কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত গান উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
নজরুলগীতি বা নজরুল সঙ্গীতবাংলাভাষার অন্যতম প্রধান কবি ও সংগীতজ্ঞ কাজী নজরুল ইসলাম লিখিত গান। তার সীমিত কর্মজীবনে তিনি ৩০০০-এরও বেশি[1] গান রচনা করেছেন। এসকল গানের বড় একটি অংশ তারই সুরারোপিত। তার রচিত চল্ চল্ চল্, ঊর্ধ্বগগণে বাজে মাদলবাংলাদেশের রণসংগীত। তার কিছু গান জীবদ্দশায় গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়েছিল যার মধ্যে রয়েছে গানের মালা, গুল বাগিচা, গীতি শতদল, বুলবুল ইত্যাদি। পরবর্তীকালে আরো গান সংগ্রন্থিত হয়েছে। তবে তিনি প্রায়শ তাৎক্ষণিকভাবে লিখতেন; একারণে অনুমান করা হয় প্রয়োজনীয় সংরক্ষণের অভাবে বহু গান হারিয়ে গেছে। তার কিছু কালজয়ী গানগুলো হলো - ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’, ‘চল চল চল’, ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ’ ইত্যাদি।
নজরুলের আবির্ভাব ও কর্মকাল রবীন্দ্রযুগের অন্তর্ভূত। তবু নজরুল রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বলয়ের সম্পূর্ণ বাইরে থেকে গীত রচনা করেছেন ও সুরারোপ করেছেন। তিনি বাংলা গানে বিচিত্র সুরের উৎস। রবীন্দ্রনাথের মতো তিনিও একই সঙ্গে গীতিকার, সুরকার ও সুগায়ক। গানের সংখ্যায় তিনি রবীন্দ্রনাথকেও ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি বহু নতুন সুরের স্রষ্টা। বিচিত্র সুর আর তালে তার গান নিত্য নতুন।
শ্রোতার পছন্দানুসারে বিবিসি বাংলার করা সর্বকালের সেরা ২০টি বাংলা গানের তালিকায় নজরুলের কারার ওই লৌহকপাট গানটি ১৬তম স্থানে এবং চল্ চল্ চল্ ঊর্ধগগনে বাজে মাদল গানটি ১৮তম স্থানে রয়েছে।[2]
সকল নজরুলগীতি ১০টি ভাগে বিভাজ্য। এগুলো হলোঃ ভক্তিমূলক গান, প্রণয়গীতি, প্রকৃতি বন্দনা, দেশাত্মবোধক গান, রাগপ্রধান গান, হাসির গান, ব্যাঙ্গাত্মক গান, সমবেত সঙ্গীত, রণ সঙ্গীত এবং, বিদেশীসুরাশ্রিত গান।
নজরুল সঙ্গীতের বিষয় ও সুরগত বৈচিত্র্য বর্ণনা করতে গিয়ে নজরুল-বিশেষজ্ঞ আবদুল আজীজ আল্-আমান লিখেছেন,
গানগুলি এক গোত্রের নয়, বিভিন্ন শ্রেণীর। তিনি একাধারে রচনা করেছেন গজল গান, কাব্য সংগীত বা প্রেমগীতি, ঋতু-সংগীত, খেয়াল, রাগপ্রধান, হাসির গান, কোরাস গান, দেশাত্মবোধক গান, গণসংগীত–শ্রমিক-কৃষকের গান, ধীবরের গান, ছাদপেটার গান, তরুণ বা ছাত্রদলের গান, মার্চ-সংগীত বা কুচকাওয়াজের গান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গান, নারী জাগরণের গান, মুসলিম জাতির জাগরণের গান, শ্যামাসংগীত, কীর্তন, বৈষ্ণবপদাবলী, অন্যান্য ভক্তিগীতি, ইসলামী সংগীত, শিশু সংগীত, নৃত্য-সংগীত, লোকগীতি – ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, সাম্পানের গান, ঝুমুর, সাঁওতালি, লাউনী, কাজরী, বাউল, মুর্শেদী এবং আরও নানা বর্ণের গান। বিভিন্ন বিদেশী সুরের আদলে রচিত গানের সংখ্যাও কম নয়। এ ছাড়া লুপ্ত বা লুপ্তপ্রায় রাগ-রাগিণীকে অবলম্বন করে 'হারামণি' পর্যায়ের গান এবং নতুন সৃষ্ট রাগ-রাগিণীর উপর ভিত্তি করে লেখা 'নবরাগ' পর্যায়ের গানগুলি নজরুলের সাংগীতিক প্রতিভার অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় বহন করে।[3]
গানের মালা
৯৫ টি সংগীত সমৃদ্ধ গ্রন্থটি ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ অক্টোবর (কার্তিক ১৩৪১) প্রকাশ করেন গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স। গ্রন্থটি উৎসর্গপত্রে লেখা ছিল: "পরম স্নেহভাজন শ্রীমান অনিলকুমার দাস কল্যাণবরেষুকে"। ৪+৯৬ পৃষ্ঠার গ্রন্থের মূল্য ছিল দেড় টাকা।
এই গ্রন্থ যে সকল গানে সমৃদ্ধ সেগুলো হল:
আমি সুন্দর নহি জানি
আধো-আধো বোল
না-ই পরিলে নোটন-খোঁপায়
অয়ি চঞ্চল-লীলায়িত দেহা
ভুল করে যদি ভালোবেসে থাকি
ঝরাফুল- বিছানো পথে এস
প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথাই
আজ নিশীথে অভিসার তোমার পথে
কার মঞ্জীর রিনিঝিনি বাজে
নিরুদ্দেশের পথে আমি হারিয়ে যদি যাই
বল্ রে তোরা বল্ ওরে ও আকাশ-ভার তারা
বল্ সখি বল্ ওরে সরে যেতে বল্
নিশি না পোহাতে যেয়ো না যেয়ো না
চম্পা পারুল যুথী টগর চামেলি
দূর দ্বীপ-বাসিনী চিনি তোমারে চিনি
মোমের পুতুল মমীর দেশের মেয়ে
বকুল-বনের পাখি ডাকিয়া আর
মনের রং লেগেছে বনের পলাশ
আধখানা চাঁদ হাসিছে যে আকাশে
যবে সন্ধ্যাবেলায় প্রিয় তুলসী-তলায়
আঁখি তোলো দানো করুণা
মদির স্বপনে মম বন-ভবনে
মুঠি মুঠি আবীর ও কে কাননে ছড়ায়
বল্লরী-ভুজ-বন্ধন খোলো
তব যাবার বেলা বলে যাও মনের কথা
তরুণ অশান্ত কে বিরহী
বরষা ঐ এল বরষ্য ঝরে বারি গগনে ঝুরুঝুরু
আমি ময়নামতীর শাড়ি দেবো
স্নিগ্ধ-শ্যাম-বেণী-বর্ণা এস মালবিকা
মেঘ -মেদুর গগন কাঁদে হুতাশ পরান
আমি অলস উদাস আনমনা
কোয়েলা কুহু কুহু ডাকে
তোমার হাতের সোনা রাখি আমার হাতে
বাদলা-মেঘের বাদল-তালে ময়ূর নাচে
কে দুরন্ত বাজাও ঝড়ের ব্যাকুল বাঁশি
এ কি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী-জননী
দূর প্রবাসে প্রাণ কাঁদে আজ
শুভ্র সমুজ্জ্বল হে চির-নির্মল
দোলে প্রাণের কোলে প্রভুর নামের মালা
শঙ্কাশূন্য লক্ষকণ্ঠে বাজিছে শঙ্খ ঐ
চল্ রে চপল তরুণ-দল বাঁধন-হারা
বীরদল আগে চল্
জননী মোর জন্মভূমি
তোমার পায়ে; কে পরালো মুণ্ডমালা
নাচে রে মোর কালো মেয়ে
মাতলো গগন-অঙ্গনে ঐ
দেখে যা-রে রুদ্রাণী মা
মহাকালের কোলে এসে গৌরী
শ্মশান-কালীর নাম শুনে রে
জাগো জাগো শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী
লুকোচুরি খেলতে হরি হার মেনেছে
খর রৌদ্রের হোমানল জ্বালি
শ্যামা তন্বী আমি মেঘ-বরণা
মম আগমনে বাজে আগমনীর সানাই
উত্তরীয় লুটায় আমার
ওরে ও রাতের ফুল
বুনো ফুলের করুণ সুবাস ঝুরে
এল শ্যামল কিশোর
এল এল রে বৈশাখী ঝড়
ঘুমাও, ঘুমাও! দেখিতে এসেছি
কলঙ্ক আর জোৎস্নায় মেশা তুমি সুন্দর চাঁদ
শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয়
তুমি ভোরের শিশির রাতের নয়ন-পাতে
রাত্রি শেষের যাত্রী আমি
ফুলের মতন ফুল্ল মুখে
ফিরে ফিরে কেন তারই স্মৃতি
আঁধার রাতের তিমির দুলে আমার সামনে
দশ হাতে ঐ দশ দিকে মা
মা এসেছে মা এসেছে
ঐ কাজল-কালো চোখ
ও কালো বউ
যেয়ো না আর যেয়ো না
আগের মত আমের ডালে বোল ধরেছে
তোর রূপে সই গাহন করে
ঝড়-ঝঞ্ঝার ওড়ে নিশান
আমার প্রাণের দ্বারে ডাক দিয়ে কে যায়
এল ঐ বনাস্তে পাগল বসন্ত
সহসা কি গোল বাঁধালো পাপিয়া আর পিকে
এস কল্যাণী, চির-আয়ুষ্মতী
দাও শৌর্য দাও ধৈর্য হে উদার নাথ
চাঁদের দেশের পথ-ভোলা ফুল
রঙ্গিলা আপনি রাধা
কুঙ্কুম আবীর ফাগের
এল ফুল-দোল ওরে
যাবার বেলায় ফেলে যেয়ো একটি খোঁপার ফুল
জাগো দুস্তর পথের নব-যাত্রী
ডেকো না আর দূরের প্রিয়া
ভেঙো না ভেঙো না ধ্যান
যাহা কিছু মম আছে প্রিয়তম
মোর বুক-ভরা ছিল আশা
বনে মোর ফুল-ঝরার বেলা
মিলন-রাতের মালা হব তোমার অলকে
যায় ঝিল্মিল্ ঝিল্মিল্ ঢেউ তুলে
কাজরী গাহিয়া চল গোপ-ললনা
এবং তরুণ-তমাল-বরণ এস শ্যামল আমার।
গীতি শতদল
এই গ্রন্থটির প্রকাশক ছিলেন ডি এম লাইব্রেরি। ৮+১০৪ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য ছিল দেড় টাকা। প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৩৪ সালের এপ্রিলে (১৩৪১ বঙ্গাব্দের বৈশাখ)। নজরুল ইসলাম এই গ্রন্থের প্রারম্ভে ‘দুটি কথা’ শীর্ষক ভূমিকায় লেখেন “গীতিশতদলে’র সমস্ত গানগুলিই গ্রামোফোন ও স্বদেশী মেগাফোন কোম্পানীর রেকর্ডে রেখাবদ্ধ হইয়া গিয়াছে। আমার বহু গীতি-শিল্পী বন্ধুর কল্যাণে ‘রেডিও’ প্রভৃতিতে গীত হওয়ায় এই গানগুলি ইতোমধ্যে জনপ্রিয় হইয়া উঠিয়াছে। এই অবসরে তাঁহাদের সকলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিতেছি।... আমার বুলবুল প্রভৃতি গানের বইয়ের মত “গীতিশতদল”-ও সকলকে আকর্ষণে সমর্থ হইলে নিজেকে ধন্য মনে করিব।”
এই গ্রন্থে মোট ১০১টি গান ছিল। যে গানগুলো স্থান পায় সেগুলো হল:
শুকনো পাতার নূপুর পায়ে
চমকে চমকে ধীর ভীরু পায়
ছন্দের বন্যা হরিণী অরণ্যা
পলাশ ফুলের মউ পিয়ে
এস বসন্তের রাজা হে আমার
তুমি নন্দন-পথ-ভোলা
তোমার ফুলের মতন মন
হেসে হেসে কল্সি নাচাইয়া
ঘুমায়েছে ফুল পথের ধুলায়
গত রজনীর কথা পড়ে মনে
পলাশ ফুলের গেলাস ভরি
রহি রহি কেন আজো
পিউ পিউ বোলে পাপিয়া
চাঁদের পিয়ালাতে আজি
এস শারদ প্রাতের পথিক
মালঞ্চে আজ কাহার যাওয়া আসা
সবুজ শোভার ঢেউ খেলে যায়
আমার দেওয়া ব্যথা ভোলা
হুল ফুটিয়ে গেলে শুধু
গোধূলির রং ছড়ালে
সকরুণ নয়নে চাহে
বাজিছে বাঁশির কার
বন-হরিণীর তব বাঁকা আঁখির
রেশমি চূড়ির তালে
সেই পুরানো সুরে আবার
ধীরে যায় ফিরে ফিরে চায়
পিয়াসী প্রাণ তারে চায়
বেলা পড়ে এল
এল ফুলের মহলে ভোমরা
ফিরে ফিরে দ্বারে আসে যায়
আজও ফোটেনি কুঞ্জে
পলাশ মঞ্জরি পরায়ে দে লো
এ ঘোর-শ্রাবণ-নিশি
দিও ফুলদল বিছায়ে
অবুঝ মোর আঁখি-বারি
উচাটন মন ঘরে রয় না
ফিরে গেছে সই
ছাড় ছাড় আঁচল বঁধু
কুল রাখ না রাখ
ফিরিয়া এস এস হে
আঁধি ঘুম-ঘুম
সেদিনো প্রভাতে
জাগো জাগো রে মুসাফির
কত জনম যাবে
হায় ঝরে যায়
এ কোথায় আসিলে হায়
ভুল করে আসিয়াছি
ভোলো প্রিয় ভোলো ভোলো
আমি যেদিন রইব না গো
এলে যে গো চির-সাথী
ও তুই যাস্নে রাই কিশোরী
দুঃখ ক্লেশ শোক
ভোলো অতীত-স্মৃতি
চির-কিশোর মুরলীধর
সাগর আমায় ডাক দিয়েছে
ভালোবেসে অবশেষে
এস নূপুর বাজাইয়া
রাস-মাঞ্চাপরি দোলে মুরলীধর
নাচিয়া নাচিয়া এস
নাচে ঐ আনন্দে
তোমারে কি দিয়া পূজি
আমার নয়নে কৃষ্ণ
মন লহ নিতি নাম
তোমার সৃষ্টি মাঝে হরি
দাও দাও দরশন
নাচিছে নট-নাথ
বাজিয়ে বাঁশি মনের বনে
বিজন গোঠে কে রাখাল
আজি নন্দ দুলালের সাথে
শোনো লো বাঁশিতে
হেলে দূলে বাঁকা কানাইয়া
মণি-মঞ্জীর বাজে
ফিরে যা সখি ফিরে যা ঘরে
আনন্দ দুলালী ব্রজবালার সনে
গুঞ্জ-মালা গলে
মোর মাধব শূন্য মাধবী কুঞ্জে
ব্রজের দুলাল ব্রজে আবার
সখি যায়নি তো শ্যাম মথুরায়
নমো নটনাথ
ভবের এই পাশা খেলায়
ভুবনে ভুবনে আজি
অসুর- বাড়ির ফেরৎ এ মা
আজি প্রথম মাধবী ফুটিল কুঞ্জে
জাগো যোগমায়া জাগো মৃন্ময়ী
হোরির রঙ লাগে
বহু পথে বৃথা ফিরিয়াছি প্রভু
জাগো জাগো! নব আলোকে
পরান হরিয়াছিলে পাশরিয়া
নবীন বসন্তের রানী তুমি
আজি মিলন-বাসর
ওরে হুলোরে তুই রাত বিরেতে
নিয়ে কাদা মাটির তাল
আজকে হোরি ও নাগরী
আচ লাচনের লেগেচে যে গাঁদি
চায়ের পিয়াসী পিপাসিত চিত আমারা চাতক দল
গিন্নির ভাই গান গাহে
নথ-দন্ত-বিহীন
নমো নমঃ আবু আর হাবু
এবং একে একে সব
বুলবুল
বিখ্যাত নজরুলগীতি সংকলন বুলবুল ১৫ নভেম্বর ১৯২৮ (আশ্বিন, ১৩৩৫) তারিখে (১ম সংস্করণ) প্রকাশিত হয়। প্রকাশক ডি এম লাইব্রেরি, কলকাতা। সুরশিল্পী দিলীপ কুমার রায়কে এই গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল। সাধারণ সংস্করণ ও রাজ সংস্করণের মূল্য ছিল যথাক্রমে এক টাকা ও পাঁচ সিকা। গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসে। ৪৯টি গান ছিল এই সংস্করণে।
১৩৫২ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (মে, ১৯৫৯) প্রমীলা নজরুল ইসলাম ১৬, রাজেন্দ্রলাল স্ট্রিট, কলিকাতা-৬, এই বুলবুল (২য় খণ্ড) নামীয় সঙ্গীত গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। গ্রন্থটির পরিবেশক ছিলেন ডি এম লাইব্রেরি। মূল্য আড়াই টাকা। গ্রন্থটিতে গান ছিল ১০১টি। কবি-পত্নী প্রমীলা নজরুল ইসলাম প্রকাশিকার ভূমিকায় লেখেন, “কবির আধুনিক গানগুলি সংকলন করে “বুলবুল” (২য়) প্রকাশ করা হলো। তাড়াতাড়ি প্রকাশ করার জন্য ছাপায় কিছু ভুল থেকে গেছে। পরবর্তী সংস্করণে আশা করি কোনো ভুল থাকবে না। বইটির শেষ পৃষ্ঠায় কিছু সংশোধন করে দেওয়া হয়েছে। এই গানের বইটির আরেকটি বিশেষত্ব এই যে, এর মধ্যে কবির আধুনিক অপ্রকাশিত কতকগুলি গান আমরা দিতে পেরেছি। নজরুলগীতি যাঁরা ভালোবাসেন তাদের কাছে এই বইটি সমাদর পেলে, আমি আমার প্রথম প্রচেষ্টাকে সার্থক বলে মনে করবো।”[4]
এই গ্রন্থটির প্রকাশক গ্রেট ইস্টার্ন লাইব্রেরি। প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২৭ জুন ১৯৩৩ (১৩৪০ বঙ্গাব্দ) মূল্য এক টাকা। কবি গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন স্বদেশী মেগাফোন-রেকর্ড কোম্পানির স্বত্বাধিকারী অন্তরতম বন্ধু জিতেন্দ্রনাথ ঘোষ মহাশয়কে। গ্রন্থের প্রারম্ভে কাজী নজরুল ইসলাম ‘দুটি কথায়’ লেখেন, "দুই-চারিটি ছাড়া ‘গুল-বাগিচা’র গানগুলি ‘স্বদেশী মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানী’ রেকর্ড করিয়াছেন। তাঁহাদের এই অনুগ্রহের জন্য আমি অশেষ ঋণী। ‘গুল-বাগিচা’য় ঠুংরী, গজল দাদরা, চৈতী, কাজরী, স্বদেশী, কীর্তন, ভাটিয়ালি, ইসলামী ধর্মসঙ্গীত প্রভৃতি বিভিন্ন ঢং-এর গান দেওয়া হইল। আমার সৌভাগ্যবশত প্রায় সমস্ত গান গুলি ইতিমধ্যে লোকপ্রিয় হইয়া উঠিয়াছে।... আমার অন্যান্য গানের বই-এর মত ‘গুল-বাগিচা’ও সমাদর লাভ করিবে-আসা করি।"
এই গ্রন্থে মোট ৮৮টি গান ছিল। যে গানগুলো ছিল সেগুলো হল;
গুল-বাগিচার বুলবুলি আমি
সোনার মেয়ে; সোনার মেয়ে! গুল-বাগিচা
বকুল চাঁপার বনে কে মোর
আঁখি-বারি আঁখিতে থাক
থাক ব্যথ হৃদয়ে
ভুল করে কোন ফুলবিতানে
পথ চলিতে যদি চকিতে
কেন ফোটে কেন কুসুম ঝরে ঝরে যায়
তোমার কুসুম বনে আমি আসিয়াছি ভুলে
কত কথা ছিল বলিবার বলা হল না
বুকে তোমায় নাই বা পেলাম
বৃথা তুই কাহার পরে করিস্ অভিমান
পিয়া পাপিয়া পিয়া বোলে
চোখের নেশার ভালবাসা সে কি কভু থাকে গো
এ কুঞ্জে পথ ভুলি কোন বুলবুলি আজ
কোন কুসুমে তোমায় আমি
পরো পরো চৈতালী-সাঁঝে কুসমী শাড়ি
ঝুমকো-লতার চিকন পাতায়
বরষ মাস যায় -সে নাহি আসে
আমার বিজন ঘরে হেসে এল পথিক মুসফির-বেশে
ভেঙো না ভেঙো বঁধু তরণ চামেলি-শাখা
আসিলে কে গো বিদেশী
এসো বঁধু ফিরে এসো, ভোলো ভোলো অভিমান
নাহি কেহ আমার ব্যথার সাথী
মাধবী-লতার আজি মিলন সখি
আজি এ বাদল দিনে
বাদল বায়ে মোর নিভিয়া গেছে বাতি
মেঘের হিন্দোলা দেয় পুব-হাওয়াতে দোলা
সাধ জাগে মনে পরজীবনে
আঁচলে হংস-মিথুন আঁকা
অচেনা সুরে অজানা পথিক
হেরি আজ শূন্য নিখিল
কত কথা ছিল তোমায় বলিতে
তুমি বর্ষায়-ঝরা চম্পা
অঝোর ধারায় বর্ষা ঝরে সঘন তিমির রাতে
একলা ভাসাই গানের কমল সুরের রাতে
তোমার আকাশে উঠেছিনু চাঁদ
দুলিবি কে আয় মেঘের দোলায়
কোন দূরে ও কে যায় চলে যায়
রিমিঝিম্ রিমিঝিম্ ঐ নামিল দেয়া
পাষাণ গিরির বাঁধন টুটে
শেষ হল মোর ও জীবনে ফুল ফোটাবার পালা
কাঁদিছে তিমির-কুন্তলা সাঁজ
আসে রজনী, সন্ধ্যামণির প্রদীপ জ্বলে
আজি কুসুম-দীপালি জ্বলিছে বনে
দোপাটি লো, লো করবী, নাই সুরভি, রূপ আছে
বাসন্তী রং শাড়ি পরো
এস এস রস-লোক-বিহারী
তোমাদের দান তোমাদের বাণী
যেন ফিরে না যায় এসে আজ
মদির আবেশে কে চলে ঢুলু ঢুলু - আঁখি
নাচে সুনীল দরিয়া, আজি দিল-দরিয়া
মহুয়া ফুলের মদির বাসে
দুপুরবেলাতে একলা পথে
শিউলি-তলায় ভোরবেলায়
যৌবন-সিন্ধু টলমল টলমল
চারু চপল পায়ে যায় যুবতী গোরী
দুধে আলতায় রং যেন তার সোনার অঙ্গ ছেয়ে
আমার ভাঙা নায়ের বৈঠা ঠেলে
বনে চলে বনমালী বনমালা দুলায়ে
ঘন-ঘোর-মেঘ-ঘেরা দুর্দিনে ঘনশ্যাম
মোর পুষ্প-পাগল মাধবী-কুঞ্জে
মনে যে মোর মনের ঠাকুর
এই দেহেরই রঙমহলায়
হে চির-সুন্দর, বিশ্ব-চরাচর
উভয়ে কপোত-কপোতী উড়িয়া বেড়াই
এ কোথায় - আসিলে হায় তৃষিত ভিখারি
চম্পক-বরণী টলমল তরণী
শিউলি ফুলের মালা দোলে
স্বদেশ আমার! জানি না তোমার
স্বপ্নে দেখেছি ভারত-জননী
দুরন্ত দুর্মদ প্রাণ অফুরান
জগতে আজিকে যারা আগে চলে ভয়-হারা
আমার দেশের মাটি
গঙ্গা সিন্ধু নর্মদা কাবেরী যমুনা ঐ।
এই গ্রন্থের ইসলামি গানগুলো হলো:
এল শোকের সেই মোহর্রম কারাবালার স্মৃতি লয়ে
বহিছে সাহারায় শোকের “লু” হাওয়া
ঈদজ্জোহার চাঁদ হাসে ঐ
তওফিক দাও খোদা ইস্লামে
সাহারাতে ডেকেছে আজ বান, দেখে যা
উম্মত আমি গুনাহগার
ফিরি পথে পথে মজ্নু দীওয়ানা হয়ে।
ভুবন-জয়ী তোরা কি হায় সেই মুসলমান
বাজিছে দামামা, বাঁধরে আমামা
খোদার হবিব হলেন নাজেল
মরহাবা সৈয়দে মক্কী মদানী আল-আরবী
মোহাম্মদ মুস্তফা সাল্লে আলা
তোমারি প্রকাশ মহান।
চন্দ্রবিন্দু
ডি এম লাইব্রেরি থেকে চন্দ্রবিন্দু' গ্রন্থটি ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে (১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বর) চন্দ্রবিন্দু প্রথম প্রকাশিত হয়। মূল্য ছিল দুই টাকা। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছিল এই লিখে: "পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীমদ্দাঠাকুর শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র পণ্ডিত মহাশয়ের শ্রীচরণকমলে"। স্বীয় পুত্র বুলবুলের মৃত্যুর পর নজরুল তার প্রধানত; হাস্যরসাত্মক ‘চন্দ্রবিন্দু’ সংগীত গ্রন্থের প্রায় সব গান রচনা করেন। নিদারুণ শোকাচ্ছন্ন মতে তার হাস্যরস সৃষ্টির ক্ষমতা বিস্ময়কর। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ অক্টোবর এই বইটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ৩০ নভেম্বর গ্রন্থটির উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলে ১৩৫২ বঙ্গাব্দের ফল্গুনে (১৯৪৬) নূর লাইব্রেরি থেকে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। তখন বইটির মূল্য রাখা হয় সাড়ে তিন টাকা। এই সঙ্গীত গ্রন্থের ১৮টি গান নজরুলের হাসির গান হিসেবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। হাসির গানগুলির মধ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনাসম্পন্ন দেশাত্মবোধক তীব্র ব্যঙ্গপ্রধান চিন্তা প্রকাশ পেয়েছে।
চোখের চাতক প্রধানত গজল গানের বই গ্রন্থটি। প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২১ ডিসেম্বর (অগ্রহায়ণ ১৩৩৬)। প্রকাশক ছিলেন ডি এম লাইব্রেরি। পৃষ্ঠা ৬+৬৫। মূল্য ছিল এক টাকা ও রাজ সংস্করণ পাঁচ সিকা। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছিল কল্যাণীয়া বীণা-কণ্ঠী প্রতিভা সোমকে যিনি পরবর্তীকালে সুসাহিত্যিক প্রতিভা বসু নামে খ্যাত।
মোট ৫৩ টি গান আছে এই গ্রন্থে। গজলগুলি হলো:
আমার কোন কুলে আজ ভিড়ল তরী
কাঁদিতে এসেছি আপনারে লয়ে
ছাড়িতে পরান নাহি চায়
কে তুমি দূরের সাথী
আজি এ শ্রাবণ-নিশি কাটে কেমনে
আজি বাদল ঝরে মোর একেলা ঘরে
মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর
কেউ ভোলে না কেউ ভোলে
যাও যাও তুমি ফিরে
ফাগুন-রাতের ফুলের নেশায়
নিশীথ-স্বপন তোর ভুলে যা
ঘোর তিমির ছাইল
দারুণ পিপাসায় মায়া মরীচিকায়
এত কথা কি গো কহিতে জানে
মন কেন উদাসে
আমার গহীন জলের নদী
তোমায় কুলে তুলে বন্ধু
আমার ‘সাম্পান’ যাত্রী না লয়
ওরে মাঝি ভাই
কেন প্রাণ ওঠে কাঁদিয়া
আঁধার রাতে কে গো একেলা
কি হবে লাল পাল তুলে ভাই
ভাঙা মন আর জোড়া নাহি চায়
আমার দুখের বন্ধু, তোমার কাছে
আমি কি সুখে লো গৃহে রব
ফুল-কিশোরী! জাগো জাগো
জাগো জাগো পোহাল রাতি
কে এলো
এলে কি শ্যামল পিয়া কাজল মেঘে
জনম জনম গেল আশা-পথ চাহি
কেন নিশি কাটালি অভিমানে
পেয়ে কেন নাহি পাই হৃদয়ে মম
আসিলে কে অতিথি সাঁঝে
না মিটিতে সাধ মোর নিশি পোহায়
পর- জনমে দেখা হবে প্রিয়
বনে বনে দোলা লাগে
কে ডাকিল আমারে আঁখি তুলে
ঘেরিয়া গগন মেঘ আসে
দুলে চরাচর হিন্দোল-দোলে
‘হিন্দোলি’ ওঠে নীল সিন্ধু
ওগো সুন্দর আমার!
জাগো জাগো, খোলো গো আঁখি
বাজায়ে জল চুড়ি কিঙ্কিণী
পরদেশী বঁধু! ঘুম ভাঙায়ো চুমি আঁখি
ঝরিছে অঝোর বরষার বারি
চল সখি জল নিতে চল ত্বরিতে
কার বাঁশির বাজে মুলতান-সুরে
মোর ধেয়ানে মোর স্বপনে
নাইয়া, কর পার!
মাধবীতলে চল মাধবিকা-দল
বৃন্দাবনে এ কি বাঁশিরি বাজে
নিশীথ জাগি গোঁয়ানু রাতি
দেখা দাও, দাও দেখা, ওগো দেবতা।
মহুয়ার গান
১৫ টি গানে সমৃদ্ধ এই মহুয়ার গান নামীয় নজরুলগীতি গ্রন্থটি ডি এম লাইব্রেরি থেকে ১ জানুয়ারি ১৯৩০ প্রকাশিত হয়। মোট পৃষ্ঠা ছিল ১৩। মূল্য ছিল দুই আনা।
এ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত গানগুলো হলো:
কে দিল খোঁপাতে ধুতুরা ফুল লো
একডালি ফুলে ওরে সাজাব কেমন করে
বউ কথা কও
কত খুঁজিলাম নীল কুমুদ তোরে
কোথা চাঁদ আমার
ফণীর ফণায় জ্বলে মণি
মহুল গাছে ফুল ফুটেছে
আজি ঘুম নহে, নিশি জাগরণ
খোলো খোলো গো দুয়ার
ভরিয়া পরান শুনিতেছি গান
(ওগো) নতুন নেশার আমার এ মদ
মোরা ছিনু একেলা, হইনু দুজন
ও ভাই আমার এ নাও যাত্রী না লয়
আমার গহীন জলে নদী
তোমায় কুলে তুলে বন্ধু আমি নামলাম জলে
রাঙা-জবা
১০০টি শ্যামাসঙ্গীতে সমৃদ্ধ রাঙা-জবা গ্রন্থটি প্রকাশ করেন ২৪ পরগনার রাজীবপুরের বেগম মরিয়ম আজিজ। গ্রন্থটির প্রথম প্রকাশ ১ বৈশাখ ১৩৭৩ শুক্রবার (এপ্রিল, ১৯৬৬)। মূল্য তিন টাকা। নজরুল নিজের জীবনে তন্ত্র ও যোগাসাধনা করেছেন। শক্তিপূজায় তার ভক্তহৃদয়ের অকৃত্রিম আকুলতা ও আর্তি এইসব গানের মধ্যে রূপায়িত।
রাঙা-জবা গ্রন্থটিতে যে সকল শ্যামাসঙ্গীত আছে সেগুলো হলো:
বলে রে জবা বল
মহাকালের কোলে এসে
ভুল করেছি ওমা শ্যামা বনের পশু বলি দিয়ে
তোর কালো রূপ লুকাতে মা বৃথাই আয়োজন
(ওমা) দুঃখ অভাব ঋণ যত মোর
(আমায়)আর কতদিন মহামায়া
ফিরিয়ে দে মা ফিরিয়ে দে গো
মোরে আঘাত যত হানবি শ্যামা
এস আনন্দিতা ত্রিলোক-বন্দিতা
ওরে আলয়ে আজ মহালয়া, মা এসেছে ঘর
কে বলে মোর মাকে কালো
মা গো আমি তান্ত্রিক নই
মা গো তোমার অসীম মাধুরী
কে পরালো মুন্ডামালা
নাচে রে মোর কালো মেয়ে
আনন্দের আনন্দ
মা এসেছে মা এসেছে
দেখে যারে রুদ্রাণী মা
মাতল গগন অঙ্গন ঐ
শ্মশানকালীর নাম শুনে
মা হবি না মেয়ে হবি
মা গো আজো বেঁচে তোরি প্রসাদ পেয়ে
দুর্গতিনাশিনী আমার
যে নামে মা ডেকেছিল সুরথ আর শ্রীমন্ত তোরে
পরম পুরুষ সিদ্ধ-যোগী মাতৃভক্ত যুগাবতার
জয় বিবেকানন্দ বীর সন্ন্যাসী
আমার হৃদয় অধিক রাঙা মা গো
মায়ের চেয়েও শান্তিময়ী
কেঁদো না কেঁদো না মাকে কে বলেছে কালো
তুই পাষাণ গিরির মেয়ে হলি
মা গো আমি মন্দমতি
শক্তের তুই ভক্ত শ্যামা
মা গো আমি আর কি ভুলি
ওমা নির্গুণেরে প্রসাদ দিতে
আমায় যারা দেয় মা ব্যথা, আমায় যারা আঘাত করে
করুণা তোর জানি মা গো
আয় নেচে আয় এ বুকে
আজও মা তোর পাইনি প্রসাদ
কোথায় গেলি মা গো আমার
মা কবে তোরে পারব দিতে
জগৎ জুড়ে জাল ফেলেছিস্
কালী কালী মন্ত্র জপি
আদরিণী মোর শ্যামা মেয়ে রে
শ্যামা তোর নাম যার জপমালা
আমি নামের নেশায় শিশুর মত (ওমা) বক্ষে ধরেন শিব যে চরণ
রক্ষা-কালির রক্ষা-কবচ আছে আমায় ঘিরে
(আমার) মুক্তি নিয়ে কি হবে মা
(মায়ের) অসীম রূপ-সিন্ধুতে রে
(আমার) কালো মেয়ে পালিয়ে বেড়ায়
জাগো যোগমায়া জাগো মৃন্ময়ী
অসুর বাড়ির ফেরৎ এ মা
আঁধার ভীত এ চিত যাচে মা গো আলো আলো
মা তোর চরণ-কমল ঘিরে
আয় মা চঞ্চলা মুক্তকেশী শ্যামা কালী
শ্মশানে জাগিছে শ্যামা
আয় অশুচি আয় রে পতিত
দীনের হতে দীন দুঃখী অধম যথা থাকে
(মা) এক্লা ঘরে ডাকব না আর
(তুই) বলহীনের বোঝা বহিস্ যেথায় ভৃত্য হয়ে
কেন আমায় আনলি মা গো মহারানীর সিন্ধুকূলে
ভাগীরথীর ধারার মত সুধার সাগর পড়–ক ঝরে
মা গো তোরি পায়ের নূপুর রাজে
জ্যোতির্ময়ী মা এসেছে আঁধার আঙিনায়
তোর কালো রূপ দেখতে মা গো
বল্ মা শ্যামা বল্ তোর বিগ্রহ কি মায়া জানে
মাকে ভাসায়ে জলে কেমনে রহিব ঘরে
কে সাজালো মাকে আমার
(আমার) আনন্দিনী উমা আজো
আমার উমা কই
গিরিরাজ সংসারেই দোলনাতে মা
মহবিদ্য আদ্যাশাক্তি
প্রণমামি শ্রীদুর্গে নারায়ণী
নন্দলোক থেকে আমি এনেছি রে
মায়ের আমার রূপ দেখে যা
নিপীড়িতা পৃথিবী ডাকে
মোরে আঘাত যত হানবি শ্যামা
কেন আমায় আনলি মা গো মহাবাণী সিন্ধুকূলে
আয় বিজয়া আয় রে জয়া
সর্বনাশি! মেখে এলি এ কোন চুলোর ছাই
আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে
শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে
মা ত্রিনয়নী! সেই চোখ দে
মা! আমি তোর অন্ধ ছেলে
আমার শ্যামা বড় লাজুক মেয়ে
আমার মা আছে রে সকল নামে
ওমা তোর ভুবনে জ্বলে এত আলো
ওমা তুই আমারে ছেড়ে আছিস
আমার মানস-বনে ফুটেছে রে শ্যামা লতার মঞ্জরী
শ্যামা নামের লাগল আগুন আমার দেহ-ধূপকাঠিতে
ওমা খড়্গ নিয়ে মাতিস রণে
আমার হৃদয় হবে রাঙা জবা
দেহ বিল্বদল
যে কালীর চরণ পায় রে
তোরই নামের কবচ দোলে
মাতৃ নামের হোমের শিখা
আয় মা ডাকাত কালী আমার ঘরে কর ডাকাতি
আমি মুক্তা নিতে আসিনি মা
আমি সাধ করে মোর গৌরী মেয়ের
আমর ভবের অভাব লয় হয়েছে
থির হয়ে তুই বস দেখি মা।
সুরমুকুর
সুরমুকুর মুখ্যত একটি স্বরলিপি সংকলন। এই গ্রন্থে ২৭টি নজরুলগীতির স্বরলিপি আছে। স্বরলিপিকার নলিনীকান্ত সরকার। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে (আশ্বিন ১৩৪১) ডি এম লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। বইটির পৃষ্ঠাসংখ্যা ২+২৮।
এ গ্রন্থে যে সকল নজরুলীতির স্বরলিপি আছে সেগুলো হলো:
দুর্গম গিরি-কান্তার মরু
কোথা চাঁদ আমার
নিশি ভোর হ’ল জাগিয়া
করুণ কেন অরুণ আঁখি
সখি বোলো বঁধুয়ারে
এ আঁখিজল মোছ পিয়া
কেমনে রাখি আঁখিবারি
দুরন্ত বায়ু পুরবইয়াঁ
ভুলি কেমনে আজো
বসিয়া বিজনে কেন একা মনে
ছাড়িতে পরান নাহি চায়
কেন দিলে এ কাঁটা যদি গো
সাজিয়াছ যোগী বল কার লাগি
বউ কথা কও বউ কথা কও
এ নহে বিলাস বন্ধু; মুসাফির
মোছরে আঁখিজল
কোন সুদুরের চেনা বাঁশির
মোরা ছিনু একেলা
পথিক ওগো চলতে পথে
এত জল ও কাজল চোখে
রে অবোধ! শূন্য শুধু
তরুণ প্রেমিক! প্রণয়-বেদন
বেসুর বীণায় ব্যথার সুরে
আজি বাদল ঝরে
পর জনমে দেখা হবে প্রিয়
আমার সাম্পান যাত্রী না লয়
ডুবু ডুবু ধর্ম্ম-তরী
সুরসাকী
সুরসাকী গ্রন্থটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে (আষাঢ় ১৩৩৯)। প্রকাশক কালীকৃষ্ণ চক্রবর্তী, চক্রবর্তী অ্যান্ড সন্স। মূল্য ছিল দেড় টাকা। মোট পৃষ্ঠা ছিল ৮+১০৪। গানের সংখ্যা ৯৭। সমৃদ্ধ সঙ্গীত গ্রন্থটি। দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩৬১ বঙ্গাব্দের আশ্বিনে (১৯৫৪)। প্রকাশিকা প্রমীলা নজরুল ইসলাম। এই সংস্করণে দুটি গান যুক্ত হয় যথা:-; গানের সংখ্যা দঁড়ায় ৯৯-এ।
এ গ্রন্থের গানগুলি হল:
গানগুলি মোর আহত পাখির সম
প্রিয় তুমি কোথায় আজি
বিদায়-সন্ধ্যা আসিল ঐ
আজি গানে গানে ঢাকব
কত সে জনম কত সে লোক
কে দুয়ারে এলে মোর
কত আর এ মন্দির-দ্বার
কে পাঠালে লিপির দূতী
ফুল-ফাগুনের এল মরসুম
আমার নয়নে নয়ন রাখি
নিরালা কানন-পথে
এল ফুলের সরসুম
প্রিয় তব গলে দোলে
ছল ছল নয়নে মোর
আনো সাকি শিরাজী
হেনে গেল তীর
গোলার ফুলের কাঁটা
আজি দোল-ফাগুনের
হৃদয় কেন চাহে হৃদয়
আজি শেফালির গায়ে হলুদ
শূন্য আজি গুল-বাগিচা
সই ভাল করে বিনোদ বেণী
পায়ে বিঁধেছে কাঁটা
ঢলঢল তব নয়ন-কমল
তোমার আঁখির কসম সাকি
বিরহের গুলবাগে মোর
ভুলিতে পারিনে তাই
যে ব্যথায় এ অন্তর-তল নিশিদিন
সখি লো তায় আন ডেকে
হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে
ডেকে ডেকে কেন সখি
ঐ ঘর-ভুলানো সুরে
আকুল হলি কেন বকুর
আনমনে জল নিতে
আয় গোপিনী খেলবি হোরি
চাঁপা রঙের শাড়ি
শ্যামের সাথে
আজকে দোলের হিন্দোলায়
চাদিনী রাতে কানন-সভাতে
একেলা গোরী জলকে চলে
পিয়া গেছে কবে পরদেশ
সখি ঐ শোনো বাঁশি বাজে
বিরহের নিশি কিছুতে আর
ঢের কেঁদেছি ঢের সেধেছি
সে চলে গেছে বলে
এ জনমে মোদের মিলন
হায় স্মরণে আসে গো
নদী এই মিনতি তোমার কাছে
ও কুল-ভাঙ্গা নদী রে
কুঁচ-বরণ কন্যারে
এস মা ভারত-জননী দুঃখ- সাগর মন্থন শেষ
বাজায়ে কাচের চুড়ি
মন কার কথা ভেবে
আমি কেন হেরিলাম
না মিটিতে মনোসাধ
তুমি কোন্ পথে এলে
যে ব্যথায় এ অন্তর-তল হে প্রিয়
থাক সুন্দর ভুল আমার
এ কি সুরে তুমি গান
আজিকে তনু-মনে লেগেছে রং
আজি দোল-ফাগুনের দোল
কাহার তরে হায় নিশিদিন
সামলে চলো পিছল পথ
আমার সোনার হিন্দুস্থান
আমার শ্যামলা রবণ বাঙলা
লক্ষ্মী মা তুই আয় গো
সাত ভাই চম্পা জাগো রে
গেরুয়া রঙ মেঠো পথে
তোরা যা লো সখি মথুরাতে
জাগো শ্যামা জাগো শ্যামা
বিজলি চাহনি কাজল কালো
ক্ষ্যাপা হাওয়াতে মোর
মোর হৃদি-ব্যথার
সাগর হতে চুরি
সুরের ধারার পাগল ঝোরা
নাচন লাগে ঐ তরুলতায়
দিল দোলা দিল দোলা
মা ষষ্ঠী গো, তোর গুষ্টির
হিন্দু-মোসলমান দুই ভাই
মোরা একবৃন্তে দুটি কুসুম
মানবতাহীন ভারত-শ্মশানে
উদার-ভারত!
ত্রিংশ কোটি তব সন্তান
আজ ভারতের নব আগমনী
নাইয়া! ধীরে চালাও তরণী
প্রিয়ার চেয়ে শালি ভালো
কেরানী আর গরুর কাঁধ
শা আর শুঁড়ি মিলে
তোমায় আমায় ও প্রেয়সী
ছিটাইয়া ঝাল নুন এ ফাল্গুন
কহ প্রিয়ে, কেমনে এ রাতি
বুকের ভিতর জ্বলছে আগুন
একি হার-ভাঙা শীত এল মামা
আমি দেখন-হাসি
রাম-ছাগী গায় চতুরঙ্গ
আমার হরি-নামে রুচি
সে যে হারাইয়া গেছে
সামলে চলো পিছল পথে।
নজরুল গীতিকা
নজরুল গীতিকা গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে।[5] এই বইয়ে ১২৭টি গান ছিলো। এ গ্রন্থে জাতীয় সংগীত, ঠুংরী, হাসির গান, গজল, ধ্রুপদ, কীর্ত্তন, বাউল, ভাটিয়ালী, টপ্পা এবং খেয়াল সহ বিভিন্ন ধরনের গান সন্নিবেশিত হয়েছে। নজরুল গীতিকা গ্রন্থের কয়েকটি গান নজরুল রচিত "বনগীতি" সহ অন্য গ্রন্থেও পাওয়া যায়।
সন্ধ্যা কাব্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে। এই বইয়ের সবগুলো গান নয়, দুয়েকটি গান থাকলেও এটি মূলত কবিতা গ্রন্থ। ২৪টি কবিতা আর গান নিয়েই এই গ্রন্থ। বাংলাদেশের রণ সংগীত “চল্ চল্ চল্, উর্ধ গগণে বাজে মাদল” এই বই থেকে নেয়া হয়েছে।
বনগীতি
৭১ টি গান নিয়ে বনগীতি গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে। [5] গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছিলো ভারতের অন্যতম সংগীত কলা-বিদ জমীরুদ্দিন খানকে। উৎসর্গ করার সুচনা-গানটি সহ মোট গানের সংখ্যা ৭২টি।
বনগীতি-গ্রন্থে গ্রন্থিত গানসমূহ হলো:
তুমি বাদশা গানের তখতে (এটি উৎসর্গ-গান)
ভালোবাসার ছলে আমায়
কে নিবি ফুল কে নিবি ফুল
পেয়ে আমি হারিয়েছি গো
সখি বাঁধো লো বাঁধো লো ঝুলনিয়া
যায় ঢুলে ঢুলে এলোচুলে
যমুনা-সিনানে
নদীর নাম সই অঞ্জনা
আল্গা কর গো খোঁপার বাঁধন
পথ ভোলা কোন রাখাল ছেলে
কোকিল, সাধিলি কি বাদ
পান্সে জোছ্নাতে কে
ঝল্মল্ জরিন বেণী
কোন বন হতে করেছো চুরি
নিশীথ হয়ে আসে ভোর
কেমনে কহি প্রিয়
নমঃ নমঃ নমঃ বাঙলাদেশ মম
প্রিয় যাই যাই বলো না
ভোল লাজ ভোল গ্লানি জননী
রুমু রুম ঝুম
পদ্মদীঘির ধারে ঐ
দিতে এলে ফুল- হে প্রিয়
কে এলে মোর চির-চেনা অতিথি
দোলে নিতি নব রুপের ঢেউ পাথার
এলে কি বধুঁ ফুল-ভবনে
হে বিধাতা! দুঃখ শোক মাঝে তোমারি পরশ বাজে
পাষানের ভাঙালে ঘুম কে তুমি সোনার ছোঁয়ায়
বলো না বলো না ওলো সই
মরম-কথা গেল সই মরমে মরে
চল মন আনন্দ ধাম
এস হৃদি রাস মন্দিরে এস
আমার সকলি হরেছ হরি
যমুনা-কুলে মধুর মধুর মুরলি সখি বাজিল
কুসুম সুকুমার শ্যামল তনু
কোথায় তুই খুঁজিস ভগবান
কেঁদে যায় দখিণ হাওয়া
মেরো না আমারে আর নয়ন বাণে
হেলে দুলে নীর-ভরণে ও কে যায়
বনে মোর ফুটেছে হেনা চামেলি যুথী বেলি
ও দুখের বন্ধুরে, ছেড়ে কোথায় গেলি
আমি ডুরি-ছেঁড়া ঘুড়ির মতন
তুমি ফুল আমি সুতো
মন নিয়ে আমি লুকোচুরি খেলা খেলি প্রিয়ে
ভালোবাসায় বাঁধব বাসা
মোর মন ছুটে যায় দ্বাপর যুগে
চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়
দেখে যা তোরা নদীয়ায়
কালা এত ভাল কি হে কদম গাছের তলা
জবাকুসুম-সঙ্কাশ ঐ অরুণোদয়
মাধব বংশীধারী বনওয়ারী গোঠ-চারী
আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়
শ্যামা তুই বেদেনীর মেয়ে
জয় বাণী বিদ্যাদায়ীনী
রোদনে তোর বোধন বাজে
তুমি দুখের বেশে এলে বলে
ওহে রাখাল রাজ!
ধ্যান ধরি কিসে হে গুর
আর লুকাবি কোথায় মা কালী
আমি ভাই ক্ষ্যাপা বাউল
ও মা ফিরে এলে কানাই মোদের
পথে পথে কে বাজিয়ে চলে বাঁশি
ও মন চল অকূল পানে
এস মুরলীধারী বৃন্দাবন-চারী
নূপুর মধুর রুনুঝুনু বোলে
হে গোবিন্দ ও অরবিন্দ
ফিরে আয় ভাই গোঠে কানাই
সুন্দর বেশে মৃত্যু আমার
রাখ রাখ রাঙা পায়
মোরে সেই রুপে দেখা দাও হে হরি
হৃদয়-সরসী দুলালে পরশি
রাখ এ মিনতি ত্রিভুবন-পতি
প্রণমি তোমায় বন-দেবতা
জুলফিকার
১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে ২৪টি গান নিয়ে প্রকাশিত হয় জুলফিকার গ্রন্থটি।[5]