মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
ইতিহাসের বিভিন্ন দিক / From Wikipedia, the free encyclopedia
আনুমানিক ১৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে স্থানীয় আদিবাসী আমেরিকানদের উত্তর আমেরিকার ভূখন্ডে আগমনের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস শুরু হয়। সেখানে অনেক স্থানীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল যার অধিকাংশ ষোলশতকের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যায়। ১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে সেখানে ইউরোপিয় ঔপনিবেশিক যুগের শুরু হয়। আমেরিকা মহাদেশের বেশীরভাগ উপনিবেশ ১৬০০ সালের পরে গড়ে উঠেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র উপনিবেশ যাদের উৎপত্তির বিস্তারিত বিবরণ সংরক্ষণ করা হয়েছে। [lower-alpha 1] ১৭৬০ সালে উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলে ২.৫ মিলিয়ন জনসংখ্যা নিয়ে তেরটি বৃটিশ কলোনি স্থাপিত হয়েছিল। ফ্রান্স ইন্ডিয়ান যুদ্ধে জয়লাভের পর বৃটিশ সরকার উপনিবেশের উপর বেশ কিছু কর ধার্য করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে প্রতিবাদ শুরু হয়। ১৭৭৩ সালে বোষ্টন টি পার্টির প্রতিবাদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আন্দোলন দমনের জন্য বৃটিশ পার্লামেন্ট বিশেষ আইন পাশ করে। পরবর্তিতে ১৭৭৫ সালে এই আন্দোলন এক রক্তক্ষয়ি সংঘর্ষে রূপ নেয়। তবে সেখানের জনসংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে এবং তার চেয়েও বেশি হারে বৃদ্ধি পায় সেখানের অর্থনীতির আকার। ১৯৪০ সালের পূর্ব পর্যন্ত শান্তিকালিন সময়ে যুক্তরাষ্ট্র তখনো কোন উল্লেখযোগ্য সামরিক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেনি।
১৭৭৬ সালে ফিলাডেলফিয়ায় দ্বিতীয় মহাদেশীয় কংগ্রেস (Second Continental Congress) জেনারেল জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে উপনিবেশগুলোর স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে নিজেদেরকে একত্রে “যুক্তরাষ্ট্র” হিসাবে ঘোষণা করে। বিপ্লবী যুদ্ধে তারা জয়লাভ করে। ১৭৮৩ সালে একটি শান্তিচুক্তির মাধ্যমে নতুন রাষ্ট্রগুলোর সীমানা নির্ধারণ করা হয়। কনফেডারেশনের শাসনপন্থা প্রণয়ন করা হয়।[2] সেই সাথে কেন্দ্রে প্রশাসনিক ক্ষমতা ও কর গ্রহণের সক্ষম নয় এমন একটি সীমিত ক্ষমতাসম্পন্ন সরকার গঠন করা হয়। ১৭৮৯ সালে একটি কনভেনশনের মাধ্যমে নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয়। ১৭৯১ সালে তাতে ‘নাগরিক অধিকার’ সংযোজন করা হয়। একই সাথে জর্জ ওয়াশিংটনকে প্রেসিডেন্ট এবং জর্জ হ্যামিলটনকে তার প্রধান পরামর্শদাতা নির্বাচিত করে কেন্দ্রে একটি শক্তিশালী সরকার গঠন করা হয়। ১৮০৩ সালে ফ্রান্সের কাছ থেকে লুজিয়ানা টেরিটরি ক্রয় করার পর যুক্তরাষ্ট্রের আকার দ্বিগুন বৃদ্ধি পায়।
ভাগ্য প্রকাশের (manifest destiny) ধারনায় অনুপ্রাণিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্র আরো পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলের তার ভূখন্ড বিস্তৃত করতে থাকে। ১৭৯০ সালে সুবিশাল ভৌগোলিক এলাকার জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৪ মিলিয়ন। দাস মালিক ও ইয়োমান কৃষকদের জন্য পশ্চিমের শস্তা জমি দেশটির পশ্চিমমূখি সম্প্রসারণের মূল চালিকা শক্তি ছিল। বিতর্কিত দাস প্রথার ব্যাপক বিস্তার ক্রমে অষোন্তস জন্ম দিতে থাকে। এক পর্য়ায়ে রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক যুদ্ধ শুরু হয়। ১৮০৪ সালের মধ্যে মেসন -ডিক্সন লাইনের উত্তরে সমস্ত রাজ্যে দাস প্রথা বিলুপ্ত করা হয়। কিন্তু দক্ষিণে কৃষিকাজে বিশেষ করে তুলা উৎপাদনের জন্য এই প্রথা তখনো চালু ছিল।
১৮৬০ সালে আব্রাহাম লিংকন দাস প্রথার বিস্তাররোধ সমর্থিক একটি প্লাটফর্ম থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। দাসশ্রমের উপর নির্ভরশীল দক্ষিণের সাতটি রাষ্ট্র তখন বিদ্রোহ করে এবং কনফেডারেসির ভিত্তি প্রস্তুত করে। ১৮৬১ সালে একটি ফেডারেল দুর্গে আক্রমণের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ১৮৬৫ সালে কনফেডারেটসের পরাজয়ের পর দাস প্রথার অবসান ঘটে। যুদ্ধ পরবর্তি পুনর্গঠনের সময়, মুক্ত দাসদের আইনগত অধিকার এবং ভোটাধিকার প্রদান করা হয়। কেন্দ্রে একটি শক্তিশালী জাতীয় সরকার গঠন করা হয়। সেই সরকারের মূল দায়িত্ব ছিল সকল নাগরিকের ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষা করা। তবে এরপরে ১৮৭৭ সালে শ্বেতাঙ্গরা যখন দক্ষিণে তাদের ক্ষমতা ফিরে পাবার পর, আধাসামরিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে ‘জিম ক্রো’ আইন পাস করে, একই সাথে নতুন রাষ্ট্রীয় সংবিধানের মাধ্যমে বেশিরভাগ আফ্রিকান আমেরিকান এবং অনেক দরিদ্র শ্বেতাঙ্গদের ভোটাধিকারে বাধা প্রদান করা হয়।
উদ্যোক্তা, শিল্পায়ন এবং লক্ষ লক্ষ অভিবাসী শ্রমিক এবং কৃষকের আগমনের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ শতকের শেষের দিকে বিশ্বের শীর্ষ শিল্প শক্তিতে পরিনত হয়। দেশজুড়ে একটি জাতীয় রেলপথ নেটওয়ার্ক নির্মিত হয় এবং বৃহৎ খনি এবং কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৯০ থেকে ১৯২০ এর দশক পর্যন্ত দুর্নীতি, অদক্ষতা এবং পুরাতন ধারার রাজনীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক অসন্তোষ ও প্রগতিশীল আন্দোলন শুরু হয়। যার ফলে ফেডারেল আয়কর, সিনেটরদের সরাসরি নির্বাচন, মদ নিষিদ্ধকরণ এবং মহিলাদের ভোটাধিকারসহ বেশ কিছু সংস্কার করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দিকে নিরপেক্ষ থাকলেও, ১৯১৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং পরের বছর মিত্র বাহিনীর যুদ্ধে অর্থায়ন করে। ‘সমৃদ্ধ গর্জনশীল বিশ’ (Roaring Twenties) এর পর, ১৯২৯ সালের ওয়াল স্ট্রিট শেয়ার বাজারের ব্যাপক ধ্বস এক দশক যাবত বিশ্বব্যাপী মহামন্দার সূচনা করেছিল। প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট `নিউ ডিল' নামের একটি নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এই কর্মসূচির মধ্যে ছিল, বেকার ও কৃষকদের সহায়তা দান, সামাজিক নিরাপত্তা বা সোসাল সিকিউরিটি এবং সর্বনিম্ন বেতন নির্ধারণ। এই কর্মসূচি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আধুনিক উদারবাদ (Modern liberalism) প্রতিষ্ঠা করেছিল। [3] মার্কিন রণঘাঁটি পার্ল হারবার আক্রান্ত হবার পর ১৯৪১ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে অংশ নিয়ে মিত্র শক্তিকে অর্থ সহায়তা প্রদান করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকা নাৎসী জার্মান ও ইটালির ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পরাস্ত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। যুদ্ধে মার্কিনদের অংশগ্রহণ চূড়ান্ত রূপ পায় যখন তারা জাপান সাম্রাজ্যের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে তাদের নতুন আবিষ্কৃত ‘আনবিক বোমা’ নিক্ষেপ করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল হিসাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্ধী শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হল। স্নায়ু যুদ্ধের সময় এই দুই পরাশক্তি, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, মাহাকাশ, প্রচার প্রচারণা এবং কমিউনিস্ট সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে স্থানীয় যু্দ্ধের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে পরস্পরের বিরুদ্ধে ঠান্ডা যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৯৬০ এর দশকে, প্রবল নাগরিক অধিকার আন্দোলনের প্রভাবে, সামাজিক সংস্কারের আরেকটি দিক, আফ্রিকান আমেরিকান এবং অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের ভোটাধিকার এবং চলাচলের স্বাধীনতার সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর শীতল যুদ্ধের অবসান হয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে একমাত্র পরাশক্তি হিসাবে পরিগনিত হতে থাকে। শীতল যুদ্ধের অবসানের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি মূলতঃ মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব অক্ষুন্ন রাখার বিষয়টি অধিক প্রাধান্য পায়। বিশেষ করে ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক হামলা এবং ইসলামিক স্টেটের মোকাবেলাই তাদের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক নীতিমালার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ২১ শতকের শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি মন্দার কবলে পরে। পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ অতিমারীর কারনে এদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অনেক মন্থর হয়ে পরে।