শীর্ষ প্রশ্ন
সময়রেখা
চ্যাট
প্রসঙ্গ

রামকৃষ্ণ পরমহংস

ভারতীয় বাঙালি যোগসাধক, দার্শনিক ও ধর্মগুরু উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ

রামকৃষ্ণ পরমহংস
Remove ads

রামকৃষ্ণ পরমহংস (শুনুন) (১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৩৬ ১৬ আগস্ট ১৮৮৬) পূর্বাশ্রমের নাম গদাধর চট্টোপাধ্যায়[][][][] । ঊনবিংশ শতকের এক প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি যোগসাধক, দার্শনিক ও ধর্মগুরু।[] প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ তার প্রচারিত ধর্মীয় চিন্তাধারায় রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন।[][][] তারা উভয়েই বঙ্গীয় নবজাগরণের[] এবং ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর বাংলা তথা ভারতীয় নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। [১০][১১] তাঁকে তাঁর অনুসারীরা অবতার (ঐশ্বরিক অবতার) বলে মনে করেন।[১২]

দ্রুত তথ্য রামকৃষ্ণ পরমহংস, ব্যক্তিগত তথ্য ...

রামকৃষ্ণ পরমহংস গ্রামীণ পশ্চিমবঙ্গের এক দরিদ্র বৈষ্ণব ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। রাণী রাসমণি প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বর ভবতারিণী মন্দিরে পৌরোহিত্য গ্রহণের পর বঙ্গীয় তথা ভারতীয় শক্তিবাদের প্রভাবে তিনি কালীর আরাধনা শুরু করেন।[] তার প্রথম গুরু তন্ত্র ও বৈষ্ণবীয় ভক্তিতত্ত্বজ্ঞা এক সাধিকা। পরবর্তীকালে অদ্বৈত বেদান্ত মতে সাধনা করে নির্বিকল্প সমাধি লাভ করেন রামকৃষ্ণ। অন্যান্য ধর্মীয় মতে, বিশেষত খ্রিস্টীয় মতে সাধনা তাঁকে “যত মত, তত পথ” উপলব্ধির জগতে উন্নীত করে।[] পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক গ্রামীণ উপভাষায় ছোটো ছোটো গল্পের মাধ্যমে প্রদত্ত তার ধর্মীয় শিক্ষা সাধারণ জনমানসে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বল্পশিক্ষিত হলেও রামকৃষ্ণ বাঙালি বিদ্বজ্জন সমাজ ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সম্ভ্রম অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৮৭০-এর দশকের মধ্যভাগ থেকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের নিকট তিনি হয়ে ওঠেন হিন্দু পুনর্জাগরণের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তৎসঙ্গে সংগঠিত করেন একদল অনুগামী, যাঁরা ১৮৮৬ সালে রামকৃষ্ণের প্রয়াণের পর সন্ন্যাস গ্রহণ করে তার কাজ চালিয়ে যান। এঁদেরই মধ্যে প্রধান শিষ্য ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ[১৩]

১৮৯৩ সালে শিকাগোতে বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দ তার ধর্মীয় চিন্তাধারাকে পাশ্চাত্যের জনসমক্ষে উপনীত করেন। বিবেকানন্দ যে বিশ্ব মানবতাবাদের বার্তা প্রেরণ করেন তা সর্বত্র সমাদৃত হয় এবং তিনিও সকল সমাজের সমর্থন অর্জন করেন। যুক্তরাষ্ট্রে হিন্দু দর্শনের সার্বজনীন সত্য প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি এরপর প্রতিষ্ঠা করেন বেদান্ত সোসাইটি এবং ভারতে রামকৃষ্ণের ধর্মীয় সমণ্বয়বাদ ও “শিবজ্ঞানে জীবসেবা”র আদর্শ বাস্তবায়িত করার জন্য স্থাপনা করেন রামকৃষ্ণ মিশন নামে একটি ধর্মীয় সংস্থা।[১৩] রামকৃষ্ণ আন্দোলন ভারতের অন্যতম নবজাগরণ আন্দোলন রূপে বিবেচিত হয়।[১৪] ২০০৮ সাল পর্যন্ত ভারত ও বহির্ভারতে রামকৃষ্ণ মিশনের মোট ১৬৬টি শাখাকেন্দ্র বিদ্যমান। এই সংস্থার প্রধান কার্যালয় পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ার বেলুড় মঠে অবস্থিত।[১৫]

Remove ads

জীবনী

সারাংশ
প্রসঙ্গ

জন্ম ও শৈশব

Thumb
কামারপুকুর গ্রামের এই ছোটো কুটিরে রামকৃষ্ণ পরমহংস বাস করতেন (কেন্দ্রে)। বামে পারিবারিক ঠাকুরঘর, ডানে জন্মস্থল যার উপর বর্তমানে শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দিরটি স্থাপিত।

পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার আরামবাগ মহকুমায় অবস্থিত কামারপুকুর গ্রামে ১৮৩৬ সালে এক দরিদ্র ধর্মনিষ্ঠ রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারে রামকৃষ্ণ পরমহংসের জন্ম হয়। কামারপুকুর শহরের চাকচিক্য দ্বারা আচ্ছন্ন ছিল না এবং এখানে ধানের ক্ষেত, লম্বা-লম্বা তাল গাছ, রাজকীয় বটগাছ, কয়েকটি পুকুর এবং দুটি শ্মশান ছিল। তিনি ছিলেন পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় এবং মা চন্দ্রমণি দেবীর চতুর্থ ও শেষ সন্তান। কথিত আছে, শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মের পূর্বে তার পিতামাতার সম্মুখে বেশ কয়েকটি অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল। সন্তানসম্ভবা চন্দ্রমণি দেবী দেখেছিলেন শিবলিঙ্গ থেকে নির্গত একটি জ্যোতি তার গর্ভে প্রবেশ করছে। তার জন্মের অব্যবহিত পূর্বে গয়ায় তীর্থভ্রমণে গিয়ে ক্ষুদিরাম গদাধর বিষ্ণুকে স্বপ্নে দর্শন করেন। সেই কারণে তিনি নবজাতকের নাম রাখেন গদাধর।[১৬]

শৈশবে গদাই নামে পরিচিত গদাধর তার গ্রামবাসীদের অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। অঙ্কন ও মাটির প্রতিমা নির্মাণে তার ছিল সহজাত দক্ষতা। যদিও প্রথাগত শিক্ষায় তার আদৌ মনোযোগ ছিল না। সেযুগে ব্রাহ্মণ সমাজে প্রচলিত সংস্কৃত শিক্ষাকে তিনি “চালকলা-বাঁধা বিদ্যা” (অর্থাৎ পুরোহিতের জীবিকা-উপার্জনী শিক্ষা) বলে উপহাস করেন এবং তা গ্রহণে অস্বীকার করেন। তবে পাঠশালার শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি তার ঔদাসিন্য থাকলেও নতুন কিছু শিখতে তার আগ্রহের অন্ত ছিল না।[১৭][১৮] গানবাজনা, কথকতা ও ধর্মীয় উপাখ্যান অবলম্বনে যাত্রাভিনয়ে তিনি অনায়াসে পারদর্শিতা অর্জন করেন।[১৯] তীর্থযাত্রী, সন্ন্যাসী এবং গ্রাম্য পুরাণকথকদের কথকতা শুনে অতি অল্প বয়সেই পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতভাগবতে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন গদাধর।[২০] মাতৃভাষা বাংলায় তার অক্ষরজ্ঞান ছিল;[২১] কিন্তু সংস্কৃত অনুধাবনে সক্ষম হলেও সেই ভাষা তিনি বলতে পারতেন না।[২২] পুরীর পথে কামারপুকুরে বিশ্রামরত সন্ন্যাসীদের সেবাযত্ন করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ধর্মীয় বিতর্ক মন দিয়ে শুনতেন গদাধর।

শ্রীরামকৃষ্ণের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, ছয়-সাত বছর বয়স থেকেই তার মধ্যে আধ্যাত্মিক ভাব তন্ময়তা দেখা দিত। একবার ধানক্ষেতের পথে চলতে চলতে আকাশে কালো মেঘের পটে সাদা বলাকার সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে তিনি বাহ্যজ্ঞান রহিত হন। পরবর্তীকালে তার সেই অবস্থাকে তিনি ব্যাখ্যা করেন এক অনির্বচনীয় আনন্দের অভিজ্ঞতারূপে।[১৯][২৩] বাল্যকালে আরও কয়েকবার তার অনুরূপ ভাবতন্ময়তা দেখা দিয়েছিল – একবার দেবী বিশালাক্ষীর পূজার সময়, আরেকবার শিবরাত্রি উপলক্ষে যাত্রায় শিবের চরিত্রাভিনয়কালে। দশ-বারো বছর বয়স থেকে এই ভাব তন্ময়তা তার নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।[২৪]

১৮৪৩ সালে পিতৃ বিয়োগের পর পরিবারের ভার গ্রহণ করেন তার অগ্রজ রামকুমার। এই ঘটনা গদাধরের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। ধর্মীয় জীবনযাপনের ইচ্ছা তার মনে দৃঢ় হয়। পিতার অভাব তাকে মায়ের খুব কাছে নিয়ে আসে; ঘরের কাজ ও গৃহদেবতার পূজাপাঠে তিনি অধিকতর সময় ব্যয় করতে থাকেন; আত্মমগ্ন হয়ে থাকেন ধর্মীয় মহাকাব্য পাঠে।[২৫]

গদাধর যখন কিশোর, তখন তার পরিবারের আর্থিক সংকট দেখা দেয়। রামকুমার কলকাতায় একটি সংস্কৃত টোল খোলেন ও পুরোহিতের বৃত্তি গ্রহণ করেন। ১৮৫২ সালে দাদাকে পৌরোহিত্যে সহায়তা করার মানসে গদাধর কলকাতায় পদার্পণ করেন।[২৬]

দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে পৌরোহিত্য

Thumb
দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি, এখানে শ্রীরামকৃষ্ণ তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিবাহিত করেন।

১৮৫৫ সালে কলকাতার মাহিষ্য সমাজের এক ধনী জমিদারপত্নী রানি রাসমণি দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা করলে রামকুমার সেই মন্দিরে প্রধান পুরোহিতের পদ গ্রহণ করেন।[২৭] তখনকার ব্রাহ্মণ সমাজে নিম্নবর্ণীয়া গণ্য এক নারীর প্রতিষ্ঠিত মন্দির হওয়া সত্ত্বেও সামান্য অনুরোধেই গদাধর সেই মন্দিরে চলে আসেন। তিনি ও তার ভাগনে হৃদয়রাম রামকুমারের সহকারী হিসাবে প্রতিমার সাজসজ্জার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৮৫৬ সালে রামকুমারের মৃত্যু হলে গদাধর তার স্থলাভিষিক্ত হন। মন্দিরে উত্তর-পশ্চিম আঙিনায় তাকে একটি ছোটো ঘর দেওয়া হয়। এই ঘরেই তিনি অতিবাহিত করেন তার অবশিষ্ট জীবন।[২৮] অনুমিত হয়, রাণী রাসমণির জামাতা মথুরামোহন বিশ্বাস, যিনি মথুরবাবু নামে পরিচিত ছিলেন, তিনিই গদাধরকে রামকৃষ্ণ নামটি দিয়েছিলেন।[২৯] অন্য মতে, এই নামটি তার অন্যতম গুরু তোতাপুরীর দেওয়া।

Thumb
ভবতারিণী কালী, দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের রামকৃষ্ণ-পূজিত দেবীমূর্তি

রামকুমারের মৃত্যুর পর রামকৃষ্ণের ভাব তন্ময়তা বৃদ্ধি পায়। কালীকে তিনি মা ও বিশ্বজননী ভাবে প্রত্যক্ষ করতে শুরু করেন। এই সময় দেবীর প্রত্যক্ষ রূপ দর্শনের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন তিনি। তার বিশ্বাস পাষাণপ্রতিমা জীবন্ত হয়ে অন্নগ্রহণ করতে শুরু করেন। পূজা করতে করতে দেবীর দর্শন না পেয়ে তিনি চিৎকার করে কেঁদে উঠতে থাকেন। রাত্রিকালে নিকটবর্তী জঙ্গলে গিয়ে বস্ত্র ও উপবীত ত্যাগ করে নির্জনে ধ্যান করতেও শুরু করেন।[৩০] কেউ কেউ বলতে থাকেন যে তিনি পাগল হয়ে গেছেন, আবার কেউ বলেন তিনি ঈশ্বরের প্রেমে আকুল হয়েছেন।[৩১]

একদিন অস্থিরতার বশে তিনি সংকল্প করেন দেবীর দর্শন না পেলে জীবন বিসর্জন দেবেন। দেওয়াল থেকে খড়্গ তুলে নিয়ে তিনি গলায় কোপ বসাবেন, এমন সময় অকস্মাৎ সমগ্র কক্ষ আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। শ্রীরামকৃষ্ণ তার প্রথম মা কালী দর্শনের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা নিম্নরূপ,

উক্ত ঘটনার পর শ্রীরামকৃষ্ণ মা কালীর নিকট নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করেন। কি সাধারণ, কি দার্শনিক – সকল ক্ষেত্রেই বালকসুলভ আনুগত্য নিয়ে তিনি দেবীর নিকট প্রার্থনা নিবেদন করতে শুরু করেন। রাণী রাসমণি ও তার জামাতা মথুরবাবু যদিও পরম স্নেহবশত তাকে তার ইচ্ছামতো পূজার অনুমতি দিয়েছিলেন, তবুও তারা মনে করতেন শ্রীরামকৃষ্ণ দীর্ঘ ব্রহ্মচর্যজনিত কোনও দুরারোগ্য মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। মথুরবাবু তার জন্য বারবণিতার বন্দোবস্ত করলেন। কিন্তু তাকে প্রলুব্ধ করার সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হল। তিনি সেই দেহোপজীবিনীর মধ্যেও দিব্য মাতৃমূর্তি দর্শন করেন।[৩৫][৩৬]

বিবাহ

Thumb
সারদা দেবী

কামারপুকুরে গুজব রটে যায়, দক্ষিণেশ্বরে অতিরিক্ত সাধনা ও শ্রমে শ্রীরামকৃষ্ণ পাগল হয়ে গেছেন। মা ও মধ্যমাগ্রজ রামেশ্বর তার বিবাহদানের চিন্তাভাবনা করতে থাকেন। তারা ভেবেছিলেন, বিবাহের পর সাংসারিক দায়-দায়িত্বের ভার গদাধরের কাঁধে চাপলে আধ্যাত্ম সাধনার মোহ তার কেটে যাবে – তিনি আবার স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে ফিরে আসবেন।[৩৭] শ্রীরামকৃষ্ণ বিবাহে আপত্তি তো করলেনই না, বরং বলে দিলেন কামারপুকুরের তিন মাইল উত্তর-পশ্চিমে জয়রামবাটী গ্রামের রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গৃহে কন্যার সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে। ১৮৫৯ সালে পঞ্চমবর্ষীয়া বালিকা সারদার সঙ্গে তার শাস্ত্রমতে বিবাহ সম্পন্ন হয়।[৩৮] শ্রীরামকৃষ্ণের বয়স তখন তেইশ। বয়সের এই পার্থক্য উনিশ শতকীয় গ্রামীণ বঙ্গসমাজে কোনও অপ্রচলিত দৃষ্টান্ত ছিল না। যাই হোক, ১৮৬০ সালের ডিসেম্বরে শ্রীরামকৃষ্ণ সারদা দেবীকে ছেড়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। ১৮৬৭ সালের মে মাসের আগে তাদের আর সাক্ষাৎ হয়নি।[৩৭][৩৮]

সাধনা

Thumb
দক্ষিণেশ্বরে ভাবসমাধিস্থ রামকৃষ্ণ পরমহংস - তার সর্বাধিক পরিচিত ও জনপ্রিয় আলোকচিত্র।

বিবাহের পর শ্রীরামকৃষ্ণ কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করে পুনরায় মন্দিরের কাজ গ্রহণ করেন। তবে ভাবতন্ময়তা কাটার পরিবর্তে তার অধ্যাত্ম-পিপাসা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। ব্রাহ্মণের জাত্যভিমান দূর করার জন্য তিনি নিম্নবর্ণীয়দের হাতে খাদ্যগ্রহণ, অন্ত্যজ পারিয়াদের (চাকর ও ঝাড়ুদার) সেবা করতে থাকেন।[৩৯][৪০] স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রাকে মাটির ঢেলার সঙ্গে মিশিয়ে তিনি বলতে শুরু করেন “টাকা মাটি, মাটি টাকা”। এবং অর্থকে লোষ্ট্রজ্ঞানে গঙ্গায় নিক্ষেপ করেন। লোকে মনে করতে থাকেন, সত্যিই তিনি পাগল হয়ে গেছেন।[৪০] কথিত আছে, এই অবস্থায় তিনি এতটাই সংবেদনশীল হয়ে উঠেছিলেন, যে ঘুমন্ত অবস্থাতে কেউ মুদ্রা স্পর্শ করালে, তার দেহ সংকুচিত হয়ে আসত।[৪১] তার শরীরে তীব্র দাহ উপস্থিত হল। তিনি নিদ্রারহিত হলেন। ফলে মন্দিরের কাজকর্ম তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ল। চিকিৎসকগণ আহূত হলেন। কিন্তু তাদের একজন বললেন যে রোগীর এই অবস্থার কারণ আধ্যাত্মিক উত্তেজনা। কোনও ঔষধ একে সুস্থ করতে সক্ষম নয়।[৪২][৪৩]

ভৈরবী ব্রাহ্মণী ও তন্ত্রসাধনা

১৮৬১ সালে ভৈরবী ব্রাহ্মণী নামে গৈরিক বস্ত্র পরিহিতা এক যোগিনী দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হন। তার প্রকৃত নাম ছিল যোগেশ্বরী এবং বয়স ছিল চল্লিশের কাছাকাছি।[৪৪] দক্ষিণেশ্বরে আগমনের পূর্বে তার জীবন সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না।[৪৫] তবে তিনি ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞা ও তন্ত্র ও বৈষ্ণব সাধনে সিদ্ধা।[৪৬][৪৭]

শ্রীরামকৃষ্ণ ভৈরবীর কাছে তার ভাব। তন্ময়তা ও দৈহিক পীড়ার বর্ণনা দিলেন। ভৈরবী তাকে এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে তিনি পাগল হয়ে যাননি; বরং আধ্যাত্মিক ‘মহাভাব’ তাকে আশ্রয় করেছে। এই মহাভাবের বশেই তিনি দিব্যপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছেন।[৪৮] বিভিন্ন ভক্তিশাস্ত্রের উদাহরণ দিয়ে তিনি দেখালেন রাধাচৈতন্য মহাপ্রভুরও একই ভাব উপস্থিত হয়েছিল।[৪৯] ভৈরবী তার দৈহিক পীড়া অবসানের নিদানও দিলেন।[৫০]

ভৈরবীর পথ নির্দেশনায় শ্রীরামকৃষ্ণ তন্ত্রমতে সাধনা শুরু করলেন। এই সাধনায় তার সমস্ত শারীরিক ও মানসিক পীড়ার উপশম হল।[৫১][৫২] ভৈরবীর সহায়তায় তিনি তন্ত্রোল্লেখিত ৬৪ প্রকার প্রধান সাধন অভ্যাস করলেন।[৪৮] জপ ও পুরশ্চরণের মতো মন্ত্রসাধনায় চিত্ত শুদ্ধ করে পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণ স্থাপন করলেন। তন্ত্র সাধনায় সাধারণত বামাচারের মতো ধর্মবিরোধী পন্থাও অভ্যাস করতে হয়; যার মধ্যে মাংস ও মৎস্য ভক্ষণ, মদ্যপান ও যৌনাচারও অন্তর্ভুক্ত।[৪৮] শ্রীরামকৃষ্ণ ও তার জীবনীকারগণের কথা থেকে জানা যায়, শেষোক্ত দুটি তিনি অভ্যাস করেননি, শুধুমাত্র সেগুলির চিন্তন করেই কাঙ্ক্ষিত সাধন ফল লাভ করেছিলেন।[৪৮] শ্রীরামকৃষ্ণ বামাচারকে একটি জ্ঞানমার্গ বলে উল্লেখ করলেও, অন্যদের এই পথে সাধন করতে নিষেধ করতেন।[৫৩] পরে তার প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ যখন তাকে বামাচার সম্পর্কে প্রশ্ন করেন, তিনি বলেন, “(এই পথ) বড় কঠিন, ঠিক রাখা যায় না, পতন হয়।”[৫৪][৫৫]

Thumb
২১ সেপ্টেম্বর ১৮৭৯, কেশবচন্দ্র সেনের গৃহে শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবসমাধি। ভাগিনেয় হৃদয় ব্রাহ্ম ভক্তবেষ্টিত শ্রীরামকৃষ্ণকে ধরে আছেন

ভৈরবী শ্রীরামকৃষ্ণকে কুমারী পূজা শিক্ষা দেন। এই পূজায় কোনও কুমারী বালিকাকে দেবীজ্ঞানে পূজা করা হয়।[৩৮] এছাড়াও ভৈরবীর নির্দেশনায় শ্রীরামকৃষ্ণ কুণ্ডলিনী যোগেও সিদ্ধ হন।[৪৮] ১৮৬৩ সাল নাগাদ তার তন্ত্রসাধনা সম্পূর্ণ হয়।[৫৬]

শ্রীরামকৃষ্ণ ভৈরবীকে মাতৃভাবে দেখতেন।[৫৭] অন্যদিকে ভৈরবী তাকে মনে করতেন ঈশ্বরের অবতার। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি প্রথম সর্বসমক্ষে শ্রীরামকৃষ্ণকে অবতার বলে ঘোষণা করেন।[৫৭] কিন্তু নানা লোকের কথা শুনেই শ্রীরামকৃষ্ণ নিজে তার অবতারত্ব সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন। যাই হোক, ভৈরবীর নিকট তন্ত্রসাধনা তার আধ্যাত্ম-সাধনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্ব বিবেচিত হয়।[][৫৮][৫৯]

বৈষ্ণবীয় ভক্তিসাধনা

বৈষ্ণব ভক্তিশাস্ত্রে ঈশ্বরের প্রতি প্রেম নিবেদনে পাঁচটি ভাবের উল্লেখ রয়েছে – শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর।[৬০] শ্রীরামকৃষ্ণ এই ভাবগুলির কয়েকটি অভ্যাস করেন।[৬১]

মা কালী দর্শন ও বিবাহের মধ্যবর্তী সময়ে কিছুকালের জন্য রামকৃষ্ণ দাস্যভাবে সাধনা করেছিলেন। এই সময় তিনি হনুমানভাবে ভাবিত হয়ে রামচন্দ্রের আরাধনা করেন। এইসময় তার হাবভাব সকলই হনুমানের মতো হয়েছিল। তিনি কদলীভক্ষণ করতেন, অধিকাংশ সময় বৃক্ষশাখায় কাটাতেন, এমনকি বানরের মতো অস্থির চোখের দৃষ্টিও লাভ করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, তার মেরুদণ্ডের নিচে সামান্য অংশও এই সময় লেজের মতো প্রসারিত হয়েছিল।[৬২] দাস্যভাবে সাধনার সময় তিনি রামের পত্নী সীতাদেবীর দর্শন পান এবং সীতার সেই মূর্তি তার নিজদেহে অন্তর্হিত হতে দেখেন।[৬১][৬২]

১৮৬৪ সালে দেবী। প্রতিমায় মাতৃভাব আরোপ করে শ্রীরামকৃষ্ণ বাৎসল্য ভাবের সাধনা করেন। এই সময় তিনি ‘রামলালা’ অর্থাৎ বালক রামচন্দ্রের একটি ধাতুমূর্তি পূজা করতেন। পরে তিনি বলেছিলেন, এই সময় তার হৃদয় মাতৃভাবে পূর্ণ হত। তার মধ্যে নারীর ভাব ফুটে উঠত এমনকি তার কথাবার্তা ও হাব ভাবও মেয়েলি আকার নিত। শ্রীরামকৃষ্ণ আরও বলেছেন যে এই সময় তিনি ধাতু মূর্তিতেই জীবন্ত বালক রামচন্দ্রকে চাক্ষুষ করতেন।[৬৩][৬৪]

পরবর্তীকালে গোপিনী রাধার ভাব আরোপ করে কৃষ্ণের প্রেমিকরূপে মধুর ভাব সাধনা করেন শ্রীরামকৃষ্ণ।[৬১] এই প্রেম উপলব্ধি করার জন্য তিনি দীর্ঘকাল নারীর বেশে নিজেকে বৃন্দাবনের গোপিনী কল্পনা করেছিলেন। এই সাধনার অন্তে তার সবিকল্প সমাধি হয় – তিনি কৃষ্ণের সাথে আধ্যাত্মিক ভাবে মিলিত হন।[৬৫]

নদিয়ায় গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভক্তিবাদের প্রবর্তক চৈতন্যনিত্যানন্দের জন্মস্থান ভ্রমণকালে তিনি ভাব চক্ষুতে দুই নৃত্যরত বালককে তার দেহে অন্তলীন হতে দেখেছিলেন।[৬৫]

মাকালী দর্শনের পর তার শান্ত ভাব অর্জিত হয়েছিল বলেও জানা যায়।[৬১]

তোতাপুরী ও বৈদান্তিক সাধনা

Thumb
পঞ্চবটী ও সেই কুটির যেখানে শ্রীরামকৃষ্ণ অদ্বৈত সাধনা করেছিলেন। বর্তমানে মাটির কুটিরের পরিবর্তে ইটের বাড়ি নির্মিত হয়েছে।

১৮৬৪ সালে তোতাপুরী নামক জনৈক পরিব্রাজক বৈদান্তিক সন্ন্যাসীর নিকট শ্রীরামকৃষ্ণ সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তার বর্ণনা অনুযায়ী তোতাপুরী ছিলেন জটাজুটধারী এক বিশালবপু উলঙ্গ নাগা সন্ন্যাসী।[৩৪] গুরুর নাম গ্রহণ করা শাস্ত্রমতে বারণ; তাই শ্রীরামকৃষ্ণ তাকে ‘ল্যাংটা’ বা ‘ন্যাংটা’ বলে উল্লেখ করতেন।[৬৬] তোতাপুরী ‘নেতি নেতি’ দৃষ্টিকোণ থেকে জগৎ দর্শন করতেন। তার মতে সকলই ছিল মায়া। দেব-দেবীর মূর্তিপূজাকেও তিনি উপহাস করতেন। বিশ্বাস করতেন এক ও অদ্বিতীয় ব্রহ্মে।[৬৭]

তোতাপুরী প্রথমে সকল জাগতিক বন্ধন থেকে শ্রীরামকৃষ্ণকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে তাকে সন্ন্যাস প্রদান করেন। অতঃপর তোতা তাকে অদ্বৈত তত্ত্ব শিক্ষা দেন –

তোতাপুরীর সহায়তায় শ্রীরামকৃষ্ণ অধ্যাত্মজীবনের চরম অবস্থা নির্বিকল্প সমাধিতে নিমগ্ন হন।[৭০]

অদ্বৈত বেদান্তের নানা তত্ত্ব শিক্ষা দেওয়ার জন্য তোতাপুরী এগারো মাস দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট রয়ে যান। তিনি বিদায় নিলে আরও ছয় মাস শ্রীরামকৃষ্ণ আধ্যাত্মিক ভাব তন্ময়তার জগতে অবস্থান করেন।[৭১] শ্রীরামকৃষ্ণের কথা অনুযায়ী, এরপর তিনি দেবী কালীর নিকট থেকে নির্দেশ প্রাপ্ত হন - “তুই ভাবমুখে থাক” (অর্থাৎ, সমাধি ও সাধারণ অবস্থার মুখে অবস্থান করে লোকশিক্ষা দান কর।) [৭২]

খ্রিস্টমতে সাধনা

১৮৭৩ সালের শেষভাগ নাগাদ শম্ভুচরণ মল্লিক শ্রীরামকৃষ্ণকেবাইবেল পাঠ করে শোনালে তিনি খ্রিস্টীয় মতে সাধনা শুরু করেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, এই সময় তার চিত্ত খ্রিস্টীয় ভাবে পূর্ণ হয়েছিল এবং তিনি কালীঘরে যাওয়া বন্ধ করেছিলেন। একদিন মেরিমাতার কোলে যিশু খ্রিস্টের চিত্রে তিনি জীবন্ত যিশুর দিব্যদর্শন লাভ করেছিলেন। তার ঘরে হিন্দু দেবদেবীদের সঙ্গে পিতরকে ত্রাণরত যিশুর একটি চিত্র ছিল, সেটিতে তিনি প্রত্যহ সকাল ও সন্ধ্যায় ধূপারতি করতেন।[৬৫][৭৩]

সারদা দেবী

সেকালের প্রথা অনুযায়ী সতেরো-আঠারো বছর বয়স হওয়ার পর সারদা দেবী স্বামীগৃহে যাত্রা করলেন। স্বামী পাগল হয়ে গেছেন – এইরূপ একটি গুজব শুনে তিনি অত্যন্ত দুঃখিত ছিলেন। আবার এও শুনেছিলেন, তার স্বামী একজন বিশিষ্ট সাধকে পরিণত হয়েছেন।[৭৪]

শ্রীরামকৃষ্ণ এই সময় ষোড়শী পূজার আয়োজন করেন। এই পূজায় তিনি সারদা দেবীকে দিব্য মাতৃকাজ্ঞানে পূজা নিবেদন করেছিলেন। তাকে দেবী কালীর পীঠে বসিয়ে পুষ্প ও ধূপদানে তার পূজা সম্পাদন করেন শ্রীরামকৃষ্ণ। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, তিনি যে নারীমাত্রেই জগজ্জননীর রূপ দর্শন করেন, তার নিজের স্ত্রীও তার ব্যতিক্রম নয়। এমনকি তিনি রূপপোজীবিনী বারবণিতাদেরও মাতৃসম্বোধন করতেন।[৭৫] দাম্পত্যজীবনে সারদা দেবীর মধ্যে মাতৃজ্ঞান করায় তাদের বিবাহ অসাধারণত্বে উন্নীত হয়।[৭৬]

সারদা দেবীর স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, শ্রীরামকৃষ্ণ কোনও দিন তাকে ‘তুই’ সম্বোধন করেননি। কখনও রূঢ়বাক্য প্রয়োগ বা তিরস্কারও করেননি।[৭৭]

সারদা দেবীকেই শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম অনুগামী মনে করা হয়। তার শিষ্য ও ভক্তসমাজে সারদা দেবী ‘শ্রীমা’ বা ‘মাতাঠাকুরানী’ নামে পরিচিতা হন। শ্রীরামকৃষ্ণের তিরোভাবের পর তিনিই রামকৃষ্ণ আন্দোলনের কেন্দ্রস্বরূপা হয়েছিলেন।[৭৮]

ব্রাহ্ম ও ভদ্রলোক সমাজে প্রভাব

Thumb
শ্রীরামকৃষ্ণের কয়েকজন সাক্ষাত শিষ্য - (বাম থেকে ডানে) ত্রিগুণাতীতানন্দ, শিবানন্দ, বিবেকানন্দ, তূরীয়ানন্দ, ব্রহ্মানন্দ ও (নিচে) সারদানন্দ

১৮৭৫ সালে প্রভাবশালী ব্রাহ্ম নেতা কেশবচন্দ্র সেনের সহিত শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ হয়।[৭৯][৮০] কেশব খ্রিস্টধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং আদি ব্রাহ্মসমাজের সহিত তার বিচ্ছেদও ঘটেছিল। তিনি প্রথমে মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করেছিলেন। পরে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের বহুদেববাদ গ্রহণ করেন এবং তার সর্বধর্ম সমন্বয়, ঈশ্বরে মাতৃভাব আরোপ এবং ব্রাহ্ম ও বহুদেববাদের সম্মিলনের আদর্শে “নববিধান” প্রতিষ্ঠা করেন।[৮১] নববিধানের পত্রপত্রিকায় কেশব বেশ কয়েকবছর শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশাবলি প্রচারও করেছিলেন।[৮২] এর ফলে বাঙালি ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণি, অর্থাৎ ইংরেজি-শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ও ভারতে বসবাসকারী ইউরোপীয়গণ তার প্রতি আকৃষ্ট হন।[৮৩][৮৪]

কেশবচন্দ্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর মতো অন্যান্য ব্রাহ্মগণও শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট যাতায়াত শুরু করেন, ও তার মতের অনুগামী হয়ে পড়েন। প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, শিবনাথ শাস্ত্রীত্রৈলোক্যনাথ সান্যাল প্রমুখ কলকাতার বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ১৮৭১ থেকে ১৮৮৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে নিময়িত তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। প্রতাপচন্দ্র মজুমদার প্রথম ইংরেজিতে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী রচনা করেন। ১৯৭৯ সালে থেইস্টিক কোয়ার্টারলি রিভিউ পত্রিকায় দ্য হিন্দু সেইন্ট নামে প্রকাশিত সেই জীবনী জার্মান ভারতবিদ ম্যাক্স মুলার প্রমুখ পাশ্চাত্য পণ্ডিতের দৃষ্টি শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি আকৃষ্ট করে।[৮২] এছাড়াও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত অন্যান্য ব্রাহ্মদের বক্তৃতা ও নিবন্ধ থেকেও বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণী শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুসারে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রেম ও ভক্তির বাণী বাঙালি সমাজে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে এবং বহু হিন্দুধর্মত্যাগী যুবককে ধর্মের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হয়।[৮২]

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরস্বামী দয়ানন্দের সঙ্গেও ধর্মবিষয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের বাক্যালাপ হয়েছিল।[৭৯] তবে ব্রাহ্মসমাজে তার মত ও ধর্মবিশ্বাসের বিরোধিতাও অনেকে করেছিলেন। তার সমাধি অবস্থাকে তারা স্নায়ুদৌর্বল্য বলে উপহাস করেন।[৭৯] ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় তার অবতারত্ব অস্বীকার করেছিলেন।[৮৫]

শ্রীরামকৃষ্ণের প্রভাব কলকাতার শিক্ষিত সমাজেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তার জীবদ্দশাতেই পণ্ডিত-বিদ্বজ্জন মহলের গণ্ডী টপকে তার ধর্মীয় চিন্তা ধারণা ও উপদেশের প্রভাব বিস্তৃত হয়েছিল বাংলার বাউলকর্তাভজা সম্প্রদায়ের মধ্যে, এমনকি বাংলার বাইরেও। অবশ্য মৃত্যুর পূর্বে রামকৃষ্ণ আন্দোলনের কাজ বিশেষ কিছুই সাধিত হয়নি।[৮২] ব্রাহ্মসমাজ ও নবোত্থিত হিন্দু পুনর্জাগরণ আন্দোলনের মধ্যে যোগসূত্র হিসাবে বাংলার নব জাগরণে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রভাব অবিস্মরণীয়।[][১০]

সেই যুগে শ্রীরামকৃষ্ণের পাশ্চাত্য গুণগ্রাহীদের অন্যতম ছিলেন স্কটিশ চার্চ কলেজের তদনীন্তন অধ্যক্ষ ডক্টর ডব্লিউ ডব্লিউ হেস্টি।[৮৬] শ্রেণিকক্ষে উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ রচিত দ্য এক্সকারসন কবিতাটিতে ব্যবহৃত "ট্র্যান্স" শব্দটি বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, শব্দটির প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করতে হলে দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট যাওয়া আবশ্যক। তার এই কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বেশ কয়েকজন তরুণ দক্ষিণেশ্বরে যান। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত, যিনি পরে স্বামী বিবেকানন্দ নামে পরিচিত হন।[৮২]

ভক্ত ও শিষ্য

Thumb
মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, শ্রীরামকৃষ্ণের সংসারী শিষ্য ও শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত গ্রন্থের প্রণেতা

স্বামী বিবেকানন্দ

১৮৭৯ থেকে ১৮৮৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে নিজের প্রধান শিষ্যদের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের সাক্ষাৎ হয়। এঁদের অনেকেই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। কেউ আবার ছিলেন একান্তই নাস্তিক; নিছক কৌতূহলের বশেই তারা শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখতে এসেছিলেন। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশ এঁদের সকলের মধ্যেই গভীর প্রভাব বিস্তার করে এবং এঁরা সকলেই তার অনুরাগী ভক্তে পরিণত হন। প্রবল যুক্তিবাদী সুরেন্দ্রনাথ মিত্র তাকে দেখতে গিয়েছিলেন, তার ‘কান মলে’ দেওয়ার জন্য; কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের একনিষ্ঠ ভক্তে পরিণত হন।[৮৭] তার অননুকরণীয় ধর্মপ্রচারের ভঙ্গি অনেক সংশয়বাদী ব্যক্তির মনেও দৃঢ় প্রত্যয়ের উন্মেষ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল।[৭৮]

তার প্রধান শিষ্যদের মধ্যে উল্লেখনীয়:

তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সকল জাতি, ধর্ম ও বর্ণের মানুষ শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে আসতে শুরু করেন - “কি মহারাজা কি ভিখারি, কি পত্রিকাকার কি পণ্ডিত, কি শিল্পী কি ভক্ত, কি ব্রাহ্ম কি খ্রিস্টান কি মুসলমান, সকল মতের সকল পেশার আবালবৃদ্ধ বণিতা”।[৮৯][৯০] জীবনীকারদের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি ছিলেন খুবই মিশুকে ও তুখোড় আলাপচারী। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক নাগাড়ে বলে যেতে পারতেন – নিজের অধ্যাত্ম অভিজ্ঞতার কথা, নানা গল্প; খুব সাধারণ দৃষ্টান্তের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে চলতেন বেদান্তের দুর্বোধ্য তত্ত্ব; রসিকতা, গান বা অন্যদের নকল করারও মাধ্যমে আমোদ-প্রমোদেও পিছপা হতেন না। সকল শ্রোতাকে মন্ত্রমুগ্ধের মত টেনে রাখতেন তার কাছে।[৯১][৯২]

কিছু সন্ন্যাসী শিষ্য থাকলেও, তিনি সকলকে গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হতে বলতেন না।[৯৩] আবার ত্যাগী শিষ্যদের সন্ন্যাস জীবনের জন্য প্রস্তুত করার মানসে তাদের জাতি নির্বিশেষে দ্বারে দ্বারে ঘুরে ভিক্ষা করার নির্দেশ দিতেন। এঁদের তিনি সন্ন্যাসী জীবনের প্রতীক গৈরিক বস্ত্র ও মন্ত্রদীক্ষাও দান করেছিলেন।[৯২]

শেষ জীবন

Thumb
রামকৃষ্ণ পরমহংসের শেষকৃত্যের পূর্বে তার শিষ্যগণ

তার গলা থেকে প্রথম রক্তক্ষরণ অগস্ট ১৮৮৫। ডাক্তারি ভাষায় এর নাম ‘ক্লার্জিম্যানস থ্রোট’। প্রখ্যাত ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার তাকে দেখেন ২ সেপ্টেম্বর ১৮৮৫ এবং পরের মাসে (১২ অক্টোবর) নিয়মিত চিকিৎসা শুরু করেন। তারই সিদ্ধান্ত, রোগটা ক্যানসার, কবিরাজি ভাষায় রোহিণী রোগ। কলকাতার শ্যামপুকুর অঞ্চলে তাকে নিয়ে আসা হয়। অবস্থা সংকটজনক হলে ১১ ডিসেম্বর, ১৮৮৫ তারিখে তাকে স্থানান্তরিত করা হয় কাশীপুরের এক বিরাট বাগানবাড়িতে।[৯৪] ২৫ মার্চ ১৮৮৬ মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. জে এম কোটস এসেছিলেন তাকে দেখতে। বিখ্যাত ডাক্তার রাজেন্দ্রনাথ দত্ত এলেন ৬ এপ্রিল ১৮৮৬।

এই সময় তার শিষ্যগণ ও সারদা দেবী তার সেবাযত্ন করতেন। চিকিৎসকগণ তাকে কথা না বলার কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই নির্দেশ অমান্য করে তিনি অভ্যাগতদের সঙ্গে ধর্মালাপ চালিয়ে যান।[৮৩] কথিত আছে, মৃত্যুর পূর্বে বিবেকানন্দকে তিনি বলেছিলেন,[৯৪] “আজ তোকে যথাসর্বস্ব দিয়ে ফকির হয়েছি। এই শক্তির সাহায্যে তুই জগতের অশেষ কল্যাণ করতে পারবি। কাজ শেষ হলে আবার স্বস্থানে ফিরে যাবি।” এও কথিত আছে বিবেকানন্দ তার অবতারত্ব সম্পর্কে সন্ধিহান হলে তিনি বলে ওঠেন, “যে রাম, যে কৃষ্ণ, সে-ই রামকৃষ্ণ...”[৯৫] তার শেষের দিনগুলিতে তিনি বিবেকানন্দকে ত্যাগী শিষ্যদের দেখাশোনার ভার অর্পণ করে যান।[৯৪]

শেষ দিন

রবিবার ১৫ অগস্ট ১৮৮৬, কাশীপুরে শ্রাবণের শেষ দিনে ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ ভাতের পায়েস খেতে আগ্রহ করেন। কিন্তু ওই দিনেই ঠাকুরের সেই বিখ্যাত উক্তি—‘‘ভিতরে এত ক্ষিধে যে হাঁড়ি হাঁড়ি খিচুড়ি খাই, কিন্তু মহামায়া কিছুই খেতে দিচ্ছেন না।’’

শেষের সেই দিনে খিচুড়ি নিয়েও বিশেষ গোলযোগ। সেবকদের জন্য শ্রীমা যে খিচুড়ি রাঁধছিলেন, তার নিচের অংশ ধরে গেল। বিকেলের দিকে পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়ায় ভক্ত শশী (পরবর্তী কালে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ) কয়েক মাইল দৌড়ে গিয়ে ডা. নবীন পালকে ধরে নিয়ে এলেন।

প্রায় রাত ন’টা , হঠাৎ ঠাকুরের সমাধি। নরেন সবাইকে ‘হরি ওঁ তৎসৎ’ কীর্তন করতে বললেন। সমাধি ভঙ্গ হল রাত প্রায় এগারোটায়। সেবক শশীর ইংরেজিতে রাখা নোট অনুযায়ী, ‘পুরো এক গ্লাস পায়েস পান করেন।’ তার পর ঠাকুর নাকি বলেন, ‘আঃ শান্তি হল। এখন আর কোনও রোগ নেই।’

স্বামী অভেদানন্দ এবং স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ ঠাকুরের শেষ মুহূর্তের বিস্তারিত বিবরণ রেখে গিয়েছেন—‘‘একটা বাজিলে অকস্মাৎ তিনি একপাশে গড়াইয়া পড়েন। তাঁহার গলায় ঘড়ঘড় শব্দ হইতে থাকে। নরেন তাড়াতাড়ি তাঁহার পা লেপে ঢাকিয়া ছুটিয়া সিঁড়ি বাহিয়া নিচে নামিয়া যান। এ দৃশ্য তিনি সহিতে পারিতেছিলেন না। নাড়ি বন্ধ হয়ে গিয়েছে, আমরা সকলে ভাবিলাম, উহা সমাধি।’’

সেই রাত্রেই দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের ভাইপো রামলালকে খবর দেওয়া হল। রামলাল এসে বলল, ‘ব্রহ্মতালু গরম আছে, তোমরা একবার কাপ্তেন উপাধ্যায়কে খবর দাও।’ তিনি তাড়াতা়ড়ি এসে বললেন, মেরুদণ্ডে গব্যঘৃত মালিশ করলে চৈতন্যোদয় হবে। তিন ঘণ্টার বেশি মালিশ করেও কোনও ফল হল না।

১৬ অগস্ট সকালবেলায় ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার কাশীপুরে আসেন। অভেদানন্দের বর্ণনা অনুযায়ী, ডা. সরকার ‘‘বেলা দশ ঘটিকায় এসে নাড়ি দেখে বলেন, ঠাকুরের প্রাণবায়ু নির্গত হয়েছে।’’

ডাক্তার সরকারের দিনলিপি, ‘‘খাওয়াদাওয়ার পর প্রথমে ডাফ স্ট্রিটে যাই এক রোগিণীকে দেখতে, তারপর পরমহংসের কাছে। তিনি মৃত। গত রাত্রে একটার সময় তার দেহাবসান হয়েছে, He was lying on the left side legs drawn up, eyes open, mouth partly open,...।’’

কাশীপুর মহাশ্মশানের উদ্দেশে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল বিকেল ছ’টার পর। [৯৬] কলকাতা কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ তাঁদের শ্মশান ঘাটের একটি ঐতিহাসিক রেজিস্টার থেকে রামকৃষ্ণ-দেহাবসানের নথিপত্রের ছবি বেলুড়ের সংগ্রহশালায় দান করতে চলেছেন। [৯৭]

স্বামী প্রভানন্দ তার ‘শ্রীরামকৃষ্ণের অন্ত্যলীলা’ বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডে (প্রথম প্রকাশ আষাঢ় ১৩৯৪) সরকারি নথি থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন:

রাম কিষ্টো প্রমোহংশ
৪৯ কাশিপুর রোড্, বয়স ৫২
মৃত্যু তারিখ- ১৫ আগস্ট ১৮৮৬
সেক্স-পুরুষ, গতি ব্রাহ্মণ
পেশা- ‘প্রিচার’
মৃত্যুর কারণ-গলায় আলসার
কে রিপোর্ট করেছেন-জি সি ঘোষ, বন্ধু

সংক্ষেপিত ‘জি সি ঘোষ’ নামটি পূর্বনাম গোপালচন্দ্র ঘোষ (সুর)।

Remove ads

মিশনের যাত্রারম্ভ

তার প্রয়াণের পর বিবেকানন্দ সন্ন্যাসী শিষ্যদের নিয়ে বরাহনগরে একটি পোড়ো বাড়িতে ওঠেন এবং গৃহী শিষ্যদের অর্থসাহায্যে প্রথম মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। শুরু হয় রামকৃষ্ণ মিশনের যাত্রা।[৭৮]

উপদেশ

সারাংশ
প্রসঙ্গ
Thumb
শ্রীরামকৃষ্ণের ফটোগ্রাফ - কলকাতার রাধাবাজারে দ্য বেঙ্গল ফটোগ্রাফার্স স্টুডিওতে তোলা ছবি, তারিখ ১০ ডিসেম্বর, ১৮৮১


লোকশিক্ষক হিসাবে রামকৃষ্ণ পরমহংস ছিলেন খুবই জনপ্রিয়। গ্রাম্য বাংলায় ছোটো ছোটো গল্পের মাধ্যমে দেওয়া তার উপদেশাবলি জনমানসে বিস্তার ব্যপকভাবে বিস্তার করেছিল।[] ঈশ্বর-উপলব্ধিই তিনি মানবজীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্য বলে মনে করতেন।[৯৮] শ্রীরামকৃষ্ণের মতে, কাম ও অর্থই একমাত্র মানুষকে ঈশ্বরের পথ হতে বিচ্যুত করে; তাই “কাম-কাঞ্চন” বা “কামিনী-কাঞ্চন” ত্যাগের পথই তার কাছে ছিল ঈশ্বরের পথ।[৯৯] জগৎকে তিনি ‘মায়া’ বলে উল্লেখ করেছেন। তার মতে জগতের অন্ধকার শক্তি ‘অবিদ্যা মায়া’ (অর্থাৎ, কামনা, বাসনা, লোভ, মোহ, নিষ্ঠুরতা ইত্যাদি) মানুষকে চেতনার সর্বনিম্ন স্তরে নামিয়ে আনে। এই মায়া মানুষকে কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ করে। অন্যদিকে সৃষ্টির আলোকময় শক্তি ‘বিদ্যা মায়া’ (অর্থাৎ, আধ্যাত্মিক গুণাবলি, জ্ঞান, দয়া, শুদ্ধতা, প্রেম ও ভক্তি) মানুষকে চৈতন্যের সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যায়।[১০০]

শ্রীরামকৃষ্ণ ইসলামখ্রিস্টধর্ম সহ বিভিন্ন ধর্মমত অভ্যাস করেছিলেন এবং উপলব্ধি করেছিলেন সকল মতই একই ঈশ্বরের পথে মানুষকে চালিত করে।[১০১] তিনি ঘোষণা করেন “যত্র জীব তত্র শিব” অর্থাৎ, যেখানেই জীবন, সেখানেই শিবের অধিষ্ঠান। “জীবে দয়া নয়, শিবজ্ঞানে জীবসেবা” – তার এই উপদেশ স্বামী বিবেকানন্দের কর্মের পাথেয় হয়েছিল।[১০২] 'শ্রীম' অর্থাৎ মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত প্রণীত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত গ্রন্থে তার ধর্মভাবনার মূল কথাগুলি লিপিবদ্ধ আছে। শ্রীরামকৃষ্ণের অনুগামীদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ এটিই।

প্রভাব

সারাংশ
প্রসঙ্গ

রামকৃষ্ণ মিশন

Thumb
রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রধান কার্যালয় বেলুড় মঠের রামকৃষ্ণ মন্দির।
Thumb
ফ্রাঞ্জ ডোরেকের আঁকা রামকৃষ্ণ পরমহংসের তৈলচিত্র

রামকৃষ্ণ পরমহংসের নামে একাধিক প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে।[১০৩] রামকৃষ্ণ মঠমিশন হল স্বামী বিবেকানন্দের স্থাপন করা প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলির একটি। এটি স্থাপিত হয়েছে ১৮৯৭ সালে। স্বাস্থ্যরক্ষা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ত্রাণকার্য, গ্রাম ব্যবস্থাপনা, আদিবাসী কল্যাণ, প্রাথমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিস্তারে রামকৃষ্ণ মিশন একাধিক শাখাকেন্দ্রের মাধ্যমে কাজ করে থাকে। রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যকলাপ ভারতে হিন্দু পুনর্জাগরণ আন্দোলনের একটি অন্যতম প্রধান অঙ্গ হিসেবে গণ্য হয়। রামকৃষ্ণ পরমহংসের নামাঙ্কিত আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ১৯২৩ সালে স্বামী অভেদানন্দ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ (বেদান্ত সোসাইটি)। ১৯২৯ সালে রামকৃষ্ণ মিশনের কয়েক জন বিক্ষুব্ধ সদস্য স্থাপন করেন রামকৃষ্ণ সারদা মঠ। ১৯৭৬ সালে স্বামী নিত্যানন্দ স্থাপন করেন রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশন। ১৯৫৯ সালে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ভগিনী সংগঠন হিসেবে স্থাপিত হয় শ্রীসারদা মঠ ও রামকৃষ্ণ সারদা মিশন[১০৩] ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর ভারতীয় ও বঙ্গীয় নবজাগরণে রামকৃষ্ণ পরমহংসকে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব মনে করা হয়। ম্যাক্স মুলার, মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, শ্রীঅরবিন্দলিও টলস্টয় মানবসমাজে রামকৃষ্ণ পরমহংসের অবদানের কথা স্বীকার করেছেন। ফ্রাঞ্জ ডোরাক (১৮৬২–১৯২৭) ও ফিলিপ গ্লাসের শিল্পকর্মে রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রভাব দেখা যায়।

রামকৃষ্ণ পরমহংস সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার "পরমহংস রামকৃষ্ণদেবের প্রতি" কবিতাটি লিখেছিলেন:[১০৪]

বহু সাধকের বহু সাধনার ধারা,
ধেয়ানে তোমার মিলিত হয়েছে তারা;
তোমার জীবনে অসীমের লীলাপথে
নূতন তীর্থ রূপ নিল এ জগতে;
দেশ বিদেশের প্রণাম আনিল টানি
সেথায় আমার প্রণতি দিলাম আনি।।

রামকৃষ্ণ মিশন আয়োজিত রামকৃষ্ণ পরমহংসের জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন প্রধান অতিথি। এই অনুষ্ঠানে তিনি রামকৃষ্ণ পরমহংসের অবদান সম্পর্কে নিজের উচ্চ ধারণার কথা উল্লেখ করেছিলেন। ১৯৩৭ সালে রামকৃষ্ণ মিশন কলকাতায় বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। এই সময় রামকৃষ্ণ পরমহংসের জন্মশতবর্ষ উৎসবও চলছিল। এই উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, "তার ব্যক্তিত্বের বিশালতা বোঝা যায় আপাত-বিরোধী সাধনপদ্ধতিগুলির অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে। আর তার মনের সরলতা পুরোহিত ও যাজকশ্রেণীর আড়ম্বর ও পাণ্ডিত্যকে চিরকালের জন্য ম্লান করে দিয়েছে।"[১০৫]

Remove ads

মূল্যায়ন

রামকৃষ্ণ পরমহংসের ব্যক্তিত্ব, ধর্মীয় অভিজ্ঞতা ও তার সাধনা, বিশেষত তন্ত্র ও মধুর ভাব সাধনা বিশিষ্ট দার্শনিক তথা বিদ্বজ্জন কর্তৃক পর্যালোচিত হয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধি, যা চিকিৎসাশাস্ত্রের লক্ষণ অনুসারে মৃত্যুবৎ, তাও বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক ও গবেষকের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়েছে। রোম্যাঁ রোলাঁ, সুধীর কক্কর, নরসিংহ শীল, জেফরি কৃপাল, অ্যালান রোনাল্ড, ডক্টর জিন ওপেনশ, সোমনাথ ভট্টাচার্য, কেলি অ্যান রাব ও জে এস হলে প্রমুখ পণ্ডিতগণ এই সব ক্ষেত্রে মনোবিশ্লেষণমূলক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অবশ্য এই ব্যাখ্যা অনেকক্ষেত্রেই বিতর্কিত। তার ব্যক্তিত্ব ও ধর্মমত, যা রামকৃষ্ণ মিশনের সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলনের মূলভিত্তি, তার পর্যালোচনা করেছেন লিও শ্নাইডারম্যান, ওয়াল্টার জি নিভাল, সাইরাস আর প্যাঙ্গবর্ন ও অমিয় পি সেন।

Remove ads

গ্রন্থপঞ্জি

      • বাংলা
  • শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, শ্রীম কথিত, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, প্রথম অখণ্ড সংস্করণ, ১৯৮৬-৮৭
  • শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ, প্রথম ভাগ, স্বামী সারদানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, দ্বাদশ সংস্করণ, ১৯৬০
  • শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ, দ্বিতীয় ভাগ, স্বামী সারদানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, একাদশ সংস্করণ, ১৯৬৩
  • শ্রীরামকৃষ্ণজীবনী, স্বামী তেজসানন্দ সংকলিত, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, ১৯৬২
      • ইংরেজি
  • Bhattacharyya, Somnath। "Kali's Child: Psychological And Hermeneutical Problems"। Infinity Foundation। সংগ্রহের তারিখ ১৫ মার্চ ২০০৮
  • Chetanananda, Swami (১৯৯০)। Ramakrishna As We Saw Him। St. Louis: Vedanta Society of St Louis। আইএসবিএন ৯৭৮-০৯১৬৩৫৬৬৪৪
  • Gupta, Mahendranath (১৯৮৫)। The Gospel of Sri Ramakrishna। Ramakrishna-Vivekananda Center। আইএসবিএন ৯৭৮-০৯১১২০৬০১২ {{বই উদ্ধৃতি}}: অজানা প্যারামিটার |coauthors= উপেক্ষা করা হয়েছে (|author= প্রস্তাবিত) (সাহায্য)
  • Hixon, Lex (১৯৯৬)। Great Swan: Meetings With Ramakrishna। Burdett, N.Y: Larson Publications। আইএসবিএন ০-৯৪৩৯১৪-৮০-৯
  • Paul Hourihan। Ramakrishna & Christ, the Supermystics: New Interpretations। Vedantic Shores Press। আইএসবিএন ১-৯৩১৮১৬-০০-X
  • Isherwood, Christopher (১৯৮০)। Ramakrishna and His Disciples। Hollywood, Calif: Vedanta Press। আইএসবিএন ০-৮৭৪৮১-০৩৭-X (reprint, orig. 1965)
  • Jeffrey J. Kripal (১৯৯৫)। Kali's Child: The Mystical and the Erotic in the Life and Teachings of Ramakrishna। University of Chicago Press।
  • ম্যাক্স মুলারRamakrishna: His Life and Sayings। Advaita Ashrama। আইএসবিএন ৮১-৭৫০৫-০৬০-৮
  • Olson, Carl (১৯৯০)। The Mysterious Play of Kālī: An Interpretive Study of Rāmakrishna। American Academy of Religion (Scholars Press)। আইএসবিএন ১-৫৫৫৪০-৩৩৯-৫
  • Rajagopalachari, Chakravarti (১৯৭৩)। Sri Ramakrishna Upanishad। Vedanta Press। এএসআইএন B0007J1DQ4
  • Ramaswamy, Krishnan (২০০৭)। Invading the Sacred: An Analysis of Hinduism Studies in America। Delhi, India: Rupa & Co। আইএসবিএন ৯৭৮-৮১২৯১১১৮২১ {{বই উদ্ধৃতি}}: অজানা প্যারামিটার |coauthors= উপেক্ষা করা হয়েছে (|author= প্রস্তাবিত) (সাহায্য)
  • Rolland, Romain (১৯২৯)। Life of Ramakrishna। Vedanta Press। আইএসবিএন ৯৭৮-৮১৮৫৩০১৪৪০ {{বই উদ্ধৃতি}}: আইএসবিএন / তারিখের অসামঞ্জস্যতা (সাহায্য)
  • Saradananda, Swami (২০০৩)। Sri Ramakrishna and His Divine Play। St. Louis: Vedanta Society। আইএসবিএন ৯৭৮-০৯১৬৩৫৬৮১১ {{বই উদ্ধৃতি}}: অজানা প্যারামিটার |coauthors= উপেক্ষা করা হয়েছে (|author= প্রস্তাবিত) (সাহায্য)
  • Saradananda, Swami (১৯৫২)। Sri Ramakrishna The Great Master। Sri Ramakrishna Math। এএসআইএন B000LPWMJQ {{বই উদ্ধৃতি}}: অজানা প্যারামিটার |coauthors= উপেক্ষা করা হয়েছে (|author= প্রস্তাবিত) (সাহায্য)
  • Satyananda Saraswati। Ramakrishna: The Nectar of Eternal Bliss। Devi Mandir Publications। আইএসবিএন ১-৮৭৭৭৯৫-৬৬-৬
  • Torwesten, Hans (১৯৯৯)। Ramakrishna and Christ, or, The paradox of the incarnation। The Ramakrishna Mission Institute of Culture। আইএসবিএন ৯৭৮-৮১৮৫৮৪৩৯৭১
  • Ananyananda, Swami (১৯৮১)। Ramakrishna: a biography in pictures। Advaita Ashrama, Calcutta। আইএসবিএন ৯৭৮-৮১৮৫৮৪৩৯৭১
  • Tyagananda, Swami। "Kali's Child Revisited or Didn't Anyone Check the Documentation?"। Infinity Foundation। সংগ্রহের তারিখ ১৫ মার্চ ২০০৮
Remove ads

আরও কয়েকজন মহান সাধক

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

Loading related searches...

Wikiwand - on

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.

Remove ads