শীর্ষ প্রশ্ন
সময়রেখা
চ্যাট
প্রসঙ্গ
যমুনা নদী (ভারত)
ভারতের নদী উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
Remove ads
যমুনা (সংস্কৃত: यमुना) উত্তর ভারতের একটি অন্যতম প্রধান নদী। এটি ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় নদী গঙ্গার প্রধান উপনদী। যমুনা নদীর উৎস মধ্য হিমালয়ের বান্দারপুচ পর্বতশৃঙ্গের দক্ষিণ-পশ্চিম পাদদেশে অবস্থিত যমুনোত্রী হিমবাহের ৬,৩৮৭ মিটার উচ্চতায়।[১] এই নদীর দৈর্ঘ্য ১,৩৭৬ কিলোমিটার (৮৫৫ মাইল)।[১] এই নদীর জলনির্গম প্রণালীর আয়তন ৩৬৬,২২৩ বর্গ কিলোমিটার;[১] যা সমগ্র গাঙ্গেয় অববাহিকার ৪০.২ শতাংশ।[১] এই নদী এলাহাবাদের ত্রিবেণী সঙ্গমে গঙ্গা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। গঙ্গা ও যমুনার মিলনস্থলে প্রতি বারো বছর অন্তর কুম্ভমেলা আয়োজিত হয়।
যমুনা নদী উত্তরাখণ্ড, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের মধ্য দিয়ে এবং হিমাচল প্রদেশ ও দিল্লির পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। প্রবাহপথে একাধিক উপনদী যমুনা নদীতে মিলিত হয়েছে। যমুনার বৃহত্তম ও দীর্ঘতম উপনদী হল টোনস। যমুনার অপর উপনদী চম্বলের নিজস্ব একটি অববাহিকা রয়েছে। যমুনার অন্যান্য উপনদীগুলি হল সিন্ধ, বেতোয়া ও কেন। যমুনার নদী উপত্যকার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যটি হল সিন্ধু গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত অতি উর্বর পললসমৃদ্ধ 'গঙ্গা-যমুনা দোয়াব' অঞ্চল। প্রায় ৫৭,০০০,০০০ মানুষ যমুনার জলের উপর নির্ভরশীল।[১] যমুনা নদীতে বার্ষিক ১০,০০০ কিউবিক মিটার জল প্রবাহিত হয়।[১] এর মধ্যে ৪,৪০০ কিউবিক মিটার জল ব্যবহার করা হয়।[১] যমুনার ব্যবহৃত জলের ৯৬ শতাংশই লাগে সেচের কাজে।[১] দিল্লির জল সরবরাহ ব্যবস্থার ৭০ শতাংশই আসে যমুনা নদী থেকে।[১]
গঙ্গার ন্যায় যমুনাও হিন্দুধর্মে একটি পবিত্র নদী বলে বিবেচিত হয়। হিন্দুরা যমুনাকে দেবী যমুনা জ্ঞানে পূজা করেন। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, যমুনা সূর্যের কন্যা ও মৃত্যুর দেবতা যমের ভগিনী। কয়েকটি জনপ্রিয় কিংবদন্তিতে তিনি যমী নামেও পরিচিত। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, যমুনার পবিত্র জল মৃত্যু যন্ত্রণা থেকে মানুষকে নিস্তার দেয়।[১][২]
হিমালয়ের যমুনোত্রী থেকে দিল্লির ওয়াজিরাবাদ পর্যন্ত যমুনার জলের "মান মোটামুটি ভাল"। যমুনার এই পথটুকুর দৈর্ঘ্য ৩৭৫ কিলোমিটার। ওয়াজিরাবাদ বাঁধ থেকে ওখলা বাঁধ পর্যন্ত নদীর গতিপথে ১৫টি পয়ঃপ্রণালী মাধ্যমে বর্জ্য জল নদীতে নিক্ষেপ করা হয়। এর ফলে দিল্লির ওয়াজিরাবাদ থেকে যমুনার জল অত্যন্ত দূষিত। একজন পদাধিকারী নদীটিকে তাই ১৪ – ২৮ এমজি/১ বায়োকেমিক্যাল অক্সিজেন ডিম্যান্ড (বিওডি) এবং উচ্চহারে কোলিফর্ম উপাদানযুক্ত একটি "নিকাশী নালা" বলে উল্লেখ করেন।[৩] যমুনা দূষণের তিনটি প্রধান উৎস হল গার্হস্থ্য ও পৌর বর্জ্যভূমি, কৃষির জন্য বনচ্ছেদনের ফলে ভূমিক্ষয় এবং বিভিন্ন কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রের থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ।
Remove ads
প্রবাহপথ
সারাংশ
প্রসঙ্গ



হরিদ্বারের উত্তরে উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশী জেলায় মধ্য হিমালয়ের মুসৌরি পর্বতশ্রেণীর বান্দারপুচ শৃঙ্গের দক্ষিণ-পশ্চিম পাদদেশে যমুনোত্রী হিমবাহের ৬,৩৮৭ মিটার উচ্চতায় যমুনা নদীর উৎপত্তি।[১] এখানে দেবী যমুনার প্রতি উৎসর্গিত যমুনোত্রী মন্দির হিন্দুধর্মের পবিত্র তীর্থগুলির অন্যতম। এই মন্দির ছোটো চারধাম যাত্রাচক্রের অন্যতম। এই মন্দিরের অনতিদূরে নদীর ডান তীর ধরে ১৩ কিলোমিটার ট্রেকরুটে মার্কণ্ডেয় তীর্থ অবস্থিত। লোকবিশ্বাস অনুসারে, এখানেই মার্কণ্ডেয় পুরাণ রচনা করেছিলেন ঋষি মার্কণ্ডেয়।[৪][৫]
এইখান থেকে যমুনা প্রবাহিত হয়েছে দক্ষিণাভিমুখে। মধ্য হিমালয়, শিবালিক পর্বতশ্রেণী ও মোরাইনিক নদীতটে মধ্য দিয়ে এই নদীর ২০০ কিলোমিটার প্রবাহপথ উচ্চ যমুনা উপত্যকা নামে পরিচিত। এই উপত্যকার জিওমরফোলজিক্যাল বৈশিষ্ট্যগুলি হল শৃঙ্খলিত শৈলশিরা, খাড়া পাথুরে ভূমিতল ও একাধিক নদীমঞ্চ। নওগাঁও অঞ্চলের মতো নদীর নিম্ন উপত্যকায় বহুকাল প্রাচীন বৃহত্তর নদীমঞ্চগুলি দেখা যায়। হিমাচল প্রদেশে ২,৩২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট যমুনা নদীর একটি প্রাচীন নদী ধারণ অঞ্চলের সন্ধান পাওয়া যায়। উচ্চ ধারণ অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপনদী হল টোনস। এটি যমুনার দীর্ঘতম ও বৃহত্তম উপনদী। টোনস নদীর উৎপত্তি হরি-কি-দুন উপত্যকায়। মূল নদীর থেকে এই নদীর জলধারণ ক্ষমতা বেশি। কলসির পরে হরিদ্বারের কাছে এটি যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই নদীর সমগ্র জলনির্গম প্রণালীটি প্রসারিত হয়েছে হিমাচল প্রদেশের গিরি-শতদ্রু ধারণ অববাহিকা ও গাড়ওয়ালের যমুনা-ভিলংনা ধারণ অববাহিকার মধ্যবর্তী অঞ্চলে। শিমলার দক্ষিণ শৈলশিরাটি এই প্রণালীর অন্তর্গত।
যমুনা অববাহিকার উচ্চ ধারণ অঞ্চলের অন্যতম উপনদীগুলি হল গিরি, ঋষিগঙ্গা, কুন্টা, হনুমানগঙ্গা ও বাটা।[৬] এরপর দেরাদুনের নিকট ডাকপাথরে যমুনা নদী দুন উপত্যকার সমভূমিতে অবতীর্ণ হয়েছে। এখানে একটি জলপ্রপাত জলাধারের সাহায্যে নদীর জল জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য একটি খালের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে। এর অল্প দূরে যমুনা ও আসসান নদীর সংযোগস্থলে আসসান বাঁধ অবস্থিত। এখানে একটি পাখিরালয়ও রয়েছে। শিখ তীর্থস্থান পাওন্টা সাহিব পেরিয়ে যমুনা নদী হরিয়ানার যমুনা নগর জেলার তাজেওয়ালায় উপস্থিত হয়েছে। ১৮৭৩ সালে এখানে একটি জলাধার নির্মিত হয়। এই জলাধারটি পূর্ব ও পশ্চিম যমুনা খাল নামে দুটি গুরুত্বপূর্ণ খালের উৎপত্তিস্থল। এই খালদুটির মাধ্যমে হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে সেচের জল সরবরাহ করা হয়। পশ্চিম যমুনা খাল যমুনা নগর, কারণাল ও পানিপথ পেরিয়ে হায়দারপুর ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে উপস্থিত হয়েছে। এই প্ল্যান্ট দিল্লির পৌর জল সরবরাহ ব্যবস্থার একটি উৎস। এর পর এতে যমুনা নগর ও পানিপথ শহরের বর্জ্য জল এসে মিশ্রিত হয়েছে। অতঃপর শূন্য যমুনা নদী আবার পূর্ণ হয়েছে বিভিন্ন ঋতুগত জলধারা ও ভৌমজলের উৎস থেকে। শুষ্ক ঋতুতে তাজেওয়ালা থেকে দিল্লি পর্যন্ত প্রবাহপথে যমুনা অনেকাংশেই শুকনো থাকে। এরপর ২২৪ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে যমুনা প্রবেশ করে পাল্লা জেলায়।

যমুনা নদী উত্তরাখণ্ড ও হিমাচল প্রদেশ রাজ্যের প্রাকৃতিক সীমানাও নির্দেশ করেছে। বিশ্বের বৃহত্তম পললসমৃদ্ধ উর্বর সমভূমি সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে গঙ্গা নদীর সঙ্গে সমান্তরালে প্রবাহিত হয়ে যমুনা নদী ৬৯,০০০ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট গঙ্গা-যমুনা দোয়াব অঞ্চলের সৃষ্টি করেছে। এই অঞ্চল সমগ্র সমভূমির এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চল জুড়ে অবস্থান করছে। বর্তমানে এই অঞ্চল কৃষিক্ষেত্রে সমৃদ্ধির জন্য সুপ্রসিদ্ধ। এখানকার উৎপাদিত ফসলগুলির মধ্যে বাসমতী চাল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ভারতের কৃষকদের এক তৃতীয়াংশ এই সমভূমি অঞ্চলেই বাস করেন।[৭]
দিল্লি, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এলাহাবাদের পবিত্র হিন্দু তীর্থ ত্রিবেণী সঙ্গমে ১,৩৭৬ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করার পর গঙ্গা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে যমুনা। এখানে নদীর মধ্যভাগে একটি উচ্চ মঞ্চে অবস্থিত তীর্থক্ষেত্রে তীর্থযাত্রীরা নৌকাযোগে পূজা দিতে যান। প্রতি বারো বছর অন্তর সঙ্গমের ঘাটগুলিতে কুম্ভমেলা আয়োজিত হয়। এই সময় পূণ্যার্থীরা নদীতে স্নান করেন।[৮] যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত শহরগুলি হল বাঘপত, দিল্লি, নইডা, মথুরা, আগ্রা, ফিরোজাবাদ, এটাওয়া, কলপি, হামিরপুর ও এলাহাবাদ। এটাওয়ায় অপর গুরুত্বপূর্ণ উপনদী চম্বল যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এর পরই সিন্ধ, বেতোয়া ও কেন নদী মিলিত হয়েছে যমুনার সঙ্গে।[২][৯]
Remove ads
প্রাচীন সাহিত্য ও ইতিহাসে যমুনা নদী
সারাংশ
প্রসঙ্গ


সংস্কৃত ভাষায় "যমুনা" নামটির অর্থ "যমজ"। গঙ্গা নদীর সমান্তরালে এই নদীর প্রবাহ বলে যমুনার এই নামকরণ। বৈদিক যুগে (১৭০০ – ১১০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) রচিত ঋগ্বেদের একাধিক স্থানে "যমুনা" নামটির উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে রচিত অথর্ববেদ এবং ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ও শতপথ ব্রাহ্মণেও "যমুনা" নামটির সন্ধান মেলে।[১০] ঋগ্বেদের একটি উপাখ্যানে ভ্রাতা যমের প্রতি যমুনার "অত্যধিক স্নেহে"র বর্ণনা রয়েছে। যম যমুনাকে নিজের জন্য এক উপযুক্ত স্বামী খুঁজে নিতে বললে যমুনা কৃষ্ণকে বরণ করেন। ষোড়শ শতাব্দীতে দার্শনিক বল্লভাচার্য রচিত যমুনাষ্টকম্ স্তোত্রে এই কাহিনির বর্ণনা রয়েছে। এই কাব্যের বর্ণনা অনুযায়ী যমুনা তাঁর প্রেমিক কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হতে এবং জগতের পাপস্খালন করতে মর্ত্যে অবতরণ করেছিলেন। এই স্তবে যমুনাকে সকল আধ্যাত্মিকতার উৎস বলে বন্দনা করা হয়েছে; বলা হয়েছে গঙ্গা বৈরাগ্য, উচ্চ জ্ঞান ও মোক্ষ দানে সমর্থ, কিন্তু যমুনা তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যমের অত্যন্ত প্রিয় বলে মৃত্যুর থেকেও মুক্তি দিতে সমর্থ। হিন্দু পুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী, যমুনা কালিন্দ পর্বত থেকে উৎসারিত। এই কারণে তাঁকে কালিন্দের কন্যা কালিন্দী নামেও অভিহিত করা হয়। কৃষ্ণের লীলাবর্ণনায় এবং বৈষ্ণব পদাবলিতে কালিন্দী নামটির বহুল প্রয়োগ লক্ষিত হয়।[১১][১২]
মহামতি আলেকজান্ডারের পদাধিকারী সেলুকাস প্রথম নিকাটরের জরিপে এবং ৩০৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ভারত ভ্রমণকারী জনৈক ডায়াডকির বর্ণনায় এই নদী ইয়োমেনস (Iomanes) বা ইওয়ামেস (Ioames) নামে পরিচিত। ২৮৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে কোনো সময়ে ভারত পর্যটনকারী গ্রিক পর্যটক ও ভৌগোলিক মেগাস্থিনিস তাঁর ইন্ডিকা গ্রন্থে এই নদীর উল্লেখ করেন। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী, যমুনা অববাহিকায় অবস্থিত দেশটি শূরসেন নামে পরিচিত ছিল।[১৩] মহাভারতের বর্ণনা অনুযায়ী পাণ্ডবদের রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থ যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। মনে করা হয়, এই অঞ্চলটি অবস্থিত ছিল বর্তমান দিল্লি অঞ্চলে।
পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে জানা যায়, যমুনা এককালে ঘগ্গর নদীর উপনদী ছিল। প্রাচীনযুগে এই ঘগ্গর নদীটি বৈদিক সরস্বতী নদী নামে অভিহিত হত। সরস্বতী, সিন্ধু ও তার পাঁচটি উপনদী একত্রে সপ্তসিন্ধু নামে পরিচিত ছিল। উত্তর ভারতের একটি ভূআন্দোলনের ফলে যমুনা তার খাত পরিবর্তন করে গঙ্গার উপনদীতে পরিণত হয়। মনে করা হয়, এরপরই সরস্বতী নদীটি শুকিয়ে যায়। এতে সিন্ধু সভ্যতার একাধিক জনবসতির পতন ঘটে এবং থর মরুভূমির উদ্ভব ঘটে। ঘগ্গর-হাকরা নদীটিতে বর্তমানে কেবল বর্ষাকালেই জল থাকে।[১৪][১৫][১৬] প্রাচীনকাল থেকেই গঙ্গা-যমুনা নদী অববাহিকা ও দোয়াব অঞ্চল একটি ঐতিহ্যবাহী ক্ষমতাকেন্দ্র বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। চালুক্য রাজ বিনয়াদিত্যের রাজত্বকাল পর্যন্ত প্রাচীন ভারতের একাধিক বৃহৎ সাম্রাজ্যের কেন্দ্র ছিল এই অঞ্চল। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য: মগধ (৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ), মৌর্য সাম্রাজ্য (৩২১-১৮৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ), শূঙ্গ সাম্রাজ্য (১৮৫-৭৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ), কুষাণ সাম্রাজ্য (খ্রিষ্টীয় প্রথম-তৃতীয় শতাব্দী) ও গুপ্ত সাম্রাজ্য (২৮০-৫৫০ খ্রিষ্টাব্দ)। এই সাম্রাজ্যগুলির কয়েকটির রাজধানী ছিল মথুরা অথবা পাটলিপুত্র শহরে। এই সকল সাম্রাজ্য গঙ্গা ও যমুনা নদীর তীরেই বিকাশলাভ করে। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের শাসনকালে (৩৭৫-৪১৫ খ্রিষ্টাব্দ) গঙ্গা ও যমুনার মূর্তি সমগ্র গুপ্ত সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। দাক্ষিণাত্যেও চালুক্য ও রাষ্ট্রকূটদের (৭৫৩-৯৮২ খ্রিষ্টাব্দ) নির্মিত মন্দির ও রাজকীয় সিলমোহরে গঙ্গা ও যমুনার ছবি পাওয়া যায়। তারও আগে চোল সাম্রাজ্যের স্থাপত্য নকশায় স্থান পেয়েছিল এই দুই নদী। রাষ্ট্রকূট রাজা তৃতীয় গোবিন্দ ইলোরার কৈলাশ মন্দির চত্বরে পাথর কেটে তিন নদীদেবী গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতীর নামে তিনটি মন্দির নির্মাণ করেন।[১৭]
Remove ads
পুরাণ
যমুনা নদীর দেবীকল্প যমী বা দেবী যমুনা নামে পরিচিত। তিনি হিন্দু সূর্যদেবতা সূর্য ও তাঁর পত্নী সমজ্ঞার কন্যা এবং মৃত্যুদেবতা যমের ভগিনী। কৃষ্ণধর্মের কৃষ্ণ সংক্রান্ত উপাখ্যানগুলির সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত এই দেবী। হিন্দু পুরাণেও কৃষ্ণ ও যমুনা নদী বিষয়ক অনেকগুলি কাহিনি প্রচলিত আছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কালীয় দমন। এই কাহিনি অনুসারে, যমুনার জলের তলায় কালীয় নামে এক বিষধর নাগের বসতি ছিল। এই নাগ ব্রজের অধিবাসীদের ভয় দেখাত। কৃষ্ণ এই নাগটিকে পরাস্ত করেন এবং এর ফণার উপর উঠে নৃত্য করেন।[১৮][১৯]
গুরুত্বপূর্ণ উপনদী
- টোনস নদী – যমুনার বৃহত্তম ও দীর্ঘতম নদী। বান্দারপুচ পর্বতের ২০,৭২০ ফুট (৬,৩১৫ মিটার) উচ্চতায় উৎপন্ন এই নদী হিমাচল প্রদেশে একটি সুবৃহৎ অববাহিকার সৃষ্টি করেছে। উত্তরাখণ্ড রাজ্যে দেরাদুনের নিকট কলসিতে এই নদী যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
- হিন্দোন নদী – উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুর জেলায় মধ্য হিমালয়ের উচ্চ শিবালিক পর্বতশ্রেণী থেকে উৎপন্ন এই নদী পুরোপুরি বৃষ্টির জলে পুষ্ট। এই নদীর ধারণ অঞ্চলের আয়তন ৭,০৮৩ বর্গকিলোমিটার। ৪০০ কিলোমিটার প্রবাহপথে এই নদী মুজফফরনগর জেলা, মিরাট জেলা, বাঘপত জেলা, গাজিয়াবাদ, নইডা, ও বৃহত্তর নইডার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দিল্লির উপকণ্ঠে যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
- কেন নদী – মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের জব্বলপুর জেলার আহিরগাঁও গ্রামের নিকট উৎপন্ন এই নদী মধ্যপ্রদেশের বুন্দেলখণ্ড অঞ্চল ও উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের মধ্য দিয়ে ৪২৭ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে উত্তরপ্রদেশের ফতেহপুরের নিকট চিল্লা গ্রামে যমুনায় পতিত হয়েছে। এই নদীর ধারণ অববাহিকার আয়তন ২৮,০৫৮ বর্গকিলোমিটার।
- চম্বল নদী – প্রাচীনকালে এই নদী চর্মণবতী নামে পরিচিত ছিল। রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এই নদীর ধারণ অঞ্চলের আয়তন ১৪৩,২১৯ বর্গকিলোমিটার। নদীটির দৈর্ঘ্য ৯৬০ কিলোমিটার। বিন্ধ্য পর্বতশ্রেণীর মহও অঞ্চলে উৎপন্ন এই নদীর জল গান্ধীসাগর জলাধার, রানা প্রতাপ সাগর জলাধার ও জওহর সাগর জলাধারের জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের কাজে লাগানো হয়। এরপর দক্ষিণ-পূর্বে প্রবাহিত হয়ে এটাওয়া জেলায় সোহনগাঁওয়ে যমুনায় মিলিত হয়েছে এই নদী। এর অব্যবহিত পরেই যমুনার সঙ্গে মিলিয় হয়েছে অপর উপনদী সিন্ধ নদী।
Remove ads
সেচ
সারাংশ
প্রসঙ্গ

সিন্ধু গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে যমুনা নদীর গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছে এই নদীর খালগুলি। খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে তুঘলক শাসনকালে নহর-ই-বেহিস্ত নামে যমুনা নদীর সমান্তরাল একটি খাল কাটা হয়েছিল। পরবর্তীকালে সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মুঘল শাসনকালে বাস্তুকার আলি মর্দান খান খালটি সংস্কার করে আরও প্রসারিত করেন। এই সময় বেনাওয়াসে যমুনার সমভূমিতে প্রবেশস্থল থেকে মুঘল রাজধানী শাহজাহানাবাদ (অধুনা দিল্লি) পর্যন্ত খালটি প্রসারিত ছিল।[২০] সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭৯০ মিটার উচ্চতায় ডাকপাথরের কাছে যমুনা উত্তরের সমভূমি অঞ্চলে প্রবেশ করেছে। দুন উপত্যকার ডাকপাথর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে আসসান বাঁধ থেকে উৎপন্ন হয়েছে পূর্ব ও পশ্চিম যমুনা খাল। এই খালদুটির মাধ্যমে এই অঞ্চলের একটি বিরাট অংশে সেচের কাজ সম্পন্ন হয়ে থাকে। এর পর দিল্লি পার হওয়ার পর যমুনা আগ্রা খাল নামে অপর একটি খালকে পুষ্ট করেছে। ১৮৭৪ সালে নিজামুদ্দিন সেতুর অদূরে ওখলা বাঁধ থেকে এই খালটির উৎপত্তি। খাড়ি নদী ও যমুনার মধ্যবর্তী উচ্চভূমি অঞ্চলে প্রবাহিত হয়ে এই খাল আগ্রা থেকে ২০ মাইল দূরে বনগঙ্গা নদীতে মিলিত হয়েছে। এই কারণে গ্রীষ্মকালে আগ্রার উজানে অবস্থিত যমুনার মূল স্রোতটিতে যথেষ্ট জল থাকে না।[২]
শতদ্রু-যমুনা লিঙ্ক (এসওয়াইএল) নামে একটি ভারী পণ্যবাহী খাল বর্তমানে নির্মাণাধীন। যমুনা নদী থেকে উৎপন্ন এই খালটি পাঞ্জাব অঞ্চলের একটি প্রাচীন ক্যারাভান পথ ও উচ্চভূমি গিরিপথের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পতিত হবে শতদ্রু-সিন্ধু জলনির্গম প্রণালীর নৌবহনযোগ্য অংশে। পূর্ব দিকে এই লিঙ্কটি গঙ্গা নদীর সঙ্গে যুক্ত হবে। এই লিঙ্কটির মাধ্যমে ভারতের পূর্ব উপকূল পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে পশ্চিম উপকূলের সঙ্গে যুক্ত হতে চলেছে। সম্পূর্ণ হওয়ার পর ভারতের পূর্ব উপকূলের সঙ্গে পশ্চিম উপকূল তথা আরব সাগরের নৌদূরত্ব বহুলাংশে কমে যাবে। ফলে উত্তর-মধ্য ভারতের বাণিজ্য লাভবান হবে। দিল্লির নিকটস্থ পাল্লা গ্রাম থেকে উৎপন্ন হয়ে হরিয়ানা রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এই লিঙ্কটি পাঞ্জাবে প্রবেশ করবে। হরিয়ানার অংশে লিঙ্কটি নির্মাণের কাজ শেষ হলেও, পাঞ্জাব রাজ্য এই লিঙ্কটি নির্মাণের বিপক্ষে। পাঞ্জাব বিধানসভা "পাঞ্জাব টার্মিনেশন অফ এগ্রিমেন্টস অ্যাক্ট ২০০৪" জারি করে পূর্ববর্তী সকল চুক্তিতে বাতিল ঘোষণা করেছে।[১]
Remove ads
ব্যবস্থাপনা
উৎসস্থল থেকে দিল্লির ওখলা পর্যন্ত যমুনার প্রবাহপথটি “উচ্চ যমুনা” (Upper Yamuna) নামে পরিচিত। ১৯৯৪ সালের ১২ মে, উচ্চ যমুনার জলবণ্টনের লক্ষ্যে পাঁচটি অববাহিকা রাজ্য উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা ও রাজস্থান এবং দিল্লির মধ্যে একটি মউ (মেমোরাণ্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং) সাক্ষরিত হয়। এর পরই জলসম্পদ মন্ত্রকের অধীনে উচ্চ যমুনা নদী পর্ষদ গঠিত হয়। এই পর্ষদের প্রাথমিক কাজ হল লাভগ্রহীতা রাজ্যগুলির মধ্যে নদীর জলের ন্যায্য ভাগের সুষম বণ্টনের তত্ত্বাবধান; ভূতল ও ভৌমজলের সংরক্ষণ ও মানোন্নয়ন; অববাহিকার জল-আবহাওয়াতত্ত্ব সংক্রান্ত তথ্য রক্ষণ; অববাহিকা ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত পরিকল্পনাগুলির পর্যবেক্ষণ; ওখলা বাঁধ পর্যন্ত সকল প্রকল্পের কাজের তত্ত্বাবধান ও পর্যবেক্ষণ।[২১]
পাওন্টা সাহিবে যেখানে যমুনা নদীর সঙ্গে উপনদী টোনস, পওয়ার ও গিরি মিলিত হয়েছে, সেখানে একটি বন্যা পূর্বাভাষ কেন্দ্র রয়েছে। পরবর্তী কেন্দ্রগুলি হল হরিয়ানার কালানৌরের তাজেওয়ালা ও দিল্লির নিকটবর্তী মাওয়াই। তাজেওয়ালা থেকে দিল্লি আসতে নদীর জলের সময় লাগে ৬০ ঘণ্টা। এই কারণে দুই দিন আগেই বন্যার পূর্বাভাষ দেওয়ার পরিষেবা এখানে সম্ভব হয়েছে।[১][২২][২৩] ১৯৫৮ সালে কেন্দ্রীয় জল কমিশন গঠিত হলে যমুনা নদীর উপর অবস্থিত দিল্লি রেল ব্রিজ স্টেশন থেকে প্রথম বন্যা পূর্বাভাষ পরিষেবা চালু করা হয়েছিল।[২৪]
Remove ads
চিত্রাবলি
তথ্যসূত্র
গ্রন্থপঞ্জি
বহিঃসংযোগ
Wikiwand - on
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Remove ads