শীর্ষ প্রশ্ন
সময়রেখা
চ্যাট
প্রসঙ্গ

বাংলাদেশে বিহারী নিপীড়ন

উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ

Remove ads

বাংলাদেশে বিহারি মুসলিম সংখ্যালঘুরা (আটকে পড়া পাকিস্তানি নামেও পরিচিত[]) ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে গণহত্যায় সরাসরি অংশ নেন বৈষম্যের শিকার হন বলে অভিযোগ করা হয়।[] ১৯৪৭-এ পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার পর ভারতের বিহার অঞ্চল থেকে স্থানীয় উর্দুভাষী মুসলিমদের একটি অনেক বড় অংশ পাকিস্তানের তৎকালীন পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশে) আসে। সাধারণভাবে এদেরকেই বিহারি বলা হয়ে থাকে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের করা ষাটের দশকের শেষাংশে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, পূর্ব পাকিস্তানে আসা উর্দুভাষী বিহারির সংখ্যা ২০ লক্ষ।[] পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ স্থানীয় মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। সাংস্কৃতিক ভিন্নতাও ছিল। ফলে সব মিলিয়ে এই কয়েক লক্ষ লোকের আগমন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের কাছে আগন্তুকের মত ছিল।[]

১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট বিহারিদেরকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভের উপযুক্ত বলে আদেশ দিয়েছিল, কিন্তু ৫০০,০০০ জন পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন বেছে নিয়েছিল। [][] কিছু প্রত্যাবর্তন রেডক্রসের মাধ্যমে কয়েক বছর ধরে বাস্তবায়িত হয়েছিল[], কিন্তু ১৯৭৮ সালে পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের বাকি পাকিস্তানিদের পাকিস্তানি নাগরিকত্ব লাভের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করে।[] গবেষকরা (যেমন সুমিত সেন)[] মনে করেন যে পাকিস্তান সরকার বিহারিদের জাতীয়করণ এবং পাকিস্তানে তাদের পুনর্বাসন করতে অনিচ্ছুক তা শরণার্থীদের মর্যাদা প্রদানের জন্য নির্যাতনের যথেষ্ট প্রমাণ। বিহারিরা তাদের নাগরিকত্ব মর্যাদার সাথে সংযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যের সম্মুখীন হয়েছে,[] এবং অনেকে শরণার্থী শিবিরে বাস করে।[]

Remove ads

ইতিহাস

সারাংশ
প্রসঙ্গ

দেশভাগের সহিংসতা

বিহার (বর্তমানে পূর্ব ভারতের একটি রাজ্য) দেশ বিভাগের কারণে মুসলমান এবং হিন্দুদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় জর্জরিত ছিল,[১০] যা ব্রিটিশ ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও ছড়িয়ে ছিল।[১১] ১৯৪৬ সালের অক্টোবরে ও নভেম্বর মাসে ৩০,০০০ এরও বেশি বিহারি নিহত হয়েছিল এবং প্রায় দশ লক্ষ পূর্ব পাকিস্তানে পাড়ি জমান।[১২] মুসলিম লীগ সিন্ধুতে বিহারি শরণার্থীদের পুনর্বাসনের আয়োজন করে। ১৯৪৬ সালে সিন্ধু ও বাংলার শিবিরে বিহারি শরণার্থীদের আগমন ১৯৪৭ সালে শরণার্থীদের পরবর্তী আন্দোলনের শুরু হয়।[১৩]

শেখ মুজিবুর রহমান (তৎকালীন ছাত্রনেতা) তার ত্রাণ দলের সাথে বিহারের ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাম পরিদর্শন করেন এবং ১৯৪৭ সালে বিহারি শরণার্থীদের পূর্ববঙ্গে চলে যেতে বলেন।[১০]

বিহার থেকে অভিবাসন

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের সময় ১১.৬ থেকে ১৮ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়; লক্ষ লক্ষ মুসলমান ভারত থেকে পাকিস্তানে চলে আসেন যখন লক্ষ লক্ষ হিন্দু ও শিখ পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে আসেন।[১৪][১৫] দ্বিজাতিতত্ত্বের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন যে পাকিস্তান ছাড়াও ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় মুসলমানদের একটি স্বাধীন মাতৃভূমি থাকা উচিত; এর ফলে পাকিস্তানের আধিপত্য বিস্তারে ব্যাপক মুসলিম অভিবাসন শুরু হয়।[১৬][১৭] ১৯৫১ সালের শুমারি অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানে ৬৭১০০ জন বিহারি ছিল; ১৯৬১ সালে বিহারি জনসংখ্যা ৪৫০,০০০ জনে পৌঁছে। বিস্তারিত হিসাবমতে, ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পরবর্তী দুই দশকে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন মুসলিম পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহার থেকে পূর্ববাংলায় চলে এসেছিল।[১৮]

Remove ads

পটভূমি

বিহারি ও বাঙালিদের ভেতর সাম্প্রদায়িক নৃশংসতার কারণ হিসেবে যা উল্লেখ করা হয় তা হল বাঙালিদের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষার দাবি করা, যার ফলাফল বাংলা ভাষা আন্দোলন। পূর্ব পাকিস্তানের অপেক্ষাকৃত ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি দুই সম্প্রদায় ও দেশের দুই অঞ্চলের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছিল।[১৯] ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিহারিরা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পরিবর্তে মুসলিম লীগকে বা পিডিপি সমর্থন করেছিল। সংগত কারণেই মুক্তিযুদ্ধেও তারা বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান নেয়। অবিচ্ছিন্ন পাকিস্তান সময়ে (১৯৪৭-১৯৭১) তারা নিজেদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানি বলে পরিচয় দিত।[২০]

সশস্ত্র প্যারামিলিশিয়া গ্রুপ, যেমন আলশামস, রাজাকার এবং আলবদরকে সশস্ত্র বাহিনীকে বিহারিরা সমর্থন করেছিল। এই বাহিনীগুলো বাঙালি, সাধারণ মানুষ, ধর্মীয় ও সংখ্যালঘু হিন্দুদের বিরুদ্ধে গণহত্যা পরিচালনা করে। গবেষকদের মতে, এই হত্যাযজ্ঞে মৃত মানুষের সংখ্যা বিশ থেকে ত্রিশ লক্ষ।

Remove ads

পরবর্তী অবস্থা

সারাংশ
প্রসঙ্গ

শরনার্থী সমস্যা

বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে বিহারিদের নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য রাষ্ট্রপতি আদেশ ১৪৯ ঘোষণা করে। সরকারি সূত্র মতে ৬০০,০০০ বিহারি এই প্রস্তাব গ্রহণ এবং ৫৩৯,৬৬৯ পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।[২১] কিন্তু ঐতিহাসিক পার্থ ঘোষের মতে, মোট ৭ লক্ষ বিহারির মধ্যে প্রায় ৪৭০,০০০ বিহারিকে ইন্টারন্যাশনাল রেডক্রসের মাধ্যমে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।[২২] পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি দল তাদের সরকারকে বিহারিদের গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছে।[২৩][২৪]

সুরুর হোদা, একজন সমাজতান্ত্রিক নেতা, শরণার্থী সংকট সমাধানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি ব্রিটিশ লেবার পার্টির রাজনীতিবিদ ডেভিড এনাল এবং বেন হুইটেকারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলের আয়োজন করেন, যা অনেক শরণার্থীকে পাকিস্তানে ফিরে যেতে উৎসাহিত করে।[২৫] ১৯৭৪ সালের একটি চুক্তিতে পাকিস্তান ১৭০,০০০ বিহারি শরণার্থী গ্রহণ; যাহোক, তারপর থেকে প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া স্থগিত রয়েছে।[২৬]

অভিবাসন

তাদের প্রাথমিক পাকিস্তানপন্থী অবস্থানের কারণে বিহারিরা পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর ইচ্ছা ধারাবাহিকভাবে ছিল। প্রাথমিকভাবে, ৮৩,০০০ বিহারি (৫৮,০০০ প্রাক্তন সরকারী কর্মচারী এবং সামরিক কর্মচারী), বিভক্ত পরিবারের সদস্য এবং ২৫,০০০ অন্যান্য বিহারিকে পাকিস্তানে সরিয়ে নেওয়া হয়।[২২] ১৯৭৪ পর্যন্ত, ১০৮,০০০ জন পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হয়েছে (প্রধানত আকাশপথে); ১৯৮১ পর্যন্ত, প্রায় ১৬৩,০০০। উভয় দেশই রাষ্ট্রহীনদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, কিন্তু মাত্র কয়েকশত লোক পাকিস্তানে যেতে সক্ষম হয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনারের তত্ত্বাবধানে ১১৯,০০০ বিহারিকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।[২৭] ইউএনএইচসিআর রিপোর্ট অনুযায়ী দ্বিতীয় দিল্লি চুক্তির পর ১৭০,০০০ বিহারিকে ফেরত পাঠানো হয়। ১৯৭৭ সালে ৪৭৯০টি পরিবার ফেরত পাঠানো হয়; ১৯৭৯ সালে ২৮০০; ১৯৮১ সালে ৭০০০; ১৯৮৪ সালে ৬০০০; এবং ১৯৯৩ সালে ৫০ পরিবার।[২৮] ১৯৭৩-১৯৯৩ সালের মধ্যে প্রায় ১৭৮,০৬৯ জন বিহারিকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়।[][২৯][৩০]

বর্তমান অবস্থা

সারাংশ
প্রসঙ্গ

যদিও অনেক বিহারি বাংলাদশের বাঙালি জনসাধারণের ভেতর অঙ্গীভূত হয়ে গিয়েছে, কিছু পাকিস্তানে চলে গিয়েছে এবং বাংলাদেশজুড়ে শরনার্থী শিবিরে অবস্থান নিয়েছে।[৩১] এক হিসাবমতে বাংলাদেশের শহুরে শরনার্থী শিবিরে এখনো কমপক্ষে ২,৫০,০০০ বিহারি রয়েছে।[৩২] ক্যাম্পগুলো বস্তিতে পরিণত হয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বড়টি (জেনেভা ক্যাম্প নামে পরিচিত, যাতে ২৫,০০০ এর বেশি লোক আছে) ঘনবসতিপূর্ন ও অনুন্নত; ১০ জন লোকের একটি পরিবার একটি কক্ষে থাকে[৩৩],৯০টি পরিবার একটি ল্যাট্রিন ভাগাভাগি করে এবং পাঁচ শতাংশের কম লোকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আছে। শিক্ষার সুযোগের অভাবে এবং জীবনের নিম্নমানের কারণে বস্তির তরুণেরা সম্প্রদায়ে শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধির জন্য উর্দুভাষী যুব উন্নয়ন সংগঠন (উর্দুভাষী তরুণ ছাত্র সংস্থা) প্রতিষ্ঠা করেছে। খারাপ ড্রেইনেজ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার কারণে স্বাস্থ্য[৩৪] ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমস্যা লেগেই থাকে এবং খবর প্রতিবেদনে ও একাডেমিক জার্নালে বিহারিদের অর্থনৈতিক অবস্থা অতি দরিদ্র বলে  প্রকাশিত হয়েছে।[৩৩]

২০১৪ সালের কালশী সংঘর্ষ

২০১৪ সালে মিরপুরে স্থানীয়দের সঙ্গে বিহারিদের সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়।[৩৫] এই সংঘর্ষের একপর্যায়ে কিছু উচ্ছৃঙ্খল বাঙালি একটি বিহারি পরিবারের আটজনসহ মোট নয় জনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরে ফেলে।[৩৬]

আক্রমণে প্ররোচনাদানের জন্য বিহারিরা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জনৈক সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লাকে দোষারোপ করেছিল।[৩৭] ইলিয়াস মোল্লা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন এবং অভিযোগটি তার বিরুদ্ধে একধরনের "স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র" বলে জানান।[৩৮]

Remove ads

নাগরিকত্ব প্রদান

২০০৩ সালের মে মাসে বাংলাদেশে হাইকোর্টের নির্দেশ অনুসারে দশজন বিহারি শরণার্থীকে নাগরিকত্ব ও ভোটের অধিকার প্রদান করে।[৩৯] এই আইন বিহারিদের মধ্যে প্রজন্মের ব্যবধান উন্মোচিত করেছিল; তরুণ বিহারিরা পরম উল্লাসিত হয়েছিল, কিন্তু অনেক বয়স্ক মানুষ "উৎসাহে ভাটা" অনুভব করেছিল এবং বলেছিল তাদের আসল বাড়ি পাকিস্তানে।[৪০] অনেক বিহারি এখন বৃহত্তর নাগরিক অধিকার এবং বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রত্যাশী।[৪১]

২০০৮ এর ১৯ মে, হাইকোর্ট বিভাগ ১,৫০,০০০ জন শরণার্থী যারা ১৯৭১ এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংখ্যালঘু ছিল, তাদের নাগরিকত্ব ও ভোটের অধিকার অনুমোদন করে।[৩৪][৪২] যারা যুদ্ধের পর জন্ম নিয়েছিল তারাও নাগরিকত্ব ও ভোটের অধিকার অর্জন করে। ২০০৮ সালের সাধারন নির্বাচনে অনেক রাজনৈতিক দল বিহারি ভোটের জন্য ক্যাম্পে প্রচার অভিযান চালিয়েছিল এবং দলটি পার্টি ও প্রার্থীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়েছিল।[৪৩]

Remove ads

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

Loading related searches...

Wikiwand - on

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.

Remove ads