Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ই-ৎসিঙ্ (৬৩৫-৭১৩ খ্রিস্টাব্দ) (সঠিক উচ্চারণ: ইজিঙ; অনেক ক্ষেত্রে ই-চিঙ নামও লেখা হয়[1]) ছিলেন তাং যুগের একজন বিখ্যাত চীনা বৌদ্ধ ভিক্ষু, পর্যটক এবং অনুবাদক। চীন ও ভারতের মধ্যবর্তী সমুদ্র রুটে তার ভ্রমণের বিবরণী মধ্যযুগীয় রাজ্যগুলোর (বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়ার শ্রীবিজয়ের) ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। নালন্দা বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের (বর্তমানে ভারতের বিহারে অবস্থিত) একজন শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি অনেক বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ সংস্কৃত ও পালি থেকে চীনা ভাষায় অনুবাদ করেছেন।
ই-ৎসিঙ্ | |
---|---|
জন্ম | ৬৩৫ খ্রিস্টাব্দ ফান-ইয়াং (ইয়ানজিং), তাং সাম্রাজ্য |
মৃত্যু | ৭১৩ খ্রিস্টাব্দ চ্যাং'আন (বর্তমান শিআন) |
পেশা | বৌদ্ধ ভিক্ষু, পর্যটক |
ব্যক্তিগত তথ্য | |
ধর্ম | বৌদ্ধ ধর্ম |
ঊর্ধ্বতন পদ | |
শিক্ষক | শি হুয়ান |
ই-ৎসিঙ্ | |||||||||
ঐতিহ্যবাহী চীনা | 義淨 | ||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
সরলীকৃত চীনা | 义净 | ||||||||
| |||||||||
বৌদ্ধ উপাধি | |||||||||
ঐতিহ্যবাহী চীনা | 三藏法師義淨 | ||||||||
সরলীকৃত চীনা | 三藏法师义净 | ||||||||
আক্ষরিক অর্থ | ত্রিপিটক ধর্ম-বিশারদ ই-ৎসিঙ্ | ||||||||
| |||||||||
ঝাং ওয়েনমিং | |||||||||
ঐতিহ্যবাহী চীনা | 張文明 | ||||||||
সরলীকৃত চীনা | 张文明 | ||||||||
|
ই-ৎসিঙ্ ৬৩৫ সালে বর্তমান বেইজিং-এর নিকটবর্তী ফান-ইয়াং (বর্তমানে চো-চৌ) এ জন্মগ্রহণ করেন। তখন তার নাম রাখা হয় জাং ওয়েনমিং। ৭ বছর বয়সেই তার শিক্ষা জীবন শুরু হয়। শানু এবং হুইজি নামক দুজন সন্ন্যাসীর অধীনে তিনি পড়াশোনা করতেন। কিন্তু, এর মাত্র ৫ বছরের মাথায় তার শিক্ষক শানু মৃত্যুবরণ করেন।[2] এসময় (১২ বছর বয়সে) বৌদ্ধ অনুশাসন সম্পর্কে তার আগ্রহ জন্মে। সেসময়, ফা-হিয়েন এবং হিউয়েন সাং উভয়ই ছিলেন প্রসিদ্ধ ভিক্ষু। তিনি তাদের দেখে বেশ অনুপ্রাণিত হন। এরই ফলশ্রুতিতে, ১৪ বছর বয়স থেকে তিনি সন্ন্যাসী হিসেবে জীবন যাপন করতে শুরু করেন।[3]
৬৫৪ সালে তিনি সেখানকার সন্ন্যাস সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হন।[3] তখন, তার গুরু হুইজি তাকে সন্ন্যাসীদের শৃঙ্খলা (বিনয়) কঠোরভাবে অনুসরণ করার আহ্বান জানান। এ কারণে তিনি তৎকালীন বিনয়পিটকের খ্যাতনামা শিক্ষক ফালি এবং দাওচুয়ানের কাছে আরও পাঁচ বছর বিনয়পিটক অধ্যায়ন করেন।[2]
ই-ৎসিঙ্ বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে আরো জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রখ্যাত বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দায় (বর্তমান ভারতের বিহার রাজ্যের অন্তর্গত) যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ফং নামক এক ব্যক্তি তার যাওয়ার খরচ বহন করে। এই ফাং সম্পর্কে ইতিহাসে আর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। যাইহোক, ৬৭১ খ্রিস্টাব্দে[3] তিনি কুয়াংচৌ (ক্যান্টন) থেকে পারস্যের নৌকায় করে যাত্রা শুরু করেন। ২২ দিন পর তিনি শ্রীবিজয়ায় (বর্তমান সুমাত্রার পালেমবাং) পৌঁছান। পরবর্তী ছয় মাসে তিনি সেখান থেকে সংস্কৃত ব্যাকরণ এবং মালয় ভাষা শেখেন। এরপর তিনি মালয় এবং কিতেহ (কেদাহ) রাজ্য ভ্রমণ করেন। ৬৭৩ সালে অতিরিক্ত ভ্রমণের দশ দিন পর তিনি "নগ্ন রাজ্য" (শু'র দক্ষিণ-পশ্চিমে) পৌঁছান। ই-ৎসিঙ্ "কুনলুন পিপলস" বইতে তার মনোভাব ব্যক্ত করে বলেন, "কুনলুনের লোকেরা কোঁকড়ানো চুল, গাঢ় রঙের দেহ বিশিষ্ট এবং তারা খালি পায়ে এবং সরোং পরে থাকে।" এরপরে তিনি ভারতের পূর্ব উপকূলে পৌঁছেছিলেন, যেখানে তিনি একজন প্রবীণ সন্ন্যাসীর সাথে সাক্ষাত করেন। তিনি সেখানে এক বছর অবস্থান করে সেই সন্ন্যাসীর কাছে সংস্কৃত অধ্যয়ন করেন। পরে তারা দুজনেই একদল বণিকের সাথে যোগ দেন এবং আরো ৩০টি রাজ্য পরিদর্শন করেন। এসময় তিনি মগধের বৌদ্ধ তীর্থস্থানগুলোতেও গমন করেন।[3] পরে নালন্দায় যাওয়ার সময়, মাঝপথে ই-ৎসিঙ্ অসুস্থ হয়ে যান এবং হাঁটতে অপারগ হয়ে পড়েন। ফলে দলটি ধীরে ধীরে তাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যায়। পরবর্তীতে তিনি হেঁটে নালন্দায় পৌঁছান।
নালন্দায় তিনি ৬৭৬-৬৮৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মোট দশ বছর অবস্থান করেন। সেখানে তিনি বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ বিনয়-পিটকের উপর জ্ঞানার্জন করেন।[3]
৬৮৫ সালে[3] (মতান্তরে ৬৮৭ সালে) ই-ৎসিঙ্ তাং চীন ফেরার পথে শ্রীবিজয় রাজ্যে থামেন। সেই সময়, পালেমবাং ছিল বৌদ্ধ ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র যেখানে দেশ-বিদেশের পণ্ডিতেরা সমবেত হতেন। ই-ৎসিঙ্ সেখানে থাকাকালীন সময়ে সংস্কৃত ভাষার বেশ কিছু বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থকে চীনা ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। ৬৮৯ সালে তিনি কালি এবং কাগজপত্র পেতে গুয়াংজুতে চলে যান (দ্রষ্টব্য: শ্রীবিজয়ে তখন কাগজ এবং কালি ছিল না)। একই বছর আবার শ্রীবিজয়ে ফিরে আসেন এবং আরো ৫ বছর সেখানে অবস্থান করেন।[3]
শেষ পর্যন্ত, ৬৯৫ সালে তিনি সমস্ত অনুবাদকার্য সম্পন্ন করেন এবং চীনের লুইয়াং-এ ফিরে আসেন। অর্থাৎ, প্রায় ২৫ বছর বিদেশ ভ্রমণ শেষে দেশে ফিরে আসেন। তখন তাং সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী ছিলেন উ জেতিয়ান, যিনি বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে বেশ খ্যাতিমান ছিলেন।[3] তিনি ই-ৎসিঙকে তার রাজ্যে স্বাগত জানান এবং সংবর্ধনা প্রদান করেন। তিনি চীনা ভাষায় অনুবাদ করা প্রায় ৪০০ বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ সাথে নিয়ে এসেছিলেন।[4][5] "দক্ষিণ সাগর থেকে স্বদেশে পাঠানো বৌদ্ধ ধর্মের দলিল" এবং "তাং সাম্রাজ্যের তীর্থযাত্রী বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ" ইজিংয়ের দুটি সেরা ভ্রমণ কাহিনী। এতে তিনি ভারতের সমাজ, বিভিন্ন সমাজের জীবনধারা স্থানীয় মানুষের বর্ণনা সহ আরও অনেক কিছু তুলে ধরেছেন।
ই-ৎসিঙ্ লিখেছেন যে, ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চলে সেখানে উভয় "ভেহিকল" (সংস্কৃত: যান)-এর অনুসারী ছিল। কিছু বৌদ্ধ হীনযান অনুসারে ধর্ম চর্চা করত এবং বাকিরা মহাযান অনুসারে ধর্ম চর্চা করত।[6] তবে তিনি উত্তর ভারত এবং দক্ষিণ সমুদ্রের বেশিরভাগ দ্বীপ (যেমন: সুমাত্রা, জাভা ইত্যাদি)-কে হীনযান প্রধান হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অন্যদিকে, চীন এবং মালয়ুর বৌদ্ধদের প্রধানত মহাযান অনুসরণকারী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।[6]
ই-ৎসিঙ্ বিভিন্ন "যান" এবং ভারতের আদিম বৌদ্ধ প্রথার মধ্যে সম্পর্কের বিষয়ে লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, "পশ্চিমে সম্প্রদায়গুলোর বিভিন্ন উপ-বিভাগ রয়েছে যার বিভিন্ন উৎস রয়েছে। তবে, অবিচ্ছিন্ন ঐতিহ্যের কেবলমাত্র চারটি প্রধান সম্প্রদায় রয়েছে।" এগুলো হল মহাসাংঘিক, স্থবিরা, মূলসর্বাস্তিবাদ এবং সমিতিয় নিকায়।[7] এদের তাত্ত্বিক অনুষঙ্গগুলোর ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি লিখেছেন, "চারটি সম্রদায়ের মধ্যে কোনটি মহাযানের সাথে আর কোনটি হীনযানের সাথে সম্পৃক্ত তা নির্ধারিত নয়।" এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের সদস্যরা "হীনযান" বা "মহাযান" যাই শিখুক না কেন, সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে খুব একটা সাদৃশ্য ছিল না।[8]
ই-ৎসিঙ্ শ্রীবিজয়ের উঁচু মানের বৌদ্ধ বৃত্তির প্রশংসা করেছিলেন এবং ভারতের নালন্দা যাত্রা করার আগে চীনা সন্ন্যাসীদেরকে সেখানে অধ্যয়নের পরামর্শ দিয়েছিলেন।
“ | ভোগার দুর্গ নগরীতে বৌদ্ধ পুরোহিতের সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি। তাদের মন ভাল শিক্ষা এবং অনুশীলনের জন্য ঝুঁকছে। তারা ভারতে বিদ্যমান বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা এবং অধ্যয়ন করে। তাদের বিধিমালা এবং অনুষ্ঠানগুলো মোটেই ভিন্ন নয়। তাই, কোনো চীনা যাজক যদি মূল ধর্মগ্রন্থগুলো পড়া এবং শোনার জন্য পশ্চিমে যেতে চান, তবে তার উচিৎ এখানে আরও দু-এক বছর অবস্থান করে সঠিক নিয়মগুলো অনুশীলন করা। | ” |
ইৎসিঙ্ তার শ্রীবিজয় সফরে পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দ্বীপ থেকে আসা লোকদের সাথে দেখা করার সুযোগ পান। তার মতে, হু-লিংয়ের জাভা রাজ্যটি ভোগা শহরের পূর্বদিকে ছিল এবং সমুদ্রপথে সেখানে যেতে চার-পাঁচ দিনের মতো সময় লাগত। তিনি আরও লিখেছেন যে, "দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপজুড়ে বৌদ্ধধর্মের বিকাশ ঘটেছিল। দক্ষিণ সমুদ্রের দ্বীপপুঞ্জগুলোর অনেক রাজা ও সর্দারগণ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রশংসা করেন এবং বিশ্বাস করেন যে, তাদের মন ভাল কাজ করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।"
ই-ৎসিঙ্ রচিত বইগুলোর মধ্যে দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। একটি হল "কিউফা গাওসেং জুয়ান" বা "চ’ইউ-ফা কাও-সেং চুয়ান"। ভারতে তিনি যেসব বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীর সাথে পরিচিত হয়েছিলেন তাদের সংক্ষিপ্ত জীবনী তিনি এ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। আসলে, ভারতে অনেক তীর্থযাত্রীর আগমন ঘটলেও অধিকাংশই তাদের ঘটনাবলী লিখে যাননি। এ বইয়ের মাধ্যমে তাদের অনেকের পরিচয় পাওয়া যায়। এ কারণেই এ বইটি গুরুত্বপূর্ণ।[3]
তার অপর বইটি হল "নান-হাই যিগুই নেইফা জুয়ান" বা "নান-হাই চি-কুই নেই-ফা চুয়ান"। এর অর্থ ‘দক্ষিণ সাগর থেকে স্বদেশে পাঠানো বৌদ্ধ ধর্মের দলিল’। এটি কেবল তার শ্রেষ্ঠ রচনাই নয়, বরং বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীদের লেখা বইগুলোর মধ্যেও এটি শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার।[3]
তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, তিনি ভারতীয় অঞ্চলে দীর্ঘ সময় অবস্থান করলেও এ অঞ্চলকে নিয়ে কোনো ভ্রমণ-কাহিনী লেখেননি। মনে করা হয়, তিনি হিউয়েন-সাং-এর জিউ জি বই সম্পর্কে জানতেন বলেই ভারত নিয়ে ভ্রমণ-কাহিনী লেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। তবে, তার বইগুলোতে ভারতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উৎসবগুলোর বিবরণ পাওয়া যায়।[3]
ই-ৎসিঙ্ ৬০ টিরও বেশি গ্রন্থ চীনা ভাষায় অনুবাদ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.