Loading AI tools
প্রভাবিত বা জানানোর জন্য তৈরি উপাদান উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা (ইংরেজি: Propaganda) অথবা প্রোপাগান্ডা হলো এমন ধরনের পক্ষপাতমূলক ও ভ্রান্ত তথ্য যা একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বা উদ্দেশ্যের প্রচারণায় ব্যবহৃত হয়।[1] উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা সাধারণত আংশিক সত্য বা আংশিক মিথ্যাকে বা সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্যকে প্রচার করে। জনগণের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গীর কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন না আসা পর্যন্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার পুনরাবৃত্তি ঘটানো হয় এবং সব ধরনের প্রচার মাধ্যম ব্যবহার করা হয়। বক্তৃতা, প্রচারপত্র, পোস্টার, সংবাদপত্রে বিবৃতি, চলচ্চিত্র, ব্যক্তিগত ক্যানভাসিং, সংবাদ সম্মেলন, রেডিও-টেলিভিশনে প্রচার, সেমিনার, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, অনলাইন রেডিও, ব্লগ, ক্ষুদে বার্তা ইত্যাদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা বিস্তারের অন্যতম মাধ্যম।
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণাকে প্রায়ই কোন নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য, অবস্থান অথবা রাজনৈতিক লক্ষ্যের দিকে জনগণকে প্রভাবিত করার ও মনোভাব বদলে দেয়ার মনোবিজ্ঞানগত কৌশলের সাথে সংযুক্ত করা হয়, যার ফলে উক্ত উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যের প্রতি জনসমর্থন তৈরি হবে।[2] প্রোপাগান্ডা হচ্ছে এমন তথ্য যা বস্তুনিষ্ঠ হয় না এবং প্রাথমিকভাবে কোন শ্রোতাকে প্রভাবিত করতেই ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে প্রায়ই সত্যগুলোকে বাছাই করে প্রকাশ করা হয় (বর্জনের দ্বারা মিথ্যা) যাতে ব্যক্তি বিশেষ বিষয়ের উপর আগ্রহী হন, অথবা "লোডেড ল্যাঙ্গুয়েজের" মাধ্যমে বার্তা প্রেরণ করা হয় যেখানে প্রকাশিত তথ্যে যৌক্তিকতার বদলে আবেগের ব্যবহার করা হয়।[2] উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার সাথে প্রায়ই সরকার কর্তৃক প্রস্তুতকৃত উপাদানকে সম্পর্কিত করা হয়। কিন্তু কোন কোম্পানি বা কর্মী সংগঠনও (activist group) উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা প্রচার করতে পারে।
বিংশ শতকে, "প্রোপাগান্ডা" শব্দটিকে প্ররোচক অর্থে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে "প্রোপাগান্ডা" শব্দটি একটি নিরপেক্ষ শব্দ হিসেবে পরিচিত ছিল।[2][3] প্রোপাগান্ডা বার্তা সকলের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য বিভিন্ন ধরনের মাধ্যম ব্যবহার করা হয়। মাধ্যমের ধরন নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভবের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়ে যায়। তাই সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে চিত্রকর্ম, কার্টুন, পোস্টার, পুস্তিকা, চলচ্চিত্র, রেডিও সম্প্রচার, টিভি সম্প্রচার ও ওয়েবসাইটকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা প্রচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
সাধারণ প্রচার-প্রচারণার সাথে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার মৌলিক পার্থক্য হল, এটি নিরপেক্ষ তথ্য প্রকাশ না করে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণকে একটি নির্বাচিত দিকে ধাবিত করতে সহায়তা করে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা এমন কিছু নির্বাচিত ঘটনা বা তথ্য তুলে ধরে যাতে কোন একটি বিষয় সম্পর্কে দর্শক কেবলমাত্র একটি উপসংহারে উপনীত হতে বাধ্য হয়। এসব তথ্য বা ঘটনা জনমনে আবেগের সঞ্চার করে এবং যুক্তিগ্রাহ্য চিন্তাভাবনা করতে বাধা দেয়। আধুনিক বিশ্বে রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আদর্শগত বা ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের একটি বড় হাতিয়ার এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা। বিভিন্ন রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান অতীতে ও বর্তমানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণাকে জনগণের মন-মানসিকতা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে এমনভাবে ব্যবহার করেছে (হলোকস্টকে বৈধতাদানের জন্য নাৎসিদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা) যে তা এখন একটি চরম নেতিবাচক বিষয় হিসেবে বিবেচিত। প্রকৃত অর্থে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার মূল উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্র ও সমাজের রীতিনীতি মেনে চলার জন্য জনগণকে উৎসাহিত করা। একসময় স্বাস্থ্যসচেতনতা, নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, অপরাধ সংঘটনের পর জনগণের করণীয় ইত্যাদি বিষয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা ব্যবহার করা হত।
ইংরেজি প্রোপাগান্ডা শব্দটি একটি আধুনিক লাতিন শব্দ যা প্রোপাগারে ক্রিয়াটির একটি বিশেষ্য আকার। এর অর্থ হল ছড়িয়ে যাওয়া। তাই "প্রোপাগান্ডা" শব্দটির আভিধানিক অর্থ হল যা ছড়িয়ে যায়।[4] উৎপত্তিগতভাবে এই শব্দটির উদ্ভব হয়েছিল একটি ক্যাথলিক গির্জা এর ১৬২২ সালে তৈরি একটি নতুন প্রশাসনিক সংগঠন থেকে, যার নাম ছিল কংগ্রেগেশিও ডে প্রোপাগান্ডা ফিদে (বিশ্বাসকে ছড়িয়ে দেবার জন্য সংগঠন)। এই প্রতিষ্ঠানকে অনানুষ্ঠানিকভাবে "প্রোপাগান্ডা" বলা হত।[3][5] প্রতিষ্ঠানটির কাজ ছিল অ-ক্যাথলিক দেশসমূহে ক্যাথলিক বিশ্বাসকে ছড়িয়ে দেয়া।[3]
১৭৯০ এর দশক থেকে এই শব্দটি ধর্মনিরপেক্ষ কার্যক্রমে ব্যবহৃত হতে শুরু করে।[3] ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে এই শব্দটি একটি নেতিবাচক অর্থ ধারণ করে, যখন শব্দটিকে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ব্যবহার করা শুরু হয়।[3]
ইতিহাসের দিকে তাকালে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার আদি ধরন নিয়ে কিছু নথি পাওয়া যায়। বেহিস্তুন লিপিতে (আনু. খ্রিষ্টপূর্ণ ৫১৫) পারস্যে সম্রাট ১ম দারিউসের উত্থান সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা আছে। বেশিরভাগ ঐতিহাসিকের মতে এটাকেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার প্রাথমিক উদাহরণ হিসেবে মনে করেন।[6] প্রাচীন ইতিহাসের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার আরেকটি উদাহরণ পাওয়া যায় শেষ রোমান গৃহযুদ্ধগুলোতে যেখানে অক্টাভিয়ান এবং মার্ক এন্টনি উভয়ই একে অপরকে তাদের পিতৃপরিচয়ের অভাব, পাশবিকতা, কাপুরুষতা, সাহিত্য ও বাগ্মীতায় অনুপযুক্ততা, লাম্পট্য, বিলাসিতা, মাতলামি এবং অন্যান্য খারাপ বিষয় নিয়ে দোষারোপ করেছিলেন।[7]
ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সময় ইউরোপে, বিশেষ করে জার্মানিতে ছাপাখানার আবিষ্কারের ফলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা খুব সহজেই ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয়। সেসময় ছাপাখানার আবিষ্কারের ফলে জনসাধারণের নিকট অনেক নতুন চিন্তাধারা, নীতি সহজে পৌঁছে যেতে শুরু করে, যা ১৬শ শতকের আগে কখনও দেখা যায় নি। যুক্তরাষ্ট্র বিপ্লবের সময়, যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশগুলোতে সংবাদপত্র ও ছাপাখানার একটি উন্নত নেটওয়ার্ক তৈরি হয়। এরা পেট্রিয়টদের (যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার পক্ষে যারা) পক্ষে বেশি কাজ করত এবং লয়ালিস্টদের (ব্রিটিশদের পক্ষে যারা) পক্ষে কম কাজ করত।
বর্তমানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা বলতে যা বোঝানো হয়, সেই ধারণাটি তৈরি হয় ১৯ শতকে শিক্ষিত ও রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় সমাজ গঠনের ফলে, যেই সমাজ গণমাধ্যম কর্তৃক বিভিন্ন বিষয়ে সংবাদ লাভ করত। একারণে সরকার সেসময় থেকেই তাদের নিজেদের নীতিসমূহের পক্ষে জনসাধারণের মতামতকে প্রভাবিত করার প্রয়োজন বুঝতে শুরু করে। ফরাসী বিপ্লব এবং নেপোলিয়নিক যুগে প্রচুর পরিমাণে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা ব্যবহার করা হত। ১৯ শতকে যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের এবলিশনিস্টগণ (যারা দাসপ্রথার বিলুপ্তি চাইতেন) দাসপ্রথার বিরুদ্ধে জটিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা অভিযান শুরু করেছিলেন।
প্রথমবারের মত বিস্তৃত পরিসরে সুশৃঙ্খলভাবে সরকারি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা ছড়ানো হয়েছিল ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর। ১ম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পর, এরিক লুডেনড্রফের মত সামরিক কর্মকর্তাগণ বলেছিলেন, তাদের পরাজয়ের ক্ষেত্রে অন্যতম কারণ ছিল ব্রিটিশ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা। এডলফ হিটলারও একই কথা বলেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ব্রিটিশদের এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণাই ছিল ১৯১৮ সালে জার্মান হোম ফ্রন্ট এবং নেভির মনোবল ভাঙ্গন এবং বিদ্রোহের কারণ। পরবর্তীতে নাৎসীরা তাদের ক্ষমতায় থাকাকালীন সময় ব্রিটিশদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা কৌশল ব্যবহার করেছিল। জার্মানির বেশিরভাগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণাই তৈরি হত "মিনিস্ট্রি অব পাবলিক এনলাইটেনমেন্ট এন্ড প্রোপাগান্ডা" থেকে। জোসেফ গোয়েবলস এই মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্বে ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একটি যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার অবিরাম ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়, যা ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতাপ্রসূত। হিটলারের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণাকারী জোসেফ গোয়েবলস, ব্রিটিশদের পলিটিকাল ওয়ারফেয়ার এক্সেকিউটিভ এবং যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব ওয়ার ইনফরমেশন, কেউই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা ব্যবহারে কারও থেকে কম ছিল না।
২০শ শতকের প্রথম দিকে, চলচ্চিত্রের আবিষ্কারের ফলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা প্রস্তুতকারকগণ রাজনৈতিক এবং সামরিক স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য একটি বিশাল সুযোগ লাভ করেন। এর মাধ্যমে জনসাধারণের একটি বিশাল অংশকে কোন বিষয়ে রাজি করানো বা কোন বাস্তব বা কাল্পনিক সত্তাকে শত্রুতে পরিণত করা বা কাউকে শত্রু স্থান থেকে সরিয়ে ফেলার একটি সুযোগ তৈরি হয়। ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের পর সোভিয়েত সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা চলচ্চিত্র তৈরি করার উদ্দেশ্যে রাসিয়ান ফিল ইন্ডাস্ট্রিকে স্পনসর করেছিল। তখনকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা চলচ্চিত্রসমূহের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হল ১৯২৫ সালের দ্য ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন যেখানে সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে মহিমান্বিত করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসী চলচ্চিত্র-প্রস্তুতকারকগণ সুডেটেনল্যান্ড দখল এবং পোল্যান্ড আক্রমণের জন্য জনসমর্থন তৈরি করতে উচ্চমাত্রার আবেগী চলচ্চিত্র প্রস্তুত করেন। ১৯৩০ এবং ১৯৪০ এর দশককে "উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার স্বর্ণযুগ" বলা হয়, যেসময়ে টোটালিটেরিয়ান বা সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রের উত্থান ঘটে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। নাৎসী জার্মানিতে কার্যরত চলচ্চিত্র-প্রস্তুতকারক লেনি রিফেনস্টাল সবচেয়ে পরিচিত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে একটি তৈরি করেন যার নাম ছিল ট্রায়াম্ফ অব দ্য উইল । যুক্তরাষ্ট্রে এনিমেশন খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। এই জনপ্রিয়তার কারণ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ দর্শকদের মন জয় করা এবং যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ-প্রচেষ্টায় এর সহায়তা দান। এই এনিমেশনগুলোর মধ্যে একটি হল ডার ফুয়েরারস ফেস (১৯৪২)। এই এনিমেশনগুলোতে হিটলারকে একটি কমিকাল চরিত্র হিসেবে দেখানো হয় এবং এটি 'স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে' - এরকম একটি মূল্যবোধ তৈরি করে। ১৯৪০ এর দশকের প্রথম দিকের যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধসংক্রান্ত চলচ্চিত্রগুলো এমনভাবে বানানো হয়েছিল যাতে সেগুলো দর্শকদের মধ্যে একটি দেশপ্রেমী ধারণা তৈরি করতে পারে এবং তাদেরকে বিশ্বাস করাতে পারে যে "শত্রুকে" পরাজিত করার জন্য প্রয়োজনে আত্মত্যাগ করতে হবে।
কোল্ড ওয়ার বা স্নায়ুযুদ্ধের সময় পাশ্চাত্য এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ইভয়ই প্রচুর পরিমাণে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা ব্যবহার করেছিল। উভয় পক্ষই তাদের নিজেদের অঞ্চলের এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশের নাগরিকদেরকে প্রভাবিত করার জন্য চলচ্চিত্র, টেলিভিশন এবং রেডিও প্রোগ্রামিং ব্যবহার করে। জর্জ অরওয়েলের সাহিত্য অ্যানিম্যাল ফার্ম এবং নাইনটিন এইটি-ফোর ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা ব্যবহারের উপর অঘোষিত পাঠ্যপুস্তক। কিউবার বিপ্লবের সময় ফিদেল কাস্ত্রো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার গুরুত্বের উপর জোর দেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় সমাজতান্ত্রিক শক্তিগুলো জনগণের মতামতকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রচুর পরিমাণে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা ব্যবহার করেছিল।[8]
যুগোস্লাভ যুদ্ধকালীন সময়ে ফেডারেল রিপাবলিক অব যুগোস্লোভিয়া সরকার এবং ক্রোয়েশিয়া সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণাকে সামরিক কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে। জনগণের মাঝে, বিশেষ করে সার্ব জনগণের মাঝে অন্যান্য জাতিগুলোর প্রতি (বসনিয়াক, ক্রোয়াট, আলবেনিয়ান এবং অন্যান্য অ-সার্ব) ভয় ও ঘৃণা ছড়িয়ে দেবার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা ব্যবহার করে। যুগোস্লাভ যুদ্ধকালীন সময়ে সার্বীয় গণমাধ্যম সার্বীয় সামরিক বাহিনীর যুদ্ধাপরাধের ন্যায্যতা প্রতিপাদন করার জন্য এবং অস্বীকার করার জন্য প্রচুর প্রচেষ্টা চালিয়েছিল।[9]
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণাকে শনাক্ত করা সবসময়ই একটি সমস্যা ছিল।[10] প্রধান সমস্যাটি ছিল একে অন্যান্য প্ররচনা থেকে আলাদা করা এবং পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্তকে এড়িয়ে যাওয়া। যেমন, একটি রাজনৈতিক দল অন্য কোন সংগঠন বা সরকারের দ্বারা কোন বস্তু উৎপাদনকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা হিসেবে দেখতে পারে, যেখানে সেই রাজনৈতিক দলটি নিজেদের দ্বারা প্রস্তুত করা পক্ষপাতদুষ্ট প্রকাশনাকেই শিক্ষামূলক উপাদান বলে মনে করতে পারে। গার্থ জোয়েট এবং ভিক্টোরিয়া ও'ডনেল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার একটি সংক্ষিপ্ত ও কার্যকরী সংজ্ঞা প্রদান করেছেন: "উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা একটি ইচ্ছাকৃত, নিয়মানুগ প্রচেষ্টা যা সাধারণ জনগণের থেকে প্রতিক্রিয়া অর্জনের জন্য তাদের ধারণাকে আকার প্রদান এবং তাদের চেতনা ও প্রত্যক্ষ আচরণকে প্রভাবিত করে, যে প্রতিক্রিয়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণাকারীকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যপূরণের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।"[11]
রিচার্ড এলান নেলসনের বর্ণনাটি আরও বেশি বোধগম্য: "উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণাকে উদ্দেশ্যপূর্ণ প্ররোচনার একটি নিয়ন্ত্রিত ধরন হিসবে নিরপেক্ষভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়, যে উদ্দেশ্যপূর্ণ প্ররোচনার সাহায্যে কোন নির্ধারিত লক্ষ্য শ্রোতার আবেগ, প্রবণতা, মতামত এবং কার্যকে আদর্শগত, রাজনৈতিক অথবা বাণিজ্যিক স্বার্থে কোন পক্ষপাতদুষ্ট বার্তা (যা কাল্পনিক হতেও পারে, নাও পারে) গণমাধ্যম বা মিডিয়া চ্যানেলের মাধ্যমে প্রদান করে নিয়ন্ত্রণ করা হয়"।[12] উভয় সংজ্ঞাতেই সংশ্লিষ্ট যোগাযোগ প্রক্রিয়ায় মনোযোগ দেয়া হয়েছে, অথবা আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, পদ্ধতির উদ্দেশ্যের উপর মনোযোগ দেয়া হয়েছে। এখানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণাকে বস্তুবাচকভাবে (objectively) বিবেচনা করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া হয়। এরপর দর্শক ও শ্রোতার দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে একে ইতিবাচক বা নেতিবাচক আচরণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। ঐতিহাসিক বাইনেক জেম্যান উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণাকে সাদা, ধূসর বা কালো হিসেবে ভাগ করেছেন। সাদা প্রোপাগান্ডা খোলাখুলিভাবে ভাবে এর উৎস্য এবং সার প্রকাশ করে। ধূসর প্রোপাগান্ডার ক্ষেত্রে দ্ব্যর্থক বা অপ্রকাশিত উৎস্য ও তাৎপর্য থাকে। কালো প্রোপাগান্ডা আসল উৎস্য ছাড়াও শত্রু অথবা কোন সংগঠন দ্বারা প্রচারিত হয়।[13] (এটি ব্ল্যাক অপারেশন এর সাথে তুলনীয়। ব্ল্যাক অপারেশন হল এক ধরনের অপারেশন যেখানে এটির পেছনে থাকা সরকার লুকনো থাকে)। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা বিজ্ঞাপন ও পাবলিক রিলেশন এর কৌশল ব্যবহার করে, এই দুটোর উভয়কেই প্রোপাগান্ডা ধরা যায় যারা একটি বাণিজ্যিক পণ্যকে প্রচার করে এবং কোন সংগঠন, ব্যক্তি বা ব্র্যান্ড সম্পর্কে মানুষের ধারণাকে একটা কাঠামো দেয়া হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর "প্রোপাগান্ডা" শব্দটি সাধারণত রাজনৈতিক বা জাতীয়তাবাদী ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। সেক্ষেত্রে রাজনীতিবিদগণ ও জাতীয়তাবাদীগণ এই কৌশলগুলোকে নির্দিষ্ট কিছু ধারণাকে প্রচার করতে ব্যবহার করা করেছেন।
উদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রচারণাকে প্রায়ই ধর্মীয় ব্যাপারগুলোতে মতামত ও বিশ্বাসকে প্রভাবিত করতে ব্যবহার করা হত, বিশেষ করে রোমান ক্যাথলিক চার্চ ও প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার সময়ে। রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার প্রয়োগ আরও সাধারণ হয়ে ওঠে, বিশেষ করে সরকার, রাজনৈতিক দলগুলো দ্বারা প্রণোদিত নির্দিষ্ট কিছু প্রচেষ্টা ও গোপন স্বার্থের ক্ষেত্রে। ২০ শতকের প্রথম দিকে, পার্টি স্লোগানের আকারে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণাকে তুলে ধরা হয়। এছাড়াও সেই সময়ে বর্ধষ্ণু জনসংযোগ শিল্পগুলোতে (public relations industry) প্রোপাগান্ডা শব্দটি খুব ব্যবহৃত হতে শুরু করে। এই ব্যবহারটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালেই বন্ধ হয়ে যায়। তখন শিল্পগুলোতে এই শব্দটি বরং পরিহার করতে শুরু করে, কারণ ততদিনে এর অর্থ অনেকটাই নিন্দাসূচক হয়ে উঠেছে। ল্যাতিন থেকে শব্দটির আক্ষরিক অনুবাদ করলে দাঁড়াতো "যেসব জিনিসকে অবশ্যই প্রচারিত হতে হবে। কোন কোন সংস্কৃতিতে এই শব্দটি নিরপেক্ষ, অনেকক্ষেত্রে ইতিবাচকও। আবার কোন কোণ সংস্কৃতিতে এই শব্দটিতে নেতিবাচকতা আরোপিত, যেখানে এর দ্বারা নিন্দাসূচক অর্থ প্রকাশিত হয়। পর্তুগীজ ও স্প্যানিশ ভাষাভাষীর দেশ সমূহে, বিশেষ করে লাতিন আমেরিকার দক্ষিণ কোণকের দেশগুলোতে (দক্ষিণের দেশ আর্জেন্টিনা, চিলি, উরুগুয়ে নিয়ে গঠিত অঞ্চল বা Southern Cone ) "প্রোপাগান্ডা" শব্দটি দ্বারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই "বিজ্ঞাপন দান" বোঝায়। ইংরেজিতে প্রোপাগান্ডা শব্দটি উৎপত্তিগতভাবে একটি নিরপেক্ষ শব্দ ছিল যেখানে একে যেকোন কাজের জন্য তথ্যের প্রচারণা বোঝাত। কিন্তু ২০ শতকের সময়, এই শব্দটি সকল পাশ্চাত্যের দেশগুলো জুড়েই এই শব্দটি নেতিবাচক অর্থ ধারণ করে। এর দ্বারা কোন কিছুর ইচ্ছাকৃত প্রচারণা বোঝানো শুরু হয়, বিশেষ করে মিথ্যার প্রচারণা। আর এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই তা কোন রাজনৈতিক কার্য বা আদর্শকে সমর্থন বা ন্যায্যতা দিয়ে বিশ্বাস করতে "বাধ্য করানোর" মত বিষয়ে পরিণতও হয়। হ্যারল্ড লাসওয়েল এর মতে, ১ম বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিল কমিটি (কমিটি অন পাবলিক ইনফরমেশন) এবং যুক্তরাজ্যের তথ্য মন্ত্রণালয় এর বিভিন্ন প্রচারণায় মানুষের সন্দেহ বাড়ার সাথে সাথে শব্দটি নেতিবাচক অর্থ গ্রহণ করতে শুরু করে। ১৯২৮ সালে লাসওয়েল তার একটি রচনায় লেখেন, "গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে অফিশিয়াল প্রোপাগান্ডা ব্যুরোগুলোর প্রতি মানুষের আশঙ্কাবোধ তৈরি হয়। ভয় তৈরি হয় যে তাদের দেয়া তথ্যগুলো কোন ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কিনা। মি. ক্রিলের বিখ্যাত ব্যুরো অব পাবলিক ইনফরমেশন (নাকি "ইনফ্লেমেশন") মানুষের মধ্যে এই ধারণা তৈরি করতে সাহায্য করে যে প্রোপাগান্ডা বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার অস্তিত্ব রয়েছে। … উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা সম্পর্কে জনসাধারণ বুঝে গেলে এর প্রতি প্রচণ্ড আক্ষেপ তৈরি হয়। প্রোপাগান্ডা শব্দটি তখন সকলের কাছে অবজ্ঞা ও ঘৃণার বিষয়ে পরিণত হয়। আর তখন প্রোপাগান্ডিস্ট বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারকগণ 'পাবলিক রিলেশন কাউনসিল', 'স্পেশালিস্ট ইন পাবলিক এডুকেশন', 'পাবলিক রিলেশন এডভাইজার' ইত্যাদি নাম নিয়ে নিজেদেরকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন।"[14]
রডরিক হিন্ডারি বলেন,[15] রাজনৈতিক বাম, ডান এবং মূলধারার কেন্দ্রপন্থী দলগুলোতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার অস্তিত্ব রয়েছে। হিন্ডারি আরও বলেন, বেশিরভাগ সামাজিক সমস্যা সংক্রান্ত বিতর্কে এই প্রশ্নটি ইতিবাচকভাবেই চলে আসতে পারে, "কেন এটা একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা বা কেন এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা নয়?"। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা, মতদীক্ষাদান এবং জঙ্গিবাদ/জঙ্গিবাদবিরোধিতা - এই বিষয়গুলোর মধ্যবর্তী সম্পর্কগুলোকে উপেক্ষা করা যাবে না। তিনি বলেন, এই ধ্বংসাত্মক হুমকিসমূহ সামাজিক ও বস্তুগতভাবেই ধ্বংসাত্মক।
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার সাথে সরকারের জনসংযোগ প্রচারণার অনেক সাদৃশ্য আছে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে বেশ কিছু আচরণকে উৎসাহিত করতে বা নিরুৎসাহিত করতে ব্যবহৃত হয়, যেমন সিটবেল্ট বাঁধতে উৎসাহিত করা, ধূমপান করতে নিষেধ করা ইত্যাদি। আবার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার ক্ষেত্রে জোড় আরও বেশি থাকে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা লিফলেট, পোস্টার, টিভি, রেডিও ব্রডকাস্ট সহ আরও বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যবহার করা হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে বিজ্ঞাপন (ওভার্ট প্রোপাগান্ডা বা প্রকাশ্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা) এবং যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের একটি সংগঠন গভার্নমেন্ট একাউন্টেবিলিটি অফিস (জিএও) দ্বারা সংজ্ঞায়িত "কোভার্ট প্রোপাগান্ডা" বা "গুপ্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা" এর মধ্যে একটি আইনি পার্থক্য আছে।
তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লবের ফলে তথ্যসংগ্রহ সহজ হয়ে যাওয়ায়, এবং তথ্য ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ কমে যাওয়ায় বিস্তৃত পরিসরে ওয়ার্কপ্লেস প্রোপাগান্ডা বা কর্মক্ষেত্রে উদ্দেশ্যপণোদিত প্রচারণার প্রয়োগ শুরু হয়। বিদ্যালয়, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন স্থানীয় ক্ষেত্রে এটির প্রয়োগ শুরু হয়।[16] পূর্বের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারকগণ যেখানে তাদের কৌশলে সত্যকে বিকৃত করতে বিভিন্ন আবেগী চিত্রকর্ম ব্যবহার করত, কর্মক্ষেত্র উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার ক্ষেত্রে ব্যক্তির আবেগকে শাসন করতে বিকৃত তথ্যের ব্যবহার করা হয়। যেমন বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যক্তির বেতন কমানোর জন্য "যুক্তি তুলে ধরা" ইত্যাদি।
জার্নালিস্টিক থিওরি বা সংবাদমাধ্যম তত্ত্ব বলে যে সংবাদগুলোর বস্তুনিষ্ঠ হওয়া উচিৎ, যাতে পাঠকেরা বিষয়টি সম্পর্কে সঠিক পটভূমি ও বিশ্লেষণ লাভ করে। অন্যদিকে বিজ্ঞাপন প্রোপাগান্ডার বিবর্তন ঘটেছে ঐতিহ্যগত বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন থেকে। আর এইসব বিজ্ঞাপন প্রোপাগান্ডা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার একটি নতুন ধরন হয়ে ওঠে যেখানে পেইড আর্টিকেল বা বৈতনিক প্রবন্ধসমূহের প্রচার করা হয় যেগুলো প্রকৃত সংবাদ থেকে ভিন্ন। এগুলোতে সাধারণত কোন সমস্যাকে খুবই ব্যক্তিবাচকভাবে (subjective) ও প্রায়ই বিভ্রান্তিকর ও ভুল তথ্য থাকে। এগুলোর প্রাথমিক উদ্দেশ্য জানানো নয়, বরং প্ররোচিত করা। সাধারণত তারা খুবই সূক্ষ্ম প্রোপাগান্ডা টেকনিক বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা কৌশল ব্যবহার করে থাকে, এগুলো ঐতিহ্যগত বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনের চেনা জানা কৌশল থেকে ভিন্ন। যদি পাঠক মনে করেন যে একটি বৈতনিক বিজ্ঞাপন আসলে একটি সংবাদ তাহলে খুব সহজেই বিজ্ঞাপনদাতার বার্তাটিকে বিশ্বাস করানো সম্ভব হবে।
এরকম বিজ্ঞাপন হচ্ছে গুপ্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা বা কোভার্ট প্রোপাগান্ডার উদাহরণ, কারণ এখানে বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের ছদ্মবেশে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়। ফেডারেল লতে বিশেষভাবে বলা হয়েছে, যদি কোন বিজ্ঞাপনকে সংবাদ উপাদানের আকারের বলে মনে হয় তাহলে তাহলে তাকে বৈতনিক বিজ্ঞাপন বা পেইড এডভারটাইজমেন্ট বলা হবে।
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারকগণ মানুষের কার্য এবং আশা আকাঙ্ক্ষাকে বদলে দেবার জন্য তারা যেভাবে কোন সমস্যা বা পরিস্থিতিকে বুঝে থাকেন তাকে নিজেদের পছন্দ মত বদলে দিতে চান। এক্ষেত্রে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা সেন্সরশিপের মত কাজ করে যেখানে একই উদ্দেশ্য কাজ করে। সেন্সরশিপের ক্ষেত্রে যেরকম মানুষের মনে অনুনোমদিত তথ্যের প্রবেশ আটকানো হয়, এক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে মানুষের কাছে বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি প্রবেশকে ঠেকানো হয়। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা অন্যান্য ধরনের এডভোকেসির সাথে যে বিষয়টি পার্থক্য করে দেয় তা হল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারকগণ প্ররোচনা ও বোঝানোর বদলে ছল ও বিভ্রান্তিকে ব্যবহার করেন। সংগঠনের নেতাগণ জানেন যে তথ্যগুলোকে একপাক্ষিক বা অসত্য হতে হবে, কিন্তু যারা প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর কাজে জড়িত থাকে তারা সেটা নাও জানতে পারেন।
প্রোপাগান্ডা শব্দটির উৎপত্তি ধর্মের সাথে সম্পর্কিত। নব্য ধর্মীয় আন্দোলন ( new religious movements) সম্পর্কিত বিতর্কেও এটি বিস্তৃতপরিসরে ব্যবহৃত হয়। যারা এই আন্দোলনকে সমর্থন করে বা যারা এর বিরোধীতা করে উভয়ের জন্যই বিতর্কের জন্য বেশ আলোচিত একটি বিষয়। এই কার্যক্রমকে আধুনিক কালে ব্যাঙ্গ করে কাল্ট বলা হয়. কাল্ট-বিরোধী কর্মীগণ এবং খ্রিষ্টান কাল্ট-বিরোধী কর্মীগণ নব্য ধর্মীয় আন্দোলনের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন যে, ধর্মীয় নেতারা ধর্মীয় প্রথাকে উদ্দেশ্য মুলক ভাবে প্রচার করে নিজেদের দল ভারী করতে চান। কিছু সমাজ বিজ্ঞানী যেমন প্রয়াত জেফরি হাডেন, CESNUR (ধর্মীয় সংগঠন) এদের বিরোধিতা করে বলেন, যারা একসময় কাল্টের সমর্থক ছিল এবং এখন তার মুখ্য সমালোচকে পরিণত হয়েছে, তারা অধার্মিকদের দলে ভিড়েছে। এবং কাল্ট বিরোধী এসব কার্যক্রম গুলোর কোনো যৌক্তিক কারণ ও নেই। তাই এটা দেখতেই বাজে দেখায়।[17][18]
যুদ্ধের সময় প্রচারণা ছড়ানো একটি শক্তিশালী হাতিয়ার, শত্রুর বিরুদ্ধে প্রবল ঘৃণা তৈরী করে তাদের অমানুষে রুপ দেওয়াই থাকে এই প্রচারণার উদ্দেশ্য। এই কাজ করার জন্য জাতিগত বিদ্বেষ এবং নিকৃষ্ট শব্দ ব্যবহার করে শত্রুদের খারাপ মানসিকতার অধিকারী হিসেবে তুলে ধরা হয়। উদাহরণস্বরুপঃ ১৯৭১ এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিক এবং সেনাবাহিনীর কাছে পাকিস্তান সরকার এই বার্তাই দিয়েছেন, বাংলাদেশের মানুষরা সঠিক মুসলমান নয়, তারা প্রত্যেকেই গাদ্দার। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় বিভিন্ন বর্ণবাদী শব্দ যেমন জ্যাপ ও গুক ব্যবহার করা হয়। যারা এই প্রচারণা ছড়ায় তাদের প্রায় সবারই এটাই প্রচেষ্টা থাকে যে, নিজ দেশের নাগরিকদের বুঝানো; এই যুদ্ধের জন্য তারা দায়ী নয়, বরং শত্রুপক্ষই এই যুদ্ধ তাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। (প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান নেভি আরএমএস লুসিতানিয়া নামক জাহাজ ডুবে যাওয়ার কথা প্রচার করে) এটা নিছক কথাসাহিত্য ও হতে পারে, আবার বাস্তবও হতে পারে। এটা যুদ্ধের উপরই নির্ভর করে। উদ্দেশ্য থাকে যাতে দেশের জনগণ বিশ্বাস করে যে যুদ্ধটি ন্যায্য। ন্যাটো মতবাদ (doctrine), প্রচারণাকে ( propaganda) সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেছে, "যে কোনো ধরনের তথ্য, ধারণা, মতবাদ অথবা বিশেষায়িত মর্মস্পর্শী কিছু প্রচারের মাধ্যমে যদি কোনো সুনির্দিষ্ট দলের চিন্তাধারা, স্বভাব, আবেগ, অনুভূতিকে প্রভাবিত করা যায় এবং এর ফলে প্রচারণাকারী যদি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপকৃত হয়, তাহলে তা উদ্দেশ্যমুলক প্রচারণা হিসেবে গণ্য হবে।" [19] এই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রচারণা ছড়ানোর সময়ে যে তথ্য দেওয়া হয়, তা যে মিথ্যাই হতে হবে এমন কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই, তবে যিনি বা যে ব্যবস্থা(system) এটা ছড়াবেন, তাকে তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য অবশ্যই পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে প্রাসঙ্গিক প্রচারণা ছড়াতে হবে।
প্রোপাগাণ্ডা এমন একটা প্রক্রিয়া যা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধবিগ্রহে (Psychological warfare) ব্যবহৃত হয়, যা ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশনেও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে যেখানে কোন কার্যক্রমকে শত্রুপক্ষের কার্যক্রম বলে দেখানো হয় (উদাহরণস্বরুপঃ বে অব পিগস আক্রমণে ব্যবহৃত সিআইএ বিমানকে কিউবান এয়ার ফোর্স হিসেবে অঙ্কন করা হয়েছে)। যারা প্রোপাগান্ডিস্টদের ইচ্ছানুসারে ইতিমধ্যেই তাদের দেয়া মিথ্যা তথ্যে বিশ্বাস করে ফেলেছে, ভুল তথ্য দিয়ে তাদের বিশ্বাসকে আরও শক্তিশালী করা অর্থেও প্রোপাগান্ডা শব্দটি ব্যবহৃত হয়। (উদাহরণস্বরুপঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রটিশ পপ্রচারণার একটা উদ্দেশ্য ছিলো, পুরুষদের আর্মিতে যোগদানে, আর নারীদের দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানে যোগদানে উৎসাহিত করা। সেসময় প্রচারণামুলক পোস্টার ব্যবহার করা হতো, কারণ বেতার বা টেলিভিশন তখন সহজলভ্য ছিল না।) [20] এই ধারণা থেকে বলা যায়, যদি জনতা মিথ্যে কোনো কিছুতে বিশ্বাস করে, তবে তারা সেই বিষয়ে সন্দিহান হয়ে থাকে। যদি সন্দেহ গুলো অপ্রীতিকর হয়, তবুও। ( দেখুন en:cognitive dissonance(স্ববিরোধী দ্বন্দ্ব))। এ কারণে প্রচারণা ছড়ানোর সময় প্রায়ই/কখনো কখনো লক্ষ্য রাখা হয়, যে জায়গা আর যাকে উদ্দেশ্য করে প্রচারণা ছড়ানো হচ্ছে, তারা যেন প্রথম থেকেই সেই দর্শনের প্রতি একটা সফট কর্ণার বা সহমর্মিতা থাকে।
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণাকে বার্তার উৎস্য ও প্রকৃতি অনুযায়ী শ্রেণিবিভাগ করা যায়। শ্বেত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা বা হোয়াইট প্রোপাগান্ডা সাধারণত আসে কোন মুক্ত শনাক্তকৃত উৎস্য থেকে, আর এটি প্ররোচনা করার নম্র কৌশল হিসেবে পরিচিত, যেমন আদর্শ জনসংযোগ কৌশল এবং কোন বিষয়কে একপাক্ষিকভাবে দেখানো। কৃষ্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা বা ব্ল্যাক প্রোপাগান্ডা হচ্ছে সেগুলো যেগুলোতে মানুষ এক জায়গার কিন্তু ঘটনা আরেক জায়াগার। এক্ষেত্রে প্রোপাগান্ডার আসল উৎস্যটিকে লুকিয়ে রাখা হয় যাতে একে কোন শত্রু রাষ্ট্রের বা নেতিবাচক পাবলিক ইমেজের ব্যক্তির সংগঠনের উপর চাপিয়ে দেয়া যায়। ধূসর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা হচ্ছে এমন যেগুলোতে উৎস্য বা লেখককে শনাক্ত করা যায় না। ধূসর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার একটি প্রধান প্রয়োগ হচ্ছে স্ট্রম্যান যুক্তির সাহায্যে শত্রুকে ভুল বিশ্বাস করানো। এক্ষেত্রে কাউকে "ক" বিশ্বাস করাবার জন্য প্রথম ধাপে ধূসর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা "খ" প্রচার করা হয়, যা "ক" এর বিপরীত। দ্বিতীয় ধাপে "খ" কে কোন স্ট্র ম্যান অখ্যাতি বা মর্যাদাহানি করা হয়। এরফলে শত্রুরা ধরে নেয় যে "ক" সত্য।
বিভিন্ন ধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণাকে এদের সাথে প্রতিযোগিতা দেবার জন্য সাম্ভব্য সত্য ও সঠিক তথ্যের উপর ভিত্তি করেও শ্রেণিবিভাগ করা যায়। যেমন, শ্বেত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার বিরোধের ক্ষেত্রে উৎস্য খুব সহজেই পাওয়া যায়, আর এর সেই প্রোপাগান্ডার উৎসের কিছুটা সম্মানহানি হয়। ধূসর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার বিরোধিতার ক্ষেত্রে, এটা প্রকাশিত হয়ে গেলে (প্রায়ই ভেতরের উৎস্য থেকেই হয়) একটা নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত শোরগোল দেখা যায়। কৃষ্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার ক্ষেত্রে বিরোধিতা প্রায় সময়ই দেখা যায় না, আর একে প্রকাশিত করাটা বিপজ্জনকও হতে পারে, কারণ কৃষ্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা কৌশল ও উৎস্য সম্পর্কে জনসাধারণের জেনে যাওয়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারকদের সমর্থিত প্রচারণার বিপর্যয় ঘটিয়ে দেবে।
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণাকে প্রতারণাপূর্ণ উপায়ে পরিচালনা করা যেতে পারে। যেমন, কোন নির্দিষ্ট দল বা বাইরের কোন দেশের ইতিহাস সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য (Disinformation) ছড়ানো কোন শিক্ষাব্যবস্থায় উৎসাহিত হতে পারে, বা সেখান থেকে প্রশ্রয় দেয়া হতে পারে। যেহেতু খুব কম মানুষই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কি শিখেছে তা দ্বিতীয় বার পুনরায় চেক করে দেখে, তাই সাংবাদিক ও পিতামাতা কর্তৃক এরকম মিথ্যা তথ্যের পুনরাবৃত্তি হয়। এভাবে একটি মিথ্যা তথ্যের ধারণাকে বারবার শক্তিশালী করে একে "সুপরিচিত তথ্য" বানানো হয়, যদিও সেই মিথ্যা তথ্যের পুনরাবৃত্তি যারা করেছে তাদের কেউই সেই তথ্যের প্রামাণ্য উৎস্য দেখাতে পারেন না। অতঃপর সেই মিথ্যা তথ্যকে গণমাধ্যম ও শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারের প্রত্যক্ষ বাঁধা ছাড়াই পুনরায় ব্যবহার করা হয়। এরকম উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা ছড়ানোর কৌশলটি কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনেও ব্যবহৃত হতে পারে যার মাধ্যমে নাগরিককে রাষ্ট্রের অবস্থা ও নীতি সম্পর্কে ভুল ধারণা দেয়া হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নে সাধারণ মানুষকে উৎসাহ দেবার জন্য যে প্রোপাগান্ডা সাজানো হয়েছিল তা স্ট্যালিন কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হত। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার ক্ষেত্রে স্ট্যালিন যে পদ্ধতিই ব্যবহার করেন, শিক্ষিত শ্রোতাগণ সহজেই বুঝতে পারতেন যে তা অ-প্রামাণ্য ছিল। অন্যদিকে জার্মানদের পাশবিকতা সম্পর্কিত অপ্রাতিষ্ঠানিক গুজবগুলো খুব ভালভাবেই সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং বিশ্বাসযোগ্য ছিল।[21] স্ট্যালিন একজন জর্জিয়ান ছিলেন যিনি ভারি উচ্চারণে রুশ ভাষায় কথা বলতেন। কিন্তু একজন জাতীয় নায়কের ক্ষেত্রে সেরকম বৈশিষ্ট্য থাকলে চলে না। তাই ১৯৩০ এর দশক থেকে তার সকল দৃশ্যমান ছবি পুনরায় নতুন করে তৈরি করা হয় যেখানে তার জর্জিয় চেহারার বৈশিষ্ট্যগুলোকে মুছে দিয়ে তাকে আরও বেশি সাধারণিকৃত সোভিয়েত নায়ক বানানো হয়। কেবলমাত্র তার চোখ ও বিখ্যাত গোঁফটি অবিকৃত রাখা হয়। জোরেস মেদভেদেভ এবং রয় মেদভেদেভ বলেন, "তার নতুন রাজকীয় ছবিটি সঠিকভাবে তৈরি করা হয় যা সকল সময় ও সকল মানুষের নেতা হিসেবে তাকে তুলে ধরবে"।[22]
ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন সিভিল এন্ড পলিটিকাল রাইটস এর আর্টিকেল ২০ এ যুদ্ধের জন্য যেকোন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা এবং জাতীয় বা ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোকে নিষিদ্ধ করা হয় কারণ এগুলোর দ্বারা অপরাধে উষ্কানি প্রদান, বৈষম্য, শত্রুতা এবং আইনের লঙ্ঘন করা হয়।[23]
৯/১১ এবং বর্ধিত গণ্যমাধ্যম তারল্যের (media fluidity), আবির্ভাবের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে প্রোপাগান্ডা সংস্থা, চর্চা এবং এর আইনি ভিত্তি নিয়ে বিবর্তিত হচ্ছে। ডঃ এমা লুইস ব্রায়ান্ট দেখান কীভাবে এর মধ্যে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় উপাদানের বর্ধিতকরণ ও একীভবন সম্ভব হয়েছে যেগুলোকে বিভিন্ন সরকার কৌশলগত যোগাযোগ (strategic communication) এর মাধ্যমে বৈদেশিক ও নিজ দেশের শ্রোতাদের জন্য প্রোপাগান্ডা তৈরিতে ব্যবহার করেন।[24] এগুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারে বিতর্ক হয় যা পেন্টাগন ও পাবলিক এফেয়ারস কর্তৃক আটকানো হয় এবং কিছু পণ্ডিতদের দ্বারা সমালোচিত হয়।[25] ২০১৩ অর্থবছরের ন্যাশনাল ডিফেন্স অথোরাইজেশন এক্ট (সেকশন ১০৭৮ (এ)) এর দ্বারা ১৯৪৮ সালের ইউএস ইনফরমেশন এন্ড এডুকেশনাল এক্সচেঞ্জ এক্ট (যা স্মিথ-মান্ট এক্ট নামে বহুল পরিচিত) এবং ১৯৮৭ সালের ফরেইন রেলেশনস অথোরাইজেশন এক্ট পরিবর্তিত হয়। এর ফলে যেসব উপাদান স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং ব্রডক্যাস্টিং বোর্ড অব গভার্নরস (বিবিজি) দ্বারা তৈরি হয় তা যুক্তরাষ্ট্র বর্ডারের মধ্যেই ডোমেস্টিক ডিস্ট্রিবিউশন, চলচ্চিত্র, ভিডিওটেপ ইত্যাদির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আরকাইভিস্ট কাছে যাবার একটি সুযোগ তৈরি হয়।... এক্ষেত্রে ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট বা ব্রডক্যাস্টিং বোর্ড অব গভরনর এর কোন মাধ্যম বা কোন ধরনের যোগাযোগে জড়িত হওয়াতে কোন ধরনের নিষেধাজ্ঞা থাকবে না, কারণ সেটা হলে যুক্তরাষ্ট্রের কোন নাগরিক এসব তথ্যের সুবিধা লাভ করতে পারবে।" যুক্তরাষ্ট্রে অভ্যন্তরীন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞার শিথিলায়নের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে জনসচেতনতা বৃদ্ধি পায়।[26]
স্বভাবগতভাবেই, সাধারণ মানুষ যুদ্ধ চায় না, না রাশিয়ার মানুষ, না যুক্তরাজ্যের মানুষ, না যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ, না জার্মানের মানুষ। এটা বোঝা যায়, কিন্তু দেশের নেতারাই এক্ষেত্রে সবসময় নীতি ঠিক করে এবং সবসময় এটাই দেখা যায় যে তারাই সাধারণ মানুষকে তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য টেনে নিয়ে আসে, তা সেটা গণতান্ত্রিক সরকারই হোক বা ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার সরকারই হোক, বা সংসদীয় বা সমাজতান্ত্রিক স্বৈরাচারই হোক। জনগণকে সবসময়ই নেতাদের পাশার দানে ব্যবহার করা হয়। আর এটা সহজ। শুধু যেটা করতে হবে তা হল, তাদেরকে বলতে হবে যে তাদের উপর হামলা করা হচ্ছে, তাদের দেশপ্রেমের অভাবের কারণে তাদের শান্তিবাদের নিন্দা করতে হবে, আর দেখাতে হবে হবে যে দেশটি বর্তমানে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে আছে। সকল দেশেই এটা একইভাবে কাজ করে।
— হারমান গোরিং[27]
ব্যবসায়ীকভাবে উদ্দেশ্যমুলক প্রচারণা মুলত সংস্থাই চালায়। এর মাধ্যমে তারা তাদের নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের (যেমন: তাদের দ্রব্যের গুণাগুণ, তাদের সেবার মান, তাদের এলাকা বা দেশভিত্তিক কার্যক্রমকে পজেটিভ ভাবে তুলে ধরতে) প্রচারণা চালায়। এধরনের প্রচারণা যারা চালায় তাদের বলা হয় প্রচারণাকারী। ব্যবসায়িক প্রচারণা যারা করে বা করায়, তারা সাধারণ ভাবে দেখা যায় দুইটি পদ্ধতি অনুসরণ করে। একটি হলো বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে (এডভার্টাইজিং) এবং অন্যটি হলো জন সম্পৃক্ততার (পাবলিক রিলেশন) মাধ্যমে। দুইটির মধ্যে সাধারণ পার্থক্য হলোঃ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে যারা প্রচারণা করে, তারা সরাসরি অর্থ নেন। আর যারা জন সম্পৃক্ততার মাধ্যমে কোম্পানি বা সংস্থার জন্য প্রচারণা চালায়, তারা সরাসরি প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ নেন না।
কর্মক্ষেত্রে যে উদ্দেশ্যমুলক প্রচারণা চালানো হয়, সেটা কর্মীর দ্বারা সরাসরি কর্মীদের উপরেই ব্যবহার করা হয়। উদ্দেশ্যমুলক বিকৃত তথ্যের উপর ভিত্তি করে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সে সিদ্ধান্ত কে বৈধতা দান করতেই প্রচারণাকে ব্যবহার করা হয়। এটাই বাণিজ্যিক প্রচারণার সাথে কর্মক্ষেত্রের প্রচারণার পার্থক্য। কর্মক্ষেত্রের প্রচারণা ছোট স্থান যেমন চ্যারিটিতে হতে পারে, আবার বশাল মার্কেট যারা বিভিন্ন সংস্থা চালায় সেখানেও হতে পারে।
সাধারণ মিডিয়া অনেকসময় উদ্দেশ্যমুলক প্রচারণা চালায়। তাদের এই প্রচারণার মধ্যে থাকে রাজনৈতিক খবর, সরকারী খবর, উদ্দেশ্যমুলক ইতহাস প্রচার, অপ বিজ্ঞান, বই, প্রচারপতত্র, সিনেমা, বেতার, টেলিভিশন এবং পোস্টার। উদ্দ্যেশ্যমুলক প্রচারণাকারীরা তাদের মতাদর্শের সাথে মিলে যায় এধরনের মানুষকে বা সাধারণ মানুষকে তাদের দলে ভিড়ানোর জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট কৌশল অনুসরণ করেন। এই প্রচারণা ছড়ানোর জন্য খুব সহজ পদ্ধতি যেমনঃ লিফলেট (প্রচারপত্র) এর মাধ্যম থেকে জটিল পদ্ধতি প্লেন থেকে প্রচারপত্র ফেলে দিয়ে প্রচারণা চালানোর পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এই সব প্রচারণায় নির্দেশিকা থাকে কী করে সেই সব প্রচারণার স্বপক্ষে আরো তথ্য সংগ্রহ করা যায়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ওয়েবসাইট, রেডিওর সুনির্দিষ্ট চ্যানেল অনুসরণ করার কথা বলা থাকে। এই ভাবে প্রচারণা ছড়ানোরর মাধ্যমে বলপূর্বক হোক বা কৌশলে হোক তথ্যদাতার সাথে তথ্য সংগ্রাহকের ( যাকে/যাদেরকে টার্গেট করে প্রচারণা ছড়ানো হয়) একটা যোগাযোগ করানো হয়, এবং তারপর তথ্য সংগ্রাহককে নানা রকম ভাবাদর্শে প্রলুব্ধ করে নেতার সংযোগ ঘটানো হয়।[28]
সামাজিক মনোবিজ্ঞানগত (social psychological) গবেষণাগুলোর ভিত্তিতে অনেকগুলো কৌশলকেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। এই কৌশলগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই হেত্বাভাসের মধ্যে পড়ে, কারণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার ক্ষেত্রে এমন যুক্তিবাক্য ব্যবহৃত হয় যা কখনও কখনও বিশ্বাসযোগ্য হলেও সবসময়ই যে সঠিক হবে এমন কোন কথা নেই।
কীভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার বার্তা ছড়িয়ে দেয়া হয় তা বিশ্লেষণ করার জন্যেও কিছু সময় ব্যয় করা হয়েছে। কাজটি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এটা পরিষ্কার যে তথ্য প্রচারণা কৌশল তখনই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা কৌশলে পরিণত হয় যখন এর সাথে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা বার্তা (propagandistic messages) যুক্ত হয়। এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা বার্তা বা প্রোপাগান্ডিস্টিক মেসেজকে শনাক্ত করাই হচ্ছে কোন পদ্ধতিতে সেই বার্তাকে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সেসম্পর্কে জানার পূর্বশর্ত।
সামাজিক মনোবিজ্ঞানে প্ররোচনা (persuasion) বিষয়ক আলোচনা করা হয়। সামাজিক মনোবিজ্ঞানীগণ সমাজবিজ্ঞানী বা মনোবিজ্ঞানী দুইই হতে পারেন। প্ররোচনা সম্পর্কে বোঝার জন্য সামাজিক মনোবিজ্ঞানে অনেক তত্ত্ব প্রদান করে। যেমন, যোগাযোগ তত্ত্ব (communication theory) বলে, যোগাযোগকারীর বিশ্বাসযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা বা বিশেষ জ্ঞান, বিশ্বস্ততা এবং আকর্ষণীয়তাকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে প্ররোচিত করা যায়। এলাবরেশন লাইকলিহুড মডেল (elaboration likelihood model) বা হিউরিস্টিক মডেল (heuristic model) বলে, কয়েকটি বিষয় (যেমন, যোগাযোগের ক্ষেত্রে বার্তা-গ্রাহকের আগ্রহের মাত্রা) আছে যা মানুষকে প্ররোচনার উপরি উপরি বিষয়গুলোকে বিভিন্ন মাত্রায় বিশ্বাস করাতে প্রভাবিত করে। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত মনোবিজ্ঞানী হারবার্ট এ. সাইমন তার নোবেল পুরস্কারটি জিতেছিলেন তার একটি তত্ত্বের জন্য, যেটা বলে মানুষ হচ্ছে চেতনাগত কৃপণ (cognitive miser)। অর্থাৎ, গণতথ্যের (mass information) সমাজে মানুষকে দ্রুত সিদ্ধান্তগ্রহণের জন্য বাধ্য হতে হয়, আর সেটা প্রায়ই যৌক্তিকভাবে না হয়ে অগভীর বা অযৌক্তিকভাবে হয়ে থাকে।
উইলিয়াম ডব্লিউ. বিডলের ১৯৩১ সালে লেখা একটি প্রবন্ধ "এ সাইকোলজিকাল ডেফিনিশন অব প্রোপাগান্ডা" অনুসারে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার ক্ষেত্রে যে চারটি নীতি অনুসরণ করা হয় সেগুলো হয়: (১) যুক্তির উপর নির্ভরশীল না হয়ে আবেগের উপর নির্ভরশীলতা, (২) একে "আমরা" বনাম "শত্রু" প্যাটার্নে নিয়ে যাওয়া, (৩) বার্তাটিকে বিভিন্ন দল ও ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেয়া, (৪) যতটুকু সম্ভব উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণাকারীকে লুকিয়ে ফেলা।[29]
এডোয়ার্ড এস. হারমান এবং নোম চম্স্কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা প্রতিমান নামে একটি তত্ত্বের উন্নয়ন করেন যেখানে গণমাধ্যমে ব্যবস্থাগত পক্ষপাতের কথা বলা হয়, এবং এগুলোকে কাঠামোগত অর্থনৈতিক কার্যকারণের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা হয়:
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা প্রতিমান তত্ত্ব প্রথম ১৯৮৮ সালে ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট: দ্য পলিটিকাল ইকোনমি অভ দ্য মাস মিডিয়া নামক বইতে প্রকাশ করা হয়। এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা প্রতিমানে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রচারমাধ্যমগুলিকে পণ্য বিক্রয় করার ব্যবসা হিসেবে গণ্য করা হয় যেখানে এগুলিকে পাঠক, শ্রোতা ও অন্যান্য ব্যবসার (বিজ্ঞাপনদাতার) কাছে সরকারী ও করপোরেট তথ্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার উপর ভিত্তি করে বিক্রয় করা হয়। এই তত্ত্বটি পাঁচটি সাধারণ শ্রেণীর "ফিল্টার" এর কথা বলে যা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়: মাধ্যমের মালিকানা, মাধ্যমের জন্য অর্থ জোগানো, সংবাদের উৎস্যের সন্ধান করা, শক্তিশালী সমালোচনা (Flak) এবং প্রতিসাম্যবাদী আদর্শ।
এদের মধ্যে প্রথম তিনটি (মালিকানা, অর্থ যোগানো ও উৎস্যের সন্ধান) - কে সাধারণত সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বলা হয়। যদিও এই মডেলটি প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমকে ভিত্তি করে বানানো হয়েছিল, চমস্কি ও হারমান বিশ্বাস করেন যে এই তত্ত্বটি যেকোন দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যেখানে দেশটিতে একই রকম মৌলিক অর্থনৈতিক কাঠামো এবং প্রচারমাধ্যম পক্ষপাত (media bias) এর কারণ হিসেবে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক নীতি থাকে।
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা বোঝার জন্য শেরিল টাটল রস এপিস্টেমিক মেরিট মডেল নামক পদ্ধতিটি দেন। ২০০২ সালেজার্নাল অব এস্থেটিক এডুকেশন এ "আন্ডারস্ট্যান্ডিং প্রোপাগান্ডা: দ্য এপিস্টেমিক মেরিট মডেল এন্ড ইটস এপলিকেশন টু আর্ট" নামক প্রবন্ধে এই বিষয়ে প্রথম উল্লেখ করা হয়।[30] রস এই এপিস্টেমিক মেরিট মডেলটি ডেভেলপ করেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার সংকীর্ণ, ভ্রান্তিমুলক সংজ্ঞার উপর তার উদ্বিগ্নতা থেকে। তিনি তার মডেলটির সাথে পোপ পঞ্চদশ গ্রেগরি, ইনস্টিটিউট ফর প্রোপাগান্ডা এনালাইসিস, আলফ্রেড লি, এফ.সি. বার্টলেট এবং হ্যান্স স্পেইয়ার এর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা সম্পর্কিত ধারণার তুলনা করেন। তিনি বলেন, এদের সকলের দেয়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার ধারণা এত সংকীর্ণ যে তিনি এর একটি নিজস্ব সংজ্ঞা দান করেন।
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা নিয়ে সঠিকভাবে আলোচনার জয়, রস যুক্তি দেখান, একজনকে অবশ্যই একটি তিন স্তর বিশিষ্ট যোগাযোগ মডেল বিবেচনা করতে হবে: যা হল, প্রেরক-বার্তা-গ্রাহক। "অর্থাৎ ... উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণায় যিনি ইচ্ছাকৃতভাবে প্ররোচনা দিচ্ছেন (প্রেরক), প্ররোচনার লক্ষ্য (গ্রাহক) ও সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর উপায় (বার্তা) থাকবে"। কোন বার্তাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা হিসেবে বিবেচনা করার জন্য চারটি শর্ত প্রযোজ্য। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণায় প্ররোচিত করবার আকাঙ্ক্ষা থাকবে। সেই সাথে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা ছড়ানো হয় কোন সমাজ-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান (sociopolitical institution) থেকে। এর পর, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার গ্রাহক হন মানুষের একটি সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সর্বশেষ, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা একটি জ্ঞানীয় সংগ্রাম (epistemic struggle) যা অন্যদের চিন্তাধারাকে মোকাবেলা করে।
রস দাবী করেন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা কেবলই মিথ্যা, এরকমটা বলা ভ্রান্তিমূলক, কেননা প্রায় সময়ই একজন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারক সেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণায় বিশ্বাস করেন। অন্য কথায়, এটা যে একটি মিথ্যাই হবে এমন কোন কথা নেই যদি প্রচারক যা প্রচার করতে চাচ্ছেন তা আসলেই তিনি বিশ্বাস করে থাকেন। "একজন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারকের লক্ষ্য থাকে বিশ্বাসযোগ্যতার একটি আভাস তৈরি করা"। এর অর্থ হচ্ছে তিনি একধরনের জ্ঞানতত্ত্বের আশ্রয় নেন যা দুর্বল বা ভ্রান্ত।
তিনটি রাজনৈতিক গ্রুত্বের উন্নয়নের দ্বারা ২০ শতককে চিহ্নিত করা যায়: গণতন্ত্রের বৃদ্ধি, করপোরেট ক্ষমতার (corporate power) বৃদ্ধি, এবং গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে করপোরেট ক্ষমতাকে রক্ষা করার জন্য করপোরেট প্রোপাগান্ডার বৃদ্ধি।[31][32]
মিথ্যা উক্তি, খারাপ যুক্তি, অনৈতিক আদেশ এবং অনুপযুক্ত উপমা (এবং অন্যান্যা সাহিত্যিক বক্রোক্তি) হচ্ছে এমন বিষয় যেগুলো জ্ঞানীয়ভাবে ত্রুটিপূর্ণ (epistemically defective)... কেবলমাত্র জ্ঞানীয় ত্রুটিপূর্ণতা (epistemic defectiveness) কীভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা কাজ করার চেষ্টা করে তা ব্যাখ্যা করে না... কারণ অনেক বার্তাই এমন আকারে থাকে যার মধ্যে সত্যমূল্য (truth-value) থাকে না কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ইতিহাস জুড়ে যারা প্ররোচিত করতে চেয়েছিলেন তারা বার্তা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে শিল্পের প্রয়োগ করেছিলেন। এটা সম্ভব হতে পারে হয় প্রচারণার উদ্দেশ্যে কোন শিল্পীকে ভাড়া করে নিয়ে আসার মাধ্যমে অথবা পূর্বের কোন অরাজনৈতিক কার্যে নতুন অর্থ যুক্ত করার মাধ্যমে। তাই, রস বলেন, "তৈরি করার শর্ত এবং ব্যবহার করার শর্তকে" বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ।
সকল প্রচারণাকারীদের মুল লক্ষ্যগুলোর একটি হলো শিশুদের টার্গেট করা। শিশুরা জটিল ভাবে চিন্তা করতে ও উত্থাপিত প্রসঙ্গ বুঝতে মানসিক ভাবে ততটা প্রস্তুত হয় না। তাই তাদেরকে প্ররোচিত করা অপেক্ষাকৃত সহজ। তাই তাদেরকেই বুঝে শুনে, বড়দের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যে বার্তা তাদের দেওয়া হচ্ছে সেটা আসলে উদ্দেশ্যমুলক প্রচারণা নাকি নয়। শিশুরা যখন বড় হতে থাকে, তখন তাদের বুঝার সক্ষমতা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, এই সময় কেও যদি প্রচারণা চালায়, তখন সেটাকে খুব বেশি বিচার-বিশ্লেষণ করার সক্ষমতা শিশুর থাকে না। এছাড়াও আলবার্ট বান্ডুরা, ডরোথিয়া রোজ এবং শিলা এ.রোজের ১৯৬০ সালের গবেষণা থেকে দেখা যায়, শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তারা আরো বলেন, সামাজিকতা, সাধারণ শিক্ষা এবং মানসম্মত টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও অনেক সময় প্রলুব্ধ করতে বিভিন্ন রকম প্রচারণা চালায়। এই উদ্দেশ্যমুলক প্রচারণা ১৯৩০-৪০ এর সময়ে জার্মানিতে ব্যাপকভাবে ছড়ানো হয়েছিল। রাশিয়ার স্ট্যালিনিস্টরাও এর ব্যতিক্রম ছিল না।
জন টেইলর গ্যাটো বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে বাচ্চাদেরকে বোকা বানিয়ে রাখার জন্য, যাতে তাদেরকে শিল্পকারখানায় কাজে লাগানোর জন্য উপযুক্ত বস্তুতে পরিণত করা যায়।
জার্মানির নাৎসি পার্টির সময়, শিক্ষা ব্যবস্থাকে এমনভাবে পরিবর্তিত করা হয়েছিল, যাতে করে জার্মানির তরুণরা ইহুদী বিদ্বেষী ধারণায় প্রলুব্ধ হয়। ১৯৩৭ সালে জার্মানির শিক্ষকদের ৯৭% ঈ জাতীয়তাবাদী সমাজতান্ত্রিক শিক্ষক লীগের সদস্য ছিলেন। এই লীগ শিক্ষকদের জাতীয়তাবাদী তত্ত্বগুলো পড়াতেই উৎসাহিত করত। বাচ্চাদের জন্য বানানো চিত্রপুস্তক- ডোন্ট ট্রাস্ট এ ফক্স ইন এ গ্রিন মিডো অর দ্য ওয়ার্ড অব এ জিউ, ডার গিফটপিলজ (বাংলায়- বিষাক্ত মাশরুম), দ্য পুডল-পাগ-ডাশান্ড-পিঞ্চার বিস্তৃত পরিসরে বিক্রয় করা হয় (ডোন্ট ট্রাস্ট এ ফক্স ... বইটি ১৯৩০ এর দশকে এক লক্ষেরও বেশি বিক্রি হয়েছিল)। এই ছবিগুলো ইহুদীদের শয়তান রুপে, শিশু নির্যাতনকারী হিসেবেই চিত্রায়িত করত। বিভিন্ন ধরনের স্লোগান যেমন: "ইহুদি জুডাস জার্মান যিশুকে প্রতারিত করেছিল"- আবৃত্তির ন্যায় পাঠ করানো হত।[33] প্রচারণাকারীদের ইহুদী বিদ্বেষ ছড়ানোর অসংখ্য উদাহরণের একটি হলো, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের জন্য ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট এসেন্স অব এডুকেশন দ্বারা প্রস্তাবিত একটি গাণিতিক সমস্যা যেখানে লেখা ছিল, "জার্মানিতে ইহুদীরা বহিরাগত- ১৯৩৩ সালে জার্মান রাইখে ৬৬,৬০৬,০০০ জন বসবাসকারী আছে,যাদের মধ্যে ৪৯৯,৬৮২ জন (০.৭৫%) হচ্ছেন ইহুদী।"[34]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.