Loading AI tools
এক ধরনের মস্তকাবরণ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
পাগড়ি বা উষ্ণীশ ( আরবি: العمامة ; ফার্সি : دولبند ) হলো এক ধরনের মস্তকাবরণ, যা একটি লম্বা বিশেষ কাপড় দিয়ে মাথায় পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধা হয়। জাতি ও সংস্কৃতিভেদে পাগড়ি অনেক বৈচিত্র্যময় হয় এবং এটি বিভিন্ন সংস্কৃতির লোকেরা প্রথাগত মস্তকাবরণ হিসাবে পরিধান করে থাকে।[1][2][3] বিশিষ্ট পাগড়ি পরিধান করা ঐতিহ্যবাহী সম্প্রদায়গুলি ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আরব উপদ্বীপ, মধ্যপ্রাচ্য, বলকান, ককেশাস, মধ্য এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা, পশ্চিম আফ্রিকা, পূর্ব আফ্রিকা ও রাশিয়ায় পাওয়া যায়। এছাড়া কিছু তুর্কি জনগোষ্ঠী ও আশকেনাজি ইহুদি সমাজে পাগড়ি পরার প্রচলন আছে। [4]
ধরন | মস্তকাবরণ |
---|---|
উপকরণ | সুতো ও তুলা |
উৎপত্তি স্থল | মধ্যপ্রাচ্য |
প্রস্তুতকারক | বিশ্বের অধিকাংশ দেশ |
প্রবর্তিত | অজানা |
শিখ পুরুষদের মধ্যে পাগড়ি পরা সাধারণ বিষয় এবং কদাচিৎ মহিলাদের মধ্যেও দেখা যায়।[5] পাগড়ি হিন্দু সন্ন্যাসীরাও পরিধান করে থাকে। পাগড়ি একটি ধর্মীয় আদেশ হিসাবেও কাজ করে। শিয়া মুসলিমদের মাঝে এমন প্রচলন রয়েছে, যারা পাগড়ি পরিধানকে সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ (নিশ্চিত পালনীয় সুন্নাত) হিসাবে বিবেচনা করে।[6] এছাড়া পাগড়ি সুফি পণ্ডিতদের ঐতিহ্যবাহী শিরোনামও। উপরন্তু ধর্মীয় পটভূমি নির্বিশেষে পাগড়ি প্রায়ই আভিজাত্যের পরিচয় বহন করে।[4]
পাগড়ির উৎপত্তি হয় মধ্যপ্রাচ্যে। কিছু প্রাচীন সভ্যতা যেমন : মেসোপটেমিয়া, সুমেরীয় এবং ব্যাবিলনীয়রা পাগড়ি ব্যবহার করত। [7][8][9] খ্রিস্টাব্দ ৪০০–৬০০ সময়কালে বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনীর সৈন্যরা সেই অঞ্চলে ফ্যাকিওলিস নামে এক ধরনের পাগড়ি পরত। [10] এছাড়া বেসামরিক বাইজেন্টাইন ব্যক্তিরাও পাগড়ি ব্যবহার করত। [11] আধুনিক তুরস্কেও বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে গ্রীক-ভাষী বংশধরের লোকেরা পাগড়ি পরিধান করত। ইসলামের শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও (৫৭০-৬৩২) সবচেয়ে পবিত্র রঙের একটি পাগড়ি পরতেন। এছাড়া অন্যান্য রঙের পাগড়ি পরারও বর্ণনা পাওয়া যায়।[12]
পাগড়ি পরার যে পদ্ধতি তিনি চালু করেছিলেন, তা হল মাথায় একটি টুপি পরিধান করে তার চারপাশে কাপড় বাঁধা ছিল। এই মস্তকাবরণটি ইমামাহ নামে পরিচিত এবং ইতিহাস জুড়ে মুসলিম রাজা ও পণ্ডিতগণ এই পদ্ধতি অনুকরণ করেছেন। শিয়া পণ্ডিতরা আজ সাদা পাগড়ি পরেন, যদি না তারা নবিজির বংশধর বা সাইয়্যেদ না হন। সাইয়েদ হলে সে ক্ষেত্রে তারা কালো পাগড়ি পরেন। অনেক মুসলিম পুরুষ সবুজ পাগড়ি পরতে পছন্দ করেন। কারণ তা জান্নাতের প্রতিনিধিত্ব করে। বিশেষ করে সুফিবাদের অনুসারীদের মধ্যে এই রঙের পাগড়ি পরার প্রবণতা রয়েছে। উত্তর আফ্রিকার কিছু অংশে সাধারণ নীল রঙের পাগড়ি পরিধানকারী নিজেকে উপজাতি হিসেবে নির্দেশ করতে পারে।[13]
বর্তমান দেশ ও অঞ্চলভেদে ভিন্ন আকার ও রঙের পাগড়ির প্রচলন আছে। উত্তর আফ্রিকা, আফ্রিকার শৃঙ্গ, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া এবং সুলু দ্বীপপুঞ্জের পাগড়ি পরিধানকারী লোকেরা সাধারণত কাপড়ের একটি লম্বা স্ট্রিপ ব্যবহার করে থাকেন এবং প্রতিবার পরার জন্য নতুন করে বাতাস করেন। এদের কাপড়ের দৈর্ঘ্য সাধারণত ৫ মিটারের নিচে হয়। কিছু দক্ষিণ এশীয় পাগড়ি স্থায়ীভাবে তৈরি করা হয় এবং একই ভিত্তিতে সেলাই করা হয়। ভিন্ন অঞ্চল, সংস্কৃতি ও ধর্মের উপর নির্ভর করে পাগড়ি খুব বড় বা বেশ বিনয়ী হতে পারে।[14]
পাগড়ি সাধারণত পূর্ব আফ্রিকায় মুসলিম ধর্মগুরু ও ইথিওপীয় অর্থোডক্স খ্রিস্টান ধর্মযাজকরা পরিধান করেন। এই অঞ্চলে মাথায় আবরণ পরার একটি দীর্ঘ প্রচলন রয়েছে এবং সেখানে প্রায়শ সুলতান, উজির, অভিজাত ব্যক্তিবর্গ ও দরবারের কর্মকর্তারা পরিধান করত। এই অভিজাতদের মধ্যে ইসহাক সালতানাতের সোমালি সুলতান ডেরিয়া হাসান, ওয়ারসাঙ্গালির মুহম্মদ আলী শিরে, মাজিরটিন সালতানাতের ওসমান মাহামুদ এবং হোবিও সালতানাতের ইউসুফ আলী কেনাদিদ ও আলী ইউসুফ কেনাদিদ । এই অঞ্চলের বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ইসলামি নেতারা, যারা পাগড়ি পরা বলে পরিচিত তাদের মধ্যে রয়েছেন শেখ আবাদির উমর আর-রিদা। এটি সাধারণত ম্যাকাউইস (সারং) বা জেলবিয়ার সাথে পরা হয়।[14]
আরব উপদ্বীপের বেশিরভাগ দেশে একটি সমতল বা চেকারযুক্ত স্কার্ফ (যাকে বলা হয় শেমাঘ বা শেফিয়াহ ) কাপড়ের টুকরো পরিধান করা হয় এবং [15] এটিকে সাধারণত পাগড়ি হিসাবে বর্ণনা করা হয় না।[16] তবে ওমানে আরবি ইমামার ঐতিহ্য এখনো শক্তিশালী এবং এটি সে দেশের পোষাকের অন্তর্ভুক্ত। সুদান ও আরব উপদ্বীপের কিছু অংশে গাবানাহ নামে একটি রঙিন পাগড়ি প্রচলিত আছে। হিজাজ অঞ্চলে এটি সাধারণ উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত একটি সাংস্কৃতিক পাগড়ি এবং এটি এখনো মক্কা, মদিনা এবং জেদ্দার বাসিন্দাদের পোশাকের অংশ। [17] গাবানা হল ঐতিহ্যবাহী এবং মর্যাদাপূর্ণ পোশাকীয় মস্তকাবরণ। এটি ব্যবসায়ী এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সাধারণ সম্প্রদায়ের জন্য মর্যাদাপূর্ণ পোশাক। তবে ধর্মীয় পণ্ডিতদের জন্য বিশেষ স্বতন্ত্র পাগড়ির প্রচলন আছে এবং এটি প্রধানত সাদা রঙের হয়ে থাকে। এই পাগড়ি হল ইসলাম ধর্মের শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাগড়ির সম্প্রসারণ, যা তিনি জীবদ্দশায় পরিধান করতেন এবং তিনি মক্কা ও মদীনায় থাকতেন বলে এই পাগড়ি এই অঞ্চলে প্রচলিত আছে। তবে এই পাগড়ি মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশের আলেমগণও পরিধান করেন এবং এটিকে ধর্মীয় পোশাকের অন্তর্ভুক্ত মনে করা হয়।
গাবানাহ'র বিভিন্ন প্রকার রয়েছে। সবচেয়ে বিখ্যাত হল হলুদ রঙের (হালাবি), যা আলেপ্পোতে তৈরি। এটি বিভিন্ন শিলালিপি দ্বারা চিহ্নিত করা হয় এবং একটি গম্বুজের মতো ফাঁপা তাকিয়াহ বা তুর্কি ফেজ/ কাল্পাক টুপিতে মোড়ানো হয়। মাসার নামে এক ধরনের রঙিন পাগড়ি ওমানের জাতীয় মস্তকাবরণ পোশাক। তবে এটি ইয়েমেন ও হাজরামাউতের দক্ষিণে কিছু অঞ্চলে এর প্রচলন অতি সাধারণ। অধিকন্তু, সাদা শুমাঘ সাধারণত হামদানিয়া শৈলীতে মোড়ানো হয় এবং এটি সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাগড়ির আকারের মত হয়।
ফিলিস্তিনে কেফিয়াহ নামে একধরনের মস্তকাবরণের প্রচলন আছে এবং এটিকে বিপ্লবের প্রতীক মনে করা হয়। এটি এক ধরনের স্কার্ফ, যা সাধারণত গলায় বা মাথায় আগল দিয়ে পরা হয়। ফিলিস্তিনি কেফিয়াহ এখন একটি ফিলিস্তিনি জাতীয় প্রতীক হয়ে উঠেছে এবং এর ব্যবহার আরব অঞ্চলকে অতিক্রম করে সারাবিশ্বে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছে। এটিকে ইসরায়েলের সাথে সংঘাতে ফিলিস্তিনিদের সাথে সংহতি প্রদর্শনের একটি মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হয় এবং সাধারণভাবে এটি বিশ্বের আন্তর্জাতিকতাবাদী বাম কর্মীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।[18][19]
পাগড়ি আফগানিস্তানের জাতীয় পোশাকের অন্তর্গত। আফগানিস্তানে মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য জায়গার তুলনায় এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় এবং শৈলী ও রঙের বিস্তৃত পরিসরে পরিধান করা হয়। স্থানীয়ভাবে পাগড়িকে লুঙ্গি বলা হয়। দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে পাগড়ি সাধারণত ঢিলেঢালাভাবে মোড়ানো হয়। তবে কাবুলে এটি ছোট ও আঁটসাঁট হয়ে থাকে। ঐতিহ্যবাহী আফগান সমাজেপাতু নামক কাপড়ের একটি অতিরিক্ত অংশ ব্যবহৃত হয়, যা ঠান্ডা থেকে বাঁচা, বসা, পশু বেঁধে রাখা বা টুপিতে জল বহন করার কাজে আসে। আফগানিস্তানের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী বিভিন্ন প্যাটার্ন, পদ্ধতি, দৈর্ঘ্য ও রঙসহ বিভিন্ন লুঙ্গি পরিধান করে। সমস্ত জাতির পুরুষরা সাধারণত উজ্জ্বল রঙের পাগড়ি পরা এড়িয়ে চলে, যা নিজের প্রতি অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তারা সাদা, ধূসর, গাঢ় নীল ও কালো সাদা রঙের সাধারণ রঙের লুঙ্গি পরতে পছন্দ করে।[20]
এটি ঐতিহ্যগতভাবে তালেবান সদস্যরা ব্যাপকভাবে পরিধান করে থাকে। তাই অনেক জায়গায় এটিকে তালেবানের পাগড়িও বলা হয়। তবে সাধারণভাবে এটি আফগান পাগড়ি বা আফগান লুঙ্গি নামে প্রসিদ্ধ।
বাংলাদেশে পাগড়ি পাগড়ি নামেই পরিচিত। চট্টগ্রাম ও সিলেটে ফাগরি বলা হয়। পাগরি ধর্মীয় নেতা এবং ইসলাম প্রচারকরা পরিধান করে থাকেন। সাধারণ মুসলিম সমাজে পাগড়ি পরার প্রচলন তেমন নেই। বাংলাদেশে পাগড়ির সবচেয়ে সাধারণ রং হল সাদা। তবে সুফিবাদের অনুসারীরা সাধারণত সবুজ পাগড়ি পরেন। এটি গ্রামীণ এলাকার প্রবীণরা সম্মান এবং সম্মানের প্রতীক হিসাবেও পরিধান করে।
বাংলাদেশের প্রায় সকল কওমি মাদরাসায় বিভিন্ন স্তরের সমাপনী শিক্ষার্থীদের সম্মানসূচক পাগড়ি প্রদান করা হয় এবং কওমি মাদরাসায় এটি একটি ঐতিহ্য হিসেবে পালন করা হয়।[21][22]
মায়ানমারে পাগড়িকে গাউং বাউং বলা হয় এবং এটিকে বেশ কিছু আঞ্চলিক শৈলীতে পরিধান করা হয়।[14]
মালয়েশিয়ায় নির্দিষ্ট মুসলিম আলেম এবং সার্বান শিখ গিয়াররা পাগড়ি পরিধান করে থাকেন।[14]
ভারতেও পাগড়িকে পাগরি নামে পরিচিত এবং এর করা হয়, পুরুষদের মাথায় পরিধান করার কাপড়ের বিশেষ টুকরো। ভারতে পাগড়ি পরার বেশ কয়েকটি শৈলী রয়েছে, যা পরিধানকারীর অঞ্চল বা ধর্মের জন্য নির্দিষ্ট হয় এবং সেগুলি আকৃতি, আকার এবং রঙে পরিবর্তিত হয়। যেমন : মহীশূরী পেটা, মারাঠি ফেটা, পুনেরি পাগাদি।[23][24] পাগড়িকে সর্বত্র সম্মান এবং সম্মানের প্রতীক হিসেবে পরিধান করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ অতিথিদের একটি পাগড়ি পরার প্রস্তাব দিয়ে সম্মান করা একটি সাধারণ রেওয়াজ।
পাগড়ির রঙ প্রায়শ অনুষ্ঠান বা পরিস্থিতি অনুসারে বেছে নেওয়া হয়। যেমন: জাফরান বীরত্ব (আত্মত্যাগ) বোঝাতে; সমাবেশের সময় পরা হয় সাদা, যা শান্তির প্রতীক; বসন্ত ঋতু বা বিয়ের অনুষ্ঠানে গোলাপী রং পরা হয়। বলা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছু সৈন্যের পাগড়ি পরা বাধ্যতামূলক ছিল। ব্রিটিশ ভারতে শিখদের পাগড়ি পরার জন্য আন্দোলনও করতে হয়েছিল।[14][25]
ইন্দোনেশিয়ায় পুরুষদের পাগড়িকে ঐতিহ্যগতভাবে ইকেট বলা হয় (জাভাই সুন্দানীয় ভাষা থেকে)। [26] এর আক্ষরিক অর্থ হল 'বেঁধে দেওয়া'। এটি একটি বর্গাকার বা আয়তক্ষেত্রাকার বাটিক কাপড় দিয়ে তৈরি, যা একটি ত্রিভুজ গঠনের জন্য তির্যকভাবে ভাঁজ করা হয়। ইকেটের উৎস আজ পর্যন্ত স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়নি। তবে অনেক সূত্র এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, সম্ভবত জাভাইরা পাগড়ি পরিহিত গুজরাতি ব্যবসায়ীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পাগড়ি পরা শুরু করেছে, যারা ৫০০ বছরেরও বেশি আগে ইন্দোনেশিয়ায় এসেছিলেন।[26]
জাভার অন্যান্য অংশে ব্যবহারের জন্য ইকেট স্থির-আকৃতির কলগিতে বিকশিত হয়েছে, যাকে সেন্ট্রাল জাভাতে ব্লাংকন এবং যোগকার্তা ও পশ্চিম জাভাতে বেন্ডো বলা হয়। পূর্ব জাভা ও বালিতে কলগি এখনো ঐতিহ্যগত উপায়ে তৈরি করা হয় এবং একে উডেং বলা হয়। বাটিক কাপড়কে ঢালাই করা শক্ত কাগজের সাথে সংযুক্ত করে সেলাইয়ের মাধ্যমে এটিকে শক্ত করা হয়। ইকেটের মতই ব্লাংকোন ও বেন্ডো উৎপত্তির ক্ষেত্র এবং পরিধানকারীর সামাজিক পদমর্যাদার উপর ভিত্তি করে আকারের কিছু বৈচিত্র্য নিয়ে আসে।[26]
নেপালে পাগড়ি সাধারণত গ্রামীণ এলাকায় পুরুষরা পরিধান করে। গ্রামীণ পাগড়িকে বলা হয় পগদি বা ফেটা। এটি কৃষকদের মধ্যে সাধারণভাবে প্রচলিত। ফেটার জন্য সব ধরনের রঙিন কাপড় ব্যবহার করা হতো। ঐতিহাসিকভাবে গোর্খালি সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা নেপালের রাজা কর্তৃক পুরস্কৃত শিরপাউ নামক সাদা পাগড়ি পরতেন। যেমন: সরদার রামকৃষ্ণ কুনওয়ারকে গোর্খালি রাজা পৃথ্বী নারায়ণ শাহ কর্তৃক শিরপাউ নামক ২২ জোড়া মস্তকাবরণে ভূষিত করা হয়েছিল। অন্যান্য সমসাময়িক রাজ্যের অভিজাতদের মধ্যেও এটির ব্যবহার সাধারণ ছিল।[27]
পাকিস্তানে পাগড়ি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় ; বিশেষ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে। এটি দেশ জুড়ে বিভিন্ন শৈলী ও রঙে পরিধান করা হয় এনং অঞ্চলভেদে তা পরিবর্তিত হয়। যেমন: দেশের উত্তরে কালো ও সাদা পাগড়ি পছন্দ করা হয়। পাকিস্তানে সবচেয়ে বেশি যে পাগড়ি পাওয়া যায়, তা সাদা ও ক্রেস্টলেস হয় এবং সাধারণত পশতুন অঞ্চলে পরিধান করা হয়। গ্রামীণ পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে এটি বেশিরভাগ প্রবীণ বা সামন্ত ব্যক্তিরা পরিধান করে। পাগড়িকে পাঞ্জাবীরা পাগরি বা পাগ বলে এবং পশতুন ও সিন্ধিরা একে পাটকে বা পাটকো বলে।[28][29]
বেলুচ জনগণ তাদের বৃহৎ পাগড়ির জন্য বিখ্যাত, যা উভয় প্রান্তে ঝুলন্ত বা বুকের উপরে থাকা লুপ হিসাবে পরা হয়। এই পাগড়িগুলি অনেক পায়ের কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয়, যা একটি টুপির চারপাশে আবৃত থাকে এবং বেশিরভাগ সাদা কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয়।
যু্ক্তরাজ্যে ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে পুরুষ ও মহিলা উভয় পাগড়ি পরিধান করে আসছে। তবে এটি খুব সাধারণ হয়ে ওঠেনি। কবি আলেকজান্ডার পোপকে মাঝে মাঝে পাগড়ি পরিহিত চিত্রিত করা হয়। এটি অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পুরুষদের সমসাময়িক চিত্রকর্ম এবং চিত্রগুলিতে দেখা যায়। যুক্তরাজ্যে পাগড়ি মূলত পশ্চিম ভারতীয় বংশোদ্ভূত কারিনাস মহিলারা পরে থাকে। কিছু মহিলা নিজের ব্যক্তিত্বের বিবৃতি দেওয়ার জন্য এগুলি পরিধান করেন; যেমন ব্রিটিশ সামাজিক উদ্যোক্তা ক্যামিলা ব্যাটম্যানগেলিডজ, যিনি সাধারণত একটি রঙিন ম্যাচিং পাগড়ি এবং পোশাক পরেন।[30]
গ্রীসে বিশেষ করে ক্রিট দ্বীপে পুরুষরা ঐতিহ্যগতভাবে একটি পাগড়ি পরিধান করেন, যা সাধারণত সারিকি নামে পরিচিত। সারিকি পাগড়ির তুর্কি প্রতিশব্দ। [31] তবে আজকাল এটি কৃত্তিকো মান্দিলি নামে অধিক পরিচিত। এটি সাধারণত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে পাওয়া যায় না ; বরং বেশিরভাগই প্রত্যন্ত, পাহাড়ী গ্রামে বয়স্ক পুরুষরা এটি পরিধান করে থাকে।[31]
ফিজির আইতাকেই আদিবাসীর প্রধান ও পুরোহিতরা তাদের মাথার চারপাশে পাগড়ির মতো একটি মাসি ( বার্কক্লথ ) আবরণ পরিধান করতেন বলে প্রচলিত আছে, যাকে বলা হয় আই-সালা। [32] [33]
ফিলিপাইনে পাগড়ির একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, যা স্থানীয় অস্ট্রোনেশীয় (মালয় ও পলিনেশিয়) সংস্কৃতির সাথে যুক্ত। মুসলিম ফিলিপিনো মহিলাদের পরিহিত সবচেয়ে সাধারণ পাগড়িটিকে বলা হয় কম্বং।[34] এটি মিন্দানাওর দাভাও অঞ্চলের মুসলিম মহিলাদের হিজাবের ঐতিহ্যবাহী শৈলী। কম্বং একটি মস্তকাবরণ হিসাবে পরা হয় এবং একে তুডং বা হেডস্কার্ফের সাথে জোড়া দেওয়া হয়, যা দিয়ে সাধারণত বুক বা কাঁধের উপরের অংশ ঢেকে রাখা হয়। কিন্তু নামাজের সময় কম্বং উপরের অংশে পরা হয় অথবা বাইরে যাওয়ার সময় এটিকে অতিরিক্ত ওড়না হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সাদা কম্বং বোঝায় যে, এর পরিধানকারী মক্কা থেকে হজ করে এসেছেন। সাদা কম্বং পরিধানকারীকে হাদজা হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এটি সেই মুসলিম মহিলাকে দেওয়া হয়, যিনি হজে গেছেন।[34]
পুরুষদের ব্যবহৃত সবচেয়ে সাধারণ পাগড়িকে বলা হয় পুটং, পোটং বা পুডং।[35] পুটং ঐতিহাসিকভাবে ১৭ শতকের মাঝামাঝি আগে বিসায়া, ইলকানো এবং তাগালগের মতো দেশের প্রায় সমস্ত প্রধান প্রধান ভাষাগত জাতিগোষ্ঠীর পুরুষরা পরিধান করত। কিন্তু স্পেনীয় ও মার্কিন উপনিবেশকালে উত্তরে ক্যাথলিক ধর্মের আগমনের পর থেকে পশ্চিমী টুপির ব্যবহারের ফলে এটি হ্রাস পেয়েছে। প্রাক ঔপনিবেশিক যুগে সামাজিক বর্ণ বোঝাতে পুডং এর পরিধানকারীরা বিভিন্ন স্বতন্ত্র রঙে রঙ্গিন হত। নীল শুধুমাত্র ম্যাগিনু আভিজাত্য শ্রেণীর জন্য ; মহরলিকা যোদ্ধা শ্রেণীর জন্য লাল পুটং এবং ক্রীতদাস বর্ণের জন্য হলুদ বা প্রাকৃতিক রঙের মতো অন্যান্য রং বরাদ্দ ছিল।
বর্তমান পাগড়ি মূলত মুসলিম ফিলিপিনো পুরুষরা পরিধান করে, বিশেষ করে ইমাম ও উলামা (ইসলামী পন্ডিত) শ্রেণীর লোকেরা। তবে অমুসলিম গোষ্ঠীগুলির লোকেরাও এটি পরিধান করে। পুটং মুসলিমদের মধ্যে এর পরিধানকারীর বিশেষ মর্যাদা বা সম্মানের প্রতি নির্দেশ করতে পারে। মুসলিম পুরুষ ও ইমামদের মধ্যে যারা হজ করে এসেছেন তারা ঐতিহ্যগতভাবে পুটং হিসাবে কুফিয়াহ পরতে পছন্দ করেন। ফিলিপাইনে ফেরার আগে এটি সাধারণত সৌদি আরবে কেনা হয় এবং এতে বোঝা যায় যে, তারা হাজ্জি। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দেশের দক্ষিণে তরুণ জিহাদি গোষ্ঠীগুলি কুফিয়াহকে তারা চরমপন্থী তাকফিরি গোষ্ঠীর সদস্য হিসাবে চিহ্নিত করার জন্য ব্যবহার করার কারণে এর ব্যবহার বর্তমান হ্রাস পেয়েছে।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সুলু দ্বীপপুঞ্জে তৌসুগ ও ইয়াকান পুরুষরা পিস সাবিত পরিধান করে থাকে। এটি একটি অলঙ্কৃত হেডস্কার্ফ যা পাগড়ি মতই পরিধান করা হয়। বড় পিস সাবিত পাগড়ির মত হয় এবং ছোট পিসগুলি ব্যান্ডানার মত হয়। ফিলিপাইনে পাওয়া অন্যান্য পুটং-এর মত পিসের আকার বা নকশা এর পরিধানকারীর সামাজিক মর্যাদা বা বর্ণ নির্দেশ করতে পারে।
দেশের সুদূর উত্তরে বাবুইয়ান দ্বীপে কিছু পরিবারের প্রধান একটি সাদা পাগড়ি পরেন এবং ছোট পুরুষরা তাদের ১৩ তম জন্মদিনের পরে একটি লাল পাগড়ি পরেন। তবে এর কোনো ধর্মীয় তাৎপর্য নেই এবং এর উৎপত্তি টোন্ডো যুগের শেষের দিকে ( ৯০০-১৫৮৯)। ১৫৮৯ সালে স্পেন যখন ফিলিপাইনে আক্রমণ শুরু করে তখন বেশিরভাগ বাবুয়ান বসতিকারী ফিলিপাইন ছেড়ে পালিয়ে যায়। পাগড়িটি এক ধরনের ছালের কাপড় থেকে তৈরি করা হত, কিন্তু এখন ফিলিপাইনের মূল ভূখণ্ড থেকে আনা তুলা বা সিল্ক দিয়ে তৈরি করা হয়।
সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগত ভিয়েতনামীরা বিভিন্ন ধরনের টুপির পাশাপাশি পাগড়িও পরিধান করত এবং একে ভিয়েতনামি ভাষায় khan vấn বা khan đóng বলা হয়।[36] এছাড়া উত্তর ভিয়েতনাম এবং দক্ষিণ চীনের আশেপাশের বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠী, যেমন : ঝুয়াং, হ্মং ও ইয়ের লোকেরাও পাগড়ি পরিধান করে থাকে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং উত্তর-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য অংশের অনেক জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেও পাগড়ি একটি সাধারণ পোশাক।
আর্মেনিয়ার বেশিরভাগ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি মধ্যপ্রাচ্য থেকে উৎপত্তি হয়েছে। যদিও প্রতিদিনের পোশাকে পাগড়ি সেখানে সাধারণ পোশাকের অংশ নয়, তবে উদযাপন ও উৎসবের সময় জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক হিসাবে কখনো কখনো পুরুষরা আনুষ্ঠানিকভাবে পাগড়ি পরিধান করে। তবে আর্মেনিয়া খ্রিস্টান জাতি হওয়ার আগে অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির মতোই পাগড়ি তাদের দৈনন্দিন পোশাকের একটি সাধারণ অংশ ছিল। বর্তমান আর্মেনীয় পুরুষরা আরখচিন নামে একধরনের টুপি পরিধান করে।[37]
সোয়াহিলি উপকূলে জাঞ্জিবারের ক্ষমতাসীন ওমানি সুলতানরা এবং তাদের অবসরপ্রাপ্তরা প্রায়ই পাগড়ি পরতেন। তুয়ারেগ বার্বার, উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকার কিছু বারবার সম্প্রদায়, সাহরাউই, সোনহাই, ওদাবে, ফুলানি এবং হাউসা জাতির লোকেরা বিভিন্ন ধরনের পাগড়ি পরে। তুয়ারেগ বার্বাররা প্রায়ই ধুলো আটকাতে মুখ আবরণ হিসেবে পাগড়ি পরে, যা লিসাম হিসাবে পরিচিত এবং এগুলি প্রায়ই নীল রঙের হয়।[38] উত্তর আফ্রিকার বেদুইন উপজাতির সদস্যরাও কখনো কখনো বাদামী, সাদা বা কমলা রঙের পাগড়ি পরে। কলম্বিয়ার রাজনীতিবিদ পিয়াদাদ কর্ডোবা পাগড়ি (বা অনুরূপ মস্তকাবরণ) পরার জন্যে পরিচিত এবং তার পাগড়ি ব্যবহার তাকে কলম্বিয়ার সংস্কৃতিতে The lady with the turban (পাগড়ি পরিহিত মহিলা) ডাকনাম অর্জনে সহায়তা করেছে।
কুর্দি লোকেরা পাগড়ি পরে যাকে তারা জামাদানী বলে। ইরাকি কুর্দিস্তান জুড়ে এটি আঞ্চলিক শৈলীর উপর নির্ভর করে বিভিন্ন উপায়ে পরিধান করা হয়। যেমন: বারজানি কুর্দিরা এমন একটি উপজাতি, যারা পাগড়িকে একটি রঙ (লাল এবং সাদা) এবং শৈলীতে পরিধান করে, যা তাদের বংশের বৈশিষ্ট্য বহন করে। দক্ষিণ কুর্দিস্তানের বেশিরভাগ অংশে জামাদানির জন্য কালো-সাদা প্যাটার্ন ব্যবহার করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কুর্দি পাগড়িতে ডোরাকাটা কাপড় থাকে, যা কোলগি নামে পরিচিত। এটি একটি শঙ্কুযুক্ত টুপির চারপাশে ছড়িয়ে থাকে। বর্তমান অনেক কুর্দি কালো ও সাদা ঘুটরা ব্যবহার করে এবং তা তাদের পাগড়িতে গড়িয়ে দেয়।[39]
পাগড়িও পশ্চিমা দেশগুলিতে মহিলারা এক ধরনের মস্তকাবরণ পরিধান করে। পশ্চিমা সমাজে মহিলাদের এই ধরনের পাগড়ি পরা ২০ শতকের আগের তুলনায় অতি সাধারণ ব্যাপার। পাগড়ি কখনো কখনো চুলের সুরক্ষার জন্য বা কেমোথেরাপি পরে মহিলাদের মাথার মোড়া হিসাবে পরিধান করা হয়।[40]
ইসলামি সংস্কৃতিতে পাগড়ি বেশ গুরুত্ব বহন করেন। বিভিন্ন সহিহ হাদিসে পাওয়া যায় যে, নবি মুহাম্মাদ সা. সর্বদা পাগড়ি পরিধান করতেন এবং তিনি সাধারণত কালো বা সাদা পাগড়ি পরতেন।[41] [42] [43] [44] [45] বিখ্যাত সাহাবি জাবির রা. বলেন, মক্কা বিজয়ের দিন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় প্রবেশ করলেন, তখন তাঁর মাথায় কালো পাগড়ি ছিল।[46][47] এসব বর্ণনার আলোকে অনেক মুসলিম পণ্ডিত পাগড়ি পরিধান করাকে মুস্তাহাব আখ্যায়িত করেছেন।[48][49][50][51][17]
মুসলিম দেশগুলিতে পাগড়ি বিভিন্ন পদ্ধতিতে পরিধান করা হয় এবং অঞ্চল ও সংস্কৃতির উপর নির্ভর করে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। আরবি ভাষায় একে ইমামাহ এবং ফার্সি ভাষায় দস্তার বা দুলবন্দ বলা হয়। শিয়া ইসলামে একটি ছোট সাদা টুপির চারপাশে একটি কালো পাগড়ি মাথায় মোড়ানো হয় এবং পরিধানকারী নিজেদের সাইয়্যিদ বলে দাবি করে। অন্যান্য সুশিক্ষিত ব্যক্তি ও আলেমগণ সাধারণত সাদা পাগড়ি পরিধান করেন। সুফি মুসলিমরা প্রায়ই একটি ছোট টুপি বা মাথার মোড়কের চারপাশে একটি সবুজ মাথার মোড়ক পরেন। দাওয়াতে ইসলামী আন্দোলনের সদস্যরা সবুজ পাগড়ি পরেন। [52] তবে সুন্নি দাওয়াতে ইসলামির সদস্যরা (যারা ১৯৯২ সালে দাওয়াতে ইসলামী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল) সাদা পাগড়ি পরেন। [52] সুদানে বড় সাদা পাগড়ি উচ্চ সামাজিক মর্যাদা বোঝায়।
মুসলিম মহিলারা সাধারণত পাগড়ি পরিধান করে না। কারণ পাগড়ি সাধারণত একজন পুরুষের পোশাকের অংশ হিসাবে বিবেচিত হয় এবং মহিলারা সাধারণত হিজাবের অংশ হিসাবে তাদের চুল ঢেকে রাখে। তবে কিছু মুসলিম মহিলা যেমন মাথার আচ্ছাদন পরেন না; তেমনি কিছু আধুনিক মুসলিম মহিলা পাগড়ি শৈলীর আচ্ছাদন পরেন। যদিও এটি ইসলামী সম্প্রদায়ের কাছে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।[53]
কেনিয়াতে আকুরিনু নামে একটি খ্রিস্টান সম্প্রদায় ধর্মীয় মস্তকাবরণ হিসাবে পাগড়ি পরিধান করে। এই সম্প্রদায়ের দেওয়া আনুষ্ঠানিক নাম হল দ্য কেনিয়া ফাউন্ডেশন অফ দ্য প্রফেটস চার্চ বা হলি ঘোস্ট চার্চ। পুরুষ ও মহিলা উভয়ই সাদা পাগড়ি পরেন; শিশুরা টিউনিক পরে। কিছু প্রাচ্যদেশীয় অর্থোডক্স চার্চ যেমন কিবতীয় অর্থোডক্স চার্চ ও সিরীয় অর্থোডক্স চার্চ যাজকের জন্য পোশাকের মধ্যে পাগড়ি অন্তর্ভুক্ত করে।
ইহুদি মহাযাজক যখন জেরুজালেমের তাম্বু ও মন্দিরে সেবা করতেন, তখন তিনি একটি মাথার আচ্ছাদন পরিধান করতেন, যার নাম মিটজনেফেট (מִצְנֶפֶת)। [54] এই শব্দটিকে মিটার (KJV) বা হেডড্রেস হিসাবে অনুবাদ করা হয়। এটি সম্ভবত একটি পাগড়ি ছিল। কারণ শব্দটি একটি এমন মূল থেকে এসেছে যার অর্থ 'মোড়ানো'। হিব্রু বাইবেলে মহাযাজকের পরা পাগড়িটি পুরোহিতদের মাথার আবরণের চেয়ে অনেক বড় ছিল এবং ফুলের মতো একটি চওড়া, চ্যাপ্টা-শীর্ষ আকৃতি তৈরি করতে ক্ষত ছিল। পুরোহিতদের মাথার আবরণ ভিন্ন ছিল, যাকে মিগবাহাত বলা হয়।
তালমুদ অনুসারে পাগড়ি পরা ইস্রায়েলের সন্তানদের পক্ষ থেকে অহংকার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছিল।ইহুদিরা যারা মধ্যযুগে আরব শাসনের অধীনে বসবাস করত। বিশেষ করে ইসলামি স্পেনে তারা পাগড়ি এবং হেডওয়্যার পরতেন, যা তাদের মুসলিম সমকক্ষদের থেকে খুব বেশি আলাদা ছিল না। কিছু বিবাহিত ইহুদি মহিলা বিনয়ের একটি কাজ হিসাবে মিগবাহাত পরে থাকে।[55]
মেন্দীয় পুরোহিতরা সাদা পাগড়ি পরেন, যা বুরজিনকা নামে পরিচিত। [56]
হিন্দুধর্মে অনেক রাজপুত সাংস্কৃতিক কারণে এটি পরিধান করে। এটি একটি সাংস্কৃতিক অনুশীলন, যা ভারতে বিশেষ করে রাজস্থান রাজ্যে কঠোর গ্রীষ্মের মাসে পরা হয়। এটি রাজস্থানের গুর্জররাও পরিধান করে। পাগড়ি ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন অংশে আরও বেশ কিছু মস্তকাবরণ এবং বিভিন্ন ধরনের পাগড়ি ব্যবহার করা হয় এবং লোকেরা বিশেষ করে গ্রামে যাওয়ার সময় সেগুলি পরে। হিন্দুধর্মের পুরোহিতদের মাঝে গেরুয়া রঙের পাগড়ি পরার রেওয়াজ আছে।[57]
রাস্তাফারি আন্দোলনের বোবো আশান্তি ম্যানশনের সদস্যরা তাদের চুল ও দাড়ি রাখে এবং মাথায় পাগড়ি পরে থাকে। তারা ১৯৫০-এর দশকে তাদের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পোশাকের অংশ হিসেবে পাগড়ি পরিধান করে আসছে। [58] যেহেতু তারা তুলনামূলকভাবে ছোট জনসংখ্যা তাই পাগড়িসহ পোশাক তাদের জ্যামাইকা এবং অন্য কোথাও চেহারায় স্বতন্ত্র করে তোলে। [59]
শিখ পাগড়ি, যা দস্তার বা দুমাল্লা নামে পরিচিত তা সাধারণত অন্যদের দেখানোর জন্য ব্যবহৃত হয় যে, তারা শিখ শিক্ষার মূর্ত প্রতীক এবং গুরুর প্রতি তাদের ভালবাসা ও সম্মান রয়েছে।[60] শিখ গুরুরা নিশ্চিত করেন যে, পুরুষ এবং মহিলা উভয়ই পাগড়ি পরতে পারবে। পাগড়ির অন্যান্য উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে, শিখদের লম্বা ছেঁড়া চুল রক্ষা করা এবং তা পরিষ্কার রাখা।[60] শিখরা একটি ধর্মীয় পালন হিসাবে তাদের চুল কাটে না। তাই পাগড়ি তাদের চুল রক্ষা করে এবং পরিষ্কার রাখে। যেহেতু শিখরা ভারতের জনসংখ্যার ১.৭% এবং কানাডার জনসংখ্যার ১.৫%, তাই পাগড়ি তাদের সনাক্ত করতে সহায়তা করে।
পাগড়ি পূর্বে কেবল উচ্চ শ্রেণীর জন্যে বিশেষিত ছিল এবং সাংস্কৃতিক অভিজাতদের অনেক পুরুষ এখনো পাগড়ি পরেন। পাগড়ি উচ্চ শ্রেণী (সরদার) ও সাধারণ জনগণের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতো। গুরু গোবিন্দ সিং পাগড়ির সাথে যুক্ত শ্রেণীব্যবস্থা দূর করার জন্য প্রত্যেক শিখকে সর্দার ঘোষণা করেন এবং বর্তমান সকল শিখ পাগড়ি পরতে পারে।[60]
আধুনিক শিখ পুরুষরা প্রধানত চার ধরনের পাগড়ি পরিধান করে: বত্তন ওয়ালি পাগড়ি, অমৃতসর শাহী পাগড়ি, বারনালা শাহী ও তাকসালি দুমালা। আরও ঐতিহ্যবাহী পাগড়ি শৈলী হলো: দরবারা সিং দুমলা, দস্তর বুঙ্গা (খালসার আসল পাগড়ি) ও পুরাতন নক পাগ।
শিখদের পরিধান করা সবচেয়ে সাধারণ পাগড়ির রঙ হল নীল, সাদা ও কালো। যদিও অন্যান্য রঙও খুব জনপ্রিয়, তবে নীল এবং হলুদ বিশেষভাবে মর্যাদাপূর্ণ এবং বৈশাখীর মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পরার প্রবণতা রয়েছে। সাদা পাগড়ি পরার অর্থ হল, একজন সাধু ব্যক্তি, যিনি একটি আদর্শ জীবনযাপন করছেন এবং সাদা রঙের অফ-শেড মানে কেউ শিখ ধর্মে শিখছেন। নীল পাগড়ি আকাশের মতো বিস্তৃত মনকে বোঝায়, যেখানে কুসংস্কারের কোনো স্থান নেই। কালো পাগড়ি ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের একটি অনুস্মারক হিসাবে কাজ করে এবং এটি নম্রতার প্রতিনিধিত্ব করে। বাসন্তী বা হলুদ পাগড়ি বিপ্লব বা আন্দোলনের সাথে জড়িত এবং সর্দার ভগত সিং এই কারণে হলুদ পাগড়ি পরতেন। রয়্যাল ব্লু সাধারণত যারা শিখ ধর্মে শেখা এবং তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রেমিক হয় তারা পরিধান করে। সবুজ রঙ কৃষকদের বোঝায়। কমলা পাগড়ি মানে হল সাহস ও প্রজ্ঞা।
সোনার রঙ শান্ত ও নিরাময়ের অনুভূতির প্রতীক, যা দুশ্চিন্তা দূর করে এবং মনকে পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। পাগড়ির রঙ শিখদের একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ককে প্রতিফলিত করতে পারে। যদিও জনপ্রিয় পাগড়ির রঙের কোনটিই কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য একচেটিয়া নয়। বিবাহে শিখদের পছন্দের রঙ হল গোলাপী। কেউ কেউ বিবাহের জন্য লাল বা কমলা পাগড়ি পছন্দ করলেও গোলাপী এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয়। শিখধর্মে পাগড়ির রঙ সাধারণত ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়। শিখ পুরুষরা ফ্যাশন বা স্বাদের উপর ভিত্তি করে রং বেছে নেয় এবং কখনও কখনও পোশাকের সাথে ম্যাচ করে পাগড়ি পরিধান করে। কিছু রঙের সাথে ঐতিহ্যের সম্পর্ক আছে। যেমন: কমলা এবং কালো প্রায়ই রাজনৈতিক প্রতিবাদ সমাবেশে পরিধান করা হয় এবং লাল ও গোলাপী পাগড়ি বিবাহ এবং অন্যান্য উদযাপন অনুষ্ঠানে পরা হয়। [61] [62]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.