Loading AI tools
৫৬৮ ও ৬৪৫ সালের মধ্যে লিপিবদ্ধ হেজাজি-লিপি পার্চমেন্ট পাণ্ডুলিপি যা কুরআনের ১৮ থেকে ২০ তম সূরার উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
বার্মিংহাম কুরআন পাণ্ডুলিপি হলো আল-কুরআনের একটি পাণ্ডুলিপি, যা এখন পর্যন্ত পাওয়া কুরআনের পাণ্ডুলিপিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন। এতে কুরআনের প্রাচীন মুসহাফের দুটি পাতা বিদ্যমান। বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত[1] পাণ্ডুলিপিটির তেজস্ক্রিয় কার্বনভিত্তিক কালনিরূপণ পরীক্ষা দ্বারা ২০১৫ সালে বয়স নির্ধারণ করা হয়, যার ভিত্তিতে এর সময়কাল ধরা হয় ৫৬৮ থেকে ৬৪৫ সাধারণ অব্দের মধ্যে (ইসলামী বর্ষপঞ্জিতে ৫৬ হিজরিপূর্ব থেকে ২৫ হিজরি সনের মধ্যে)।[2][3] এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাডবেরি গবেষণা গ্রন্থাগারে তত্ত্বাবধানে থাকা মধ্যপ্রাচ্যের পাণ্ডুলিপির মিঙ্গানা সংগ্রহশালার অংশ।[2]
বার্মিংহাম কুরআন পাণ্ডুলিপি | |
---|---|
ক্যাডবারি গবেষণা গ্রন্থাগার, বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় | |
অপরনাম | বার্মিংহাম মুসহাফ |
ধরন | প্রাচীন কুরআন পাণ্ডুলিপি |
তারিখ | ৫৬৮ হতে ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে |
ভাষা | আরবি |
অনুলেখক | অজ্ঞাত |
উপাদান |
|
বিন্যাস | উলম্ব |
লিপি | হেজাজি |
আধেয় | সূরা ১৮ (আল-কাহফ) থেকে ২০ (সূরা ত্বোয়া-হা) এর অংশ |
পান্ডুলিপিটিতে আরবি হেজাজি লিপি ব্যবহার করা হয়েছে এবং এখনও তা স্পষ্টভাবে পাঠযোগ্য।[3] পাতাগুলিতে সূরা ১৮ (আল-কাহফ) থেকে ২০ (সূরা ত্বোয়া-হা) এর অংশগুলি সংরক্ষিত আছে।[4] এটি ২০১৫ সালে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং তারপর ৫ আগস্ট ২০১৬ পর্যন্ত বার্মিংহাম জাদুঘর এবং শিল্পকলা চিত্রশালায় প্রদর্শন করা হয়েছিল[5] ক্যাডবেরি গবেষণা গ্রন্থাগার, পাণ্ডুলিপিটির বহু-আলোক বর্ণালিমিতিক (মাল্টিস্পেকট্রাল বিশ্লেষণ) এবং এতে ব্যবহৃত কালির এক্স-রে ফ্লোরোসেন্স (এক্সআরএফ) বিশ্লেষণ করেছে।[6]
১৯২০-এর দশকে অ্যালফোন্স মিঙ্গানা তিন হাজার (৩০০০) এরও বেশি নথি সম্বলিত "মিঙ্গানা সংগ্রহশালা" সংগ্রহ করেছিলেন[3] এবং এতে তাঁকে অর্থায়ন করেছিলেন বার্মিংহাম-ভিত্তিক চকলেট-তৈরিকারী ক্যাডবেরি পরিবারের একজন সদস্য, এডওয়ার্ড ক্যাডবেরি[7], যিনি ছিলেন একাধারে সমাজসেবী ও ব্যবসায়ী।[2]
বার্মিংহাম পান্ডুলিপির যে দুটি পাতা চিহ্নিত করা হয়েছে[2][8][9], সেগুলো হচ্ছে ১৬টি পাতার অংশ যা BnF Arabe 328(c)[10][11] নামে প্যারিসের জাতীয় গ্রন্থাগারে তালিকাভুক্ত। এই ১৬টি পাতা এখন কোডেক্স প্যারিসিনো-পেট্রোপলিটানাস[12] নামক কুর'আনের অপর প্রাচীন পান্ডুলিপির সাথে সংযুক্ত আছে। বার্মিংহাম পান্ডুলিপির পাতা দুটি (ফ্রান্সের গ্রন্থাগারের) ১৬টি পাতার সেই আয়াতগুলোর সাক্ষ্য বহন করে যেগুলো সেখানে পান্ডুলিপি-ঘাটতি হিসেবে আছে।
বার্মিংহামের পাতাগুলো এখন মিঙ্গানা ১৫২৭এ হিসাবে ক্যাটালগভুক্ত যেগুলো ফলিও আকারের (সর্বাধিক প্রশস্ততায় ৩৪৩ x ২৫৮ মি.মি.),[13] এবং সুপ্রশস্থ-স্কেল ও পাঠযোগ্য লিপিতে (পাতার) উভয় পাশে লিখিত।[3] দুই পৃষ্ঠা সম্বলিত পাতার এক পৃষ্ঠায় (লিখিত) আছে সূরা ১৮ (কাহফ) এর ১৭ থেকে ৩১ আয়াতগুলো, অপরদিকে অন্য পৃষ্ঠায় সূরা ১৯ (মারইয়াম) এর শেষ আটটি আয়াত (৯১ হতে ৯৮ নং আয়াত) এবং সূরা ২০ (তা-হা) এর প্রথম ৪০টি আয়াত রয়েছে।[13] (বার্মিংহাম পান্ডুলিপির সুরা এবং আয়াতগুলোর) সবই তাদের বর্তমান দিনের ক্রমানুসারে (লিখিত) আছে এবং (বর্তমান কুর'আনের) আদর্শ পাঠের সাথে সেগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ। মূলতঃ টিকে থাকা এই পাতা দুটি মূল হস্ত-লিখিত পান্ডুলিপিতে ১৮ এবং ১৯ সূরার মধ্যবর্তী আয়াত সম্বলিত অনেকগুলো ফোলিও (পাতা) দ্বারা পৃথক ছিল যেগুলো (বার্মিংহাম পান্ডুলিপিতে) অনুপস্থিত। পাতা দুটিতে (আরবির) সংক্ষিপ্ত স্বর নির্দেশ করার জন্য কোন ডায়াক্রিটিকাল চিহ্ন নেই (যেমন, নুকতাহ, হরকত ইত্যাদি), তবে ব্যঞ্জনবর্ণগুলি মাঝেমধ্যে তির্যক ড্যাশের মাধ্যমে আলাদা করা আছে। লেখাগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছে যা একটি পূর্ণ কুরআন পাণ্ডুলিপির জন্য আদর্শ ছিল (সুতরাং, এগুলো হয়তঃ কোন একটি পূর্ণ কুর'আন পাণ্ডুলিপির অংশ ছিল)। তাছাড়াও, পাতা দুটিতে অধ্যায় বা সূরার বিভাজন (সমাপ্তি) বুঝাতে (হাতে আঁকা) একটি সজ্জিত লাইন (উপরের চিত্রে লাল কালিতে আঁকা পৃষ্ঠা-বরাবর জোড়-বক্র রেখা) ব্যবহৃত হয়েছে এবং আয়াতের সমাপ্তি বুঝাতে দুই আয়াতের মাঝে ব্যবহার করা হয়েছে গুচ্ছ বিন্দু (কয়েকটা বিন্দু একসাথে লেখা, যেমন বাংলায় "অতএব" এর সাংকেতিক চিহ্ন-রূপ)।
যদিও বার্মিংহামের পাতা দুটিতে প্রাপ্ত কুর'আনের পাঠটি (শব্দ, আয়াত ইত্যাদি) প্রায় সম্পূর্ণরূপে[14] (বর্তমান মাসহাফের) আদর্শ পাঠের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ,[15] তবে নীরব আলিফ (ألف) এর লেখার (অথবা, তা উহ্য রাখার) ক্ষেত্রে সেগুলোর লিখনবিধি ভিন্ন।[16] প্রাচীন আরবি লিপিতে নীরব আলিফ লেখার প্রবণতা ছিল না।[17][18] পরবর্তীতে পাতা দুটির অতিবেগুনী পরীক্ষা করা হয়, যা নিশ্চিত করে যে সেগুলোতে কোন অবলিখন ঘটেনি। এ পরীক্ষার মাধ্যমে পাতা দুটি'র প্যালিম্পসেস্ট (যে পান্ডুলিপির লেখা মুছে তার উপর আবার লেখা হয়েছে) হওয়ার সম্ভাবনা নাকচ হয়ে যায়।[19]
মিঙ্গানা ১৫২৭এ এবং বিএনএফ আরাবে ৩২৮(সি) ফোলিওগুলোর একটি বিশদ যৌথ বিশ্লেষণের পর আলবা ফেডেলি তার থিসিসে এমএস পিএবি নামে (থিসিসের ১৬৯ পৃঃ) ডাবিং (নতুন তথ্য ইত্যাদি যোগ) করার মাধ্যমে তার ফলাফলগুলিকে সংক্ষিপ্ত করেছেন:[20]
এমএস পিএবি (উপোরেল্লিখিত অ্যালবা ফেডেলির থিসিসে) এবং (আধুনিক) মদিনা মুসাহাফের অনুলিপির মধ্যে তুলনা করলে বেশ কিছু পার্থক্য চিহ্নিত করা যায়। এই ভিন্নরুপগুলিকে অনুলিপিকারের ভাষাগত দক্ষতা এবং তার ভাষাগত প্রেক্ষাপটের আলোকে (দর্পণ হিসাবে) বোঝা যেতে পারে। আর এটি এভাবে যে, (বার্মিংহাম) পাণ্ডুলিপিতে কিছু ধ্বনিগত (ধ্বনিবিজ্ঞান), অর্থোগ্রাফিক (লিখনবিধি), রূপগত (রূপমূলতত্ত্ব) এবং সিনট্যাকটিক (বাক্যতত্ত্ব) ভিন্নরুপতা রয়েছে। তবে (ব্যতিক্রমভাবে) কয়েকটি আভিধানিক ভিন্নরুপতাও রয়েছে যেগুলোর মধ্যে কিছু আছে বার্তাটির ভয়েস ও তার প্রাপক সম্পর্কিত, আর কিছু ভিন্নরুপতার উদ্ভব হয়েছে কপিকালীন সময়ের (ভয়েস কপি বা লিখন কপি) যান্ত্রিক ত্রুটি হতে। পরিশেষে, (বার্মিংহাম) পান্ডুলিপিটিতে কুরআনের পাঠকে আয়াতে বিভক্ত করার ক্ষেত্রে কয়েকটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। অধিকন্তু, ইসলামী ঐতিহ্যগত (অনুরুপ অন্যান্য) লেখার (যেমন, প্রাচীন বা আধুনিক পান্ডুলিপি, বই ইত্যাদি) সাথে পাণ্ডুলিপিটির পাঠ বিশ্লেষণ করলে কতিপয় কির'আত (কুর'আনের আরবি পঠন-রীতি) প্রকাশ পায় যা পাণ্ডুলিপিটির মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়।
অ্যালবা ফেডেলি, যিনি তার "প্রাথমিক কুর'আনিক পাণ্ডুলিপি, তাদের পাঠ্য এবং বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সংগ্রহ বিভাগের তত্ত্বাবনাধীন আলফোনস মিঙ্গানা কাগজপত্রাদি " শিরোনামের পিএইচডি থিসিসের জন্য মধ্য-প্রাচ্যের পাণ্ডুলিপি ভিত্তিক তৈরিকৃত "মিঙ্গানা সংগ্রহের" বিষয়াবলী অধ্যয়ন করছিলেন,[21] তিনিই (প্রথম) আবিষ্কার করেন যে, (বার্মিংহাম ) পাতা দু'টিকে (পূর্বে) ভুলভাবে শনাক্ত করা হয়েছে এবং সপ্তম শতাব্দীর অন্য একটি কুর'আন পাণ্ডুলিপির সাথে বাঁধাই (যুক্ত) করা হয়েছে যেটিও হিজাজি লিপিতে লেখা ছিল (বর্তমানে সেটি "মিঙ্গানা ১৫২৭ বি" হিসাবে তালিকাভুক্ত)।[2] কুর'আনের পাঠগত ইতিহাস অনুসন্ধানের নিমিত্তে করপাস কোরানিকাম প্রকল্পে ইসলামিক আরবি ১৫৭২ থেকে একটি নমুনা প্রদানের জন্য বার্লিন-ব্র্যান্ডেনবার্গ একাডেমির ২০১৩ সালের একটি প্রচেষ্টাগত পদ্ধতির সাথে ফেডেলি'র গবেষণার হস্তলিখনের মিল পাওয়া যায়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] তাই, বার্লিন-ব্র্যান্ডেনবার্গ একাডেমির ২০১৩ সালের সেই প্রচেষ্টাগত পদ্ধতি অনুসরণপূর্বক ক্যাডবেরি রিসার্চ লাইব্রেরি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওকার্বন অ্যাক্সিলারেটর ইউনিটে (বার্মিংহাম) পাণ্ডুলিপিটির তেজস্ক্রিয় কার্বনভিত্তিক কালনিরূপণের ব্যবস্থা করে। তারা পার্চমেন্টটির (পাণ্ডুলিপি-পাতা) তেজস্ক্রিয় কার্বনভিত্তিক সময়কাল নির্ণয় করেছিল ১৪৬৫±২১ বছর বিপি (১৯৫০ এর আগে), যা (পরিমাপের) আকার-সংশোধনের পর ক্যালেন্ডার বছর সিই ৫৬৮-৬৪৫ এর সাথে ৯৫.৪% নিশ্চয়তা সহকারে মিলে যায়।[22][23]
তেজস্ক্রিয় কার্বনভিত্তিক পরীক্ষা দ্বারা পাণ্ডুলিপিটির জন্য যে সম্ভাব্য সময়কাল (সিই ৫৬৮-৬৪৫) প্রস্তাব করা হয়েছে তা তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ ইসলামি নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া-সাল্লাম) আনুমানিক ৫৭০ থেকে ৬৩২ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন।[24] সুন্নি মুসলিম ঐতিহ্য অনুসারে এটি ছিলেন প্রথম খলিফা আবু বকর (রা. ৬৩২-৬৩৪), যিনি কুরআন সংকলন করেছিলেন এবং উসমান (রা. ৬৪৪-৬৫৬) যিনি কুর'আনের আদর্শ সংস্করণটি সু-প্রচলিত করেছিলেন এবং এরপর আদেশ দিয়াছিলেন যে, কুরআনের পূর্ববর্তী সকল সংস্করণ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।[25] উসমান (রাদ্বি-আল্লাহু আনহু) এর সময়ে সংকলিত কুর'আনের আদর্শ সংস্করণটিই তখন থেকে বিশ্বব্যাপী সমস্ত মুসলিমদের দ্বারা গৃহীত ও ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
ব্রিটিশ লাইব্রেরির ফার্সি ও তুর্কি পাণ্ডুলিপির প্রধান কিউরেটর মুহাম্মদ ইসা ওয়ালি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রচারিত ঘোষণায় বলেন :[2]
কয়েক দশক পর্যন্ত (তৎকালীন) মুসলিম সম্প্রদায় পশুর চামড়া মজুদ করার মতো যথেষ্ট সম্পদশালী ছিল না এবং পবিত্র কোরআনের একটি সম্পূর্ণ মুসহাফ বা অনুলিপি (চামড়ায় লেখা পূর্ণ পান্ডুলিপি) তৈরি করতে অনেক চামড়ার প্রয়োজন ছিল। কার্বন ডেটিং ভিত্তিক পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ এক্ষেত্রে ইঙ্গিত করে যে বার্মিংহামের ক্যাডবেরি রিসার্চ লাইব্রেরিতে এমন কিছু মূল্যবান (এখন পর্যন্ত) টিকে থাকা (পান্ডুলিপি) আছে যেগুলোতে অন্তর্ভুক্ত থাকা সূরাগুলোর বিবেচনায় বলা যায় যে, সেগুলো সেই সময়কালের কোন একটি মুস'হাফের কেন্দ্র বা মধ্যভাগেরপাতা হিসেবে ছিল। এছাড়াও, এটি এমন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয় বলে মনে হয় যে, উসমানিয় সম্পাদনাটি যে সময়ে ধারণা করা হয়, তারও আগে করা হয়েছিল - অথবা এমনটাও ধারণা করা যায় যে, এই ফোলিওগুলি (বার্মিংহাম পাতা) সেই প্রক্রিয়ার (উসমানিয় সম্পাদনার) আগের সময়কালের। এ দু' সম্ভাবনার যেটিই (সত্য বলে ধরা) হোক না কেন, বিষয়বস্তুর অপার সৌন্দর্য এবং আশ্চর্য করার মত স্পষ্ট হিজাজি লিপি সমেত এটি (বার্মিংহাম পান্ডুলিপি) নিয়ে এসেছে এমন সংবাদ যা মুসলিমদের হৃদয়ের জন্য আনন্দদায়ক।
বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্রিস্টানত্ত্ব ও ইসলামের অধ্যাপক ডেভিড থমাস বলেন:[2]
বার্মিংহাম ফোলিওগুলোর (নথি) পার্চমেন্টের (যেমন চামড়ায় লেখা পান্ডুলিপির পাতা) উপর করা পরীক্ষাগুলি এমন প্রবল সম্ভাবনার উদ্রেক করে যে, এটি (পান্ডুলিপি-পাতার চামড়া) যে প্রাণীটি থেকে নেওয়া হয়েছিল তা নবী মুহাম্মদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) জীবদ্দশায় বা তার কিছুকাল পরে জীবিত ছিল। এর অর্থ এমনটা দাঁড়ায় যে, এই পার্চমেন্টে কুরআনের যে অংশগুলি লেখা আছে তার সময়টা যে মুহাম্মদের মৃত্যুর দুই দশকেরও কম সময়ের মধ্যে হতে পারে তা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলা যায়। এই অংশগুলি অবশ্যই এমন রুপে বিদ্যমান, যা বর্তমান পঠিত কোর'আনের (গঠনগত) রুপের (যেমন, আয়াতসমূহের সদৃশ্যতা) খুব কাছাকাছি। এমন (সমরুপতার) ঘটনা এই দৃষ্টিভঙ্গিকেই সমর্থন করে যে, (বার্মিংহাম কুর'আনের) পাঠটিতে (আয়াত) কোনও পরিবর্তন সাধন করা হয়নি এবং আরো সমর্থন করে যে, এটির সময়কাল নির্ধারণ করা যায় সেই সময়ের খুব কাছাকাছি একটি পর্যায়ে যে সময়টাতে এটি অবতীর্ণ হচ্ছিল বলে বিশ্বাস করা হয় (অর্থাৎ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের ওহিকালীন সময়ের বা তার কিছু পরে)।
রিয়াদে অবস্থিত সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজের পরিচালক সৌদ আল-সারহান (পান্ডুলিপিটির সময়কাল বিষয়ে) আরও সন্দেহপ্রবণ অবস্থানে আছেন, যিনি প্রশ্ন তুলেছেন যে পার্চমেন্টটি প্যালিম্পসেস্ট হিসেবে হয়তবা পুনঃব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে, এবং এও উল্লেখ করেছেন যে (বার্মিংহাম পান্ডুলিপির) লেখাটিতে "অধ্যায় বিভাজক" (সূরার সমাপ্তি বুঝাতে) এবং (গুচ্ছ) "বিন্দু যুক্ত আয়াত-সমাপ্তি সূচক" চিহ্নসমূহ ব্যবহৃত হয়েছে, আর আরবি লেখনরীতির এই (চিহ্নসূচক) বৈশিষ্ট্যগুলোর ব্যবহার কুর'আনে (ধারণাকৃত সময়ের অনেক) পরে সূচনা করা হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। পরবর্তীতে, অতিবেগুনী পরীক্ষার মাধ্যমে (বার্মিংহাম) পান্ডুলিপিটির প্যালিম্পসেস্ট হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া হয়।[19] সৌদি ভিত্তিক বেশ কিছু কুর'আনের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ সৌদের সমালোচনাকে সমর্থন করেছেন যারা কিনা পাণ্ডুলিপিটি মুহাম্মাদের জীবদ্দশায় লিখিত হয়ে থাকতে পারে এমনটি মানতে নারাজ। তারা এ বিষয়টিতে জোর দেন যে, যখন মুহাম্মাদ জীবিত ছিলেন তখন কুরআনের লেখাগুলি কোন (সূরা বা) অধ্যায় (সমাপ্তিসূচক) অলঙ্করণ, আয়াতের সমাপ্তিসূচক চিহ্ন বা রঙিন কালি এগুলোর ব্যবহার ছাড়াই লেখা হয়েছিল এবং (তখনকার) লেখাগুলোতে সূরাগুলোর কোনও আদর্শ ক্রম (কোন সূরার পর কোন সূরা হবে) অনুসরণ করা হয়নি। কেউ কেউ মনে করেন যে, লেখাটি খলিফা উসমানের শাসনামলের সময়কালের হতে পারে, অপরদিকে অন্যান্যরা এটির সময়কাল উমাইয়া যুগের শেষদিকের কোন এক সময়ে হতে পারে বলে অভিমত দেন।[26]
ইতিহাসবিদ টম হল্যান্ড বলেন, হালকাভাবে বলতে গেলে পাণ্ডুলিপিটির কার্বন ডেটিং এর মাধ্যমে, "কিভাবে কুর'আনের উদ্ভব হয়েছিল, [এবং] যার ফলস্বরূপ মুহাম্মাদ এবং [তার অনুসারীদের] ঐতিহাসিকতায় এসবের কিরুপ প্রভাব ছিল" এসব সম্পর্কিত যেকোন কিছু আমরা নিশ্চিতরুপে জানতে পারি এমন ধারণাকে অস্থিত (বা নড়বড়ে) করে তোলে।[27]
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ফেলো এবং কুর'আন পাণ্ডুলিপি বিষয়ক পরামর্শক কেইথ স্মল হল্যান্ডের সাথে একমত হয়ে বলেছেন:
"এটি (বার্মিংহাম পাণ্ডুলিপি) কুর'আনের উদ্ভব সম্পর্কিত প্রান্তিক দৃষ্টিভঙ্গিগুলিকে আরও মজবুত করে, যেমন মুহাম্মাদ এবং তাঁর প্রাথমিক অনুসারীরা এমন একটি পাঠ্য (কুর'আন) ব্যবহার করেছিলেন যা ইতিমধ্যেই বিদ্যমান ছিল এবং মুহাম্মাদ এটি স্বর্গ হতে প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত হন এমন ধারণার পরিবর্তে তারা এটিকে (কুর'আন) তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক ও ধর্মতাত্ত্বিক লক্ষ্য পূরণে রুপায়িত করেছিলেন (এমনটিই মনে হয়)।"[27]
ইয়ালোভা ইউনিভার্সিটির ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদের সুলেমান বার্ক তুর্কি ও ইসলামি শিল্পকলা জাদুঘরে থাকা কয়েকটি হিজাজি কুরআনের লিপি যেগুলো ১৮৯৩ সালের আগুনের পরে দামেস্কের গ্রেট মসজিদ থেকে ইস্তাম্বুলে আনা হয়েছিল সেগুলো এবং বার্মিংহামের পাতার লিপিগুলোর মধ্যে শক্তিশালী মিল লক্ষ্য করেছেন। (অতীতের ঘটনা হতে) বার্ক স্মরণ করেন যে, যৌথভাবে এই পাণ্ডুলিপিগুলো ২০১০ সালে ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত "১৪০০ তম বছরে কুর'আন" নামক কুর'আনের ইতিহাসের একটি প্রদর্শনীর সাথে নিবিড়ভাবে গবেষণা করা হয়েছিল এবং (এই গবেষণার) ফলাফলগুলো ২০১৩ সালে উমাইয়াদের কোরান হিসাবে ফ্রাঁসোয়া ডিরোচে কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছিল।[28] সেই গবেষণায়, প্যারিস কুরআন বিএনএফ আরাবে ৩২৮(সি) এর সাথে ইস্তাম্বুলের কুরআনের তুলনা করা হয়েছে এবং (ফলাফলে) "সপ্তম শতাব্দীর শেষের দিকে এবং অষ্টম শতাব্দীর শুরুতে" (ইস্তাম্বুলের কুরআন) লেখা হয়েছে বলে উপসংহারে বলা হয়েছে।[29]
ব্র্যান্ডেস ইউনিভার্সিটির জোসেফ ইবি লুম্বার্ড বার্মিংহাম পণ্ডিতদের প্রস্তাবিত (বার্মিংহাম পাণ্ডুলিপির) সময়কালগুলোর সমর্থনেহাফিংটন পোস্টে (নিবন্ধ) লিখেছেন। লুম্বার্ড লক্ষ্য করেন যে, যদি ইসলামী যুগের প্রথম দশকে লেখা হয়েছে এমন একটি কুর'আনের পাঠের আবিষ্কার রেডিওকার্বন ডেটিং দ্বারা নিশ্চিত করা হয়, অন্যদিকে এমন একটি পাঠ সামনে আনা হয় (যেমন, বর্তমান কুর'আন) যেটি ঐতিহ্যগতভাবে গৃহীত সেই পাঠের সাথে (যেমন, বার্মিংহাম পাণ্ডুলিপি) উল্লেখযোগ্যভাবে সঙ্গতিপূর্ণ, তাহলে তা ক্রমবর্ধমান একটি একাডেমিক ঐক্যমতকে শক্তিশালী করে। আর তা হলো, কুর'আনের উৎপত্তি বিষয়ক অনেক পশ্চিমা সংশয়বাদী এবং 'সংশোধনবাদী' তত্ত্বগুলো এখন পরীক্ষামূলক প্রাপ্ত ফলাফলগুলোর আলোকে অকার্যকর বলে প্রমাণিত। অন্যদিকে, কুর'আনের উৎপত্তি বিষয়ক প্রাচীন ইসলামী ঐতিহ্যের মধ্যে পাওয়া বিপরীত যুক্তিগুলো (যেমন, কুর'আন আল্লাহর বাণী) চলমান বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারসমূহের আলোকে ভালভাবে টিকে থাকে।[30]
ডেভিড থমাস উল্লেখ করেছেন যে, রেডিওকার্বন পরীক্ষায় সেই প্রাণীর মৃত্যু-তারিখ পাওয়া গেছে যার চামড়ায় (বার্মিংহাম) কুর'আন তৈরি, (তাই এটি) সে সময়ের তারিখ নয় যখন কুর'আন লেখা হয়েছিল। যেহেতু অলিখিত (ফাঁকা) পার্চমেন্ট প্রায়শই তৈরি হওয়ার পরে বছরের পর বছর ধরে সংরক্ষণ করা হয়, তাই তিনি বলেন যে, (বার্মিংহাম) কুর'আনটি উসমানের অধীনে কুরআনিক কোডিফিকেশনের সময়কালে তথা ৬৫০-৬৫৫ সালের শেষের দিকে লেখা হয়ে থাকতে পারে। বিবিসি কর্তৃক পরামর্শকৃত অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, "কোন কিছুই উড়িয়ে দেওয়া উচিত নয়" এবং (বার্মিংহাম কুর'আন লেখার) তারিখটি আবু বকরের অধীনে প্রথম লিখিত কুর'আনসমূহের শুরুর দিকেরও হতে পারে।[31]
২০১৫ এর ডিসেম্বরে কলেজ ডি ফ্রান্স এর ফ্রাঁসোয়া ডিরোচে প্যারিসের কোরআন বিএনএফ আরাবে ৩২৮(সি) এর সাথে বার্মিংহাম (কুর'আন পান্ডুলিপির) পাতা দুটির সনাক্তকরণ নিশ্চিত করেছিলেন যেমনটি আলবা ফেডেলি কর্তৃক (২০১৫ সালে) প্রস্তাবিত হয়েছিল। তবে, ডিরোচে বার্মিংহামের পাতা দুটির জন্য প্রস্তাবিত রেডিওকার্বন (ভিত্তিক) সময়কালের নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে আপত্তি প্রকাশ করেছেন। তিনি সেই সমস্ত অপরাপর উদাহরণগুলোর উল্লেখ করেছেন যেগুলোর ক্ষেত্রে রেডিওকার্বন ডেটিং (পরীক্ষা) এর ভিত্তিতে, একটি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাযুক্ত সময়কালের সাথে কুর'আনের (সময়কাল) নির্ধারণ করার প্রচেষ্টা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তিনি (ফ্রাঁসোয়া ডিরোচে) আরো উল্লেখ করেছেন যে, প্যারিস পাতাগুলো [বিএনএফ আরাবে ৩২৮(সি)] যেগুলো কিনা (বার্মিংহাম পান্ডুলিপির) অনুরুপ প্রতিলিপি, সেগুলোর একটিরও তেজস্ক্রিয় কার্বনভিত্তিক কালনিরূপণ পরীক্ষা করা হয়নি। স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের ইসলামিক স্টাডিজের সিনিয়র লেকচারার মোস্তফা শাহ প্রস্তাব রেখেছেন যে, বার্মিংহামের পাতায় বিদ্যমান ব্যাকরণগত চিহ্নগুলো এবং আয়াত বিভাজকগুলো প্রস্তাবিত প্রারম্ভিক রেডিওকার্বন সময়কালের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জামাল বিন হুওয়ারিব প্রস্তাব করেছেন যে, যদি রেডিওকার্বনের সময়কালগুলো নিশ্চিত করা যেত, তবে বার্মিংহাম/প্যারিস কুরআনকে প্রথম খলিফা আবু বকরের দ্বারা একত্রিত করা কুর'আনের (লিখিত) পাঠের সংকলন হিসেবে চিহ্নিত করা যেত যার সময়কাল ছিল ৬৩২ এবং ৬৩৪ সালের (সিই) মধ্যে।[31]
মারিজান ভ্যান পুটেন, যিনি উসমানি পাঠ প্রকরণের শব্দপ্রকরণের স্বকীয়তা যা কিনা সমস্ত (উসমানি) প্রাথমিক পান্ডুলিপিতে দেখা যায়, এর উপর[32] (গবেষণালব্ধ) কাজ (জার্নালে) প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন এবং উদাহরণ সহ দেখিয়েছেন যে, বার্মিংহাম (পান্ডুলিপি) অংশে (মিঙ্গানা ১৫৭২এ + আরাবে ৩২৮সি) এসব একই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যগত বানানগুলির একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ উপস্থিতি আছে, আর সেকারণে (তিনি বলেন যে) এটি "স্পষ্টভাবে উসমানিয় লিখন রীতির একটি অধস্তন রুপ" (উসমানিয়-লিপি-জাত) এবং (এও বলেন যে) পান্ডুলিপিটির (পার্চমেন্ট) পূর্বেকার তেজস্ক্রিয় কার্বনভিত্তিক কালনিরূপণ সত্ত্বেও এটি যে একটি প্রাক-উসমানিক কপি (খলিফা উসমান রাদ্বি-আল্লাহু আনহুর খেলাফতকালীন সময়ের পূর্বের)- তা (প্রমাণ) "অসম্ভব"।[33]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.