শীর্ষ প্রশ্ন
সময়রেখা
চ্যাট
প্রসঙ্গ

লুচি

আটা বা ময়দা দ্বারা তৈরী একপ্রকার খাবার উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ

লুচি
Remove ads

লুচি বা নুচি বাংলার একটি খুবই উল্লেখযোগ্য খাবার। এটি ময়দার তৈরী ডুবোতেলে ভাজা একটি খাদ্য। 'বাঙালির খাদ্যকোষ' রচয়িতা মিলন দত্তের মতে লুচি হল বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় নোনতা খাবার।[]

দ্রুত তথ্য অন্যান্য নাম, উৎপত্তিস্থল ...
Remove ads

ব্যুৎপত্তি

কোনও প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থে লুচি বা লুচিকা বা অন্য কোনও কাছাকাছি শব্দ পাওয়া যায় না। প্রাকৃতেও লুচি শব্দটি নেই। আবার লুচি বাংলার দেশজ শব্দও নয়। একটি মত অনুসারে লুচি সম্ভবত হিন্দি উদ্ভূত শব্দ। হিন্দিতে পিচ্ছিল বোঝাতে 'লুচ' বা 'লুচলুচিয়া' শব্দটি ব্যবহার করা হয়। ঘিয়ে ভাজা লুচি হাত থেকে পিছলে যায় বলে, এর নামকরণ হয়েছে 'লুচি'।[] অন্য একটি মত অনুসারে লুচি শব্দটি এসেছে সংস্কৃত 'লোচক' থেকে। লোচকের অর্থ চোখের মণি। লুচি যেহেতু চোখের মণির মত গোল, তাই তার এমন নাম।[]

Remove ads

ইতিহাস

একাদশ শতকে পাল যুগের বিখ্যাত চিকিৎসক চক্রপাণি দত্ত রচিত 'দ্রব্যগুণ' গ্রন্থে লুচির বর্ণনা পাওয়া যায়।[][] তিনি লিখেছেন, 'সুমিতায়া ঘৃতাক্তায়া লোপ্‌ত্রীং কৃত্বা চ বেল্লয়েৎ। আজ্যে তাং ভর্জয়েৎ সিদ্ধাং শষ্কুলী ফেনিকা গুণাঃ॥' যার বাংলা অর্থ হল, 'গম চূর্ণকে ঘি দিয়ে মেখে, লেচি করে বেলে, গরম ঘিয়ে ভেজে তৈরী হয় শষ্কুলী, যার গুণ ফেনিকার মত।'[][] শষ্কুলী লুচির আদি রূপ। পাল যুগে তিন প্রকার শষ্কুলী বা লুচি প্রচলিত ছিল - খাস্তা, সাপ্তা ও পুরি।[] ময়ান দিয়ে ময়দার লেচি বেলে তৈরী হত খাস্তা, ময়ান ছাড়া ময়দার লেচি বেলে তৈরী হত সাপ্তা, ময়দার পরিবর্তে আটা ব্যবহার করলে তাকে বলা হত পুরি।[][][] মানিকলাল গঙ্গোপাধ্যায় রচিত ধর্মমঙ্গলে লুচিকে জনপ্রিয় খাদ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[] ১৮৫৪ সালে রামনারায়ণ তর্করত্ন রচিত 'কুলীন কুলসর্বস্ব' গ্রন্থে লুচিকে উত্তম ফলারের সর্বপ্রথম উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।[]

পাল যুগের খাস্তা লুচিই বর্তমানে বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় নোনতা খাবার লুচি। আর সেই যুগের আটার লুচিই আজ উত্তর ভারতের জনপ্রিয় খাবার পুরি[] লুচিতে কোনো পুর থাকে না। সাধারণভাবে আটার লুচি বা পুরিতেও কোনো পুর থাকে না। লুচির সমগোত্রীয় পুর দেওয়া নোনতা খাবারগুলি হল ডালপুরি, কচুরিরাধাবল্লভী

Remove ads

প্রস্তুত প্রণালী

সারাংশ
প্রসঙ্গ
Thumb
লুচির প্রধান উপাদান ময়দা

লুচির মূল উপাদান হল ময়দা, জল, লবণঘি। লুচিকে ফুলকো করে তোলার জন্য সামান্য সুজি ব্যবহার করা হয়।[][] সুজির পরিবর্তে অল্প চিনি ব্যবহার করা যেতে পারে। ঘি মহার্ঘ হওয়ার কারণে ঘিয়ের পরিবর্তে সর্ষের তেলসহ বিভিন্ন ভেষজ তেল এমনকি ডালডাও ব্যবহার করা হয়। উৎকৃষ্ট লুচি প্রস্তুত করতে গেলে, ময়দায় ময়ান দিতে হয়। জল দিয়ে ময়দা মাখার সময় তাতে উত্তমরূপে ঘি যোগ করাকে ময়ান দেওয়া বলে। ময়ান না দিলে লুচি কড়া হয়। আবার অত্যধ্যিক ময়ান দিলে লুচি ভেঙে যায়। সেই জন্য পরিমাণমত ময়ান দিতে হয়।[১০] সাধারণতঃ ১৬ ভাগ ময়দায় এক থেকে দুই ভাগ ঘিয়ের ময়ান দেওয়া হয়। ময়াদা মাখার সময় ময়দাকে ক্রমাগত ঠাসতে হয়। ময়দা যত ঠাসা হয় লুচি ততই ফুলকো ও মোলায়েম হয়।[১০] ময়দা মাখার পর তা থেকে ছোট ছোট গোলকাকৃতি গুটি বা লেচি বা লেট্টি কাটা হয়। তারপর গুটি বা লেচিকে বেলন চাকিতে বেলে চ্যাপ্টা গোলাকৃতি রূপ দেওয়া হয়। চাকীতে হাল্কা ঘি বা তেল ঘষে নিয়ে, লেচিটা শুকনো ময়দায় মাখিয়ে বেলন দিয়ে বেলা হয়। অনেক বাড়িতে বেলনের আড়াই টানে লুচি বেলার প্রথা প্রচলিত আছে। লুচি বেলা হয়ে গেলে তাকে গরম ঘি বা তেলে ছাড়া হয়। খানিক পরই লুচি ফুলতে শুরু করে। এই সময় খুন্তি বা ঝাঝরি দ্বারা লুচিকে ঈষৎ চেপে ধরলে তা প্রকৃত গোলকের আকৃতি ধারণ করে।[১০] একদিক ফুলে উঠলেই লুচিকে উল্টে দেওয়া হয়, যাতে অপর পিঠও অনুরূপ ফুলে ওঠে। যে ফোলা লুচির উপর এবং নিচের স্তর বা অংশটি সমান পাতলা হয় (একটি মোটা অপরটি সরু নয়) তাকে ফুলকো লুচি বলে। লুচি ফুলকো করার জন্য কেউ জোর দেন ময়ানে, কেউ জোর দেন ময়দার মাখার উপর, কেউ জোর দেন পরিমাণমত সুজি ব্যবহার করার উপর।

পরিবেশনা

বিশুদ্ধ লুচির রং সাদা।[] শেফ অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের মতে বাঙালির মানসে লুচির একটা ভিসুয়াল আইডেন্টিটি রয়েছে। তার থেকে বিচ্যুতি হলে ক্ষমা নেই। তাই লুচির রং লালচে হলে বিশুদ্ধবাদী বাঙালি ভোজনরসিকের কাছে তা কখনই গ্রহণীয় নয়। অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের মতে টেবল এস্থেটিকসের পরীক্ষায় লালচে লুচি ফেল।[] টেবল এস্থেটিকসের মাপকাঠিতে দুধ সাদা পোর্সেলিনের প্লেটে ফুলকো ঘি-সাদা লুচিই শ্রেষ্ঠ।[][] ফুলকো লুচি সাধারণত পায়েশ, বেগুনভাজা, ডাল, আলুর দম বা মাংসের সাথে খাওয়া হয়। বাঙালি হিন্দু অভিজাত পরিবারে তিন আঙুলের অর্থাৎ‍ বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ, তর্জনী ও মধ্যমার ডগায় শ্বেতশুভ্র লুচি ছিড়ে তরকারি দিয়ে খাওয়ার চল আছে। সত্যজিত্‍ রায় ১৯৬৪ সালে নির্মিত চারুলতা ছায়াছবিতে ভূপতির চরিত্রকে উনবিংশ শতকের কলকাতার নব্য বাবুসমাজের প্রতিনিধি হিসেবে দৃশ্যায়িত করতে গিয়ে তিন আঙুলে লুচি খাওয়া দেখিয়েছেন।[]

Remove ads

প্রকারভেদ

সারাংশ
প্রসঙ্গ
Thumb
কান্তজীউয়ে মন্দিরে বগিথালার আকৃতির লুচি তৈরী হত

বাংলায় ভৌগোলিক অবস্থানের সাথে লুচির প্রকারভেদ লক্ষ্য করা যায়। সাহিত্যিক মণিশঙ্কর মুখার্জির মতে কলকাতা থেকে দূরবর্তী জেলাগুলোয় লুচির আকৃতি বড়, এবং সেই আকৃতি কলকাতার দিকে অগ্রসর হলেই ক্রমশঃ কমতে থাকে।[১১] গ্রাম বাংলায় প্রচলিত লুচির ব্যাস ছয় থেকে আট ইঞ্চি। কলকাতায় প্রচলিত লুচির ব্যস তিন থেকে চার ইঞ্চি।[] দিনাজপুর জেলার কান্তনগর মন্দিরের ঠাকুরবাড়ীতে এককালে যে লুচি তৈরী হত তার আকৃতি ছিল একটি বগি থালার মত। ভক্তরা সেই লুচি দু'হাত দিয়ে ছিঁড়ে ডাল, দই বা ক্ষীর মাখিয়ে খেতেন।[] মালদহ জেলায় লুচির আকৃতি প্লেটের মত। ব্যাস বারো ইঞ্চির বেশি।[] ইংরেজ বাজার]]]ের নিকটবর্তী সাদুল্লাপুর শ্মশান অঞ্চলে হাতিপায়া লুচি বলে একপ্রকার লুচি পাওয়া যায়, যা আকৃতিতে প্রকৃতই হাতির পায়ের মত। মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে পুণ্যার্থীরা ভাগিরথী নদীতে স্নান করার পর হাতিপায়া লুচি খেয়ে থাকেন। হাতিপায়া লুচি ওজন দরে বিক্রয় হয়। মেদিনীপুর জেলার রাধামোহনপুর স্টেশনের কাছে পলাশী গ্রামে নন্দী পরিবারের ঠাকুরবাড়ির ভোগে নিবেদিত লুচির ব্যাস এক থেকে দেড় ইঞ্চি। গবেষক প্রণব রায়ের মতে এটি সম্ভবত ভারতের ক্ষুদ্রতম লুচি।[]

Thumb
ঐতিহ্যবাহী পদ্মলুচি

লুচিতে ব্যবহৃত উপাদানের উপরও লুচির প্রকারভেদ লক্ষ্য করা যায়। ভাদ্র মাসে জন্মাষ্টমীর সময়ে বাঙালি হিন্দু বাড়িতে তালের বিভিন্ন পদ রান্না হয়, তাদের মধ্যে তালের লুচি অন্যতম ঐতিহ্যবাহী খাবার।[১২]

Remove ads

স্বাস্থ্য সচতেনতা

সারাংশ
প্রসঙ্গ
দ্রুত তথ্য প্রতি ১০০ গ্রাম (৩.৫ আউন্স)-এ পুষ্টিমান, শক্তি ...

১০ গ্রাম ময়দা দিয়ে তৈরী একটি মাঝারি মাপের লুচিতে থাকে ১২৫ ক্যালোরি।[১৩] বিশিষ্ট শেফ ও লেখিকা তরলা দালালের মতে একটি লুচিতে থাকে ৯৫ ক্যালোরি।[১৪] বর্তমানে চিকিৎসকদের মতে সপ্তাহে একদিন লুচি খেলে অসুবিধা নেই। প্রতিদিন লুচি খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক।[১৫] এবং প্রাতঃরাশে লুচি একদমই উচিত নয়।[১৫] তার কারণ ময়দা দিয়ে প্রস্তুত হওয়ায় লুচিতে অধিক মাত্রায় ফ্যাট থাকে। তার উপর ভাজার সময় লুচি যথেষ্ট তেল শোষণ করে। সকালবেলায় লুচির মত তৈলাক্ত খাবার যকৃতের পক্ষে ক্ষতিকারী হতে পারে।[১৫] এছাড়া প্রতিদিন লুচি খেলে ত্বকেরও ক্ষতি হতে পারে। ব্রণ হওয়ার সম্ভবনা বেড়ে যায়।[১৫] লুচি ভাজার পর সেই তেল দিয়ে রান্না করলে ক্যান্সার, অ্যালঝাইমার, বা হার্টের অসুখ হতে পারে।[১৬] তবে বাদাম তেল বা ভেষজ তেলের স্মোকিং পয়েন্ট অনেক বেশি হওয়ার জন্য সেই তেল দিয়ে আবার রান্না করা যেতে পারে। গরম তেলকে ঠাণ্ডা করে এয়ারটাইট কন্টেনারে ভরে ফ্রিজে রেখে পুনরায় ব্যবহার করা যায়।[১৬]

Remove ads

জনপ্রিয়তা

Thumb
কোজাগরী লক্ষ্মীপূজায় মা লক্ষ্মীকে লুচি ও সুজির ভোগ

কলকাতার ঘটিদের মধ্যে কথ্য ভাষায় লুচিকে 'নুচি' বলা হয়।[১৭][১৮] ঘটি-বাঙাল বাক্‌যুদ্ধে বাঙালরা ঘটিদের লুচির এহেন উচ্চারণকে ব্যঙ্গ করে থাকেন।[১৮]

বাঙালি হিন্দুর জীবনে বিভিন্ন উপলক্ষে লুচি খাওয়া হয়। দুর্গাপুজোসহ সমস্ত পুজোয় দেবতাদের ভোগ হিসেবে লুচি নিবেদন করা হয় এবং পরে তা প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। দুর্গাপুজোয় লুচির সাথে লাবড়া[১৯], আলুর দম[২০] খুবই জনপ্রিয় খাবার। বাঙালি হিন্দুর অধিকাংশ ধর্মীয় উপাচারে যেখানেই ভাত খাওয়ার উপর বিধিনিষেধ থাকে, সেখানেই বাঙালি হিন্দুরা ভাতের পরিবর্তে লুচি খেয়ে থাকেন।[২০] জামাইষষ্ঠীতে শ্বাশুড়ীরা জামাইদের লুচি দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকেন।[২১] ধর্মীয় ছাড়াও অন্যান্য উপলক্ষে বাঙালি হিন্দুরা লুচি খেয়ে থাকেন। এককালে বিবাহ উপলক্ষে পাকা দেখার দিন পাত্রপক্ষকে লুচি আলুর দম সহযোগে আপ্যায়ন করাই ছিল রীতি।[১৭] বিয়েবাড়ির ভোজের ক্রমণীতে প্রথমেই থাকত লুচি এবং বোঁটাসহ লম্বা করে কাটা বেগুনভাজা।[২২] ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত ক্রমণীতে লুচির সঙ্গে অনুপান ছিল বেগুনভাজা, ছোলার ডাল অথবা বাদাম দিয়ে রান্না করা শাক।[১৭] ১৯৭০-এর দশক থেকে লুচির সাথে চলতে থাকে কাশ্মীরি আলুর দম।[১৭]

Remove ads

চিত্রশালা

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

Loading related searches...

Wikiwand - on

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.

Remove ads