শীর্ষ প্রশ্ন
সময়রেখা
চ্যাট
প্রসঙ্গ

জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড

১৯৮১ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে হত্যা উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ

জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড
Remove ads

বাংলাদেশের ৮ম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০শে মে চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একদল কর্মকর্তা কর্তৃক নিহত হন। জিয়া তার রাজনৈতিক দল, বিএনপির স্থানীয় নেতাদের মধ্যে সংঘটিত একটি সংঘর্ষের মধ্যস্থতা করতে চট্টগ্রামে যান। ৩০শে মে রাতে একদল সেনা কর্মকর্তা চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ অধিকার করে জিয়াসহ আরও কয়েকজনকে গুলি করে। যার ফলশ্রুতিতে, জিয়া নিহত হন।

দ্রুত তথ্য জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড, স্থান ...
Thumb
১৯৭৯ সালে নেদারল্যান্ডসে রাষ্ট্রপতি জিয়া
Remove ads

পটভূমি

সারাংশ
প্রসঙ্গ
Thumb
এ. কে. এ. ফিরোজ নুন ও রাষ্ট্রপতি জিয়া (১৯৭৯)

রণনায়ক হিসেবে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের অনেক রাজনীতিবিদদের কাছে সমাদৃত ও স্বীকৃত। তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে সপরিবারে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডে তার ভূমিকা বিতর্কিত। ১৯৭৫ সালে মুজিবের হত্যাকারীদের বিচারকার্য বন্ধ করার জন্য খন্দকার মোশতাক আহমেদের অনুমোদিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জিয়ার দ্বারা তার আমলে বৈধকরণ করা হয়। তিনি রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন শেখ মুজিবুর রহমানের কতিপয় হত্যাকারীকে বিদেশে প্রেরণ করা হয়। ঢাকা হাইকোর্ট এক রায়ে জিয়ার সামরিক শাসনসহ ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে সামরিক অভ্যূত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকে "বেআইনি ও অসাংবিধানিক" বলে ঘোষণা করে। জিয়ার সামরিক আইন ও আদেশ, অভ্যুত্থান থেকে ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি পদ গ্রহণ এবং ১৯৭৮ সালে অনুষ্ঠিত গণভোট সংবিধানবিরোধী বলে ঘোষিত হয় এবং আদালতের রায়বলে ইনডেমনিটি আধ্যাদেশ বাতিল করা হয়। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তার রাজনৈতিক বিরোধীদের কঠোরভাবে দমন করা হয়। এ সময় তার বিরুদ্ধে প্রায় ৬২ হাজার আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে রাখার অভিযোগ রয়েছে যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিও আকর্ষণ করেছিল। দাবি করা হয়, জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে বিচার বহির্ভূতভাবে অন্তত ৩০০০ সেনাসদস্য, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা নিহত অথবা গুম হন। ১৯৭৭ সালের অক্টোবরের ২ তারিখে অনুষ্ঠিত এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার অভিযোগে ১১৪৩ জনকে বিভিন্ন কারাগারে ফাঁসি দেয়া হয়। তার ইসলামিক মনোভাব তাকে বাংলাদেশের মানুষের সমর্থন এনে দেয়। শেখ মুজিবুর রহমানের অসাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রত্যাখান করে জিয়া বাংলাদেশে ইসলামিক রাজনীতি চালু করেন এবং মুসলিম জাতিসমূহের সহযোগিতা সংস্থায় বাংলাদেশকে তুলে ধরেন। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে, এসব ব্যবস্থা বাংলাদেশের অনেক উপজাতীয় ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিচ্ছিন্ন ও বিরুদ্ধাচরণ করে যা ভবিষ্যতের বেশ কিছু সাম্প্রদায়িক ও উপজাতিক দ্বন্দ্বকে ত্বরান্বিত করে।[]

জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রপতিত্ব

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমানের মেয়াদ শুরু হয়েছিল ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের কাছ থেকে রাষ্ট্রপতির পদ অধিগ্রহণের মাধ্যমে।[]

দেশের রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা সৃষ্টির আভাস দিয়ে তিনি বলেন,

আমি রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতিকে কঠিন করে তুলব।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের ২৪ ঘন্টারও কম সময়ে, জিয়া তার শাসন সম্পর্কে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে একটি আস্থা গণভোট করার ঘোষণা দেন।[] সমালোচকরা পরামর্শ দেন যে আস্থার গণভোটটি তার রাষ্ট্রপতিত্বকে বৈধ করার জন্য তার বিড ছিল।

গণভোট ও নির্বাচন

১৯৭৭ সালের ৩০ মে অনুষ্ঠিত গণভোটটি রাজনৈতিক ভাষ্যকার এবং পর্যবেক্ষকদের হতবাক করেছিল। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন অনুসারে জিয়া ৯৮.৮৭% ভোট পেয়েছিলেন, মাত্র ১% ভোটার তার মতামতের বিরোধিতা করে, প্রক্রিয়া সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল।

গণভোটকে বিতর্কিত করার সাথে সাথে জিয়া পরের বছরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ঘোষণা দেন। যেটি ছিল রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচন।

জিয়া, একজন যুদ্ধ-নায়ক, জাতীয়বাদী ফ্রন্টের প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছিলেন, ছয়টি দলের জোট যার মধ্যে একদিকে মুসলিম লীগের মতো ইসলামপন্থী দলগুলি এবং অন্যদিকে তফসিলি জাতি ফেডারেশনের মতো সংখ্যালঘু-নেতৃত্বাধীন দলগুলি অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানী, যিনি আওয়ামী লীগ এবং কিছু বামপন্থী দলের একটি প্ল্যাটফর্ম গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট দ্বারা সমর্থিত ছিলেন।[]

আতাউর রহমানের নেতৃত্বাধীন কয়েকটি দল নির্বাচন বর্জন করে। যার মধ্যে রয়েছে ডেমোক্রেটিক লীগ, ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ, জাতীয় দল, জাতীয় লীগ ও শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল[]

নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ

১৯৭৮ সালে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়া প্রায় ৭৬% ভোট পেয়েছিলেন এবং জেনারেল ওসমানী কর্তৃপক্ষের ভাগ করা সংখ্যা অনুসারে ২১% ভোট পান। ওসমানীর সমর্থকরা দাবি করেছেন, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে এবং সারা দেশে ব্যালট বাক্স ভর্তির ঘটনা ঘটেছে। যাইহোক, ফলাফলের বিশ্লেষণে দেখা যায় যে নির্বাচনটি অনেকাংশে সুষ্ঠু হয়েছে এবং গোপালগঞ্জের মতো আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত কয়েকটি জেলায় জিয়াউর রহমান মোট ভোটের ১৬% এর মতো কম পেয়েছেন।[]

নির্বাচনে জয় জিয়াকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাংলাদেশ পরিচালনার একধরনের বৈধতা দিয়েছিলেন।

স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে আপোষ

১৯৭৫ সালের ৩১শে ডিসেম্বর ৭২' এর ঘাতক দালাল আইন বাতিল করে ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধীর মুক্তি দেওয়া হয়, যাদের মধ্যে ৭৫২ জন দণ্ডপ্রাপ্ত ছিল। সেনাবাহিনীকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার জন্য ও ক্ষমতাকে দৃঢ় করার জন্য এবং কিছু ডানপন্থী রাজনৈতিক দল যেমন জামায়াত-ই-ইসলামীর সমর্থন অর্জনের জন্য জিয়া বেশ কিছু বিতর্কিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।

১৯৭৭ সালের ২২ এপ্রিল সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের মূল-পরিবর্তন আনা হয়। মুসলিম লীগ ও জামায়াত-ই-ইসলামী সহ অন্যান্য দলগুলোর প্রত্যাবর্তনের সুবিধা প্রদানের পাশাপাশি তাদের সকল কার্যকলাপকে সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়া হয়। এই সময় ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অনুমতিও প্রদান করা হয়। ১৯৭৮ সালের ৫ই এপ্রিল সংবিধানের ৫ম সংশোধনীতে বিশেষ 'নাগরিকত্ব আইন' প্রণীত হয়। যার আওতায় গোলাম আযমকে দেশে প্রবেশের অনুমতি ও ১৯৭৯ সালে আব্বাস আলী খানকে জামাতের আমীর হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বৈধতা প্রদান করা হয়।

জিয়া অত্যন্ত বিতর্কিতভাবে স্বাধীনতা বিরোধী ব্যক্তিত্ব শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেছিলেন। যিনি বাঙালি হয়েও ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের প্রতিনিধি হয়ে জাতিসংঘে যান এবং বলেন,

“…পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক বাহিনী হামলা চালিয়ে অন্যায় কিছু করেনি। পাকিস্তানে মুক্তিযুদ্ধের নামে যা চলছে তা ভারতীয় ষড়যন্ত্র এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন…।”

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বৈধকরণ

জিয়া শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত বেশ কয়েকজনকে বিদেশে নিয়োগ দিয়েছিলেন। মেজর ডালিম, মেজর রশিদমেজর ফারুককে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি দেওয়া হয় এবং পরবর্তী বছরগুলোতে তারা আফ্রিকান ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন।

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ (যা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড, অভ্যুত্থান এবং ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে অন্যান্য রাজনৈতিক ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের আইনি পদক্ষেপ থেকে অনাক্রম্যতা প্রদান করেছিল) ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ কর্তৃক ঘোষণা করা হয়েছিল, যা সংসদে ইনডেমনিটি হিসাবে অনুমোদিত হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী হিসেবে আইনটি সংযোজিত হয়।

জাতীয় সংগীত বিতর্ক

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান এক গোপন চিঠিতে বলেন,

"রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি গান ভারতীয় জাতীয় সংগীত। তিনি বাংলাদেশের নাগরিক ও নন। হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন কবির লেখা গান জাতীয় সংগীত হওয়ায় মুসলিম উম্মাহ উদ্বিগ্ন। এই গান আমাদের সংস্কৃতির চেতনার পরিপন্থী বিধায় জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন আবশ্যক।"

প্রধানমন্ত্রীর ওই চিঠিতে ‘আমার সোনার বাংলা’র পরিবর্তে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’কে জাতীয় সঙ্গীত করার প্রস্তাব করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর এই চিঠি পেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রেডিও, টেলিভিশন এবং সব সরকারি অনুষ্ঠানে প্রথম বাংলাদেশ গানটি প্রচারের নির্দেশনা জারি করে। জিয়া নিজেই জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের পক্ষপাতী ছিলেন, বিএনপি নেতা ডা. ইউসুফ এক অধিবেশনে জিয়াকে জাতীয় পতাকায় পরিবর্তন আনতে অনুরোধ করলে জিয়া জবাব দেন,

"হবে, হবে, সবকিছুই হবে। আগে হিন্দুর লেখা জাতীয় সঙ্গীত বদলানো হোক। তারপর জাতীয় পতাকার কথা ভাববো।"

এসময় রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি প্রথম বাংলাদেশ গানটি গাওয়া শুরু হয়। কিন্তু ১৯৮১ সালে জিয়ার মৃত্যুর পর সেই উদ্যোগ থমকে যায়।

সশস্ত্র বাহিনীতে গণহত্যা

জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনকালে ২০টিরও অধিক সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়।

১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর ঢাকায় সামরিক বাহিনীর একটি অংশের অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তৎকালীন সেনাশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের নির্দেশে গঠিত বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালের বিচারে সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়। যা ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় এই স্কেলে সামরিক কর্মীদের প্রথম গণহত্যা।

অভ্যুত্থান-পরবর্তী দুই মাস ১১০০ থেকে ১৪০০ সৈনিককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কিংবা ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা হয়েছিল। ঐ সময় শুধু ঢাকা ও কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে সৈনিকদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ঢাকায় ১২১ জন আর কুমিল্লায় ৭২ জনের মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। এ ছাড়া ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পাঁচ শতাধিক সৈনিককে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।[]

অক্টোবরের ওই অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তাঁর আ লিগ্যাসি অব ব্লাড গ্রন্থে উল্লেখ করেন,

এ সময় পরবর্তী দুই মাসে বাংলাদেশের সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী ১১৪৩ জন সৈনিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। বাংলাদেশে সে সময়ে প্রায় সকল কারাগারে গণফাঁসি দেয়ার ঘটনা ঘটেছিল। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ দেশের প্রায় সকল প্রগতিশীল সংগঠনই তখন এর প্রতিবাদ করেছিল। অভিযোগ উঠেছিল, কোনো আইনকানুনের পরোয়া না করে বিচারবহির্ভূতভাবে ফাঁসির ঘটনাগুলো ঘটানো হচ্ছিল।

১৯৭৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটন পোস্ট-এ ‘Bangladesh Executions: A Discrepancy' শিরোনামে এক প্রতিবেদনে বলা হয়,

১৯৭৮ সালের ১৯ জানুয়ারি স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠানো একটি গোপন তারবার্তায় ঢাকার আমেরিকান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স জানান, তার পাওয়া তথ্য অনুসারে ২১৭ জন মিলিটারি সদস্যকে ক্যু প্রচেষ্টার পরবর্তীকালে হত্যা করা হয়।

প্রতিবেদনটিতে আলফ্রেড ই বার্গেনসেন উল্লেখ করেন,

"আমাদের মনে হয় মিলিটারি কোর্ট স্থাপনের আগেই সম্ভবত এদের ৩০-৩৪ জনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিল।"

১৯৭৮ সালের ৫ মার্চ লন্ডনের দ্য সানডে টাইমস-এর প্রতিবেদনে বলা হয়,

গত অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০০ সেনাসদস্যের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এই রক্তগঙ্গা কেবল আংশিকভাবে উন্মোচিত হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের গত সপ্তাহের প্রতিবেদনে... বিমানবাহিনীর সাবেক এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা দ্য সানডে টাইমসকে বলেছেন, ৩০ সেপ্টেম্বর বগুড়ায়, আর ২ অক্টোবর ঢাকায় অভ্যুত্থানের পর সামরিক ট্রাইব্যুনালে ৮০০-এর অধিক সেনাসদস্যকে দণ্ডিত করা হয়েছে। সামরিক আদালতের সঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্যাঙ্গারু কোর্টের পার্থক্য খুব বেশি নয়। ঢাকায় প্রায় ৬০০ সেনাসদস্যের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে ফায়ারিং স্কোয়াডে অথবা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে।

১৯৭৮ সালের ২৫ মার্চ মুম্বাইয়ের ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলির প্রতিবেদনে বলা হয়,

যদিও অ্যামনেস্টি শুধু এটুকুই বলতে প্রস্তুত যে কমপক্ষে ১৩০ জন এবং সম্ভবত কয়েক শর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে, তবে ঢাকার কিছু ওয়াকিবহাল সূত্রের মতে এ সংখ্যা ৭০০ পর্যন্ত হতে পারে।

তৎকালীন লগ এরিয়া কমান্ডার কর্ণেল এম এ হামিদ তার 'তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা' গ্রন্থে উল্লেখ করেন,

"৩ থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত প্রতি রাতে সেনা ও বিমানবাহিনী ব্যারাক থেকে সৈনিকদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয় নির্যাতন ক্যাম্পে, তারা আর ফিরে আসেনি। সারা ক্যান্টনমেন্ট জুড়ে হাহাকার। কান্নার রোল। কত সৈনিক, বিমানসেনা ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলল, কতজন প্রাণ হারাল, 'গুপ্ত হত্যা'র শিকার হলো, এর কোনো হিসেব নেই।.....এছাড়াও ঢালাওভাবে গ্রেফতারের পর বহু সৈনিকের মৃত্যু ঘটে অমানবিক নির্যাতনে।.....সরকারি হিসাব মতেই শুধু দুই মাসে ফাঁসিতে ঝুলানো হয় ১১৪৩ জন সৈন্যকে, যার মধ্যে বিমান সেনাই ছিল ৫৬১ জন। হতভাগ্য সৈনিকদের লাশ পর্যন্ত তাদের আত্মীয়স্বজনদের দেওয়া হয়নি।.....তাদের স্বজনরা আজও খুঁজে ফেরে প্রিয়জনদের লাশ। কেউ শুনেনি তাদের ফরিয়াদ, তারা পায়নি বিচার।.....কোথায় যে এত লাশ গুম করা হলো, তা-ও এক রহস্য। এটা ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, না-কি অভ্যুত্থান, তা এখনও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। অনেকেরই ধারণা, এটা ছিল পূর্ব-পরিকল্পিত এক নিধনযজ্ঞ।"[]

কর্ণেল তাহেরের উত্থান ও মৃত্যু

জিয়া অনেক পূর্ব থেকেই সেনাবাহিনীর একজন জনপ্রিয় অফিসার, কর্নেল তাহেরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। কর্নেল তাহের সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে জাসদ-সৃষ্ট ‘গণবাহিনী’র প্রধান ছিলেন। গণবাহিনীর লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ পদ্ধতির পরিবর্তে একটি চীনা ধরনের ‘পিপলস আর্মি’ তথা ‘শ্রেণিবিহীন সেনাবাহিনী’ গঠন করা। ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বরের অভ্যুত্থানে জিয়া গৃহবন্দী হলে টেলিফোনে তাহেরকে নিজের মুক্তির জন্য সহায়তা চান।

তাহের সৈনিকদের একতাবদ্ধ করার লক্ষ্যে ১২ দফা দাবি উপস্থাপন করেন। এই ১২টি দফা মূলত সিপাহীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রণীত হয়। জিয়াকে মুক্ত করার জন্য কর্নেল তাহেরজাসদের উদ্যোগে পরিকল্পনা করা হয়: জিয়াকে মুক্ত করা, খালেদ মোশাররফের পতন ঘটানো এবং জিয়ার কাছ থেকে সিপাহীদের স্বার্থে ১২ দফার বাস্তবায়ন।

জাসদের উদ্যোগে সেনানিবাসে সহস্রাধিক লিফলেট প্রচার করা হয়। প্রচার চালানো হয় যে, খালেদ মোশাররফ ভারতের দালাল এবং ভারতের চক্রান্তে খালেদ ক্ষমতায় আরোহণ করেছেন। এ পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ সামরিক নিম্নপদস্থ সিপাহীরা জাসদের গণবাহিনীর সহায়তায় ৭ই নভেম্বর পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটায়।

বিক্ষুব্ধ সৈনিকেরা এ অভ্যুত্থানে অফিসারদের হত্যা করতে থাকে। জিয়াউর রহমানকে তার ঢাকা সেনানিবাসের গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্ত করে অভ্যুত্থানকারীরা ২য় ফিল্ড আর্টিলারির সদরদপ্তরে নিয়ে আসে।  ঐ দিন সকালেই পাল্টা অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়ায় শেরে বাংলা নগরে নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদরদপ্তরে ক্ষুব্ধ জওয়ানদের হাতে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ ,কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা এবং লেঃ কর্নেল এ টি এম হায়দার নিহত হন।

এদিকে জিয়া কর্নেল তাহেরকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করেন এবং তার (জিয়ার) জীবন রক্ষা করার জন্য তাহেরকে ধন্যবাদ জানান। জিয়া আরো বলেন, কর্নেল তাহেরজাসদের জন্য তিনি (জিয়া) জীবন দিতেও প্রস্তুত। তারপর জিয়া রাষ্ট্রপতির অনুমতি ব্যতিরেকে বেতারে ভাষণ দেন এবং নিজেই নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বলে দাবি করেন। পরে প্রতিবাদের মুখে পিছিয়ে এসে উপ-সামরিক আইন প্রশাসক হন। জিয়া ৭ই নভেম্বর ০৭:৪৫ মিনিটে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা তথা গণবাহিনীর ১২ দফা দাবিতে স্বাক্ষর করেন।

কিন্তু অভ্যুত্থানের পর থেকে পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তীত হয়ে যায়। জিয়া সৈনিকদের দাবি পূরণে অস্মীকৃতি জানাতে থাকেন। এদিকে কর্নেল তাহেরও জিয়ার উদাসীনতা দেখে ক্ষুব্ধ হন। জিয়া, তাহেরের গোপন দাবিদাওয়া মেনে নিতে অস্মীকার করেন।

সৈনিকদের দাবি পূরণে জিয়ার উদাসীনতা দেখে তারা জিয়াকে সন্দেহ করেন। ফলে সৈনিকগণ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে যায় এবং অফিসারদের বাসস্থানে প্রবেশ করে হত্যা করতে থাকে। এমন দিনগুলোতে নাটকীয়ভাবে অফিসারদের ক্যান্টনমেন্ট থেকে বোরকা পরিধান করে সপরিবারে পলায়ন করতে দেখা যেত।

বাধ্য হয়ে জিয়া সৈনিকদের ওপর দমন-পীড়ন চালাতে থাকেন। কর্নেল তাহেরকে ৭ই নভেম্বরে প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত ‘নির্বাচিত’ সরকারকে উৎখাত ও সেনাবাহিনীতে উস্কানিমুলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত করার অভিযোগে ২৪শে নভেম্বর গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করা হয়। রব, জলিল ও অন্যান্য জাসদ নেতাদেরও আটক করা হয়।

একটি প্রহসনমূলক বিচারে ২১ জুলাই, ১৯৭৬ ‘জিয়ার আদেশে’ তাহেরকে ফাঁসি দেয়া হয়। তাকে অভিযোগপত্র প্রদর্শন করা হয়নি কিংবা আত্নপক্ষ সমর্থন বা আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শেরও সুযোগ দেয়া হয়নি এবং বিচারের প্রহসন সম্পর্কে অবগত হয়েও বিচারপতি সায়েম তাহেরের মৃত্যুদণ্ডাদেশ স্থগিত করতে ব্যর্থ হন। কারণ সায়েমের নামে জিয়াই ছিলেন মূল ক্ষমতার অধিকারী। তাহেরের মৃত্যুদণ্ডের তিন দশক পর আদালত মৃত্যুদণ্ডটিকে অবৈধ এবং পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে আখ্যা দেয়।

সেনাবাহিনীতে দ্বন্দ্ব ও অসন্তোষ

জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আরোহণের পর বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত অভ্যুত্থান ও বিদ্রোহ দমনের নামে বিচার বহির্ভূতভাবে সেনাসদস্য, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুত, সাজা, নিহত অথবা গুম হওয়ার ঘটনায় সেনাবাহিনীতে অসন্তোষ তৈরি হয়। পাশাপাশি সেনাবাহিনীতে পাকিস্তান-প্রত্যাগত কর্মকর্তাদের অধিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান ও পদোন্নতি, মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে।

এই বিষয়ে সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর রেজাউল করিম রেজা বলেন,

"জিয়াউর রহমান অমুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তান ফেরত সেনা কর্মকর্তাদের বেশি সুযোগ সুবিধা বা পদ-পদন্নোতি দিয়েছেন এবং পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করেছিলেন। একারণে জেনারেল মঞ্জুর এবং কর্ণেল মতিউর রহমানসহ মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। সেনা প্রধানের পদ থেকে জেনারেল এরশাদকে অপসারণ করে জেনারেল মঞ্জুর বা অন্য কোন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে ঐ পদে নিয়োগ দেয়া এবং একইসাথে পাকিস্তান প্রত্যাগত বা অমুক্তিযোদ্ধা আরও যে কর্মকর্তারা সেনাবাহিনীর বিভিন্ন উচ্চপদে ছিলেন, তাদের সরিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের সে সব পদে নিয়ে আসার দাবি জানাচ্ছিলেন তারা।"[]

জেনারেল ইব্রাহিমও সামরিক আদালতে অভিযুক্তদের কাছ থেকে একই ধরনের তথ্য পাওয়ার কথা জানান।

তবে মেজর রেজা আরও বলেন যে, "জিয়াউর রহমানের মন্ত্রীসভায় প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমানসহ 'পাকিস্তানপন্থী' মন্ত্রীদের সরানোর দাবিও ছিল।"[]

কর্নেল (অব.) শওকত আলী লিখেছেন,

"সে (জিয়া) প্রত্যাগতদের সাথে সুসম্পর্ক রেখে চলতো। কিন্তু গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের উস্কিয়ে দিতো প্রত্যাগতদের বিরুদ্ধে। প্রত্যাগতদের মধ্যে কিছু অফিসারের আস্থা অর্জন করে অনুরূপভাবে তাদের ক্ষেপিয়ে তুলতো মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে। চুয়াত্তরের প্রথম দিকের কথা। পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত পুরাতন বন্ধুদের সাথে আমার বন্ধুত্ব অক্ষুণ্ন ছিল। তাদের সাথে মেলামেশা জিয়ার চোখ এড়ায় নি। একদিন সে তার অফিসে এক প্রত্যাগতের নাম উল্লেখ করে বলল, তার সাথে তোমার এত ঘনিষ্ঠতা কেনো ? বললাম, সে আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু।... জিয়া গম্ভীর হয়ে বলল, ‘শওকত, কোন প্রত্যাগত অফিসার তোমার বন্ধু হতে পারে না। তোমার মত একজন মুক্তিযোদ্ধার পাকিস্তানীদের সাথে ঘনিষ্ঠ রাখা ঠিক নয়’। হঠাৎ করে আমি যেন দিব্যদৃষ্টি পেলাম। সেনাবাহিনীতে তখন যে সকল ঘটনা ঘটেছিল আমার কাছে তার অনেক কারণ পরিষ্কার হয়ে উঠলো। অবশ্য আমি আগেও কিছু কিছু জানতাম। কিন্তু জিয়া আমার কাছে ধরা দেবে তা আশা করি নি। আমি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বললাম, ‘স্যার, আমি দুঃখিত। আপনার সাথে একমত হতে পারছিনা।... অনুগ্রহ করে আপনি খেলা বন্ধ করুন। জাতীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করে সেনাবাহিনীতে বিভেদ সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকুন। আপনি সেনা বাহিনীর উপপ্রধান। আপনি যদি এ ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক কাজে লিপ্ত হন, তাহলে আমাদের জুনিয়রগণ কী করবে’? কথাগুলো বলে আমি চলে আসি। কড়া কথা ইচ্ছে করেই বলেছিলাম। এজন্য অবশ্য আমাকে ব্যক্তিগতভাবে অনেক খেসারত দিতে হয়েছে।... পরবর্তীকালে ক্ষমতার শীর্ষে বসে জিয়াউর রহমান আমার বিরুদ্ধে যেসব হয়রানিমূলক পদক্ষেপ নেয়, তার জের এখনো চলছে।"

Remove ads

ষড়যন্ত্র

বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ গ্রন্থে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস উল্লেখ করেন, সেনা কর্মকর্তা কর্ণেল মতিউর রহমান "জিয়া এবং ঢাকার সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের অপছন্দ করতেন। তিনি দেশকে ধ্বংসকারী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পচনের জন্য তাদের দায়ী করেন"। ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বরে মতিউর লে. কর্নেল মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনের সাথে দেখা করেন এবং 'সরকারীদল ও সরকারের - সামাজিক অবিচার, দুর্নীতি এবং উচ্চমূল্য' সম্পর্কে তাকে অভিযোগ করেন।[]

১৯৮১ সালের ২৫ মে মতিউর ঢাকা সফর করছিলেন, যেখানে তিনি তার বন্ধু লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহফুজুরের সাথে দেখা করেছিলেন। এ সময় মাহফুজুর জিয়ার ব্যক্তিগত স্টাফ অফিসার (সচিব) ছিলেন। মাহফুজুর মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুরকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করার বিষয়ে জিয়ার পরিকল্পনার কথা মতিউরকে অবহিত করেন। এই সংবাদে মতিউর ক্ষুব্ধ হন। বিচারে উপস্থাপিত প্রমাণ অনুযায়ী মতিউর ও মাহফুজুর জিয়াকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেন। মাসকারেনহাস উল্লেখ করেন, "যখন মাফুজুর মতিকে (মতিউর) জানান যে জিয়া ২৯ তারিখে চট্টগ্রামে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখন হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।"[১০]

Remove ads

ঘটনাপ্রবাহ

সারাংশ
প্রসঙ্গ

১৯৮১ সালের ২৯ মে রাত ১১:৩০ টায়, কর্নেল মতিউর রহমান বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার সাথে একটি বৈঠকের আয়োজন করেন।[১১] ৩০ মে রাত ২:৩০ টায় ষড়যন্ত্রকারীরা নিজেদের তিনটি দলে বিভক্ত করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম দুটি দল সার্কিট হাউসে আক্রমণ করবে, যেখানে জিয়া অবস্থান করছিলেন এবং তৃতীয় দলটি পালানোর চেষ্টাকারীদের গুলি করবে। দলগুলো সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত ছিল কারণ তালিকাভুক্ত কর্মীরা অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিল। এ আক্রমণে ১৬ জন অফিসার জড়িত ছিলেন। তাদের এগারটি সাবমেশিন গান, তিনটি রকেট লাঞ্চার এবং তিনটি গ্রেনেড ফায়ারিং রাইফেল ছিল। আক্রমণকারীদের সকলেই ছিলেন কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার।[১২]

সার্কিট হাউস

৩০শে মে ভোরে জিয়া চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অবস্থান করছিলেন। ভোর ৪টায় সেনাবাহিনীর অফিসারদের তিনটি দল চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ আক্রমণ করে। আক্রমণকারী দলের মূল হোতা লে. কর্নেল মতিউর রহমান, লে. কর্নেল মাহবুব, মেজর খালেদ, এবং লে. কর্নেল ফজলে হোসেন সার্কিট হাউজে রকেট নিক্ষেপ করে ভবনের দেয়ালে দুটি গর্ত সৃষ্টি করার মাধ্যমে আক্রমণ শুরু করেন। আক্রমণের সময় জিয়াউর রহমানের বেশ কয়েকজন রক্ষী নিহত হন।[১৩]

হত্যাকাণ্ড

অফিসাররা সার্কিট হাউসের কক্ষগুলোতে জিয়াউর রহমানকে খুঁজতে থাকেন। মেজর মোজাফফর এবং ক্যাপ্টেন মোসলেহ উদ্দিন সর্বপ্রথম জিয়াকে খুঁজে পান। মোসলেহ উদ্দিন জিয়াকে জানান যে, তাকে তাদের সাথে সেনানিবাসে যেতে হবে। এরপর কর্নেল মতিউর রহমান আরেকটি দল নিয়ে উপস্থিত হন এবং জিয়াকে অনেক কাছ থেকে একটি এসএমজি দিয়ে গুলি করে।[১৪]

জিয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যাওয়ার পর মতিউর জিয়ার মুখমন্ডল ও ধড়ে গুলি চালিয়ে তাকে বিকৃত করে। এতে তার একটি চোখ বেড়িয়ে পড়েছিল বলে জানা যায়। সার্কিট হাউসে হামলা ২০ মিনিটেরও কম সময় স্থায়ী হয়। জিয়াকে হত্যার পর আক্রমণকারীরা চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ফিরে আসে। জিয়াউর রহমানসহ তার দুই রক্ষী, কর্নেল আহসান এবং ক্যাপ্টেন হাফিজের মরদেহ একটি সামরিক পিকআপ ভ্যানে তুলে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়।[১৩]

ফলাফল

সারাংশ
প্রসঙ্গ
Thumb
রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা ইউনিয়নে জিয়াউর রহমানের প্রথম সমাধিস্থল

১৯৮১ সালের ৩০শে মে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর চট্টগ্রাম শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয় অভ্যুত্থানকারীরা।[১৫] জারি করা হয় সান্ধ্য আইন। জেনারেল মঞ্জুর চট্টগ্রাম থেকে বাংলাদেশ বেতারে ভাষণ দেন। সেই ভাষণে জেনারেল মঞ্জুর জেনারেল এরশাদকে সেনা প্রধানের পদ থেকে বরখাস্ত এবং জেনারেল মীর শওকত আলীকে সেনা প্রধান হিসাবে ঘোষণা দেন। এছাড়া বিপ্লবী পরিষদ গঠনের ঘোষণা দিয়ে জেনারেল মঞ্জুর সেনা বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানান।[১৬]

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চীফ অব আর্মি স্টাফ লেঃ জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনুগত থাকেন এবং মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুরের নেতৃত্বে জিয়ার সহযোগীদের দ্বারা সংগঠিত অভ্যুত্থান দমন করার জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন।[১৭] সরকার বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দিয়ে সময়সীমা প্রদান করে। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অপারেশনে অংশগ্রহণকারী অফিসাররা এবং অধিকাংশ সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। নেতৃত্ব প্রদানকারী অফিসাররা সহ জিওসি মঞ্জুর পার্বত্য চট্টগ্রামে পালানোর চেষ্টা করেন। পথিমধ্যে সরকার প্রেরিত বাহিনী কর্তৃক তারা গ্রেফতার হন। কর্নেল মতিউর রহমান এবং লে. কর্নেল মাহবুব (২১ ইস্ট বেঙ্গলের প্রধান, মঞ্জুরের ভাগ্নে) মেজর মান্নান (পাকিস্তান ফেরত অফিসার, ১২ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়নের ২আইসি) কর্তৃক নিহত হন।[১৫]

জেনারেল মঞ্জুর তার স্ত্রী ও সন্তানদের খাওয়ানো অবস্থায় ফটিকছড়ির একটি চা বাগানের জীর্ণ কুটিরে পুলিশ ইন্সপেক্টর গোলাম কুদ্দুসের হাতে ধরা পড়েন। পুলিশ ইন্সপেক্টর গোলাম কুদ্দুস তাকে গ্রেফতার করে হাটহাজারী থানায় নিয়ে যায়। সেখানে তিনি একজন আইনজীবীর জন্য আবেদন করলে তা নাকচ করে দেওয়া হয়। তিনি বারবার পুলিশের হেফাজতে থেকে চট্টগ্রামে জেলে প্রেরিত হওয়ার জন্য আবেদন করতে থাকেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন পুলিশের হেফাজত থেকে নিষ্কৃতি পেলেই সেনাবাহিনী তাকে হত্যা করবে। কিন্তু যখন তাকে পুলিশ ভ্যানে উঠানো হয়, তখন সেনাবাহিনী একটি দল থানায় উপস্থিত হয়। কিছুক্ষণ বিতর্কের পর ক্যাপ্টেন্ এমদাদ জেনারেল মঞ্জুরের হাত-পা বেঁধে প্রায় টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুলে চট্টগ্রাম অভিমুখে রওয়ানা হয়। পরবর্তীতে কী ঘটেছিল তা সরকার কখনো প্রকাশ করেনি। তবে সরকারের রেডিও-টেলিভিশনে ঘোষিত হয়- চট্টগ্রাম সেনানিবাসে একদল উচ্ছৃঙ্খল সৈন্যের হাতে জেনারেল মঞ্জুর নিহত হয়েছেন।[১৫]

মঞ্জুরের মৃত্যুর কারণ হিসেবে সর্বপ্রথম ক্ষুদ্ধ সৈন্যদের দেখানো হলেও তার ময়নাতদন্তে বের হয়ে আসে মঞ্জুরের মৃতুর কারণ ছিল পেছন দিক দিয়ে মাথায় করা একটি গুলি। ফলে মঞ্জুরের মৃত্যুর বিষয়টি রহস্যাবৃত হয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম বিদ্রোহের অন্যান্য পরিকল্পনাকারীদের সামরিক আদালতে বিচারের আওতায় আনা হয় এবং জেল ও ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। ১৯৯৫ সালে মঞ্জুরের বড় ভাই জেনারেল এরশাদসহ বেশ কয়েকজনকে মঞ্জুর হত্যায় দায়ী করে মামলা দায়ের করে।[১৮]

জিয়ার হত্যাকাণ্ডের পরে চট্টগ্রাম ও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।[১৫] তিনি ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেও ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ এরশাদ কর্তৃক সংঘটিত এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে অপসারিত হন।

১২ জন অফিসার মুক্তিযোদ্ধাকে জিয়া হত্যাকাণ্ডে তথাকথিত ভূমিকার জন্য সামরিক আদালতে মাত্র ১৮ দিনের দ্রুত বিচারকার্যে ফাঁসি দেওয়া হয়। ১৩তম মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে চট্টগ্রামে ৩০শে মের ঘটনাপ্রবাহে বুলেটের আঘাতে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন থাকার জন্য দুই বছর পরে ফাঁসি দেওয়া হয়। অন্যান্য আক্রমণকারীদের মধ্যে মেজর খালেদ এবং মেজর মোজাফফর পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও ক্যাপ্টেন মোসলেহ উদ্দিন গ্রেফতার হন এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা লাভ করেন। তবে ২০১০ সাল পর্যন্ত পাওয়া তথ্যানুযায়ী তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। ক্যাপ্টেন (অব.) গিয়াসউদ্দিন আহমেদ পরবর্তীতে ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ২০২২ সালে বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন।[১৫]

Remove ads

কোর্ট মার্শাল

সারাংশ
প্রসঙ্গ

সামরিক ট্রাইবুনালে জিয়া হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে ১৮ জন অফিসারকে অভিযুক্ত করা হয়। এদের মধ্যে ১৩ জন মৃত্যদণ্ড এবং বাকি ৫ জন বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড লাভ করেন। এ অফিসারদের ১৯৮১ সালের ১লা থেকে ৩রা জুনের মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছিল। মেজর জেনারেল আবদুর রহমানের সভাপতিত্বে ১০ই জুলাই ১৯৮১ থেকে ২৮শে জুলাই ১৯৮১ পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলে সামরিক আদালতের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। রায় অনুযায়ী ১২ জন অফিসারের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। পাকিস্তান-ফেরত অফিসার মেজর জেনারেল আবদুর রহমানকে পরবর্তীতে ১৯৮৩/৮৪ সালে ফ্রান্সে রাষ্ট্রদূত হিসেবে প্রেরণ করা হয় এবং সেখানেই তিনি রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। জেনারেল রহমানের পরিবারের দাবি- তার মৃত্যুর সাথে বাংলাদেশ সরকার জড়িত।[১৯]

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ

  1. ব্রিগেডিয়ার মহসিন উদ্দিন আহমেদ
  2. কর্নেল এম আব্দুর রশীদ
  3. লেঃ কর্নেল এওয়াইএম মাহফুজুর রহমান
  4. লেঃ কর্নেল এম দেলোয়ার হোসেন
  5. লেঃ কর্নেল শাহ মোঃ ফজলে হোসেন
    (শারীরিকভাবে অক্ষম থাকা সত্ত্বেও ১৯৮৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়)
  6. মেজর এজেড গিয়াসউদ্দীন আহমেদ
  7. মেজর রওশন ইয়াজদানী ভূঁইয়া
  8. মেজর কাজী মোমিনুল হক
  9. মেজর এম মজিবুর রহমান
  10. ক্যাপ্টেন মোঃ আব্দুস সাত্তার
  11. ক্যাপ্টেন জামিল হক
  12. লেঃ রফিকুল হাসান খান, মাত্র ২৩ বছর বয়সে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় (রফিক দাবি করেন তিনি উপর মহলের আদেশে এ বিদ্রোহ সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকা সত্ত্বেও অংশগ্রহণ করেন)।

এই ১২ জন অফিসারের পক্ষের আইনজীবীরা বিচারের সময় আত্মপক্ষ সমর্থনের সামান্যতম সুযোগ না পাওয়ায় পরবর্তীতে বিচারকার্যটিকে "প্রহসনমূলক বিচার" বলে দাবি করেন।[১৫]

কারাদণ্ডপ্রাপ্ত

  1. লেঃ মোসলেহ উদ্দীন। (যাবজ্জীবন কারাদন্ড)

(এই অফিসারটি ব্রিগেডিয়ার মহসিনের ভাই ছিলেন, মহসিনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও তাকে দেওয়া হয়নি।)

বহিষ্কৃত অফিসারগণ

নিম্নলিখিত অফিসাররা সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত হন।[২০]

  1. ব্রিগেডিয়ার আবু সৈয়দ মতিউল হান্নান শাহ
  2. ব্রিগেডিয়ার একেএম আজিজুল ইসলাম
  3. ব্রিগেডিয়ার গিয়াস উদ্দীন আহমেদ চৌধুরী (বীর বিক্রম)
  4. ব্রিগেডিয়ার আবু জাফর আমিনুল হক (বীর বিক্রম)
  5. কর্নেল মোঃ বজলুল গনি পাটোয়ারী (বীর প্রতিক)
  6. লেঃ কর্নেল এএস এনামুল হক
  7. লেঃ কর্নেল মোঃ জয়নাল আবেদিন
  8. লেঃ কর্নেল মোঃ আব্দুল হান্নান (বীর প্রতিক)
  9. মেজর মঞ্জুর আহমেদ (বীর প্রতিক)
  10. মেজর ওয়াকার হাসান (বীর প্রতিক)
  11. মেজর মোঃ আব্দুল জলিল
  12. মেজর রফিকুল ইসলাম
  13. মেজর মোঃ আব্দুস সালাম
  14. মেজর একেএম রেজাউল ইসলাম (বীর প্রতিক)
  15. মেজর মোঃ আসাদুজ্জামান
  16. ক্যাপ্টেন জহিরুল হক খান (বীর প্রতিক)
  17. ক্যাপ্টেন মাজহারুল হক
  18. ক্যাপ্টেন এএসএম আব্দুল হাই
  19. ক্যাপ্টেন ইলিয়াস (ব্রিগেডিয়ার মোহসিনের সঙ্গে রাজশাহী জেলে ছিলেন)
  20. লেঃ আবুল হাসেম
Remove ads

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

Loading related searches...

Wikiwand - on

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.

Remove ads