Loading AI tools
সপ্তম শতাব্দীর আরবের স্বঘোষিত নবী উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
মুসাইলিমা (আরবি: مسيلمة) বা মুসাইলিমা বিন হাবিব (আরবি: مسيلمة بن حبيب) হল সে সকল (মুসাইলিমার ভবিতব্য স্ত্রী সহ) লোকেদের মধ্যে একজন যারা ষষ্ঠ শতকের আরবে নবুয়াতের দাবি করেছিলো। মুসলমানদের কাছে সে একজন ভণ্ড নবী হিসেবে বিবেচিত এবং তারা তাকে সর্বদা আল-কাযযাব (আরবি: الكذّاب) বা মিথ্যাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করেন।[1]
মুসাইলিমার পৈতৃক নাম হল "ইবনে হাবিব আল-হানিফি" যার দ্বারা বোঝা যায় যে সে নজদ প্রদেশে অবস্থিত আরবের অন্যতম বৃহৎ গোত্র বনু হানিফার সদস্য হাবিবের পুত্র ছিল। বনু হানিফা ছিল বনু বকর গোত্রের একটি খ্রিস্টান উপগোত্র, যা ইসলামের আগমনের অনেক পূর্ব থেকেই বিদ্যমান ছিল।
মুসাইলিমা আরবের ইয়ামামা নামক অঞ্চলের ধর্মগুরু ছিল, যেখানে সে মুহাম্মাদের হিজরতের পূর্বেই প্রতিষ্ঠিত হয়। সেসময় সে পূর্ব আরবের একটি বিশাল অংশ নিয়ন্ত্রণ করতো। নবী মুহাম্মাদের থেকেও অধিক বৃহৎ অঞ্চল তার নিয়ন্ত্রণে ছিল।
তার সম্পর্কিত যে বর্ণনাগুলো পাওয়া যায় তার মধ্যে প্রথমটি হল দাওয়াতের বছর হিসেবে খ্যাত ৯ম হিজরিতে, যখন সে তার নিজ গোত্র হতে আগত একটি প্রতিনিধিদলের সাথে মদিনায় আগমণ করে। ওই দলে আরও দুজন প্রসিদ্ধ মুসলিম ছিলো। উক্ত দুইজন পরবর্তীকালে তাদের নিজ গোত্রকে ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করতে মুসাইলিমার উত্থানে এবং প্রভাব বিস্তৃতিতে সাহায্য করেছিলো। এরা হলো নাহার আর-রাজ্জাল বিন উনফুয়া (অথবা রাহাল)[2] এবং মুজা’আ বিন মারারা। মদিনায় বনু নাজ্জার গোত্রের আল হারিস নামক এক আনসারী মহিলার সাহচার্যে উক্ত প্রতিনিধিদলটি অবস্থান করছিলো।
প্রতিনিধিদলটি মদিনায় এসে পৌঁছলে উটগুলোকে একটি ভ্রমণকারীদের ক্যাম্পে বেঁধে রাখা হল এবং মুসাইলিমা উটগুলোর দেখভাল করার জন্য সেখানেই রয়ে গেলো। অন্যান্য প্রতিনিধিগণ দাওয়াত গ্রহণের জন্য প্রস্থান করলেন।
মুহাম্মাদের সাথে তাদের বেশ কিছু কথা হল। বিদায় নেবার আগেই প্রতিনিধিদলটি খ্রিস্টধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করল। অন্যান্য ধর্মান্তরিতদের ন্যায় এদেরকেও মুহাম্মাদ কিছু উপঢৌকন দিলেন। উপঢৌকন নেয়ার সময় তাদের একজন বলে উঠলো, “আমরা আমাদের এক সহযাত্রীকে আমাদের সওয়ারীগুলো দেখভাল করার জন্য ক্যাম্পে রেখে এসেছি।" মুহাম্মাদ তাদেরকে তার জন্যেও উপঢৌকন দিলেন, আর বললেন, “তোমাদের ঐ সঙ্গিটি তোমাদের চাইতে কম মর্যাদার লোক নয় যে, তাকে এখানে না এনে তোমাদের জিনিসপত্র পাহারা দিতে রেখে এসেছ।” ফিরে আসার পর তারা নিজ গোত্র বনু হানিফাকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে। তারা ইয়ামামায় একটি মসজিদ নির্মাণ করে সেখানে নিয়মিত প্রার্থনা শুরু করে।
ইবনে হিশামের রচিত সিরাতেও ইবনে ইসহাকের বর্ণনা থেকে সংগৃহীত উক্ত ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। তবে সেখানে আরও কিছু অংশ যোগ করা হয়েছে। উক্ত রেওয়ায়েতে বলা হয়, তারা ইয়ামামার পৌছা মাত্রই মুসাইলিমা ইসলাম ত্যাগ করলো এবং মিথ্যা নবুওয়াতের দাবী করে বসলো। সে বললো, “তোমারা যখন মুহাম্মাদের নিকট আমার কথা উল্লেখ করেছিলে তখন তিনি কি বলেননি যে, "সে তোমাদের চাইতে কম মর্যাদাশীল নয়।" এ কথা তিনি এ জন্যই বলেছেন যে, আমি যে তার সহকর্মী নবী তা তিনি জানেন।” এরপর সে তাদের কাছে নানা রকমের ছন্দবদ্ধ কথা বলে কুরআনের সাথে সাদৃশ্য প্রমাণ করার চেষ্টা করে। তার এ ধরনের একটি ছন্দবদ্ধ উক্তি হলো,
“আল্লাহ গর্ভবতী মহিলাদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন কেনোনা তিনি তাদের পেট থেকে চলাচল করতে সক্ষম মানুষ বের করেছেন-নাড়ীভুঁড়ি ও তরল পদার্থের মধ্য থেকে।”
এছাড়াও ইবনে হিশামের বর্ণনায় আরেকজনের কাছ থেকে একটি আনুমানিক বর্ণনার উল্লেখ পাওয়া যায়, তা হল বনু হানীফার প্রতিনিধিদল মুসাইলিমাকে কাপড়ে ঢেকে নিয়ে মুহাম্মাদ ও তার সাহাবাদের সাথে বসে ছিলেন। তার হাতে ছিল একটা পাতা-ছাঁটা খেজুরের ডাল। ডালের মাথার দিকে কয়েকটি পাতা ছিল। কাপড়ে আচ্ছাদিত মুসাইলিমা মুহাম্মাদ - এর নিকট পৌছে তার সাথে কথা বললো এবং কিছু দান প্রার্থনা করলো। মুহাম্মাদ বললেন, “তুমি যদি এই খেজুরের ডালটি আমার কাছে চাও তবে তাও আমি দেব না।”
তার দেয়া শিক্ষা বর্তমানে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে তবে দাবেস্তান-এ-মাজাহেব নামক গ্রন্থে সেগুলোর নিরপেক্ষ বর্ণনার উল্লেখ পাওয়া যায়।[3] সে মদ ও শুঁকরের মাংস খেতে নিষেধ করতো, যে কোন দিকে মুখ করে দৈনিক তিনবার ঈশ্বরের উপাসনা করার নির্দেশ দিতো, রমজানের রাতে রোজা রাখার নির্দেশ দিতো এবং খাতনা করাকে অনাবশ্যক বলতো।
মুসাইলিমা একজন দক্ষ জাদুকর হিসেবেও প্রসিদ্ধ ছিলো,[4] সে জনসমারহে জাদু দেখিয়ে মানুষকে তাক লাগিয়ে দিতো। সে বোতলের সরু মুখছিদ্র দিয়ে আস্ত ডিম বোতলের ভেতর ঢুকিয়ে দিতে পারতো; পাখির পালক কেটে তা এমনভাবে আবার জোড়া দিয়ে দিতো যে পাখিটি এরপরও উড়তে পারত। এসব দেখিয়ে সে মানুষকে বলতো যে ঈশ্বর তাকে নবুয়াতের লক্ষণ হিসেবে এ সকল অলৌকিক ক্ষমতা দিয়েছে।
মুসাইলিমা বিভিন্ন উক্তি বলে মানুষের কাছে দাবি করতো যে এইগুলো আল্লাহ তার উপর নাযিল করেছেন এবং আরও দাবি করতো যে মুহাম্মাদ তার সাথে নবুয়াতের দায়িত্ব ভাগাভাগি করেছেন। [2] এমনকি সে নিজেকে "রহমান" বলেও দাবি করতো,[1] এই উদ্দেশ্যে যে মানুষ যাতে মনে করে সে আল্লাহর কাছ থেকে ঐশী গুন লাভ করেছে। ফলশ্রুতিতে, কিছু লোক তাকে মুহাম্মাদের পাশাপাশি আরেকজন নবী হিসেবে গ্রহণ করে। স্বভাবতই মুসাইলিমার প্রভাব ও স্বীকৃতি তার নিজ গোত্রের সহায়তায় বৃদ্ধি পেতে থাকে। মুসাইলিমা তার গোত্রের জন্য মদ ও ব্যভিচার হালাল এবং নামায মাফ করে দেয়।[2] এছাড়াও সে জনসমারহে নিজেকে মুহাম্মাদের ন্যায় রাসুলুল্লাহ উপাধিতে সম্বোধন করতো এবং নিজের মনগড়া কিছু উক্তিকে তার উপর নাযিল হওয়া কুরআনের আয়াত হিসেবে প্রচার করতো। উক্ত উক্তিগুলোর অধিকাংশই ছিল কুরাইশ গোত্রের উপর তার নিজ গোত্র আবু হানিফার শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনাকারী অতিরঞ্জিত প্রশংসায় ভরপুর।
এছাড়াও মুসাইলিমা মুহাম্মাদ কে তার সাথে আরবের উপর কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা ভাগাভাগি করার প্রস্তাব জানায়। ১০ম হিজরির শেষের দিকে সে মুহাম্মাদ কে একটি চিঠিতে লেখে:
“আল্লাহর রাসুল মুসাইলিমার পক্ষ থেকে আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদের নিকট। আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। আমাকে আপনার নবুয়াতের অংশীদার করা হয়েছে। পৃথিবীর অর্ধেকটা আমাদের ভাগে এবং অপর অর্ধেক কুরাইশদের ভাগে। তবে কুরাইশরা সবসময় বাড়াবাড়ি করে থাকে।"
মুহাম্মাদের উত্তরে লিখেন:
“ | ”বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে মিথ্যা দাবিদার মুসাইলিমার প্রতি। যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছ থেকে আগত হেদায়াতের অনুসারী তার উপর সালাম। জেনে রাখো, পৃথিবী সম্পূর্ণই আল্লাহর। তিনি তার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা করেন পৃথিবীর কর্তৃত্ব দান করেন আর আখিরাতের সফলতা তো তাঁদের জন্যই যারা আল্লাহকে ভয় করে।"[5] | ” |
মুহাম্মাদের মৃত্যুর পর রিদ্দার যুদ্ধ নামে খ্যাত স্বধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন চলাকালে সাজাহ বিনতে হারিস নাম্নী এক মহিলা নিজেকে নবী হিসেবে দাবি করে, যখন সে জানতে পারে মুসাইলিমা এবং তুলায়হাও নিজেদের নবী বলে দাবি করেছে।[6] সে চারহাজার লোককে একত্রে সমবেত করে মদিনার অভিমুখে রওয়ানা হয়। আরও কিছু মদিনাবিরোধী লোকও তার সাথে যুক্ত হয়। যাত্রাপথে খালিদ বিন ওয়ালিদের কাছে তুলায়হা'র (আরেক স্বঘোষিত নবুয়াতের দাবিদার) পরাজিত হওয়ার খবর পেলে সাজাহ মদিনা আক্রমণের পরকল্পনা স্থগিত করে।[7] এরপর, সে খালিদের হুমকির মুকাবিলা করার জন্য মুসাইলিমার সহযোগিতা চাইলো। তারা দুজনে একটি প্রাথমিক বোঝাপড়ায় পৌছুতে সক্ষম হলো। এরপর তারা দুজন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হল এবং এবং সাজাহ তার স্বঘোষিত নবুয়াতের দাবিকে মেনে নিলো। ইত্যবসরে খালিদ বিন ওয়ালিদ সাজাহ কর্তৃক সৃষ্ট নবুয়াতের আন্দোলনকে আক্রমণ করে ভেঙ্গে ফেলেন এবং মুসাইলিমাকে আক্রমণ করতে অগ্রসর হন। ইয়ামামার যুদ্ধে মুসাইলিমা ওয়াহশি ইবনে হারব নামের এক ইথিওপীয় সাহাবী কর্তৃক নিহত হয়, যে কিনা মুসাইলিমার হত্যার বিষয়টিকে ইসলাম গ্রহণের পূর্বে উহুদের যুদ্ধে মুহাম্মাদ এর চাচা হামজাকে নিজ হাতে হত্যা করার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে গ্রহণ করেছিল। মুসাইলিমা নিহত হবার পর, সাজাহ ইসলাম গ্রহণ করে ধর্মান্তরিত হয়।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.