শীর্ষ প্রশ্ন
সময়রেখা
চ্যাট
প্রসঙ্গ
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট
ফরাসি সমরনেতা, রাজনীতিবিদ ও সম্রাট (১৭৬৯-১৮২১) উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
Remove ads
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট[খ] (জন্ম নাম: নাপোলেওনে দি বুয়নাপার্তে;[১][গ] ১৫ আগস্ট ১৭৬৯ – ৫ মে ১৮২১) একজন ফরাসি সামরিক কর্মী ও কূটনীতিজ্ঞ, যিনি ফরাসি বিপ্লবের সময় খ্যাতি অর্জন করেছিলেন এবং ১৭৯৬ থেকে ১৮১৫ পর্যন্ত ফরাসি বিপ্লবী ও নেপোলিয়নীয় যুদ্ধসমূহ পর্ব চলাকালীন ইউরোপজুড়ে একাধিক সফল সামরিক অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৭৯৯ থেকে ১৮০৪ সাল পর্যন্ত তিনি ফরাসি প্রজাতন্ত্রের প্রথম কনসাল ছিলেন। পরে ১৮০৪ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত তিনি ফরাসি সম্রাট ছিলেন। তারপর ১৮১৫ সালে ১০০ দিনের জন্য তিনি ফরাসি সম্রাট ছিলেন, যা "একশো দিনের শাসন" বলে পরিচিত।
নেপোলিয়ন ফ্রান্সের কর্সিকা দ্বীপে এক ইতালীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ১৭৭৯ সালে তিনি ফ্রান্সের মূল ভূখণ্ডে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন। ১৭৮৫ সালে তিনি ফরাসি রাজকীয় সেনাবাহিনীর একজন কর্মী হিসাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের সমর্থন করেছিলেন এবং কর্সিকা দ্বীপে এর প্রচার করেছিলেন। ১৭৯৬ সালে প্রথম জোটের যুদ্ধ চলাকালীন নেপোলিয়ন অস্ট্রিয়া ও তার ইতালীয় মিত্রদের বিরুদ্ধে এক সামরিক অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি চূড়ান্তভাবে জয়ী হয়েছিলেন এবং ফ্রান্সের জাতীয় নায়ক হিসাবে পরিচিত হয়েছিলেন। ১৭৯৮ সালে তাঁর নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী মিশর ও সিরিয়ার উপর আক্রমণ করেছিল, যা তাঁকে একঝাঁপে রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করেছিল। ১৭৯৯ সালের নভেম্বরে ফরাসি ডিরেক্টরির বিরুদ্ধে এক অভ্যুত্থানের আয়োজন করেছিলেন এবং তিনি ফরাসি প্রজাতন্ত্রের প্রথম কনসাল হয়েছিলেন। ১৮০০ সালে নেপোলিয়ন মারেঙ্গো যুদ্ধ জয় করেছিলেন, যা দ্বিতীয় জোটের যুদ্ধে ফ্রান্সের জয় সুনিশ্চিত করেছিল। ১৮০৩ সালে নেপোলিয়নের সময় ফ্রান্স তার লুইজিয়ানা উপনিবেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিক্রয় করেছিল। ১৮০৪ সালের ডিসেম্বরে তিনি নিজেই নিজেকে ফরাসি সম্রাট হিসাবে অভিষিক্ত করেছিলেন, যা তাঁর ক্ষমতবৃদ্ধি করেছিল।
অঁমিয়ে চুক্তির ভাঙনের ফলে ১৮০৫ সালে তৃতীয় জোটের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। আউস্টারলিৎসের যুদ্ধে নেপোলিয়ন এই জোট ভেঙে দিয়েছিলেন, যার ফলে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল। চতুর্থ জোটের যুদ্ধ চলাকালীন ১৮০৬ সালে ইয়েনা-আউয়ারস্টেটের যুদ্ধে নেপোলিয়ন প্রুশিয়াকে পরাজিত করেছিলেন। ১৮০৭ সালে তাঁর গ্রঁদ আর্মে (Grande Armée) পূর্ব ইউরোপের দিকে কুচকাওয়াজ চালিয়েছিল এবং ফ্রিডলান্ডের যুদ্ধে রুশদের পরাজিত করেছিল। ব্রিটেনের বিরুদ্ধে তাঁর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা প্রসারণের জন্য ১৮০৮ সালে নেপোলিয়ন আইবেরিয়া আক্রমণ করেছিলেন এবং তাঁর ভ্রাতা জোসেফ বোনাপার্টকে স্পেনের রাজার আসনে বসিয়েছিলেন, যার ফলে ১৮০৯ সালে উপদ্বীপীয় যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। ১৮০৯ সালে পঞ্চম জোটের যুদ্ধে অস্ট্রিয়ানরা ফ্রান্সকে আহ্বান করেছিল, আর ভাগ্রামের যুদ্ধ জয় করে নেপোলিয়ন ইউরোপে তাঁর দাম্পত্যকে আরও মজবুত করেছিলেন। ১৮১২ সালে গ্রীষ্মকালে তিনি রাশিয়া আক্রমণ শুরু করেছিলেন, কিন্তু ঐ বছরের শীতকালে এটি ফরাসি সেনাবাহিনীর বিপর্যয়কারী পশ্চাদপসরণে সমাপ্ত হয়েছিল। ১৮১৩ সালে ষষ্ঠ জোটের যুদ্ধে প্রুশিয়া ও অস্ট্রিয়া রাশিয়ার সাথে হাত মিলিয়েছিল, এবং লাইপজিগের যুদ্ধে নেপোলিয়ন পরাজিত হয়েছিলেন। সেই ষষ্ঠ জোট বাহিনী ফ্রান্সে আক্রমণ করেছিল এবং প্যারিস দখল করেছিল, যার ফলে ১৮১৪ সালে এপ্রিলে নেপোলিয়ন সিংহসনচ্যুত হতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই জোট বাহিনী তাঁকে ভূমধ্যসাগরের এলবা দ্বীপে নির্বাসিত করেছিল এবং বুরবোঁ রাজবংশকে পুনরায় ফ্রান্সের ক্ষমতায় এনেছিল। দশ মাস পর নেপোলিয়ন জাহাজে করে হাজার মানুষসহ এলবা দ্বীপ থেকে ফ্রান্সে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। সেই হাজার মানুষ মিলে নেপোলিয়ন প্যারিসের সিকে কুচকাওয়াজ চালিয়ে ক্ষমতা পুনরায় লাভ করেছিলেন। তাঁর বিরোধীরা সপ্তম জোট গঠন করে আর ১৮১৫ সালের ওয়াটারলুর যুদ্ধে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন। নেপোলিয়নকে দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের নির্জন সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসিত করা হয়েছিল এবং ১৮২১ সালে ৫১ বছর বয়সে পাকস্থলীর ক্যান্সারে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ইতিহাসের অন্যতম সেনাপতি হিসাবে পরিচিত এবং নেপোলিয়নীয় সমরকৌশল এখনও বিশ্বের বিভিন্ন সামরিক বিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। নেপোলিয়নীয় বিধির মাধ্যমে তিনি ফ্রান্স ও পশ্চিম ইউরোপে আইন ও প্রশাসনে আধুনিকীকরণের প্রচেষ্টা করেছিলেন। তিনি গণশিক্ষা চালু করেছিলেন,[২] সামন্ততন্ত্রের বিন্দুবিসর্গের অবসান ঘটিয়েছিলেন,[৩] ইহুদি ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মুক্তি দিয়েছিলেন,[৪] স্পেনীয় ইনকুইজিশনের অবসান ঘটিয়েছিলেন,[৫] আবির্ভূত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের জন্য আইনের আগে সাম্যের নীতি চালু করেছিলেন[৬] এবং ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের অবসান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করেছিলেন।[৭] তাঁর অভিযানসমূহ রাজনৈতিক পরিবর্তন ও জাতিরাষ্ট্রের বিকাশের অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছিল। তবে ইউরোপে বিধ্বংসী যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা, যুদ্ধে জয় করা অঞ্চলে লুটপাট এবং আংশিক নাগরিক অধিকার প্রদানের জন্য তিনি একজন বিতর্কিত চরিত্রও বটে। তিনি মুক্ত সংবাদপত্রের অবসান ঘটিয়েছিলেন, সরাসরি নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের অবসান ঘটিয়েছিলেন, তাঁর শাসনের সমালোচকদের কারাগারে বন্দি করতেন বা নির্বাসিত করতেন, হাইতি ব্যতীত অন্যান্য ফরাসি উপনিবেশে দাসপ্রথা পুনরায় চালু করেছিলেন, কৃষ্ণাঙ্গ ও মুলাটোদের ফ্রান্সে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন, ফ্রান্সে নারী ও শিশুদের নাগরিক অধিকার খর্ব করেছিলেন, বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্র পুনরায় চালু করেছিলেন[৮][৯][১০] আর তাঁর শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলনকে হিংস্রভাবে দমিয়ে রেখেছিলেন।[১১]
Remove ads
প্রাথমিক জীবন
সারাংশ
প্রসঙ্গ
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এক ইতালীয় পরিবার জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পৈতৃক বুয়নাপার্তে (পরে বোনাপার্ট) বংশ টাসকানির এক অভিজাত পরিবার থেকে আগত এবং ষোড়শ শতাব্দীতে তারা কর্সিকা দ্বীপে স্থানান্তরিত হয়েছিল। তাঁর মাতৃক রামোলিনো বংশ লম্বার্ডির এক অভিজাত পরিবার থেকে আগত।[১২]

নেপোলিয়নের পিতা কার্লো মারিয়া বুয়নাপার্তে ও মাতা মারিয়া লেতিৎসিয়া রামোলিনো কর্সিকার আয়াকচিওতে অবস্থিত মেসোঁ বনাপার্তে (Maison Bonaparte) বসবাস করতেন। ১৭৬৯ সালের ১৫ আগস্টে নেপোলিয়ন সেই বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর এক জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা জোসেফ ও ছয় কনিষ্ঠ ভাইবোন: লুসিয়েঁ, এলিজা, লুই, পোলিন, কারলিন ও জেরোম।[১৩] আরও পাঁচ ভাইবোন জন্মের সময় কিংবা শৈশবকালে মৃত।[১৪] নেপোলিয়নকে একজন ক্যাথলিক হিসাবে দীক্ষিত করা হয়েছিল এবং তখন তাঁর নাম "নাপোলেওনে দি বুয়নাপার্তে" (Napoleone di Buonaparte)। যৌবনে তাঁর নামের একাধিক বানান ব্যবহার করা হতো, যেমন: Nabulione, Nabulio, Napolionne কিংবা Napulione।[১৫]
নেপোলিয়নের জন্মের এক বছর আগে, অর্থাৎ ১৭৬৮ সালে জেনোয়া প্রজাতন্ত্র ফ্রান্সকে কর্সিকা দ্বীপ দান করেছিল।[১৬][১৭] তাঁর পিতা কার্লো পাসকুয়ালে পাওলির নেতৃত্বে কর্সিকা দ্বীপের স্বাধীনতার জন্য ফ্রান্সের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। ১৭৬৯ সালে কর্সিকার পরাজয় ও পাওলির ব্রিটেনে নির্বাসনের ফলে কার্লো ফরাসি গভর্নর শার্ল লুই দ্য মারবফের সাথে বন্ধুত্ব করেছিলেন, যিনি পরে নেপোলিয়নের পৃষ্ঠপোষক ও ধর্মপিতা হয়ে গিয়েছিলেন।[১৮][১৯] মারবফের সাহায্যের জন্য কার্লো ষোড়শ লুইয়ের দরবারে কর্সিকা দ্বীপের প্রতিনিধি হয়েছিলেন এবং নেপোলিয়ন ফ্রান্সের এক সামরিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনার জন্য রাজকীয় বৃত্তি অর্জন করেছিলেন।[২০][২১]
নেপোলিয়নের মাতা তাঁর শৈশবের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর কঠোর শিষ্টাচার নেপোলিয়নের মতো ছটফটে শিশুকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছিল।[২০] অভিজাত ও যথেষ্ট বিত্তবান পরিবারে জন্ম হওয়ায় নেপোলিয়ন ততৎকালীন কর্সিকা-বাসীদের তুলনায় শিক্ষার্জনে অধিক সুবিধা লাভ করেছিলেন।[২২]
১৭৭৯ সালের জানুয়ারিতে নয় বছর বয়সে নেপোলিয়ন ফ্রান্সের মূল ভূখণ্ডে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন। সেখানে তাঁর ফরাসি ভাষার দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ওতাঁ অঞ্চলের এক ধার্মিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়েছিল, কারণ তাঁর মাতৃভাষা ইতালীয় ভাষার কর্সিকান উপভাষা।[২৩][২৪][২৫] যদিও তিনি ক্রমে ফরাসি ভাষায় স্বচ্ছন্দ হয়ে গিয়েছিলেন, তিনি কর্সিকান বাচনভঙ্গিতে কথা বলতেন এবং তাঁর ফরাসি বানান নিম্নমানের ছিল।[২৬]

মে মাসে তাঁকে ব্রিয়েন-ল্য-শাতোতে অবস্থিত সামরিক বিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়েছিল। সেখানে তাঁর সমকক্ষরা তাঁর বাচনভঙ্গি, জন্মস্থান, কম উচ্চতা, মুদ্রাদোষ ও নিম্নমানের ফরাসির জন্য তাঁকে নিয়মিতভাবে উৎপীড়ন করা হতো।[২৩] তিনি গুরুগম্ভীর ও বিষাদগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিলেন এবং নিজেকে পড়ার জন্য মনোনিবেশ করেছিলেন। একজন পরীক্ষক তাঁর সম্পর্কে বলেছেন যে নেপোলিয়ন সর্বদাই গণিতে তাঁর বাস্তবিক প্রয়োগের জন্য সম্মানিত এবং তাঁর ইতিহাস ও ভূগোলে ভালো জ্ঞান রয়েছে।[ঘ][২৮]
স্কুলজীবনে নেপোলিয়নের এক প্রচলিত গল্প অনুযায়ী তুষারবল নিয়ে মারামারির এক খেলায় তিনি জ্যেষ্ঠ ছাত্রছাত্রীর বিরুদ্ধে কনিষ্ঠ ছাত্রছাত্রীদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং তাঁদের দল জয়ী হয়েছিল, যা নাকি তাঁর নেতৃত্বের দক্ষতার পরিচায়ক।[২৯] তবে নেপোলিয়নের খ্যাতি অর্জনের পরে এই গল্প প্রচলিত হয়েছিল।[৩০] ব্রিয়েনের বসবাসের পরবর্তী বছরে তিনি এক স্পষ্টবাদী কর্সিকান জাতীয়তাবাদী এবং পাসকুয়ালে পাওলির অনুরাগী হয়ে গিয়েছিলেন।[৩১]
১৭৮৪ সালের সেপ্টেম্বরে নেপোলিয়নকে প্যারিসের একল মিলিতেরে (École militaire) ভর্তি করা হয়েছিল এবং সেখানে তাঁকে গোলন্দাজি শেখানো হয়েছিল। তিনি গণিতে অন্যের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন এবং তিনি ইতিহাস, ভূগোল ও সাহিত্য নিয়ে গভীর পড়াশোনা করেছিলেন। তবে ফরাসি ও জার্মান ভাষায় তাঁর দক্ষতা নিম্নমানের।[৩২] ১৭৮৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে পিতৃবিয়োগের জন্য তাঁর পারিবারিক আয় কমে গিয়েছিল, যা তাঁকে দুই বছরের পড়াশুনাকে এক বছরে শেষ করতে বাধ্য করেছিল। সেপ্টেম্বরে বিখ্যাত বিজ্ঞানী পিয়ের-সিমোঁ লাপলাস তাঁর পরীক্ষা নিয়েছিলেন এবং তিনি একল মিলিতের থেকে স্নাতক প্রথম কর্সিকান।[৩৩][৩৪]
Remove ads
প্রাথমিক জীবিকা
সারাংশ
প্রসঙ্গ
কর্সিকায় প্রত্যাবর্তন

১৭৮৫ সালের সেপ্টেম্বরে স্নাতক হওয়ার পর নেপোলিয়ন বোনাপার্ট লা ফের গোলন্দাজ রেজিমেন্টের সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন।[৩৫] ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবে প্রাদুর্ভাবের আগে তিনি ভালঁস ও ওক্সনে সেনারক্ষকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। তবে তিনি কর্সিকাতে অনেকক্ষণ ধরে ছুটি কটিয়েছিলেন, যা তাঁকে কর্সিকান জাতীয়তবাদে উদ্বুদ্ধ করেছিল।[৩৬][৩৭] ১৭৮৯ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি কর্সিকাতে ফিরে এসেছিলেন এবং ফরাসি বিপ্লবী যুক্তি প্রচার করেছিলেন। ১৭৯০ সালের জুলাইতে পাসকুয়ালে পাওলি তাঁর দ্বীপে ফিরে এসেছিলেন, তবে নেপোলিয়নের প্রতি তাঁর কোনো দয়া নেই, কারণ কর্সিকান স্বাধীনতার যুক্তিকে অগ্রাহ্য করার জন্য নেপোলিয়নের পিতা তাঁর কাছে দেশদ্রোহী বলে মনে হয়েছিল।[৩৮][৩৯]
নেপোলিয়ন রাজতন্ত্রী, বিপ্লবী ও কর্সিকান জাতীয়তাবাদী—এই জটিল ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি জাকোবাঁদের সমর্থক হয়েছিলেন, এবং তিনি ফরাসিপন্থী কর্সিকান প্রজাতন্ত্রীদের সাথে মিলিত হয়েছিলেন যারা পাওলির নীতি ও তাঁর বিচ্ছিন্নতাবাদী আকাঙ্ক্ষার বিরোধী।[৪০]
১৭৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নেপোলিয়ন ফরাসিদের ব্যর্থ সার্ডিনিয়া অভিযানের সদস্য ছিলেন। তখন পাওলি এই অভিযানে অন্তর্ঘাত সৃষ্টি করেছিলেন এবং নেপোলিয়নের নেতৃত্ব দুর্নীতিগ্রস্ত ও অযোগ্য, এই অভিযোগে ফরাসি জাতীয় কনভেনশন নেপোলিয়নকে বহিষ্কার করেছিল। জুন মাসের প্রথম দিকে নেপোলিয়ন ও তাঁর ৪০০ জন সেনার বাহিনী কর্সিকান স্বেচ্ছাসেবকদের থেকে আয়াকচিও দখল করতে পারেনি, আর ঐ দ্বীপটি পাওলির সমর্থকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যখন নেপোলিয়ন বুঝতে পড়লেন যে কর্সিকান আইনসভা তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে নিন্দা করেছিল, তখন সেই বোনাপার্ট পরিবার ফ্রান্সের মূল ভূখণ্ডে অবস্থিত তুলোঁতে স্থানান্তরিত হয়েছিল।[৪১][৪২]
তুলোঁ অবরোধ

নেপোলিয়ন তাঁর নিস রেজিমেন্টে ফিরে এসেছিলেন এবং তিনি এক উপকূলীয় গোলন্দাজ বাহিনীর ক্যাপ্টেন হয়েছিলেন।[৪৩] ১৭৯৩ সালের জুলাইতে তিনি "ল্য সুপে দ্য বোকের" (Le souper de Beaucaire) বলে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন যা জাতীয় কনভেনশনের প্রতি তাঁর সমর্থনকে তুলে ধরেছে। তখন জাতীয় কনভেনশন জাকোবাঁদের দ্বারা অত্যন্ত প্রভাবিত।[৪৪][৪৫]
সেপ্টেম্বরে তাঁর কর্সিকান সহচরী অঁতোয়ান ক্রিস্তফ সালিচেতির সহযোগিতায় নেপোলিয়নকে এক প্রজাতন্ত্রী বাহিনীর গোলন্দাজ সেনাপতি হিসাবে মনোনীত করা হয়েছিল, যা ব্রিটিশ ও মিত্রবাহিনীদের দ্বারা দখল করা তুলোঁ বন্দরের পুনর্দখল করার লক্ষ্যে ছিল।[৪৬] তিনি দ্রুত উপস্থিত গোলন্দাজের সংখ্যা বৃদ্ধি করলেন এবং তিনি এক পাহাড়ি দুর্গ দখল করার পরিকল্পনা করেছিলেন, যেখানে প্রজাতন্ত্রীদের বন্দুকগুলো বন্দরে প্রাধান্য লাভ করবে এবং ব্রিটিশদের অপসারণ করতে বাধ্য করবে। ১৬-১৭ ডিসেম্বরে অবস্থানে আকস্মিক হামলার ফলে তুলোঁর পুনর্দখল সফল হয়েছিল।[৪৭]
তুলোঁতে নেপোলিয়নের সাফল্য জাকোবাঁ মাক্সিমিলিয়াঁ রবেসপিয়েরের অনুজ ওগুস্তাঁ রবেসপিয়েরের মতো ক্ষমতাশালী ব্যক্তিত্বের দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। তাঁকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের পদে উন্নীত করা হয়েছিল এবং ভূমধ্যসাগরের উপকূলে প্রতিরক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ১৭৯৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে ইতালির সেনাবাহিনীর গোলন্দাজ সেনাপতি করা হয়েছিল এবং তিনি সার্ডিনিয়া রাজ্য (পিডমন্ট) আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেছিলেন।[৪৮][৪৯]
১৭৯৪ সালের এপ্রিল মাসে সাওরজোর দ্বিতীয় যুদ্ধে ফরাসি সেনাবাহিনী নেপোলিয়নের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করেছিল এবং আল্পস পর্বতমালার ওরমেয়া দখল করেছিল। সাওরজে অস্ট্রো-সার্ডিনীয় অবস্থান থেকে পাশ কাটানোর জন্য তারা ওরমেয়া থেকে পশ্চিমদিকে গিয়েছিল। এই অভিযানের পর ওগুস্তাঁ রবেসপিয়ের ফ্রান্সের প্রতি জেনোয়া প্রজাতন্ত্রের অভিসন্ধি জানার জন্য নেপোলিয়নকে এক অভিযানে পাঠিয়েছিলেন।[৫০][৫১]
১৩ ভঁদেমিয়ের
১৭৯৪ সালের জুলাই মাসে মাক্সিমিলিয়াঁ রবেসপিয়েরের পতনের পর প্রধান জাকোবাঁদের সাথে নেপোলিয়নের সম্পর্কের জন্য তিনি নতুন শাসনতন্ত্রের দ্বারা রাজনৈতিকভাবে সন্দেহভাজন হয়ে গিয়েছিলেন। ৯ আগস্টে তিনি কারাগারে বন্দি হন কিন্তু দুই সপ্তাহ পরই তিনি ছাড়া পান।[৫২][৫৩][৫৪] অস্ট্রিয়া-ফ্রান্স যুদ্ধে তাঁকে ইতালীয় অবস্থানে আক্রমণের পরিকল্পনা রচনা করতে বলা হয়েছিল। ১৭৯৫ সালের মার্চ মাসে তিনি ব্রিটিশদের কাছ থেকে কর্সিকা ফেরত পাওয়ার অভিযানের অংশগ্রহণ করেছিলেন, তবে ব্রিটিশ নৌবাহিনী ফরাসি বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করেছিল।[৫৫]
১৭৯৫ সালের ৩ অক্টোবর রাজপক্ষীয়রা এবং বিদ্রোহের বিরোধীরা জাতীয় কনভেনশনের বিরুদ্ধে একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলে। নেপোলিয়নকে টুইলারিস(Tuileries) প্রাসাদে প্রতিষ্ঠিত কনভেনশনের রক্ষায় গঠিত বাহিনীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি জোয়েচিম মুরাট (Joachim Murat) নামক একজন তরুণ কর্মকর্তাকে নিয়ে গোলন্দাজ বাহিনীর বিভিন্ন অংশকে একত্র করেন। তিনি এই বাহিনীকে আক্রমনকারীদের বিরুদ্ধে নিয়োগ করেন। তিনি পরে একে এভাবে ব্যাখা করেন যে তিনি হুইফ অফ গ্রেপশট-এর মাধ্যমে পথ পরিষ্কার করেছেন। এই সঘর্ষ সমগ্র ফ্রান্সেই বিদ্বেষপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করে। এ অসাধারণ বিজয় তাকে অনেক খ্যাতি এনে দেয়। তিনি নতুন ডিরেক্টরির নেতা বারাসের (barras) সমর্থন পান। কিছুদিন পরেই তিনি বারাসের প্রাক্তন স্ত্রী জোসেফাইন দ্য ব্যুহ্যারানাইস (Josephine de Beauharnais) কে ১৭৯৬ সালের ৯ মার্চ বিবাহ করেন।
প্রথম ইতালি অভিযান
বিয়ের পরেই ১৭৯৬ সালের ২৭ মার্চ নেপোলিয়ন ফরাসি আর্মি অফ ইতালির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি সফলতার সাথে ইতালি আক্রমণ করেন। লোডিতে(Lodi) তিনি দি লিট্ল করপোরাল(le petit caporal) উপাধিতে ভূষিত হন। তিনি তার প্রায় সমস্ত সৈন্যকে খুব ভালোভাবে চিনতেন। তা থেকে ধারণা করা যায় সতীর্থদের সাথে তার সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের কথা। তিনি লোম্বার্ডি থেকে অস্ট্রিয়ানদের বিতাড়িত করেন এবং পাপাল প্রদেশের(Papal States) সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন। এর কারণ ছিল, পোপ পিউস ৬(Pope Pius VI) কর্তৃক লুইস ১৬ (Louis XVI) এর কর্মকাণ্ডের প্রতিরোধ, ফ্রান্স কর্তৃক দুটি ক্ষুদ্র পাপাল ভূখণ্ডের দখল। নেপোলিয়ন ইতালি আক্রমণ এবং পোপকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য ডিরেক্টরির আদেশ অগ্রাহ্য করেন। অবশ্য পরের বছরই জেনারেল বার্থিয়ের(General Berthier) ইতালি দখল করে নেন এবং ফেব্রুয়ারির বিশ তারিখ পোপকে বন্দী করেন। সেখানেই শারীরিক অসুস্থতার কারণে পোপ মৃত্যুবরণ করেন। ১৭৯৭ সালের শুরুতেই নেপোলিয়ন তার সেনাবাহিনী নিয়ে অস্ট্রিয়ায় প্রবেশ করেন এবং তার শক্তিকে শান্তির জন্য কাজে লাগান। কিছুদিনের মধ্যেই ফ্রান্স উত্তর ইতালির অধিকাংশই দখল করে নেয়। নিচুদেশসমূহ এবং রাইনল্যান্ডও ফ্রান্সের অধিকারে আসে। কিন্তু তখনো ফ্রান্স ভেনিস অধিকার করতে পারেনি। নেপোলিয়ন এরপর ভেনিসে গমন করেন এবং ভেনিস আত্নসমর্পন করতে বাধ্য হয়। এভাবে এক সহস্র বছরের স্বাধীন ভেনিসের পতন হয়। পরবর্তীতে ১৭৯৭ সালেই নেপোলিয়ন ইতালির ফ্রান্স শাসিত রাজ্যসমূহ নিয়ে সিজালপাইন রিপাবলিক (Cisalpine Republic) গড়ে তুলেন।
নেপোলিয়নের সামরিক তৎপরতাসমূহ তার বাস্তবক্ষেত্রে সামরিক শক্তি প্রয়োগের অসীম জ্ঞানেরই প্রতিফলন ঘটায়। নেপোলিয়নের ভাষায়ঃ
“ | আমি ষাটটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি, কিন্তু আমি এমন কিছু শিখিনি যা আমি শুরুতে জানতাম না। | ” |
মিশর অভিযান

দুই মাসের পরিকল্পনার পর নেপোলিয়ন বুঝতে পেরেছিলেন যে ব্রিটিশ নৌবাহিনী রয়্যাল নেভির মুখোমুখি হওয়ার মতো তেমন ক্ষমতা ফরাসি নৌবাহিনীর নেই। তাই তিনি মিশর দখল করে ব্রিটিশদের সাথে ভারতের বাণিজ্যিক যোগাযোগকে দুর্বল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।[৩৫] নেপোলিয়ন মধ্যপ্রাচ্যে ফরাসি উপস্থিতি এবং ব্রিটিশদের শত্রু মহীশূরের শাসক টিপু সুলতানের সামরিক সাহায্য করতে চেয়েছিলেন।[৫৬] নেপোলিয়ন ডিরেক্টরিকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে মিশর জয় করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ভারতের দেশীয় রাজাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করবেন এবং তাঁরা একসাথে ইংরেজদের উপর আক্রমণ করবে।[৫৭] ভারতের সাথে বাণিজ্যপথ স্থাপনের স্বার্থে ডিরেক্টরি এতে রাজি হয়েছিল।[৫৮]
১৭৯৮ সালের মে মাসে নেপোলিয়নকে ফরাসি বিজ্ঞান একাডেমির সদস্য হিসাবে নির্বাচিত করা হয়েছিল। তাঁর মিশর অভিযানে ১৬৭ জন বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, প্রকৃতিবিদ, রসায়নবিদ ও ভূগণিতবিদ ছিল। তাদের আবিষ্কারের মধ্যে রসেত্তা পাথর অন্তর্গত, এবং ১৮০৯ সালে তাদের গবেষণা প্রকাশিত হয়েছিল।[৫৯]
নেপোলিয়ন ও তাঁর অভিযান রয়্যাল নেভির পশ্চাদ্ভাবনকে সুকৌশলে এড়িয়ে চললেন এবং ১ জুলাইতে আলেকজান্দ্রিয়াতে অবতরণ করেছিলেন।[৩৫] তিনি মিশরের মামলুকদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। এর ফলে ২১ জুলাইয়ের পিরামিডের যুদ্ধে জন্য ফরাসি বাহিনী তাদের প্রতিরক্ষার কৌশলের অনুশীলন করতে সাহায্য করেছিল, যা পিরামিড চত্বর থেকে প্রায় ২৪ কিমি দূরে সংঘটিত হয়েছিল। নেপোলিয়নের ২৫,০০০ জনের বাহিনী মামলুকদের অশ্বারোহী বাহিনীর প্রায় সমান। ২৯ জন ফরাসি[৬০] ও প্রায় ২,০০০ জন মিশরীয় এই যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। এই যুদ্ধের জয় ফরাসি সেনাবাহিনীর মনোবল দৃঢ় করেছিল।[৬১]
১৭৯৮ সালের ১ আগস্টে নীল নদের যুদ্ধে স্যার হোরেশিও নেলসনের নেতৃত্বে ব্রিটিশ নৌবহর ফরাসি নৌবহরের দুটি বাদে সমস্ত জলযানকে ধ্বংস বা হস্তগত হয়েছিল, যার ফলে নেপোলিয়ন ভূমধ্যসাগরে ফরাসি আধিপত্যকে দৃঢ় করতে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।[৬২] তাঁর সেনাবাহিনী মিশরে ফরাসি ক্ষমতার সাময়িক বৃদ্ধিতে সফল হয়েছিলেন, যদিও এটি বারবার বিদ্রোহের সম্মুখীন হয়েছিল।[৬৩] ১৭৯৯ সালের প্রথমদিকে তিনি ১৩,০০০ জন সৈন্যের বাহিনীসহ উসমানীয় ভিলায়েত দামেস্কে (সিরিয়া ও গ্যালিলি) গমন করেছিলেন। তিনি তাঁর বাহিনীসহ উপকূলীয় শহর আরিশ, গাজা, জাফা ও হাইফাতে আক্রমণ করেছিলেন।[৬৪] বিশেষত জাফা শহরে আক্রমণ নিষ্ঠুর। নেপোলিয়ন সেখানে লক্ষ করেছিলেন যে সেখানে রক্ষকদের অনেকেই প্রাক্তন যুদ্ধবন্দি, এবং আপাতভাবে পালাবে না এই শর্তে তারা মুক্তিপ্রাপ্ত। সেইজন্য তিনি রক্ষীসেনা ও প্রায় ১,৫০০-৫,০০০ জন বন্দিদের সঙ্গিন দিয়ে বিদ্ধ করে বা ডুবে মারার আদেশ দিয়েছিলেন।[৬২][৬৫][৬৬] পুরুষ, নারী ও শিশুদের তিন দিনের মধ্যে লুটপাট করে হত্যা করা হয়েছিল।[৬৭]
নেপোলিয়ন ১৩,০০০ জন পুরুষদের বাহিনী নিয়ে শুরু করেছিলেন, যার মধ্যে ১,৫০০ জন নিখোঁজ হয়েছিল, ১,২০০ জন যুদ্ধে মারা গিয়েছিল এবং হাজার হাজার জন মূলত বিউবনিক প্লেগ রোগে মারা গিয়েছিল। তিনি একে শহরের দুর্গকে কব্জায় আনতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, সুতরাং মে মাসে বাহিনীসহ মিশরে ফিরে গিয়েছিলেন। দ্রুত পশ্চাদপসরণের জন্য নেপোলিয়ন প্লেগে আক্রান্ত পুরুষদের আফিমের মাধ্যমে বিষপ্রয়োগের আদেশ দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়।[৬৮] ২৫ জুলাইতে মিশরে ফেরার পর নেপোলিয়ন আবুকিরে উসমানীয়দের উভচর আক্রমণকে পরাজিত করেছিলেন।[৬৯]
নেপোলিয়ন ইউরোপীয় ঘটনাবলী নিয়ে অবহিত ছিলেন। তিনি জানতে পারেন যে দ্বিতীয় জোটের যুদ্ধে ফ্রান্স একের পর এক পরাজয়ের শিকার হয়েছিল।[৭০] ১৭৯৯ সালের ২৪ আগস্টে ফরাসি প্রজাতন্ত্রের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভয়ের সময় তিনি ফ্রান্সের উপকূলীয় বন্দর থেকে ব্রিটিশ জাহাজের সাময়িক প্রস্থানের সুবিধা নিয়ে ফ্রান্সে পাড়ি দিয়েছিলেন, যদিও প্যারিসের তরফ থেকে তিনি কোনো সুনিশ্চিত আদেশ পাননি।[৬২] তাঁর সেনাবাহিনীকে জঁ-বাপতিস্ত ক্লেবের দায়িত্বে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।[৭১]
Remove ads
ফ্রান্সের শাসক
সারাংশ
প্রসঙ্গ
১৮ ব্রুমের
ফ্রান্সে এক সম্ভাব্য আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য ডিরেক্টরি নেপোলিয়নকে সেনাবাহিনী-সহ মিশর থেকে ফিরে আসার আদেশ পাঠিয়েছিল, কিন্তু সেই আদেশ তাঁর কাছে পৌঁছায়নি।[৭০] অক্টোবরে প্যারিসে ফিরে আসার সময় ধারাবাহিক জয়ের মাধ্যমে ফ্রান্সের অবস্থা উন্নত হয়েছিল। কিন্তু ফরাসি প্রজাতন্ত্র দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল এবং ব্যর্থ ডিরেক্টরির জনপ্রিয়তা কমে গিয়েছিল।[৭২] মিশরে ব্যর্থতার সত্ত্বেও নেপোলিয়নকে এক নায়কের মতো করে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল। ডিরেক্টরি নেপোলিয়নের সেনাত্যাগের বিষয়ে আলোচনা করেছিল কিন্তু অতি দুর্বলতার জন্য তাঁকে শাস্তি দিতে পারেনি।[৭০]
বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য নেপোলিয়ন তালিরঁ এবং পাঁচ হাজারের পরিষদ ও ডিরেক্টরির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠাতা-সদস্যদের সাথে এক জোট গঠন করেছিল, যেমন: লুসিয়াঁ বোনাপার্ট, এমানুয়েল জোসেফ সিয়েইয়েস, রজে দুকো এবং জোসেফ ফুশে। ১৭৯৯ সালের ৯ নভেম্বরে (বা ফরাসি প্রজাতান্ত্রিক পঞ্জিকা অনুযায়ী ১৮ ব্রুমের) ষড়যন্ত্রকারীরা এক অভ্যুত্থানের সূচনা করেছিল। পরের দিনে পাঁচ হাজারের পরিষদকে ঐ ডিরেক্টরির অবসান ঘটাতে বাধ্য করে নেপোলিয়ন, এমানুয়েল ও রজেকে অন্তর্বর্তীকালীন কনসাল হিসাবে মনোনীত করেছিল।[৭৩][৭৪]
কনসুলেট

১৫ ডিসেম্বরে নেপোলিয়ন একটি সংবিধান চালু করেছিলেন যার অধীনে ১০ বছরের জন্য তিনজন কনসালকে মনোনীত করা হতো। প্রকৃত ক্ষমতা প্রথম কনসাল নেপোলিয়নের হাতে ছিল, আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় কনসাল হিসাবে যথাক্রমে জঁ-জাক-রেজি দ্য কঁবাসেরে ও শার্ল-ফ্রঁসোয়া ল্যব্রাঁকে মনোনীত করা হয়েছিল যাঁদের ক্ষমতা মূলক পরামর্শ-বিষয়ক। ঐ সংবিধান কর লেজিসলাতিফ (Corps législatif) ও ত্রিবুনার (Tribunat) প্রতিষ্ঠা করেছিল যাদের সদস্যরা পরোক্ষভাবে নির্বাচিত। এছাড়া এটি সেনা কঁজেরভাতর (Sénat conservateur) ও কঁসেই দেতাতের (Conseil d'État) প্রতিষ্ঠা করেছিল যাদের সদস্যরা কার্যত নির্বাহী দ্বারা মনোনীত।[৭৫]
১৮০০ সালের ১ ফেব্রুয়ারিতে গণভোটের মাধ্যমে এই নতুন সংবিধান অনুমোদিত হয়েছিল। সরকারি গণনা অনুযায়ী গণভোটে ৩০ লাখের অধিক পক্ষে এবং ১,৫৬২ জন বিপক্ষে ছিল। তবে যোগ্য ভোটদাতাদের বেশিরভাগই এই সংবিধানে সম্মতি দিয়েছে এই মিথ্যা ধারণা সৃষ্টির জন্য লুসিয়াঁ এই পক্ষ ভোটের সংখ্যা দ্বিগুণ করেছিলেন।[৭৬][৭৭]
কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার জন্য স্থানীয় ও আঞ্চলিক প্রশাসনে পরিবর্তন আনা হয়েছিল।[৭৮] বিবাচন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল এবং ভিন্নমতের প্রকাশ দমন করার জন্য বেশিরভাগ বিরোধী সংবাদপত্র বন্ধ করা হয়েছিল।[৭৯] রাজতন্ত্রী ও আঞ্চলিক বিদ্রোহদের সামলানোর জন্য দুইরকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল; অস্ত্র প্রত্যাহার করলে তাদের ক্ষেত্রে সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হতো, আর প্রতিরোধ চালিয়ে গেলে তাদের নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হতো।[৮০][৮১][৮২] এছাড়া রাষ্ট্রীয় অর্থসংস্থান উন্নয়নের জন্য নেপোলিয়ন ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষার প্রতিশ্রুতিতে ঋণ জোগাড় করেছিলেন, তামাক, মদ্য ও লবণের উপর কর বৃদ্ধি করেছিলেন এবং ফ্রান্সের তাঁবেদার প্রজাতন্ত্রদের কাছ থেকে কর বা সৈন্য সংগ্রহ করেছিলেন।[৮৩]
নেপোলিয়ন বিশ্বাস করতেন যে তাঁর শাসনব্যবস্থা নিরাপদ রাখার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে বিজয়ী শান্তি।[৮৪] ১৮০০ সালের মে মাসে অস্ট্রিয়ান বাহিনীদের অবাক করার উদ্দেশ্যে নেপোলিয়ন তাঁর সেনাবাহিনী-সহ সুইস আল্পস হয়ে ইতালিতে গমন করেছিলেন। নেপোলিয়নের মিশরে থাকাকালীন অস্ট্রিয়ানরা ইতালি পুনর্দখল করেছিল। আল্পস পর্বতমালার দুঃসাধ্য অতিক্রমের পর ২ জুন ফরাসিরা মিলান দখল করেছিল।[৮৫][৮৬]
১৪ জুনে মারেঙ্গোর যুদ্ধে ফরাসি বাহিনী মিখায়েল ফন মেলাসের অধীনে অস্ট্রিয়ান বাহিনীর সম্মুখীন হয়েছিল।[৮৫][৮৬] অস্ট্রিয়ানরা ৩০,০০০ সৈন্যদের রণক্ষেত্রে নামিয়েছিল, যেখানে নেপোলিয়ন ২৪,০০০ সৈন্যদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।[৮৭] অস্ট্রিয়ানদের প্রাথমিক আক্রমণ ফরাসিদের অবাক করা দিয়েছিল।[৮৮] তবে দুপুরের শেষের দিকে লুই দেজের অধীনে এক পুরো সেনা ডিভিশন রণক্ষেত্রে পৌঁছল এবং যুদ্ধের গতিবিধিকে উল্টে দিল। ১৪,০০০ জন সৈন্যের প্রাণহানির পর অস্ট্রিয়ান বাহিনী পালিয়ে গিয়েছিল।[৮৯] পরের দিন অস্ট্রিয়ানরা এক যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে স্বাক্ষর করল এবং উত্তর ইতালি ত্যাগ করতে রাজি হয়েছিল।[৮৯]
ইউরোপে সাময়িক শান্তি

এক দশক ধরে যুদ্ধের পর ১৮০২ সালের মার্চে ফ্রান্স ও ব্রিটেন আমিয়াঁ চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল, যা ফরাসি বিপ্লবী যুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছিল। এই চুক্তির অধীনে ব্রিটেন ফ্রান্স ও তার মিত্র দেশ থেকে সম্প্রতি লাভ করা বেশিরভাগ উপনিবেশগুলোকে প্রত্যাহার করতে রাজি হয়েছিল, আর ফ্রান্স নেপলস থেকে সৈন্য অপসারণ করতে রাজি হয়েছিল। এপ্রিলে নেপোলিয়ন ইউরোপের শান্তি ও পোপ সপ্তম পিয়াসের সাথে বিতর্কিত ১৮০১-এর কোঁকরদাকে জনসমক্ষে পালন করেছিলেন। ঐ বিতর্কিত কোঁকরদার অধীনে পোপ নেপোলিয়নের শাসনকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং ঐ শাসন ক্যাথলিক ধর্মকে ফ্রান্সের সংখ্যাগুরু ধর্ম হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। জাতীয় মীমাংসার আরেক ধাপ হিসাবে ফ্রান্সে ফিরতে ইচ্ছুক এমন এমিগ্রেদের উদ্দেশ্যে নেপোলিয়ন সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করেছিলেন।[৯০][৯১]
ইউরোপে যখন শান্তি বিরাজ করছিল এবং এর অর্থনীতি যখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছিল তখন নেপোলিয়ন দেশ-বিদেশে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিলেন।[৯২] ১৮০২ সালের মে মাসে কঁসেই দেতাত এক নতুন গণভোটের সুপারিশ দিয়েছিল যেখানে "নেপোলিয়ন বোনাপার্ট"-কে "যাবজ্জীবনের কনসাল" হওয়ার জন্য ফরাসি জনগণকে জিজ্ঞাসা করা হবে।[৯৩] ঐ গণভোটে প্রায় ৩৬ লাখ পক্ষে এবং ৮,৩৭৪ জন বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল। ৪০-৬০% যোগ্য ফরাসিরা এতে ভোট দান করেছিল, যা ফরাসি বিপ্লবের পর গণভোটে সর্বোচ্চ ভোটদানের হার।[৯৪][৯৫]
আমিয়াঁ চুক্তির মাধ্যমে ফ্রান্স তার সমুদ্রপার উপনিবেশগুলো পুনরায় লাভ করেছিল কিন্তু সবগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করেনি। ১৭৯৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় কনভেনশন দাসপ্রথা অবসানের জন্য ভোট করেছিল, কিন্তু ১৮০২ সালের মে মাসে সাঁ-দমিঙ্গ ও গুয়াদেলুপ বাদে সমস্ত উপনিবেশে নেপোলিয়ন পুনরায় দাসপ্রথা চালু করেছিলেন। সাঁ-দমিঙ্গ ও গুয়াদেলুপ তখন বিদ্রোহীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় সেখানে দাসপ্রথা পুনরায় চালু করা হয়নি। অঁতোয়ান রিশপঁস পরে গুয়াদেলুপের ক্ষমতা পুনরায় লাভ করেছিলেন এবং ১৬ জুলাইতে সেখানে দাসপ্রথা পুনরায় চালু করেছিলেন।[৯৬]
ফরাসি উপনিবেশগুলির মধ্যে সাঁ-দমিঙ্গ সবচেয়ে লাভবান ছিল, কারণ এটি চিনি, কফি ও নীলের প্রধান উৎস ছিল, কিন্তু এটি তখন প্রাক্তন ভৃত্য তুসাঁ লুভেরতুরের অধীনে ছিল।[৯৭] ঐ উপনিবেশ পুনরায় ফরাসি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য নেপোলিয়ন তাঁর শ্যালক জেনারেল ল্যক্লের্ককে সেখানে পাঠিয়েছিলেন। ১৮০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ২৯,০০০ সৈন্যের বাহিনী নিয়ে জেনারেল ল্যক্লের্ক সেখানে অবতরণ করেছিলেন। যদিও জুলাইতে তুসাঁকে গ্রেপ্তার করে ফ্রান্সে আনা হয়েছিল, উচ্চহারে রোগাক্রান্তি ও বিদ্রোহী সেনাপতি জঁ-জাক দেসালিনের কাছে বারবার পরাজয়ের ফলে জেনারেল ল্যক্লের্কের অভিযান শেষমেসে ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল। ১৮০৩ সালের মে মাসে নেপোলিয়ন এই পরাজয় স্বীকার করেছিলেন এবং অবশিষ্ট ৮,০০০ জন ফরাসি সৈন্যরা এই উপনিবেশ ট্যাগ করেছিলেন। ১৮০৪ সালে প্রাক্তন ভৃত্যরা এই উপনিবেশকে স্বাধীন হাইতি প্রজাতন্ত্র হিসাবে ঘোষণা করেছিল।[৯৮][৯৯]
১৮০৩ সালে যখন ব্রিটেনের সাথে যুদ্ধ ক্রমশ ফুটে উঠছিল, তখন নেপোলিয়ন বুঝতে পেরেছিলেন যে উত্তর আমেরিকার লুইজিয়ানা উপনিবেশকে রক্ষা করা দুঃসাধ্য।[১০০] তাই অর্থের প্রয়োজনে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ২১,৪৪,৪৮০ বর্গকিলোমিটার (৮,২৭,৯৮৭ বর্গমাইল) আয়তনের এই উপনিবেশকে $১৫ মিলিয়নে বিক্রয় করতে রাজি হয়েছিলেন, যা মার্কিন দৃষ্টিকোণ থেকে লুইজিয়ানা ক্রয় নামে পরিচিত। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের আয়তন দ্বিগুণ হয়েছিল।[১০১][১০২][১০৩]
ফরাসি সাম্রাজ্য
রাজ্যাভিষেক
১৮০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের পুলিশ নেপোলিয়নের অপহরণ বা গুপ্তহত্যার এক রাজতন্ত্রী ষড়যন্ত্র সম্পর্কিত ধারাবাহিক গ্রেপ্তারকাজ করেছিল। ব্রিটিশ সরকার, মরো ও নাম-না-জানা এক বুরবোঁ রাজকুমার এই ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল। বিদেশমন্ত্রী তালিরঁর মন্ত্রণায় নেপোলিয়ন অঁগিয়াঁর ডিউকের অপহরণের আদেশ দিয়েছিলেন, যা বাডেনের সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ণ করেছিল। এক গোপন সামরিক বিচারে ডিউককে দ্রুত প্রাণবধ করা হয়েছিল, যদিও এই ষড়যন্ত্রে তাঁর ভূমিকার কোনো প্রমাণ ছিল না। ডিউকের অপহরণ ও প্রাণবধ ইউরোপজুড়ে রাজতন্ত্রী ও রাজশাসকদের ক্রোধোন্মত্ত করেছিল এবং রাশিয়া এর প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবাদ করেছিল।[১০৪][১০৫][১০৬]
এই রাজতন্ত্রী ষড়যন্ত্রের পর নেপোলিয়নের সমর্থকরা তাঁকে বুঝিয়েছিলেন যে শাসনব্যবস্থাকে বংশানুক্রমিক করলে মৃত্যুর পরেও তাঁর শাসনব্যবস্থাকে নিরাপদে রাখতে সাহায্য করবে, শাসনব্যবস্থাটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্রীদের কাছে আরও গ্রহণীয় হয়ে উঠবে আর একে অন্যান্য ইউরোপীয় রাজতন্ত্রের সমকক্ষে আনবে।[১০৭][১০৮][১০৯] ১৮ মে-তে সেনা কঁজেরভাতর নেপোলিয়নকে "ফরাসি সম্রাট" বলে ঘোষণা করেছিল এবং নতুন সংবিধানকে গ্রহণ করেছিল। পরের দিন নেপোলিয়ন তাঁর সাম্রাজ্যের জেনারেল মার্শালের মধ্যে ১৮ জনকে মনোনীত করেছিলেন।[১১০]
জুনে এক গণভোটের মাধ্যমে এই বংশানুক্রমিক সাম্রাজ্য অনুমোদিত হয়েছিল। সরকারি গণনা অনুযায়ী গণভোটে ৩৫ লাখের অধিক পক্ষে এবং ২,৫৬৯ জন বিপক্ষে ছিল। তবে এখানে পক্ষে ভোটের সংখ্যা ইচ্ছা করে ৩,০০,০০০-৫,০০,০০০ করে বাড়ানো হয়েছিল। এতে ভোটদানের হার ৩৫%, যা আগের গণভোটের তুলনায় কম।[১১১][১১২] ব্রিটেন, রাশিয়া, সুইডেন ও উসমানীয় সাম্রাজ্য নেপোলিয়নের নতুন উপাধিকে স্বীকৃতি দিতে নারাজ ছিল। অন্যদিকে, প্রথম ফ্রান্সিসকে নেপোলিয়ন অস্ট্রিয়া সম্রাট হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন তার বিপরীতে অস্ট্রিয়া নেপোলিয়নকে ফরাসি সম্রাট হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল।[১১৩]
১৮০৪ সালের ২ ডিসেম্বরে নোত্র্ দাম দ্য পারিতে নেপোলিয়নের রাজ্যাভিষেক সম্পন্ন হয়েছিল, এবং পোপ সপ্তম পিয়াস এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পোপ তাঁর দেহে তেল লেপন করেছিলেন, আর তার পর নেপোলিয়ন নিজেই নিজের মাথায় শার্লমেইনের মুকুটের একটি প্রতিরূপ পড়েছিলেন। তারপর তিনি জোসেফিনকে মুকুট পরিয়েছিলেন, যিনি ফরাসি ইতিহাসে দ্বিতীয় নারী যাঁর মাথায় মুকুট পড়ানো হয়েছিল ও দেহে তেল লেপন করা হয়েছিল। তারপর তিনি ফরাসি প্রজাতন্ত্রের এলাকার প্রতিরক্ষা; কোঁকর্দাকে সম্মান; ধর্মস্বাধীনতা; রাজনৈতিক ও নাগরিক স্বাধীনতা; রাষ্ট্রায়ত্ত জমি বিক্রয়; আইন ব্যতীত করবৃদ্ধি না করা; লেজিওঁ দনর অক্ষুণ্ণ রাখা; এবং ফরাসি জাতির স্বার্থ, কল্যাণ ও গৌরবের কথা মাথায় রেখে শাসন করার শপথ নিয়েছিলেন।[১১৪]
২৬ মে-তে মিলান ক্যাথিড্রালে নেপোলিয়ন নিজেকে ইতালির রাজা হিসাবে অভিষিক্ত করেছিলেন। ইতালিতে নিজস্ব স্বার্থের জন্য অস্ট্রিয়া এই রাজ্যাভিষেককে উস্কানিমূলক বলে মনে করেছিল। নেপোলিয়ন যখন জেনোয়া ও লিগুরিয়াকে তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, তখন অস্ট্রিয়া একে লুনেভিল চুক্তি অমান্য বলে এর প্রতিবাদ করেছিল।[১১৫]
তৃতীয় জোটের যুদ্ধ
১৮০৫ সালের সেপ্টেম্বরে সুইডেন, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, নেপলস ও উসমানীয় সাম্রাজ্য ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ব্রিটেনের সাথে একটি জোট গঠন করেছিল।[১১৬][১১৭]
১৮০৩ ও ১৮০৪ সালে ব্রিটেন আক্রমণের জন্য নেপোলিয়ন বুলোনিয়-সুর-মের চারিদিকে সৈন্য সমবেত করেছিলেন। ৯ তারা ব্রিটেন আক্রমণ করেনি কিন্তু ১৮০৫ সালের আগস্টে তারা নেপোলিয়নের গ্রঁদ আর্মের (Grande Armée) কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।[১১৮][১১৯] প্রথমদিকে ফরাসি সেনাবাহিনীতে প্রায় বিভিন্ন কর্পসে বিন্যস্ত ২,০০,০০০ সৈন্য, গোলন্দাজ ও অশ্বারোহী রিজার্ভ এবং অভিজাত গার্দ আঁপেরিয়াল ছিল।[১২০][১১৯] ১৮০৫ সালের আগস্টে এই গ্রঁদ আর্মের সৈন্যসংখ্যা ৩,৫০,০০০-এ বেড়েছিল[১২১] এবং এই সৈন্যরা সুসজ্জিত, সুপ্রশিক্ষিত আর দক্ষ আধিকারিকদের নেতৃত্বের অধীনে।[১২২]
এই ব্রিটেন আক্রমণকে সহজতর করার জন্য নেপোলিয়ন ব্রিটিশ ওয়েস্ট ইন্ডিজে গতি পরিবর্তনের আক্রমণের মাধ্যমে ব্রিটিশ নৌবাহিনী রয়্যাল নেভিকে প্রলুব্ধ করার পরিকল্পনা করেছিলেন।[১২৩] কিন্তু ১৮০৫ সালের জুলাইতে সংঘটিত ফিনিসতেরে অন্তরীপের যুদ্ধে ব্রিটিশদের জয়ের পর এই পরিকল্পনা প্রকাশ্যে এসেছিল। তখন ইংলিশ চ্যানেলে আক্রমণের জন্য ফরাসি অ্যাডমিরাল ভিলনভ ব্রেস্টে ফরাসি নৌবাহিনীর সাথে সংযোগ না রেখে কাদিসে পশ্চাদপসরণ করেছিলেন।[১২৪]
ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের তাঁর শত্রুদের সম্ভাব্য আক্রমণের সম্মুখীন হয়ে নেপোলিয়ন ইংল্যান্ড আক্রমণ ছেড়ে দিয়েছিলেন এবং অস্ট্রিয়ার মিত্র রাশিয়া বাহিনী নিয়ে আসার আগেই দক্ষিণ জার্মানিতে বিচ্ছিন্ন অস্ট্রিয়ান বাহিনীদের নির্মূল করার লক্ষে ছিলেন। ২৫ সেপ্টেম্বরে ২,০০,০০০ ফরাসি সৈন্যরা ২৬০ কিমির তটে রাইন নদী পার করতে শুরু করেছিল।[১২৫][১২৬]
অস্ট্রিয়ান সেনাপতি কার্ল মাক ফন লাইবারিখ বেশিরভাগ অস্ট্রিয়ান সৈন্যদের উলমের দুর্গে সমবেত করেছিলেন। কিন্তু নেপোলিয়নের বাহিনী দ্রুত অগ্রসর হয়ে অস্ট্রিয়ান বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে গিয়েছিল। কিছু গৌণ লড়াই উলমের যুদ্ধে শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছিল এবং মাক আত্মসমর্পণ করেছিলেন। এতে ২,০০০ জন ফরাসি সৈন্য নিহত হলেও তাঁর বাহিনীর দ্রুত পদক্ষেপের মাধ্যমে নেপোলিয়ন ৬০,০০০ অস্ট্রিয়ান সৈন্যদের কব্জায় এনেছিলেন।[১২৭]
তবে ২১ অক্টোবরে ট্রাফালগারের যুদ্ধে রয়্যাল নেভির চূড়ান্ত জয় ফরাসিদের এই সমারোহপূর্ণ জয়কে মাটি করে দিয়েছিল। ট্রাফালগারের পর নেপোলিয়নের নৌবহর রয়্যাল নেভিকে কখনোই দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করেনি।[১২৮]
নভেম্বরে ফরাসি বাহিনী ভিয়েনা দখল করেছিল। সেখানে ডানিউব নদী বরাবর ১,০০,০০০ তবক, ৫০০টি কামান ও অক্ষত সেতুসমূহ উদ্ধার করা হয়েছিল।[১২৯] নেপোলিয়ন তখন মিত্রপক্ষের উদ্দেশ্যে তাঁর বাহিনীকে উত্তরের দিকে পাঠিয়েছিলেন। অস্ট্রিয়ান সম্রাট প্রথম ফ্রান্সিস ও রুশ সম্রাট জার প্রথম আলেকজান্ডার নেপোলিয়নের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যদিও কিছু মিত্ররা এর আপত্তি করেছিল।[১৩০]
২ ডিসেম্বরে আউস্টারলিৎসের যুদ্ধে নেপোলিয়ন প্রাৎসেন উচ্চস্থানের তলদেশে তাঁর বাহিনী বিকীর্ণ করা হয়েছিল। মিত্রপক্ষকে ঐ উচ্চস্থান থেকে নেমে আসতে প্ররোচিত করার জন্য তিনি তাঁর ডানপক্ষের সৈন্যদের পশ্চাদপসরণের ভান করার আদেশ দিয়েছিলেন। তখন মধ্য ও বামপক্ষের ফরাসি সৈন্যরা ঐ উচ্চস্থান দখল করেছিল এবং দুদিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণ করে মিত্রপক্ষের সৈন্যদের কব্জায় এনেছিল। এই ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য হাজার হাজার রুশ সৈন্য এক তুষারাবৃত হ্রদের উপর দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল এবং তাদের মধ্যে ১০০ থেকে ২,০০০ জন সৈন্য ডুবে মারা গিয়েছিল।[১৩০][১৩১] মিত্রবাহিনীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশদের হত্যা করা হয়েছিল, কব্জায় আনা হয়েছিল কিংবা আহত করা হয়েছিল।[১৩২]
আউস্টারলিৎসের এই বিপর্যয়ের ফলে অস্ট্রিয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তির চেষ্টা করেছিল। ২৬ ডিসেম্বরে স্বাক্ষরিত প্রেসবুর্গ চুক্তিতে অস্ট্রিয়া এই তৃতীয় জোট ত্যাগ করেছিল, তার এলাকার এক বড় অংশ ইতালি রাজ্য ও বাভরিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং ৪০ মিলিয়ন ফ্রাঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। রাশিয়ায় ফিরে যাওয়ার জন্য আলেকজান্ডারের বাহিনীকে নিরাপদ পথ দেওয়া হয়েছিল।[১৩৩][১৩৪]
নেপোলিয়ন নিজের মতে আউস্টারলিৎসের এই যুদ্ধ তাঁর লড়াই করা সমস্ত যুদ্ধের মধ্যে সেরা।[১৩৩] ফ্রাঙ্ক ম্যাকলিনের মতে নেপোলিয়ন এই যুদ্ধে এতখানি সফল ছিলেন যে তিনি বাস্তবের সাথে সংযোগ ছিন্ন করেছিলেন, আর যা আগে ফরাসিদের বিদেশনীতি ছিল তা ক্রমে ব্যক্তিগত নেপোলিয়নীয় বিদেশনীতি হয়ে গিয়েছিল।[১৩৫] ভিনসেন্ট ক্রোনিন এই মতে রাজি হননি। তাঁর মতে নেপোলিয়ন অতিমাত্রায় উচ্চাকাঙ্ক্ষী নন, বরং তিনি ৩ কোটি ফরাসিদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।[১৩৬]
মধ্যপ্রাচ্যের জোটসমূহ
ব্রিটেন ও রাশিয়াকে চাপে ফেলার উদ্দেশ্যে নেপোলিয়ন মধ্যপ্রাচ্যে ফরাসি উপস্থিতি স্থাপনের মহাপরিকল্পনা চালিয়ে গিয়েছিলেন, যার মধ্যে উসমানীয় সাম্রাজ্যের সাথে জোট গঠনও থাকতে পারে।[৫৬] ১৮০৬ সালে ফেব্রুয়ারিতে উসমানীয় সম্রাট তৃতীয় সেলিম নেপোলিয়নকে "সম্রাট"-এর স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তিনি ফ্রান্সের সাথে জোট গঠনের মনস্থির করেছিলেন, আর তিনি ফ্রান্সকে উসমানীয়দের প্রাকৃতিক ও আন্তরিক মিত্র বলে অভিহিত করেছিলেন।[১৩৭] তবে এই সিদ্ধান্তের ফলে উসমানীয় সাম্রাজ্য রাশিয়া ও ব্রিটেনের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল। নেপোলিয়ন ও পারস্যের মধ্যেও একটি জোট গঠন হয়েছিল। ১৮০৭ সালে ফ্রান্স ও রাশিয়ার মধ্যে অপ্রত্যাশিত জোটের ফলে পারস্যের সাথে জোট ছিন্ন হয়েছিল।[৫৬] অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যে নেপোলিয়ন কোনো কার্যকরী জোট গঠন করতে পারেননি।[১৩৮]
চতুর্থ জোটের যুদ্ধ ও টিলজিট
আউস্টারলিৎসের পর নেপোলিয়ন ইউরোপে তাঁর রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছিল। ১৮০৬ সালে তিনি নেপলসের বুরবোঁ রাজাকে সিংহসনচ্যুত করে তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা জোসেফকে সিংহাসনে বসিয়েছিলেন। তিনি তখন তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা লুইকে হল্যান্ডের রাজা করেছিলেন।[১৩৯] ফ্রান্স ও মধ্য ইউরোপের মধ্যে একটি প্রাবর-রাষ্ট্র বা বাফার স্টেটের জন্য একাধিক ক্ষুদ্র জার্মান রাষ্ট্রদের একত্রিত করে তিনি রাইন মিত্রসংঘ গঠন করেছিলেন। এই মিত্রসংঘ গঠনের ফলে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের অবসান ঘটেছিল।[১৪০]
জার্মানিতে নেপোলিয়নের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মহা শক্তি হিসাবে প্রুশিয়ার অবস্থাকে হুমকি দিয়েছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় তৃতীয় ফ্রেডরিক উইলিয়াম ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রুশিয়া ও রাশিয়া এক নতুন সামরিক জোট গঠন করেছিল। তবে দক্ষিণ জার্মানিতে ফরাসি বাহিনী থাকাকালীন এবং রণক্ষেত্রে রুশ বাহিনী আসার কয়েকমাস আগেই প্রুশিয়া যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল, যা তার কৌশলগত ভ্রান্তি ছিল।[১৪১]
১,৮০,০০০ সৈন্যদের নিয়ে নেপোলিয়ন প্রুশিয়া আক্রমণ করেছিলেন আর জালা নদীর ডান তীরে দ্রুত কুচকাওয়াজ করেছিলেন। প্রুশিয়ান বাহিনীর অবস্থান জানতে পেরে ফরাসি বাহিনী পশ্চিমদিকে ঘুরে গিয়েছিল, যার ফলে প্রুশিয়ান বাহিনী বার্লিন ও ধীরগতিতে আগত রুশ বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ১৪ অক্টোবর ইয়েনা ও আউয়ারস্টেটের দ্বৈত যুদ্ধে ফরাসি বাহিনী বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রুশিয়ান বাহিনীকে পরাজিত করেছিল এবং সেখানে প্রচুর প্রাণহানি হয়েছিল। একাধিক সেনাপতির মৃত্যু বা শক্তি হরণের ফলে প্রুশিয়ার রাজা কার্যত সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম হয়ে গিয়েছিলেন, যা দ্রুত ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল।[১৪২][১৪৩]
পরের মাসে ফরাসি বাহিনী ১,৪০,০০০ সৈন্য ও ২,০০০-এর বেশি কামান কব্জা করেছিল। চূড়ান্ত পরাজয়ের সত্ত্বেও যুদ্ধে রুশ বাহিনীর অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকা পর্যন্ত প্রুশিয়ান বাহিনী ফরাসি বাহিনীর সাথে মীমাংসা করতে রাজি হয়নি।[১৪২][১৪৪][১৪৫]
বিজয়ের পর ১৮০৬ সালের নভেম্বরে ইস্যু হওয়া বার্লিন অধ্যাদেশের মাধ্যমে নেপোলিয়ন ব্লকুস কোঁতিনঁতাল (Blocus continental, আক্ষ. 'মহাদেশীয় অবরোধ') আরোপ করেছিলেন, যা ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের দেশগুলোকে ব্রিটেনের সাথে বাণিজ্য করতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু এই ব্যবস্থা নেপোলিয়নের শাসনকালে একাধিকবার লঙ্ঘন করা হয়েছিল।[১৪৬]
১৮০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে নেপোলিয়নের বাহিনী পোল্যান্ড হয়ে আসা রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে কুচকাওয়াজ করেছিল, আর এইলাউর যুদ্ধে রক্তাক্ত লড়াই লড়েছিল।[১৪৭] উভয়পক্ষের বিশ্রাম ও পুনর্বিন্যাসের পর জুনে পুনরায় এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তবে হাইলজবার্গের প্রাথমিক লড়াই অনিশ্চায়ক ছিল।[১৪৮]
১৪ জুনে ফ্রিডলান্ডের যুদ্ধে নেপোলিয়ন রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত জয় লাভ করেছিলেন, এবং রুশ বাহিনীর পক্ষে ৩০% প্রাণহানি হয়েছিল।[১৪৯] রুশ পরাজয়ের বিপুল আকারের জন্য তারা ফরাসিদের সাথে শান্তিচুক্তি করতে রাজি হয়েছিল। ২৫ জুন টিলজিট শহরে নেমান নদীর মাঝে একটি ভাসমান ভেলায় দুই দেশের সম্রাট শান্তির মীমাংসা শুরু করেছিলেন, যা ফরাসি ও রুশ বাহিনী এবং তাদের নিজস্ব প্রভাবক্ষেত্রকে আলাদা করেছিল।[১৫০]
টিলজিটে প্রুশিয়ার প্রতি অবমাননাকর আচরণের ফলে সেই দেশে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী অপমানবোধ সৃষ্টি হয়েছিল। রাশিয়াতেও এই চুক্তি জনপ্রিয় ছিল না, যা জার প্রথম আলেকজান্ডারকে ফ্রান্সের সাথে জোট ছিন্ন করার চাপ সৃষ্টি করেছিল। যাইহোক, টিলজিট চুক্তি নেপোলিয়নকে যুদ্ধ থেকে অবসর দিয়েছিল এবং ফ্রান্সে ফিরে যেতে সাহায্য করেছিল, যা তিনি ৩০০ দিনেরও বেশি সময় ধরে দেখে যেতে পারেননি।[১৫১][১৫২]
উপদ্বীপীয় যুদ্ধ ও আরফুর্ট

টিলজিটের পর নেপোলিয়ন পর্তুগালের দিকে মনোযোগ দিলেন, কারণ পর্তুগাল তার পারম্পরিক মিত্র ব্রিটেনের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে অবরোধ প্রয়োগ করতে নারাজ ছিল।[১৫৩][১৫৪] ১৮০৭ সালের ১৭ অক্টোবরে স্পেনীয় অনুমতিতে এই অবরোধ প্রয়োগ করার জন্য জেনারেল জুনো ২৪,০০০ সৈন্যের বাহিনী নিয়ে পিরিনীয় পর্বতমালা অতিক্রম করেছিলেন এবং পর্তুগালের দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন।[১৫৫] নভেম্বরে জুনো লিসবন দখল করেছিলেন কিন্তু পর্তুগিজ রাজপরিবার তখনই পর্তুগিজ বহর নিয়ে ব্রাজিলে পালিয়ে গিয়েছিল।[১৫৬]
১৮০৮ সালে এক অভ্যুত্থানের ফলে স্পেনের রাজা চতুর্থ কার্লোস সিংহাসনচ্যুত হয়েছিলেন এবং তাঁর পুত্র সপ্তম ফেরনান্দো রাজা হয়েছিলেন।[১৫৭][১৫৮] পরের মাসে নেপোলিয়ন চতুর্থ কার্লোস ও সপ্তম ফেরনান্দো উভয়কে বেইয়নে আহ্বান করেছিলেন যেখানে মে মাসে তিনি উভয়কে স্পেনের সিংহাসনের দাবি ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন। নেপোলিয়ন তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা জোসেফ বোনাপার্টকে স্পেনের রাজা করেছিলেন।[১৫৯]
তখন ১,২০,০০০ জন ফরাসি সৈন্য আইবেরিয়াতে (স্পেন ও পর্তুগাল) সন্নিবিষ্ট ছিল।[১৬০][১৬১] স্পেনীয় বুরবোঁ রাজবংশকে উৎখাত করার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে বিক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল। ২ মে মাদ্রিদে ফরাসিদের বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহ সৃষ্টি হয়েছিল এবং কয়েক সপ্তাহে তা সারা স্পেনে ছড়িয়ে গিয়েছিল। ফরাসিদের নিষ্ঠুর দমননীতির সম্মুখীন হয়ে এই বিদ্রোহ এক দীর্ঘস্থায়ী দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছিল।[১৬২]
জুলাইতে জোসেফ মাদ্রিদে ভ্রমণ করেছিলেন এবং ২৪ তারিখে তিনি নিজেকে স্পেনের রাজা হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। তবে বাইলেনের যুদ্ধে সাধারণ স্পেনীয় বাহিনী দ্বারা ফরাসিদের পরাজয়ের খবর জানতে পেরে জোসেফ কয়েকদিন পর মাদ্রিদ ত্যাগ করেছিলেন।[১৬৩] পরের মাসে ব্রিটিশ বাহিনী পর্তুগালে অবতরণ করেছিল এবং ২১ আগস্টে ভিমিয়েরোর যুদ্ধে ফরাসিদের পরাজিত করেছিল। সিন্ত্রার কনভেনশন অনুযায়ী ফরাসিরা পর্তুগাল থেকে সৈন্য অপসারণ করেছিল।[১৬৪][১৬৫]
বাইলেন ও ভিমিয়েরোর পরাজয়ের ফলে নেপোলিয়ন বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁকে এই আইবেরীয় অভিযানের হাল ধরতে হবে। স্পেনের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার আগে তিনি রাশিয়ার সাথে জোটকে মজবুত করার চেষ্টা করেছিলেন এবং জারের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলেন যে অস্ট্রিয়া ফ্রান্সকে আক্রমণ করার চেষ্টা করলে রাশিয়া যুদ্ধ ঘোষণা করবে। ১৮০৮ সালের অক্টোবরের আরফুর্টের কংগ্রেসে নেপোলিয়ন ও প্রথম আলেকজান্ডার এক চুক্তি করেছিলেন যেখানে ফিনল্যান্ডে রুশ আক্রমণকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল এবং ব্রিটেনকে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান করা হয়েছিল।[১৬৬] কিন্তু জার অস্ট্রিয়ার সাথে যুদ্ধ করার কোনো দৃঢ় প্রতিজ্ঞা দিতে পারেননি।[১৬৭][১৬৮]
পঞ্চম জোটের যুদ্ধ
সাম্রাজ্যের একত্রীকরণ
রাশিয়া আক্রমণ
ষষ্ঠ জোটের যুদ্ধ
এলবা দ্বীপে নির্বাসন
একশো দিনের শাসন
Remove ads
সেন্ট হেলেনাতে নির্বাসন
মৃত্যু
১৮২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকেন। এরের ৫ মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার শেষ শব্দগুলো ছিল, "ফ্রান্স, ল'আর্মি, তেতে দ'আর্মি, জোসেফিনে" ( অনুবাদ : "ফ্রান্স, সেনাবাহিনী, সেনা প্রধান, জোসেফিনে")। [১৬৯][১৭০]
ধর্ম
সারাংশ
প্রসঙ্গ
ধর্মবিশ্বাস
নেপোলিয়ন ১৭৭১ সালের ২১ জুলাই আজাকিকোতে ব্যাপ্টিস্ট মতবাদে দীক্ষা নেন; তিনি একজন ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক হিসেবে বেড়ে ওঠেন কিন্তু যথেষ্ট ধর্মবিশ্বাস তার ছিল না। [১৭১] পরিণত বয়সে [১৭২] তাঁর উপাস্য ছিল অদৃশ্য ও অধরা ঈশ্বর। তবে সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যক্ষেত্রে তিনি সংঘবদ্ধ ধর্মীয় শক্তির প্রতি অত্যন্ত অনুরাগী ছিলেন এবং নিজ লক্ষ হাসিলের জন্য তিনি তা প্রয়োগের জন্য যথেষ্ট মনযোগী ছিলেন। নিজের উপর ক্যাথলিক রীতিনীতি ও চমৎকারিত্বের প্রভাব উল্লেখ করেন তিনি।[১৭১]
নেপলিয়ান জোসেফিন ডি বেহার্নেসকে ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়া আইনি প্রক্রিয়ায় বিয়ে করেন। মিশর অভিযানের সময় নেপলিয়ান একজন বিপ্লবী সেনাপ্রধান হিসাবে যথেষ্ট ধর্মীয় উদারতা প্রকাশ করেন। ওলামাদের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং ধর্মীয় উদযাপনের নির্দেশ দেন; কিন্তু পোপ ষষ্ঠ পায়াসের মৃত্যু হওয়ার পর তার প্রধান সহকারী তার এ আচরণকে রাজনৈতিক কৌশল বলে মন্তব্য করেন: "আমরা তাদের ধর্মের প্রতি মিছে আগ্রহ দেখানোর ভান করে মিশরীয়দের বোকা বানাই। তিনি ও আমি কেউই এই ধর্ম ততটা বিশ্বাস করি না, যতটা পায়াস দ্য ডিফাংটের ধর্মে করি।"[note ১]
নিজ স্মৃতিচরণে বোনপর্তের সচিব বোরিন বেনাপার্টের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে একই মন্তব্য লেখেন।[১৭৪] তার ধর্মীয় সুযোগগ্রহণের কৌশল তার এই বিখ্যাত উক্তিতে ফুটে উঠেছে: "নিজেকে ক্যাথলিক বানানোর মাধ্যমে আমি ব্রিটানি ও ভ্যান্ডিতে শান্তি এনেছি। নিজেকে ইতালীয় বানানোর মাধ্যমে আমি ইতালিতে সকলের মন জয় করেছি এবং নিজেকে মুসলিম বানিয়ে আমি মিশরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং আমি যদি ইহুদিদের শাসক হতাম, তবে সলোমনের মন্দির পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতাম।"[১৭৫] তবে জোয়ান কোরের মতে, "সে তুলনায়, নবী মুহাম্মদের জন্য বোনপোর্টের প্রশংসা ছিল খুবই খাঁটি।"[১৭৬] সেন্ট হেলেনায় তার বন্দিদশায় থাকাকালীন ভলতেয়ারের সমালোচনামূলক মঞ্চনাটক মাহোমেটে নবী মুহাম্মাদ সা.-কে নেতিবাচক চিত্রায়নের কঠোর সমালোচনা করেন।[১৭৭]
নেপোলিয়ন হিন্দু ধর্মের প্রতিও বিশেষ আকর্ষণ বোধ করেন এবং হিন্দুরাজা শিবা মহারাজের ভূয়সী প্রসংসা করেন। তিনি ১৮০৪ সালের ১-২রা ডিসেম্বর প্যারিসের নটরডেমে পোপ ৭ম পায়াস কর্তৃক 'সম্রাট নেপোলিয়ন' উপাধি লাভ করেন। ১৮১০ সালে অস্ট্রিয়ার রাজকন্যা ম্যারি লুইকে তিনি ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী বিয়ে করেন। ১৮১৩ সালে স্পেনে তার ভাইয়ের শাসনকালীন তিনি স্প্যানিশ ইনকুইজিশন প্রথা বিলুপ্ত করেন।
সেন্ট হেলেনায় নির্বাসিত হিসেবে অবস্থানকালে তিনি জেনারেল গরগারডের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় মানুষের উৎপত্তি নিয়ে তার অধিবাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন[note ২] এবং যীশুর স্বর্গীয়তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন এই বলে, রোমান ক্যাথলিক না হওয়ার কারণে সক্রেটিস, প্লেটো, মুসলিম ও অ্যাংলিকানরা ধ্বংস হয়ে যাবে এমনটা বিশ্বাস করা খুবই হাস্যকর। [note ৩] ১৮১৭ সালে তিনি গর্গার্ডকে আরও বলেন যে "আমি মুহাম্মদীয় ধর্মটাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি। এতে অল্প হলেও কিছু জিনিস আছে, যা আমাদের ধর্মের থেকে অধিক শক্তিশালী।"[১৭৯] আরো বলেন যে, "সকল ধর্মের মাঝে মুহাম্মদীয় ধর্ম সবচেয়ে উত্তম।"[১৮০] তবে মৃত্যুর পূর্বে একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজকই তাকে গোসল করিয়েছিলেন।[১৮১]
Remove ads
ব্যক্তিত্ব
সংস্কারসমূহ
প্রশাসন
নেপোলিয়নীয় বিধি
রণকৌশল
শিক্ষা
অভিজাততন্ত্র ও সম্মান
স্মৃতি ও মূল্যায়ন
সমালোচনা
প্রচারশৈলী ও স্মৃতি
ফ্রান্সের বাইরে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
সন্তান
টীকা
- ফরাসি: Napoléon Bonaparte, নাপলেওঁ বনাপার্ত্, [napɔleɔ̃ bɔnapaʁt]।
- ইতালীয়: Napoleone di Buonaparte, নাপোলেওনে দি ব্ৱনাপার্তে, [napoleˈoːne di ˌbwɔnaˈparte]।
- শুধু তাঁর নামটুকু ছাড়া নেপোলিয়নের সঙ্গে নেপোলিয়নের উপপাদ্যের মধ্যে তেমন কোনো সম্পর্ক নেই।[২৭]
তথ্যসূত্র
আরও পড়ুন
Wikiwand - on
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Remove ads