Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
দাবানল (ইংরেজি: Wildfire) হচ্ছে বনভূমি বা গ্রামীণ এলাকার বনাঞ্চলে সংঘটিত একটি অনিয়ন্ত্রিত আগুন।[1] পাহাড়িয়া অঞ্চলে দাবানলের ইন্ধন কিছু বেশি। উষ্ণ তাপক-শিখা ক্রমশ ওপরের দিকে উঠতে থাকে আর পোড়াতে থাকে বন। উঁচু গাছের ক্যানপির আগুন অনায়াসে উড়তে থাকে যত্রতত্র। এসব আগুন নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন হয়ে পড়ে কারণ আগুন থামাবার জন্যে সহজে কোনো ব্ল্যাঙ্ক করিডোর তৈরি করা যায় না যেখান থেকে সরিয়ে ফেলা যায় স্তূপ, ঝরা পাতা, ভেষজ দাহ্যবস্তুসমূহ। অতএব যতক্ষণ খুশি আপন মনে জ্বলতে থাকে আগুন। জ্বলতে জ্বলতে যখন খাদ্যের প্রচণ্ড অভাব হয় কেবল তখনই মরে যায়, দুর্ভিক্ষে মরার মতোই। ইতোমধ্যে মাটি পুড়ে টেরাকোটা হয়ে যায়, হারিয়ে ফেলে দরকারি জলশোষণ ক্ষমতা। এমন দগ্ধ মাটির ওপর যখন ঝুম বৃষ্টি নামে তখন এসব আলগা পোড়ামাটি আর কাদা ধুয়ে সমানে নামতে থাকে পাহাড়ের গা বেয়ে। নামতে নামতে পাদদেশে গড়ে তোলে কদর্য বিপুল পাহাড়,যা অনেক সময় ।
আমেরিকার বনাঞ্চলে বিভিন্ন উপায়ে আগুন লাগে বছরে প্রায় এক লক্ষ বার যে কারণে পুড়ে যায় ২০ লক্ষ হেক্টর জমি। ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার গতিতে চলতে সক্ষম এই আগুন সামনে যা কিছু পায় পুড়িয়ে নিঃশেষ করে গাছপালা ঘরবাড়ি মানুষসহ। বজ্রপাতসহ এই আগুন লাগবার পেছনে প্রাকৃতিক কারণ মাত্র পাঁচ ভাগের একভাগ। বাকী চারভাগের জন্যে দায়ী মানুষ। প্রকৃতি থেকে যতটা আগুন লাগে,তার চেয়ে বেশি আগুন লাগে অযত্নে ফেলে রাখা ক্যাম্পফায়ারের আগুন, সিগারেটের অবশিষ্টাংশ ইত্যাদি থেকে। একবার আগুন লাগলে প্রকৃতি তাকে ইন্ধন যোগায় পাগলের মতো। ফায়ার স্টর্ম, আগুনে-সাইক্লোন, অগ্নি-টর্নেডোর রূপ নিয়ে দিকবিদিক ছড়িয়ে পড়ে তার করাল গ্রাস। ক্যালফোর্নিয়াতে সান্টা অ্যানা শুষ্ক বায়ুপ্রবাহ অগ্নি স্ফূলিঙ্গকে মাইল মাইল দূরে অনায়াসে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। অতএব কেবল রাস্তার ওপাড়ে নয়, নদীর ওপাড়েও দুর্বিনীত আগুনকে বহন করে নিয়ে যেতে পারে এমন বায়ুপ্রবাহ।
গত তিরিশ বছরে দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন অরণ্য, আফ্রিকার কঙ্গো বর্ষাবন এলাকা এবং ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের মিলিয়ন মিলিয়ন একর এলাকার বৃক্ষ ধ্বংস করে জুম এবং নিয়মিত চাষাবাদের জমি বের করা হয়েছে। উর্বরা শক্তি কম হবার কারণে কয়েক বছর পরেই আবার নতুন করে পোড়াতে হচ্ছে বন-বনানী। যে কারণেই আগুন জ্বলুক, বড় ধরনের আগুনের কিছু উটকো আচরণও আমাদের চোখে পড়ে। দাবানলে পোড়া সাইবেরিয়ার তাইগা বনের ধোঁয়া ৩ হাজার মাইল দূরে জাপানের ওসাকা শহরকে অন্ধকার করে দিয়েছে, অস্ট্রেলিয়ার ব্ল্যাক ফ্রাইডে বুশ-ফায়ারের ছাই উড়ে গিয়ে পড়েছে ২ হাজার মাইল দূরের নিউজিল্যান্ডে।
আগুন প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম যেভাবেই লাগুক এবং এক পর্যায়ে এটা ক্ষতিকর রূপ নিলেও এর ভেতর কিছু কল্যাণকর দিকও আছে। প্রকৃত প্রস্তাবে, মাঝে মাঝে আগুন না লাগলে বনাঞ্চলের ন্যাচারাল ইকোসিস্টেম নষ্ট হয়ে যেতে চায়। মৃত ও পচনশীল দ্রব্যাদি পুড়ে গিয়ে শুদ্ধ হয় পরিবেশ, গাছের কাণ্ডে জমে থাকা পুষ্টি, অগ্নিকান্ডের পরে আবার ফেরত আসে জমিতে। যাবতীয় ক্ষতিকর পোকামাকড় ধ্বংস হয় এতে, রোগশোকের জীবাণুও নষ্ট হয়ে যায়। উচুঁ গাছের শামিয়ানা পুড়ে গেলে অন্ধকার স্যাঁতসেতে বনের উঠানে সূর্যের আলো ঢুকে পড়ে। তখন ছাইয়ের গাদায় শুরু হয় নতুন জীবন। প্রথমে তৃণ, তারপর বড় গাছ এবং ক্রমশ নিবিড় অরণ্য। আবার কখনো বজ্রপাতে পুড়ে যাবার জন্যে তৈরি হয় বন। এভাবেই চলতে থাকে প্রাকৃতিক অগ্নি-চক্র।
কখনো উষ্ণ বায়ুর প্রভাবে এসব চলমান আগুন শহরে ঢুকে পড়ে বসতি উজাড় করে ফেলে। ঠাসবুনোট শহরাঞ্চল আগে অনেকাংশেই ঘরবাড়ি নির্মিত হয়েছে কাঠ, খুঁটি ও তক্তা জাতীয় বৃক্ষ উপাদান দিয়ে। ফাঁকফোকর কম থাকার কারণে অত্যাচারী রাজা নীরোর আমলে জ্বলে গেছে রোম শহরের শতকরা ৭০ ভাগ, ১৪টি জেলার ১০টি জেলাই। টেসিটাসের মতো কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন স্ত্রী ও মাতৃহন্তারক নীরো তার স্বর্ণ প্রাসাদ "ডোমাস অরোরা" নির্মাণের জন্যে লোকজন দিয়ে ইচ্ছে করেই পুড়িয়ে দিয়েছে শহর। আর যখন লেলিহান অগ্নিশিখায় রোম জ্বলে যাচ্ছে তখন না কি আনন্দে বেহালাও বাজিয়েছে সে। আদতে বেহালার আবিষ্কার হয়েছে নীরোর আত্মহত্যার কমপক্ষে হাজার বছর পরে। কথাটার সত্যতা যাই থাক, ক্রমাগত ৯ দিন আগুনে জ্বলার পর, নতুন শহর তৈরি করতে গিয়ে আগুনের নিয়ন্ত্রণ কল্পনা করে নীরো তখন পোড়া ইট আর পাথর দিয়ে বিল্ডিং বানিয়েছে বড় বড় করিডোর তৈরি করে।
১৬৬৫ সনে প্লেগের ভয়াবহ আক্রমণের পরে ১৬৬৬ সনে বেকারির আগুন থেকে সূত্রপাত হয় গ্রেট ফায়ার অব লন্ডনের। প্রচণ্ড তাপে তখন সেন্ট পল ক্যাথেড্রালের ছাদের সীসা গলে রাস্তায় স্রোত নেমেছিল। আশ্চর্য ব্যাপার হল, কবুতরগুলো কিছুতেই তাদের আবাস ছেড়ে যায়নি, পালক পুড়িয়ে তারা আত্মাহুতি দিয়েছিল আগুনে। এই অগ্নিকাণ্ডে মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে মাত্র ৬ জনের। যার ভেতর একজন হলেন ভুল করে বেকারির ওভেন খোলা রেখে যাওয়া মহিলা, যিনি জীবনের বিনিময়ে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন শহরকে। শহরের মেয়রের কাছে যখন প্রকাশ করা হয়েছিল আগুনের উদ্বেগের কথা, তিনি তা গুরুত্ব দেননি, তাচ্ছিল্য করে বলেছেন, এটা আর কি এমন আগুন "এ ওম্যান ক্যান পিস ইট আউট"। এসব অযত্ন-অবহেলায় বড্ড দেরি হয়ে গেল, জ্বলে গেল লন্ডন শহর। প্লেগ অধ্যুষিত বস্তিগুলো নিঃশেষে পুড়ে গেল, পুতিগন্ধময় বিষাক্ত উপনদীর পানি টগবগ করে ফুটে জীবাণুমুক্ত করে দিল, শেষ হয়ে গেল প্লেগের অধ্যায়।
বাংলাদেশের আনুমানিক ১১% অপ্রতুল বনাঞ্চলের বড় গাছগুলির ক্যানপি বা শামিয়ানা লাগাতার নয়। অতীতে যে সব অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে তার অধিকাংশই মানুষের কারণে যা বেশ খণ্ড খণ্ড। পুরো বন নস্যাৎ করার মতো দাহ্যবস্তু কখনো থাকে না বলে অগ্নিকাণ্ড ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে না। তবে বনানীতে গ্যাস সংক্রান্ত অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপারে সচেতন হবার প্রয়োজন রয়েছে। ভারতে ১৯% বনাঞ্চলের প্রায় ৫০ শতাংশ বন বেশ ঘন যুক্ত-শামিয়ানার। জলস্বল্পতার কারণে যে সব ঝরাপাতা শুকিয়ে অগ্নি উপকরণ হিশেবে মাটির ওপর বিছিয়ে থাকে সেখান থেকে মানুষের অসাবধানতায় আগুন লেগে তা বিস্তৃতি লাভ করেছে বহুবার। ১৯৯৫ সনের ভয়াবহ আগুনে উত্তর প্রদেশ এবং হিমাচল প্রদেশের প্রায় ৭ লক্ষ হেক্টর জমি পুড়ে গেছে যা পূরণ করতে বহু বছর লেগে যাবে।
বাংলাদেশের ১১ % বনাঞ্চলে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা নগণ্য। এর একটি কারণ, বনাঞ্চলের বড় গাছগুলির ক্যানপি বা শামিয়ানাগুলি লাগাতার নয়, খণ্ড খণ্ড। এসব খণ্ড বনে দাহ্য বস্তুর অভাবহেতুও অগ্নিকাণ্ড সহজে ভয়াবহ রূপ নিতে পারে না। উল্টোদিকে ভারতের ১৯% বনাঞ্চলের প্রায় ৫০% নিবিড় বন। শুষ্ক আবহাওয়ায় জলস্বল্পতার কারণে পত্রমোচী গাছ পাতা ঝরিয়ে দেয়। সেই ঝরা পাতা আর শুকনো গুল্ম থেকে আগুন লেগে বিস্তৃত হয়ে পড়ে বনানীতে। ১৯৯৫ সনে উত্তর প্রদেশ এবং হিমাচল প্রদেশে ভয়াবহ অগ্নেকাণ্ডে পুড়ে গেছে ৭ লক্ষ একর জমির বনাঞ্চল যার ক্ষতিপূরণ হতে দীর্ঘদিন লেগে যাবে। ভারত ও বাংলাদেশের প্রায় সব আগুনই মানুষের অবহেলাজনিত কারণে লেগে থাকে, প্রাকৃতিক কারণে নয়।
যে সব কারণে বনে দাবানল হয়, শহর পুড়ে যায় নিঃশেষে, তার বেশ ক'টি অবস্থা এখনও বিদ্যমান আমাদের উপমহাদেশে। যথেষ্ট সাবধান না হলে আমরা অগ্নি-কবলিত হতে পারি, রোম বা লন্ডনের মতো জ্বলে যেতে পারে আমাদের ঠাসবোনা বস্তি-শহর, জ্বলে যেতে পারে অবশিষ্ট বনজ সম্পদ।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.