Loading AI tools
দারুল উলুম হাটহাজারীর ইতিহাস উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
দারুল উলুম হাটহাজারী সংক্ষেপে হাটহাজারী মাদ্রাসা বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ও সর্বপ্রাচীন কওমি মাদ্রাসা। ২০১০ সালে এই মাদ্রাসা থেকে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের জন্ম হয়, যা ২০১৩ সালে সরকার বিরোধী কর্মসূচির মাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। সংগঠনটির আমির ছিলেন মাদ্রাসার মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফী ও মহাসচিব ছিলেন মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক জুনায়েদ বাবুনগরী। মাদ্রাসাটিতে আহমদ শফীর পরে জুনায়েদ বাবুনগরীর অবস্থান ছিল। ২০১৩ সালে আন্দোলনের পর থেকে উভয় নেতার মধ্যে চিন্তাগত পরিবর্তন আসে। আহমদ শফী আস্তে আস্তে সরকার বিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসেন এবং জুনায়েদ বাবুনগরী তার অবস্থানে অটল থাকেন।[1] আহমদ শফীর এই পরিবর্তনের পিছনে তার ছেলে আনাস মাদানীকে দায়ী করা হয়। যিনি পিতার প্রভাব খাটিয়ে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত হন। আনাস মাদানীর সমর্থকরা তার নেতৃত্বে মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির একটি বৈঠকের মাধ্যমে জুনায়েদ বাবুনগরীকে মাদ্রাসাটির সহকারি পরিচালক হিসেবে অপসারণ করার পর দুই গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে আসে।[2] যার পরিপ্রেক্ষিতে আনাস মাদানীকে অপসারণ, আহমদ শফীকে মহাপরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে উপদেষ্টা বানানো সহ ৫ দফা দাবি নিয়ে ২০২০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে।
২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মহাসমাবেশের রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে সংগঠনের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী সহ অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে। সংগঠনটির আমীর শাহ আহমদ শফী তার কর্মস্থল চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ফেরার সুযোগ পান। হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রচুর মামলা দায়ের করা হয়। এই ঘটনার পর একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে হেফাজতে ইসলামের উত্থান ঘটে।[3]
পরবর্তী পরিস্থিতিতে আহমদ শফী আস্তে আস্তে তীব্র সরকার বিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসেন।[3] তার সঙ্গে যেসব নেতারা ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানী (সংগঠনের প্রচার সম্পাদক), মঈনুদ্দীন রুহী (যুগ্ম মহাসচিব) ও মুফতি ফয়জুল্লাহ এবং আবুল হাসনাত আমিনী (ঢাকা মহানগর সেক্রেটারি)।[4] ফলে মামলাগুলো গতি হারায়। কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতি সহ বেশকিছু দাবি মেনে নেয়া হয়।[3]
২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কওমি মাদ্রাসাসমূহের দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রির সমমান প্রদান আইন, ২০১৮ পাস করা হয়। তাই ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শুকরানা মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এই আয়োজন না করতে হেফাজতের ৬৮ নেতার স্বাক্ষরিত একটি চিঠি আহমদ শফী বরাবর দেওয়া হয়েছিল।[4] হেফাজতের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী, নায়েবে আমির নূর হুসাইন কাসেমী, ইজহারুল ইসলাম, আজিজুল হক ইসলামাবাদীসহ (সাংগঠনিক সম্পাদক) অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতা শুকরানা মাহফিলে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন। ২ অক্টোবর নায়েবে আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী সংগঠন থেকে পদত্যাগ করেন।[4]
আহমদ শফীর পুত্র আনাস মাদানী সরকারের দালাল হিসেবে পরিচিতি পান। তিনি তার পিতা আহমদ শফীকে প্রলুব্ধ করে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের প্রভাব খাটিয়ে মাদ্রাসার ছাত্রদের নানাভাবে হয়রানি, মাদ্রাসার শিক্ষকদের সাথে দুর্ব্যবহার, অর্থ লোপাট, অর্থের বিনিময়ে কওমি মাদ্রাসার নিয়মনীতিকে পাশ কাটিয়ে কওমি ধারার বিভিন্ন মাদ্রাসায় মুহতামিম বা পরিচালক নিয়োগ দেন। দারুল উলুম হাটহাজারীতেও ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করেন। কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশে একচ্ছত্রভাবে আধিপত্য বিস্তার করেছেন। সিনিয়র নেতাদের অবমূল্যায়ন, মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত ও নিয়োগ বাণিজ্যের সাথে সাথে গড়েছেন অঢেল সম্পদ। এসব মিলে তার উপর ছাত্রদের ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।[5]
হেফাজতের আমীর এবং দলের কেন্দ্রীয় নেতাবৃন্দের একাংশের সাথে সরকার ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সখ্যকে সংগঠনের একটি অংশ মেনে নিতে পারে নি।[4] জুনায়েদ বাবুনগরী তাদের নেতা হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেন। অন্যদিকে, দরবারি আলেম হিসেবে কেউ কেউ সমালোচিত হন। বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসার তরুণ অংশ এই সকল অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ফেসবুকে সরব হওয়া শুরু করে। উসামা মুহাম্মদ নামে রহস্যময় ফেসবুক আইডি কওমি অঙ্গনের এসব নানা দুর্নীতি আর অনিয়ম নিয়ে নিয়মিত সোচ্চার হয়।[3]
বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ, দারুল উলুম হাটহাজারী ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই অভ্যন্তরীণ সমস্যা চলতে থাকে। অভিযোগ উঠে, হেফাজত আমীর আহমদ শফীর ছোট ছেলে আনাস মাদানী নিজস্ব প্রভাববলয় তৈরি করে সবকিছু তার নিয়ন্ত্রণাধীন রাখতে চাইছেন।[6] ২০২০ সালের ১৭ জুন জুনায়েদ বাবুনগরীকে সহকারী পরিচালকের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।[7] অভিযোগ আছে, আনাস মাদানী তার পছন্দের ব্যক্তিকে সহকারী পরিচালকের পদে বসানোর প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বাবুনগরীকে সরিয়ে দেন।[8]
২০২০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জুনায়েদ বাবুনগরীর গ্রামের বাড়ি বাবুনগরে তার ছেলের বিবাহত্তোর ওয়ালিমার আয়োজনে অনেক আলেম অংশগ্রহণ করেন। সেখানে মামুনুল হক আহমদ শফীর নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। এরপর থেকেই বিষয়টি নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। অভিযোগ করা হয়, সে ওয়ালিমায় হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে যেসকল ছাত্র বাবুনগর মাদ্রাসায় গিয়েছিল তাদেরকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়েছিল। পরদিন ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকার কামরাঙ্গীরচরের নূরিয়া মাদ্রাসায় একই বিষয়ে একটি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়। এতে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব নূর হুসাইন কাসেমী, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমির আতাউল্লাহ হাফেজ্জী, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাহফুজুল হক উপস্থিত ছিলেন।[9][5]
২০২০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বাদ জোহর শিক্ষকদের অবরুদ্ধ করে মাদ্রাসার মাঠে ছাত্ররা বিভিন্ন স্লোগানের বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে। আনাস মাদানীর রুমে ভাঙচুর চালায়। এছাড়া প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ এড়ানোর জন্য মাদ্রাসার ছাত্ররা মসজিদের মাইক ব্যবহার করে বারবার ঘোষণা করেছে।[6] হাটহাজারীর আন্দোলনের সমর্থনে ঢাকায় এক ছাত্র সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি, নুরুল হক নুর সমর্থন দিয়ে ছাত্রদের গায়ে হাত তোলা হলে রাজধানী ঢাকাকে অচল করে দেওয়ার হুমকি দেন।[3] বিকেলে আনাস মাদানীর সহযোগী মাইনুদ্দীন রুহীকে শলাপরামর্শের মাধ্যমে দারুল উলুম হাটহাজারীসহ কওমি মাদ্রাসায় সব ধরনের অনিয়ম এবং অরাজকতার বীজ বপনের অভিযোগ এনে গণপিটুনি দেয় বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা।[10]
ছাত্ররা ৫ দফা দাবি নিয়ে এই আন্দোলন শুরু করে। বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর মাদ্রাসায় লিফলেটের মাধ্যমে দাবিসমূহ ছড়িয়ে দেওয়া হয়। দাবি সমূহের মধ্যে রয়েছে:[9]
রাত ১০ টার দিকে (১৬ সেপ্টেম্বর) হাটহাজারী মাদ্রাসার শুরা কমিটি মোট তিনটি সিদ্ধান্ত নেয়। সেগুলো হল: আনাস মাদানীকে অব্যাহতি প্রদান, মাদ্রাসার ছাত্রদের কোনো রকমের হয়রানি না করার প্রতিশ্রুতি এবং আগামী শনিবার মজলিসে শুরার সকল সদস্যদের উপস্থিতিতে অন্য সমস্যাসমূহের সমাধানের প্রতিশ্রুতি।[11] এর পর পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত হয়ে যায়। পরদিন ১৭ সেপ্টেম্বর আরেকটি খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, শাহ আহমদ শফী আরেকটি বৈঠক ডেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে যাচ্ছেন যে, তিনি মাদ্রাসাটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে দেবেন এবং সাথে তার ছেলে আনাস মাদানীর প্রত্যাহার আদেশটি তিনি অজ্ঞাত অবস্থায় স্বাক্ষর করেছেন জানিয়ে সেই আদেশটি স্থগিত করবেন। ফলশ্রুতিতে আবারও উত্তেজনা দেখা দেয়। ১১টার দিকে ছাত্ররা আবার বিক্ষোভে নামে।[12][13]
একইদিন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সহকারী সচিব সৈয়দ আসগর আলী স্বাক্ষরিত একটি প্রজ্ঞাপনে করোনা ভাইরাসের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেসব শর্ত আরোপিত হয়েছিল তা সঠিকভাবে প্রতিপালিত না হওয়ার কারণ দেখিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য হাটহাজারী মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা করা হয়।[14] মাদ্রাসাটি যেহেতু সরকারি নয় — সেজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমন ঘোষণা দেওয়ার এখতিয়ার নেই যুক্তি দেখিয়ে মাদ্রাসা বন্ধ করে দেওয়া সরকারি সিদ্ধান্তটি প্রত্যাখান করে মাদ্রাসায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীবৃন্দ। রাত ৭.৪৫ বাজে মাদ্রাসার মসজিদের মাইক ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা এই ঘোষণা দেয়।[15] পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গোটা এলাকায় র্যাব ও পুলিশ সহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৩০০+ সদস্য মোতায়েন করা হয়।[12]
সেইদিন রাতে মহাপরিচালকের পদ থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন শাহ আহমদ শফী।[16] পদত্যাগ করার পর শাহ আহমদ শফী অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছিল। অবস্থার অবনতি হওয়ার পর শুক্রবার বিকালে তাকে ঢাকায় আনার পরই তার মৃত্যু হয়।[17]
১৯ সেপ্টেম্বর বিকেলে আহমদ শফীর দাফন সম্পন্ন হওয়ার পর দারুল উলুম হাটহাজারীর মজলিশে শুরা মাদ্রাসাটি পরিচালনার জন্য তিনজন সিনিয়র শিক্ষক: আবদুস সালাম, শেখ আহমদ এবং ইয়াহইয়া আলমপুরীকে অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্ব দেয় এবং হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী মাদ্রাসার শিক্ষাপরিচালক ও মাদ্রাসার প্রধান শায়খুল হাদিস হিসেবে মনোনীত হন।[18] ২০ সেপ্টেম্বর থেকে কর্তৃপক্ষ মাদ্রাসার কার্যক্রম পুনরায় চালু করার ঘোষণা দেন।[19]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.