মহীনের ঘোড়াগুলি ১৯৭৬ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত প্রথম বাংলা স্বাধীন রক ব্যান্ড।[1] এটি ভারতের প্রথম রক ব্যান্ড যা ১৯৭০-এর দশকের মাঝ পর্বে কলকাতায় যাত্রা শুরু করে।[2][3] গৌতম চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়, প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, রঞ্জন ঘোষাল, এব্রাহাম মজুমদার, তাপস দাসতপেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, এই সাত জন সঙ্গীতশিল্পী সহকারে নব্বই দশকের পর তাঁরা ব্যাপকভাবে ভারতীয় রক যুগের কিংবদন্তি, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং সর্বাধিক প্রভাবশালী আভা-গার্দ সঙ্গীতদল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠেন।[4][5] আমেরিকান, লাতিন, রক, জ্যাজ, লোক, বাউল বিভিন্ন সঙ্গীত ধারায় নিরীক্ষামূলক কাজ এবং এসবের প্রভাবের মিশ্রণ থাকায় এই সঙ্গীত দলকে যে কোনো একটি সঙ্গীত শৈলী অনুসারে শ্রেণিভুক্ত বা আলাদা করা কঠিন হবে।[5] তবে বাউল সঙ্গীত এবং বাংলা রক ধারায় লোক ঐতিহ্যের স্বাধীনচর্চার পাশাপাশি প্রায়ই উদ্ভাবনী উপায়ে শাস্ত্রীয় উপাদান একত্রিত করার কারণে মহীনের ঘোড়াগুলিকে লোক-রক সঙ্গীত ব্যান্ড বলা যেতে পারে।

দ্রুত তথ্য মহীনের ঘোড়াগুলি, প্রাথমিক তথ্য ...
মহীনের ঘোড়াগুলি
Thumb
১৯৭৯ সালে রবীন্দ্রসদনে কনসার্টের সময়ে মহীনের ঘোড়াগুলি; বাম থেকে: রাজা ব্যানার্জী, প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, তাপস দাস, প্রণব সেনগুপ্ত, গৌতম চট্টোপাধ্যায় এবং রঞ্জন ঘোষালএব্রাহাম মজুমদার এবং বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন, যদিও এখানে অদৃশ্যমান।
প্রাথমিক তথ্য
উদ্ভবকলকাতা, ভারত
ধরন
কার্যকাল১৯৭৬ (1976)–১৯৮১ (1981); ১৯৯৫ (1995)–১৯৯৯ (1999)
লেবেল
  • গাথনি রেকর্ডস
  • হিন্দুস্তান রেকর্ডস
  • ভারতী রেকর্ডস
  • আশা অডিও
প্রাক্তন
সদস্য
বন্ধ

সত্তরের দশকে দলটি গড়ে উঠলেও প্রাথমিকভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। সে সময়ে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের গানে আমূল নতুনত্ব থাকলেও চলচ্চিত্রের গান বাণিজ্যিকভাবে প্রভাব বিস্তার করায় বাংলা সঙ্গীত জগতে একধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছিলো। ষাটের দশকের বব ডিলনের মতো তাদের সঙ্গীতেও শহুরে লোক আন্দোলনের একধরনের ব্যক্তিক আকূতি বা সামাজিক প্রকৃতির ছাপ রয়েছে। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত সংবিগ্ন পাখিকূল ও কলকাতা বিষয়ক (১৯৭৭), অজানা উড়ন্ত বস্তু বা অ-উ-ব (১৯৭৮) এবং দৃশ্যমান মহীনের ঘোড়াগুলি (১৯৭৯); এই তিনটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। যদিও সে সময়ে তারা প্রায় অপরিচিত ছিল বলা যায়। নব্বইয়ের দশকে তারা দ্য ভেলভেট আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ডের মতোন পুনরায় সমালোচনামূলক মূল্যায়ন পেয়েছে। ১৯৯৫ সালে সমসাময়িক বিভিন্ন শিল্পীদের সমন্বয়ে গৌতম চট্টোপাধ্যায় আবার বছর কুড়ি পরে শিরোনামে মহীনের ঘোড়াগুলির একটি কভার সংকলন প্রকাশ করেন। জীবনমুখী গান এবং নৈতিক সঙ্গীত দর্শনের কারণে বর্তমানে তাঁদেরকে বাংলা গানের পথিকৃৎ বিবেচনা করা হয়ে থাকে। গান রচনার শৈলী অনুযায়ী সমালোচনামূলক ভাবে বলা যায় তাঁরা জোরালোভাবে বাংলা লোক এবং আমেরিকান শহুরে লোক ধারা কর্তৃক প্রভাবিত।

আশির দশকের প্রারম্ভে ব্যান্ডটি ভেঙে যাবার পর সদস্যরা বিভিন্ন কর্মজীবনে মনোনিবেশ দেয়। গৌতম চট্টোপাধ্যায় কলকাতায় চলচ্চিত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায় পাড়ি জমান সান ফ্রান্সিসকোতে, প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রকৌশলী জীবনে মনোযোগ দেন, রঞ্জন ঘোষাল বেঙ্গালুরুতে বিজ্ঞাপন আর থিয়েটারে যুক্ত হয়ে পড়েন, এব্রাহাম মজুমদার জার্মানিতে মিউজিক স্কুল চালু করেন, তাপস দাস কলকাতায় চলচ্চিত্রপ্রামাণ্যচিত্র নিয়ে কাজ শুরু করেন আর তপেশ বন্দ্যোপাধ্যায় যোগ দেন তাঁর কর্মজীবনে।[6]

ইতিহাস

১৯৭৪–৭৯: গঠন, প্রারম্ভিক বছর

গঠন

কলকাতার কয়েকজন সঙ্গীতশিল্পী সহযোগে ১৯৭৪ সালের প্রান্তিকালে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ব্যান্ডটি গঠিত হয়। প্রাথমিকভাবে দলটিতে সাত জন সদস্য থাকায় তাদের নাম ছিল "সপ্তর্ষি"।[7][8] সাত সদস্যের মধ্যে ছিলেন, গৌতম চট্টোপাধ্যায়, তপেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, রঞ্জন ঘোষাল, তাপস দাস, এব্রাহাম মজুমদার, বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়। পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় "তীরন্দাজ" এবং একটি কনসার্টে গৌতম চট্টোপাধ্যায় দলটিকে "গৌতম চ্যাটার্জি বিএসসি অ্যান্ড সম্প্রদায়" নতুন নামে পরিচয় করিয়ে দেন। শেষের দিকে রঞ্জন ঘোষাল ব্যান্ডটির বর্তমান নাম মহীনের ঘোড়াগুলি প্রস্তাব করে।[6] প্রকৃতপক্ষে এই নামকরণ করা হয়েছে আধুনিক বাঙালি কবি জীবনানন্দ দাশ রচিত সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮) কাব্যগ্রন্থের ঘোড়া শিরোনামের কবিতার দ্বিতীয় পঙ্‌ক্তি থেকে:[7][9]

"মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে।"

১৯৭০-এর দশক বাংলা ব্যান্ড এবং রক সঙ্গীতের পক্ষে খুব একটা সুবিধার সময় ছিল না। সেই সময় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীরা। সঙ্গীতের দিক থেকে তাঁরা ছিলেন রবীন্দ্রনাথনজরুলের পুরনো ঐতিহ্যের ধারক-বাহক। এ কারণে তাদের গাওয়া বাংলা সিনেমার গান এবং বাংলা আধুনিক গানের জনপ্রিয়তা বেশি ছিল।

স্টুডিও অ্যালবাম

Thumb
সংবিগ্ন পাখিকূল ও কলকাতা বিষয়ক (১৯৭৭) অ্যালবামের কভার

১৯৭৭ সালে প্রথম অ্যালবাম সংবিগ্ন পাখিকূল ও কলকাতা বিষয়ক প্রকাশিত হবার পর আনন্দবাজার পত্রিকার কড়চায় শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশংসা করেন। এরপর দূরদর্শনের বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানেও যোগ দেয় তারা। তবে এরপর শ্রোতামহলে ব্যান্ডটির গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পেতে থাকে। পোস্টবক্সে জমা হতে থাকে তাদের বিরুদ্ধে আসা যাবতীয় চিঠি। ১৯৭৮ সালে রঞ্জন ঘোষাল অজানা উড়ন্ত বস্তু বা অ-উ-ব শিরোনামের দ্বিতীয় অ্যালবাম কভারের নকশা করে সে-সমস্ত চিঠি-পত্র সমন্বয়ে। ১৯৭৯ সালে তৃতীয় এবং সর্বশেষ স্টুডিও অ্যালবাম দৃশ্যমান মহীনের ঘোড়াগুলি প্রকাশিত হবার পর, আশির দশকের গোড়ার দিকে ব্যান্ডটি ভেঙে যায়। বন্ধ হয়ে যায় অ্যালবাম বিক্রি।[6]

১৯৮৬–৮৭: পরবর্তী বছর

১৯৮৬-১৯৮৭ সালে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের সাথে অরুণেন্দু দাসের সাক্ষাৎ হয়। পরবর্তীতে মহীনের ঘোড়াগুলির চারটি সম্পাদিত স্টুডিও অ্যালবামের প্রত্যেকটিতেই অরুণেন্দুর কে কে যাবিরে, দিশে হারা যে মোর মন , গঙ্গা, আমার প্রিয়া ক্যাফে ইত্যাদি গান ব্যবহার করা হয়।

সাঙ্গীতিক দক্ষতা

১৯৭৮ সাল পর্যন্ত কণ্ঠ ও গিটারে ছিলেন তপেশ বন্দ্যোপাধ্যায় বা ভানু দা। পরবর্তীতে তার স্থলাভিষিক্ত হন রাজা ব্যানার্জি। রঞ্জন ঘোষাল ছিলেন দলের আরেক গীতিকার। তিনি দলের হয়ে মিডিয়া রিলেশনের দিকটিও দেখতেন। ব্যান্ডটির স্রষ্টা গৌতম চট্টোপাধ্যায় গীতিকার হিসেবে ছিলেন একদমই নতুন মুখ। তবে তার সমাজ ভাবনা ছিল বেশ আলাদা, স্বকীয় বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। অনেকটা ষাটের দশকের বব ডিলানের মতো। মূলত সে সময় গৌতম একজন কমিউনিস্ট যোদ্ধা ছিলেন যার প্রতিফলন তাদের অধিকাংশ গানেই পাওয়া যায়।

আশির দশকে গৌতম চট্টোপাধ্যায় ও দীপক মজুমদার মিলে বাউল-ফকিরদের নিয়ে নতুন ধারার সঙ্গীতের সূচনা করেছিলেন। ফলে মহীনের অনেক গানে এই লোকায়ত জীবন ও সঙ্গীতের প্রভাব দেখা যায়।[10] এছাড়াও মহীনের প্রাথমিক প্রভাবের মধ্যে দ্য বিটল্‌স, বব ডিলন, লুডভিগ ফান বেটোফেন, রবিশঙ্কর, আলী আকবর অন্তভূক্ত ছিলো।

গীতধর্মী বিষয়

রাজনীতি, দারিদ্র্য, অর্থনীতি, অন্যায়-অবিচার, বিপ্লব, ভালোবাসা, একাকিত্ব, স্বাধীনতা, ভিক্ষাবৃত্তি, যৌনপেশাসহ আরো বহুমুখী বিষয় নিয়ে গান করেছে মহীনের ঘোড়াগুলি। বর্তমানে কবীর সুমন, নচিকেতা, অঞ্জন দত্তের মতো শিল্পীরা জীবনমুখী গান করলেও, তাদের পূর্বসূরী এখনও মহীনের ঘোড়াগুলিই।[7] এই ব্যান্ডের একটি জনপ্রিয় গান হায় ভালোবাসি (১৯৭৭) বাংলার প্রকৃতির রুপময় নৈসর্গিক দিকটি তুলে ধরার মধ্য দিয়ে জীবনানন্দের প্রভাব এখানে স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়েছে। এখানে আরেকটি মিল পাওয়া যায়; জীবনানন্দ তৎকালীন সমসাময়িক কবিতার বৃত্তের বাইরে এসে বাংলা সাহিত্যে আধুনিক কবিতার সূচনা করেন, তেমনি মহীনের ঘোড়াগুলি ব্যান্ডটিও তৎকালীন সাধারণ সঙ্গীতের গন্ডির বাইরে বাংলা সঙ্গীতের নতুন ধারার সূচনা করে।[11] গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের তীব্র রাজনৈতিক বিশ্বাস ছিল। তিনি ছিলেন মূলত বামপন্থী মনোভাবের লোক। এই বামপন্থী চিন্তাধারা তার সঙ্গীতের ভেতরে প্রকাশিত হত। মহীনের ঘোড়াগুলির একজন সদস্য এব্রাহাম মজুমদারের মতে গৌতম চট্টোপাধ্যায় হয়তো নকশাল আন্দোলনের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন।

প্রভাব

২০০৬ সালে মহীনের ঘোড়াগুলিরআবার বছর কুড়ি পরে সম্পাদিত স্টুডিও অ্যালবামেরপৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে গানের সুরানুকরণে গ্যাংস্টার হিন্দি চলচ্চিত্রে জেমস ভিগি ভিগি শিরোনামে একটি গান গায়। ২০১৪ সালে মায়া (১৯৯৭) সম্পাদিত স্টুডিও অ্যালবামের টেলিফোন গানের একটি লাইনের অনুপ্রেরণায় অরিন্দম দেকখন তোমার আসবে টেলিফোন নামে একটি বাংলা চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন।[12] আবার বছরকুড়ি পরে অ্যালবামেরপৃথিবীটা নাকি শিরোনামের গানে তারা টেলিভিশন কীভাবে শহুরে উন্মত্ততা সৃষ্টি করেছে তার প্রতিফলন দেখিয়েছে, যা বিভিন্ন সমসাময়িক শিল্পীদের দ্বারা কাভার করা হয়েছে।

সদস্যবৃন্দ

ডিস্কোগ্রাফি

মূল স্টুডিও অ্যালবাম (১৯৭৭-১৯৭৯)

সরাসরি পরিবেশনা

মূল মহীনের ঘোড়াগুলির সদস্যরা ১৯৭৬-১৯৮১ পর্যন্ত কলকাতায় বিভিন্ন সরাসরি অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন। তাদের উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানগুলো নিম্নরুপঃ

  • যোগেশ মাইম আকাদেমি (১৯৭৭)
  • স্টার থিয়েটার (১৯৭৮)
  • ম্যাক্স মূলার ভবন (১৯৭৯)
  • রবীন্দ্র সদন (১৯৭৯)
  • সেন্ট পলস ক্যাথেড্রাল (১৯৮০)
  • কলকাতা আন্তর্জাতিক জ্যাজ উৎসব (১৯৮০)
  • কলকাতা সঙ্গীত বিদ্যালয় (১৯৮১)

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

বহিঃসংযোগ

Wikiwand in your browser!

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.

Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.

Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.