Loading AI tools
বিজ্ঞানের ধারণা বহির্ভূত এক জীব, যা জীবিতের রক্ত শোষণ করে জীবনধারণ করে। উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ভ্যাম্পায়ার বা রক্তচোষক হল বিজ্ঞানের ধারণা বহির্ভূত এক জীব, যা জীবিতের প্রাণরস (সাধারণত রক্তের আকারে) শোষণ করে জীবনধারণ করে। এরা প্রকৃতি ও মানুষের মন কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।ইউরোপীয় লোককথায় ভ্যাম্পায়ারদের মৃতোত্থিত জীব (Undead) মনে করা হয়। এই লোককথাগুলিতে দেখা যায়, তারা শবাচ্ছাদন বস্ত্র পরিধান করে, প্রিয়জনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং জীবৎকালে তারা যেখানে থাকত সেখানকার প্রতিবেশীদের ক্ষতিসাধন করে বা তাদের মৃত্যু ঘটায় ও নিজেদের মতো করে নেই। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে যে আধুনিক ভ্যাম্পায়ার কল্পনার সূত্রপাত ঘটেছিল তার বর্ণনায় ভ্যাম্পায়াররা কৃশকায় ও পাণ্ডুরবর্ণ হলেও লোককথার উক্ত ভ্যাম্পায়ারদের চেহারা সাধারণ মানুষ এর মতোই। বর্তমানে ভ্যাম্পায়ার সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
সারা বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ভ্যাম্পায়ার-জাতীয় জীবের কথা নথিবদ্ধ রয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর বলকান ও পূর্ব ইউরোপে প্রচলিত পুরনো লোকবিশ্বাসটিকে ঘিরে এক গণ-উন্মাদনার প্রেক্ষাপটে পশ্চিম ইউরোপে ‘ভ্যাম্পায়ার’ শব্দটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই গণ-উন্মাদনার ফলে কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকেরা কোনও কোনও ক্ষেত্রে ভ্যাম্পায়ার সন্দেহে মৃতদেহে সূচালো প্রান্তযুক্ত লাঠি বিদ্ধ করত, এমনকি অনেকের বিরুদ্ধে ভ্যাম্পায়ার-সত্তার অভিযোগও আনত।[1] পূর্ব ইউরোপে ভ্যাম্পায়ার-জাতীয় জীবেরা স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন: আলবেনিয়ায় শ্ট্রিগা, গ্রিসে ভ্রাইকোলাকাস ও রোমানিয়ায় স্ট্রিগোই।
আধুনিক যুগে ভ্যাম্পায়ারকে সাধারণত কাল্পনিক জীবই মনে করা হয়। তবে ভ্যাম্পায়ারের অনুরূপ জীবের অস্তিত্বে বিশ্বাস কোনও কোনও সংস্কৃতিতে এখনও বিদ্যমান। এই প্রসঙ্গে চুপাকাবরা-র নাম করা যেতে পারে। মনে করা হয় যে, মৃত্যুর পর দেহের ক্ষয় সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব এবং প্রাক্-শিল্পযুগীয় সমাজে সেই ক্ষয়ের সপক্ষে কী যুক্তি উপস্থাপনা করা হত তারই উদাহরণ হল ভ্যাম্পায়ার-সংক্রান্ত পুরনো লোকবিশ্বাসগুলি। সেই যুগে এই জাতীয় জীব কল্পনা করেই মৃত্যুর রহস্য ব্যাখ্যা করা হত। ১৯৮৫ সালে ভ্যাম্পায়ার কিংবদন্তির সঙ্গে যুক্ত হয় পরফিরিয়ার ধারণাটি। গণমাধ্যমে তা ব্যাপক প্রচার পেলেও সেই সময় থেকেই এই মতটিকে বিজ্ঞানীরা অস্বীকারই করে এসেছেন।[2][3]
১৮১৯ সালে প্রকাশিত হয় ইংরেজ লেখক জন পোলিডোরি রচিত "দ্য ভ্যাম্পায়ার" বইটির। এই বইটির মাধ্যমেই আধুনিক কথাসাহিত্যের সৌন্দর্যমণ্ডিত ও কেতাদুরস্ত ভ্যাম্পায়ার-ধারণার সূত্রপাত ঘটে। বইটি ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে। তর্কসাপেক্ষে এই বইটিকেই ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে লেখা সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ভ্যাম্পায়ার কাহিনি বলা চলে।[1] ১৮৯৭ সালে প্রকাশিত ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা উপন্যাসটিকে স্মরণ করা হয় ভ্যাম্পায়ার-বিষয়ক উপন্যাসের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন হিসেবে। এই উপন্যাসটিই আধুনিক ভ্যাম্পায়ার কিংবদন্তির মূল ভিত্তিটি রচনা করেছিল। যদিও স্টোকারের সমসাময়িক আইরিশ লেখক জোসেফ শেরিডান লে ফানুর কারমিলা উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭২ সালেই। তবে ড্রাকুলা উপন্যাসের সাফল্যই পরবর্তীকালে কথাসাহিত্যে স্বতন্ত্র ও বিপুলায়তন ভ্যাম্পায়ার কথাসাহিত্যের বর্গটির জন্ম দেয় এবং সেই সময় থেকেই ভ্যাম্পায়ারেরা ভৌতিক কথাসাহিত্যের অন্যতম প্রধান চরিত্রে পরিণত হয়। কথাসাহিত্যের বাইরেও চলচ্চিত্র, টেলিভিশন অনুষ্ঠান ও ভিডিও গেমের মাধ্যমে একবিংশ শতাব্দীতেও এই বর্গ তার জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে।
১৭৩২ সালে পূর্ব ইউরোপে ভ্যাম্পায়ার "মহামারী"-সংক্রান্ত সংবাদ প্রতিবেদনে ইংরেজি ভাষায় প্রথম vampire শব্দটি (vampyre বানানে) আবির্ভূত হয়।[4] ভ্যাম্পায়ারদের কথা তার আগেই আলোচিত হয়েছিল [[ফরাসি সাহিত্য|ফরাসি][5] ও জার্মান সাহিত্যে।[6] ১৭১৮ সালে পাসারোউইটজের চুক্তি বলে অস্ট্রিয়া উত্তর সার্বিয়া ও অলটেনিয়া অধিকার করলে আধিকারিকেরা সমাধি উৎখনন করে দেহ তুলে আনা ও "ভ্যাম্পায়ার হত্যা"-র স্থানীয় প্রথাটি লক্ষ্য করেন।[6] ১৭২৫ থেকে ১৭৩২ সালের মধ্যবর্তী সময়কালে প্রস্তুত করা এই প্রতিবেদনগুলি বহুল প্রচার লাভ করে।[6] ভ্যাম্পায়ারের ইংরেজি প্রতিশব্দটির উৎস (সম্ভবত ফরাসি vampyre হয়ে) জার্মান Vampir শব্দটি। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এই জার্মান শব্দটি আবার উৎসারিত হয়েছিল সার্বীয় vampir (সার্বীয় সিরিলীয়: вампир) শব্দটি থেকে।[7][8][9][10]
ভ্যাম্পায়ার নামের সার্বিয়ান প্রতিশব্দটির সমান্তরাল শব্দ কার্যত সকল স্লাভীয় ভাষাতেই রয়েছে: বুলগেরীয় ও ম্যাসেডোনীয় ভাষায় вампир (vampir), বসনীয় ভাষায় вампир (vampir), ক্রোয়েশীয় ভাষায় vampir, চেক ও স্লোভাক ভাষায় upír, পোলীয় ভাষায় wąpierz ও (সম্ভবত পূর্ব স্লাভীয়-প্রভাবিত) upiór, ইউক্রেনীয় ভাষায় упир (upyr), রাশিয়ান ভাষায় упырь (upyr'), বেলারুশীয় ভাষায় упыр (upyr), প্রাচীন পূর্ব স্লাভীয় упирь (upir') থেকে (এই ভাষাগুলির মধ্যে অনেকগুলিই পশ্চিম ইউরোপ থেকে পরবর্তীকালে "vampir/wampir" শব্দগুলি ঋণ করেছিল; জীবটির মূল স্থানীয় নামের থেকে এগুলি অনেকটাই আলাদা)। ‘ভ্যাম্পায়ার’ শব্দের সঠিক ব্যুৎপত্তিগত অর্থটি অস্পষ্ট।[11] প্রস্তাবিত প্রত্ন-স্লাভিক প্রতিশব্দগুলির অন্যতম *ǫpyrь ও *ǫpirь।[12] আলবেনিয়ান lu(v)gat ও dhampir শব্দ দু’টিও ব্যবহৃত হয়ে থাকে; শেষোক্ত শব্দটি সম্ভবত স্লাভিক ভাষাগুলি থেকে ঋণকৃত। তবে বাহ্যত মনে হয় যে এটি উৎসারিত হয়েছে ঘেগ dhamb (অর্থাৎ ‘দাঁত’) ও pir (অর্থাৎ ‘পান করা’) শব্দ দু’টি থেকে।[13]
আরেকটি কম প্রচারিত তত্ত্ব হল এই যে স্লাভিক ভাষাগুলি শব্দটি ঋণ করেছে ‘ডাইনি’ শব্দের তুর্কি প্রতিশব্দের থেকে (অর্থাৎ, তাতার ubyr শব্দটি; যদিও এটির সম্পর্কে প্রথম লৌকিক কিংবদন্তিগুলি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগের আগে নথিবদ্ধ হয়নি)।[12][14] চেক ভাষাতত্ত্ববিদ ভাক্লাভ মাচেক একটি ব্যুৎপত্তিগত প্রেক্ষাপট হিসেবে স্লোভাক ক্রিয়াপদ vrepiť sa (অর্থাৎ বিদ্ধ করা, ঠেলে ঢোকানো) বা সেটির বর্ণানুক্রম পরিবর্তন করে সৃষ্ট প্রকল্পিত শব্দ vperiť sa (চেক ভাষায় অচলিত ক্রিয়াপদ vpeřit-এর অর্থ ‘সবেগে ঠেলে ঢোকানো) শব্দটিকে প্রস্তাব করেছেন। এরফলে upír শব্দটির অনূদিত অর্থ দাঁড়ায় “যে ব্যক্তি ঠেলে ঢোকায়, কামড়ায়”।[15] ভিন্ন ভিন্ন সূত্র অনুযায়ী একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনও এক সময়ে রচিত বলে কথিত প্যাগান-বিরোধী "সন্ত গ্রিগোরির বাণী" (রাশিয়ান: Слово святого Григория) আলোচনা-গ্রন্থে প্রাচীন রাশিয়ান শব্দটির একটি আদি ব্যবহার লক্ষিত হয়, যেখানে প্যাগানদের দ্বারা upyri-র পূজার কথা জানানো হয়েছে।[16][17]
ভ্যাম্পায়ার-জাতীয় সত্তার ধারণা বহু সহস্রাব্দ ধরে বিদ্যমান। মেসোপটেমীয়, ইব্রীয়, প্রাচীন গ্রিক, মণিপুরী ও রোমানদের লোককথায় এমন কিছু দৈত্য ও প্রেতসত্তার উল্লেখ পাওয়া যায়, যেগুলিকে আধুনিক ভ্যাম্পায়ারের পূর্বসূরি মনে করা হয়। এই সব প্রাচীন সভ্যতায় ভ্যাম্পায়ার-জাতীয় জীবের কল্পনা থাকলেও ভ্যাম্পায়ার নামে যে জীবটি আজকে পরিচিত তার লোককথার উৎস প্রায় স্বতন্ত্রভাবেই অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের দক্ষিণপূর্ব ইউরোপ।[1] এই সময়েই এই অঞ্চলের অনেক জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে মৌখিকভাবে প্রচলিত লোককথা নথিবদ্ধ ও প্রকাশিত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভ্যাম্পায়ারেরা হল মৃতের জগৎ থেকে ফিরে আসা অশুভ সত্তা, আত্মহত্যাকারী বা ডাইনি। কিন্তু একটি মৃতদেহে ভর করে এক অশুভ আত্মা ভ্যাম্পায়ার সৃষ্টি করতে পারে; আবার এক ভ্যাম্পায়ার কর্তৃক দংশিত হয়েও আরেক ভ্যাম্পায়ারের সৃষ্টি সম্ভব – এমন বিশ্বাসও প্রচলিত ছিল। এই জাতীয় কিংবদন্তিতে বিশ্বাস এতটাই ব্যাপ্তি অর্জন করেছিল যে, কোনও কোনও এলাকায় গণ-উন্মাদনার সৃষ্টি হয়; এমনকি ভ্যাম্পায়ার সন্দেহে অনেককে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ডও দান করা হয়।[18]
লোককথার ভ্যাম্পায়ারের একটি একক সংজ্ঞামূলক বিবরণ প্রদান করা কঠিন। যদিও অনেক ইউরোপীয় কিংবদন্তির মধ্যে ভ্যাম্পায়ারের বেশ কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষিত হয়। বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ভ্যাম্পায়ারদের শরীর স্ফীত, গায়ের রং আরক্তিম, নীলচে লাল অথবা কালো; এই বৈশিষ্ট্যগুলি ভ্যাম্পায়ারদের সাম্প্রতিক রক্তপানের দ্যোতক। যখন ভ্যাম্পায়ারদের শবাচ্ছাদন-বস্ত্র পরিহিত অবস্থায় বা কফিনে শায়িত অবস্থায় দেখা যায় তখন তাদের মুখ ও নাক থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ে এবং তাদের বাঁ চোখ প্রায়শই খোলা থাকে।[19] কবর দেওয়ার সময় যে লিনিন শবাচ্ছাদন বস্ত্র সহ তাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল সেই কাপড়টি দিয়ে তার শরীর ঢাকা থাকে। তার দাঁত, চুল ও নখ খানিকটা বৃদ্ধিপ্রাপ্তও হতে পারে। যদিও সাধারণভাবে শদন্ত লোককথার ভ্যাম্প্যায়ারের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল না।[20] যদিও সাধারণভাবে ভ্যাম্পায়ারদের মৃতোত্থিত জীব বলে বর্ণনা করা হয়, কোনও কোনও লোককথায় তাদের জীবিত সত্তা হিসেবেই দর্শানো হয়েছে।[21][22]
মূল লোককথায় ভ্যাম্পায়ারের সৃষ্টির কারণ অনেকগুলি এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ। স্লাভীয় ও চীনা লোককথায় বলা হয়েছে যে, কোনও মৃতদেহের উপর যদি কোনও পশু (নির্দিষ্টভাবে কুকুর বা বেড়াল) ঝাঁপিয়ে পড়ে, তবে সেই মৃতদেহের মৃতোত্থিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।[23] যদি কোনও দেহে কোনও ক্ষতচিহ্ন থাকে এবং তা গরম জল দ্বারা চিকিৎসা করা না হয়, তাহলেও তার ভ্যাম্পায়ার হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। রাশিয়ান লোককথায় বলা হয়েছে যে, একদা ভ্যাম্পায়ারেরা ছিল ডাইনি অথবা সেই সব মানুষ যারা জীবদ্দশায় রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল।[24]
আলবেনীয় লোককথায়, ধ্যাম্পায়ার হল কার্কানজহোল (লোহার মেইল শার্ট পরিহিত এক নেকড়ে মানব-জাতীয় প্রাণী) অথবা লুগাট-এর (জলে বসবাসকারী ভূত বা দৈত্য) সংকর সন্তান। কার্কানজহোলের থেকে উদ্ভূত ধ্যাম্পায়ারদের কার্কানজহোলের উপস্থিতি উপলব্ধি করার এক স্বতন্ত্র ক্ষমতা রয়েছে। তা থেকেই “ধ্যাম্পায়ার লুগাটকে জানে” – এই কথাটির উদ্ভব। লুগাটদের দেখা যায় না। ধ্যাম্পায়ারই একমাত্র লুগাটকে হত্যা করতে পারে। আর এই ধ্যাম্পায়াররা সচরাচর লুগাটেরই পুত্র হয়। ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায়, বিভিন্ন পশুকে এমনকি নিদ্রিত জীবন্ত মানুষকেও লুগাটদের মতোই অশুভ জ্ঞান করা হয়। ধ্যাম্পিরাজ একটি আলবেনীয় পদবিও বটে।[25]
আধুনিক কথাসাহিত্যে দেখা যায়, যখন একজন ভ্যাম্পায়ার একজন মানুষকে কামড়ায় বা ‘জন্ম দেয়’, তখন সে সেই মানুষটিকে এক নতুন ভ্যাম্পায়ারে পরিণত করে এবং তাকে চিরন্তন জীবন দান করে। তবে জন্মদাতা ভ্যাম্পায়ারকে সেই মানুষটির জীবনরক্ষা করতে হয়। ভ্যাম্পায়ার যদি সেই মানুষের সব রক্ত শোষণ করে নেয় তাহলে সেই মানুষের মৃত্যু ঘটে। ভ্যাম্পায়ার সৃষ্টির এই প্রক্রিয়াটি চিত্রিত হয়েছে অ্যানে রাইসের ইন্টারভিউ উইথ দ্য ভ্যাম্পায়ার, ২০০০-এর দশকের টেলিভিশন ধারাবাহিক অ্যাঞ্জেল, ২০১২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত নেইল জর্ডন পরিচালিত ছবি বাইজান্টিয়াম এবং ২০১৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত জিম জারমাশ্চ পরিচালিত ছবি অনলি লাভারস লেফট অ্যালাইভ-এ।
বিভিন্ন সংস্কৃতিতে সদ্যপ্রয়াত প্রিয়জনেদের এক অশুভ মৃতোত্থিতে রূপান্তরিত হওয়া নিবারণ করতে নানা রকম প্রথার উদ্ভব ঘটেছে। এই ক্ষেত্রে মৃতদেহ হেঁটমুণ্ড-উর্ধ্বপদ অবস্থায় কবর দেওয়ার প্রথাটি বহুল প্রচলিত। এছাড়াও লম্বা হাতলওয়ালা কাস্তে বা ছোটো কাস্তে[26] প্রভৃতি জাগতিক বস্তু কবরের কাছে রেখে দেওয়া হয় যাতে দেহে প্রবেশে ইচ্ছুক দৈত্যেরা তুষ্ট হয়ে দেহটিতে প্রবেশ না করে অথবা যাতে মৃত ব্যক্তি তুষ্ট হয়ে কফিন থেকে ওঠার ইচ্ছা ত্যাগ করে। এই প্রথাটির সঙ্গে প্রাচীন গ্রিকদের মৃতদেহের মুখে ওবোল রাখার প্রথাটির সাদৃশ্য রয়েছে। গ্রিকরা মনে করত, স্টিক্স নদী পেরিয়ে পাতাললোকে যাত্রার জন্য ক্যারোনকে পারানি দিতে হয়। এর একটি বিকল্প ব্যাখ্যা এই দেওয়া হয় যে, মুদ্রাটির উদ্দেশ্য ছিল অশুভ আত্মাদের দেহে প্রবেশে বাধা দেওয়া এবং এটিই সম্ভবত পরবর্তীকালের ভ্যাম্পায়ার লোককথাকে প্রভাবিত করেছিল। ভ্রাইকোলাকাস-সংক্রান্ত আধুনিক গ্রিক লোককথায় এই প্রথাটি এখনও রয়ে গিয়েছে। এই লোককথায় দেখা যায়, মৃতদেহের ভ্যাম্পায়ারে রূপান্তর নিবারণ করতে তার উপর একটি মোমের ক্রস ও "যিশু খ্রিস্ট জয় করেন" এক টুকরো মৃৎপাত্র রেখে দেওয়া হয়।[27]
ইউরোপে যে সব পদ্ধতিগুলির বহুল প্রচলন ছিল তার মধ্যে রয়েছে ভ্যাম্পায়ার সন্দেহে মৃতদেহের হাঁটুর টেন্ডন ছিন্ন করা অথবা তার কবরের কাছে মাটিতে পোস্ত বীজ, বজরা বা বালি রেখে দেওয়া। শেষোক্ত প্রথাটির উদ্দেশ্য এই যে ভ্যাম্পায়ার সমস্ত রাত্রি ভূপতিত দানাগুলি গুনতে ব্যস্ত থাকবে।[28][29] এটি ইঙ্গিত করে ভ্যাম্পায়ারদের সঙ্গে অ্যারিথমোম্যানিয়া নামক মানসিক অসুখটির সম্পর্ক রয়েছে। অনুরূপ চীনা উপাখ্যানে বলা হয়েছে যে, ভ্যাম্পায়ার-জাতীয় সত্তারা যদি একটি চালের বস্তা পায় তাহলে তারা প্রতিটি দানা গুনে দেখে। একই ধারণা পাওয়া যায় ভারতীয় উপমহাদেশের লোককথায় এবং ডাইনি ও অন্যান্য অশুভ বা দুষ্ট প্রেত বা সত্তা-সংক্রান্ত দক্ষিণ আমেরিকান উপকথাতেও।[30]
ভ্যাম্পায়ার শনাক্ত করতে অনেক ধরনের আচার পালিত হত। ভ্যাম্পায়ারের কবর খুঁজে বার করার একটি প্রণালীতে যৌনমিলনে অনভিজ্ঞ এক বালককে যৌনমিলনে অনভিজ্ঞ একটি ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে কবরখানা বা গির্জা চত্বরের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হত—মনে করা হত, কোনও কবরে ভ্যাম্পায়ারের অস্তিত্ব থাকলে ঘোড়াটি সেই কবরের কাছ দিয়ে যেতে চাইবে না।[24] এক্ষেত্রে কালো ঘোড়া ব্যবহৃত হত। তবে আলবেনিয়ায় সাদা ঘোড়ার প্রয়োজন হত।[31] কবরের উপর মাটিতে গর্তের আবির্ভাবও ভ্যাম্পায়ার-সত্তার অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা হত।[32]
মনে করা হত যে, ভ্যাম্পায়ারে পরিণত হওয়া মৃতদেহগুলির অবস্থা প্রত্যাশিতের তুলনায় অধিকতর স্বাস্থ্যকর, সেই সব মৃতদেহ স্ফীত এবং তাতে পচনের চিহ্ন কম বা কোনও চিহ্নই থাকে না।[33] কয়েকটি ক্ষেত্রে গ্রামবাসীরা জানিয়েছিল যে, সন্দেহজনক কবরগুলি খনন করার পর দেখা গিয়েছে মৃতদেহের সারা মুখে তার শিকারের তাজা রক্ত লেগে ছিল।[34] নির্দিষ্ট এলাকায় গবাদি পশু, ভেড়া, মৃতের আত্মীয়স্বজন বা প্রতিবেশীর মৃত্যুও ভ্যাম্পায়ারের সক্রিয়তার প্রমাণ হিসেবে গৃহীত হত। লোককথার ভ্যাম্পায়ারেরা মাঝে মাঝে উপদ্রবকারী ভূতের মতো ছোটোখাটো ঘটনা ঘটিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয়। যেমন, ছাদে পাথর ছোঁড়া বা ঘরের জিনিসপত্র সরানো, [35] এবং ঘুমন্ত মানুষের বুকের উপর চেপে বসা।[36]
ভ্যাম্পায়ার লোককথায় অশুভ সত্তা দূরীকরণে সক্ষম নানাপ্রকার রক্ষাকবচের ব্যবহার লক্ষিত হয়। রসুন একটি সাধারণ উদাহরণ।[37] কথিত আছে, বুনো গোলাপ ও সাধারণ হথর্ন গাছের ডালও ভ্যাম্পায়ারদের ক্ষতি করে। ইউরোপে ভ্যাম্পায়ারদের দূরে রাখার জন্য বাড়ির ছাদে সরিষা দানা ছড়ানোরও প্রথা ছিল।[39] অন্যান্য রক্ষাকবচের মধ্যে ছিল ক্রুশিফিক্স, জপমালা ও পবিত্র জলের মতো পবিত্র বস্তুসকল। কথিত আছে, ভ্যাম্পায়ারেরা গির্জা বা মন্দিরের মতো পবিত্রকৃত স্থানের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারে না অথবা বহমান জলও পার হতে পারে না।[38]
প্রথাগতভাবে রক্ষাকবচ হিসেবে পরিগণিত না হলেও আয়নাকে মাঝে মাঝে ভ্যাম্পায়ার দূরীকরণের কাজে ব্যবহার করা হত। সেই ক্ষেত্রে আয়নাগুলিকে দরজায় বাইরের দিকে মুখ করে রাখা হত। কোনও কোনও সংস্কৃতিতে এমন বিশ্বাস ছিল যে, আয়নায় ভ্যাম্পায়ারের প্রতিবিম্ব ধরা পড়ে না এবং ক্ষেত্রবিশেষে ভ্যাম্পায়ারের ছায়াও থাকে না। এর কারণ হিসেবে সম্ভবত ভ্যাম্পায়ারদের আত্মা না থাকার বিষয়টিকে ধরে নেওয়া হত।[40] ভ্যাম্পায়ার সম্পর্কিত এই ধারণা বিশ্বজনীন না হলেও (গ্রিক ভ্রাইকোলাকা/তিম্পানিও-রা প্রতিবিম্ব ও ছায়া সৃষ্টিতে সক্ষম), ব্রাম স্টোকার ড্রাকুলা উপন্যাসে এই ধারণাটির প্রয়োগ ঘটান এবং পরবর্তীকালের লেখক ও চলচ্চিত্রকারদের মধ্যেই এটির জনপ্রিয়তা বজায় থাকে।[41]
কোনও কোনও পরম্পরায় মনে করা হয় যে, গৃহকর্তা কর্তৃক আমন্ত্রিত না হলে ভ্যাম্পায়ার কোনও গৃহে প্রবেশ করতে পারে না। একবার আমন্ত্রিত হওয়ার পর যখন ইচ্ছে ভ্যাম্পায়ারেরা আসা-যাওয়া করতে পারে।[40] লোককথার ভ্যাম্পায়াররা সাধারণের বিশ্বাস অনুযায়ী রাত্রিবেলা অধিকতর সক্রিয় হলেও তাদের সাধারণত সূর্যালোকে অরক্ষিত মনে করা হত না।[41]
সন্দেহভাজন ভ্যাম্পায়ারদের ধ্বংস করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হত। সেগুলির মধ্যে মৃতদেহে সূচালো প্রান্তযুক্ত লাঠি বিদ্ধ করার প্রথাটি ছিল বহুল প্রচলিত। বিশেষত দক্ষিণ স্লাভীয় সংস্কৃতিগুলিতে এই প্রণালীর বিশেষ চল ছিল।[43] এই লাঠি প্রস্তুতের ক্ষেত্রে রাশিয়া ও বাল্টিক রাষ্ট্রগুলিতে অ্যাশ কাঠ ব্যবহার করা হত;[44] সার্বিয়ায় ব্যবহার করা হত হথর্ন;[45] এবং সিলেসিয়াতে ওক কাঠ ব্যবহারের কথা নথিবদ্ধ হয়েছে।[46][47] লাঠি তৈরির ক্ষেত্রে আস্পেন কাঠ ব্যবহারেরও চল ছিল। কারণ মনে করা হত যে, খ্রিস্টের ক্রস আস্পেন কাঠে নির্মিত হয়েছিল। কথিত ভ্যাম্পায়ারদের কবরের উপর আস্পেনের ডাল রাখলে তারা রাতে জাগরিত হতে পারে না, এমন এক বিশ্বাসও প্রচলিত ছিল।[48] সম্ভাব্য ভ্যাম্পায়ারদের প্রায়শই হৃদপিণ্ড উক্ত লাঠি দিয়ে বিদারিত করা হয়। যদিও রাশিয়া ও উত্তর জার্মানিতে ভ্যাম্পায়ারের মুখে আঘাত করার[49][50] এবং উত্তরপূর্ব সার্বিয়ায় পাকস্থলীতে আঘাত করার প্রথা ছিল।[51]
স্ফীতকায় ভ্যাম্পায়ারদের ‘বিস্ফীত’ করার একটি উপায় ছিল বুকের চামড়ায় ছিদ্র করা। এটি ছিল "ভ্যাম্পায়ার-বিরোধী সমাধিস্থকরণ" প্রথার অনুরূপ: কাস্তের মতো ধারালো জিনিস মৃতদেহের সঙ্গে সমাহিত করা, যাতে দেহটি যদি অশুভ প্রভাবে স্ফীত হতে শুরু করে তাহলেই শরীরের চামড়ায় ছিদ্র সৃষ্টি হবে।[52]
জার্মানি ও পশ্চিম স্লাভীয় অঞ্চলগুলিতে শিরোশ্ছেদও ছিল আরেকটি প্রচলিত প্রক্রিয়া। সেই ক্ষেত্রে ছিন্ন মুণ্ডটি পায়ের ফাঁকে, নিতম্বের পিছনে বা শরীরের থেকে দূরে সমাধিস্থ করা হত।[43] কোনও কোনও সংস্কৃতিতে মনে করা হত যে, আত্মা মৃতদেহের সঙ্গেই থেকে যায়। তাই এই প্রক্রিয়াটিকে আত্মার দ্রুত বিতাড়নের পদ্ধতি হিসেবে দেখা হত। ভ্যাম্পায়ারের মাথা, শরীর বা পোষাক খুঁটি দিয়ে মাটির সঙ্গে বিদ্ধ করে রাখা হত তার জাগরিত হওয়া আটকানোর জন্য।[53]
রোমানিরা কবর দেওয়ার সময় শবদেহের হৃদপিণ্ডে ইস্পাত বা লোহার সূচ বিদ্ধ করত এবং শবের মুখে, চোখের উপর, দুই কানে ও আঙুলের ফাঁকে ইস্পাতের টুকরো রেখে দিত। এছাড়াও তারা শবের মোজায় হথর্ন রেখে দিত অথবা পায়ের মধ্যে হথর্নের সূচালো লাঠি বিদ্ধ করত। ভেনিসের কাছে ষোড়শ শতাব্দীর একটি সমাধিক্ষেত্রে একটি মহিলার শবদেহের মুখে ইট গোঁজা অবস্থায় পাওয়া যায়। ২০০৬ সালে যে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা এই সমাধিটি আবিষ্কার করেন তাঁরা এটিকে একটি ভ্যাম্পায়ার-হত্যার প্রথা বলে ব্যাখ্যা করেন।[55] বুলগেরিয়ায় একশোটিরও বেশি কঙ্কালে ধাবত বস্তু আবিষ্কৃত হয়েছে। এই সব বস্তুর অন্যতম শরীরের মধ্যে নিহিত লাঙলের অংশ।[54]
এছাড়াও ভ্যাম্পায়ার ধ্বংসের জন্য কবরের উপর গরম জল ঢালা বা দেহের সম্পূর্ণ ভস্মীভবনের প্রথা ছিল। বলকান অঞ্চলে মনে করা হত যে গুলি করে, ডুবিয়ে, অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া পুনরায়োজিত করে, দেহের উপর পবিত্র জল ছিটিয়ে অথবা প্রেত-বিতাড়ন ক্রিয়ার মাধ্যমেও ভ্যাম্পায়ার ধ্বংস করা যায়। রোমানিয়ায় শবের মুখে রসুন রাখা এবং ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত কফিনে গুলি করার মতো প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হত। প্রতিরোধমূলক ক্ষেত্রে শবদেহকে ছিন্নভিন্ন করে টুকরোগুলিকে পোড়ানো হত, জলে মেশানো হত এবং ঔষধ হিসেবে পরিবারের সদস্যদের প্রদান করা হত। জার্মানির স্যাক্সন অঞ্চলগুলিতে সন্দেহভাজন ভ্যাম্পায়ারের মুখে একটি লেবু রেখে দেওয়ারও প্রথা ছিল।[56]
সারা বিশ্ব জুড়ে বহু শতাব্দী ধরে প্রায় প্রতিটি সংস্কৃতিতেই জীবিতের রক্ত বা মাংস পান বা আহার করে জীবনধারণ করা অতিলৌকিক সত্তাদের কাহিনি পাওয়া যায়।[57] ‘ভ্যাম্পায়ার’ শব্দতির অস্তিত্ব অবশ্য প্রাচীনকালে ছিল না। রক্তপান ও অনুরূপ কার্যকলাপ দানব বা প্রেতাত্মার কাজ বলে মনে করা হত। মনে করা হত, এই জাতীয় সত্তারা রক্তপান করে বা মাংস ভক্ষণ করে। এমনকি শয়তানকেও ভ্যাম্পায়ারের সমার্থক মনে করা হত।[58] প্রায় প্রতিটি সংস্কৃতিতেই রক্তপানকে এক ধরনের অশুভ সত্তা বা দানবের কাজের সঙ্গে যুক্ত করা হয়; ক্ষেত্রবিশেষে সেটিকে মনে করা হয় কোনও দেবতার কাজ। ভারতে কথাসরিৎসাগরের অন্তর্গত একটি বিশিষ্ট কাহিনি বেতাল পঞ্চবিংশতিতে বেতাল নামে এক ধরনের পৈশাচিক সত্তার উল্লেখ আছে। এই বেতালেরা মৃতদেহে বসবাস করে। রাজা বিক্রমাদিত্য রাত্রিবেলা এক পলায়নপর বেতালকে ধরতে বের হয়েছিলেন। তা নিয়েই বেতাল পঞ্চবিংশতির কাহিনি।[59] পাপী বা যারা পাগল অবস্থায় মারা যায় তাদের প্রেতাত্মা পিশাচ নামে পরিচিত। এই পিশাচদেরও ভ্যাম্পায়ার-সুলভ বৈশিষ্ট্য লক্ষিত হয়।[60]
পারস্যই প্রথম সভ্যতা যেখানে রক্তপায়ী দানবদের কাহিনি গড়ে ওঠে: মানুষের রক্তপানে উদ্যত এই জীবদের ছবি উৎখননের ফলে প্রাপ্ত মৃৎপাত্রের ভাঙা টুকরোয় পাওয়া যায়।[61] প্রাচীন ব্যাবিলনিয়া ও আসিরিয়ায় পৌরাণিক লিলিটুর উপাখ্যান প্রচলিত ছিল।[62] লিলিটু ও হিব্রু দানবতত্ত্বে উল্লিখিত লিলিথ (হিব্দু לילית) সমার্থক। লিলিটুর কাহিনিই লিলিথ ও তার কন্যাবর্গ লিলুর কাহিনিটির উৎস। লিলিটুকে দানব মনে করা হয় এবং বর্ণনায় প্রায়শই তাকে শিশুদের রক্তপানকারিনী হিসেবে দেখানো হয়।[62] এছাড়াও হিব্রু দানবতত্ত্বে এস্ট্রি নামে এক রক্তপায়ী রূপান্তরক্ষম দানবীর উল্লেখ আছে, যারা রাতে মানুষের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় শিকারের খোঁজে। সেফের হাসিদিমের মতে, ঈশ্বর বিশ্রাম গ্রহণের পূর্বে গোধূলিবেলায় এস্ট্রিদের সৃষ্টি হয়েছিল। একজন আহত এস্ট্রি আরোগ্যলাভ করতে পারে তার আক্রমণকারীদের দেওয়া রুটি ও নুন খেয়ে।
গ্রিকো-রোমান পুরাণে বর্ণিত হয়েছে এম্পুসা,[63] লামিয়া,[64] মোর্মো[65] ও স্ট্রিক্সদের কথা। কালক্রমে প্রথম দু’টি নাম যথাক্রমে ডাইনি ও দানবদের সংজ্ঞাবাচক সাধারণ নামে পরিণত হয়। এম্পুসা ছিল দেবী হেকেটির কন্যা। পুরাণে তাকে এক দানবীসুলভ ও ব্রোঞ্জের পা-বিশিষ্ট জীব হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সে তরুণীর রূপ ধরে পুরুষদের প্রলুব্ধ করে তাদের সঙ্গে যৌনসংগম করত এবং তারপর তাদের রক্তপান করত।[63] লামিয়া রাতে শিশুদের বিছানায় হানা দিয়ে তাদের রক্ত পান করে। গেলোরাও একই কাজ করে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[64] লামিয়ার মতো স্ট্রিক্সরাও শিশুদের শিকার করে, কিন্তু তারা প্রাপ্তবয়স্কদেরও ছাড়ে না। পুরাণের বর্ণনায় তাদের শরীর কাক বা সাধারণভাবে পাখির মতো। পরবর্তীকালে রোমান পুরাণে স্ট্রিক্স নামে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। রোমান পুরাণের বর্ণনায় বলা হয় যে, স্ট্রিক্সেরা এক ধরনের নিশাচর পাখি, যারা নরমাংস ও নররক্তে জীবনধারণ করে।[66]
ভ্যাম্পায়ার-কেন্দ্রিক অনেক অতিকথারই উৎস মধ্যযুগ। দ্বাদশ শতাব্দীর ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ও কালপঞ্জিকার ওয়াল্টার ম্যাপ ও নিউবার্গের উইলিয়াম অশুভ সত্তার কথা নথিবদ্ধ করেছিলেন।[18][67] যদিও এর পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডের নথিতে ভ্যাম্পায়ার-জাতীয় সত্তার উল্লেখ অল্পই পাওয়া যায়।[68] স্ক্যান্ডিনেভীয় লোককথায় ড্রৌগর হল ভ্যাম্পায়ার সমতুল্য মৃতোত্থিত জীবের আরেকটি মধ্যযুগীয় উদাহরণ।[69] ইহুদি সাহিত্যে ভ্যাম্পায়ার-জাতীয় সত্তাদের কথা খুব কমই লেখা হয়েছে। ষোড়শ শতাব্দীর রাব্বি ডেভিড বেন সলোমন ইবন আবি জিমরা (রাদবাজ) লিখেছেন যে, এক নিষ্ঠুর অনুদার বৃদ্ধার মৃতদেহ মৃত্যুর পর তিন দিন অরক্ষিত ও অসমাহিত অবস্থায় পড়ে ছিল এবং তারপর সে এক ভ্যাম্পায়ার-জাতীয় জীব হিসেবে উত্থিত হয়ে শতাধিক লোককে হত্যা করেছিল। তিনি এই ঘটনাটিকে যুক্ত করেছিলেন মৃত্যুর পর শ্মিরাহ্-এর (প্রহরা) অভাবের সঙ্গে যুক্ত করেন এবং বলেন যে অরক্ষিত মৃতদেহ অশুভ আত্মার মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে।[70]
যথাযথভাবে লোককথা থেকে উৎসারিত ভ্যাম্পায়ারদের কথা সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে পূর্ব ইউরোপ থেকে প্রতিবেদনের আকারে বহুল প্রচারিত হয়। এই উপাখ্যানগুলিই ভ্যাম্পায়ার কিংবদন্তির ভিত্তি রচনা করে, যা পরবর্তীকালে জার্মানি ও ইংল্যান্ডে প্রবেশ করে। এই দুই দেশে এরপর এই কিংবদন্তি অলংকৃত হয় এবং জনপ্রিয়তা লাভ করে। ভ্যাম্পায়ার সক্রিয়তার সবচেয়ে পুরনো নথিবদ্ধ উল্লেখটি পাওয়া যায় ১৬৭২ সালে আধুনিক ক্রোয়েশিয়ার ইস্ট্রিয়া অঞ্চল থেকে।[71] স্থানীয় প্রতিবেদনে বর্ণিত হয় যে, ১৬৫৬ সালে মৃত্যুর পর জুরে গ্র্যান্ডো ভ্যাম্পায়ারে পরিণত হয়েছেন এমন এক বিশ্বাস থেকে গ্রামবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল।[72] স্থানীয় গ্রামবাসীরা দাবি করে যে, তিনি মৃতের জগৎ থেকে ফিরে এসেছেন, মানুষের রক্ত পান করে বেড়াচ্ছেন এবং নিজের বিধবা পত্নীকে যৌন হেনস্থা করছেন। গ্রামপ্রধান আদেশে তাঁর হৃদপিণ্ডের মধ্য দিয়ে সূচাগ্র লাঠি বিঁধিয়ে দেওয়া হয় এবং পরে সেই মৃতদেহটির শিরোশ্ছেদও করা হয়।[73]
অষ্টাদশ শতাব্দীতে পূর্ব ইউরোপে ভ্যাম্পায়ার দেখা গিয়েছে বলে এক উন্মাদনা দেখা দেয় এবং তার ফলে প্রায়শই সম্ভাব্য অশুভ সত্তাদের শনাক্ত ও হত্যা করার জন্য কবর খোঁড়া ও মৃতদেহে সূচ্যগ্র লাঠি বিদ্ধ করার ঘটনা ঘটতে থাকে। এমনকি সরকারি আধিকারিকেরাও এই ধরনের ভ্যাম্পায়ার শিকারের কাজে জড়িয়ে পড়তে থাকেন।[74] আলোকিত যুগ নামে পরিচিত এই সময়কালে লোককথার অধিকাংশ কিংবদন্তি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে খারিজ হয়ে গেলেও ভ্যাম্পায়ারে বিশ্বাস নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায় এবং তার ফলে ইউরোপের প্রায় সমগ্র অঞ্চল জুড়ে এক গণ-উন্মাদনার সৃষ্টি হয়।[18] ১৭২১ সালে পূর্ব প্রুশিয়ায় এবং ১৭২৫ থেকে ১৭৩৪ সালের মধ্যবর্তী সময়ে হ্যাবসবার্গ রাজ্যে তথাকথিত ভ্যাম্পায়ার আক্রমণের প্রাদুর্ভাব ঘটতেই এই সব অঞ্চলে এবং সেই সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলেও মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সরকারিভাবে প্রথম নথিবদ্ধ করা দু’টি কুখ্যাত ভ্যাম্পায়ার আক্রমণের ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল সার্বিয়ার পিটার ব্লাগোজেভিচ ও মিলোস সিজারের শবদেহের নাম। কথিত আছে যে, ৬২ বছর বয়সে প্রয়াত ব্লাগোজেভিচ মৃত্যুর পর ফিরে এসে নিজের পুত্রের থেকে খাবার চেয়েছিলেন। কিন্তু পুত্র তা দিয়ে অস্বীকার করলে পরদিন তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। স্থানীয়দের বিশ্বাস, ব্লাগোজেভিচ এর পরেও ফিরে আসেন এবং কয়েজজন প্রতিবেশীকে আক্রমণ করেন। তাদের শরীরের রক্ত কমে গিয়ে মৃত্যু ঘটেছিল।[74]
অপর দিকে মিলোস ছিলেন এক প্রাক্তন সৈনিক যিনি কৃষকের বৃত্তি গ্রহণ করেছিলেন। জনশ্রুতি অনুযায়ী, খড় কাটতে কাটতে মৃত্যু হওয়ার কয়েক বছর আগে একটি ভ্যাম্পায়ার তাঁকে আক্রমণ করেছিল। মিলোসের মৃত্যুর পর যখন আশেপাশের এলাকায় মানুষ একে একে মারা যেতে শুরু করে তখন সবাই মনে করে যে মিলোস ফিরে এসে প্রতিবেশীদের শিকার করে বেড়াচ্ছেন।[75][76] আরেকটি কুখ্যাত সার্বীয় ভ্যাম্পায়ার কিংবদন্তিতে জনৈক সাভা সাভানোভিচের নাম পাওয়া যায়। কথিত আছে, তিনি একটি ওয়াটারমিলে থাকতেন এবং মিলের শ্রমিকদের হত্যা করে রক্তপান করতেন। সার্বীয় লেখক মিলোভান গ্লিসিচ এই চরিত্রটিকে ভিত্তি করে পরবর্তীকালে একটি গল্প রচনা করেন এবং ১৯৭৩ সালে যুগোস্লাভে নির্মিত ভৌতিক চলচ্চিত্র লেপ্টিরিকা এই গল্পটি থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছিল।[77]
এই দু’টি ঘটনা ভালোভাবে নথিবদ্ধ করা হয়েছিল। সরকারি আধিকারিকবৃন্দ মৃতদেহগুলি পরীক্ষা করে কেস রিপোর্ট লেখেন এবং সারা ইউরোপ জুড়ে এই বিষয়ে বই প্রকাশিত হয়।[76] সাধারণভাবে "অষ্টাদশ শতাব্দীর ভ্যাম্পায়ার বিতর্ক" নামে পরিচিত এই গণ-উন্মাদনা এক প্রজন্মকাল টিকে ছিল। গ্রামের দিকে তথাকথিত ভ্যাম্পায়ার আক্রমণের ঘটনাগুলি এই সমস্যাটিকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যায়। এর ফলে স্থানীয় গ্রামবাসীরা প্রায়শই কবর খুঁড়ে দেহ তুলে আনা এবং ক্ষেত্রবিশেষে সেই সব মৃতদেহে লাঠি বিদ্ধ করার মতো কাজে লিপ্ত হতে থাকে।[78]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.