Loading AI tools
শেখ মুজিব কর্তৃক গৃহীত বৃহত্তর উন্নয়নমুখী কর্মসূচি উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
দ্বিতীয় বিপ্লব হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উপস্থাপিত একটি রাজনৈতিক প্রকল্প।[1][2] এই প্রকল্পটিতে রাষ্ট্রের তিনটি ভিত্তি কাঠামোর (প্রশাসন, বিচার ও আইনসভা) বেশ কিছু ধারাবাহিক সংস্কারমূলক কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সংস্কারগুলো সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে জারি করা হয়েছিল। বাকশালকে বিপ্লব পরিচালনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ পরিষদরূপে গঠন করা হয়েছিল।[3]
তারিখ | ২৫ জানুয়ারি – ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ (৬ মাস ও ৩ সপ্তাহ) |
---|---|
অবস্থান | বাংলাদেশ |
ফলাফল |
|
আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের নাম দেওয়া উক্ত 'বিপ্লব'টি ১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড এর পরে বাকশালের বিলুপ্তি মাধ্যমে সমাপ্ত হয়।
১৯৭১ সালে একটি স্বাধীন জাতি হিসাবে বাংলাদেশ এর উত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি গণপ্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়, যা গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসাবে গ্রহণ করে। আর স্বাধীনতার এক মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ তার সাংবিধানিক গঠনতন্ত্র লাভ করে।
বাংলাদেশ সরকার ৩০০টি নির্বাচনী এলাকা নিয়ে আইনসভা হিসাবে একটি সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করে, যেখানে সংসদ সদস্যদের প্রত্যেক সদস্যকেই ভোটারদের দ্বারা প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হতে হত। এবং ১৯৭৩-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০টির মধ্যে ২৯৩টি আসনে জয়ী হয়ে দেশ পরিচালনা করতে দেশের একক বৃহত্তম দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।
রাজনৈতিক সাফল্যের মাঝেও বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরে অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে সমস্যার মুখোমুখি হয়। স্বাধীনতার তিন বছর পর ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে, বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) মাত্র ২% বৃদ্ধি পায়, যখন জনসংখ্যা বেড়ে দাড়ায় ৩ শতাংশ, যা ছিল সরকারের জন্য বিব্রতকর।[4] রাষ্ট্রীয় নীতি অনুসারে প্রায় সমস্ত বেসরকারী উদ্যোগ জাতীয়করণ ছিল এবং বেসরকারী উদ্যোগকে নিরুৎসাহিত করা হয়। ভূমি সংস্কারের ন্যায় অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকারের বিষয়ে তেমন কোন অগ্রগতি দেখা যাচ্ছিল না।
স্বাধীনতার পর থেকে অর্থনীতিতে ধীরগতির অগ্রগতি, অকার্যকর উৎপাদন ব্যবস্থা, সীমান্তে পণ্য চোরাচালান এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের লাইসেন্স প্রাপ্ত ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ও অন্যান্য সুবিধা লাভ, এ সকল কারণের ফলশ্রুতিতে ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষে অন্তত ১.৫ লক্ষ (দেড় লক্ষ) মানুষের অনাহারে মৃত্যু ঘটে।[5] অমর্ত্য সেনসহ আরও অনেক উল্লেখযোগ্য অর্থনীতিবিদদের অনুমান অনুযায়ী উক্ত মৃত্যুর সংখ্যা আরও অনেক বেশি ছিল।[6] একই বছরে আকস্মিক বন্যার কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়, ফলে শত শত লোক অনাহারে মারা যায়।
উল্লেখ্য যে, স্বাধীন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার বিস্তার, নানামুখী অপপ্রচার এবং ভারতবিরোধী এবং পাকিস্তানপন্থী সম্প্রদায়ের আত্নপ্রকাশ দেশের পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তুলতে থাকে।
এ সকল ব্যর্থতার ফলে, সরকারবিরোধী দল এবং সংবাদপত্রগুলো সরকারের সমালোচনা করা শুরু করে। তিন বছর ব্যাপী জাতীয় রক্ষীবাহিনীর অতিরঞ্জিত কাজকর্ম ও পুলিশি কার্যক্রমের মাধ্যমে সিরাজ সিকদার, মোশারফ হোসেন, বাদল খান এবং প্রায় ত্রিশ হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা বা গুম করে রাখা হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] বিরোধী দলগুলো সরকারি দমন-প্রতিবাদের প্রতিবাদ শুরু করে এবং তাদের মধ্যে কয়েকটি আত্মরক্ষার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষ নেয়। এরমধ্যে কমপক্ষে চারজন সংসদ সদস্য নিহত হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
পরবর্তী ঘটনাবলী থেকে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, স্বাধীনতার প্রথম তিন বছরে ব্যর্থতা এবং দেশের ক্রমবর্ধমান আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে সরকার এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, গণতন্ত্র দ্বারা দেশের শান্তি শৃঙ্খলা ধরে রাখা সম্ভব নয় এবং এ কারণে তখন বিকল্প ধারাবাহিক সংস্কার সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে প্রথম বিপ্লব বিবেচনা করে, "দ্বিতীয় বিপ্লব" পরিভাষাটি দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকার ১৯৭৪ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর তারিখের সংস্করণে প্রথম ব্যবহার করা হয়, যে পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি।[7][8]
মনি একদলীয় রাষ্ট্রের ধারণাটি তার মামা রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবের সঙ্গে আওয়ামী লীগ যুব অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী যুব লীগের সভা সমাবেশগুলোতে প্রচার করতে থাকেন।
১৯৭৪ সালের অক্টোবরে, তিনি আওয়ামী লীগের অনেকগুলো সমাবেশ পরিচালনা করেন, এবং জনসমক্ষে এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রচার করতে থাকেন যে, সংসদীয় ব্যবস্থা বাংলাদেশে ব্যর্থ হয়েছে এবং আরেকটি "বিপ্লব" এখন অনিবার্য হয়ে পড়েছে।[7]
১৯৭৪ সালের একটি ব্যক্তিগত বৈঠকে মনি তার মামা শেখ মুজিবকে বিষয়টি জানান আর বলেনঃ
লিডার, জাতির পিতা একজন রাষ্ট্রপতির অধীনে নিছক একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে, এটা একদমই ভালো দেখায় না। আমরা আপনাকে অনুরোধ করছি, আপনি সংসদীয় ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তন করুন আর আমৃত্যু দেশের রাষ্ট্রপতি হন।[9]
প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি তার সংসদীয় বক্তব্যে প্রথমবারের মত "দ্বিতীয় বিপ্লবের" ঘোষণা দেন।[10]
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী কার্যকর করার মাধ্যমে দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনা ঘটে। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মাধ্যমে পাস হওয়ার পরে শেখ মুজিবুর রহমান সংসদ সদস্যদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন:
বাংলাদেশিদের মধ্যে কেবল আমাদের মত ৫% শিক্ষিত জনগণই হল সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত। আমরাই কথা বেশি বলি আর আমরাই খবরের কাগজে লেখালেখি করি। আজকে দিন এসেছে আমাদের আত্মসমালোচনা করার; এমনটা আর বেশিদিন হতে দেওয়া যায় না। আজ আমি সংবিধান সংশোধন করেছি। আজ আমি ঘোষণা করতে চাই, এটি আমাদের দ্বিতীয় বিপ্লব। আমরা এখন থেকে যে নতুন ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছি এটিও একটি গণতন্ত্র। এটি হল শোষিতের গণতন্ত্র।[11]
যদিও দ্বিতীয় বিপ্লব শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কার সহ একটি সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের দিকে এক ধাপ এগিয়ে ছিল, এটি অন্যান্য সমসাময়িক বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবগুলোর চেয়ে অনেকাংশে আলাদা ছিল। এতে সমাজ পরিবর্তনের চেয়ে কিছু রাজনৈতিক সংস্কারের লক্ষ্য অর্জন অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি মুজিবুর রহমান তার আবেগময় ভাষণে বিপ্লবের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন:
আর কতদিন বন্ধু রাষ্ট্রগুলো আমাদের খাদ্য আর সহায়তা দিয়ে যাবে? আমাদেরকে অবশ্যই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমাদের অবশ্যই নিজেকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে হবে। আমি কোন ভিক্ষুক জাতির নেতা হতে দিতে চাই না।[1]
১৯৭৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের দুই অগ্রগামী নেতা রাশেদ খান মেনন এবং হায়দার আকবর খান রনোর সাথে একটি বৈঠকে শেখ মুজিব বলেন,
আমি সমাজতন্ত্রের পক্ষে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার সাথে এসো। আমিই সেই লোক যে পাঞ্জাবি পুঁজিবাদীদের তাড়িয়ে দিয়েছিলাম, এখন সেই একই আমি মারোয়ারী পুঁজিবাদীদের সুযোগ দিতে পারি না।আমি দেশকে পুঁজিবাদী হতে দেব না। আমি একে সমাজতান্ত্রিক বানাবো।[12]
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান দ্বিতীয় বিপ্লবের ধারণাটি এভাবে নির্দেশ করেছেন:
সংসদে সাংবিধানিক পরিবর্তন আনার সময় শেখ মুজিব ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি "সিস্টেম" পরিবর্তন করছেন কারণ পুরনো ব্যবস্থাটি একটি " ফ্রিস্টাইল বা অবাধ গণতন্ত্র" হয়ে ওঠেছে যা দেশের আসল সমস্যা সমাধানে অক্ষম ছিল। (তার মতে) যে নতুন সিস্টেমকে তিনি তাঁর "দ্বিতীয় বিপ্লব" বলেছিলেন তা "সর্বহারা"দের গণতন্ত্রকে নিশ্চিত করবে।[13]
তবে, মুজিবুর পরে উল্লেখ করেছিলেন যে চলমান সংসদীয় গণতন্ত্র উক্ত সময়ে একটি ফ্রিস্টাইল বা অবাধ-বেপরোয়া ও সবার-জন্য-উন্মুক্ত খোলামেলা (free-for-all) গণতন্ত্রে অধঃপতিত হয়েছিল এবং তিনি মনে করছিলেন তার অবশ্যই এটি বন্ধ করা উচিত।
একটি জনসভায় বাকশালের গঠনতন্ত্র ঘোষণাকালে তিনি বলেন:
আমি স্মরণ করতে পারি না যে, গত দশ থেকে বিশ বছরে কোনও প্রবীণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে তিরস্কার করার পরে পল্টন ময়দান ছেড়ে গিয়েছে। তারপরেও ক্ষমতায় আসার পরে ... আমি বললাম আপনারা যদি ভাল কিছু বলতে চান বলুন। দেশের উন্নতির লক্ষ্যে কথা বললে চান বলুন। তবে আমরা কী দেখতে পেলাম? আমরা যখন এভাবে এগিয়ে যেতে শুরু করলাম তখন বিদেশী এজেন্টরা এদেশে মাথা উঁচু করল এবং ফ্রি স্টাইল শুরু হল।[13]
অনেক বিশেষজ্ঞ শেখ মুজিবের মন্তব্যের ইঙ্গিত হিসেবে মনে করেন যে, তিনি বিরোধী দলগুলির যে সমালোচনার শিকার হয়ছিলেন তা গণতন্ত্রের 'ফ্রি-স্টাইলের' কারণে সংঘটিত হয়েছিল এবং দ্বিতীয় বিপ্লবের একটি কারণ ছিল এর অবসান ঘটানো।[14]
শেখ মুজিবুর রহমানের মতে দ্বিতীয় বিপ্লব ছিল সরকার ও সমগ্র (সামাজিক) পদ্ধতির সংস্কার।
১৯৭৫ সালের ২৫ শে মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অনুষ্ঠিত জনসভায় শেখ মুজিব দ্বিতীয় বিপ্লবের চারটি উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন। তিনি বলেন,
'দ্বিতীয় বিপ্লব' কোন সমাপ্তি নয়। এটি উৎপাদন বৃদ্ধি, পরিবার পরিকল্পনা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই এবং জাতীয় ঐক্যের একমাত্র পদক্ষেপ।এর চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হল শোষণমুক্ত এমন একটি সমাজ গঠন করা যেখানে কোনও অত্যাচার, দমন-নিপীড়ন, অবিচার, বা দুর্নীতি হবে না এবং যার উদ্দেশ্য হবে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের সম্মান ও মর্যাদাকে ধরে রাখা।[15]
দ্বিতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের সুস্পষ্ট বর্ণিত চারটি উদ্দেশ্য ছিল:[16]
দ্বিতীয় বিপ্লব সংস্কারের মূল ধারণায় বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী চিহ্নিত কিছু বৈশিষ্ট্য অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং পরবর্তী সরকারি আদেশসমূহ ছিল:[13]
সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে, ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় বিপ্লব শুরু হয়, এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সংসদীয় পদ্ধতি থেকে একটি রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকার ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়।[7][17]
চতুর্থ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতির সাথে সম্পর্কিত সম্পূর্ণ অধ্যায় এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে সম্পর্কিত দ্বিতীয় অধ্যায় এবং চতুর্থ অংশের অধীনে মন্ত্রিসভা অংশটি নতুন বিধান দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। নতুন ব্যবস্থাটিতে নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত হয়, যাকে সরাসরি নির্বাচিত হতে হবে।[18]
১৯৭৫ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি মুজিবুর বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের একমাত্র বৈধ রাজনৈতিক দল হিসেবে ঘোষণা করেন। এই ঘোষণায় অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দলের তৎপরতা অবৈধ হয় পড়ে।[19][20]
একই বছরের ২ জুন শেখ মুজিব নতুন দলের গঠনতন্ত্র ঘোষণা করেন। দলটির উৎপত্তি ছিল চতুর্থ সংশোধনীর পরবর্তী ধাপ যা রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে দল গঠনের সমস্ত ক্ষমতা প্রদান করে। সংস্থার ১১৭ ক (৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকারী কর্মচারীদের জন্য জাতীয় দলের সদস্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের ব্যবস্থাও করা হয়।[21][22]
দ্বিতীয় বিপ্লবের তত্ত্ব অনুসারে এমতরূপ বিধান করা হয় যে, উপ-বিভাগসমূহ বাকশালের প্রতিনিধিগণ, সংসদ সদস্য এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি নতুন প্রশাসনিক কাউন্সিলবিশিষ্ট জেলায় রূপান্তরিত হবে। প্রতিটি প্রশাসনিক কাউন্সিলের নেতৃত্বে একজন গভর্নর থাকবেন, যিনি স্থানীয় প্রশাসন পরিচালনা করবেন।
১৯৭৫ সালের ২১ শে জুন রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান সমসাময়িক ১৯টি জেলাকে ৬১ টি জেলায় বিভক্ত করেন। একই বছরের ১লা জুলাই জেলাগুলোর গভর্নর হিসেবে মনোনীত ব্যক্তিদের নাম ঘোষণা করা হয়।
স্থানীয় যুবক, মহিলা, শ্রমিক, কৃষক এবং বাকশাল সদস্যদের সমন্বয়ে প্রতিটি থানার জন্য প্রশাসনিক কাউন্সিল গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
১৯৭৫ সালের ২৬ শে মার্চ শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস সমাবেশে ঘোষণা করেন যে দেশের প্রতিটি গ্রামে বাধ্যতামূলক বহুমুখী সমবায় থাকতে হবে। পর্যায়ক্রমে সমবায়গুলো গঠিত হবে, পাঁচ বছরের পরিকল্পনার আওতায় সমস্ত ৬৫,০০০ গ্রামে উক্ত সমবায় থাকবে।[23] প্রতিটি সমবায় ৫০০-১০০০ পরিবার নিয়ে গঠিত হবে। এই সমবায়গুলো জাতির অর্থনৈতিক একক হিসাবে বিবেচিত হবে।[24]
দ্বিতীয় বিপ্লব রাজনৈতিক কার্যকলাপের মৌলিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা এবং বিচার বিভাগ সহ নাগরিক স্বাধীনতার উপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে।
বিচার বিভাগকে রাষ্ট্রপতির অধীনস্থ করা হয়। পূর্ববর্তী পদ্ধতির বিপরীতে রাষ্ট্রপতিকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক ছাড়া অন্য বিচারক নিয়োগ দেওয়ার এবং প্রধান বিচারপতিসহ যে কোনও বিচারককে কেবল 'দুর্ব্যবহার ও অক্ষমতার' ভিত্তিতে আদেশের মাধ্যমে অপসারণের সম্পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয়।[7][25]
১৯৭৫ সালের ১৬ই জুন চারটি বড় শহরের প্রায় ২০ টি দৈনিক সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে যায় এবং কেবল চারটি পত্রিকাকে অনুমোদন দেওয়া হয়: দ্য বাংলাদেশ অবজারভার, দ্য বাংলাদেশ টাইমস, দৈনিক বাংলা এবং ইত্তেফাক।[7]
সরকার চারটি সংবাদপত্র অধিগ্রহণ করে এবং সেগুলোতে সম্পাদক নিয়োগ দেয়। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে ইত্তেফাকের সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, যা দেশের অন্যতম জনপ্রিয় দৈনিক ছিল এবং তিনি নুরুল ইসলাম পাটোয়ারীর পরিবর্তে উক্ত স্থান পেয়েছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি দ্য বাংলাদেশ টাইমস-এর সম্পাদক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।[7][26]
দ্বিতীয় বিপ্লব-এর উদ্দেশ্য ছিল সুদূরপ্রসারী। এরজন্যে সংবিধানে, দেশের রাজনৈতিক কাঠামোতে এবং সরকার পরিচালনা ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্ত আনয়ন করা হয়েছিল। যেমন বিপ্লবী কর্মসূচির আওতাধীন সংস্কারের ফলে, শেখ মুজিবুর রহমান অনির্দিষ্টকালের জন্য রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয় এবং রাষ্ট্রপতির অভিশংসনের সম্ভাব্য উপায়গুলো আরও কঠোর করা হয়। রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসনের জন্য প্রয়োজনীয় সর্বনিম্ন ভোটের সংখ্যা সংসদ সদস্যদের মোট সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ থেকে বাড়িয়ে তিন-চতুর্থাংশ করা হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
যদিও বিপ্লবটি কার্যকর করার আগেই একদল সেনা কর্মকর্তা শেখ মুজিবকে হত্যার মাধ্যমে তা ব্যর্থ করে দেয়, কিন্তু তবুও তা দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে ক্ষুব্ধ করে। দুর্ভিক্ষের কারণে চলমান দুর্ভোগের কারণে বাংলাদেশীরা তা মেনে নিতে পারেনি।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
হঠাৎ করে প্রায় সকল পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে অনেক সাংবাদিক বেকার হয়ে পড়ে, যদিও সরকার তাদের কয়েকজনের জন্য একটি টোকেন উপবৃত্তির ব্যবস্থা করেছিল।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, ইউনাইটেড পিপলস পার্টি এবং আরও কিছু দলকে পরিবর্তিত ব্যবস্থায় নিষ্ক্রিয় অবস্থায় চলে যেতে হয়েছিল। দলটি নিষ্ক্রিয় অবস্থায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সশস্ত্র বিভাগ গণবাহিনীকে আরও সক্রিয় করে তোলা হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
যদিও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্য ছিলেন, এই বাহিনীর একটি শাখা সংস্কারের জন্য উদ্গ্রীব ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশে একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও বিপ্লবটির নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একদল সেনাসদস্যের হাতে নিহত হন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
দ্বিতীয় বিপ্লব সফল করার জন্যে সংবিধান নিযুক্ত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব বিশেষভাবে প্রয়োজনীয় ছিল। কারণ দ্বিতীয় বিপ্লব তাঁরই রাজনৈতিক দর্শন থেকে উদ্ভূত। কিন্তু বিপ্লবটি কার্যকর করার আগেই একদল সেনা কর্মকর্তা ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট তারিখে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে হত্যা করে। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী বাতিল করে দেয় হয়। ফলে দ্বিতীয় বিপ্লব অগ্রসর হতে পারে নি।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের ফলে তার দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচি কার্যকর হবার আগে স্থগিত করে ফেলা হয়, ফলে এর যৌক্তিকতা কিংবা সাফল্য সম্পর্কে কোন বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়নি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান বিপ্লবটির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে তার লেখায় বলেন: "এটা ব্যাখ্যা করা কঠিন যে, এমন সংস্কারবাদী লক্ষ্য পূরণের জন্য কারও কেনইবা একটি বিপ্লবের প্রয়োজন হবে!"[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] জাহানের মতে, শেখ মুজিবের রাজনৈতিক পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশকে ওয়েস্টমিন্সটার মডেলের ভারতীয় সংস্করণ হিসেবে প্রতিলিপিত করা - যা হল একটি "একদলীয়" সংসদীয় গণতন্ত্র।[27] তিনি আরও বলেন, 'দ্বিতীয় বিপ্লব' কোনও আমূল পরিবর্তন আনেনি, কারণ নতুন মডেলটি 'একই দলীয় বিভাজন এবং একই শৈলীতে পুরানো নেতৃত্বকে বজায় রাখা'র মাধ্যমে 'নতুন বোতলে পুরানো মদ' ছাড়া আর কিছুই ছিল না।[28]
যদিও জাতীয় ঐক্যকে লালন করা ছিল বিপ্লবটির মূল লক্ষ্য, তবুও শেখ মুজিব লক্ষ্য অর্জনে কোন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ না করার জন্য সমালোচিত হয়েছিলেন।[29] কেন্দ্রীয় কমিটির ১৫০ টি পদের মধ্যে মাত্র ৮টি পদ দেওয়া হয়েছিল সে সকল পার্টির নেতাদেরকে, যারা জাতীয় ঐক্যের প্লাটফর্ম বাকশালে যোগদান করেছিলেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] বাকশালের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণ পরিষদে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোন দলের অংশগ্রহণ ছিল না।[16]
ইতিহাসবিদ এ. এফ. সালাহউদ্দীন আহমদ বিপ্লবটিকে বাংলাদেশের সত্যিকারের রাজনৈতিক মৃত্যু বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।[30]
তারিখ | ঘটনাপঞ্জি |
---|---|
২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ | শেখ ফজলুল হক মনি তার বাংলা ভাষার দৈনিক বাংলার বাণীতে দ্বিতীয় বিপ্লব শব্দটি ব্যবহার করেন। |
১১ অক্টোবর ১৯৭৪ | মনি শব্দটিকে যুবলীগের একটি জনসভায় ব্যবহার করেন এবং দাবি করেন যে বিপ্লব অনিবার্য। |
২৮ ডিসেম্বর ১৯৭৪ | বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন |
৬ জানুয়ারি ১৯৭৫ | জরুরী আইনের অধীনে জনসভা, ধর্মঘট এবং এই জাতীয় যে কোন কার্যক্রমকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। |
২১ জানুয়ারি ১৯৭৫ | প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজনীয় যে কোন পদক্ষেপ নেওয়ার নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রদান করে। |
২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ | চতুর্থ সংশোধনী বিলটি সংসদে পাস হয় এবং শেখ মুজিব সংবিধান সংশোধন সম্পর্কে বক্তৃতায় দাবি করেন যে এটি তার দ্বিতীয় বিপ্লব। |
২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫ | শেখ মুজিব নতুন জাতীয় দল বাকশাল গঠনের ঘোষণা দেন এবং অন্যান্য সমস্ত রাজনৈতিক দল ও সংগঠন নিষিদ্ধ করেন। |
৮ মার্চ ১৯৭৫ | আবদুল হামিদ খান ভাসানী শেখ মুজিবের সাথে টাঙ্গাইলে এক যৌথ ঘোষণায় দ্বিতীয় বিপ্লবকে সমর্থন জানান, যদিও তিনি বাকশালে যোগদান থেকে বিরত ছিলেন।[30] |
২৬ মার্চ ১৯৭৫ | মুজিবুর তার দ্বিতীয় বিপ্লব পরিকল্পনা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেন, বিপ্লবের চারটি উদ্দেশ্য তুলে ধরেন এবং বহুমাত্রিক সমবায়কে অর্থনৈতিক একক হিসাবে গঠনের অভিপ্রায় ঘোষণা করেন। |
২৫ এপ্রিল ১৯৭৫ | পাকিস্তানপন্থী রাজনীতিবিদ ও বিরোধী নেতা আতাউর রহমান খান বাকশালে যোগ দিয়ে বিপ্লবের অংশ হওয়ার অঙ্গীকার করেন। |
৬ জুন ১৯৭৫ | শেখ মুজিব জাতীয় দলের গঠনতন্ত্র এবং পাঁচটি ফ্রন্ট ঘোষণা করেন। |
১৬ জুন ১৯৭৫ | চারটি ব্যতীত সমস্ত সংবাদপত্র নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।[31][32][33] |
২১ জুন ১৯৭৫ | ৬১ টি মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হয়। |
১৬ জুলাই ১৯৭৫ | গভর্নর হিসেবে মনোনীত ৬১ জন ব্যক্তির নাম প্রকাশ করা হয়েছে, গভর্নরদের জন্য এক মাসব্যাপী রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের সময়সীমা একই বছরের ১৬ আগস্টের মধ্যে শেষ হওয়ার দিন তারিখ চূড়ান্ত হয়। |
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ | বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একদল সদস্য কর্তৃক একটি সামরিক অভ্যুত্থানের সময় শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং তার পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যকে হত্যা করা হয়। বিপ্লবের নেতার মৃত্যুর কারণে বিপ্লব ব্যর্থ হয়। |
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.