Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষণ বলতে বোঝানো হয় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহায়তাকারীদের দ্বারা সংঘটিত ধর্ষণ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনীর সদস্যরা দুই থেকে চার লক্ষ বাঙালি নারীকে ধর্ষণ করে।[1][2][3][4] গবেষকদের মতে, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলিম এবং সংখ্যালঘু হিন্দু উভয় সম্প্রদায়কে ভীতসন্ত্রস্ত করতে এই ধর্ষণ চালানো হয়েছিল। এর ফলে হাজার হাজার নারী গর্ভধারণ করেন, যুদ্ধশিশুর জন্ম হয় এবং গর্ভপাত, আত্মহত্যা ইত্যাদি সমস্যার সূত্রপাত হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে এই যুদ্ধাপরাধের[5] সমাপ্তি ঘটে।[6][7] প্রথমদিকে ভারত দাবি করেছিল যে তারা মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করছে। পরবর্তীতে তারা মানবাধিকারের প্রেক্ষাপট থেকে এই যুদ্ধে অংশ নেয়াকে ব্যাখ্যা করে। কিন্ত জাতিসংঘ তাদের এই দাবি অগ্রাহ্য করলে তারা দাবি করে তাদের নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ প্রয়োজন।[8][9] বর্তমানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অংশগ্রহণের মানবিক দিকটাই বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে।[10] স্বাধীনতা যুদ্ধের ৪০ বছর পরে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধাপরাধ অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে ধর্ষণসহ বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধে ১,৫৯৭ জন ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করে। ২০১০ থেকে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল কয়েক জন আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুর আদেশ দিয়েছে। বিভিন্ন চলচ্চিত্রে, সাহিত্যে এবং চিত্রকর্মে ধর্ষিতাদের গল্প তুলে ধরা হয়েছে।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে ভারতের স্বাধীনতা লাভ করা এবং পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র সৃষ্টির মাধ্যমে শুধুমাত্র পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে ভৌগোলিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে পৃথক দুটি আলাদা ভূখন্ডের সৃষ্টি হয়। পশ্চিমাংশের শাসকগোষ্ঠী বাঙালি মুসলিমদেরকে 'অতি বাঙালি' হিসেবে দেখতো এবং তাদের মুসলমানিত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করতো। আর এই কারণে তারা বাঙালিদের বিশ্বাসযোগ্য মনে করতো না। এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী জোরপূর্বক সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালিদেরকে পাকিস্তানিদের মত তৈরি করার চেষ্টা শুরু করে।[11] পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষী জনগণ মুসলিম হলেও এখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু বাঙালি বাস করত। খুবই অল্প সংখ্যক মানুষ উর্দুতে কথা বলতো। ১৯৪৮ সালে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বাঙালি জনগণ পাকিস্তানি শাসকদের এই অন্যায় আইন মেনে নিতে পারেনি। মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের জন্য বাঙালিরা আন্দোলন শুরু করে।[12] ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাঙালিরা ভাষার দাবিতে রক্ত দেয় যা বিশ্ব ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন নামে সুপরিচিতি লাভ করে। ১৯৪৯ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিম লীগের বিকল্প হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করা হয়।[13] পরবর্তীতে আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগ নামে আত্মপ্রকাশ করে। পরবর্তী দেড় দশক ধরে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শক্তির প্রতিপক্ষ হিসেবে বাঙালি জনগোষ্ঠী রাজনৈতিক পটভূমিতে আত্মপ্রকাশ করে।[14][15] ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে গণ্য করার প্রবণতা শুরু হয়। পূর্ব পাকিস্তানকে বলা হতো মিথ্যাবাদী জনগণের মিথ্যাবাদী দেশ'।[16]
পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। বিপুল ভোটে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এই ফল মেনে নিতে পারেনি[17]। ঢাকায় একজন জেনারেল মন্তব্য করেন, "চিন্তা করো না, আমরা এই কালো জারজদের কিছুতেই আমাদেরকে শাসন করতে দেবো না।"[18][19] প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন।[20][21]
বাঙালি জাতীয়তাবাদকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ 'অপারেশন সার্চলাইট' এর নামে বাঙালি নিধন শুরু করে[22]। তারা হিন্দু এবং বাংলাভাষী মুসলিমদের নির্বিচারে হত্যা শুরু করে[23]। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যায় ত্রিশ লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়, এক কোটি মানুষ শরণার্থী হয়ে পার্শ্ববর্তী ভারতে পালিয়ে যায় এবং দেশের মধ্যে তিন কোটি মানুষ নিরাপত্তাহীনভাবে টিকে থাকে।[24]
পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা বাঙালিদের দূর্বল জাতি হিসেবে উল্লেখ করে এবং যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে বাঙালি নারীদের ধর্ষণ করে।[25][26] বাঙালি জাতিকে 'শুদ্ধ' করতে তারা বাঙালি নারীদের জোরপূর্বক ধর্ষণ করে গর্ভবতী করার মাধ্যমে 'বিশুদ্ধ জাতি' তৈরির নোংরা প্রকল্প হাতে নেয়।[27][28]
‘বীরাঙ্গনা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে 'বীর নারী'; জাতির জনক বঙ্গবন্ধুই যুদ্ধকালীন সময় লাঞ্ছিত, নির্যাতিত নারীদের বীরাঙ্গনা খেতাব দিয়েছিলেন।[29] স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় লাভের পর যুদ্ধকালীন সময় ধর্ষিত নারীদেরকে ‘ধর্ষিতা রমণী’, ‘অপমানিতা রমণী’, ‘দুঃস্থ মহিলা’, ‘ধর্ষণের শিকার’, ‘সৈন্যদের নিপীড়নের শিকার’, ‘ক্ষতিগ্রস্ত মহিলা’, ‘ভাগ্যবিড়ম্বিতা’ ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত করা হতো। ১৯৭২ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তিযুদ্ধকালীন নির্যাতিত মহিলাদের জন্য সরকার বাংলাদেশ মহিলা পূনর্বাসন বোর্ড গঠন করে ধর্ষিতা মহিলাদের জন্য গৃহীত পুনর্বাসন কর্মসূচির মাধ্যমে নির্যাতিতাদের মর্যাদা সমুন্নত করার উপায় উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা নেয় এবং জাতীয় পর্যায়ে তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দেয় বীরাঙ্গনা খেতাব প্রদানের মাধ্যমে।[30]
জেনারেল টিক্কা খান, যিনি ছিলেন অপারেশন সার্চলাইট-এর প্রণেতা, তার নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে আক্রমণ পরিচালনা করে এবং তিনি তার কর্মকান্ডের জন্য বাঙালিদের নিকট থেকে 'বাংলার কসাই' অভিধা লাভ করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ "আমি এই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করবো" - এই বক্তব্যের দ্বারা খান স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের দায়িত্বে আছেন।[31][32] বীনা ডি'কোস্টা মনে করেন যে খানের ব্যবহৃত এই উপমাটি একটি সংকেত যার মাধ্যমে তিনি সামরিক অভিযানকালে গণধর্ষণকে একটি ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহৃত কৌশল হিসাবে গ্রহণের প্রমাণপত্র প্রদান করেছেন। যশোরে সাংবাদিকদের একটি দলের সঙ্গে আলাপকালে খান "প্যাহেলে উনকো মুছলমান কারো" (প্রথমে এদেরকে মুসলমান বানাও) বলে উক্তি করেছিলেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিলো। ডি'কোস্টা যুক্তি দেখান যে, এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে সশস্ত্রবাহিনীর সর্বোচ্চ স্তরের নিকট বাঙালিদের সম্পর্কে অনুভূতি হচ্ছে আনুগত্যহীন মুসলিম এবং দেশপ্রেমহীন পাকিস্তানি।[33]
রাতের বেলা অভিযান পরিচালনাকালীন আক্রমণকারীরা গ্রামের মহিলাদের উপর চড়াও হতো;[34] প্রায়শঃই ত্রাস সৃষ্টির অংশ হিসেবে তাদের পরিবারের সদস্যদের সামনেই এগুলো ঘটানো হতো।[35] এছাড়াও ৮ থেকে ৭৫ বছর বয়সী নারীদের অপহরণ করে বিশেষভাবে নির্মিত শিবিরে নিয়ে যাওয়া হতো যেখানে তারা বারবার লাঞ্ছিত হতো। ক্যাম্পে বন্দি থাকা অনেককেই হত্যা করা হয় অথবা তারা নিজেরাই আত্মহত্যা করে;[36][37] কিছু নারী তাদের নিজেদের চুল ব্যবহার করে আত্মহত্যা করায় সৈন্যরা বন্দিনীদের চুল কেটে দেয়।[33] যারা অপহৃত হয়েছিলো এবং সেনাবাহিনীর হাতে আটক ছিলো এধরনের ৫৬৩ জন নারী সম্পর্কে টাইম ম্যাগাজিনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়, যেখানে বলা হয় যখন সেনাবাহিনী তাদেরকে মুক্তি দেয়া শুরু করে তখন এদের সকলেই তিন হতে পাঁচ মাসের গর্ভবতী ছিলো।[38] কিছু নারীকে জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয়।[39] পাকিস্তান সরকারের হিসাব মতে যেখানে ধর্ষণের সংখ্যা শতাধিক[40] সেখানে অন্যান্য হিসাব মতে এই সংখ্যা আনুমানিক ২,০০,০০০[41] হতে ৪,০০,০০০।[42] পাকিস্তান সরকার নির্যাতন সম্পর্কিত প্রতিবেদন এই অঞ্চলের বাইরে পাঠাতে বাধাদানের চেষ্টা করলেও গণমাধ্যমে নৃশংসতার সংবাদ বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হওয়ায় সাধারণ্যে তা পৌঁছে যায় এবং এটি স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য ব্যাপক আন্তর্জাতিক জনসমর্থন বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে।[43]
জেনিক এ্যারিন্স কর্তৃক বিবৃত আছে যে কোনো একটি জাতিগত গোষ্ঠীকে নির্মূল করার জন্য একটি ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টা হিসেবে অসংখ্য নারী ধর্ষিত হয়, হত্যা করা হয় এবং এরপর যৌনাঙ্গের মধ্যে বেয়নেট দ্বারা আঘাত করা হয়।[44] কানাডীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যাডাম জোনস বলেছেন যে, এই গণধর্ষণের অন্যতম একটি কারণ ছিল বাঙালি নারীদের "অসম্মান" করার মাধ্যমে বাঙালি সমাজের মনস্তাত্ত্বিকভাবে পতন ঘটানো এবং সেজন্য কিছু নারীকে মৃত্যু না-হওয়া পর্যন্ত ধর্ষণ করা হয় অথবা বারংবার এভাবে আঘাতের কারণে নিহত হয়।[45] পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি পুরুষদেরও ধর্ষণ করেছিলো। পুরুষেরা যখন কোন একটি তল্লাশিকেন্দ্র পার হতো তখন তাদেরকে খৎনা করানো হয়েছিল কি-না তা প্রমাণ করতে নির্দেশ দেয়া হতো এবং এখানেই এধরনের ঘটনাগুলো সাধারণতঃ ঘটতো।[46] ইন্টারন্যাশনাল কমিশন ফর জাস্টিস মন্তব্য করেছেন যে, পাকিস্তানের সশস্ত্রবাহিনীর দ্বারা সংঘটিত নৃশংসতা ছিলো একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী দ্বারা স্বেচ্ছায় গৃহীত নীতির একটি অংশ"।[47] লেখক মুলক রাজ আনন্দ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে বলেছেন, "ধর্ষণগুলো এতোটাই পদ্ধতিগত এবং পরিব্যাপক ছিলো যে এগুলো সচেতনভাবে গৃহীত সমরনীতির অংশ ছিলো, "পশ্চিম পাকিস্তানিদের কর্তৃক পরিকল্পিত একটি নতুন জাতি তৈরি করতে ইচ্ছাকৃতভাবে" অথবা বাঙালি জাতীয়তাবাদকে হালকা করে দিতে"।[48] পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীর আত্মসমর্পণ করার পর অমিতা মালিক বাংলাদেশ থেকে প্রেরিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে, একজন পশ্চিম পাকিস্তানি সৈনিক বলেছে যে: "আমরা যাচ্ছি। কিন্তু আমরা পেছনে আমাদের উত্তরসূরি রেখে যাচ্ছি"।[49]
সকল পাকিস্তানি সামরিক ব্যক্তিবর্গ সহিংসতাকে সমর্থন করেননি; জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান, যিনি রাষ্ট্রপতিকে সামরিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে পরামর্শ দিয়েছিলেন,[50] এবং মেজর ইকরাম সেহগাল, উভয়ই প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন; একইভাবে পদত্যাগ করেন এয়ার মার্শাল আসগর খান। বেলুচ রাজনীতিবিদ মীর গাউস বখশ বাইজেনজু এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা খান আব্দুল ওয়ালী খান সশস্ত্র বাহিনীর কার্যক্রমের প্রতিবাদ করেছিলেন। এই সকল প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব, যারা সহিংসতার বিরুদ্ধে ভিন্নমত পোষণ করেন এবং তাদের সাথে সাবিহউদ্দিন গাউসি এবং আই এ রহমান নামীয় দুজন সাংবাদিক, সিন্ধি নেতা জি এম সৈয়দ, কবি আহমাদ সালিম, বিমান বাহিনীর সদস্য আনোয়ার পীরজাদা, অধ্যাপক এম আর হাসান, তাহেরা মাজহার এবং ইমতিয়াজ আহমেদকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিলো।[51] মালিক গোলাম জিলানিকেও গ্রেফতার করা হয়েছিলো প্রকাশ্যে বাংলাদেশে সশস্ত্র আক্রমণের বিরোধিতা করায় এবং ইয়াহিয়া খানকে লেখা বহুল প্রচারিত একটি খোলাচিঠির জন্য। এছাড়াও কারারুদ্ধ করা হয় ডন পত্রিকার সম্পাদক আলতাফ হোসেন গওহরকে।[52] ২০১৩ সালে জিলানি এবং কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজকে তাদের সহমর্মিতামূলক কর্মকান্ডের জন্য বাংলাদেশ সরকার সম্মননা প্রদাণ করেন।[53]
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পিটার টমসনের মতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনগনকে রুখতে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আই.এস.আই. রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামির সাথে মিলিত হয়ে আল বদর (চাঁদ), আল শামস (সূর্য) এর মত মিলিশিয়া আধা-সামরিক বাহিনী গঠন করে।[54][55] এই সকল বাহিনী নিরস্ত্রদের লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করতো এবং অন্যান্য অপরাধের পাশাপাশি ধর্ষণের মত যুদ্ধাপরাধে অংশ নিয়েছে।[56] স্থানীয় সহযোগী যারা রাজাকার নামে পরিচিত তারাও এই সকল ঘৃণ্য অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলো।[57]
১৯৭০ সালের নির্বাচনে পরাজিত মুসলিম লীগ, নিজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামি এবং জমিয়তে উলামা পাকিস্তান দলের সদস্যরা সামরিক বাহিনীর সাথে শখ্যতা গড়ে তোলে এবং তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করতে থাকে।[58] জামায়াতে ইসলামির প্রথম সারির বেশকিছু নেতার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে যোগসাজশ এবং ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ রয়েছে।[59] বাংলাদেশে স্থাপিত আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালতে এদের কয়েক জনের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। আল-বদর এবং আল-শামসের সংঘটিত গণহত্যা বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়; গণহত্যা এবং ধর্ষণের তথ্য ব্যাপকভাবে সম্প্রচার করা হয়।[55]
আনুষ্ঠানিক শুমারি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই নয় মাসের হত্যাযজ্ঞ নি:সন্দেহে গণহত্যা।[60][61] পূর্ব পাকিস্তানে পরিচালিত নারকীয় ঘটনা সমূহের মধ্যে ধর্ষন প্রথমেই বিশ্ব মিডিয়ার নজরে আসে[62] এবং স্যালি যে স্কলজের মতে এটাই প্রথম কোন গণহত্যা যা বিশ্বমিডিয়ার নজর কাড়ে।[63] বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক যুদ্ধকালীন সময়ে পরিচালিত নারী নিগ্রহের ইতিহাস প্রকাশ করেছে।[64]
হত্যাযজ্ঞের মাত্রা দেখে ঢাকায় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস গণহত্যা হচ্ছে বলে টেলিগ্রাফ প্রেরণ করে। এর মধ্যে একটি টেলিগ্রাম ব্লাড টেলিগ্রাম নামে সুপরিচিত। তৎকালী সময়ে USAID এবং USIS এ কর্মরত মার্কিন কর্মকর্তাদের সাথে ঢাকার মার্কিন কনস্যুল জেনারেল আর্চার ব্লাড এই টেলিগ্রাম প্রেরণ করেন। এটা গণহত্যা সম্পর্কে আমেরিকানদের মিশ্র অভিব্যক্তি প্রকাশ করে।[65][66] ১৯৭২ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য প্রেরণের স্বপক্ষে বলেন, আমরা কি বসে বসে তাদের (বাংলাদেশের) নারীদের ধর্ষিত হতে দেখবো?[67] এই ঘটনা নিয়ে ব্রিটেনের হাউজ অফ কমন্সে বিস্তর আলোচনা হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পার্লামেন্টের ২০০ সদস্যের সমর্থনে জন স্টোনহাউজ একটি প্রস্তাবনা পেশ করেন।[68] তারা তাদের প্রস্তাবনা দুইবার আইন পরিষদে পেশ করলেও ব্রিটিশ সরকার আলোচনা করার সময় বের করতে পারেনি।[69]
যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই ভারতে অবস্থানরত শরণার্থীদের জন্য আন্তঃর্জাতিক সম্প্রদায় প্রচুর পরিমানে সাহায্য প্রেরণ করে। মানবিক সহায়তা করা সত্ত্বেও যুদ্ধ শেষে যখন বাংলাদেশ যুদ্ধপরাধের বিচারের প্রস্তাবনা পেশ করে তখন খুবই কম সমর্থন পাওয়া যায়।[70] আমেরিকার সমালোচকদের বলতে শোনা যায় বৃহৎ আকারের হত্যা বন্ধে ১৯৭১ সালে সেনা অভিযান সঠিক ছিলো।[71] যুদ্ধ ধর্ষণ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সহায়তা পাওয়া যায়।[72] বীরাঙ্গনাদের গর্ভে যেসব যুদ্ধ শিশুর জন্ম হয় তাদের অনেককেই আন্তঃর্জাতিক বিশ্ব দত্তক হিসেবে গ্রহণ করে।
সুসান ব্রাউনমিলারের মতানুসারে, যুদ্ধকালীন সময় গণধর্ষণ কোন নতুন বিষয় নয়। তিনি অভিমত দেন যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অনন্য বিষয়টি ছিল এটাই যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে পারে যে মানুষকে সন্ত্রাসিত করতে নিয়মানুগ ধর্ষণ একটি অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।[73]
যুদ্ধ সমাপ্তের পর পাকিস্তান সরকার ধর্ষণের সংক্রান্ত বিষয়ে নীরবতা অবলম্বনের নীতি গ্রহণ করে।[41] তারা ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সার্বিক নৃশংসতা এবং পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ বিষয়ক বিস্তারিত বিবরণের জন্য হামুদুর রহমান কমিশন নামক একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করে। কমিশন সেনাবাহিনীর সম্পর্কে অত্যন্ত সংবেদনশীল ছিল।[74] কমিশনের কাজে হস্তক্ষেপের প্রচেষ্টা চালানোর জন্য সেনাবাহিনীর প্রধান এবং পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রধানদ্বয়কে তাদের পদ থেকে অপসারন করা হয়েছিলো।[75] কমিশন রাজনীতিবিদ, কর্মকর্তা ও ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাত্কারের উপর ভিত্তি করে তার প্রতিবেদন তৈরি করে। ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করা হয়েছিলো; কিন্তু পরবর্তীকালে এর সমস্তটিই ধ্বংস করা হয়, কেবলমাত্র পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো স্পর্কিতটি ব্যতীত। প্রতিবেদনে প্রাপ্ত তথ্য কখনোই সর্বসাধরনের জন্য প্রকাশ করা হয়নি।[76]
১৯৭৪ সালে কমিশনটি পুনরায় চালু করা হয়েছিলো এবং তারা একটি সম্পূরক প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেটি ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হওয়া পূর্ব পর্যন্ত ২৫ বছর ধরে গোপনীয় অবস্থায় থাকে।[77] প্রতিবেদনটিতে বলা হয় যে, ২৬ হাজার মানুষ নিহত ও শতাধিক ধর্ষিত হয়; এবং মুক্তিবাহিনীর বিদ্রোহীরা ব্যাপক ধর্ষণ এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার সাথে জড়িত।[40] রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সুমিত গাঙ্গুলী বিশ্বাস করেন যে, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের এখনো সুযোগ আছে সংগঠিত নৃশংসতার জন্য বক্তব্য দেয়ার; যেমনটি ২০০২ সালে বাংলাদেশ সফরকালে তৎকালীন পাকিস্তারে রাষ্ট্রপতি পারভেজ মুশাররফ দায় স্বীকার বিহীনভাবে নৃশংসতার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন।[78]
২০০৮ সালে, ১৭ বছরের তদন্ত শেষে, যুদ্ধাপরাধ অনুসন্ধান কমিটি ১৫৯৭ জনের বিরুদ্ধে নখিপত্র জমা দেয় যারা যুদ্ধকালীন নৃশংতায় জড়িত ছিল। এই নথিপত্রে জামায়তে ইসলামী এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বি.এন.পি), একটি রাজনৈতিক দল যা ১৯৭৮ এ প্রতিষ্ঠিত হয়, এর সদস্যদের নাম রয়েছে।[79] ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধাপরাদের সাথে জড়িতদের অপরাধ তদন্তের উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল গঠন করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ট্রাইবুন্যালকে সমর্থন করলেও,[80] আইনজীবীদেরকে হয়রানী করায় সংস্থাটি সমালোচনা সম্মুখীন হয়েছে। ব্রাড অ্যাডামস, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক শাখার পরিচালক, বলেছেন, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ট্রাইবুন্যাল যাতে গুরুতর কোন পদক্ষেপ নিতে না পারে সে জন্য অভিযুক্তদের পূর্ণ আইনি সুরক্ষা দিতে হবে[80] এবং আইরিন খান, একজন মানবাধিকার কর্মী, যুদ্ধকালীন সময়ে যে গণধর্ষণ এবং গণভাবে নারীদের হত্যা করা হয়েছে তার সুষ্ঠ বিচার হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন।[81] সরকারে প্রতিক্রিয়ায় আইরিন খান জানান:
একটি রক্ষণশীল মুসলিম সমাজ এই বিষয়টিতে অবহেলা ও অস্বীকারের একটি ঘোমটা পরিয়ে দিয়েছেন, যারা লিঙ্গ সহিংসতায় সহযোগিতা বা আতাঁত করেছেন এবং নারীদেরকে এমন অত্যাচার এবং লজ্জাকর অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছেন যা প্রকাশের ভাষা নেয়।[81]
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র অরুনোদয়ের অগ্নিস্বাক্ষী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের বিজয় দিবসের প্রথম উদ্যাপন দিবসে ধারণ করা হয়। এই চলচ্চিত্রে একজন অভিনেতা আলতাফের অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে। আলতাফ যখন কলকাতায় নিরাপদ আশ্রয়ে পোঁছানোর চেষ্টা করছে পথিমধ্যে তার সাথে ধর্ষিত মহিলাদের সাক্ষাত হয়। বীরাঙ্গনাদের শূন্য উদাস দৃষ্টি তাকে বিচলিত করে। ধর্ষিতাদের কেউ কেউ আত্মহত্যা করছে অথবা পাগল হয়ে গেছে।[82]
১৯৯৫ সালে গীতা সেহগাল ওয়ার ক্রাইমস ফাইল (যুদ্ধাপরাধের নথি) নামে একটি প্রামান্যচিত্র নির্মাণ করেন, যা চ্যানেল ফোরে প্রদর্শিত হয়। ২০১১ সালে গুয়াহাটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে মেহেরজান চলচ্চিত্রটি প্রদর্শিত হয়। এই চলচ্চিত্রে দুটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে যুদ্ধকে দেখা হয়েছেঃ একজন মহিলা যে একজন পাকিস্তানি সেনাকে ভালোবাসতো এবং ধর্ষণের ফলে জন্ম নেয়া একজন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী।[83]
১৯৯৬ সালে প্রখ্যাত লেখিকা নীলিমা ইব্রাহিম এর লেখা আমি বীরাঙ্গনা বলছি বইটি প্রকাশিত হয়। পূণর্বাসন কেন্দ্রে কাজ করার সময় নীলিমা এই তথ্য সংগ্রহ করেন।.[84] এই বইয়ে সাতজন ধর্ষিতার জবানবন্দি তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের যুদ্ধ পরবর্তী সমাজ বীরাঙ্গনা নারীদের সমর্থন দিতে যে ব্যর্থ হয়েছে তারই চিত্র ফুঁটে উঠেছে এই বইয়ে।[85]
২০১২ সালে প্রকাশিত হয় ছাই থেকে উঠে আসাঃ নারীর কন্ঠে ১৯৭১ (Rising from the Ashes: Women's Narratives of 1971)। এই বইয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে আক্রান্ত নারীদের কথা তুলে ধরা হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের জন্য বীর প্রতাপ খেতাব প্রাপ্ত নারী মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবির সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। বইটিতে ৯ জন ধর্ষিতার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হয়েছে। স্বাধীনতার ৪০ বছর উদ্যাপন উপলক্ষে বইটি ইংরেজিতে প্রকাশ উপলক্ষে নিউ ইয়র্ক টাইমস একে গুরুত্বপূর্ণ মৌখিক ইতিহাস হিসেবে উল্লেখ করে।[86]
২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া যুদ্ধশিশু (The Bastard Child বা Children of War) চলচ্চিত্রে যুদ্ধের এই বিভীষিকাময় দিকটি তুলে ধরা হয়েছে। মৃত্যুঞ্জয় দেবব্রত পরিচালিত এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন ফারুক শেখ, ভিক্টর ব্যানার্জী, রাইমা সেন। এই চলচ্চিত্রে অভিনেত্রীরা ধর্ষণকে এতটাই জীবন্ত হিসেবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন যাতে দর্শকের অনুভূতিতে গিয়ে আঘাত করে, যাতে কেউ ধর্ষককে ক্ষমা করাও চিন্তাও না করে।[87]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.