শীর্ষ প্রশ্ন
সময়রেখা
চ্যাট
প্রসঙ্গ
শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা
পবিত্র হিন্দু ধর্মগ্রন্থ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
Remove ads
ভগবদ্গীতা (সংস্কৃত: भगवद्गीता) বা গীতা বা শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা সাতশত শ্লোকের ধর্মগ্রন্থ। তাই একে সপ্তশতী বলা হয়। এটি সংস্কৃত মহাকাব্য মহাভারত-এর অংশ। এটি ভীষ্মপর্ব নামে মহাভারতের ষষ্ঠ পর্বের ২৩-৪০ অধ্যায়ে গঠিত। এই গ্রন্থটি খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের দ্বিতীয়ার্ধে রচিত।[১] গীতা স্বতন্ত্র ধর্মগ্রন্থ তথা পৃথক শাস্ত্র এর মর্যাদা পেয়ে থাকে। হিন্দুরা গীতাকে শ্রীভগবানের মুখনিঃসৃত বাণী মনে করেন। মানবধর্ম, দর্শন ও সাহিত্যের ইতিহাসে গীতা এক বিশেষ স্থানের অধিকারী।[২] গীতার কথক কৃষ্ণ হিন্দুদের দৃষ্টিতে ঈশ্বরের অবতার পরমাত্মা স্বয়ং।[২] তাই গীতায় তাঁকে বলা হয়েছে "শ্রীভগবান"।[৩]
গীতার বিষয়বস্তু কৃষ্ণ ও পাণ্ডব রাজকুমার অর্জুনের কথোপকথন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু ঠিক আগে শত্রুপক্ষে আত্মীয়, বন্ধু ও গুরুকে দেখে অর্জুন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। এই সময় কৃষ্ণ তাঁকে ক্ষত্রিয় যোদ্ধার ধর্ম স্মরণ করিয়ে দিয়ে এবং বিভিন্ন প্রকার যোগশাস্ত্র ও বৈদান্তিক দর্শন ব্যাখ্যা করে তাঁকে যুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করেন। তাই গীতাকে বলা হয় মানব ধর্মতত্ত্বের সংক্ষিপ্ত পাঠ এবং হিন্দুদের জীবনচর্যার ব্যবহারিক পথনির্দেশিকা। যোগশাস্ত্র ব্যাখ্যার সময় কৃষ্ণ নিজের স্বয়ং ভগবান রূপটি উন্মোচিত করেন এবং বিশ্বরূপে অর্জুনকে দর্শন দিয়ে আশীর্বাদ করেন। এই বিশ্বরূপ দর্শনের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে অর্জুনের প্রতিক্রিয়া নির্দেশ করেছেন ভাদুড়ী মহাশয়- মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ :
"অগ্রে অর্জুন ভগবানকে তাঁহারই মত একজন মানুষ মনে করিয়াছিলেন। কিন্তু এইরূপ দেখিয়া যখন অর্জুনের ভ্রমজ্ঞান তিরোহিত হইল, তখন তিনি তাঁহাকে ‘পুরাণ পুরুষ’ ‘আদি পুরুষ’ বলিয়া সম্বোধন করিলেন।"
- বাস্তবে এখানেই নিহিত বিশ্বরূপ দর্শনের তাৎপর্য।
অর্জুন ছাড়া প্রত্যক্ষভাবে কৃষ্ণের মুখ থেকে গীতা শুনেছিলেন সঞ্জয় (তিনি যুদ্ধের ঘটনা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে বর্ণনা করার জন্য বেদব্যাসের কাছ থেকে দিব্য দৃষ্টি লাভ করেছিলেন), হনুমান (তিনি অর্জুনের রথের চূড়ায় বসে ছিলেন) ও ঘটোৎকচের পুত্র বর্বরীক যিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সব ঘটনা দেখেছিলেন।
গীতাকে গীতোপনিষদ বলা হয়। অর্থাৎ, গীতা উপনিষদ্ বা বৈদান্তিক সাহিত্যের অন্তর্গত।[৫] "উপনিষদ্" নামধারী ধর্মগ্রন্থগুলো শ্রুতিশাস্ত্রের অন্তর্গত হলেও, মহাভারতের অংশ বলে গীতা স্মৃতিশাস্ত্রের অন্তর্গত।[৬][৭] আবার উপনিষদের শিক্ষার সারবস্তু গীতায় সংকলিত হয়েছে বলে একে বলা হয় "উপনিষদ্সমূহের উপনিষদ্"।[৮] গীতাকে মোক্ষশাস্ত্র নামেও অভিহিত করা হয়।[৯]
ভারতীয় মনীষীদের পাশাপাশি অ্যালডাস হাক্সলি, জে. রবার্ট ওপেনহাইমার,[১০] রালফ ওয়াল্ডো এমারসন, কার্ল জাং, হেনরিক হিমার ও হারমান হেস, বিজ্ঞানী দেবদূত শেঠ প্রমুখ পাশ্চাত্য মনীষীরাও গীতার উচ্চ প্রশংসা করেছেন।[৮][১১]
Remove ads
নামব্যুৎপত্তি
ভগবদ্গীতার গীতা অর্থ "গান।" ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও পণ্ডিতগণ ভগবদ শব্দটিকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেন। তদনুসারে, ভগবদ্গীতাকে আধ্যাত্মিক দর্শনসমূহের পণ্ডিতগণ "ভগবান বা ঈশ্বরের বাণী" "প্রভুর বাণী" "ঐশ্বরিক গীতিকা" বলে ব্যাখ্যা করেন,[১২][১৩][১৪] কেউ বা "স্বর্গীয় গীত" বলে থাকেন৷[১৫]
ভারতবর্ষে প্রায়শই সংস্কৃত "श्रीमद्भगवद्गीता" নামটি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, শ্রীমদ্ ভগবদ্গীতা (বা একক শব্দ “ভগবদ্গীতা” “भगवद्गीता”) হিসেবে লেখা হয়। এখানে শ্রীমদ্ উপসর্গটি " শ্রদ্ধার উচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত " বা "প্রশংসনীয়" বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। বিশেষ উল্লেখ্য এই যে, ভাগবত বা শ্রীমদ্ভাগবতকে ভগবদ্গীতা ভ্রমে বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয়। ভাগবত একটি পুরাণ যাতে হিন্দু দেবতা কৃষ্ণ ও বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতার ও ভক্তদের কথা রয়েছে।
ভগবদ্গীতাকে ঈশ্বর গীতা, অনন্ত গীতা, হরি গীতা, ব্যাস গীতা বা গীতাও বলা হয়।[১৬]
Remove ads
রচনা
ভগবদ্গীতার ঐতিহাসিক পাণ্ডুলিপির ১ম, ২য় ও ৩য় অধ্যায়ের মুখ্য পৃষ্ঠা। উপরে: বাংলা লিপি; নীচে: গুরুমুখী লিপি।
যেহেতু বেদব্যাস মহাভারত রচনা করেছিলেন বলে মনে করা হয়, সেহেতু মহাভারতের অংশরূপে গীতাও তার দ্বারাই রচিত বলে ধারণা করা হয়।[১৭] ভগবদ্গীতার রচনাকাল সম্বন্ধে অনেক রকম মতামত রয়েছে। ঐতিহাসিকেরা এই গ্রন্থের রচনাকাল হিসেবে খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম থেকে দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত যে কোন সময়ের মধ্যে হতে পারে বলে অনুমান করেছেন। অধ্যাপক জিনিন ফাউলারের মতে এই গ্রন্থের রচনাকাল খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী বলে মনে করলেও,[১৮] গীতা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ কাশীনাথ উপাধ্যায় মহাভারত, ব্রহ্ম সূত্র ও অন্যান্য গ্রন্থ পর্যালোচনা করে প্রমাণ যে, গীতা খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম থেকে চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে রচিত হয়েছিল।[১৯]
অষ্টাদশ শতকের পূর্বপর্যন্ত গীতা মহাভারতের অংশ হতে পৃথক ছিলনা। তবে শঙ্করাচার্য ৭৮৮-৮২০ খ্রিস্টাব্দের মাঝে গীতার ভাষ্য রচনা করেন। ১৮৭৫ সালের পূর্বপর্যন্ত বিভিন্ন মতের আরও ৫০জন গীতার ভাষ্য ও অনুবাদ করেন। ঔপনিবেশিক শাসনের প্রথম ভাগে কম্পানির অর্থায়নে চার্লস উইলকিন্স মহাভারতের ভীষ্ম পর্বের, ২৫তম অধ্যায় হতে ৪২তম অধ্যায় পর্যন্ত ১৮টি অধ্যায়কে আলাদা করে ‘Dialogues of Kreeshna and Arjoon in Eighteen Lectures with Notes’ নামে প্রথম ইংরেজি ভাষায় প্রকাশ করেন৷[২০]
Remove ads
পাঠের রীতি
ভগবদ্গীতা বা গীতা পাঠের ক্ষেত্রে সুর, তাল এবং লয়ের বিশেষ ব্যবহার প্রচলিত। ১৮৯৫ সালের জুলাই মাসে ভাদুড়ী মহাশয়- মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ-এর সঙ্গে সাক্ষাতে এসে নাড়াজোলের রাজা মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের বিদ্যালয়ের ছাত্রদের মুখে সুর, তাল, লয় সহযোগে গীতা পাঠ শুনে মন্তব্য করেন :
"আমি কখনও এরূপ মধুর সুরে গীতার আবৃত্তি শুনি নাই। এখন বুঝিতেছি গীতার শ্লোকগুলি গীত হয় বলিয়া ইহার নাম গীতা হইয়াছে।"
- বাস্তবে গীতার সঙ্গে যে গীতের সম্পর্ক আছে তা অনস্বীকার্য। তবে এক্ষেত্রে রীতিগত কিছু বৈচিত্র্য আছে। কারণ বিষয়টি পুরোপুরি গুরুমুখী বিদ্যা হিসেবেই নির্দেশিত।
সমালোচনা
উনিশ শতকের হিন্দু সন্ন্যাসী ও বেদান্তবাদী স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ভগবদ্গীতা হয়তো বা পুরাতন। তবে অষ্টম শতকের প্রথম দিকে ভারতীয় ইতিহাসে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি অজ্ঞাত ছিল। শঙ্করাচার্য তার বহুল অনুসৃত টীকাখানি রচনা করে ভগবদ্গীতা কে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন।[২১][২২] কেউ কেউ অনুমান করেন, বিবেকানন্দ বলেছেন, "শঙ্করাচার্য ছিলেন গীতার রচয়িতা। তিনিই এটিকে মহাভারতে সংযুক্ত করেন।"[২১] তবে আদি শঙ্করের প্রতি আরোপিত এই অনুমানটি অসম্ভব কারণ শঙ্কর স্বয়ং ভগবদ্গীতার পূর্ববর্তী ভাষ্যসমূহের উল্লেখ করেছেন। কারণ অপরাপর হিন্দু শাস্ত্র ও সংস্কৃতি যা শঙ্কর দর্শনের বিরোধিতা করে তাতে ভগবদ্গীতাকে উদ্ধৃতকারী অনেক প্রাচীন পুস্তকের উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও এই প্রাচীন আনুষঙ্গিক পুঁথির অধিকাংশই অধুনা বিলুপ্ত।[২১]
Remove ads
গীতাধ্যায়
সারাংশ
প্রসঙ্গ
গীতা ৭০০টি শ্লোক নিয়ে ১৮টি অধ্যায়ে বিভক্ত।
অধ্যায় | অধ্যায়ের নাম | শ্লোক |
১ | অর্জুন বিষাদ যোগ | ৪৭ |
২ | সাংখ্য যোগ | ৭২ |
৩ | কর্ম যোগ | ৪৩ |
৪ | জ্ঞান-কর্ম-সন্ন্যাস যোগ | ৪২ |
৫ | কর্ম-সন্ন্যাস যোগ | ২৯ |
৬ | আত্ম-সংযম যোগ | ৪৭ |
৭ | জ্ঞান-বিজ্ঞান যোগ | ৩০ |
৮ | অক্ষর-পরব্রহ্ম যোগ | ২৮ |
৯ | রাজ-বিদ্যা-রাজ-গুহ্য যোগ | ৩৪ |
১০ | বিভূতি যোগ | ৪২ |
১১ | বিশ্বরূপ-দর্শন যোগ | ৫৫ |
১২ | ভক্তি যোগ | ২০ |
১৩ | ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ-বিভাগ যোগ | ৩৪ |
১৪ | গুণত্রয়-বিভাগ যোগ | ২৭ |
১৫ | পুরুষোত্তম যোগ | ২০ |
১৬ | দৈবাসুর-সম্পদ-বিভাগ যোগ | ২৪ |
১৭ | শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ যোগ | ২৮ |
১৮ | মোক্ষ-সন্ন্যাস যোগ | ৭৮ |
সর্বমোট | ৭০০ |
- ১ অর্জুন বিষাদ-যোগ:
কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে সেনা-পর্যবেক্ষণ: রণাঙ্গনে প্রতীক্ষমাণ সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয়ে, মহাযোদ্ধা অর্জুন উভয় পক্ষের সৈন্যসজ্জার মধ্যে সমবেত তার অতি নিকট আত্মীয়-পরিজন, আচার্যবর্গ ও বন্ধু-বান্ধবদের সকলকে যুদ্ধে প্রস্তুত হতে এবং জীবন বিসর্জনে উন্মুখ হয়ে থাকতে দেখেন। শোকে ও দুঃখে তার মন মোহাচ্ছন্ন হল এবং তিনি যুদ্ধ করার সংকল্প পরিত্যাগ করেন।
- ২ সাংখ্য যোগ কৃষ্ণের কাছে তার শিষ্যরূপে অর্জুন আত্মসমর্পণ করেন এবং অনিত্য জড় দেহ ও শাশ্বত চিন্ময় আত্মার মূলগত পার্থক্য নির্ণয়ের মাধ্যমে অর্জুনকে কৃষ্ণ উপদেশ প্রদান করতে শুরু করেন। দেহান্তর প্রক্রিয়া, পরমেশ্বরের উদ্দেশ্যে নিঃস্বার্থ সেবার প্রকৃতি এবং আত্মজ্ঞানলব্ধ মানুষের বৈশিষ্ট্যাদি সম্পর্কে কৃষ্ণ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন।
- ৩ কর্মযোগ
এই জড় জগতে প্রত্যেককেই কোনও ধরনের কাজে নিযুক্ত থাকতে হয়। কিন্তু কর্ম সকল মানুষকে এই জগতের বন্ধনে আবদ্ধ করতেও পারে, আবার তা থেকে মুক্ত করে দিতেও পারে। স্বার্থচিন্তা ব্যতিরেকে, পরমেশ্বরের সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে কাজের মাধ্যমে, মানুষ তার কাজের প্রতিক্রিয়া জনিত কর্মফলের বিধিনিয়ম থেকে মুক্তি পেতে পারে এবং আত্মতত্ত্ব ও পরমতত্ত্ব দিব্যজ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হয়।
- ৪ জ্ঞানযোগ
আত্মার চিন্ময় তত্ত্ব, ভগবৎ-তত্ত্ব এবং ভগবান ও আত্মার সম্পর্ক -এই সব অপ্রাকৃত তত্ত্বজ্ঞান বিশুদ্ধ ও মুক্তিপ্রদায়ী। এই প্রকার জ্ঞান হচ্ছে নিঃস্বার্থ ভক্তিমূলক কর্মের (কর্মযোগ) ফলস্বরূপ। পরমেশ্বর ভগবান গীতার সুদীর্ঘ ইতিহাস, জড় জগতে যুগে যুগে তার অবতরণের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য এবং আত্মজ্ঞানলব্ধ গুরুর সান্নিধ্য লাভের আবশ্যকতা ব্যাখ্যা করেছেন।
- ৫ সন্ন্যাস-যোগ
বহিঃবিচারে সকল কর্তব্যকর্ম সাধন করলেও সেগুলির কর্মফল পরিত্যাগ করার মাধ্যমে, জ্ঞানবান ব্যক্তি পারমার্থিক জ্ঞানতত্ত্বের অগ্নিস্পর্শে পরিশুদ্ধি লাভ করে থাকেন, ফলে শান্তি, নিরাসক্তি, চিন্ময় অন্তর্দৃষ্টি এবং শুদ্ধ আনন্দ লাভ করেন।
- ৬ ধ্যানযোগ
নিয়মতান্ত্রিক ধ্যানচর্চার মাধ্যমে অষ্টাঙ্গযোগ অনুশীলন মন ও ইন্দ্রিয় আদি দমন করে এবং অন্তর্যামী পরমাত্মার চিন্তায় মনকে নিবিষ্ট রাখে।এই অনুশীলনের পরিণামে পরমেশ্বরের পূর্ণ ভাবনারূপ সমাধি অর্জিত হয়।
নিষ্কাম সেবা
—ভগবদ্গীতা, ৬/১।
- ৭ জ্ঞান-বিজ্ঞানযোগ
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমতত্ত্ব, সর্বকারণের পরম কারণ এবং জড় ও চিন্ময় সর্ববিষয়ের প্রাণশক্তি। উন্নত জীবাত্মাগণ ভক্তি ভরে তার কাছে আত্মসমর্পণ করে থাকেন, পক্ষান্তরে অধার্মিক জীবাত্মারা অন্যান্য বিষয়ের ভজনায় তাদের মন বিক্ষিপ্ত করে থাকে।
- ৮ অক্ষরব্রহ্মযোগ
আজীবন কৃষ্ণের চিন্তার মাধ্যমে এবং বিশেষ করে মৃত্যুকালে তাকে স্মরণ করে, মানুষ জড় জগতের ঊর্ধ্বে ভগবানের পরম ধাম লাভ করতে পারে।
- ৯ রাজবিদ্যা-রাজগুহ্য যোগ কৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান এবং পরমারাধ্য বিষয়। অপ্রাকৃত ভগবত-সেবার মাধ্যমে জীবাত্মা মাত্রই তার সাথে নিত্য সম্বন্ধযুক্ত। মানুষের শুদ্ধ ভক্তি পুনরুজ্জীবিত করার ফলে শ্রীকৃষ্ণের পরম ধামে প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব।
- ১০ বিভূতি যোগ
জড় জগতের বা চিন্ময় জগতের শৌর্য, শ্রী, আড়ম্বর, উতকরশ-সমস্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় কৃষ্ণের দিব্য শক্তি ও পরম ঐশ্বর্যাবলির আংশিক প্রকাশ মাত্র অভিব্যক্ত হয়ে আছে। সর্বকারণের পরম কারণ, সর্ববিষয়ের আশ্রয় ও সারাতিসার রূপে কৃষ্ণ সর্বজীবেরই পরমারাধ্য বিষয়।
- ১১ বিশ্বরূপ দর্শন যোগ কৃষ্ণ অর্জুনকে দিব্যদৃষ্টি দান করেন এবং সর্বসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষক তার অনন্ত বিশ্বরূপ প্রকাশ করেন। এভাবেই তিনি তার দিব্যতত্ত্ব অবিসংবাদিতভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। কৃষ্ণ প্রতিপন্ন করেছেন যে, তার স্বীয় অপরূপ সৌন্দর্যময় মানবরূপী আকৃতিই ভগবানের আদিরূপ। একমাত্র শুদ্ধ ভগবত-সেবার মাধ্যমেই মানুষ এই রূপের উপলব্ধি অর্জনে সক্ষম।
- ১২ ভক্তিযোগ
চিম্নয় জগতের সর্বোত্তম প্রাপ্তি বিশুদ্ধ কৃষ্ণপ্রেম লাভের পক্ষে ভক্তিযোগ বা কৃষ্ণের উদ্দেশ্য শুদ্ধ ভক্তি হচ্ছে সর্বোত্তম পন্থা। যারা এই পরম পন্থার বিকাশ সাধনে নিয়োজিত থাকেন, তারা দিব্য গুণাবলীর অধিকারী হন।
- ১৩ ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ-বিভাগ যোগ
দেহ, আত্মা এবং উভয়েরও ঊর্ধ্বে পরমাত্মার পার্থক্য যিনি উপলব্ধি করতে পারেন, তিনিই এই জড় জগৎ থেকে মুক্তি লাভে সক্ষম হন।
- ১৪ গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ
সমস্ত দেহধারী জীবাত্মা মাত্রই সত্ত্ব, রজ ও তম—জড়া প্রকৃতির এই ত্রিগুণের নিয়ন্ত্রণাধীন। পরমেশ্বর কৃষ্ণ এই ত্রিগুণাবলির স্বরূপ, আমাদের ওপর সেগুলির ক্রিয়াকলাপ, মানুষ কীভাবে সেগুলিকে অতিক্রম করে এবং যে মানুষ অপ্রাকৃত স্তরে অধিষ্ঠিত তার লক্ষণাবলী ব্যাখ্যা করেছেন।
- ১৫ পুরুষোত্তম-যোগ
বৈদিক জ্ঞানের চরম উদ্দেশ্য হচ্ছে জড়-জাগতিক বন্ধন থেকে মানুষের মুক্তি লাভ এবং পরম পুরুষোত্তম ভগবানরূপে কৃষ্ণকে উপলব্ধি করা। যে মানুষ কৃষ্ণের পরম স্বরূপ উপলব্ধি করে, সে তার কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং ভক্তিমূলক সেবায় আত্মনিয়োগ করে।
- ১৬ দৈবাসুর-সম্পদ-বিভাগযোগ
যারা আসুরিক গুণগুলি অর্জন করে এবং শাস্ত্রবিধি অনুসরণ না করে যথেচ্ছভাবে জীবন যাপন করে থাকে, তারা হীনজন্ম ও ক্রমশ জাগতিক বন্ধনদশা লাভ করে। কিন্তু যারা দিব্য গুণাবলির অধিকারী এবং শাস্ত্রীয় অনুশাসনাদি মেনে বিধিবদ্ধ জীবন যাপন করেন, তারা ক্রমান্বয়ে পারমার্থিক সিদ্ধিলাভ করেন।
- ১৭ শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ
জড় প্রকৃতির ত্রিগুণাবলির থেকে উদ্ভূত এবং সেগুলির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শ্রদ্ধা তিন ধরনের হয়ে থাকে। যাদের শ্রদ্ধা রাজসিক ও তামসিক, তারা নিতান্তই অনিত্য জড়-জাগতিক ফল উৎপন্ন করে। পক্ষান্তরে, শাস্ত্রীয় অনুশাসন আদি মতে অনুষ্ঠিত সত্ত্বগুণময় কার্যাবলি হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করে এবং পরিণামে পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শুদ্ধ ভক্তি-শ্রদ্ধার পথে মানুষকে পরিচালিত করে ভক্তিভাব জাগ্রত করে তোলে।
- ১৮ মোক্ষযোগ কৃষ্ণ ব্যাখ্যা করেছেন ত্যাগের অর্থ এবং মানুষের ভাবনা ও কার্যকলাপের উপর প্রকৃতির গুণাবলির প্রতিক্রিয়াগুলি কেমন হয়। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন ব্রহ্ম উপলব্ধি, ভগবদগীতার মাহাত্ম্য ও গীতার চরম উপসংহার- ধর্মের সর্বোচ্চ পন্থা হচ্ছে পরমেশ্বর কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ, যার ফলে সর্বপাপ হতে মুক্তি লাভ হয়, সম্যক জ্ঞান-উপলব্ধি অর্জিত হয় এবং শাশ্বত চিন্ময় পরম ধামে প্রত্যাবর্তন করা যায়।
Remove ads
সামসময়িক জনপ্রিয়তা
সারাংশ
প্রসঙ্গ
অষ্টাদশ শতাব্দীতের প্রথমার্ধে পাশ্চাত্য গবেষকদের মধ্যে ভগবদ্গীতা-র অনুবাদ ও চর্চা শুরু হয়। এই সময় থেকেই ভগবদ্গীতা-র জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে।[web ১] ভারতীয় ইতিহাসবিদ ও সাহিত্যিক খুশবন্ত সিংয়ের মতে, রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের বিখ্যাত কবিতা "ইফ—" হল ইংরেজিতে ভগবদ্গীতা-র বাণীর সারমর্ম।[২৩]
প্রশংসা
ভগবদ্গীতা কেবল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ও সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের মতো বিশিষ্ট ভারতীয় রাজনৈতিক নেতা ও দার্শনিকদের দ্বারাই প্রশংসিত হয় নি,[২৪] বরং অ্যালডাস হাক্সলি, হেনরি ডেভিড থরো, জে. রবার্ট ওপেনহিমার,[২৫] রালফ ওয়াল্ডো এমারসন, কার্ল জাং, হেরমান হেস[৮][২৬] ও অন্যান্যদের দ্বারাও প্রশংসিত হয়েছে। ভগবদ্গীতা-য় উল্লিখিত নিষ্কাম সেবা ছিল গান্ধীর অনুপ্রেরণা।[২৭] তিনি লিখেছেন:
যখন সংশয় আমাকে তাড়া করে ফেরে, যখন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে হতাশা, আমি দিগন্তে আশার কোনো আলো দেখতে পাই না, তখন আমি ভগবদ্গীতার দিকে মুখ ফেরাই। এমন একটি শ্লোক পেয়ে যাই, যা আমাকে শান্তি দেয়। তখন ঘনায়মান দুঃখের মধ্যেও আমার মুখে হাসি ফোটে। আমার জীবন বাহ্যিক ব্যর্থতায় পরিপূর্ণ। আমার জীবনে যদি তাদের কোনো দৃশ্য বা অদৃশ্য প্রভাব না থাকে, তার জন্য আমি ভগবদ্গীতার শিক্ষার প্রতি কৃতজ্ঞ।[২৮]
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ভগবদ্গীতা প্রসঙ্গে বলেছেন: ভগবদগীতা মানব অস্তিত্বের আধ্যাত্মিক ভিত্তিটির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। জীবনের দায়দায়িত্ব ও কর্তব্যকর্মের জন্য কর্মের ডাক দেওয়া হয়েছে গীতায়। সেই সঙ্গেই আধ্যাত্মিক প্রকৃতি ও মহাবিশ্বের বৃহত্তর উদ্দেশ্যটির দিকেও দৃষ্টি রাখা হয়েছে।[২৯]
মার্কিন পদার্থবিদ ও ম্যানহ্যাটন প্রজেক্টের পরিচালক জে. রবার্ট ওপেনহিমার ১৯৩৩ সালে সংস্কৃত শিখে ভগবদ্গীতা মূল সংস্কৃতে পাঠ করেন। পরবর্তীকালে তিনি এই বইটিকে জীবনদর্শনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রভাবশালী বইগুলোর একটি বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেছিলেন যে ১৯৪৫ সালে বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষাটি দেখার পর ভগবদ্গীতার একাদশ অধ্যায়ের ৩২ সংখ্যক শ্লোকটি থেকে "এখন আমি বিশ্ববিধ্বংসী মৃত্যু হয়েছি" কথাটি তার মনে পড়েছিল।[২৫][৩০]
ফিলিপ গ্লাস তার সত্যাগ্রহ (১৯৭৯) অপেরায় দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীর আন্দোলনের প্রথম পর্যায়টি তিনি ভগবদ্গীতার মাধ্যমে দেখান। অপেরার মূল লিবারেটো অংশটি মূল সংস্কৃতে ভগবদ্গীতা গানের মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়েছে।[web ২] ডগলাস জে. কোমোর অর্জুন'স ডায়ালেমা অপেরায় ভারতীয় ও পাশ্চাত্য সাংগীতিক ঐতিহ্যের মাধ্যমে অর্জুনের দ্বিধার বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়।[web ৩] ১৯৯৩ সালে জি. ভি. আয়ার পরিচালিত সংস্কৃত চলচ্চিত্র ভগবদ্গীতা ১৯৯৩ সালে শ্রেষ্ঠ কাহিনিচিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়।[web ৪][web ৫]
দ্য লেজেন্ড অফ ব্যাগার ভেন্স উপন্যাস (১৯৯৫) ও গলফ চলচ্চিত্রটি (২০০০) ভগবদ্গীতা অবলম্বনে নির্মিত।[৩১]
Remove ads
গীতা জয়ন্তী
সারাংশ
প্রসঙ্গ

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রথম দিনের স্মরণে গীতা জয়ন্তী একটি বার্ষিক উদ্যাপন। মার্গশীর্ষ (ডিসেম্বর) মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে গীতা জয়ন্তী পালিত হয়। আজ থেকে ৫০০০ বছরেরও পূর্বে এই তিথিতেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে কৃষ্ণ ভগবদ্গীতা আকারে ভক্তিমূলক সেবার গোপনীয় জ্ঞান তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ভক্ত অর্জুনকে প্রদান করেছিলেন। সেই মহিমা মণ্ডিত তিথিকে স্মরণ করার জন্য সারা বিশ্বের হিন্দুধর্মাবলম্বীরা গীতা জয়ন্তী পালন করে থাকেন।
আজ থেকে ৫০০০ বছর পূর্বে ভগবদ্গীতার দিব্যজ্ঞান কৃষ্ণ অর্জুনকে প্রদান করলেও গীতার চতুর্থ অধ্যায়ে বলা আছে যে, এর পূর্বেও তিনি এই জ্ঞান অন্যকে প্রদান করেছিলেন। মহাভারতের শান্তিপর্বে ভগবদ্গীতার ইতিহাস উল্লেখ আছে। কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন যে, তিনি প্রথম এই জ্ঞান সূর্যদেবকে প্রদান করেন এবং সূর্যদেব তা মনুকে প্রদান করেন। মনু সেই জ্ঞান ইক্ষ্বাকুকে প্রদান করেন। এভাবে ভগবদ্গীতার দিব্যজ্ঞান প্রদান গুরু-শিষ্য পরম্পরায় চলতে থাকলেও কালের বিবর্তনে তা হারিয়ে যায়। সর্বশেষ ভগবান কৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রথম দিনে তিনি তার পরম ভক্ত ও শ্রেষ্ঠ বীর অর্জুনকে সেই অমূল্য জ্ঞান প্রদান করেন।
ভগবদ্গীতা মানবজাতির জন্য কৃষ্ণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] প্রকৃতপক্ষে তার উদ্দেশ্য ছিল মানবজাতিকে জড়-জাগতিক অজ্ঞতা থেকে উদ্ধার করা। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুন যখন যুদ্ধে কৌরবপক্ষে তার আত্মীয়দের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ইতস্তত করছিলেন, তখন কৃষ্ণ জীবনের সত্য এবং কর্ম, জ্ঞান, ধ্যান এবং ভক্তির দর্শন তাঁর কাছে ব্যাখ্যা করেছিলেন, যার ফলে বিশ্বের অন্যতম বড় ধর্মগ্রন্থ, ভগবদ্গীতা প্রকাশিত হয়।
গীতা জয়ন্তী উপলক্ষে বৈষ্ণবভক্তগণ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন। অনেক মন্দিরে গীতা যজ্ঞ করা হয়, যেখানে সম্পূর্ণ ভগবদ্গীতা পাঠ করা হয়। এছাড়া ভক্তগণ ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ইত্যাদি নির্বিশেষে প্রত্যেককে ভগবদ্গীতা বিতরণে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
Remove ads
গীতা সংঘানুষ্ঠান

গীতা সংঘানুষ্ঠান হলো একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান যেখানে শ্রীমদ্ভগবদগীতার পাঠ এবং ব্যাখ্যা করা হয়। এই ধরনের অনুষ্ঠান সাধারণত ভক্তিমূলক পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে উপস্থিত ব্যক্তিরা গীতার পাঠ শুনে জীবনের ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক দিক নিয়ে আলোচনা করেন। অনেক সময় ভক্তিমূলক গান বা কীর্তন পরিবেশনা এবং প্রার্থনার মাধ্যমে ভক্তরা তাদের ভক্তিভাব প্রকাশ করেন। সংঘানুষ্ঠান একটি সংঘ কর্তৃক দৈনিক, সাপ্তাহিক বা মাসিক হতে পারে।
Remove ads
আরও দেখুন

উইকিউক্তিতে শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা সম্পর্কিত উক্তির সংকলন রয়েছে।

উইকিবইয়ে এই বিষয়ের উপরে আরো তথ্য রয়েছে: শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা
- ব্যাধগীতা
- হংসগীতা বা উদ্ধবগীতা
- দেবীগীতা
- ঈশ্বরগীতা
- অষ্টাবক্রগীতা
- গুরুগীতা
- অনুগীতা
- গণেশ গীতা
- অবধূত গীতা
পাদটীকা
তথ্যসূত্র
উৎস
ওয়েব উৎস
বহিঃসংযোগ
Wikiwand - on
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Remove ads