Loading AI tools
মৌলভীবাজারের পশ্চিমভাগ গ্রামে প্রাপ্ত তাম্রশাসন উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
পশ্চিমভাগ তাম্রশাসন, শ্রীচন্দ্র পশ্চিমভাগ তাম্রশাসন[1] বা চন্দ্রপুর তাম্রশাসন দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার চন্দ্রবংশীয় রাজা শ্রীচন্দ্র কর্তৃক প্রণীত একটি তাম্রশাসন, যা ১৯৬০ এর দশকে মৌলভীবাজারের পশ্চিমভাগ গ্রাম থেকে আবিষ্কৃত হয়।[4] এটি চন্দ্রবংশীয় রাজাদের বারোটি আবিষ্কৃত তাম্রশাসনের অন্যতম।[3] তাম্রশাসনটি হলো মূলত একটি দানপত্র, যেখানে প্রায় ছয় হাজার ব্রাহ্মণকে ভূমি অনুদান দেওয়া হয়।[5] তাম্রশাসনে চন্দ্রবংশীয় রাজত্বের পাশাপাশি পাল ও কম্বোজ সাম্রাজ্যের বিস্তৃত বর্ণনা ছাড়াও তৎকালীন সমাজের চিত্র পাওয়া যায়।[6][7] পশ্চিমভাগ তাম্রশাসনে জমি বণ্টনের মাধ্যমে রাজা শ্রীচন্দ্র নয়টি মঠের সমন্বয়ে “চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়” প্রতিষ্ঠা করেন বলে ধারণা করা হয়।[8] পশ্চিমভাগ তাম্রশাসন ও একই অঞ্চলে প্রাপ্ত ভাটেরা তাম্রশাসনের ওপর ভিত্তি করে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বিশ্ববিদ্যালয় আবিষ্কারে অনুসন্ধান চালায়।[9]
পশ্চিমভাগ তাম্রশাসন শ্রীচন্দ্র পশ্চিমভাগ তাম্রশাসন[1] | |
---|---|
উপাদান | তামা |
উচ্চতা | ১৭.৫ ইঞ্চি (৪৪ সেমি) |
প্রস্থ | ১২ ইঞ্চি (৩০ সেমি) |
ওজন | ২৪ পাউন্ড (১১ কেজি) |
লিখন | নাগরী লিপিতে সংস্কৃত |
আবিষ্কৃত | ১৯৫৮ পশ্চিমভাগ, রাজনগর, মৌলভীবাজার |
আবিষ্কার করেছেন | পরেশ পাল,[1] বিনোদবিহারী চক্রবর্তী[2] |
নির্মিত | ৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দ[3] |
দশম শতাব্দীতে রাজা ত্রৈলোক্যচন্দ্র (আনু. ৯০০ - ৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ) দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় চন্দ্রবংশীয় শাসনামলের শুরু করেন।[10] তারপর রাজা শ্রীচন্দ্র শাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে “পরমসৌগত”,[5] “পরমেশ্বর”, “পরমভট্টারক” ও “মহারাজাধিরাজ” উপাধি গ্রহণ করেন।[10] শ্রীচন্দ্র ৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ৪৫ বছর রাজ্য শাসন করেন বলে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. আব্দুল মোমিন চৌধুরী তার “ডাইন্যাস্টিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল” (বাংলার রাজবংশীয় ইতিহাস) বইয়ে উল্লেখ করেন।[3] আবার রমেশচন্দ্র মজুমদার “বাংলাদেশের ইতিহাস” গ্রন্থে শ্রীচন্দ্রের শাসনামল ৯০৫ থেকে ৯৫৫ পর্যন্ত বলে উল্লেখ করেছেন।[8][11] তবে পাঁচ প্রজন্মের চন্দ্রবংশীয় রাজাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজা শ্রীচন্দ্রই দীর্ঘতম সময় রাজ্য চালনা করেন।[9][12] বর্তমান মানিকগঞ্জ, ঢাকা, ফরিদপুরের পদ্মার তীরবর্তী এলাকা, শ্রীহট্ট ও কুমিল্লা তার শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল।[11] শ্রীচন্দ্র রাজ্যের রাজধানী দেবপর্বত থেকে বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুর অঞ্চলে স্থানান্তর করেছিলেন।[10] পশ্চিমভাগ তাম্রশাসনের মাধ্যমে চন্দ্র রাজবংশ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সম্ভব হয়।[13]
১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন সিলেট জেলার মৌলভীবাজার মহকুমার পশ্চিমভাগ গ্রামে (বর্তমানে রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও ইউনিয়নে[14]) “চন্দ্রপুরশাসন” নামে একটি তাম্রলিপি উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে গ্রামের নামে তাম্রলিপিটি “পশ্চিমভাগ তাম্রশাসন” নামে পরিচিত হয়।[5]
১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে পরেশ পাল নামক স্থানীয় একজন পুকুর খননের সময় এটি খুঁজে পান।[1][4][15][16] যদিও তাম্রশাসনের পাঠোদ্ধারকারী কমলাকান্ত গুপ্ত তার ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত “কপার-প্লেটস অব সিলেট” গ্রন্থে জনৈক বিনোদ বিহারী চক্রবর্তীর পতিত জমিতে দূর্ঘটনাবশত তাম্রশাসনটি পাওয়া যায় বলে জানান।[2] পার্শ্ববর্তী ভূমিউড়া গ্রামের শ্যামপদ কাব্যতীর্থ ভট্টাচার্যের হাত হয়ে তাম্রশাসনটি ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে “সিলেট হিস্টোরিক্যাল অ্যান্ড আর্কিওলজিক্যাল সোসাইটি”র সদস্য ও স্থানীয় যুগভেরী পত্রিকার সম্পাদক আমিনুর রশীদ চৌধুরী সংগ্রহ করেন।[1][16][17]
১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত কমলাকান্ত গুপ্তের “কপার-প্লেটস অব সিলেট” গ্রন্থ ও তার প্রবন্ধ সংগ্রহ ড. জফির সেতু সংকলিত ও সম্পাদিত “তাম্রশাসনে শ্রীহট্ট” বইয়ে পশ্চিমভাগ তাম্রশাসনের বর্ণনা পাওয়া যায়। শাসনটি হরদাস নামক একজন লিপিকার খোদাই করেন।[2] এটি বাংলায় কম্বোজ শাসকদের সময়ে জারি করা একটি লিখিত দলিল।[7][9] এটি ১৭.৫ ইঞ্চি×১২ ইঞ্চির তামার ফলকে খোদিত। এর উপরের অংশে মাঝ বরাবর একটি সিল (চিহ্ন) রয়েছে। সিলটি মূল প্লেটে পাঁচ ইঞ্চির মতো প্রবেশ করানো এবং সামনের ও পেছনের অংশের দুটি করে লাইনের মধ্যে বিভাজন বা ছেদ সৃষ্টি করে। সিলসহ শাসনের ওজন প্রায় ২৪ পাউন্ড বা ১০.৯ কেজি।[3]
তাম্রশাসনের উপরের সিলটিতে ধর্মচক্রমুদ্রা বা আইনের চাকা খোদাই করা আছে। চাকার দুইপাশে দুইটি হরিণ ও বেশ কয়েকটি বৃত্ত খোদিত আছে। এটি মূলত গৌতম বুদ্ধের মৃগয়ার সময় প্রথম আইনের চাকারস্বরূপ প্রকাশকে চিহ্নিত করে। সিলের নিচে রাজা শ্রী-শ্রীচন্দ্র দেবের (রাজা শ্রীচন্দ্র) নামের চিহ্ন অঙ্কিত রয়েছে।[3]
শাসনে মোট ৬৫টি লাইন খোদাই করা আছে। এর মধ্যে সামনের অংশে ২৮টি এবং পিছনের অংশে ৩৭টি লাইন আছে। শাসনটি সংস্কৃত ভাষায় ও উত্তরবঙ্গীয় নাগরী লিপিতে (যা পরবর্তীতে বাংলা-অসমীয়া লিপি হিসেবে পরিচিতি পায়) লেখা।[2]
পশ্চিমভাগ তাম্রশাসনে গৌতম বুদ্ধের বন্দনা, চন্দ্র রাজবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রীচন্দ্রের পারিবারিক পরিচয়, তার পিতা মহারাজা ত্রৈলোক্যচন্দ্রের যুদ্ধযাত্রা, বিজয়গাঁথা, তাম্রশাসনের সাক্ষী শ্রীচন্দ্রের রাজপারিষদদের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।[3] এতে খিরোদা (বা ক্ষিরোদা) নদীর তীরে সমতটের দেবপর্বতের নাম উৎকীর্ণ আছে।[7] শাসনে ত্রৈলোক্যচন্দ্র কর্তৃক লালমাইয়ের বনাঞ্চল হতে আগত সমতট আক্রমণকারী কম্বোজদের পরাজিত করে লালাম্বী রক্ষা করার কথা উদ্ধৃত আছে।[7][9][18] তবে ড. নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, কম্বোজদের হাতে রাজধানী দেবপর্বত বিধ্বস্ত হয়েছিল, এরকম একটি ইঙ্গিত শ্রীচন্দ্রের পশ্চিমভাগ তাম্রশাসনে স্পষ্টভাবে দেওয়া হয়েছে। কেননা, রাজা ত্রৈলোক্যচন্দ্র কম্বোজদের বিতাড়িত করতে পেরেছিলেন কিনা তা সুস্পষ্টভাবে শাসনে লেখা না থাকলেও, দেবপর্বত থেকে রাজধানী বিক্রমপুরে স্থানান্তর করার কথা বলা হয়েছে।[5]
পশ্চিমভাগ তাম্রশাসনটি হলো মূলত জমি দানের আদেশ। তাম্রশাসনে শ্রীচন্দ্রের পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তির[টীকা 1] শ্রীহট্ট মণ্ডলের[টীকা 2] চন্দ্রপুর, গরলা ও পোগারা বিষয়ে[টীকা 3] বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ভূমি দান করার কথা উল্লেখ আছে। এদের মধ্যে চন্দ্রপুর বিষয় বৃহদায়তন হওয়ায় তাম্রলিপির "চন্দ্রপুরশাসন" নাম হয়েছে।[3]
তাম্রশাসনে মোট নয়টি মঠের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও অন্যান্য সাধারণ ব্যয় নির্বাহের জন্য ভূমিদান করার কথা উল্লেখ আছে। প্রাচীন এই নয়টি মঠে শিক্ষার্থীরা উপাধ্যায় বা অধ্যাপকদের কাছ থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করতেন।
তাম্রশাসনের প্রথম অংশে ১২০ পাটক[টীকা 4] (প্রায় ৬০০০ একর[5][11]) চন্দ্রপুর মঠে[টীকা 5][6] দান করা হয়েছিল। দীনেশচন্দ্র সরকার সম্পাদিত "Select Inscription: Bearing on Indian History and Civilization" অনুসারে এই ১২০ পাটকের মধ্যে ১০ পাটক (প্রায় ৫০০ একর) জমি প্রতিবদ্ধ চন্দ্র নামের একজন উপাধ্যায়কে (অধ্যাপক বা শিক্ষক) প্রদান করা হয়।[2] এই মঠে মূলত চন্দ্রগোমীর ব্যাকরণ পড়ানো হতো।[6] বাকি ভূমি মঠের সাথে সংশ্লিষ্ট ১০ জন ছাত্র,[টীকা 6] পাঁচজন অপূর্ণ ব্রাহ্মণের ভোজন ও রন্ধনকাজে নিযুক্ত এক ব্রাহ্মণ, গণক, কায়স্থ বা লেখক, চারজন মালাকার, দুইজন তৈলিক, দুইজন কুম্ভকার, পাঁচজন কাহলিক, দুইজন শঙ্খবাদক, দুইজন ঢঙ্কাবাদক, আটজন দ্রাগঢ়িক, ২২ জন কর্মকার বা মজুর ও চর্মকার, একজন নট, দুইজন সূত্রধর, দুইজন স্থপতি, দুইজন কর্মকার বা কামারের জন্য দান করা হয় এবং অন্য নয়টি কাজের জন্য আরও ৪৭ পাটক ভূমি বরাদ্দ করা হয়।[2][6]
দ্বিতীয় অংশে আরও ২৮০ পাটক (প্রায় ১৪,০০০ একর) ভূমি অন্য আটটি মঠে (চারটি দেশান্তরীয় মঠ ও চারটি বাঙ্গালা মঠ) দান করা হয়। দ্বিতীয় খণ্ডের ভূমিও বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মাঝে ভাগ করা হয়। এখানকার প্রতি চারটি মঠে একজন করে বৈদ্য বা চিকিৎসকও ছিলেন।[2] আটটি মঠের এই ধর্মীয় কমপ্লেক্সে অগ্নিদেব বা বৈশ্বানর, যোগেশ্বর, জৈমিনি বা জমনি এবং মহাকালের পূজা করা হতো।[6] এই আটটি মঠে চতুর্বেদ অধ্যয়ন ও অনুশীলন করানো হতো।[6] চন্দ্রপুরের এই নয়টি মঠ নিয়েই “চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়” প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।[13]
তৃতীয় অংশে চন্দ্রপুর ও অন্যান্য বিষয়ের বাকি সম্পত্তি স্থানীয় ব্রাহ্মণ গার্গ ও অন্যান্য ছয় হাজার ব্রাহ্মণের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হয়।[5] ছয় হাজার সংখ্যাটি অতিরঞ্জিত বা অনির্দিষ্ট হতে পারে, কারণ লিপিতে মাত্র ৩৮ জনের নাম পাওয়া যায়।[6] তবে সহস্র ব্রাহ্মণ থেকে রাজনগরের ক্ষেমসহস্র, বালিসহস্র ও মহাসহস্র গ্রামের নামকরণ করা হয়ে থাকতে পারে।[13] এছাড়া তাম্রশাসনে শ্রীহট্টের মধ্যবর্তী কোনো এক স্থানে “ইন্দেশ্বর নৌকাবান্ধা”[টীকা 7][13] নামে এক প্রাচীন নৌবন্দরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। রাজা শ্রীচন্দ্র এ নৌবন্দরের জন্য ৫২ পাটক (প্রায় দুই হাজার ছয়শ একর) জমি দান করেছিলেন।[3]
শ্রীচন্দ্রের শাসনে ভূমি বণ্টনের ক্ষেত্রে সামাজিক অসামঞ্জস্যতা দেখা যায়। শাসনে একজন ব্রাহ্মণকে ২ পাটক, একজন কায়স্থকে ২.৫০ পাটক জমি দেওয়া হলেও বৈদ্য শ্রেণীয় একজন ব্যক্তিতে তিন পাটক জমি দেওয়া হয়েছে। এ থেকে সমাজব্যবস্থায় সমস্যা সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়।[6]
সংগ্রাহক আমিনুর রশীদ চৌধুরী ও সিলেট হিস্টোরিক্যাল অ্যান্ড আর্কিওলজিক্যাল সোসাইটির সহযোগিতায় কমলাকান্ত গুপ্ত ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে তাম্রশাসনটির পাঠোদ্ধার করেন। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে আমিনুর রশীদ চৌধুরীর “লিপিকা এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড” থেকে “কপার-প্লেটস অব সিলেট” (Copper-plates of Sylhet) নামক গ্রন্থে কমলাকান্ত গুপ্ত তা প্রকাশ করেন।[3] এছাড়া এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা আহমদ হাসান দানীও তাম্রলিপির পাঠোদ্ধার করে ইংরেজিতে রূপান্তর করেন।[7]
সোসাইটি বিলুপ্ত হওয়ার পর তাম্রশাসনটি আমিনুর রশীদ চৌধুরীর বাড়িতে সংরক্ষিত ছিল। এরপর ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ আগস্ট থেকে সিলেটের দরগা গেইট এলাকার কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ ভবনে স্থাপিত “ভাষা সৈনিক মতিন উদ্দীন আহমদ জাদুঘর”-এ সংরক্ষণ করা হয়।[3] জাদুঘরে একই সাথে কমলাকান্ত গুপ্তের “কপার-প্লেটস অব সিলেট” গ্রন্থের একটি মূল কপিও সংরক্ষিত আছে।[3]
এখন পর্যন্ত চন্দ্রবংশীয় রাজাদের বারোটি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়েছে। তার মধ্যে আটটিই রাজা শ্রীচন্দ্র প্রণীত।[টীকা 8][2] এই তাম্রশাসনগুলোর মধ্যে পশ্চিমভাগ তাম্রশাসন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।[3] তাম্রশাসনটি শ্রীচন্দ্রের রাজত্বের পঞ্চম বর্ষে (৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দ) জারি করা হয়।[2][9] এই তাম্রশাসনটি ভূমিদানের উদ্দেশ্যে জারি করা হলেও, এতে চন্দ্র বংশ, ইতিহাস, ভূতত্ত্ব, ভূমিব্যবস্থা, স্থানীয়দের ধর্ম, জীবনাচরণ, ভাষা ও অন্য নানা দিকের তথ্য সন্নিবেশিত হয়।[5] চন্দ্রপুরশাসন থেকে ইতিহাসবিদরা রাজা ত্রৈলোক্যচন্দ্র এবং শ্রীচন্দ্রের রাজত্ব উত্তর-পূর্ব ভারতের কামরূপ (বর্তমান আসাম) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে নিশ্চিত হন। শাসনে শ্রীচন্দ্রের কামরূপ অভিযানের বর্ণনা পাওয়া যায়।[12] রাজা শ্রীচন্দ্র গৌড় রাজ্যের বিরুদ্ধেও অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। এছাড়া পাল রাজা তৃতীয় গোপালের[টীকা 9] রাজ্য পুনরুদ্ধারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।[12] শাসনে চন্দ্রপুরকে পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তির অন্তর্ভুক্ত বলা হয়েছে। এ থেকে ধারণা করা হয়, পুণ্ড্রবর্ধনের সীমানা উত্তর-পূর্বে শ্রীহট্ট পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল।[19] পশ্চিমভাগ তাম্রশাসন তৎকালীন পাল সাম্রাজ্যে কম্বোজদের উত্থানের ধারণাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে।[20]
পশ্চিমভাগ তাম্রশাসনে শ্রীহট্টে প্রাচীন চন্দ্রপুরের অবস্থান ও চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জানা যায়। তৎকালীন শ্রীহট্টে (বর্তমান মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার সাগরনাল গ্রামে[টীকা 10][9]) “চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়” নামে একটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল,[21] যা অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় বা জগদ্দল বিহার থেকেও প্রাচীন।[2][9][11] ৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজা শ্রীচন্দ্র তার নামে ৪০০ পাটক জমিতে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন।[8][11][21] বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্বেদ, চান্দ্র ব্যাকরণ, হিন্দু শাস্ত্রবিদ্যা, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র,[22] হেতুবিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতিষবিদ্যা, শল্যবিদ্যা, ধাতুবিদ্যা, শব্দবিদ্যা ইত্যাদি বিষয় পড়ানো হতো।[টীকা 11][8][11][9] ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়টি মহাস্থানগড় ও তক্ষশীলার মতো উন্নতমানের ছিল বলে কমলাকান্ত গুপ্তকে এক চিঠিতে জানান।[13] ড. জফির সেতুর মতে, চন্দ্রপুরে নালন্দা বা ওদন্তপুরীর মতো বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল, যা ছিল মূলত ধর্মীয় শিক্ষার কেন্দ্র।[2] ২৫ শ্রেণির কর্মচারী, শিক্ষার্থী ও অতিথিদের ভরণপোষণের জন্য ভূমিবণ্টন সুশৃঙ্খল প্রশাসনিক ব্যবস্থার ইঙ্গিত দেয়, যা আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।[2] এখন পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত হলেও পশ্চিমভাগ তাম্রশাসন ও পার্শ্ববর্তী ভাটেরা ইউনিয়নের রাজার টিলায় প্রাপ্ত “ভাটেরা তাম্রশাসন” থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টির অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।[14] এছাড়াও কমলাকান্ত গুপ্ত তার ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত “মহারাজা শ্রীচন্দ্রের নবলব্ধ প্রাচীন (পশ্চিমভাগ) তাম্রশাসন” প্রবন্ধে চন্দ্রপুর বিষয়ের মধ্যে “শ্রীচন্দ্রপুর” বা “চন্দ্রপুর” নামে একটি নগর থাকার ইঙ্গিত দিয়ে তা অনুসন্ধানের তাগিদ দেন। এই নগরে চন্দ্রপুরের বিষয়পতি[টীকা 12] বসবাস করতেন বলেও তিনি ধারণা করেন।[2]
রাজা শ্রীচন্দ্র বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও গৌতম বুদ্ধের নামে চন্দ্রপুর ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশাল অংশ ব্রাহ্মণ ও তাদের মঠে দান করেছেন।[2] শাসনের পাঠোদ্ধারকারী কমলাকান্ত গুপ্ত এই দানকে সেসময়কার বৌদ্ধধর্মীয় অন্যান্য রাজাদের থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী বলে মন্তব্য করেন।[3]
পশ্চিমভাগ তাম্রশাসন থেকে রাজারা অনাবাদী এলাকাকে চাষের অধীনে আনার জন্য ও অনাবাসিক জায়গায় বসতি স্থাপনের জন্য স্থানীয় জনগণের চেয়ে বহিরাগত বা দেশান্তরীয়দের[টীকা 13] বেশি সুবিধা দিয়ে যে ঔপনিবেশিক বসতি স্থাপনের[5] পৃষ্ঠপোষকতা করতেন, সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।[6] এছাড়া একই দেবতার পূজা ও একই এলাকায় বাস করা সত্ত্বেও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দুইটি উপদলের (বঙ্গাল[টীকা 14][23] ও দেশান্তরীয়) বিভাগ তাম্রশাসনে দেখা যায়, যা মধ্যযুগীয় বাংলায় বিরল।[6] এটি তৎকালীন সমাজে ভূমি বণ্টন সংক্রান্ত অসামঞ্জস্যতা থেকে দুই উপদলের বিভেদের প্রতি ইঙ্গিত করে। এই মঠগুলি রাজার পৃষ্ঠপোষকতা পেত এবং রাজার ক্ষমতাকেও স্থিতিশীল করতে কাজ করত।[6][21]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.