Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
বাংলায় মারাঠা আক্রমণ (১৭৪২) দ্বারা ১৭৪২ সালে বাংলার ভূখণ্ডে পরিচালিত মারাঠা আক্রমণকে বোঝানো হয়[1]। ১৭৪২ সালে মারাঠা নেতা প্রথম রঘুজী ভোঁসলের প্রধানমন্ত্রী ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে একটি বিরাট সৈন্যবাহিনী বাংলা আক্রমণ করে এবং সমগ্র বাংলা জুড়ে লুটপাট চালায়[1][2]। তীব্র সংঘর্ষের পর বাংলার নবাব আলীবর্দী খান মারাঠাদেরকে বাংলা থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হন[1]। বাংলা থেকে বিতাড়িত হয়ে মারাঠারা উড়িষ্যা আক্রমণ করে এবং দখল করে নেয়। কিন্তু নবাব আলীবর্দী ১৭৪২ সালের ডিসেম্বরে তাদেরকে সেখান থেকেও বিতাড়িত করেন[1]। এরপর পরাজিত মারাঠারা বাংলা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়[1][2] এবং সংঘর্ষের সমাপ্তি ঘটে।
বাংলায় মারাঠা আক্রমণ (১৭৪২) | |||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
মূল যুদ্ধ: বর্গির হাঙ্গামা | |||||||||
| |||||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||||
বাংলা | মারাঠা সাম্রাজ্য | ||||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||||
আলীবর্দী খান গোলাম মুস্তফা খান শেখ মাসুম পানিপথী † রায় দুর্লভ আব্দুর রসুল খান[1] মোহাম্মদ রেজা |
প্রথম রঘুজী ভোঁসলে ভাস্কর পণ্ডিত শীষ রাও[2] মীর হাবিব[1] | ||||||||
শক্তি | |||||||||
অজ্ঞাত | ৪০,০০০[1] | ||||||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||||||
অজ্ঞাত | অজ্ঞাত, তবে প্রচুর[1][2] |
১৭৪১ সালের আগস্টে নবাব আলীবর্দী খান কর্তৃক পদচ্যুত উড়িষ্যার বিদ্রোহী প্রাদেশিক শাসনকর্তা দ্বিতীয় মুর্শিদ কুলি খানের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে মারাঠাদের নাগপুর রাজ্যের রাজা রঘুজী ভোঁসলে উড়িষ্যা আক্রমণের জন্য দ্বিতীয় মুর্শিদ কুলির জামাতা মির্জা বাকেরের নেতৃত্বে একদল মারাঠা সৈন্য প্রেরণ করেন[1]। মির্জা বাকেরের নেতৃত্বাধীন সৈন্যরা সহজেই রাজধানী কটকসহ সমগ্র উড়িষ্যা দখল করে নেয়[1], কিন্তু একই বছরের ডিসেম্বরে নবাব আলীবর্দী খান উড়িষ্যা পুনর্দখল করে নিতে সক্ষম হন[1][2]। পরবর্তী বছর মারাঠারা সরাসরি বাংলা আক্রমণ করে[1][2]।
মির্জা বাকেরের কাছ থেকে কটক পুনরুদ্ধারের পর আলীবর্দী সেখানে দুই-তিন মাস অবস্থান করে সেখানকার প্রশাসন ব্যবস্থা পুনর্গঠন করেন এবং এরপর বাংলায় প্রত্যাবর্তনের জন্য যাত্রা করেন। পথিমধ্যে বালেশ্বরের কাছে তিনি যাত্রা স্থগিত করেন। নিকটবর্তী ময়ূরভঞ্জ অঞ্চলের রাজা সাম্প্রতিক যুদ্ধে আলীবর্দীর প্রতি বৈরিতা প্রদর্শন করেছিলেন। তাঁকে শাস্তি দেয়ার জন্য আলীবর্দী সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন[3]। এরপর জয়গড়ে পৌঁছে নবাব জানতে পারেন যে, রঘুজী ভোঁসলে বাংলা আক্রমণ করার জন্য তাঁর প্রধানমন্ত্রী ভাস্কর পণ্ডিতের অধীনে একটি শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেছেন[3]।
১৭৪২ সালের এপ্রিলের প্রথম দিকে রঘুজী বাংলা আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য তাঁর প্রধানমন্ত্রী ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে একটি ৪০,০০০ সৈন্যের একটি বৃহৎ অশ্বারোহী বাহিনী প্রেরণ করেন[1]। ভাস্কর পণ্ডিত উড়িষ্যা সীমান্তের অরণ্য ও ঝাড়খণ্ড অঞ্চলের মধ্য দিয়ে তাঁর বিরাট বাহিনী-সহ বাংলায় প্রবেশ করেন[1][2]। এবার মারাঠাদের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্নরকম। বাংলার কোনো অঞ্চল স্থায়ীভাবে দখলের উদ্দেশ্য তাদের ছিল না। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলার বিস্তীর্ণ সমৃদ্ধিশালী গ্রামাঞ্চলে লুটতরাজ চালানো[1][2]।
ভাস্কর পণ্ডিত দৈনহাটায় ঘাঁটি স্থাপন করেন[1][2] এবং ঘাঁটির নিরাপত্তার জন্য চতুর্দিকে পরিখা খনন করেন। এর ফলে মারাঠা ঘাঁটি আক্রমণ করা দুরূহ হয়ে পড়ে। এই শক্তিশালী ঘাঁটি থেকে মারাঠারা বর্ধমান ও মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে লুটতরাজ আরম্ভ করে দেয়[2]।
নবাব আলীবর্দী উড়িষ্যা থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় মারাঠাদের লুটতরাজ ও উপদ্রবের সংবাদ পান[1]। এসময়ে তাঁর সঙ্গে স্বল্পসংখ্যক সৈন্য ছিল। এই ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে তিনি হুগলি জেলার মুবারক মঞ্জিল থেকে বিরাট মারাঠা বাহিনীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। ১৭৪২ সালের ১৫ এপ্রিল তিনি বর্ধমানে পৌঁছেন[1] এবং মারাঠা বাহিনীর সাক্ষাৎ পান।
একজন সুনিপুণ সমরবিশারদ হিসেবে আলীবর্দী খ্যাতিমান ছিলেন[1][2]। এজন্য ভাস্কর পণ্ডিত বিরাট সৈন্যবাহিনী থাকা সত্ত্বেও আলীবর্দীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হতে সাহস পান নি। তিনি মারাঠাদের অভ্যস্ত অনিয়মিত যুদ্ধপদ্ধতি অনুসরণ করেন। কিন্তু তাতেও তিনি সুবিধা করতে পারেন নি[1]। তিনি নবাবের নিকট প্রস্তাব করেন যে, তাঁকে ১০ লক্ষ টাকা দিলে তিনি তাঁর সৈন্যদল নিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করবেন। নবাব আলীবর্দী এ প্রস্তাবে সম্মত হন নি[1]।
বিক্ষিপ্তভাবে যুদ্ধ হওয়ার ফলে এক পর্যায়ে মারাঠাদের একটি বড় সৈন্যদল আলীবর্দীকে ঘিরে ফেলে। এসময় তাঁর সঙ্গে খুব অল্পসংখ্যক সৈন্য ছিল। নবাব নিশ্চিত ধ্বংসের সম্মুখীন হন। সুযোগ বুঝে ভাস্কর পণ্ডিত নবাবের কাছে ১ কোটি টাকা দাবি করে সন্ধির প্রস্তাব করেন। কিন্তু আলীবর্দী এ অপমানজনক প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন[2]।
এসময় মীর হাবিব ইস্পাহানি, নবাবের একজন ইরানি সঙ্গী, নবাবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁর সৈন্যদল ত্যাগ করেন এবং মারাঠাদের সঙ্গে যোগ দেন[1]। এদিকে মারাঠারা অবরুদ্ধ নবাবের রসদপত্র সরবরাহের পথ বন্ধ করে দেয়, এবং আরেকটি মারাঠা দল আশেপাশের ৪০ মাইলব্যাপী অঞ্চল জুড়ে লুটতরাজ করতে থাকে। আশ্রয়হীনভাবে অবরুদ্ধ থাকায় খাদ্যের অভাবে নবাব ও তাঁর সৈন্যরা ভীষণ দুর্দশায় পতিত হন। এই অবস্থায়ও আলীবর্দী সাহসের সঙ্গে মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এই অবরোধ ভাঙতে সক্ষম হন[2] এবং ২৬ এপ্রিল কাটোয়ায় পৌঁছেন।
ভাস্কর পণ্ডিত নিরাশ হয়ে বাংলা ত্যাগ করার সংকল্প করেন। কিন্তু মীর হাবিবের প্ররোচনায় তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন[2]। মীর হাবিব অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিলেন। দীর্ঘদিন নবাব সুজাউদ্দিন খানের অধীনে কাজ করার সুবাদে বাংলার ভৌগোলিক, সামরিক, অর্থনৈতিক - সকল বিষয়েই তিনি পরিপূর্ণভাবে অবগত ছিলেন। তাঁর এই জ্ঞানের সাহায্যে তিনি মারাঠাদের সকল অভিযানে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেন[2]। তাঁর অনন্যসাধারণ সামর্থ্য এবং আলীবর্দী খানের প্রতি অনমনীয় শত্রুতার মনোভাব বাংলায় মারাঠা আক্রমণকে এক প্রলম্বিত এবং ধ্বংসাত্মক রূপ প্রদান করে[2]।
নবাব আলীবর্দীর কাটোয়ায় অবস্থানকালে মীর হাবিব ভাস্কর পণ্ডিতকে সীমাহীন লুণ্ঠনের লোভ দেখিয়ে নবাবের অনুপস্থিতিতে অতর্কিতে তাঁর রাজধানী আক্রমণ করতে প্রলুব্ধ করেন[1]। ১৭৪২ সালের ৬ মে ভাস্কর পণ্ডিতের মারাঠা হানাদারেরা মুর্শিদাবাদের একটি উপশহর দাহিপাড়ায় পৌঁছায়, সেখানকার বাজার পুড়িয়ে দেয়[2], এবং তারপর এটি অতিক্রম করে খোদ মুর্শিদাবাদে পৌঁছে সেখানে লুটতরাজ করে[2]। কেবল ব্যাঙ্কার জগৎ শেঠের বাড়ি থেকেই তারা ৩ লক্ষ টাকা ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্য লুট করেছিল[2]। আলীবর্দী ৭ মে সকালে তাঁর রাজধানী রক্ষা করতে পৌঁছান। মারাঠা হানাদারেরা কাটোয়ায় পশ্চাৎপসরণ করে, পথিমধ্যে অসংখ্য গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় এবং জ্বলন্ত গ্রামসমূহের সারি তাদের পদচিহ্ন হিসেবে থেকে যায়[2]। জুন মাস থেকে কাটোয়া মারাঠা সৈন্যবাহিনীর সদরদপ্তরে পরিণত হয়। মীর হাবিব তাদের প্রধান উপদেষ্টা এবং প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতে থাকেন[2]।
১৭৪২ সালের জুলাই-এর প্রথমদিকে মীর হাবিব হুগলিতে তাঁর বন্ধুদের সহযোগিতায় জেলাটির মদ্যপ ফৌজদার মুহাম্মদ রেজাকে বন্দি করতে সক্ষম হন[1][2]। মারাঠারা হুগলি শহর দখল করে সেখানে লুটতরাজ করে। শীষ রাও-এর অধীনে একটি মারাঠা সৈন্যদলকে সেখানে নিযুক্ত করা হয়। এভাবে, রাজমহল থেকে মেদিনীপুর ও যশোর পর্যন্ত গঙ্গানদীর পশ্চিমের জেলাগুলো মারাঠাদের হাতে চলে যায়[1], এবং শীষ রাও তাদের গভর্নর নিযুক্ত হন। মীর হাবিব মারাঠাদের পক্ষে বাংলার দিওয়ান হিসেবে কাজ করেন, এবং মারাঠা প্রশাসনের নিকট চৌথ প্রদান করার জন্য জমিদারদের তলব করেন। মারাঠাদের উপদ্রবে এই অঞ্চলের লোকের দুর্দশা চরমে পৌঁছে। বহু মানুষ তাঁদের পরিবারের নারীদের সম্মান রক্ষার জন্য তাঁদের বাড়িঘর ত্যাগ করেন[2] এবং গঙ্গানদীর পূর্বতীরে চলে গিয়ে গোদাগারী-তে আশ্রয় নেন। এই জন্য গোদাগারীকে 'ভাগনগর' বলা হতো।
অনিয়মিত মারাঠা আক্রমণ গঙ্গানদীর পূর্ব তীরের অঞ্চলেও নবাবের শাসনের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। যেসব অঞ্চলের ওপর নবাব কর্তৃত্ব হারিয়েছিলেন সেসব অঞ্চলে মারাঠা দলগুলো উদ্দেশ্যহীন ধ্বংসসাধন করে এবং অকথ্য অত্যাচার চালায়। মারাঠা লুণ্ঠনের ভয়ে বণিক এবং তাঁতিরা বীরভূম থেকে পালিয়ে যান[2]। অন্যান্য অঞ্চলে মারাঠা ধ্বংসযজ্ঞে ভয় পেয়ে রেশমি বস্তুসামগ্রী প্রস্তুতকারীরা পালিয়ে যায়। রেশম এবং কাপড়ের কারখানা ও বিক্রয়কেন্দ্রগুলো পরিত্যক্ত হয়[2], খাদ্যশস্য দুর্লভ হয়ে পড়ে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সব ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়।
১৭৪২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ভোরে নবাবের সৈন্যরা কাটোয়ায় ভাস্কর পণ্ডিতের ঘুমন্ত মারাঠা শিবিরে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়[4]। মারাঠারা তাদের শিবির এবং মালপত্র পিছনে ফেলে পালিয়ে যায়[4][5]। ভাস্কর তাঁর সৈন্যদের বাংলার সকল ঘাঁটি থেকে ডেকে পাঠান এবং সকল পলাতকদের নিয়ে মেদিনীপুরে যান, সেখানকার একটি বিখ্যাত রেশম-পালন কেন্দ্র রাধানগর লুট করেন এবং জ্বালিয়ে দেন[2], এবং নারায়ণগড়ে অবস্থান গ্রহণ করেন।
আলীবর্দী স্বয়ং সৈন্য নিয়ে মারাঠাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। এ সংবাদ পেয়ে মারাঠারা নারায়ণগড় থেকে উড়িষ্যায় চলে যায় এবং নবাবের নিযুক্ত প্রাদেশিক শাসনকর্তা শেখ মাসুম পানিপথীকে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করে কটক দখল করে নেয়[1][2]। কিন্তু আলীবর্দী উড়িষ্যার দিকে অগ্রসর হলে ভাস্কর পণ্ডিত ভয় পেয়ে উড়িষ্যা ত্যাগ করেন। আলীবর্দী ১৭৪২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে মারাঠাদের চিলকা হ্রদেরও দূরে তাড়িয়ে দেন[1][2]। এর মধ্য দিয়ে বাংলায় দ্বিতীয় মারাঠা আক্রমণের অবসান ঘটে[2]।
মারাঠাদের পরাজয়ের পর আলীবর্দী তাঁর আফগান সৈন্যাধ্যক্ষ গোলাম মুস্তফার ভ্রাতুষ্পুত্র আব্দুর রসুল খান-কে উড়িষ্যার প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন[1]। ১৭৪৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি তিনি বিজয়ীর বেশে মুর্শিদাবাদে প্রত্যাবর্তন করেন[2]। কিন্তু পরের মাসেই মারাঠারা আবার বাংলা আক্রমণ করে[1]।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.