Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
সুমেরীয় ধর্ম ছিল প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার প্রথম সাক্ষর সভ্যতা সুমেরের অধিবাসীগণ কর্তৃক আচরিত ও অনুসৃত ধর্ম। সুমেরীয়রা মনে করত, প্রাকৃতিক ও সামাজিক শৃঙ্খলার সঙ্গে সম্পর্কিত সকল বিষয়ের জন্য দায়ী তাদের দেবদেবীরা।[3]:৩–৪
সুমেরের রাজপদের সূচনার আগে নগর-রাষ্ট্রগুলি কার্যকরভাবে শাসিত হত পুরোহিত ও ধর্মীয় আধিকারিকদের দ্বারা। পরবর্তীকালে এই শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে রাজশাসনের প্রবর্তন ঘটলেও পুরোহিতরা সুমেরীয় সমাজে এক বিরাট প্রভাবশালী গোষ্ঠী হিসেবেই থেকে যান। প্রথম দিকে সুমেরীয় মন্দিরগুলি ছিল সাদাসিধে এক-কক্ষবিশিষ্ট ভবন, যা কোনও কোনও ক্ষেত্রে উচ্চ বেদির উপর নির্মিত হত। সুমেরীয় সভ্যতার শেষ দিকে এই মন্দিরগুলি বিকাশ লাভ করে জিগুরাটে, যা ছিল উপরিতলে পুণ্যস্থান-সহ এক-একটি দীর্ঘাকৃতি, পিরামিডসদৃশ ভবন।
সুমেরীয়রা বিশ্বাস করত যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে ধারাবাহিকভাবে একের পর এক মহাজাগতিক জন্মের মধ্যে দিয়ে। প্রথমে আদ্যকালীন জলরাশি নাম্মু জন্ম দিয়েছিলেন আন (আকাশ) ও কি-র (পৃথিবী)। তাঁদের সংগমের ফলে এনলিল নামে এক পুত্রের জন্ম হয়। এনলিল স্বর্গকে পৃথিবীর থেকে বিচ্ছিন্ন করেন এবং পৃথিবীকে নিজ রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করেন। মনে করা হয়, আন ও নাম্মুর পুত্র এনকি হলেন মানবজাতির স্রষ্টা। সুমেরীয়দের বিশ্বাস অনুযায়ী, স্বর্গ ছিল শুধুমাত্র দেবদেবীদের জন্যই সংরক্ষিত এবং জীবৎকালে আচরণ যাই হোক না কেন, মৃত্যুর পর সকল নশ্বর ব্যক্তির আত্মাই মৃত্যুর পর মাটির অনেক নিচে অবস্থিত এক শীতল ও অন্ধকার গুহায় গমন করত। এই প্রেতলোকের নাম ছিল কুর এবং এই লোক শাসন করতেন দেবী এরেশকিগাল। কুরে একমাত্র শুকনো ধুলো ছাড়া আর কোনও খাদ্য পাওয়া যেত না। পরবর্তীকালে সুমেরীয়দের ধারণা হয় যে, এরেশকিগাল তাঁর স্বামী নেরগালের সঙ্গে একযোগে প্রেতলোক শাসন করেন।
সুমেরীয় দেবমণ্ডলীর প্রধান দেবদেবীদের অন্যতম ছিলেন স্বর্গের দেবতা আন, বায়ু ও ঝড়ের দেবতা এনলিল, জল ও মানব সংস্কৃতির দেবতা এনকি, উর্বরতা ও পৃথিবীর দেবী নিনহুরসাগ, সূর্য ও ন্যায়বিচারের দেবতা উতু এবং উতুর বাবা তথা চন্দ্রদেবতা নান্না। আক্কাদীয় যুগ ও তার সমগ্র সুমের অঞ্চল জুড়ে যৌনতা, সৌন্দর্য ও যুদ্ধের দেবী ইনান্নার পূজার ব্যাপক প্রচলন ঘটে এবং অনেক পৌরাণিক উপাখ্যানে তাঁর উপস্থিতি লক্ষিত হতে থাকে। উল্লেখ্য, ইনান্নার একটি বিখ্যাত কাহিনি ছিল তাঁর প্রেতলোকে অবতরণের কাহিনি।
সুমেরীয় ধর্ম গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল পরবর্তীকালের মেসোপটেমীয় জাতিগোষ্ঠীগুলির ধর্মবিশ্বাসসমূহকে। এই ধর্মের বিভিন্ন উপাদান হুরীয়, আক্কাদীয়, ব্যাবিলনীয়, আসিরীয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর পুরাণ ও ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে অব্যাহত থাকে। তুলনামূলক পুরাণবিদ্যার গবেষকেরা প্রাচীন সুমেরীয়দের উপাখ্যানগুলির সঙ্গে পরবর্তীকালে নথিবদ্ধ হিব্রু বাইবেলের প্রথম অংশের কাহিনিগুলির অনেক সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছেন।
সুমেরীয়রা দেবদেবী দের সন্তুষ্ট করার জন্য খাবার মাখন ঘি উৎসর্গ করতো।এছাড়া ও তারা গরু, ছাগল,ভেড়া,কবুতর,হাস মুরগী দেব দেবীদের সন্তুষ্ট করার জন্য বলি দেওয়া হত।অনেক যুদ্ধ বন্দিদের ও দেবতাদের উদ্দেশ্য বলি দিত।পরে এই প্রথা বন্ধ করে পশু বলি দেওয়া শুরু করে।এসব পুরোহিতরা গ্রহণ করে অনেক বিত্তশালী হয়ে উঠে।
লিখন পদ্ধতি আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত সুমেরীয় পুরাণকথাগুলি মৌখিকভাবে প্রচলিত ছিল (এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রাচীনতম পুরাণকথাটি হল গিলগামেশের মহাকাব্য; এটি সুমেরীয় এবং ধারাবাহিকভাবে ভাঙা মৃৎফলকে লিখিত)। আদি সুমেরীয় কিউনিফর্ম ব্যবহৃত হত প্রধানত নথিরক্ষণের কাজে। আদি রাজবংশীয় যুগের শেষভাগেই প্রথম ধর্মীয় রচনার উদ্ভব ঘটে। সেই যুগে ধর্মীয় রচনা বলতে ছিল মন্দির প্রশস্তিসূচক স্তোত্রাবলি[5] এবং নাম-শুব (উপসর্গ + "নিক্ষেপ করা") নামে পরিচিত "জাদুমন্ত্র"-এর একটি রূপ।[6] এই ফলকগুলি নির্মিত হত কাদাপাথর বা পাথরে এবং এক ধরনের ছোটো কুড়ুলের মাধ্যমে তাতে প্রতীক ইত্যাদি অঙ্কন করা হত।
সুমেরীয় নগর-রাষ্ট্রগুলিতে প্রথম যুগের মন্দির চত্বরগুলি ছিল ছোটো এবং উচ্চ বেদির উপর নির্মিত এক-কক্ষবিশিষ্ট ভবন। আদি রাজবংশীয় যুগে উত্তোলিত স্তর এবং বহু-কক্ষবিশিষ্ট মন্দির নির্মাণ শুরু হয়। সুমেরীয় সভ্যতার শেষ লগ্নে জিগুরাটগুলি মেসোপটেমীয় ধর্মীয় কেন্দ্রের মন্দির ভবন হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।[9]
আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দ পর্যন্ত মন্দিরগুলি ছিল সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রধান কার্যালয়। এরপর লু-গাল (“পুরুষ” + “বিরাট”)[6] নামে পরিচিত সামরিক রাজাদের উত্থান ঘটলে রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের কেন্দ্র হিসেবে প্রায়শই পৃথক "প্রাসাদ" চত্বর নির্ধারিত হত।
লুগাল শাসনের পূর্বাবধি সুমেরীয় নগর-রাষ্ট্রগুলি প্রকৃত প্রস্তাবে বিভিন্ন এন বা এনসিদের (শহরের দেবতাদের কাল্টের প্রধান পুরোহিত, নারী পুরোহিতদের বলা হত নিন) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পুরোহিততান্ত্রিক সরকার কর্তৃক শাসিত হত। পুরোহিতেরাই তাঁদের নগর-রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রথাগুলির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে দায়ী ছিলেন। তাঁদের মানবজাতি এবং মহাজাগতিক ও পার্থিব শক্তিগুলির মধ্যে মধ্যস্থতাকারী গণ্য করা হত। পুরোহিতেরা পূর্ণ সময়ের জন্য মন্দির চত্বরে বাস করতেন এবং সভ্যতার উদ্বর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় বড়ো সেচ প্রক্রিয়া সহ রাষ্ট্রের সমস্ত বিষয় পরিচালনা করতেন।
কথিত আছে, উরের তৃতীয় রাজবংশের সমসাময়িক কালে সুমেরের লাগাশ নগর-রাষ্ট্রে বাষট্টি জন "বিলাপ পুরোহিত" ছিলেন এবং তাঁদের সঙ্গত দানের জন্য ১৮০ জন গায়ক ও বাদ্যকার নিযুক্ত থাকতেন।
সুমেরীয়রা মনে করত, মহাবিশ্ব একটি বদ্ধ গম্বুজের আকৃতিবিশিষ্ট এবং সেটিকে ঘিরে রয়েছে আদ্যকালীন লবণাক্ত জলের এক সমুদ্র।[10] এই গম্বুজের ভিত্তিটি হল শিলাময় পৃথিবী এবং পৃথিবীর নিচে রয়েছে একটি পাতাললোক এবং আব্জু নামে পরিচিত মিষ্টি জলের একটি মহাসাগর। গম্বুজাকৃতি নভোমণ্ডলের দেবতার নাম ছিল আন এবং পৃথিবীর দেবীর নাম ছিল কি। প্রথম দিকে পাতাললোকটিকে দেবী কি-র ব্যাপ্তি মনে করা হত। কিন্তু পরবর্তীকালে পাতালকে কেন্দ্র করে কুর-এর ধারণার উৎপত্তি ঘটে। আদ্যকালীন লবণাক্ত জলের সমুদ্রটির নাম ছিল নাম্মু। পরবর্তীকালে সুমেরীয় নবজাগরণের যুগে ও তার পরে এই দেবতাটি পরিচিত হন তিয়ামাত নামে।
সুমেরীয় সৃষ্টি অতিকথা-সংক্রান্ত তথ্যের প্রধান সূত্র উপাদান হল গিলগামেশ, এনকিডু ও প্রেতলোক নামক মহাকাব্যের প্রস্তাবনা অংশটি।[12]:৩০–৩৩ সেখানে সৃষ্টিপ্রক্রিয়াটি সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে: আদিতে শুধুমাত্র নাম্মু অর্থাৎ আদ্যকালীন সমুদ্রই ছিলেন।[12]:৩৭–৪০ তারপর নাম্মু জন্ম দিলেন আন (আকাশ) ও কি-র (পৃথিবী)।[12]:৩৭–৪০ আন ও কি-র মিলনের ফলে জন্মগ্রহণ করলেন বায়ু, বৃষ্টিপাত ও ঝড়ের দেবতা এনলিল।[12]: ৩৭–৪০ এনলিল আন ও কি-কে বিচ্ছিন্ন করলেন এবং পৃথিবী জয় করে তাকে নিজ রাজ্য বলে ঘোষণা করলেন। আন আকাশ জয় করলেন।[12]:৩৭–৪১
প্রাচীন মেসোপটেমীয়রা মনে করত আকাশ হল চ্যাপ্টা পৃথিবীর উপর স্থাপিত সাধারণত তিনটি, কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে সাতটি গম্বুজের সারি।[13]:১৮০ প্রতিটি গম্বুজই আলাদা আলাদা ধরনে মূল্যবান পাথর দিয়ে তৈরি।[13]:২০৩ স্বর্গের সর্বনিম্ন গম্বুজটি ইয়াশব পাথরে নির্মিত এবং সেখানেই নক্ষত্রেরা অবস্থান করে।[14] স্বর্গের মধ্যবর্তী গম্বুজটি সাগ্গিলমুত পাথরে তৈরি এবং এই অংশে বাস করেন ইগিগি দেবমণ্ডলী।[14] স্বর্গের সর্বোচ্চ ও সর্ববহিঃস্থ গম্বুজটি লুলুদানিতু পাথরে তৈরি এবং সেটি ছিল আকাশের দেবতা আনের মূর্ত প্রতীক।[14][15] এছাড়া মহাজাগতিক বস্তুগুলির সঙ্গে নির্দিষ্ট দেবদেবীদের সম জ্ঞান করা হত।[13]:২০৩ শুক্র গ্রহকে মনে করা হত প্রেম, যৌনতা ও যুদ্ধের দেবী ইনান্না।[13]:২০৩[16]:১০৮–১০৯ সূর্যকে মনে করা হত তাঁর ভাই তথা ন্যায়বিচারের দেবতা উতু[13]:২০৩ এবং চাঁদকে মনে করা হত তাঁদের বাবা নান্না।[13]:২০৩ সাধারণ নশ্বর মানুষ স্বর্গে যেতে পারত না, কারণ স্বর্গ ছিল শুধুমাত্র দেবতাদেরই আবাসস্থল।[17] বরং কোনও ব্যক্তির মৃত্যু হলে তার আত্মা গমন করত কুর (পরবর্তীকালে যা ইরকাল্লা নামে পরিচিত হয়) নামে এক অন্ধকার ছায়াময় প্রেতলোকে। এই কুর ভূপৃষ্ঠের নিচে অনেক গভীরে অবস্থিত বলে মনে করা হত।[17][18]
সুমেরীয় প্রেতলোক মাটির অনেক গভীরে একটি অন্ধকার নিরানন্দময় গুহা।[18][19] মনে করা হত, সেখানকার অধিবাসীরা তাদের "পৃথিবীতে অতিবাহিত জীবনের একটি ছায়াময় রূপ" নির্বাহ করে।[18] এই শীতল রাজ্যটির নাম ছিল কুর[16]:১১৪ এবং দেবী এরেশকিগালকে সেই রাজ্যের শাসনকর্ত্রী মনে করা হত।[13]:১৮৪[18] সকল আত্মাই একই প্রেতলোকে যেত[18] এবং জীবদ্দশায় ব্যক্তির কাজই আসন্ন জগতে তার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে।[18]
মনে করা হত, কুরে আত্মারা শুধুমাত্র শুকনো ধুলো ছাড়া কিছুই খেতে পায় না[16]:৫৮ এবং মৃত ব্যক্তি যাতে জল পান করতে পারে সেই জন্য তার পরিবারের সদস্যদের মাটির নলে করে মৃতের সমাধির মধ্যে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তর্পণ করতে হয়।[16]:৫৮ কেউ কেউ অনুমান করেন, ধনী ব্যক্তিদের সমাধিতে আবিষ্কৃত ধনসম্পদ সম্ভবত মৃত ব্যক্তিকে প্রেতলোকে বিশেষ সুযোগসুবিধা দানের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য উতু ও আনুন্নাকি সদস্যদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত হয়েছিল।[19] উরের তৃতীয় রাজবংশের সমসাময়িককালে মনে করা হত যে, কোনও ব্যক্তি প্রেতলোকে কেমন থাকবেন, তা নির্ভর করছে কীভাবে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়েছে তার উপর।[16]:৫৮ যাঁদের সমাধি জাঁকজমকপূর্ণ হবে তাঁদের প্রেতলোকে ভালো ব্যবহার পাবেন।[16]:৫৮ কিন্তু যাঁদের সাদামাটাভাবে সমাধিস্থ করা হবে, তাঁরা জীবিতদের তাড়া করে বেড়াবেন বলেই মনে করা হত।[16]:৫৮
মনে করা হত, কুরের প্রবেশপথটি দূর প্রাচ্যে জারগোস পর্বতমালায় অবস্থিত।[16]:১১৪ এই প্রেতলোকের সাতটি দরজা ছিল, যেগুলি আত্মাকে পার হতে হত।[18] দেবতা নেতি ছিলেন দ্বাররক্ষক।[13]:১৮৪[16]:৮৬ এরেশকিগালের সুক্কাল বা দূত ছিলেন দেবতা নামতার।[13]:১৮৪[16]:১৩৪ সুমেরীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, গাল্লা নামে এক শ্রেণির দানব প্রেতলোকে বাস করত।[16]:৮৫ তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব অনুমিত হয় হতভাগ্য নশ্বরদের কুরে টেনে নামিয়ে আনা।[16]:৮৫ জাদুগ্রন্থগুলিতে প্রায়শই তাদের কথা উল্লিখিত হয়েছে।[16]:৮৫–৮৬ কোনও কোনও গ্রন্থে আবার তাদের সংখ্যা সাত বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।[16]:৮৫–৮৬ আবিষ্কৃত কবিতাগুলির মধ্যে অনেকগুলিতে বর্ণিত হয়েছে, গাল্লা দানবেরা দেবতা দুমুজিদকে প্রেতলোকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।[16]:৮৬ পরবর্তীকালের মেসোপটেমীয়রা প্রেতলোককে চিনত সেটির পূর্ব সেমিটিক ইরকাল্লা নামটিতে। আক্কাদীয় যুগে প্রেতলোকের শাসক রূপে এরেশকিগালের ভূমিকাটি যুক্ত করা হয় মৃত্যুদেবতা নেরগালের সঙ্গে।[13]:১৮৪[18] নেরগালের এরেশকিগালের স্বামী আখ্যা দিয়ে আক্কাদীয়রা প্রেতলোকের এই দ্বৈত উপাসনার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করেছিল।[18]
সুমেরীয় সভ্যতার সূত্রপাত যে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০০ থেকে ৪০০০ অব্দের মধ্যবর্তী কোনও এক সময়ে ঘটেছিল, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞেরা সাধারণভাবে একমত। তবে এই সভ্যতার প্রাচীনতম ঐতিহাসিক নথিটি খ্রিস্টপূর্ব ২৯০০ অব্দের সমসাময়িক।[20] সুমেরীয়রা মূলত একটি বহু-ঈশ্বরবাদী ধর্মের অনুগামী ছিল। এই ধর্মের নরাত্বরোপিত দেবদেবীরা ছিলেন তাদের জগতের মহাজাগতিক ও পার্থিব শক্তিসমূহের প্রতীক।[13]:১৭৮–১৭৯ খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে রচিত প্রাচীনতম সুমেরীয় সাহিত্যে চার জন দি দেবতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এঁরা হলেন আন, এনলিল, নিনহুরসাগ ও এনকি। মনে করা হত যে, এই আদি দেবতারা মাঝে মাঝে একে অপরের বিরুদ্ধে অনিষ্টকর কাজকর্ম করতেন। তবে সাধারণভাবে তাঁদের সমন্বয়মূলক সৃজনশীল শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিযুক্ত দেবতা হিসেবেই গণ্য করা হত।[21]
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের মধ্যভাগে সুমেরীয় সমাজ অধিকতর পরিমাণে নগরায়িত হয়ে ওঠে।[13]:১৭৮–১৭৯ এর ফলে সুমেরীয় দেবদেবীগণ প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর আদি সম্পর্কগুলি হারাতে শুরু করেন এবং বিভিন্ন শহরের পৃষ্ঠপোষক দেবহা হয়ে ওঠেন।[13]:১৭৯ প্রত্যেক সুমেরীয় নগর-রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট নিজস্ব পৃষ্ঠপোষক দেবতা ছিল।[13]:১৭৯ মনে করা হত, সেই দেবতা শহর ও শহরের স্বার্থ রক্ষা করেন।[13]:১৭৯ বহু-সংখ্যক সুমেরীয় দেবদেবীর তালিকা পাওয়া যায়। কিউনিফর্ম ফলকগুলি পর্যালোচনার সময় সেই সব দেবদেবীদের গুরুত্বের ক্রম ও পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখা হয়।[22]
খ্রিস্টপূর্ব ২০০০-এর দশকের শেষভাগে আক্কাদীয়রা সুমের জয় করে।[13]:১৭৯ আক্কাদীয়রা তাদের নিজস্ব দেবদেবীদের সঙ্গে সুমেরীয় দেবদেবীদের সমন্বয় সাধন ঘটিয়েছিল।[13]:১৭৯ এর ফলে সুমেরীয় ধর্মে একটি সেমিটিক রং লাগে।[13]:১৭৯ পুরুষ দেবতারা প্রাধান্য অর্জন করেন[13]:১৭৯ এবং দেবদেবীরা প্রাকৃতিক বস্তু ও ঘটনার সঙ্গে তাঁদের আদি সম্পর্ক সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেন।[13]:১৭৯–১৮০ মানুষ দেবতাদের শ্রেণি কাঠামো-যুক্ত এক সামন্ততান্ত্রিক সমাজের অধিবাসী মনে করতে থাকে।[13]:১৭৯–১৮১ মনে করা হতে থাকে যে, এনকি ও ইনান্নার মতো শক্তিশালী দেবদেবীরা তাঁদের ক্ষমতা অর্জন করেছেন প্রধান দেবতা এনলিলের থেকে।[13]:১৭৯–১৮০
অধিকাংশ সুমেরীয় দেবদেবী আনুন্না (“আনের [সন্তানসন্ততি]”) নামে একটি শ্রেণির অন্তর্গত। অন্যদিকে এনলিল ও ইনান্না সহ সাত জন দেবদেবী আনুন্নাকি (“আনের + কি-র [সন্তানসন্ততি]”) “প্রেতলোকের বিচারক” শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। কথিত আছে, উরের তৃতীয় রাজবংশের সমসাময়িক কালে ছত্রিশশো দেবদেবী সুমেরীয় দেবমণ্ডলীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।[13]:১৮২
এনলিল ছিলেন আকাশ, বায়ু ও ঝড়ের দেবতা।[23]:১০৮ তাঁকে সুমেরীয় দেবমণ্ডলীর প্রধান দেবতা[23]:১০৮[24]:১১৫–১২১ এবং নিপ্পুর শহরের পৃষ্ঠপোষক দেবতাও মনে করা হত।[25]:৫৮[26]:২৩১–২৩৪ তাঁর প্রধানা মহিষী ছিলেন দক্ষিণ বায়ুর দেবী নিনলিল[27]:১০৬ নিনলিল ছিলেন নিপ্পুর শহরের অন্যতম মাতৃকা দেবী এবং মনে করা হত যে, তিনি এনলিলের সঙ্গে একই মন্দিরে বাস করেন।[28] নিনুর্তা ছিলেন এনলিল ও নিনলিলের পুত্র। তাঁকে যুদ্ধ, কৃষি ও অন্যতম সুমেরীয় বায়ুদেবতা হিসেবে পূজা করা হত। তিনি ছিলেন গিরসু শহরের পৃষ্ঠপোষক দেবতা এবং লাগাশ শহরের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক দেবতা।
এনকি ছিলেন মিষ্টি জল, পুরুষদের যৌন সক্ষমতা ও জ্ঞানের দেবতা।[16]:৭৫ তাঁর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাল্ট কেন্দ্রটি ছিল এরিডু শহরের এ-আব্জু মন্দির।[16]:৭৫ তিনি ছিলেন মানবজাতির স্রষ্টা ও পৃষ্ঠপোষক[16]:৭৫ এবং মানব সংস্কৃতির দায়িত্ব গ্রহণে প্রতিশ্রুতিবান।[16]:৭৫ তাঁর প্রধানা মহিষী ছিলেন সুমেরীয় ভূদেবী নিনহুরসাগ।[16]:১৪০ কেশ ও আদাব শহরে নিনহুরসাগের পূজা প্রচলিত ছিল।[16]:১৪০
ইনান্না ছিলেন সুমেরের প্রেম, যৌনতা, পতিতাবৃত্তি ও যুদ্ধের দেবী।[16]:১০৯ তিনি ছিলেন শুকতারা ও সন্ধ্যাতারা-রূপী শুক্র গ্রহের দিব্য প্রতিমূর্তি।[16]:১০৮–১০৯ ইনান্নার প্রধান কাল্ট কেন্দ্রটি ছিল উরুক শহরের এয়ান্না মন্দির। এই মন্দিরটি অবশ্য প্রথম দিকে আনের প্রতি উৎসর্গিত হয়েছিল।[30] দেবত্বারোপিত রাজারা নারী পুরোহিতদের সঙ্গে ইনান্না ও দুমুজিদের বিবাহের পুনরাভিনয় করতেন।[16]:১৫১, ১৫৭–১৫৮ তাঁর পিতামাতার পরিচয় নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন কাহিনি প্রচলিত ছিল।[16]:১০৮ অধিকাংশ পুরাণকথায় তাঁকে সাধারণত নান্না ও নিনগালের কন্যা রূপে বর্ণনা করা হয়েছে।[29]:ix-xi, xvi কিন্তু অন্য কাহিনিগুলিতে বলা হয়েছে যে, তিনি এনকি অথবা আনের কন্যা এবং তাঁর মায়ের নাম অজ্ঞাত।[16]:১০৮ সুমেরীয়দের অন্যান্য দেবদেবীদের তুলনায় ইনান্নাকে নিয়ে পুরাণকথাই বেশি প্রচলিত ছিল।[12]:১০১[29]:xiii, xv এই উপাখ্যানগুলির মধ্যে অনেকগুলির মূল উপজীব্য বিষয় কীভাবে ইনান্না অন্যান্য দেবদেবীদের ক্ষেত্র অন্যায়ভাবে দখল করার চেষ্টা করেছিলেন তার বিবরণ।[31]
উতু ছিলেন সূর্যদেবতা। তাঁর প্রধান উপাসনা কেন্দ্রটি ছিল সিপ্পার শহরের এ-বাব্বার মন্দির।[32] উতুকে প্রধানত ন্যায়বিচার বণ্টনকর্তা মনে করা হত।[13]:১৮৪ মনে করা হত, তিনি ন্যায়নিষ্টকে রক্ষা করেন এবং দুষ্টকে শাস্তি দেন।[13]:১৮৪ নান্না ছিলেন চাঁদ ও প্রজ্ঞার দেবতা। তিনি ছিলেন উতুর বাবা এবং উর শহরের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক দেবতা।[33] তিনি সম্ভবত ইনান্না ও এরেশকিগালেরও বাবা ছিলেন। নান্নার পত্নী ছিলেন নিনগাল।[34] এই নিনগালকেই কোনও কোনও কাহিনিতে উতু, ইনান্না ও এরেশকিগালের মা মনে করা হয়েছে।
এরেশকিগাল ছিলেন সুমেরীয় প্রেতলোকের দেবী। এই প্রেতলোক পরিচিত ছিল কুর নামে।[13]:১৮৪ তিনি ছিলেন ইনান্নার দিদি।[35] পরবর্তীকালের পুরাণকথায় দেবতা নেরগালকে তাঁর স্বামী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[13]:১৮৪ প্রেতলোকের দ্বাররক্ষক ছিলেন দেবতা নেতি।[13]:১৮৪
নাম্মু ছিলেন আদ্যকালীন সমুদ্র (এনগুর)। তিনি আন (স্বর্গ) ও কি-র (পৃথিবী) জন্ম দান করেছিলেন। এঁরাই প্রথম দেবদেবী। ক্রমে কি পরিচিত হন দেবী তিয়ামাত নামে। আন ছিলেন প্রাচীন সুমেরীয়দের স্বর্গদেবতা। তিনিই ছিলেন অন্যান্য সকল প্রধান দেবতার পূর্বপুরুষ[36] এবং উরুক শহরের আদি পৃষ্ঠপোষক দেবতা।
খ্রিস্টপূর্ব ২৩৪০ অব্দে আক্কাদের সারগোন কর্তৃক সুমেরীয়দের অঞ্চল দখলের আগে উত্তর মেসোপটেমিয়ার আক্কাদীয় জাতিগোষ্ঠীর কয়েক প্রজন্ম ধরে সুমেরীয় ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান চলছিল। সুমেরীয় পুরাণ ও ধর্মীয় প্রথাগুলি দ্রুত আক্কাদীয় সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হচ্ছিল।[37] অনুমান করা হয়, সেগুলি ইতিহাসের গর্ভে প্রায় বিলীন মূল আক্কাদীয় ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। সুমেরীয় দেবদেবীদের আক্কাদীয় প্রতিরূপের সৃষ্টি হয়। পরবর্তী ব্যাবিলনীয় ও আসিরীয় শাসনকালের পূর্বাবধি কয়েকজন কার্যতই একই থাকেন। উদাহরণস্বরূপ, সুমেরীয় দেবতা আন আক্কাদীয় প্রতিরূপে হন আনু; সুমেরীয় দেবতা এনকি পরিণত হন এয়ায়। দেবতা নিনুর্তা ও এনলিলের মূল সুমেরীয় নামগুলি বজায় থাকে।
খ্রিস্টপূর্ব সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগের মধ্যে আমোরীয় ব্যাবিলনীয়রা দক্ষিণ মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। পুরনো ব্যাবিলনীয় যুগে সুমেরীয় ও আক্কাদীয় ভাষা দু’টি অব্যাহত রাখা হয়েছিল ধর্মীয় উদ্দেশ্যে। ইতিহাসবিদদের কাছে পরিচিত সুমেরীয় পৌরাণিক সাহিত্যের অধিকাংশেরই রচনাকাল এই পুরনো ব্যাবিলনীয় যুগ।[5] এই সাহিত্য পাওয়া যায় হয় প্রতিলিপিকৃত সুমেরীয় গ্রন্থের আকারে (এগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হল গিলগামেশের মহাকাব্য-এর ব্যাবিলনীয় সংস্করণ) নয় ব্যাবিলনীয় পৌরাণিক সাহিত্যে সুমেরীয় বা আক্কাদীয় প্রভাবের আকারে (এগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য এনুমা এলিশ)। সুমেরীয়-আক্কাদীয় দেবমণ্ডলীর মধ্যে অদলবদল হয়েছিল। এই ক্ষেত্রে নতুন সর্বোচ্চ দেবতা মারদুকের পরিচয়সাধন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পুরনো ব্যাবিলনীয় যুগেই সুমেরীয় দেবী ইনান্নার প্রতিরূপ ইশতারের উদ্ভব ঘটেছিল।
খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দের মধ্যেই হুরীয়রা আক্কাদীয় দেবতা আনুকে নিজেদের দেবমণ্ডলীর অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। অন্যান্য সুমেরীয় ও আক্কাদীয় দেবদেবীরাও হুরীয় দেবমণ্ডলীতে স্থান করে নেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন এয়ার হুরীয় প্রতিরূপ আয়াস; ইশতারের হুরীয় প্রতিরূপ শাউশকা এবং দেবী নিনলিল[38] যাঁর পুরাণকথার ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটিয়েছিল ব্যাবিলনীয়রা।
হিব্রু বাইবেলের প্রাচীনতর অংশে নথিভুক্ত কিছু কাহিনির সঙ্গে সুমেরীয় পুরাণের কিছু গল্পের ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য লক্ষিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, নূহ ও মহাপ্লাবনের যে উপাখ্যান বাইবেলে পাওয়া যায়, তার সঙ্গে নিপ্পুরে আবিষ্কৃত একটি সুমেরীয় ফলকে নথিভুক্ত সুমেরীয় প্লাবন পুরাণকথার আশ্চর্য সাদৃশ্য দেখা যায়।[39]:৯৭–১০১ ইহুদি প্রেতলোক শেওলের বিবরণ সুমেরীয় এরেশকিগাল শাসিত প্রেতলোক কুর ও ব্যাবিলনীয় প্রেতলোক ইরকাল্লার অনুরূপ। সুমের বিশেষজ্ঞ স্যামুয়েল নোয়া ক্রেমার অনেক সুমেরীয় ও আক্কাদীয় "প্রবচন"-এর সঙ্গে পরবর্তীকালের হিব্রু প্রবচনগুলির মিলের কথা উল্লেখ করেছেন। এই প্রবচনগুলির মধ্যে অনেকগুলি হিতোপদেশেও বিবৃত হয়েছে।[40]:১৩৩–১৩৫
আরও দেখুন: মেসোপটেমীয় দেবদেবী
আন | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
নিনহুরসাগ | এনকি নাম্মার সন্তান | নিনকিকুরগা নাম্মার সন্তান | নিসাবা উরাশের সন্তান | হায়া | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
নিনসার | নিনলিল | এনলিল | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
নিনকুর্রা | নিনগাল সম্ভবত এনলিলের কন্যা | নান্না | নেরগাল সম্ভবত এনকির পুত্র | নিনুর্তা সম্ভবত নিনহুরসাগের গর্ভজাত | বাবা উরাশের সন্তান | ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
উত্তু | ইনান্না সম্ভবত এনকির, এনলিলের অথবা আনেরও কন্যা | দুমুজিদ সম্ভবত এনকির পুত্র | উতু | নিনকিগাল নেরগালের পত্নী | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
মেশকিআংগাশের | লুগালবান্দা | নিনসুমুন | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
এনমেরকার | গিলগামেশ | ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
উরনুনগাল | |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.