Loading AI tools
প্রাচীন মিশরীয় দেবতা উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
আনুবিস (/əˈnjuːbɪs/;[2] প্রাচীন গ্রিক: Ἄνουβις) বা প্রাচীন মিশরীয় ভাষায় নামান্তরে ইনপু, ইনপও, জ্নপও বা আনপু (কিবতীয়: ⲁⲛⲟⲩⲡ, প্রতিবর্ণী. Anoup) হলেন প্রাচীন মিশরীয় ধর্মে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দেবতা, সমাধিক্ষেত্রের রক্ষাকর্তা এবং পাতাললোকের পথপ্রদর্শক। তাঁকে সাধারণত শ্বদন্তী বা শ্বদন্তীমুখী মানুষের আকারে চিত্রিত করা হত।
অন্যান্য অনেক মিশরীয় দেবদেবীর মতো আনুবিসও বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ভূমিকা গ্রহণ করেন বলে মনে করা হত। প্রথম রাজবংশের যুগেই (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩১০০ – ২৮৯০ অব্দ) সমাধিক্ষেত্রের রক্ষাকর্তা হিসেবে চিত্রিত আনুবিসকে মমি-প্রস্তুতকারকও বলা হত। মধ্য রাজত্বকালে (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২০৫৫-১৬৫০ অব্দ) পাতাললোকের অধিপতি রূপে মিশরীয় ধর্মবিশ্বাসে তাঁকে স্থানচ্যূত করেন ওসাইরিস। তাঁর অন্যতম প্রধান ভূমিকা ছিল পরলোকে মৃতের আত্মাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও। মিশরীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, "হৃদয়ের ভার পরিমাপ"-এর সময় তিনি তুলাদণ্ডের সামনে উপস্থিত থাকতেন এবং এই অনুষ্ঠানেই মৃতের আত্মা মৃতের রাজ্যে প্রবেশের যোগ্য কিনা নির্ধারিত হত। মিশরীয় দেবমণ্ডলীতে সর্বাপেক্ষা অধিক বার উল্লিখিত ও চিত্রিত দেবতাদের অন্যতম ছিলেন আনুবিস। অবশ্য কোনও প্রাসঙ্গিক অতিকথা তাঁর উপর আরোপ করা হয়নি।[3]
আনুবিসের গায়ের রং ছিল কালো। এই রংটি ছিল পুনরুজ্জীবন, জীবন, নীল নদের পলি মাটি এবং মমিকরণের পর মৃতদেহের বর্ণহানির প্রতীক। আনুবিস তাঁর ভ্রাতা তথা কুকুরমুখী বা কুকুররূপী শ্বদন্তী দেবতা ওয়েপওয়াওয়েতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে ওয়েপওয়াওয়েতের গায়ে ছিল ধূসর বা সাদা পশুলোম। ইতিহাসবিদেরা মনে করেন যে, দুই দেবতা ক্রমে সংযুক্ত হয়ে পড়েছিলেন।[4] আনুবিসের নারী প্রতিরূপ ছিলেন আনপুত এবং আনুবিসের কন্যা ছিলেন সর্পদেবী কেবেচেত।
"আনুবিস" নামটি হল এই দেবতার মিশরীয় নামের গ্রিক রূপান্তর।[5][6] খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে মিশরে গ্রিক জাতি উপনীত হওয়ার আগে আনুবিস পরিচিত ছিলেন আনপু বা ইনপু নামে। প্রাচীন মিশরীয় ভাষায় নামটির শব্দমূলের অর্থ ছিল "এক রাজকীয় শিশু"। ইনপু শব্দের একটি শব্দমূল ছিল "ইন্প" অর্থাৎ "ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়া"। আনুবিস "প্রথম পশ্চিমবাসী", "পবিত্র ভূমির অধিপতি", "নিজ পবিত্র পর্বতের উপর অধিষ্ঠানকারী", "নয় ধনুকের শাসক", "লক্ষগ্রাসী কুকুর", "গুহ্যতত্ত্বের অধিপতি", "মমিকরণ-স্থলে অধিষ্ঠানকারী" এবং "দিব্য কক্ষের অগ্রণী" নামেও পরিচিত ছিলেন।[7] "নিজ পবিত্র পর্বতের উপর অধিষ্ঠানকারী", "পবিত্র ভূমির অধিপতি", "প্রথম পশ্চিমবাসী" ও "মমিকরণ-স্থলে অধিষ্ঠানকারী" অভিধাগুলির মধ্যে যে স্থান তিনি অধিকার করেছিলেন সেগুলিও প্রতিফলিত হয়।[8]
পুরনো রাজ্যে (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৬৮৬ থেকে ২১৮১ অব্দ) চিত্রলিপিতে তাঁর নামটি লেখার প্রামাণ্য পদ্ধতিটি ছিল ইনপও (inpw) এই শব্দসংকেতটি লেখার পর একটি শিয়াল[lower-alpha 1], নিচে একটি ḥtp চিহ্ন:[10]
। পুরনো রাজ্যের শেষভাগে একটি দীর্ঘাকার আধারের উপর শিয়াল-সহ একটি নতুন মূর্তির আবির্ভাব দেখা যায় এবং সেটিই পরবর্তীকালে সুপ্রচলিত হয়ে পড়ে:[10]
।
আনুবিসের জ্নপও (jnpw) নামটির সম্ভাব্য উচ্চারণ [a.ˈna.pʰa(w)], যার ভিত্তি কপটিক আনোউপ এবং নামটির আক্কাদীয় প্রতিলিপি 𒀀𒈾𒉺⟨a-na-pa⟩ <ri-a-na-pa> "রেয়ানাপা", যা আমারনা পত্র ইএ ৩১৫-এ পাওয়া যায়।[11][12] যদিও এই প্রতিলিপিটিকে rˁ-nfr রূপেও বিশ্লেষণ করা যেতে পারে, যা চতুর্থ রাজবংশের রাজকুমার রানেফেরের অনুরূপ একটি নাম।
মিশরের আদি রাজবংশীয় যুগে (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩১০০-২৬৮৬ অব্দ) আনুবিসকে পূর্ণরূপে পশুমূর্তিতে অর্থাৎ "শিয়ালের" মাথা ও দেহ-বিশিষ্ট রূপে দেখানো হত।[13] প্রথম রাজবংশের হোর-আহা, দ্জের প্রমুখ ফ্যারাওদের রাজত্বকালে উৎকীর্ণ শিলালিপিগুলিতে যে শিয়ালদেবতাকে দেখা যায়, তিনি সম্ভবত আনুবিস।[14] প্রাগৈতিহাসিক মিশরে মৃতদেহ সমাধিস্থ করা হত অগভীর কবরে। সেই সময় থেকেই শিয়ালেরা সমাধিক্ষেত্রগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। কারণ, মাটি খুঁড়ে মানুষের পচা-গলা মৃতদেহ বের করে এনে খেয়ে ফেলত।[15] "কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হলে তার সমতুল্য হতে হবে" – এই ধারণা থেকে মৃতের রক্ষক হিসেবেও বেছে নেওয়া হয় শিয়ালকেই। কারণ, "সমাধিস্থকরণের অল্পকালের মধ্যেই সমাধিক্ষেত্রের আশেপাশে বসবাসকারী শিয়াল ও অন্যান্য বন্য কুকুর কর্তৃক মৃতদেহগুলি খুঁড়ে বের করা নিশ্চয় একটি সার্বিক সমস্যা (এবং দুশ্চিন্তার কারণ) হয়ে উঠেছিল।"[16]
পুরনো রাজ্যে আনুবিস ছিলেন মৃতের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দেবতা। মধ্য রাজ্যে (খ্রিস্টপূর্ব ২০০০-১৭০০ অব্দ) তাঁকে স্থানচ্যূত করেছিলেন ওসাইরিস।[17] খ্রিস্টপূর্ব ৩০ অব্দে মিশরে রোমান শাসনের সূত্রপাত ঘটলে সমাধি-চিত্রকলায় আনুবিসকে দেখা যেতে থাকে মৃত ব্যক্তিদের হাত ধরে তাদের ওসাইরিসের কাছে নিয়ে যেতে।[18]
আনুবিসের পিতামাতার পরিচয় অতিকথা, সময় ও সূত্র অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন। আদিকালীন পুরাণকথায় তাঁকে রা-এর পুত্র রূপে চিত্রিত করা হয়েছে।[19] প্রথম মধ্যবর্তী পর্যায়ে (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২১৮১-২০৫৫ অব্দ) শবাধার লিপিগুলিতে আনুবিসকে হয় গো-দেবী হেসাতের অথবা বেড়ালমুখী দেবী বাসতেতের পুত্র রূপে উল্লেখ করা হয়েছে।[20] অপর এক পরম্পরায় তাঁকে রা ও নেফথিসের পুত্র রূপে বর্ণনা করা হয়েছে।[19] গ্রিক লেখক প্লুটার্ক (আনুমানিক ৪০-১২০ অব্দ) এমন এক পরম্পরার কথা জানিয়েছেন, যে পরম্পরায় মনে করা হত আনুবিস ছিলেন নেফথিস ও ওসাইরিসের অবৈধ পুত্র, কিন্তু ওসাইরিসের পত্নী আইসিস আনুবিসকে দত্তক গ্রহণ করেছিলেন:[21]
কারণ যখন আইসিস জানতে পেরেছিলেন যে ওসাইরিস আইসিসের ভগিনীকে ভালোবাসেন এবং আইসিস ভেবে ভুল করে তাঁর ভগিনীর সঙ্গেই সম্পর্ক স্থাপন করেছেন, এবং যখন তিনি দেখলেন যে তার একটি প্রমাণ ক্লোভারের একটি মালার আকারে ওসাইরিস ফেলে গিয়েছেন নেফথিসের কাছে – তিনি একটি শিশুর সন্ধান করছিলেন, কারণ, নেফথিস সেথের ভয়ে জন্মদান করেই শিশুটিকে পরিত্যাগ করেছিলেন; এবং যখন আইসিস জানতে পারলেন যে শিশুটিকে সাহায্য করছে কুকুরেরা, যারা অনেক কষ্ট করে শিশুটিকে তাঁর কাছে নিয়ে এসেছিল, তিনি শিশুটিকে প্রতিপালন করেন এবং সে আইসিসের রক্ষী ও সহযোগীতে পরিণত হয় আনুবিস নামে।
মিশরতত্ত্ববিদ জর্জ হার্ট এই কাহিনির মধ্যে "ওসাইরিসীয় দেবমণ্ডলীতে স্বাধীন দেবতা আনুবিসকে একত্রীভূত করার একটি প্রয়াস" খুঁজে পেয়েছেন।[20] রোমান যুগের ( খ্রিস্টপূর্ব ৩০ অব্দ -৩৮০ খ্রিস্টাব্দ) একটি মিশরীয় প্যাপিরাসে সাদামাটাভাবে আনুবিসকে বলা হয়েছে "আইসিসের পুত্র"।[20] নুবিয়াতে আনুবিসকে তাঁর মা নেফথিসের স্বামী হিসেবে দেখা হত।[1]
টলেমীয় যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০-৩০ অব্দ) মিশর যখন গ্রিক ফ্যারাও শাসিত একটি হেলেনীয় রাজ্যে পরিণত হয়েছিল, তখন আনুবিস গ্রিক দেবতা হার্সিমের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে হার্মানুবিসে পরিণত হয়।[22][23] দুই দেবতাকেই একক জ্ঞান করা হত, কারণ, তাঁরা দু’জনেই মৃতের আত্মাকে পরলোকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যান বলে বিশ্বাস করা হত।[24] এই দেবতার কাল্ট কেন্দ্রটি ছিল উতেন-হা/সা-কা/সিনোপোলিস। এই স্থানটির গ্রিক নামের অর্থ "কুকুরের শহর"। আপুলেইয়াসের লেখা দ্য গোল্ডেন অ্যাস উপন্যাসের একাদশ খণ্ড থেকে এমন প্রমাণ পাওয়া যায় যে, অন্তত খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত এই দেবতার পূজা অব্যাহত ছিল। বাস্তবিকই হার্মানুবিসকে পাওয়া যায় মধ্যযুগ ও রেনেসাঁ যুগের অ্যালকেমি-সংক্রান্ত ও হার্মেটিকবাদী সাহিত্যেও।
যদিও গ্রিকরা ও রোমানরা সচরাচর মিশরীয়দের পশুপাখি-মুখী দেখদেবীদের অদ্ভুত ও সেকে বলে তাচ্ছিল্য করত (গ্রিকরা উপহাস করে আনুবিসকে বলত "ঘেউ ঘেউ-কারী"), তবুও আনুবিসকে কখনও সখনও যুক্ত করা হত স্বর্গের সিরিয়াস এবং পাতাললোকের সারবেরাস ও হেডিসের সঙ্গে।[25] নিজের সংলাপগুলিতে প্লেটো প্রায়শই উল্লেখ করেছেন যে, সক্রেটিস "কুকুরের দিব্যি" (গ্রিক: kai me ton kuna), "মিশরের কুকুরের দিব্যি" এবং "কুকুর ও মিশরীয়দের দেবতার দিব্যি" – এই শপথবাক্যগুলি উচ্চারণ করতেন পাতাললোকের সত্যের নিয়ন্তা হিসেবে আনুবিসের উপর গুরুত্ব আরোপ ও আনুবিসের কাছে আবেদন করার জন্য।[26]
jmy-wt (ইমিউত অথবা ইমিউত ফেটিশ) অর্থাৎ "মমিকরণের স্থানে অবস্থানকারী" হিসেবে আনুবিস মমিকরণের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তাঁর অপর নাম ছিল ḫnty zḥ-nṯr অর্থাৎ "যিনি দেবতার কক্ষ পরিচালনা করেন"; এখানে "কক্ষ" বলতে মমিকরণের স্থান অথবা ফ্যারাওয়ের সমাধিকক্ষ উভয়কেই বোঝাতে পারে।[27][28]
ওসাইরিস অতিকথায় দেখা যায়, আনুবিস আইসিসকে ওসাইরিসের মমিকরণে সাহায্য করেছিলেন।[17] বাস্তবিকই যখন ওসাইরিস অতিকথার উত্থান ঘটেছিল, তখন বলা হয়েছিল যে সেতের হাতে নিহত হওয়ার পর ওসাইরিসের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আনুবিসকে উপহার দেওয়া হয়েছিল। এই সূত্রেই আনুবিস মমিকরণ-কারীদের পৃষ্ঠপোষক দেবতায় পরিণত হন। মৃতের বই-এ প্রায়শই চিত্রিত হয়েছে যে, মমিকরণ-সংক্রান্ত আচার-অনুষ্ঠানগুলি পালনের সময় নেকড়ের মুখোশধারী একজন পুরোহিত খাড়া করে দাঁড় করানো মমি ধরে রয়েছেন।
আনুবিস ছিলেন সমাধি ও সমাধিক্ষেত্রের অন্যতম রক্ষাকর্তা। মিশরীয় লিপি ও অভিলিখনগুলিতে তাঁর নামের সঙ্গে বেশ কয়েকটি উপাধি যুক্ত হয়েছে এই ভূমিকাটির প্রেক্ষিতে। খেনতি-আমেনতিউ (অর্থাৎ, "প্রথম পশ্চিমবাসী") উপাধিটি এবং অপর এক পৃথক শ্বদন্তী অন্ত্যেষ্টি-দেবতার নামও আনুবিসের এই রক্ষাকারী ভূমিকার ইঙ্গিতিবাহী। কারণ, মৃত ব্যক্তিদের সাধারণত নীল নদের পশ্চিম তীরে সমাধিস্থ করা হত।[29] অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সঙ্গে তাঁর সংযোগের প্রেক্ষিতে তাঁকে আরও কয়েকটি নাম দেওয়া হয়েছিল। যেমন, tpy-ḏw.f (তেপি-দ্জুয়েফ, অর্থাৎ "নিজ পর্বতের উপর অধিষ্ঠানকারী", নিহিতার্থে: উপর থেকে সমাধির তত্ত্বাবধানকারী) ও nb-t3-ḏsr (নেব-তা-দ্জেসের, অর্থাৎ "পবিত্র ভূমির অধিপতি", নিহিতার্থে: মরুভূমিস্থ সমাধিনগরীর এক দেবতা)।[27][28]
জুমিলহাক প্যাপিরাসে অপর এক কাহিনির বিবরণ আছে, যেখানে বলা হয়েছে যে, আনুবিস সেতের হাত থেকে ওসাইরিসের মৃতদেহটিকে রক্ষা করেছিলেন। সেত নিজেকে একটি চিতাবাঘে রূপান্তরিত করে ওসাইরিসের দেহ আক্রমণ করার চেষ্টা করেছিলেন। আনুবিস সেতকে থামিয়ে দেন এবং পরাজিত করেন। সেতের চামড়ায় তিনি গরম লৌহদণ্ডের দ্বারা ছেঁকা দিয়ে দেন। তারপর আনুবিস সেতের ছাল ছাড়িয়ে নিয়ে সেই চামড়া পরিধান করেন মৃতের সমাধিগুলি অপবিত্রকরণের দুষ্কর্মকারীদের প্রতি সতর্কবাণী হিসেবে।[30] মৃতের অন্ত্যেষ্টি-অনুষ্ঠানে উপস্থিত পুরোহিতেরা সেতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আনুবিসের বিজয় স্মরণ করে চিতাবাঘের চামড়া পরিধান করত। আনুবিস কর্তৃক চিতাবাঘ-রূপী সেতের গায়ে ছেঁকা দেওয়ার কিংবদন্তির মাধ্যমে চিতাবাঘের গায়ের চাকা-চাকা দাগগুলির কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হত।[31]
অধিকাংশ প্রাচীন সমাধিতে আনুবিসের উদ্দেশ্যে রচিত প্রার্থনা খোদাই করা ছিল।[32]
পরবর্তীকালীন ফ্যারাও যুগের (খ্রিস্টপূর্ব ৬৬৪-৩৩২ অব্দ) মধ্যেই আনুবিসকে প্রায়শই চিত্রিত করা হত ব্যক্তির আত্মাকে জীবিতের জগতের প্রবেশপথ পেরিয়ে পরলোকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার অবস্থায়।[33] অবশ্য একই রকম একটি ভূমিকা মাঝে মাঝে গোমুখী দেবী হাথোরের উপরও আরোপ করা হত। তবে এই কাজটি সম্পূর্ণ করার জন্য সাধারণত বেছে নেওয়া হত আনুবিসকেই।[34] মিশরের ইতিহাসের রোমান যুগের গ্রিক লেখকেরা এই ভূমিকাটিকে চিহ্নিত করেন "সাইকোপম্প" (গ্রিক ভাষায় যার অর্থ "আত্মার পথপ্রদর্শক") হিসেবে। এই ভূমিকাটি গ্রিকরা আরোপ করত তাদের দেবতা হার্মিসের উপর। গ্রিক ধর্মে হার্মিসই এই ভূমিকাটি পালন করতেন।[24] এই যুগের অন্ত্যেষ্টি শিল্পকলায় আনুবিসকে চিত্রিত করা হয়েছে গ্রিক পোষাক পরিহিত নারী ও পুরুষকে ওসাইরিসের কাছে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। উল্লেখ্য, বহুকাল আগেই মিশরীয় বিশ্বাসে পাতাললোকের অধিপতি হিসেবে আনুবিসের বদলে ওসাইরিস প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন।[35]
আনুবিসের অন্যতম ভূমিকা ছিল "তুলাদণ্ডের তত্ত্বাবধায়ক"।[36] মৃতের বই-তে হৃদয়ের ভার পরিমাপের যে সঙ্কটপূর্ণ দৃশ্যটি বর্ণিত হয়েছে তাতে দেখা যায়, আনুবিস কোনও ব্যক্তি মৃত্যুর পর মৃতের রাজ্যে (মিশরীয় পুরাণে দুয়াত নামে পরিচিত পাতাললোক) প্রবেশের যোগ্য কিনা তা পরিমাপ করে স্থির করছেন। তুলাদণ্ডের একদিকে থাকত মৃত ব্যক্তির হৃদয় এবং অপর দিকে থাকত মাতের (বা "সত্য") প্রতীক (প্রায়শই এটি ছিল উটপাখির একটি পালক); এই দুইয়ের তুলনা করে আনুবিস আত্মার গতি নির্ধারণ করে দিতেন। যে আত্মার ওজন পালকটির থেকে বেশি হত সেই আত্মাকে গ্রাস করতেন আমমিত এবং যে আত্মার ওজন পালকটির থেকে কম হত তাকে প্রেরণ করা হয় স্বর্গলোকে।[37][38]
প্রাচীন মিশরীয় শিল্পকলায় যে-সব দেবদেবী প্রায়শই চিত্র বা মূর্তির আকারে বর্ণিত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন আনুবিস।[3] প্রথম রাজবংশের যুগ থেকেই রাজ-সমাধিগুলিতে তাঁর চিত্র বা মূর্তি প্রদর্শিত হয়ে এসেছিল।[7] এগুলিতে সচরাচর দেখা যেত আনুবিস রাজার মৃতদেহের পরিচর্যা করছেন, মমিকরণ অনুষ্ঠান ও অন্ত্যেষ্টি-ক্রিয়ায় সার্বভৌমত্ব প্রদান করছেন অথবা দুই সত্যের সভাগৃহে আত্মার হৃদয়ের ভার পরিমাপের সময় সহকারী দেবতাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন।[8] তাঁর সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় রূপগুলির মধ্যে একটি ছিল তীক্ষ্ণাগ্র কর্ণ সহ-শৃগালমুখী ও মনুষ্যদেহধারী, দণ্ডায়মান বা হাঁটু গেড়ে বসা, আত্মার হৃদয় ও মাতের সাদা সত্য পালক সহ সোনার তুলাদণ্ড হাতে ধরে থাকা মূর্তিটি।[7]
আদি রাজবংশীয় যুগে আনুবিসকে কালো শ্বদন্তী পশুর আকারে চিত্রিত করা হত।[39] তাঁর স্বাতন্ত্র্যসূচক কালো রংটি পশুটির প্রতীক ছিল না, বরং এটির একাধিক প্রতীকী অর্থ ছিল।[40] এটি ছিল "মমিকরণের সময় মৃতদেহকে ন্যাট্রন দিয়ে পরিচর্যা এবং রজন-সদৃশ পদার্থ দিয়ে মমি করার বস্ত্রখণ্ডগুলিকে নিষিক্ত করার পর মৃতদেহের বর্ণহানি"-র প্রতীক।[40] নীল নদের উর্বর পলি মাটির রং কালো হওয়ায় এই রংটি মিশরীয়দের কাছে উর্বরতা ও পরলোকে পুনর্জন্ম-লাভেরও প্রতীক ছিল।[41] মধ্য রাজত্বকালে আনুবিসকে প্রায়শই এক শৃগালমুখী পুরুষের রূপে চিত্রিত করা হত।[42] আনুবিস সহ অসংখ্য প্রাচীন মিশরীয় দেবদেবীদের আফ্রিকান শিয়ালের রূপে চিত্রিত করা হত।[43] অ্যাবিডোসে দ্বিতীয় রামেসিসের একটি উপাসনালয়ে আনুবিসকে পরিপূর্ণ মানবাকৃতিতে চিত্রিত করা হয়েছে। এটি আনুবিসের একটি অতি-বিরল চিত্রণ।[40][6]
আনুবিসকে প্রায়শই চিত্রিত করা হত একটি রিবন-পরিহিত অবস্থায় এবং হাতে রাখালের ছড়িতে একটি nḫ3ḫ3 বা "কস্তানি" সহ।[42] আনুবিসের অপর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল jmy-wt বা ইমিউত ফেটিশ, যা মমিকরণের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকার দ্যোতক।[44] অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার প্রেক্ষিতে আনুবিসকে দেখানো হত হয় মৃত ব্যক্তির মমির পাশে দণ্ডায়মান অথবা কোনও সমাধির উপর উপবিষ্ট হয়ে সমাধিটিকে রক্ষা করার ভঙ্গিতে। নতুন রাজ্যে সমাধি-সিলমোহরেও আনুবিসকে নয় ধনুকের উপর উপবিষ্ট অবস্থায় দেখা যায়। এই নয় ধনুক ছিল মিশরের শত্রুদের উপর তাঁর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের প্রতীক।[45]
অনেক অতিকথায় আনুবিসের উল্লেখ না থাকা সত্ত্বেও আনুবিস মিশরীয়দের ও অন্যান্যদের সংস্কৃতিতেও অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন।[7] গ্রিকরা তাঁকে যুক্ত করেছিল মৃতকে পরলোকে পথপ্রদর্শনকারী দেবতা হার্মিসের সঙ্গে। এই যুগল-রূপটি পরবর্তীকালে পরিচিত হয় হার্মানুবিস নামে। আধুনিক ধারণা যাই হোক না কেন, প্রাচীন মিশরীয়রা মনে করত তিনি মানুষকে আশা প্রদান করেন এবং এই আশাতেই আনুবিসের পূজা বহুল প্রচলিত ছিল। মৃত্যুর পর তাদের শরীর সম্মান লাভ করবে, তাদের আত্মা সুরক্ষিত থাকবে এবং ন্যায়বিচার পাবে এই কথা ভেবেই মানুষ বিস্মিত হত।[7]
আনুবিসের পুরোহিতেরা ছিলেন পুরুষ। তাঁরা অনুষ্ঠান আচরণের সময় আনুবিসের অনুকরণে কাঠের মুখোশ পরে নিতেন।[7][8] আনুবিসের কাল্ট কেন্দ্র ছিল উচ্চ মিশরের সিনোপোলিসে। তবে তাঁর স্মারক সর্বত্র নির্মিত হয়েছিল এবং মিশরের সর্বত্রই তিনি সমানভাবে সম্মান অর্জন করেছিলেন।[7]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.