Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
রৌপ বিজ্ঞান (ইংরেজি: Formal science) বিজ্ঞানের একটি শাখা যেখানে বিভিন্ন রৌপ ব্যবস্থা যেমন যুক্তিবিজ্ঞান, গণিত, পরিসংখ্যানবিদ্যা, তাত্ত্বিক পরিগণক বিজ্ঞান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, তথ্য তত্ত্ব, ক্রীড়া তত্ত্ব, ব্যবস্থাদি তত্ত্ব, সিদ্ধান্ত তত্ত্ব ও তাত্ত্বিক ভাষাবিজ্ঞান, ইত্যাদি রৌপ ভাষাভিত্তিক শাস্ত্রসমূহ অন্তর্ভুক্ত।[1]
প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের যথাক্রমে ভৌত ব্যবস্থাদি ও সামাজিক ব্যবস্থাদিকে অভিজ্ঞতাবাদী পদ্ধতিসমূহ ব্যবহার করে চরিত্রায়ন করার চেষ্টা করা হয়। এর বিপরীতে রৌপ বিজ্ঞানগুলিতে ভাষিক সরঞ্জাম ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রতীকী ব্যবস্থা দ্বারা বর্ণিত বিমূর্ত কাঠামোসমূহকে চরিত্রায়ন করার চেষ্টা করা হয়।
অভিজ্ঞতাভিত্তিক বিজ্ঞানসমূহে যেখানে আরোহী যুক্তিপাত অবলম্বন করা হয়, সেখানে রৌপ বিজ্ঞানগুলিতে অভিজ্ঞতালব্ধ সাক্ষ্যপ্রমাণ ব্যতিরেকে কেবলমাত্র অবরোহী যুক্তিপাত ব্যবহার করা হয়। এ কারণে রৌপ বিজ্ঞানগুলি হল পূর্বতঃসিদ্ধ কিছু জ্ঞানের শাখা এবং এ জন্য এগুলিকে বিজ্ঞান বলা উচিত কি না, সে ব্যাপারে মতানৈক্য আছে। তবে রৌপ বিজ্ঞানগুলি অভিজ্ঞতাভিত্তিক বিজ্ঞানগুলির কর্মক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং ভৌত ও সামাজিক বিশ্বকে যেসব কাঠামো দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়, সেগুলি নির্মাণে সহায়তা করে।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সূত্রায়নের অনেক আগেই রৌপ বিজ্ঞানের যাত্রা শুরু হয়। গণিত বিষয়ক সবচেয়ে প্রাচীন রচনাগুলি আনুমানিক ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে (ব্যাবিলনীয় গণিত), ১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে (মিশরীয় গণিত) ও ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে (ভারতীয় গণিত) রচিত হয়েছিল। এর পরে আরও অন্যান্য সংস্কৃতি যেমন গ্রিক গণিত, মধ্যযুগীয় ইসলামি পর্বের গণিত (আরব ও পারসিক), ইত্যাদি গণিতে বহু গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এছাড়া এগুলির বাইরে চীনা গণিত ও জাপানি গণিতের নিজস্ব ঐতিহ্যও গড়ে ওঠে।
গণিতশাস্ত্রের পাশাপাশি যুক্তিবিজ্ঞান হল সবচেয়ে প্রাচীন রৌপ বিজ্ঞানগুলির একটি উদাহরণ। যুক্তিপাতের বিভিন্ন পদ্ধতির সুস্পষ্ট বিশ্লেষণকারী এই শাস্ত্রটি তিনটি ভৌগোলিক অবস্থানে দীর্ঘদিন ধরে বিকাশ লাভ করে; এগুলি হল ভারতবর্ষ (খ্রিস্টপূরব ৬ষ্ঠ শতক থেকে), চীন (খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতক থেকে) এবং গ্রিস (খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতক থেকে)।[2] আধুনিক যুক্তিবিজ্ঞানের পরিশীলিত রূপটি গ্রিক ঐতিহ্য থেকে উৎসারিত হয়েছে; এর শুরু হয়েছিল আরিস্তোতলীয় যুক্তিবিজ্ঞান থেকে, যা পরবর্তীতে মধ্যযুগে এসে ইসলামী যুক্তিবিজ্ঞানীদের দ্বারা আরও বিকাশপ্রাপ্ত হয়। ভারতীয় যুক্তিবিজ্ঞানের ঐতিহ্যটিও প্রাথমিক আধুনিক যুগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। চীনের যুক্তিবিজ্ঞানের ঐতিহ্যটি প্রাচীন যুগের পরে আর বিকাশ লাভ করেনি, তবে ভারতীয় যুক্তিবিজ্ঞানের বিভিন্ন ধ্যানধারণা মধ্যযুগীয় চীনে গ্রহণ করা হয়েছিল।
বর্তমান যুগে প্রচলিত বেশ কিছু রৌপ বিজ্ঞান গণিতের উপর গভীরভাবে নির্ভরশীল। তাই গণিত আপেক্ষিকভাবে একটি উন্নত স্তরে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত এগুলির অস্তিত্ব ছিল না। খ্রিস্টীয় ১৭শ শতকে পিয়ের দ্য ফের্মা ও ব্লেজ পাস্কাল (১৬৫৪) এবং ক্রিস্টিয়ান হাইখেনস সম্ভাবনা তত্ত্বের সবচেয়ে প্রথম দিককার গবেষণা শুরু করেন। ১৯শ শতকের শেষভাগে ১৮৮০-র দশকে গাউস ও লাপ্লাস পরিসংখ্যানবিদ্যার গাণিতিক তত্ত্বটি নির্মাণ করেন। এই সময়েই পাশ্চাত্যের বীমা প্রতিষ্ঠান ও সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলিতে হিসাবরক্ষণে পরিসংখ্যানের ব্যবহার শুরু হয়। ২০শ শতকের শুরুতে এসে গাণিতিক পরিসংখ্যান একটি গাণিতিক শাস্ত্র তথা রৌপ বিজ্ঞান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
২০শ শতকের মধ্যভাগে এসে দুইটি বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সামরিক গণিতের পরিধি আরও বৃদ্ধিলাভ করে ও ঋদ্ধ হতে শুরু করে, যার কারণ বেশ কিছু নতুন গাণিতিক বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের শাখার উদয়, যেমন অভিযান গবেষণা ও ব্যবস্থাদি প্রকৌশল। এই বিজ্ঞানগুলি প্রথমে তড়িৎ প্রকৌশলের মৌলিক গবেষণা ও পরবর্তীতে বৈদ্যুতিক পরিগণনের বিকাশ থেকে লাভবান হয়, যা আবার তথ্য তত্ত্ব, সাংখ্যিক বিশ্লেষণ (বৈজ্ঞানিক পরিগণন) ও তাত্ত্বিক পরিগণক বিজ্ঞানের বিকাশে ভূমিকা রাখে। তাত্ত্বিক পরিগণক বিজ্ঞান গাণিতিক যুক্তিবিজ্ঞান ও এর অন্তর্ভুক্ত পরিগণনার তত্ত্ব থেকেও লাভবান হয়।
রৌপ বিজ্ঞানের শাখাগুলির মধ্যে যুক্তিবিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র, পরিসংখ্যানবিদ্যা, তাত্ত্বিক পরিগণক বিজ্ঞান (কম্পিউটার বিজ্ঞান), তথ্য বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাদি বিজ্ঞান উল্লেখ্য।
যে একটি কারণে গণিতশাস্ত্র অন্য সব বিজ্ঞানের চেয়ে বেশি মর্যাদা উপভোগ করে, তা হল এই যে গণিতের সূত্রগুলি পরমভাবে নিশ্চিত ও অবিতর্কিত, অন্যদিকে অন্যান্য বিজ্ঞানের সূত্রগুলি কিছুটা হলেও বিতর্কের যোগ্য এবং সবসময়ই নতুন আবিষ্কৃত বাস্তব ঘটনাভিত্তিক তথ্য দ্বারা এগুলি উৎখাত হবার আশঙ্কা থেকে যায়।
অভিজ্ঞতাভিত্তিক প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের বিপরীতে রৌপ বিজ্ঞানসমূহে কোনও অভিজ্ঞতাভিত্তিক কর্মপদ্ধতি ব্যবহার করা হয় না। অধিকন্তু এগুলিতে বাস্তব ঘটনাচক্রজাত তথ্যের জ্ঞানের পূর্বানুমান অপরিহার্য নয় এবং এগুলি বাস্তব বিশ্বকে বর্ণনা করে না। এই দিক থেকে রৌপ বিজ্ঞানগুলি যুক্তিগতভাবে ও পদ্ধতিগতভাবে উভয়ভাবেই "পূর্বতঃসিদ্ধ", কেননা এগুলির বিষয়বস্তু ও বৈধতা যেকোনও ধরনের অভিজ্ঞতাভিত্তিক পদ্ধতি অপেক্ষা স্বাধীন। একারণে রৌপ বিজ্ঞানগুলি ঠিক "বিজ্ঞান" নয়। এগুলি হল রৌপ যুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থা যার বিষয়বস্তুর লক্ষ্য অভিজ্ঞতালব্ধ বাস্তবতার অংশবিশেষ, যেমন তথ্য ও চিন্তা। রৌপ বিজ্ঞান একটি পদ্ধতি যা বিজ্ঞানের জন্য উপকারী, কিন্তু এটি দ্বারা বিজ্ঞানকে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয়।
যদিও রৌপ বিজ্ঞানগুলি অভিজ্ঞতাভিত্তিক বিষয়বস্তুবিহীন ধারণামূলক কিছু ব্যবস্থা, তার মানে এই নয় যে এগুলির সাথে বাস্তব বিশ্বের কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু তাদের এই সম্পর্ক এমন যে রৌপ বিজ্ঞানগুলির রৌপ বিবৃতিগুলি সমস্ত সম্ভাব্য কল্পনাসাধ্য বিশ্বের জন্য সত্য, অন্যদিকে অভিজ্ঞতালব্ধ তত্ত্বভিত্তিক বিবৃতিগুলি (যেমন সাধারণ আপেক্ষিকতা বা বিবর্তনমূলক জীববিজ্ঞান) সমস্ত সম্ভাব্য বিশ্বের জন্য সত্য নয় এবং ঘটনাক্রমে আমাদের বর্তমান বিশ্বের জন্যও সম্পূর্ণ সত্য বা বৈধ বলে প্রমাণিত না-ও হতে পারে। এই কারণেই রৌপ বিজ্ঞানগুলি জ্ঞানের সমস্ত ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য এবং সমস্ত অভিজ্ঞতাভিত্তিক বিজ্ঞানের জন্য উপকারী।
অ-অভিজ্ঞতাভিত্তিক প্রকৃতির কারণে রৌপ বিজ্ঞানগুলিকে কতগুলি স্বতঃসিদ্ধ ও সংজ্ঞার সাহায়ে নির্মাণ করা হয়, যেগুলি থেকে অন্যান্য বিবৃতিতে (উপপাদ্য) অবরোহী পদ্ধতিতে উপনীত হওয়া যায়। এই কারণে রুডলফ কার্নাপ বিজ্ঞানের জ্ঞানতত্ত্বের যে যৌক্তিক দৃষ্টবাদী কল্পনাটি করেছিলেন, সেটি অনুযায়ী রৌপ বিজ্ঞানগুলির অন্তর্ভুক্ত উপপাদ্য বা তত্ত্বগুলিতে কোনও সংশ্লেষণী বিবৃতি নেই, বরং এগুলির সমস্ত বিবৃতিই বিশ্লেষণী প্রকৃতির।[4][5]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.