপের জ্ঞানবিজ্ঞানকে যে চিরকালই আমরা শুদ্ধমাত্র ছাত্রের মতো গ্রহণ করিব, তাহা নহে; ভারতবর্ষের সরস্বতী জ্ঞানবিজ্ঞানের সমস্ত দল ও দলাদলিকে একটি শতদল পদ্মের মধ্যে বিকশিত করিয়া তুলিবেন, তাহাদের খণ্ডতা দূর করিবেন । ঐক্যসাধনাই ভারতবর্ষীয় প্রতিভার প্রধান কাজ । ভারতবর্ষ কাহাকেও ত্যাগ করিবার, কাহাকেও দূরে রাখিবার পক্ষে নহে; ভারতবর্ষ সকলকেই স্বীকার করিবার, গ্রহণ করিবার, বিরাট একের মধ্যে সকলেরই স্বস্বপ্রধান প্রতিষ্ঠা উপলব্ধি করিবার পন্থা এই বিবাদনিরত ব্যবধানসংকুল পৃথিবীর সম্মুখে একদিন নির্দেশ করিয়া দিবে। সেই সুমহৎ দিন আসিবার পূর্বে— "একবার তোরা মা বলিয়া ডাক্![25]
আদিবাসী পণ্ডিত লিন্ডা তুহিবা স্মিথ মনে করেন পদ্ধতির বিউপনিবেশায়ন প্রয়োজন। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত "ডিকলোনাইজিং মেথডোলোজিস" নামক তার বিখ্যাত পুস্তকে তিনি পদ্ধতির বিউপনিবেশায়নের তাৎপর্য তুলে ধরেছেন। বিংশ শতকের বিভিন্ন সময় জ্ঞানের বিউপনিবেশায়নের পদ্ধতিগত পরিবর্তনও হয়েছে। সৈয়দ নিজার ভারতীয় উপমহাদেশে বিউপনিবেশায়ন পদ্ধতিগুলোর মূল্যায়ন করতে গিয়ে লিখেছেন:
এ অঞ্চলের জ্ঞানকাণ্ডে উপনিবেশের প্রভাব এবং বিউপনিবেশায়ন তৎপরতা নিয়ে দারুণ সব গবেষণা হয়েছে। তারপরও দার্শনিক অনুসন্ধান কম থাকার কারণে বিউপনিবেশায়ন তত্ত্বের দার্শনিক দুর্বলতা রয়ে গেছে। তার কারণ শুধু উত্তর-কাঠামোবাদের উপর নির্ভরশীলতা নয়। যদিও একথা সত্য যে দুই-চার জন বিউপনিবেশায়ন তাত্ত্বিকের উত্তর-কাঠামোবাদের উপরে নির্ভরশীলতা দেখলেই প্রশ্ন আসতে পারে বিউপনিবেশায়ন তত্ত্ব কতটা বিউপনিবেশিত।[26]
ওয়াল্টার মিনিওলো জ্ঞানের বিউপনিবেশায়নের উপায় হিসেবে পাশ্চাত্য জ্ঞানব্যবস্থার সাথে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা প্রত্যাশা করেছেন যা তার মতে জ্ঞানব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটা যুগান্তকারী পরিবর্তন সূচনা করবে এবং পরিণামে অন্যান্য জ্ঞানতত্ত্ব, জ্ঞান ও বোঝাপড়ার নীতিগুলিকে স্বীকৃতি দেবে।[11]
নব্য ঔপনিবেশিক গবেষণা বা বিজ্ঞান[27][28] (প্রায়শই যে বিষয়টিকে উড়োজাহাজ গবেষণা, প্যারাসুট বিজ্ঞান,[29][30] বা গবেষণা[31], বা সাফারি গবেষণা হিসাবে বর্ণনা করা হয়)[32] বলতে বৈজ্ঞানিক গবেষণার এমন অনুশীলন বা চর্চাকে বোঝায় যার মাধ্যমে ধনী দেশগুলির গবেষকরা একটি উন্নয়নশীল দেশে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন এবং তাদের নিজ দেশে ফিরে গিয়ে তথ্য ও নমুনাগুলি বিশ্লেষণ করে স্থানীয় গবেষকদের কৃতিত্ব প্রদান না করেই ফলাফল প্রকাশ করেন। ২০০৩ সালে হাঙ্গেরিয়ান একাডেমি অফ সায়েন্সেসের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে স্বল্পোন্নত দেশ সম্পর্কিত প্রকাশনাগুলির নমুনায় প্রায় সত্তর ভাগ নিবন্ধে স্থানীয় গবেষকদের লেখক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
এই ধরনের গবেষণায় স্থানীয় গবেষকদের রসদ সরবরাহের কাজে ব্যবহার করা হয় কিন্তু তাদের দক্ষতার জন্য তাদের নিয়োগ দেয়া হয় না বা তাদের গবেষণায় অংশগ্রহণের জন্য কোনো কৃতিত্ব দেওয়া হয় না। প্যারাসুট গবেষণার বদৌলতে তৈরি বৈজ্ঞানিক প্রকাশনাগুলি কেবল ধনী দেশগুলির বিজ্ঞানীদের ক্যারিয়ারে অবদান রাখে। এটি স্থানীয় বৈজ্ঞানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি (যেমন অর্থায়িত গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন) বা স্থানীয় বিজ্ঞানীদের ক্যারিয়ার বিকাশে কোনো অবদান রাখে না।[27] এটি এক ধরনের "ঔপনিবেশিক বিজ্ঞান" যা ঊনবিংশ শতকের বৈজ্ঞানিক অনুশীলনের জের ধরে গবেষণাকর্মে পাশ্চাত্যের বাইরে থেকে আসা অংশগ্রহণকারীদের আলাদা চোখে দেখে থাকে। এই ধরনের বৈজ্ঞানিক চর্চা উপনিবেশবাদের বিকাশে সহায়তা করে। জ্ঞানের বিউপনিবেশায়নের প্রয়োজনীয়তা থেকে সমালোচকেরা এই ধরনের অপচর্চা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে আসছেন।[33][34]
এই জাতীয় গবেষণা পদ্ধতি গবেষণার মান হ্রাস করে। কারণ, আন্তর্জাতিক গবেষকরা প্রায়শই সঠিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে বা স্থানীয় সমস্যা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন।[35] ফলস্বরূপ, স্থানীয় সম্প্রদায়গুলি তাদের নিজস্ব সুবিধার্থে গবেষণার ফলাফল প্রয়োগ করতে অসুবিধার সম্মুখীন হয়।[30] বিশেষ করে সংরক্ষণ-জীববিজ্ঞানের মতো বৈশ্বিক ইস্যুগুলি মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে ব্যর্থ। কারণ গবেষণালব্ধ সমাধানগুলির প্রয়োগে স্থানীয় সম্প্রদায়ের ভূমিকাই মুখ্য। কিন্তু নব্য ঔপনিবেশিক বিজ্ঞান বৈজ্ঞানিকদের দ্বারা অধ্যয়ন করা বিষয়গুলি স্থানীয় সম্প্রদায়ের মাঝে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ প্রক্রিয়ায় বাঁধার সৃষ্টি করে। [33]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.