Loading AI tools
উনিশ শতকে দক্ষিণ ভারতে উদ্ভুত হিন্দু সম্প্রদায় উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
আয়াবালি (তামিল: அய்யாவழி, মালয়ালম: അയ്യാവഴി, প্রতিবর্ণী. Ayyāvaḻi, আক্ষ. অনু. গুরুর পথ) হল উনিশ শতকে দক্ষিণ ভারতে উদ্ভুত হিন্দু সম্প্রদায়।[1]
আয়া বৈকুন্দরের জীবনদর্শন ও ধর্মপ্রচার কেন্দ্রিক আয়াবালি ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ আকিলাথিরাত্তু আম্মানাই এবং আরুল নূল। আয়া বৈকুন্দর ছিলেন নারায়ণের পূর্ণ অবতার।[2] হিন্দুধর্মের সাথে আয়াবালি’র বিশ্বাস এবং অনুশীলনগত অনেক ধারণার সাদৃশ্যতা আছে, কিন্তু ভালো-মন্দ এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। ধর্ম ভিত্তিক হওয়ার কারণে আয়াবালিকে একটি ধর্মীয় বিশ্বাস হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়।
আয়াবালি উনিশ শতকে হিন্দু সম্প্রদায় হিসেবে সর্ব প্রথম জনসাধারণের নজরে আসে।[3] আয়াবালি নারায়ণ গুরু[4] এবং রামালিঙ্গ স্বামীগাল সহ বেশ কয়েকটি সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত করে।[5] আয়া বৈকুন্দরের কার্যক্রম এবং অনুসারীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা ১৯ শতকের ট্রাভাঙ্কোরিয়ান [6] এবং তামিল সমাজে ব্যাপক বৈপ্লবিক সংস্কার সাধন করে,[7] দক্ষিণ ভারতের তৎকালীন সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে অবাক করে দেয়।
আয়াবালি অনুসারীরা সমগ্র ভারত জুড়ে ছড়িয়ে থাকলেও মূলত দক্ষিণ ভারতে সংখ্যাধিকভাবে,[8] বিশেষ করে তামিলনাড়ু এবং কেরালায় অধিক সংখ্যক বসবাস করে।[9] আদমশুমারির সময় আয়াবালিদের হিন্দু হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়[10] তাই অনুসারীদের সঠিক সংখ্যা অজানা। তারপরও সংখ্যায় ৮,০০০,০০০ থেকে ১০,০০০,০০[11] ধারনা করা হয়।
তামিল ভাষায় আয়া মানে 'গুরু' এবং ওয়াজি/বালি, 'পথ'; সরল অনুবাদ হল "গুরুর পথ" বা 'পিতার পথ'[12] যদিও তামিল ভাষায় একই শব্দগুচ্ছের শব্দার্থ অনেকসময় বিভিন্ন তত্ত্বের অর্থ প্রকাশ করে।[13][14][15] শুরুর দিকে আয়াবালি ধর্মের বিপুল সংখ্যক অনুসারীদের বৈকুন্দর (ঐতিহাসিকভাবে "মুদিসুদুম পেরুমল" নামে পরিচিত) (১৮০৯- সে. ১৮৫১)[16] পুওভান্দনথোপে জমায়েতগত ভাবে উপাসনা করতে দেখা যায়।[17] সমাজের প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীদের[17] অংশগ্রহনে ১৮৪০ সালের থুভায়াল থাভাসু (ধোয়ার তপস্যা) নামক একটি বিকল্প ধর্মীয়-সংস্কার ভিত্তিক উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্য দিয়ে আয়াবালি ধর্মের উৎপত্তি।[18] সমাজের প্রান্তিক ও দরিদ্র অনুসারীরা একটি স্বতন্ত্র এবং স্বায়ত্তশাসিত সমাজ হিসাবে কাজ করতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে তারা 'আয়া বালি' শব্দগুচ্ছ কে তাদের পাথেয় করে নেয়। অনুসারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল নাদার বর্ণের, তবে অন্যান্য বর্ণের বিপুল সংখ্যক লোকও এটিকে পালন করে।[19] ১৯ শতকের মাঝামাঝি খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকদের রিপোর্টে প্রথম শতক জুড়ে আয়বালির দ্রুত বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।[20]
১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, আয়াবালি দক্ষিণ ট্রাভাঙ্কোর এবং দক্ষিণ তিরুনেলভেলি অঞ্চলে একটি জনপ্রিয় ও স্বীকৃত ধর্ম হিসেবে প্রসার লাভ করে।[21] ১৮৪০ সাল থেকে অনুসারীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।[17] ১৯ শতকের শেষের দিকে স্বামীথোপকে আয়াবালির ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। বৈকুন্দরের সময়কালের পরে তার শিক্ষার মাধ্যমে আয়াবালি ছড়িয়ে পড়ে। পাঁচজন বীজবপক, বৈকুন্দরের শিষ্য এবং তাদের বংশধরেরা দেশের বিভিন্ন স্থানে আয়াবালি’র মতাদর্শ প্রচার করে।[22] পায়ান রাজবংশ স্বামীথোপ্পে পাথির শাসনকার্য শুরু করায় অন্যান্য পাথিরা আয়া অনুসারীদের শাসনের অধীনে আসে।[23] আকিলাত্তিরাত্তু আম্মানাই (আকিলাম) এর নির্দেশ অনুসরণ করে উপাসনা এবং ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়নের জন্য সারা দেশে নিঝল থাঙ্গাল (ছোট প্যাগোডা) প্রতিষ্ঠিত হয়।[24]
আয়াবালি ধর্মের অন্যতম ধর্মগ্রন্থ আরুল নূল ১৯২৭ সালে ছাপায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। লেখ্যরুপে লিপিবদ্ধ থাকার প্রায় এক শতাব্দী পরে ১৯৩৩ সালে আকিলম ধর্মগ্রন্থ হিসেবে ছাপায় প্রকাশিত হয়েছিল। আকিলম প্রকাশের পর থেকে পূর্বেকার মৌখিকভাবে প্রচলিত আচার রীতি পরিত্যাগ করে ধর্মশ্রাস্ত্র নির্ভয় হয়। আয়াবালি সদর দপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে আয়াবালি ভারতের স্বাধীনতা লাভের (১৯৪০-এর দশক) পরে দ্রুত এবং ১৯৯০-এর দশকে দ্রুততর ভাবে ছড়িয়ে পড়ে।[25] বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে আয়াবালি-ভিত্তিক অনেক সমাজকল্যাণ সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।[26] কিছু বিতর্কিত সংস্করণ সহ আকিলমের বেশ কয়েকটি বিকল্প সংস্করণ এই সময়েই প্রকাশিত হয়।[27] আনবুক্কোদিমাক্কল থিরুচ্চাবাই নামক একটি গণতান্ত্রিক ব্যুরো ১৯৯০ দশকের গোড়ার দিকে ধর্মকে সুসংগঠিতভাবে পরিচালনার জন্য ধর্মীয় সদর দফতর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। মুম্বাই, চেন্নাই এবং তিরুবনন্তপুরম সহ দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন শহরে সাংগঠনিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।[25]
আয়াবালির ধর্মের দ্রুত প্রচার লাভ দেখে ১৯৯৪ সালে কন্যাকুমারী জেলার, ২০০৬ সালে তিরুনেলভেলি এবং তুতিকোরিন জেলাগুলোর রাজ্য প্রশাসন আয়া বৈকুন্দরের আবির্ভাব দিবসকে আয়া বৈকুন্দ অবতারম নামে ছুটি হিসেবে ঘোষণা করে।[28] ২০১২ সালে সমগ্র তামিলনাড়ু রাজ্যে এবং ২০১৫ সাল থেকে কেরালা রাজ্যে বৈকুন্দ অবতারম কে সীমাবদ্ধ ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়।[29] পায়ান রাজবংশের উত্তরাধিকারী বালা প্রজাপতি আদিকালার কে আয়াবালির বর্তমান সময়ের নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।[30]
আয়াবালির পবিত্র বইগুলো হলঃ আকিলাত্তিরাত্তু আম্মানাই (সাধারণত আকিলাম নামে পরিচিত)[31] এবং আরুল নূল যা ধর্মীয় পুরাণের উৎস। নারায়ণ তার স্ত্রী লক্ষ্মীর কাছে আকিলমের বিষয়বস্তু যেভাবে মুখে বলেছিলেন তা শুনে সেভাবে ১৮৪১ সালে হরি গোপালন সীদার আকিলত্তিরত্তু আম্মানাই লিপিবদ্ধ করে ছিলেন।[32] পৌরাণিক ঘটনা ছাড়াও আকিলম থেকে ব্যাপক পরিমাণ বিশেষ করে দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি এবং শেষের দিককার ঐতিহাসিক তথ্য জানা যায়।
পরবর্তীতে সৃষ্ট সংস্করন পূর্ববর্তী সংস্করনগুলো, যেমন স্বামীথোপ সংস্করণ, কোটাঙ্গাডু সংস্করণ এবং পাঁচালঙ্কুরিচি সংস্করণ। এ সংস্করনগুলো আকিলমের প্রাচীনতম বিদ্যমান তাল-পাতার সংস্করণ[33] কে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে ধারনা করা হয়। অন্যান্য প্রকাশিত সংস্করণের মধ্যে রয়েছে সেন্ট্রাথিসাই ভেনট্রাপেরুমাল, বিবেকানন্দন, ভিটিভি এবং পালারামচন্দ্রন সংস্করণ। সংস্করনগুলোর মাঝে ভিটিভি অত্যন্ত সমালোচিত।[33] প্রাচীনতম এবং সাধারণভাবে গৃহীত সংস্করণ হলো পালারামচন্দ্রন সংস্করণ ।[33] আকিলমে সতেরোটি বিভাগে ১৫,০০০ এরও বেশি বানী রয়েছে। এটি গীতিনাট্য আকারে কাব্যিক তামিল ভাষায় এবং অনন্য আক্ষরিক-শৈলীর সাথে দুটি উপশৈলী, বিরুত্তম এবং নাতাই জুড়ে রচিত।
আয়াবালি ধর্মের দ্বিতীয় প্রধান ধর্মগ্রন্থ হলো তামিল ভাষায় সংকলিত আরুল নূল। বিশ্বাস করা হয় যে এটি অরুলারকাল (একটি ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী) দ্বারা লেখা।[34][35] এটিতে প্রার্থনা, স্তোত্র এবং ধর্মীয় উপাসনা পালনের নির্দেশাবলী রয়েছে। সেইসাথে আচার-অনুষ্ঠান ভবিষ্যদ্বাণী এবং রীতিনীতির বিশদ আলোচনা রয়েছে।[34] ভাইকুন্দরের জীবন সম্পর্কিত আকিলামে পাওয়া যায় এমন অনেক ঘটনাও আরুল নূলে রয়েছে।[36]
আয়াবালি ভক্তদের কাছে, সাতটি পবিত্র স্থান রয়েছে যাদের প্রত্যেকটিকে এক একটি পাথি বলা হয়।[37] পাথিগুলোর মধ্যে পাঁচটি পাথি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।[38] এদেরকে পঞ্চপাথি বলে।
পঞ্চপাথির পাঁচটি পাথি হল:
যদিও ভাকাইপাথি সদর দফতরের দ্বারা পঞ্চপাথির অন্তর্ভুক্ত নয় তবুও এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পাথি হিসাবে বিবেচনা করা হয়।[39][40] বৈকুন্দ পাথি এবং অবথারা পাথির মতো আরও কিছু পাথির পবিত্রতা নিয়ে আয়াবালির অনুসারীদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। আয়াবালির সদর দপ্তর কর্তৃক ঘোষিত পাথির তালিকায় এই পাথিদের অন্তর্ভুক্তি নেই।[41]
প্রতীক হলো আকিলম-ভিত্তিক দর্শনের আদর্শিক সারাংশ। আয়াবালি ধর্মের প্রতীক হলঃ একটি শিখা আকৃতির সাদা নামাম বহনকারী পদ্ম।[42] এই প্রতীকটি ২০ শতকের মাঝামাঝি থেকে ব্যবহার করা হচ্ছে। পদ্মের ১,০০৮ টি পাপড়ি সহস্রারা’র (তামিল, লাদামে প্রচলিত) রুপক পরিচিয় বহন করে আর নামাম আন্মা জ্যোতি বা আত্মা র স্বরুপকে রুপায়িত করে।[42] আয়াবালির প্রধান ধর্মগ্রন্থের উভয়েই প্রতীকের শীর্ষে উপস্থিত অংশে সরাসরি পদ্মকে নয় থিরুনামাম নামক "শিখা-আকৃতির প্রতীক" কে বলা হয়েছে।[43]
আকিলমের পৌরাণিক বর্ণনায় দার্শনিকভাবে আটটি চক্রের মাধ্যমে আট যুগ সম্পর্কে রুপক বর্ণনা পাওয়া যায়।[44] প্রথম চক্র নীতিয়া ইউকাম হল বিন্দু এবং শেষ অবস্থা আর ধর্ম ইউকাম হল সহস্রারা বা পরম সুখ। জ্ঞান চক্রের নিজের চেতনার শক্তি (নামাম) এর আহবানে, বিন্দু (নীতিয়া ইউকাম) থেকে চূড়ান্ত সহস্রারায় (ধর্ম ইউকাম) আরোহন করতে হয়। ধর্মীয় জীবনে সর্বোচ্চ প্রাপ্তি হলো- পরম "আনন্দ" অনুভব যা শিখা-আকৃতির প্রতীক পদ্ম দ্বারা প্রতীকে রুপায়িত।[45]
ধর্মের চূড়ান্ত রুপ ইউকাম (সহস্রারা) এর নিয়ন্ত্রন ক্ষমতা হল ইকাম, যা বৈকুন্দর ত্রিমূর্তি ধারণার একটি অংশ, বা পরম বস্তুর পরমতার প্রকাশ।[42]
আকিলম থেকে আয়াবালির প্রতীক সম্পর্কে যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে প্রতীকের "তিরুনামামের সাথে পদ্ম" প্রকাশ করে "সহস্রারায় বৈকুন্দর জ্ঞানী" রুপ কে।
কিছু হিন্দু ধর্মগ্রন্থে, সহস্রারা চক্রে ১০০০টি পাপড়ি রয়েছে।[46] কিন্তু আয়াবালি প্রতীকবাদে সহস্রারায় ১০০৮ টি পাপড়ি রয়েছে।[44] আয়াবালির কোনও শাস্ত্রগ্রন্থে ১০০০-এর অস্তিত্ব নেই তবে ১০০৮ সংখ্যাটির সাধারণ উল্লেখ আছে। এছাড়াও, বৈকুন্দরের আবির্ভাবের বছর হল মালায়ালাম যুগ অনুযায়ী ১০০৮। কাণ্ডবিহীন পদ্ম প্রতীক দ্বারা সহস্রারা কে চিহ্নিত করা হয়েছে।
নিঝল থাঙ্গাল নির্মাণের মাধ্যমে আয়াবালি স্থাপত্য বিকশিত হয়েছিল, যেখানে ছাদ ঢেকে দেয়ার জন্য সহস্রারার উল্টানো পদ্মফুল ব্যবহার করা হয়েছিল।[47] যেখানে পদ্ম হৃদয় এবং শিখা আকার (থিরুনামাম) দেবত্বের প্রতিনিধিত্ব করে।[48] বৈষ্ণব 'ত্রিপল নামাম' (বর্তমানে ব্যবহৃত হয় না) এবং শঙ্খ সহ অন্যান্য প্রতীক আয়াবালি ধর্মে ব্যবহার করা হয়েছে।
আয়াবালি শিক্ষার মৌলিক বিষয়ের অধিকাংশই আকিলাত্তিরাত্তু আম্মানাই বইতে পাওয়া যায় এবং অন্যান্য শিক্ষাগুলো অজানা লেখকদের দ্বারা লিখিত বিভিন্ন বই থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে এবং আরুল নূলে সংগৃহীত রয়েছে।[49] ধর্মের মতো আয়াবালির অন্যান্য শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়গুলো হলো দ্বিমুখীতা বিষয়ক, সমাজতাত্ত্বিক এবং আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কিত। আধ্যাত্মিকর শিক্ষাগুলো ঐশ্বরিক জ্ঞান লাভের জন্য পালনীয়, সামাজিক শিক্ষাগুলো মূলত সমাজে বৈষম্য এবং বৈষম্য দূর করার সাথে সম্পর্কিত। শিক্ষাগুলো ভয়ের উপর নয়, প্রেমের উপর ভিত্তি করে ঈশ্বরের সাথে একটি ইতিবাচক সম্পর্ককে উত্সাহিত করে। অনুসারীদেরকে ঈশ্বরের প্রতি তাদের ঘনিষ্ঠতা এবং স্নেহ জোরদার করার জন্য 'আয়া', "পিতা", হিসেবে সম্বোধিত করার জন্য আহবান করা হয়।[50]
আয়াবালি আধ্যাত্মিকরা সর্বোচ্চ একত্বের উপর মনোনিবেশ করেন।[51] এর বিভিন্নতার মধ্যে, ধর্মতত্ত্ব সর্বদা একত্বের উপর এই মনঃসংযোগ বজায় রাখে। কালীর প্রেতাত্বা ব্যাক্তির আত্মা এবং পরমব্রহ্মান্ডের মধ্যে প্রচলিত চরম একত্বতাকে বাধা দেয়, এদের মধ্যে দূরাত্মা এবং অহম (অহংকার) [52] ভাবনা সৃষ্টি করে। এমন ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি একত্বতা থেকে বিচ্ছিন্নতার আপাত অনুভূতি সৃষ্টি করে এবং একত্বতার বিরুদ্ধে চলতে উদ্বুদ্ধ করে। ইকাম [53]- "অতি-আত্মা" বা পরমাত্মা -কে সমগ্র অস্তিত্ব, প্রকৃতিতে পরিবর্তনহীন এবং সর্বব্যাপী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। অশুভ শক্তি মায়ার কারণে এটি "স্থান এবং সময়ের সাথে বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়"।[54]
ইকাম হলো পরম চেতনা যা থেকে সমস্ত সৃষ্টি বিকশিত হয়েছে। ইকামের সমস্ত গুণাবলী প্রতিটি আত্মার মধ্যে নিহিত থাকে এবং তা থেকে বিকশিত হয়। প্রতিটি ব্যক্তি আত্মা হল প্রতিফলন[55] [আত্ম-প্রকাশিত উৎস] বা পরম সত্ত্বার দর্পন স্বরুপ। মানব এবং অন্যান্য সমস্ত আত্মা কালীর প্রেতাত্মা দ্বারা বাধাগ্রস্ত করে এবং সীমাবদ্ধ করে । এই কারণেই ব্যক্তি আত্মা পরম সুখ লাভ করতে সক্ষম হয় না, এবং তাই ইকামের কাছে পরাজিত হয়ে যায়। আত্মা একবার যদি মায়ার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারে, তবে এটি ইকামের সাথে একত্ব হয়ে যায়। এর স্বকীয়তা লোপ পায় এবং এর ফলে এটি ইকামে পরিনত হয়। অন্যদিকে পরম চেতনাকে পরমাত্মা (অতি আত্মা) হিসাবে মূর্তমান করা হয়েছে ঈশ্বর রুপে "স্বামী", অন্য সমস্ত আত্মা হল তাঁর "পত্নী", থিরুকল্যানা একানাই দ্বারা প্রতীকী, যেখানে বৈকুন্দর পৃথক আত্মাকে বরন করেন। এছাড়াও, আয়াবালি দর্শনে মানব এবং মহাবিশ্বের বাকি সৃষ্টির জন্য একটি সাধারণ তত্ত্ব প্রয়োগ করে। বাহ্যিকভাবে যা কিছু আছে বিশ্বব্রহ্মান্ডে তা মানুষের কাছেও তা অভ্যন্তরীণভাবে আছে।
আয়াবালি তার সামাজিক শিক্ষায় বর্ণ বৈষম্যের স্পষ্ট নিন্দা করে। এটি বর্ণ বৈষম্য বরং জাতিগত বিদ্বেষ বৈষম্যকে নিন্দা করে।[56]
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আয়াবালি দ্বিগুণভাবে সামাজিক সংস্কারের একটি ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করেছে, বিশেষ করে ত্রাভাঙ্কোর এলাকায়, যেটি আগে তার শক্তিশালী বর্ণপ্রথার জন্য পরিচিত ছিল।[57] এই প্রেক্ষাপটে আয়াবালি কেন্দ্রগুলো বর্ণবৈষম্য মুক্ত সমাজ রূপান্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।[58] আয়া বৈকুন্দরই প্রথম[59] যিনি একজন সমাজ সংস্কারক হিসেবে সফল হন[60] দেশে রাজনৈতিক সংগ্রাম[61], সামাজিক নবজাগরণ [62][63][64] পাশাপাশি ধর্মীয় সংস্কার [65][66] শুরু করেন। বৈকুন্দর ছিলেন তামিলনাড়ু[67] এবং কেরালার সামাজিক বিপ্লবীদের পথপ্রদর্শক।[68] গবেষকগণ বৈকুন্দরকে শিক্ষক, নিরাময়কারী এবং একজন অলৌকিক কর্মী হিসাবে বিবেচনা করেন।[69] তিনি ভারতের সমস্ত সমাজ সংস্কারকদের অগ্রদূতও বলা হয়।[70] আকিলম শ্রমজীবী শ্রেণীর প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করে এবং প্রায়ই অতিরিক্ত ট্যাক্সের বিরোধিতা করে যা তারা দিতে বাধ্য হয়।[71] শুরু থেকেই অনুসারীরা, শিক্ষা দ্বারা সুদৃঢ়, রাজনৈতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধেও শক্ত অবস্থান নিয়েছে। আকিলামে এটি সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা যায়, যেখানে তিরুভিথকানুর রাজাকে কালীনিসান (যিনি কালীর গোলাম) এবং ব্রিটিশরা সামাজিক অর্থে ভেনিসান (সাদা নীসান) হিসাবে চিহ্নিত হয়। [72][73] আয়াবালি মানবাধিকার ও সামাজিক সমতার জন্য আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল।[70] আয়াবালি দক্ষিণ ভারতে অনেক সামাজিক পরিবর্তনও প্রভাবিত করেছিল, যার ফলশ্রুতিতে সামাজিক ও আত্মসম্মান আন্দোলনের একটি সিরিজের উত্থান ঘটে যেমন উপরিংশে পরিধেয় কাপড়ের আন্দোলন[68][74][75], মন্দিরে প্রবেশের আন্দোলন এবং সেগুলো সহ অন্যান্য আন্দোলন নারায়ণ গুরুর,[4][76] চট্টম্পি স্বামীকাল, বল্লালার[5] এবং আয়ঙ্কলি।
সারা ভারতে হাজার হাজার নিঝল থাঙ্গাল রয়েছে,[77][78][79] বেশিরভাগই দক্ষিণ ভারতে।[80] দক্ষিণ ভারতে প্রধানত তামিলনাড়ু এবং কেরালায় ৭০০০ টিরও বেশি এ রকম উপাসনা কেন্দ্র রয়েছে।[81] ১৯ শতকের মাঝামাঝি লন্ডন মিশনারি সোসাইটি (এলএমএস) থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোও নিঝল থাঙ্গালের কথা বলা হয়েছে।[82] যেহেতু আয়াবালি ধর্ম কেন্দ্রীয়ভাবে সুসংগঠিত নয়, তাই স্বামীথোপ পাথি ধর্মীয় সদর দফতর হিসেবে কাজ করে আর উপাসনা কেন্দ্রের মধ্যে পাথি’ই বেশি গুরুত্ব পায়।[83]
বৈকুন্দর এবং তার কার্যকলাপে ঐতিহাসিকভাবে পাথিগুলো উপাসনাকেন্দ্র হিসেবে যুক্ত ছিল বিধায় সাতটি পাথি,[35] বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য লাভ করে। স্বামীথোপ পাথি, যদিও ধর্মের সদর দফতর হিসাবে বিবেচিত হয়, তবে আনুষ্ঠানিকভাবে বাকি পাথিগুলোকে কোনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে না। সমস্ত পাথি স্বাধীন কমিটি দ্বারা পরিচালিত হয়।[84] পঞ্চপাথি নামে পরিচিত পাঁচটি পাথিকে পাথিদের মধ্যে অগ্রগণ্য বলে মনে করা হয়।[85] নিঝল থাঙ্গাল, অন্য পাথিগুলোর তুলনায় ছোট হলেও উপাসনা এবং বৈকুন্দরের শিক্ষা দানের জন্য প্রাথমিক দিনগুলোতে স্কুল শিক্ষার কেন্দ্র হিসাবেও কাজ করেছিল।[86] এই কেন্দ্রগুলোতে অভাবীদের খাদ্য এবং আশ্রয় দেওয়া হয়।[87] বৈকুন্দর জীবিত থাকাকালীন যে পাথিগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যেমন আরুল নূল ও সাতটি থাঙ্গাল এগুলোকে অন্যদের তুলনায় প্রধান হিসাবে বিবেচনা করা হয়।[88] বর্তমানে এ কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন দাতব্য কাজ পরিচালিত হয়।[89]
যদিও এই পাথিগুলো ধর্মীয় উপাসনালয় হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল[90] তারপরও নিঝল থাঙ্গাল আয়াবালি জনগণের সামাজিক-ধর্মীয় জীবনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন পানিভিদাই নামক সামাজিক কার্যক্রম প্রতিদিন তিনবার পর্যন্ত পরিচালিত হয়ে থাকে, তবে সমস্ত উপাসনা কেন্দ্র প্রতিদিন অন্তত একবার পানিভিদাই পরিচালিত হয়।
রূপক আশ্রিত পৌরাণিক কাহিনীর সাথে একত্রিত বর্ণনা আয়াবালির নীতিশাস্ত্র, প্রাথমিক ধর্মগ্রন্থ, আকিলাত্তিরাত্তু আম্মানাই জুড়ে পাওয়া যায়।[91] নীতিশাস্ত্রের বিষয়ে আরুল নূল হল আকিলমে পাওয়া মূল ধারণাগুলোর একটি সংগ্রহ।[92] আকিলমে, নৈতিক স্লোক মন্ত্রগুলো মন্ত্রিত হয় এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে তাদের অনুজ অনুসারী, সাধু প্রমুখ জিজ্ঞাসিত হলে "ঈশ্বর তাদেরকে বলেছিলেন" বলে উল্লেখ করা হয়।
নীথাম হল আয়াবালি ধর্মের প্রধান নৈতিক গুণ। এটি দেখায় সমাজ, তার প্রজা, শাসক রাজা ইত্যাদি, প্রকৃতির সাথে কিভাবে নিরঙ্কুশ সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপন করেছিল, কিভাবে প্রাথমিক যুগে তাদের সমস্ত কাজ, কাজ এবং কার্যকলাপে সর্বশক্তিমান শক্তি স্থাপন করেছিল এবং বিনিময়ে, প্রকৃতি এবং ঐশ্বরিক প্রান নীথাম এর অনুসারী সমাজকে কিভাবে রক্ষা করেছিল । পবিত্রতা এবং প্রকৃতির সাথে মহামিলন জীবনের অপূর্ব মাহাত্ম্য, যা অনুসরণ করা উচিত। আকিলমের মত, ভিনচাই হল ভগবান (নারায়ণ) কর্তৃক বৈকুন্দরকে প্রদত্ত নিয়ম ও প্রবিধান। এরকম তিনটি ভিনচাই আছে। সেখানে পাওয়া বিধানগুলো মানুষের নৈতিক মানদণ্ড উন্নত করার জন্য উপযুক্ত। তিরুচেন্দুরের প্রথম ভিনচাই আকিলামে পাওয়া বৃহত্তম নৈতিক সঞ্চয় গঠন করে।[91]
আয়াবালিতে ধর্মীয় শিক্ষাগুলোকেও কিছু ক্ষেত্রে নীতিশাস্ত্র হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সামাজিক নীতিশাস্ত্রে দাতব্য এবং আধ্যাত্মিকতায় "একত্ববাদের মহা সত্য উপলব্ধি করার প্রচেষ্টা" হল আয়াবালি ধর্মের ব্যানারে প্রধান বিধান।[93] আকিলম এছাড়াও দেবদের জন্য পৃথক নীতিশাস্ত্র দেয়।[93] এটি উল্লেখযোগ্য যে আয়াবালি নীতিশাস্ত্র বৈকুন্দর এর অবতার রুপে সর্বজনীন পরিবর্তনের পর থেকে একটি বিশাল পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে যায়।[93] সর্বোপরি, সর্বাগ্রে নৈতিকতাকে প্রাধান্য দেয়া, মানুষকে ভালবাসা, সহনশীলতা এবং শান্তির অস্ত্র দিয়ে অশুভ শক্তি কালিমায়াই কে পরাস্ত করার পরামর্শ দেওয়া হয়, যেহেতু মায়া হিসাবে কালিয়ান মানুষের মনকে শাসন করে।
আরুল নূল নৈতিকতা সহ আয়াবালির নিয়ম ও প্রবিধান গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করে। এটি পৃথকভাবে সামাজিক এবং সেইসাথে ঐশ্বরিক নৈতিকতা জ্ঞান দান করে। শিবকান্দা আথিকারা পাথিরাম এক্ষেত্রে বিশেষভাবে নীতিশাস্ত্র শেখানোর জন্য নিবেদিত। ধর্মীয় শিক্ষা হলো- অনৈতিক চিন্তাভাবনা এবং কাজ থেকে সংঘটিত পাপকে ধুয়ে ফেলার জন্য আচার-অনুষ্ঠান, বিশেষ করে পরিক্রমণ পালন করা উচিত।
হিন্দু ধর্মগ্রন্থের সাথে আয়াবালি ধর্মগ্রন্থের পারস্পরিক সম্পর্ক থাকার কারণে আয়াবালি মতবাদের ধর্মগ্রন্থের কোন সুনির্দিষ্ট তালিকা দেওয়া কঠিন। অকিলাম এ প্রাথমিকভাবে বলা হয়েছে যে বৈকুন্দরের আবির্ভাবের মাধ্যমে তৎকালীন বিদ্যমান ধর্মশাস্ত্রগুলোর (অর্থাৎ যা হিন্দুদের) মূল ধারণা বিকৃত হয়ে যায়।[94] এটা আরও বলে যে অকিলাম মানবজাতিকে একটি বিকল্প হিসাবে দেওয়া হয়েছিল কারণ কালিয়ান মূল বেদ এবং শাস্ত্রসমূহ সহ নষ্ট করেছিল, এবং কলি যুগের শুরুতে এটি পূর্ববর্তী শাস্ত্রগ্রন্থগুলোর কয়েকটি সংযোজন দিয়েছিল। [95] এ দুটো দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে হিন্দু গ্রন্থগুলোর উপর অকিলামের দর্শন প্রকাশ করে এবং এগুলোকে প্রত্যাখ্যানের কারণ হিসাবে রাখে।
আয়াবালি ধর্মতত্ত্বের ধর্মীয় পাঠের ভিত্তি হলো আয়াবালি ধর্মগ্রন্থের দর্শন, শর্তাবলী এবং পৌরাণিক কাহিনী।[96] আকিলমে উদ্ধৃত বেশ কয়েকটি পদ হিন্দু ধর্মগ্রন্থের আলোকে বর্ণনামূলক বিবরণ উল্লেখ না করলে সম্পূর্ণরূপে বোঝা যায় না।[97] উদাহরণস্বরূপ হিন্দুধর্মের ৯৬ টি তত্ত্ব বোঝা গেলে, আকিলমের কলিয়ান বোঝা যায়।[98] তাই মানবদেহ সংশ্লিষ্ট দেহতত্ত্বমূলক জ্ঞান লাভের জন্য ধর্মতাত্ত্বিক এবং দার্শনিকগন আজকে হিন্দু ধর্মগ্রন্থের দিকে ঝুঁকেছেন, যা আকিলমে বিশদভাবে বলা হয়নি। আকিলম এবং এর দর্শন বোঝার জন্য, হিন্দুধর্মীয় ধারণা এবং দর্শন সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান থাকতে হবে।[97]
পৌরাণিক অধ্যয়নের ক্ষেত্রে, আকিলম সীমিত বিবরণ সহ হিন্দুধর্মের প্রায় সমগ্র প্রধান পুরাণকে অন্তর্ভুক্ত করে, যার মধ্যে রয়েছে মহাভারত, রামায়ণ, কাঁথা পুরাণ এবং বিষ্ণু পুরাণ।[99] এটি শুধুমাত্র মূলধারার কাহিনী প্রবাহের সাথে সরাসরি যুক্ত মূল ঘটনাগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু প্রতিটি বিষয়ে বিস্তারিত অধ্যয়ন করার জন্য, উপযুক্ত হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলোকে তথ্যসূত্রে উল্লেখ করা হয় যেগুলো সেই ঘটনাগুলোকে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করে। আকিলম এই সব বিষয়গুলোকে সম্মিলিতভাবে একটি সামগ্রিক কাহিনী সূত্রের মাধ্যমে সংক্ষেপে একত্রিত করে, যা এটিকে অনন্য করে তোলে। হিন্দুধর্মের অনেক দার্শনিক ধারণা আকিলমে পাওয়া যায়; তাদের মধ্যে কিছু সম্পূর্ণরূপে গৃহীত হয়[100], কিছু নতুনভাবে সংযোজন করা হয়[94], অন্যদের প্রত্যাখ্যান করা হয়।[101] সাধারনভাবে বিবেচনা করা হয় যে যদি কোনো নির্দিষ্ট ধারণাকে আয়াবালি ধর্মগ্রন্থ যেমন আকিলাত্তিরাত্তু আম্মানাই বা আরুল নুল (হিন্দু শাস্ত্রে যেমন বিশদ বিবরণ হিসাবে) বর্ণনা করা হয় নাই, এবং তার পরিবর্তে কেবলমাত্র সাধারনভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে, তবে সেই নির্দিষ্ট ধারণাটি ধর্মীয় অধ্যয়নের জন্য হিন্দুদের মতোই গৃহীত হয়।[102] কিন্তু যদি আকিলমে বিদ্যমান মতাদর্শের সাথে হিন্দুধর্মের প্রচলিত (হিন্দু) ধর্মগ্রন্থ থেকে কোনো বিষয়ে আকিলমের একবারও ভিন্ন মত দেখা যায়, তবে তা আকিলমে গভীরভাবে বর্ণনা করা হবে এবং তাই অন্য ধর্মগ্রন্থের উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই।[102]
আয়াবালির ধর্মতত্ত্ব জটিল[103] এবং অন্যান্য অদ্বৈতবাদী ধর্ম থেকে যথেষ্ট আলাদা।[104] আয়াবালি ধর্ম ইকাম নামক একত্ববাদের স্বত্বাকে কেন্দ্র করে আলোচিত। ইকাম হলো এমন এক স্বত্বা কথা যা থেকে সমস্ত কিছু তৈরি হয় এবং যা সমস্ত পার্থক্যের পিছনে বিদ্যমান, যাকে পরম দৈব শক্তি হিসাবে প্রকাশ করা হয়, প্রতিটি পরিবর্তনশীল বিষয়ের গভীরে মায়া দ্বারা প্রভাবিত না হওয়ার একটি পরম ধ্রুবক হিসাবে বিরাজ করে এই ইকাম। ধর্মতাত্ত্বিক পরিভাষায়, ঈশ্বর, সর্বোচ্চ অর্থে, নিরাকার, অসীম, লিঙ্গহীন এবং সময় ও স্থানের বাইরে। তামিল ভাষায় ইকাম শব্দটি সহজ অর্থ হলো- এক, পরম[105], সর্বত্র যা বিদ্যমান[106] এবং অতুলনীয়[107] যে অর্থগুলোর প্রতিটিই আয়াবালি ধর্মতত্ত্ব থেকে ঈশ্বর সম্পর্কে কয়েক ধরনের সরাসরি অদ্বৈতবাদী সংজ্ঞা দেয়।
পৌরাণিক কাহিনীর মাধ্যমে বলা হয়ে থাকে- ইকাম থেকে প্রথম উদ্ভূত হয়েছে শিব এবং শক্তি। তারপর নাথম (কণ্ঠ), ত্রিমূর্তি, অন্যান্য গৌন দেবতা এবং সমগ্র মহাবিশ্ব উদ্ভূত হয়েছে। মানবমূর্তি দেবদের মধ্যে ত্রিমূর্তি বড়। ত্রিমূর্তির অন্যতম শিব হলো কলিযুগ পর্যন্ত সর্বোচ্চ শক্তির অধিকারী । কলিযুগের আবির্ভাবের পর থেকে বিষ্ণুই পরম। তারপর, বৈকুন্দরের আবির্ভাব থেকে, আবার বিষ্ণু সহ সকল দেব-প্রধানদের ক্ষমতা বৈকুন্দরে রূপান্তরিত হয়। ইকাম, ত্রিমূর্তি তত্ত্বের মধ্যে এক হিসাবে পরম একত্ব বর্তমান যুগের জন্য বৈকুন্দরের মধ্যে স্থান করে নেয়। তাই বলা হয়, বৈকুন্দরই একমাত্র উপাসনাযোগ্য ও পরম শক্তি। আকিলম তের থেকে একটি উদ্ধৃতি বলছে এ সর্বোচ্চ একত্বতা (ইকাম) নিজেই বৈকুন্দর দ্বারা সৃষ্ট, যিনি একজন মূর্তিমান ঈশ্বর। এই ক্ষেত্রে, আয়াবালি বৈকুন্দরকে কেন্দ্র করে, অদ্বৈতবাদী না হয়ে অধিকতর একেশ্বরবাদী। অন্য কোন দেব-প্রধান, এমনকি বৈকুন্দরের পিতা নারায়ণও বৈকুণ্ডরের সমান বা বেশি মর্যাদা লাভ করেননি। বৈকুন্দর হলেন একজন ত্রয়ী শক্তি যিনি নিজের মধ্যে সন্ত্রর, নারায়ণ এবং ইকামের গুণাবলী ধারন করেন।
আয়াবালি পুরাণে ক্রোনিকে বলা হয়ে থাকে একটি আদিম মন্দের পূর্ণবিকাশ [108] হিসেবে যা ছয় ভাগে বিভক্ত হয়েছিল এবং পরপর ছয়টি যুগে বিষ্ণু-বিরোধী ভূমিকা পালন করে প্রতিটি খণ্ডের জন্ম হয়েছিল। অবশেষে ঈশ্বর-শাসিত ধর্ম ইউকাম দ্বারা অনুসরণ করা হয় এমন একটি চূড়ান্ত রায় দ্বারা ধ্বংস হয়েছিল। এই বর্ণনাটি আয়াবালি ধর্মতত্ত্বকে কিছু দ্বৈতবাদী মাত্রা দেয়। কিন্তু যেহেতু আরুল নূলের কেন্দ্রবিন্দুতে, আয়াবালি শিক্ষার সঞ্চয়ন অত্যন্ত অদ্বৈতবাদী এবং যেহেতু ক্রোনির চূড়ান্ত খণ্ডটিকেই কালিমায়াই (ভৌত বা বস্তুগত অবতারের পরিবর্তে একটি ধারণা) বলা হয়, তাই এটি সাধারণভাবে গৃহীত হয়েছিল যে 'মায়া' হলো মূলত প্রতীকী। যা আয়াবালির উপর দ্বৈতবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে দূর করে।[109] এছাড়াও, আয়াবালি ধর্মগ্রন্থগুলোতে সর্বৈশ্বরবাদী এবং সর্বৈশ্বরবাদের প্রমান পাওয়া যায়।
আয়াবালি ধর্মে দুটি বাৎসরিক উত্সব রয়েছে। “আয়া বৈকুন্দ অবতারম” তামিল মাসের মাসি (ফেব্রুয়ারি - মার্চ) এর বিশতম দিনে উদযাপিত হয়। এটি সৌর ক্যালেন্ডার অনুসারে পালিত হওয়া একমাত্র আয়াবালি উৎসব।[110] নাগেরকোয়েল থেকে স্বামীথোপে পর্যন্ত এই দিনে বিশাল এক ধরনের গণ মিছিল পরিচালিত হয়। থিরু এডু-ভাসিপ্পু হল সতেরো দিনের একটি উৎসব যা তামিল মাসে কার্থিগাই (নভেম্বর-ডিসেম্বর) পালিত হয়। আয়াবালি ধর্মগ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে এই উত্সব পালন করা হয়। এছাড়াও, স্বামীথোপের কোডিয়েত্রু থিরুনালের একটি ত্রি-বার্ষিক উদযাপন রয়েছে। আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হল স্বামীথোপে প্রতিটি দিনকে প্রতিদিন একটি উৎসব হিসেবে উদযাপন করা হয়, (স্বতন্ত্রভাবে একমাত্র স্বামিতোপেই) যাকে 'নিথাম থিরুনাল' বলা হয়। [111]
দার্শনিক ধারণা এবং পৌরাণিক কাহিনী ছাড়াও, আয়াবালির আচার-অনুষ্ঠানগুলো তাদের স্বতন্ত্র উপায়ে বিকশিত হয়েছিল। অধিকাংশ আচার-অনুষ্ঠানের বিভিন্ন কার্যত ও ঐতিহাসিক অর্থবহুল তাৎপর্য রয়েছে। [112] আচার-অনুষ্ঠানগুলোকে তৎকালীন সমাজে বিরাজমান বর্ণ বৈষম্য ভেঙ্গে ফেলার এবং সমাজতাত্ত্বিকভাবে নিঃস্ব ও দুর্বলদেরকে শক্তিশালী ও উন্নীত করার প্রয়াস হিসেবে ব্যবহার করা হত। এর উদাহরণগুলোর মধ্যে রয়েছে 'আন্না ধর্মম' হিসাবে খাদ্যের জন্য দাতব্য, থুভায়াল থাভাসুর মাধ্যমে শারীরিক পাশাপাশি আত্মিক পরিচ্ছন্নতা, থোত্তুনামমের মাধ্যমে অস্পৃশ্যতা দূর করা, হেডগিয়ারের মাধ্যমে আত্মসম্মান এবং সাহস, এবং মুথিরিক্কিনারুর মাধ্যমে বিভিন্ন জাতিকে একত্রিত করা। [113]
প্রতিটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান ধর্মীয় ভাষায় উপদেশিত গভীর দার্শনিক ধারণা প্রকাশ করে। মুথিরিক্কিনারু এবং থিরুনামামকে ধর্মীয় দিক থেকে এমনভাবে বিবেচনা করা হয় যেন তাদের পাথম এবং নামামের সমস্ত ধরণের মানসিক পাশাপাশি শারীরিক অসুস্থতা নিরাময় করার ক্ষমতা রয়েছে।[114] ধর্ম ইউকামের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রশিক্ষণ হিসেবে থুভায়াল থাভাসুকে পরামর্শ দেওয়া হয়।[115] মুকুটটির ব্যবহার প্রকাশ করে যে "সবাই রাজা", অদ্বৈতের মতো একটি আদর্শকে কল্পনা করে। এছাড়াও, আয়াবালি ধর্মগ্রন্থগুলো এই দার্শনিক ধারণাগুলোকে সাধারণ জনগণের কাছে বুঝতে সাহায্য করতে অনেক বেশি সফল হয়েছে যা খুবই অসাধারণ। স্বতন্ত্র আচার-অনুষ্ঠান, উচ্ছ্বসিত ধর্মীয়তা এবং আচার নিরাময়, যা আয়াবালি উপাসনার বৈশিষ্ট্য, মুক্তিবাদের ধারণা এবং সামাজিক পরিবেশ গঠনে অবদান রাখে। আচার-অনুষ্ঠান অধিকারবঞ্চিতদের উন্নয়ন ও পরিবর্তনে কাজ চেষ্টা করে।[116] উল্লেখ্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ধর্মীয়ভাবে আয়াবালি মহাবিশ্বে ব্যবহৃত হিন্দুধর্ম থেকে ভিন্ন বিকল্প শব্দগুচ্ছ, নির্দিষ্ট কিছু অনুশীলনের প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যবহার করা হয়।
অন্তর্ভুক্তি এবং স্বতন্ত্রতার সূত্রটি আয়াবালির ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা অনন্য কারণ উভয় তত্ত্বই আয়াবালি শাস্ত্রে মিশ্রিত। অন্তর্ভুক্তিমূলক তত্ত্ব একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিভিন্ন ধর্মের মতামত গ্রহণ করে এবং তারপর থেকে তার বর্ণনায় একচেটিয়াভাবে তাদের সকলকে প্রত্যাখ্যান করে।
আয়াবালি বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন ঈশ্বর-প্রধানকে গ্রহণ করে, যেমন ইসলাম ধর্মের আল্লাহর এবং হিন্দুধর্মের প্রায় সমস্ত প্রধান দেবতাদের ধারণা । এটি আরও বলে যে এক এবং একই ঈশ্বর মানুষের দুঃখকষ্ট থেকে উদ্ধারের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে অবতারণা করেন। কিন্তু কালিয়ানের আবির্ভাবের কারণে এবং তার মজ্জাগত নিষ্ঠুর প্রকৃতির কারণে, প্রথমবারের মতো, পরম শক্তি ইকাম বিশ্বে বৈকুন্দর রূপে অবতীর্ণ হন, [উদ্ধৃতি প্রয়োজন] এবং তাই সমস্ত ছোট-বড় ঈশ্বর-প্রধান এবং পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থগুলো[117] তাদের ধর্মীয় সারমর্ম হারিয়েছিল। তাই বৈকুন্দের আবির্ভাব সময়ের পরে, বৈকুন্দরকে একমাত্র উপাস্য ঈশ্বর বলে ব্যক্ত করা হয়েছিল এবং এজন্যই আয়াবালির ধর্মতত্ত্বকে বর্জনবাদের দিকে প্রবাহিত করা হয়েছিল। আকিলাম বিভিন্ন ধর্মের ধর্মগ্রন্থের সাথে যেভাবে আচরণ প্রদর্শন করে তা জটিল। উদাহরণ স্বরূপ, যদিও আয়াবালি গ্রন্থের কোথাও 'খ্রিস্ট' বা 'বাইবেল' শব্দের কোনো প্রত্যক্ষ উল্লেখ নেই, তবে আকিলম তেরোতে একটি পরোক্ষ উল্লেখ রয়েছে যে খ্রিস্ট ছিলেন নারায়ণের অবতার[118], কিন্তু এটি বাইবেলের রচনাকে স্বীকৃতি দেয়নি। মনে হয় বাইবেলের উপর আকিলামের দৃষ্টিভঙ্গি "এটি মানুষের অভিপ্রায়ে সৃষ্টি হয়েছে, ঈশ্বরের উদ্দেশ্য নয়"[119] সাধারণভাবে, ধর্মের সৃষ্টি এবং তাদের জন্য ব্যক্তিত্ব গঠনের ব্যাপক সমালোচনা করা হয়। 'ঈশ্বর' এবং 'ধর্ম' ধারণাগুলোকে আকিলমে আলাদা করে রাখা হয়েছে, এবং এটি একটি মতাদর্শ বজায় রেখেছে বলে মনে হয় 'ঈশ্বরকে গ্রহণ করুন; ধর্ম প্রত্যাখ্যান করুন' [120]
আয়াবালি হিন্দুধর্মে বর্ণিত বিভিন্ন অবতারের ধারণা গ্রহণ করে, কিন্তু তথাকথিত 'হিন্দু' ধর্মগ্রন্থগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে। এটি প্রাথমিকভাবে বেদ গ্রহণ করে।[121] পরবর্তীতে কালিয়ান যেহেতু বেদকে বর হিসেবে কিনে নিয়েছিলেন, কালিয়ানের আবির্ভাবে তারাও তাদের উপাদান হারিয়ে ফেলেছিল এবং তাই অবৈধ হয়ে গিয়েছিল। এটি আরও বলে যে তিনি (কালিয়ান) বেশ কয়েকটি সংযোজন করেছিলেন এবং তাদের কিছু বিষয়বস্তু গোপন করেছিলেন। আর তাই ঈশ্বর বৈকুন্দর রূপে অবতীর্ণ হন। এজন্য বর্তমান যুগের জন্য আকিলমকে একমাত্র 'বুক অফ পারফেকশন' বলা হয়। এর দ্বারা আয়াবালি অন্য সব ধর্মগ্রন্থকে প্রত্যাখ্যান করে এবং শুধুমাত্র নিজের ধর্মকে অনুসরণ করে। আকিলম ধর্ম বিশেষ করে একচেটিয়া ধর্মীয় ও ধর্মতাত্ত্বিক ধারণার সৃষ্টির তীব্র নিন্দা করেন। এটি তাদের অগ্রণী কালী মায়াই (কালীর মন্দ) হিসাবে দেখায়।[122] ধর্মগ্রন্থগুলো সংবেদনশীল এবং প্রতীকীভাবে শিক্ষা দেয় যে ঈশ্বর এবং তাঁর কার্যকলাপ ধর্মের নাগালের বাইরে। এটি সর্বজনীন একত্ববাদ সম্পর্কেও প্রচার করে।
আয়াবালির পৌরাণিক কাহিনী বর্ণনার তথা দৃষ্টিভঙ্গির সারমর্ম হল অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে ঐতিহাসিক বিবরণ - - যার অর্থ অভিজ্ঞতামূলক তথ্য, ইতিহাস ভিত্তিক ঘটনার সাথে পৌরাণিক বিবরণগুলোকে একত্রিত করণ।[123] আয়াবালির পুরাণ সান্তর, কালী ইউকাম এবং ধর্ম ইউকাম নামে তিনটি স্বতঃসিদ্ধ শ্রেনীভেদের চারপাশে পূর্ববর্তী যুগের ধারণা এবং ঘটনাগুলোর উপর ভিত্তি করে বিরাজমান, এগুলো হিন্দু পুরাণের সাথেও সম্পর্কিত। মৌলিক ধারণাগুলো একযোগে ধর্মীয় এবং সামাজিক বিষয়ে প্রতীকী ধারনা দেয়।[124]
আয়াবলি ধর্ম হিন্দু ধর্মের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। আকিলম এ পূর্ববর্তী যুগ এবং তাদের মাধ্যমে ক্রোনির বিবর্তন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বিভিন্ন আকারে ঘটনা, পৌরাণিক চরিত্র এবং ধারণাগুলোর আলোচনা করা হলেও হিন্দুধর্মের সাথে সম্পর্ক রয়েছে। যুগ এবং অবতার সংখ্যা হিন্দুধর্ম থেকে আয়াবালির মধ্যে আলাদা।[125] বর্তমান যুগের জন্য অশুভ সত্ত্বার মূর্ত রূপ, কালিয়ান, আয়াবালির কাছে অনন্য। আকিলম বলেছে যে- কালীর আবির্ভাবের কারণে পূর্ববর্তী সমস্ত ধর্মগ্রন্থগুলো তাদের যথার্থতা হারিয়েছিল, সত্যিকারের ধারণাগুলো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।[126]
আকিলম ক্রোনির চূড়ান্ত রুপ প্রকাশ কে মন্দ আত্মাকে ধ্বংস করার জন্য কালী ইউকামে (বর্তমান যুগে) পৃথিবীতে ঈশ্বরকে অবতার রুপে অবতরন হিসেবে বর্ননা করে। ভগবান বৈকুন্দর রূপে অবতীর্ণ হন, এবং যেহেতু বৈকুন্দর এর ইতিহাস অতি সাম্প্রতিক কালের, তাই তিনি বর্তমান ইতিহাসে সুপরিচিত। পৌরাণিক কাহিনীর দ্বিতীয় অংশে অনেক পৌরাণিক এবং ঐতিহাসিক ঘটনা একসাথে বর্ননা করা হয়েছে। বেশিরভাগ ঘটনা যেমন মুথিরিক্কিনারু,[127] পূজার সময় মস্তক আবৃত করা[128], থুয়ায়াল থাভাসু[129] সবই উল্লেখ করা হয়েছে।
ক্রমিক
নং |
যুগ | অসুর | অবতার | চক্র* (রূপক) | ভূতত্ত্ব* (রূপক) | যুগের সমাপ্তি (ভূতাত্ত্বিক পরিভাষায়) |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | নীতিয়া যুগ | ক্রোনি | নারায়ণ | বিন্দু | লেট হেডেন, আর্কিয়ান, প্রোটেরোজয়িক যুগ | ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণ ** |
২ | চথুরা ইউকাম | কুন্দোমাসালি | মেয়ন | মুলধারা | অর্ডোভিসিয়ান সময়কাল | অর্ডোভিসিয়ান-সিলুরিয়ান বিলুপ্তির ঘটনা |
৩ | নেতু ইউকাম | থিল্লাই মল্লালন ও মল্লোসিবাহানন | থিরুমল | স্বাধিস্থান | ডেভোনিয়ান সময়কাল | দেরী ডেভোনিয়ান বিলুপ্তি |
৪ | কৃতযুগ | সুরপদমান ও ইরানিয়ান | মুরুগা ও নরসিংহ | মণিপুরা | পারমিয়ান সময়কাল | পারমিয়ান-ট্রায়াসিক বিলুপ্তির ঘটনা |
৫ | ত্রেতাযুগ | রাবণ | রাম | আনহাত | ট্রায়াসিক সময়কাল | ট্রায়াসিক-জুরাসিক বিলুপ্তির ঘটনা |
৬ | দ্বাপর যুগ | দুর্যোধন | কৃষ্ণ | বিশুদ্ধ | ক্রিটেসিয়াস সময়কাল | ক্রিটেসিয়াস-প্যালিওজিন বিলুপ্তির ঘটনা |
৭ | কলিযুগ | কালিয়ান | ট্রিনিটি | আজনা | প্লাইস্টোসিন, হলোসিন যুগ (প্রয়াত চতুর্মুখী সময়কাল ) | হোলোসিন বিলুপ্তি |
৮ | ধর্মযুগ | কোনটি | আইয়া ভাইকুন্দর | সহস্রার | - | - |
যদিও আরুল নূলে বিষ্ণুর দশটি অবতারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য উদ্ধৃতি রয়েছে, তারপরও মনে হয় যে তাদের এই অবতারগুলোকে সমান মর্যাদায় দেখা যায় না (সারণীর মতো)। ক্রোনির টুকরোগুলোর ধ্বংসের সাথে যুক্ত প্রাথমিক অবতারদের গৌণ বলে বিবেচিত হত। এই দৃষ্টিভঙ্গি হিন্দুধর্মের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ নয়, কারণ শুধুমাত্র নরসিংহ, রাম এবং কৃষ্ণকে প্রাথমিক অবতার হিসাবে বিবেচনাপূর্বক এখনও উপাসনা করা হয়। অন্যান্য অবতারদের পূজা করা হয় না, গৌন অবতার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
স্যান্টর হল আয়াবালির ধর্মীয় এবং সামাজিক গুরুত্ব[130] রয়েছে এমন ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়।[131] সামাজিক অর্থে, স্যান্টর শব্দটি- প্রারম্ভিক "চানারদের" সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, যাদেরকে আরবরা "আল হিন্দ" নামে ডাকত এবং বাইবেলের সময়ে "পাঁচ নদীর মানুষ" হিসাবে পরিচিত ছিল।[132] কিন্তু মতাদর্শগত অর্থে এবং তামিল ভাষায় "স্যান্ট্রর" শব্দটির সাহিত্যিক অর্থ থেকে, এটি এমন একজনকে প্রতিনিধিত্ব করে যিনি মহৎ এবং মর্যাদার সাথে জীবনযাপন করেন [133] এবং সর্বোচ্চ জ্ঞান[134], অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্র এবং সর্বজনীন গ্রহনযোগ্যতা বিদ্যমান। ঐতিহাসিকরা বর্ণনা করেন যে প্রাচীন দ্রাবিড় সংস্কৃতিতে, ঈশ্বরের উদ্যোগী ভক্তদের 'চানার' বলা হত।[135] আকিলমের একটি উদ্ধৃতিও পড়ে, "চানার (সন্ত্রার) তারাই যারা ক্রমাগত 'অদৃশ্য' দেখার ক্ষমতা রাখে।"[130]
স্যান্টর সম্পর্কে আয়াবালি পুরাণে ঐতিহাসিক পটভূমি হিসেবে বলা হয়েছে যে- থিরুমলের দ্বারা সাত কুমারীকে স্বর্গীয় সাতটি বীজ ব্যবহার করে সাতটি ছেলেকে পৌরাণিক উদ্যান অযোধা অমির্থ ভানামে (বর্তমান শ্রীরঙ্গম, তামিলনাড়ু এবং ত্রিকোনামালি, শ্রীলঙ্কার মধ্যে বলে মনে করা হয়) জন্মদান করা হয়েছিল। ধর্মতত্ত্ববিদরা ব্যাখ্যা করেন যে এই 'সেভেন বয়েজ' পুরো মানব জাতির পূর্বপুরুষকে বোঝায় এবং তাই "স্যান্টর" শব্দটি সমগ্র মানবজাতিকে বোঝায়।[136] তাদের বংশ দ্বাপর ইউকামের শেষ পর্বে শুরু হয়েছিল এবং কালী ইউকামের মধ্য দিয়ে ধর্ম ইউকামে চলেছিল। এটা বিশ্বাস করা হয় যে কালী বৈকুন্দর পথে সন্তুর ক্রিয়াকলাপের দ্বারা ক্রমাগত ধ্বংস হচ্ছে, এবং তাই ধর্ম ইউকাম শেষ পর্যন্ত প্রকাশ পায়। এই অর্থে সর্বাগ্রে মন্দ কালী ধ্বংসে তাদের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে।
আয়াবালি ধর্ম ইউকামের ব্যানারে একটি মুক্তিমূলক নিখুঁত সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রস্তাব করেছে।[137] বিশ্বাসের ভিত্তি হল যে আয়া বৈকুন্দর চূড়ান্ত রায়ের মাধ্যমে ক্রোনিকে নরকে দণ্ডিত করার পর কালী ইউকামের জায়গায় ধর্ম ইউকামের উপর চিরস্থায়ী রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও শাসন করতে এসেছিলেন।[138][139] দ্বারকা পাথি, ক্রমবর্ধমান পৌরাণিক ল্যান্ডমাস (যা দ্বাপর যুগের শেষে কৃষ্ণ দ্বারা নিমজ্জিত হয়েছিল) বর্তমান কন্যাকুমারীর[140] দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত। ধর্ম ইউকাম সময় এবং স্থান সীমা অতিক্রম হিসাবে বর্ণনা করা হয়। [141] এটি প্রায়ই 'একত্ববাদ' অবস্থার সাথেও মোক্ষ-ব্যক্তিগত মুক্তির সাথে সম্পর্কিত।[142][143]
হিন্দু এবং আয়াবালি মতাদর্শ একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে আবদ্ধ। কলিযুগের আবির্ভাবের স্থান যেখানে আয়াবালি এবং হিন্দুধর্ম একে অপরের থেকে বিদায় নেয়। আকিলম বলেছে যে কলিযুগের আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত বেদ এবং অন্যান্য সমস্ত হিন্দুগ্রন্থের দেবতারাও তাদের সমস্ত ক্ষমতা সহ দেবত্বের সাথেই ছিল। কিন্তু কলিযুগের সূচনা থেকেই তারা এবং তাদের সকল গুণের পতন ঘটে। কালিয়ান ছিলেন জাগতিক আদিম প্রকাশের একটি অংশ যারা বিদ্যমান ধর্মগ্রন্থ এবং দেবতাদের উপর মায়া বা বিভ্রম ছড়িয়েছিল।[146] কলিযুগে সমস্ত সত্য শাস্ত্র মায়ায় আবদ্ধ এবং অসহায়। সমগ্র ব্যবস্থার বিচ্ছিন্নতার জন্য আকিলমে বর্ণিত কারণ হল, দ্বাপর যুগের শেষের দিকে, কৈলাস পর্বতে দেবতাদের কথা বিশ্বাস করে শিব যিনি কালিয়ানকে ধ্বংস করার দায়িত্ব পেয়েছিলেন, বিষ্ণুর সাথে আলোচনা না করেই কালিয়ান সৃষ্টি করেছিলেন। পূর্বের কাজ অনুযায়ী,[147] বিষ্ণু কালিয়ানকে ধ্বংস করার জন্য পৃথিবীতে জন্ম নিতে অস্বীকার করেন।[148] তাই শিব ও ব্রহ্মা তাদের সমস্ত ক্ষমতা বিষ্ণুর কাছে সমর্পণ করলেন।[149]
এই ঘটনার আগ পর্যন্ত, আকিলামের মতে শিব ছিলেন সর্বোচ্চ শক্তি। উল্লেখযোগ্য যে এটি শৈব ধর্মের অনুরূপ একটি ধর্মতাত্ত্বিক ধারণা, যেখানে শিব সকলের জন্য সর্বোচ্চ। আবার অন্যদিকে বিষ্ণুই পরম শক্তি।[150] এখানে বৈষ্ণব মতবাদের মতই আদর্শের পরিবর্তন হয়। বিষ্ণুর এই আধিপত্য কলিযুগের শুরু থেকে বৈকুন্দর অবতার হিসেবে আবির্ভাব পর্যন্ত এইভাবে রয়ে গেছে, যেখান থেকে এটি আরও পরিবর্তিত হয়।
আবির্ভাবকালে, বিষ্ণু নিজেই কালিয়ানকে ধ্বংস করার জন্য সরাসরি পৃথিবীতে অবতারণা করতে পারেন না, যেহেতু তিনি (কালিয়ান) বিষ্ণুর সহ দেবগণের শক্তিকে বর হিসাবে কিনেছিলেন এবং মায়া হিসাবে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাই ঈশ্বরকে একটি নতুন নিয়ম এবং অনন্য গুরুত্ব সহকারে অবতারিত হতে হবে। দেব-প্রধানগনের শক্তি সম্পর্কের, শাস্ত্রের নিয়ম, ধর্ম ইত্যাদির সর্বজনীন রূপান্তর ঘটেছিল এবং ইকামের ক্ষমতা গ্রহণ করে, লক্ষ্মী ও বিষ্ণু সমুদ্রের অভ্যন্তরে একত্রে মিলিত হয়ে বৈকুন্দর জন্মগ্রহণ করেছিলেন।[151]
তখন থেকেই আগামীর জন্য সমুদ্রের অভ্যন্তরে বিষ্ণু থেকে বৈকুন্দরকে সমস্ত ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। শিব, বিষ্ণু এবং ব্রহ্মা তাই বৈকুন্দরের মধ্যে একটি অংশ গঠন করে।[152] ত্রিমূর্তি সম্পর্কে এই আদর্শ (শক্তিতে তিনজন সমান) স্মার্তবাদ বা স্মার্ত ঐতিহ্যের মতই। বিষ্ণু একাই দ্বৈত ভূমিকা পালন করে; একটি, বৈকুন্দরের মধ্যে, এবং অন্যটি, তার পিতা হিসাবে সমুদ্রের ভিতরে থেকে এবং ভিঞ্চাইসের মাধ্যমে বৈকুন্দরকে নিয়ন্ত্রণ করে।[152] [বৈকুন্দর জন্মের পর, ইকামের ক্ষমতা গ্রহণ করে, অন্যান্য সমস্ত ঈশ্বর-প্রধানের কাছে বৈকুন্দর ছিলেন বিষ্ণু যদিও বিষ্ণু বৈকুন্দরের পিতার ভূমিকা পালন করেছিলেন। যেহেতু বৈকুন্দরকে বিষ্ণুর দায়িত্ব পালনের জন্য জন্ম দেওয়া হয়েছিল, যা তিনি (বিষ্ণু) করতে পারেননি বৈকুন্দরকে বিষ্ণুর আদেশ মানতে হয়েছিল। বৈকুন্দর (এবং তাঁর দ্বারা প্রদত্ত ধর্মগ্রন্থগুলো) হল সর্বোচ্চ ইকামের প্রকাশ। তাই আয়াবালি ধর্মগ্রন্থের আধ্যাত্মিকতায়- তিনিই একমাত্র উপাসনাযোগ্য সর্বজনীন শক্তি।[153]
আকিলমের প্রথম অংশটি পূর্ববর্তী যুগের ঘটনাবলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ এবং যা হিন্দু ধর্মগ্রন্থেও বিদ্যমান।[154] দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে সার্বজনীন রূপান্তর এবং বৈকুন্দরের স্বতন্ত্রতা এবং তার অবতার কার্যকলাপ সম্পর্কে।[154] তাই সংক্ষিপ্তসার হিসাবে, কলিযুগের শুরু পর্যন্ত হিন্দুধর্ম যা, তাই হল আয়াবালি। এরপর থেকে একাধিক কারণে, আকিলম বলে যে 'হিন্দু' ধর্মগ্রন্থের মতাদর্শ তার বিশুদ্ধতা হারিয়ে ফেলেছিল এবং ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।[155] তাই ধর্মকে আকিলম হিসেবে এবং বৈকুন্দর ও 'হিন্দু' নামে পুনরায় সংস্কার করে ধারণাগুলো পুনর্গঠিত হয়েছিল।
ধর্মের পুনর্জন্ম হিসাবে আকিলম পুরোপুরি নতুন মতাদর্শের আকারে এর ভিত্তিকে নির্দেশ করে।[157] কিন্তু আজ আয়াবালির অধিকাংশ অনুসারী বৈকুন্দরকে শুধু বিষ্ণুর অবতার বলে সম্বোধন করেন। একইভাবে, নিঝল থাঙ্গাল এর বেশিরভাগকে হিন্দু বৈষ্ণব মতের অনুরূপ নারায়ণ স্বামী পাথি বা নারায়ণ স্বামী মন্দির বলা হয়। অধিকাংশ অনুগামী হিন্দু দেবতা যেমন কালী, হনুমান এবং অন্যান্য মানবমূর্তিধারী দেবতাদের উপাসনা করা হয়, যদিও আয়াবালি ধর্মগ্রন্থে বহু-ঈশ্বরবাদ বিরোধী ধারণা রয়েছে।[158]
আয়াবালির কিছু অনুসারী কল্কি হিসাবে বিষ্ণুর দশটি অবতারের অংশ হিসাবে বৈকুন্দরকে অন্তর্ভুক্ত করে আবার কেউ কেউ মোক্ষ, ব্যক্তিগত মুক্তির জোরালো সমর্থন করে যদিও এটি আকিলমে সরাসরি বলা হয়নি। কেউ কেউ আয়াবালির ত্রিমূর্তি ধারণাকেও প্রত্যাখ্যান করে এবং নারায়ণকে সর্বোচ্চ সর্বজনীন শক্তি বলে বিশ্বাস করে।[159] অনন্য একেশ্বরবাদী বিশ্বাস যা আকিলমের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু আজ অধিকাংশ অনুসারীদের মধ্যে সম্পূর্ণ অজানা।[158] আকিলমের কঠোর একেশ্বরবাদী শিক্ষা থেকে অনেক দূরে বিচ্যুত, কিছু থাঙ্গাল অন্যান্য গৌন দেবতাদের জন্যও পানিভিদাই সরবরাহ করে।[158]
সাধারণ মানুষের মধ্যে আয়াবালির প্রসার ঘটেছিল মূলত শামানবাদের অনুশীলনের কারণে। প্রায় সব দিক দিয়েই হিন্দুদের অনুরূপ হওয়ায় আয়াবালি অনুসারীদের চিহ্নিত করা কঠিন। আয়াবালির অনুসারীদের আলাদা করার একমাত্র চিহ্ন হল তারা তিরুনামাম (তাদের কপালে একটি চিহ্ন) ধারন করে।[160] অন্যান্য মন্দিরের মধ্যে নিঝল থাঙ্গাল কে চিহ্নিত করা হয়-পল্লীয়ারায় মূর্তি প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে।[160] আয়াবালি ধর্মগ্রন্থে শিক্ষিত মুষ্টিমেয় পণ্ডিতদের আবৃত্তিই আকিলমের প্রকৃত ঘটনা ও ধারণা এবং হিন্দুধর্ম থেকে আয়াবালির দার্শনিক ও আদর্শগত বিচ্যুতিকে নির্দেশ করে।[161] এমনকি প্রধান কার্যালয় থেকে পায়ানরাও আকিলম-ভিত্তিক মতাদর্শকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে পারেনি। আয়াবালির সমাজে এই সমস্ত দার্শনিক, আদর্শিক এবং ধর্মীয় বৈচিত্র তাদের আলাদা বিশ্বাস হিসাবে চিহ্নিত করা এবং আলাদা করা এবং পরিবর্তে একটি হিন্দু সম্প্রদায় হিসাবে নেওয়া কঠিন করে তোলে।
একটি সাধারণ বিশ্বাস আছে যে আয়া বৈকুন্দর একজন অবতার এবং তিনি তার জীবদ্দশায় অনেক ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। বিপরীতে, আকিলাম বা আরুল নূলের অন্যান্য বইতে এমন কোন তথ্য নিহিত নেই যে তিরুভাসাগাম ৪, আকিলম:১২ ব্যতীত বৈকুন্দর নিজে কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। সাধারণ ভুল বোঝার কারণ হল, আকিলম এবং আরুল নূলে শত শত ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে এবং উভয় বইয়ের বিষয়বস্তু বৈকুন্দর দ্বারা সীদারদের কাছে ঐশ্বরিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে এবং সীদাররা সেগুলোকে লিখিত আকারে নিয়ে এসেছেন। সুতরাং, উভয় গ্রন্থের ভবিষ্যদ্বাণীর পরিবর্তে সীদারের যে ভবিষ্যদ্বাণীগুলো বিবেচনা করা হচ্ছে তা মূলত বৈকুন্দরের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো । রবার্ট ক্যাল্ডওয়েল, সমসাময়িক সময়ের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদদের মধ্যে একজন (যাদের মতামত সবসময় বৈকুন্দরের প্রতি অপ্রতিরোধ্যভাবে নেতিবাচক, যেহেতু তিনি একজন এলএমএস খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক ছিলেন) এছাড়াও তৎকালীন বিশ্বাসের কথা উল্লেখ করেছিলেন যে সিডার (শিষ্যরা) ও ঘটনাগুলোর ভবিষ্যদ্বাণী করত।[162]
সরলতার জন্য আয়াবালি পূজা পরিচিত ছিল। মূর্তি পূজা এবং পুরোহিতদের মধ্যস্থতার অনুপস্থিতি, এবং বিকল্প ধরনের উপাসনা কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্তি, পাথি এবং নিঝল থাঙ্গাল, ছিল আয়াবালি উপাসনার অন্যান্য বৈশিষ্ট্য। আয়াবালির আচার-অনুষ্ঠান হল হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্যুত সংস্কার বা বিপ্লবী কার্যকলাপ, যা সামাজিক সাম্যের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে । আচার-অনুষ্ঠানগুলো বিকল্প আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ ধর্মীয় বিশ্বাসে আবদ্ধ।[163] এর ধর্মগ্রন্থগুলো সমগ্র হিন্দুধর্মের মৌলিক উপাদান এবং শাস্ত্র, আগম, বেদ এবং পুরাণ উল্লেখ করে।[164] কিন্তু বৈকুন্দরের আবির্ভাব দ্বারা তাদের সকলকে বিকৃত বলে সম্বোধন করে,[165] যেখান থেকে আয়াবালি ধর্মগ্রন্থগুলো অন্যান্য সমস্ত ঐতিহ্যের উপর নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে। আয়াবালিকে হিন্দু নবজাগরণ হিসেবে চিত্রিত করা যেতে পারে। আয়াবালিকে একটি সংস্কার আন্দোলন হিসেবেও দেখা হয়,[166] কারণ এটি ১৯ শতকে তামিল ও কেরালার সমাজে অনেক সামাজিক পরিবর্তন এনেছিল।
আয়াবালি ধর্মগ্রন্থ বিকল্প ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা হিসাবে নিজেকে রূপান্তরিত করেছিল। আয়াবালিরা তাদের প্রথাকে "আয়া বালি" শব্দগুচ্ছ দিয়ে "ঈশ্বরের পথ" বলে সম্বোধন করেছিল। একদিকে আয়াবাললি ধর্ম সমস্ত পুরানো ঐতিহ্য (ধর্ম) প্রতিস্থাপন করতে এসেছে, কিন্তু অন্যদিকে তারা বিশ্বাস করে যে আয়াবালি বিশ্বের ধর্মীয় জ্ঞানের সংক্ষিপ্তসার। একদিকে তারা বিশ্বাস করে যে বৈকুন্দর তার মধ্যে সমস্ত দেবতাকে একত্রিত করেছে; অন্য দিকে বলে বৈকুন্দর আবির্ভাবে পূর্ববর্তীগুলো বিকৃত হয়ে গিয়েছে।[165] সেই সাথে আয়াবালির নিজস্ব আলাদা ধর্মতত্ত্ব, পুরাণ, পবিত্র স্থান, উপাসনা কেন্দ্র এবং নীতিশাস্ত্র রয়েছে।
যদিও এর কিছু অনুসারী একে একটি পৃথক ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করেন, অনেক নতুন গবেষণাপত্র, একাডেমিক গবেষকদের মতে- স্বায়ত্তশাসিত ধর্মের পরিবর্তে আয়াবালি একটি হিন্দু সম্প্রদায়।[167] তারা তামিলনাড়ুর উপজাতীদের ধর্মের অনুরূপ অনুসারী এবং ভবিষ্যদ্বাণীর ঐশ্বরিকতার অনুশীলনে লিপ্ত। এ ধর্মের মূল বিশ্বাসের অনেক কিছু হিন্দু সম্প্রদায়[168] ও অদ্বৈত এবং স্মার্টবাদের মতো।
ধর্মীয় সদর দফতরের তালিকা ছাড়াও আদমশুমারির তথ্যমতে (যদিও এটা স্পষ্ট যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাগজপত্র থেকে আয়াবালি অনুসারীরা ভারতজুড়ে ছড়িয়ে আছে), আয়াবালি অনুসারীদের তুলনামূলকভাবে এবং সংখ্যায় কম হলেও দক্ষিণ ভারতে বেশি পাওয়া যায়। বিশেষ করে তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারী এবং তিরুনেলভেলি জেলায় আয়াবালি উপাসনা কেন্দ্র ছাড়া একটি গ্রামও খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.