মীনাক্ষী মন্দির
ভারতের একটি হিন্দু মন্দির উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ভারতের একটি হিন্দু মন্দির উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
মীনাক্ষী মন্দির বা মীনাক্ষী আম্মান মন্দির বা মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বর মন্দির[2] হলো একটি ঐতিহাসিক ও উল্লেখযোগ্য মন্দির, যা দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর মাদুরাই শহরে ভাইগাই নদীর [3] দক্ষিণ তীরে অবস্থিত৷ এটি তামিলনাড়ুর মন্দির নগরীগুলির অন্যতম৷[4] মন্দিরটি দেবী পার্বতীর মীনাক্ষী রূপ এবং তার স্বামী শিবের সুন্দরেশ্বর রূপের উদ্দেশ্যে নিবেদিত৷[5][6] মন্দিরটি প্রাচীন মন্দিরনগরী মাদুরাইয়ের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত৷ খ্রিস্টীয় ষষ্ট শতাব্দীতে তামিল সঙ্গম সাহিত্যের মন্দিরটিকে মূলত দেবী মীনাক্ষীর মন্দির হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে৷[7] এটি খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে তামিল সাহিত্যে উল্লিখিত ২৭৫ টি "পাঠল প্রাপ্ত স্থলম" শিবমন্দিরগুলির একটি৷
মীনাক্ষী মন্দির তিরু আলাবৈ | |
---|---|
মদুরৈ মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বর কোয়িল | |
ধর্ম | |
অন্তর্ভুক্তি | হিন্দুধর্ম |
জেলা | মাদুরাই |
ঈশ্বর | মীনাক্ষী দেবী, সুন্দরেশ্বর/চোক্কনাথ |
উৎসবসমূহ | চৈত্রী তিরুবিলা |
বৈশিষ্ট্য |
|
অবস্থান | |
অবস্থান | মাদুরাই |
রাজ্য | তামিলনাড়ু |
দেশ | ভারত |
স্থানাঙ্ক | ৯°৫৫′১০″ উত্তর ৭৮°০৭′১০″ পূর্ব |
স্থাপত্য | |
ধরন | দ্রাবিড়[1] |
শিলালিপি | চল্লিশোর্দ্ধ |
উচ্চতা | ১৪৪ মি (৪৭২ ফু) |
ওয়েবসাইট | |
Official TNHRCE |
দক্ষিণ ভারতের পাণ্ড্য রাজবংশ-এর আমলে এই মন্দির নির্মাণ শুরু ও সম্পন্ন হয়। রাজবংশের রাজধানী ছিল মাদুরাই । রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে বিসতৃত জায়গা নিয়ে এই মন্দিরের নির্মাণ শুরু হয়।
মন্দিরটি রাজা প্রথম সদায়বর্মণ কুলাসেকরণ পাণ্ড্য (১১৯০-১২১৬ খ্রিষ্টাব্দ) দ্বারা নির্মাণ শুরু হয়। তিনি সুন্দরেশ্বরর মন্দিরের প্রবেশদ্বারে গোপুরাটির(প্রবেশ মিনার) মূল অংশগুলি এবং মন্দিরের প্রাচীনতম বেঁচে থাকা অংশগুলির মধ্যে কয়েকটি যেমন দেবী মীনাক্ষী মন্দিরের কেন্দ্রীয় অংশটি নির্মাণ করেছিলেন। ঐতিহ্যবাহী গ্রন্থগুলিতে তাঁকে কবি-সাধক রাজা বলা হয়, প্রধান মন্দিরের নিকটবর্তী নটরাজ ও সূর্য-এর পূর্বে আয়য়নার, দক্ষিণে বিনয়গর, পশ্চিমে করিয়ামাল্পারুমাল এবং উত্তরে কালী মন্দিরগুলি প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি একটি মহামন্ডপমও নির্মাণ করেছিলেন। কুলাসেকর পান্ড্যও কবি ছিলেন এবং তিনি দেবী মীনাক্ষীর উপর একটি কবিতা রচনা করেছিলেন যার নাম অম্বিকাই মালাই।
১২৩১ সালে কুলাসেকরণের ছোট ভাই এবং উত্তরসূরি প্রথম মারাভর্মণ সুন্দর পাণ্ডন একটি গোপুরা তৈরি করেছিলেন, পরে অনন্তরমন নামে পরিচিত, পরে পুনর্নির্মাণ, প্রসারিত এবং সুন্দরা পান্ড্য তিরুচুপুরম নামকরণ করা হয়।
কমপ্লেক্সের দক্ষিণ পূর্ব দিকে চিত্রা গোপুরম (পশ্চিম), যা মুত্তালাকুম ভাইয়েল নামেও পরিচিত, সেটি পরবর্তী রাজা দ্বিতীয় মরাবর্মণ সুন্দর পাণ্ডন (১২৩৮-১২৫১) দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। হিন্দু সংস্কৃতির ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মীয় বিষয়কে চিত্রিত করে ফ্রেসকোস এবং পরিত্রাণগুলির নামে এই গোপুরামটির নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়াও সুন্দরেশ্বর মন্দির এবং সুন্দর পাণ্ডন মন্ডপমকে একটি স্তম্ভিত করিডোর দ্বারা যুক্ত করেছিলেন।
যদিও মন্দিরটির পেছনে অনেক ইতিহাস ও পৌরাণিক কথা রয়েছে, তাও বলা যায় বর্তমান মন্দিরের সংস্কার, বিস্তৃতকরণ এবং অধিকাংশ নিদর্শনই খ্রিস্টীয় চতুর্দ্দশ শতাব্দী এবং পরে তিরুমালাই নায়কের দ্বারা সপ্তদশ শতাব্দীতে তৈরী হয়েছিলো৷[8][9] চতুর্দ্দশ শতাব্দীর শুরুর দিকে দিল্লির মুসলিম শাসক তার সেনাধ্যক্ষ মালিক কাফুর তার সৈন্যদলসহ মন্দিরটি আক্রমণ করেন, মহামূল্যবান জিনিসপত্র লুঠ করেন এবং দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য মন্দিরের মতো এটিও নষ্ট করার চেষ্টা করেন৷[10][11][12] সমসাময়িক মন্দিরটি বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সময়ে আবার নতুন করে তৈরী করা হয় ও তাদেরই তৎপরতায় তার চালু হয়৷[10][13] খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে নায়ক বংশের শাসক বিশ্বনাথ নায়ক মন্দির চত্বরটি আবার বিস্তৃৃত করার কাজ শুরু করান,যা বংশানুক্রমে সংস্কার হতে থাকে৷ বর্তমানে পূর্ণতাপ্রাপ্ত স্থাপত্যটিতে ১৪টি গোপুরম তথা প্রবেশমিনার রয়েছে৷ এগুলি মোটামুটি ৪৫-৫০ মিটার অবধি উচ্চ এবং দক্ষিণদিকে সজ্জিত একটি গোপুরম সর্বাধিক ৫২ মিটার উচ্চ৷ মন্দির চত্বরে বহুসংখ্যায় ভাস্কর্যখচিত স্তম্ভ রয়েছে, যার মধ্যে সহস্রস্তম্ভযুক্ত "আয়িরক্কল" দালান অন্যতম৷ এছাড়াও রয়েছে কিলিক্কূণ্ডু মণ্ডপম (শুকপিঞ্জর মন্ডপ), গোলু মণ্ডপম (কর্ণিক মন্ডপ), পুদু মণ্ডপম (নব মন্ডপ) ইত্যাদি৷ মন্ডপ, স্তম্ভ এবং মন্দিরের বিমানে একাধিক পৌরানিক ঋষি, সাধক ও দেবদেবীর মর্ত্তি রয়েছে৷ মীনাক্ষী ও সুন্দরেশ্বর শিবের গর্ভগৃহের ওপর অবস্থিত বিমানটি স্বর্ণমণ্ডিত করা রয়েছে৷[13][14][15]
শৈব্যদের মধ্যে দেবী মীনাক্ষী এবং শিবেব অদ্দেশ্যে তৈরী এই মন্দিরটির শৈবতীর্থ হিসাবে মাহাত্ম অধিক৷ স্থানীয় বিভিন্ন আখ্যানে এই মন্দিরটির সাথে বিষ্ণুও জড়িত রয়েছেন৷ মন্দিরটির ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে বিষ্ণুকে দেবী মীনাক্ষীর ভ্রাতারূপে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে৷[16] এই শ্রুতির ফলই "দক্ষিণ ভারতের মথুরা", তথা মাদুরাইয়ের নাম বৈষ্ণবদের বিভিন্ন গ্রন্থে পাওয়া যায়৷[17][18] মীনাক্ষী মন্দিরে লক্ষ্মী, বংশীবাদক কৃৃষ্ণ, রুক্মিনী, ব্রহ্মা, সরস্বতী এবং বেদ ও পুরাণে বর্ণিত অন্যান্য অনেক দেবদেবীর মূর্তি ও তাদের ভাস্কর্য হয়ে মন্দিরের বিভন্ন স্থানে৷ মন্দিরটির বৃহত্তর এলাকা এবং মাদুরাই শহরের মধ্যস্থলে অবস্থানের দরুন প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী এই মন্দির দর্শন করতে আসেন৷[19] প্রতিবছর দশদিন ধরে চলা মীনাক্ষী তিরুকল্যাণম অনুষ্ঠানে প্রতিদিন গড়ে দশলক্ষেরও অধিক পূণ্যার্থী ও দর্শনার্থী জমায়েত হন৷ তামিল মাস চিত্তিরৈতে (বাংলার চৈত্রমাস) ঐ অনুষ্ঠান চলাকালীন মূলমূর্ত্তির রথারোহণের দিন সর্বাধিক ভক্তসমাগম ঘটে৷[20] মন্দিরটি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উদ্ভাবিত স্বচ্ছ ভারত অভিযান প্রকল্প অনুসারে ১লা অক্টোবর ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে শ্রেষ্ঠ "সোয়াছ আইকনিক প্লেস" (নির্মল দিব্য স্থান) উপাধিতে ভূষিত হয়৷[21]
মীনাক্ষী মন্দিরটি ঐতিহাসিক মাদুরাই শহরের প্রাণকেন্দ্রে ভাইগাই নদীর দক্ষিণ তীরে কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত৷ এটি রাজ্যের রাজধানী চেন্নাই থেকে ৪৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিম দিকে অবস্থিত৷[22] মন্দিরটির সাথে অন্যান্য অঞ্চলের সড়ক পরিবহন যথেষ্ট উন্নত৷ ৩৮ নম্বর ভারতীয় জাতীয় সড়ক, মাদুরাই জংশন রেলওয়ে স্টেশন এবং দৈনিক বিমান পরিবহনযুক্ত মাদুরাই বিমানবন্দরটি এর সন্নিকটে অবস্থিত৷ শহরটির একাধিক বৃহত্তর সড়ক মন্দিরচত্বরে এসেই মিলিত হয়৷ আবার হিন্দু শিল্পশাস্ত্র অনুসারে শহরের নকশায় তৈরী সমকেন্দ্রীয় বৃৃত্তাকার রিংরোড বা বলয় সড়কটিও এই মন্দিরটিকে ঘিরেই তৈরী৷[8][23] রাজ্যের অন্যান্য একাধিক মন্দিরকেন্দ্রিক শহরগূলির মতোই মাদুরাই শহরটিও ঐতিহাসিক কার্যক্রম ও জনশ্রুতি অনুসারে নামাঙ্কিত৷ ঐ নির্দিষ্ট অঞ্চলে বিশেষ ধরনের বৃৃক্ষ ও গুল্মজাতীয় গাছপালার মধ্যে দেবমূর্ত্তি রক্ষিত ছিলো বলে প্রবাদ রয়েছে৷ সাধারণের মধ্যে প্রবাদ আছে যে দিব্যমূর্তি সেই কদম্ববনের মধ্যেই লুক্কাইত ছিলো ফলে জায়গাটি কদম্ববনম নামে পরিচিত ছিলো৷[24]
মীনাক্ষী (সংস্কৃত: मीनाक्षी, প্রতিবর্ণীকৃত: মীনাক্ষী, তামিল: மீனாட்சி, প্রতিবর্ণী. মীন়াট্চি) হলো একটি সংস্কৃত শব্দ যার আক্ষরিক অর্থ "মৎস্যসম চক্ষুবিশিষ্টা",[25] যা দুটি সংস্কৃৃত শব্দ "মীন" বা মাছ এবং "অক্ষী" বা চক্ষুবিশিষ্টা-এর সমন্বয়ে গঠিত৷[26] দেবী এর পূর্বে তামিল ভাষাতে "তড়াদকৈ" নামে পরিচিতা ছিলেন, যার আক্ষরিক অর্থও মীনসম অক্ষিবিশিষ্টা৷ প্রাচীন ঐতিহাসিক পুঁথি অনুসারে তিনি ছিলেন হিংস্র, অবিবাহিত এবং মাংসভক্ষণকারী দেবী, যিনি পরে মীনাক্ষী নামে সংস্কৃৃৃতকরণ হন৷[27] আবার অন্যমত অনুসারে, দেবীর নামের উৎপত্তিগত আক্ষরিক অর্থ "মৎস্যকুলের শাসন", যা দুটি তামিল শব্দ "মীন" অর্থাৎ মৎস্য এবং "আটচি" অর্থাৎ শাসন নিয়ে গঠিত৷[28][29] এছাড়াও তিনি "অঙ্গয়ড়কন্নি" বা "অঙ্গয়ড়কন্নম্মৈ" তামিল নামে পরিচিত, তামিল ভাষা অনুসারে এর আক্ষরিক অর্থ সুন্দর মৎস্যন্যায় চক্ষুবিশিষ্টা মাতৃৃমূর্ত্তি৷[25][30]
দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য একাধিক শিব মন্দির গুলিতে ভগবান শিব মূখ্যমূর্ত্তি হলেও মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বর মন্দিরে দেবী মীনাক্ষীর মূর্ত্তিই মূল হিসাবে গণ্য করা হয়৷ [4] তামিল পুস্তক "তিরুবিলৈয়তরপুরাণম"-এ উল্লিখিত কথা ও কথিত জনশ্রুতি অনুসারে, রাজা মলয়ধ্বজ পাণ্ড্য এবং তার স্ত্রী কাঞ্চনমলৈ পুত্রলাভ কামনায় একবার একটি যজ্ঞ আয়োজন করেন৷ কিন্তু ফলস্বরূপ তিনি ইতিমধ্যেই তিন বৎসর বর্ষীয়া এবং ত্রিস্তনসম্পন্না এক কন্যা লাভ করেন৷ শিব প্রকট হন এবং সন্তানের অভিভাবক-অভিভাবিকাকে বলেন যেন তারা তাকে পুত্ররূপে পালন করেন, আবার জাত কন্যা তার হবুস্বামীর সাক্ষাৎ পেলে নিজে থেকেই তার তৃতীয় স্তন খসে পড়বে৷ তারা ভগবান শিবের আদেশ পালন করেন৷ যথারীতি কন্যা বড় হতে থাকলে রাজা তাকে একজন সফল যোদ্ধা উপমায় ভূষিত করেন৷ পরে তিনি ভগবান শিবের সাক্ষাৎ পেলে তাদের কথা সত্যি হয় এবং কন্যাটি তার আসল "মীনাক্ষী" রূপের প্রকাশ ঘটান৷[31][32] বিদ্বজ্জনের মতে, ঘটনাটি দক্ষিণ ভারতের মাতৃকুলভিত্তিক পরিবার প্রথা এবং" অন্তিম শক্তি নারীর মধ্যেই বর্তায়" এই আঞ্চলিক বিশ্বাসকেই প্রতিফলিত করে৷ দেবতাগণ রাজার কথা চিন্তা করেন এবং রাজ্যে নারীতান্ত্রিক শ্বাসনতন্ত্রের সূত্রপাত করেন৷[31] বিশ্লেষচ সুসান বেইলির মতে, দেবী মীনাক্ষীর প্রতি শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠা প্রদর্শন হলো হিন্দু দেবীর উদ্দেশ্যে কৃৃত দ্রাবিড় হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি রীতি "নারীই সমাজতন্ত্রের কাণ্ডারী" এই কথাটির সাথে সামাজিক সম্বন্ধ্যের প্রতিফলন ঘটায়৷[33]
বিশ্বাস করা হয় যে, দেবী মীনাক্ষী এবং ভগবান শিবের বিবাহ অনুষ্ঠানে সমস্ত অন্যান্য দেব-দেবী এবং সমস্ত মর্তবাসী আমন্ত্রিত ছিলেন৷ শ্রীবিষ্ণু এই বিবাহের দেবী মীনাক্ষীর ভ্রাতারূপে নিজেকে প্রকাশ করেন৷ তিনিই তার ভগিনীকে ভগ্নীপতি শিবের হাতে সমর্পণ করেছিলেন বলে প্রবাদ রয়েছে৷
মাদুরাই শহরটি বেশ প্রাচীন এবং সঙ্গম কালীন নথিপত্রগুলিতেও শহরটির অস্তিত্বের উল্লেখ পাওয়া যায়৷[3] যুগটি ছিলো খ্রিস্টীয় প্রথম থেকে চতুর্থ শতকের বিস্তৃৃত সময়ের মধ্যে৷[34] কিছু পুরানো তামিল বইতে মাদুরাই শহরটির নাম "কূডল" বলে উল্লেখ করা রয়েছে এবং সেখানে শহরটিকে রাজধানী নগরের সাথে সাথে মন্দিরনগরীগুলির একটিও বলা হয়েছে৷ উল্লেখ রয়েছে শহরের মূলমন্দির থেকে শহরের যোগাযোগের রাস্তাগুলি বিভিন্ন দিকে বিস্তৃত করার পরিকল্পনা৷ দেবী মীনাক্ষীকে শহরটির দৈবিক শাসিকা হিসাবে ধরা হতো, যিনি তার স্বামী শিবের সহিত পান্ড্য সাম্রাজ্যের মতো তামিলনাড়ুর দক্ষিণা সাম্রাজ্যগুলিতে সম্মানের সহিত পূজিতা হতেন৷[3] পুরানো লিখিত প্রমাণ অনুসারে খ্রিস্টীয় ষষ্ট শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময় থেকে শহরটিতে মীনাক্ষী মন্দিরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়৷[23] মধ্যযুগীয় সাহিত্যে এবং শিলালিপি থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জায়গাটিকে 'কদম্ববনম' (কদম গাছের বনাঞ্চল) বা 'বেল্লিয়ম্বলম' (রজত মঞ্চ, যেখানে ভগবান শিব তার আনন্দ তাণ্ডব প্রদর্শন করেছিলেন) বলেও উল্লেখ করা হয়েছে৷ সঙ্গমযুগের বিদ্বজ্জনদের লেখনীতে স্থানটি ছিলো বহুগুণীজনদের মিলনস্থল৷ এই ঘটনার কথা তামিল পুঁথি "তিরুবিলয়াড়লপুরাণম" এবং সংস্কৃৃত পুঁথি "হলস্য মাহাত্ম্য"-তে রয়েছে৷[35] এটি ২৭৫ টি পাড়ল পেত্র স্থলমের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য দেবস্থান ও দিব্যমূর্ত্তি৷
তামিল ভাষায় রচিত পুরাতন পুঁথি গুলিতে এই মন্দির এবং এর দেবমূর্ত্তি একাধিক নামে একাধিক বর্ণনায় বর্ণিত হয়েছে৷ উদাহরণ স্বরূপ খ্যাতনামা শৈবধর্মের হিন্দু পণ্ডিত শ্রী জ্ঞানসম্বন্ধ খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে তার লেখায় মন্দিরটির উল্লেখ করে দৈবমূর্ত্তিকে "আলাবৈ ইরৈবন" নামে অভিহিত করেন৷[36] মন্দির প্রতিষ্ঠার ইতিহাস এইসময়কার পুরানো তামিল পুস্তক এবং কিছু আঞ্চলিক পৌরাণিক ও সাহিত্যের বইতে পাওয়া যায়৷ এই সমস্ত জায়গার উল্লেখ অনুসারে মন্দিরকে জড়িয়ে দেবীমূর্ত্তির যুদ্ধের বিবরণ পাওয়া গেলেও আলাদা আলাদা রচয়িতার কারণে ঘটনাবলীর সূক্ষতা একে অপরের থেকে গুরুত্বপূর্ণভাবে সম্বন্ধহীন৷ কিছু সুত্র অনুসারে স্থানীয়রা দৈবমূর্ত্তিদুটিকে "আলাবৈ ইরৈবন" এবং "আলাবৈ অন্নল" বলে পূজতো আবার কোনোস্থানে এর নাম পাওয়া যায় "অঙ্গয়র কন্নি আম্মৈ" নামে৷ কেউ কেউ মন্দিরটির জনশ্রুতি হিসাবে ইন্দ্রের গল্প বলেন, যেখানে তিনি ছিলের মূখ্য আরাধ্য দেবতা, আবার এক্ষেত্রে বাকীরা বিবরণ দেন হিন্দু দেবতারা বিভিন্ন সাধু-সন্ত এবং রাজাদের কাছে এক দেবীর উদ্দেশ্যে মন্দির নির্মানের আদেশ দিলে তখনকার বিত্তশালী বণিককুল এই মন্দির নির্মানে তৎপর হন৷ অপর একটি জনশ্রুতি অনুসারে সন্তানহীন এক রাজদম্পতি শিবের উদ্দেশ্যে পুত্রলাভের জন্য যজ্ঞ করেন৷ পরবর্তীতে তাদের একটি কন্যাসন্তান জন্ম নেয় যিনি সমস্ত রাজত্বের দায়িত্ব নেন এবং বিশ্বজয় করেন৷ পরে তার সাথে ভগবান শিবের সাক্ষাতে তিনি নিজরূপ বুঝতে পেরে তাকে বিবাহ করলে প্রজাগণ তার পরাক্রমশীলতাকে স্মরণ করে মাদুরাইতে পার্ব্বতীদেবী রূপে তার পূজা করেন ও মন্দিরটি নির্মান করেন৷ এরকম অপ্রামাণ্য ইতিহাসগুলিকে বাদ দিয়েও পণ্ডিতগণ মাদুরাই শহর থেকে সামান্য দূরে সমকালীন বিভিন্ন নথিপত্র ও শিলালেখ থেকে মন্দির ও মন্দির নির্মানের সম্ভাব্য ইতিহাস খুঁজে পান৷ দ্রাবিড় সভ্যতার রাজবংশ ও তাদের রাজত্বের মধ্যে তুলনামূলক তথ্যালোচনার মাধ্যমে তারা খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর শেষদিকের কিছু তথ্য পান৷[13][37]
ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরাংশে তখন দিল্লির সুলতানদের আধিপত্য কায়েম হয়েছে৷ খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষদিকে মুসলীম শাসকরা তাদের সৈন্য নিয়ে মধ্য ভারতের দিকে অগ্রসর হওয়া শুরু করে৷ ১৩১০ থেকে ১১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে আলাউদ্দিন খিলজির মুসলীম সনাধ্যক্ষ মালিক কাফুর এবং তার শাহী দিল্লির সৈন্যদল আরো দক্ষিণে ভারতীয় উপদ্বীপের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং লুঠতরাজ শুরু করে ও ধীরে ধীরে রাজ্যগুলিকে মুসলীম প্রভুর বার্ষিক করদ রাজ্যে পরিণত করা শুরু করে৷[38][39][40] শাহী সুলতানী দিল্লির ঐতিহাসিক রাজসভাসদ্বর্গ দাবী করেন যে, মালিক কাফুর এই সময়ে মাদুরাই, চিদম্বরম, শ্রীরঙ্গম প্রভৃৃতি তামিল শহরে আক্রমণ করেন এবং মন্দির ধ্বংসর সাথে সাথে সোনা-গয়না লুঠ করে দিল্লিতে নিয়ে আসেন৷[41][42][43]
অধ্যাপক ও ভারতীয় স্থাপত্যশৈলীর ঐতিহাসিক ভাস্কর্য চর্চাকারী স্যার জর্জ মিশেলের মতে খ্রিস্টীয় চতুর্দ্দশ শতকের মুসলিম আক্রমণ ছিলো তামিল হান্দু মন্দির নগরীগুলির ঐতিহ্য সংরক্ষণের অযাচিত বিপত্তি৷[44] তামিল হিন্দু সম্প্রদায় একাধিক শহর রক্ষা করতে সক্ষম হলেও মাদুরাই এর মতো বেশকিছু স্থানে তা ছিলো বেশ সময়সাপেক্ষ৷[39] লুণ্ঠন ও ধ্বংসসাধনের পর দিল্লির সুলতানীর শাসন মাদুরাইতে একজন মুসলিম শাসককে নিয়োগ করে, যিনি কিছু বছরের মধ্যেই দিল্লি সালতানাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাদুরাই সালতানাত প্রতিষ্ঠা করে৷ এই সুলতানি শাসন মন্দিরগুলিকে সমর্থন করা তো দূরস্ত বরং সেগুলি থেকে রাজস্ব আদায় শুরু করে৷ মাদুরাইতে মুসলিম সুলতানি শাসন বেশিদিন টেকেনি৷ খ্রিস্টীয় চতুর্দ্দশ শতাব্দীর শেষদিকে হিন্দু বিজয়নগর সাম্রাজ্যের উত্থানের সাথে সাথে এই শাসনতন্ত্রের পতন ঘটে৷[44] কুমার কম্পনের স্ত্রী গঙ্গাদেবীকে বিশেষিত করে রচিত "মধুর বিজয়ম" নামক একটি কাব্যিক শ্রুতি অনুসারে, তিনি(স্ত্রী) তার স্বামীকে একটি অসি দিয়ে মাদুরাই শহরকে নিকৃৃষ্ট শক্তির হাত থেকে উজ্জীবিত করে মীনাক্ষী মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে পুণরায় মন্দিরোদ্ধার ও তা পুণরায় ভক্তদের জন্য খোলার আর্জি জানান৷ বিজয়নগরের শাসকগণ সাফল্য পান, তারা মন্দিরের ভগ্নাবস্থা কাটিয়ে ভক্তদের প্রার্থনার জন্য মন্দিরটি পুণর্নির্মান করে সংস্কার করান৷[45] তারা খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বর মন্দিরসহ আশেপাশে একাধিক মন্দির পুণর্নির্মান, সংস্কার ও বিবর্ধিত করতে সক্ষম হন৷[46]
খ্রিস্টীয় ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যে মন্দিরটির পুনঃসংস্কার করেন মাদুরাইয়ের হিন্দু নায়ক রাজবংশের শাসক বিশ্বনাথ নায়ক৷ সুসান লেওয়ান্ডৌস্কির মতে, নায়ক রাজবংশের শাসকরা "শিল্প শাস্ত্র" নামক হিন্দুদের স্থাপত্য কৌশল অনুসরণ করে মীনাক্ষী মন্দির এবং মন্দিরনগরী মাদুরাইয়ের নকশা পরিকল্পনামাফিক প্রস্তুত করেছিলেন৷ লেওয়ান্ডৌস্কির মতে, শহরটিতে একাধিক সমকেন্দ্রিক বর্গাকার ও বলয়াকার সড়ক নির্মাণ করার পরিকল্পনা করা হয়েছিলো৷ আবার এই সমকেন্দ্রিক রাস্তাগুলির যোজক রাস্তাগুলি মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বর মন্দিরের বহির্চত্বর থেকে বাইরে পরিধির দিকে বিস্তৃত ছিলো৷[47] এই অপসারী রাস্তাগুলির নাম রাখা হতো পরম্পরাগত তামিল হিন্দু মাস তথা "অধি", "চিত্রৈ", "অবনীমূল", "মাসি" ইত্যাদি নামে৷ প্রতি মাসে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ঐ মাসের নামাঙ্কিত রাস্তা দিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সময় পূজার একাধিক তামার সামগ্রী নিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করতেন৷[47] উদীয়মান সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে প্রথমার্ঘ দানের হেতু মন্দির তথা মন্দির নগরীটি ছিলো সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী পূর্বমুখী৷[47][note 1] মন্দিরকে কেন্দ্র করে ধ্বংসপ্রাপ্ত পুরাতন সমৃদ্ধশালী মন্দির নগরটি আবার গড়ে ওঠে ও মন্দিরের চারিদিকে বর্ণভিত্তিক মানববসতি শুরু হয়৷ লেওয়ান্ডৌস্কির মতে, রাজকীয়তার সহিত ক্ষত্রিয়বর্ণ এবং বৈশ্যবর্ণের ব্যবসায়ীরা মন্দিরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বসতি গড়ে তুলতে থাকে৷ ব্রাহ্মণরা বিশেষ সুবিধাসহ মন্দিরের সবচেয়ে নিকটবর্তী বৃত্তে এক চতুর্থাংশ স্থান নিয়ে বসতি গড়ে৷ অন্য বর্ণ ও মিশ্র বর্ণের লোকজন মন্দিরের পার্শ্ববর্তী বাকী অঞ্চলগুলিতে এবং শহরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করা শুরু করে৷[48] মন্দিরের সাথে সামাজিক জীবনের সূত্র ঘটাতে এবং নিজের উদ্যোগের মন্দিরের দিব্যত্ব বজায় রাখার জন্য রাজা মন্দির থেকে একটি পদযাত্রার আয়োজন করেন৷[48] বেইলির মতে, রাজার আয়োজিত পদযাত্রাটি বিপরীত ক্রমের মাতৃকুলভিত্তিক বংশ পরম্পরার সামাজিক গুরুত্বকে প্রতিফলিত করে এবং ভাই-বোন ও জ্ঞাতির মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের গুরুত্ব বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে৷ তামিলনাড়ু অঞ্চলে যোদ্ধা নারী মাতৃৃমূর্ত্তির পূজার প্রচলন বহুপ্রাচীন এবং এই প্রথা নাটকীয়ভাবে খ্রিস্টীয় চতুর্দ্দশ শতাব্দীর পুণরুদ্ধারের যুদ্ধে জয়লাভের পর আরো বৃৃদ্ধি পায় বলে বেইলি মনে করেন৷[33]
রাজা বিশ্বনাথ নায়কের তৎপরতায় মন্দির ও সংলগ্ন অঞ্চল নির্মানের কাজ ১৫৬০ খ্রিষ্টাব্দে শেষ হয় এবং মন্দিরের বর্তমান বিস্তৃৃত অংশের নির্মান ১৬২৩ থেকে ১৬৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তিরুমালা নায়কের শাসনকালে পুরোপুরি সম্পন্ন হয়৷ তিরুমালা নায়ক ছিলেন একজন জাতিগত তেলুগু হিন্দু রাজা৷ তিনি মন্দিরচত্বরের একটি বিশাল সংখ্যক স্থাপত্য খাঁড়া করতে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন৷ তার সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য অবদানটি হলো বসন্তোৎসব পালনের জন্য তৈরী করা "বসন্ত মণ্ডপম" এবং পাখির খাঁচার আকারের "কিলিক্কূণ্ডু মণ্ডপম"৷ মন্দিরের জলাধারের দর-দালান এবং "মীনাক্ষী নায়কর মণ্ডপম"টি রাণী মঙ্গম্মাল তৈরী করান৷ মন্দিরের ভেতরের প্রাথমিক ছোটোখাটো কিছু পরিবর্তন করার দায়িত্ব ছিলো নায়ক রাজবংশের মূখ্যসচিব আর্যনাথ মুদলিয়ারের তত্বাবধানে৷[49]
ঔপনিবেশিক যুগে মীনাক্ষী মন্দিরের চারপাশে ক্রম বর্ধমান জনসংখ্যা কারণে তা পর্তুগাল সহ ইউরোপের অন্যান্য একাধিক মিশনারী সংগঠনগুলির প্রতিযোগিতা ও কার্যকলাপের মূলকেন্দ্র হয়ে উঠতে থাকে৷[50] ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী প্রথমদিকে মন্দিরগুলিকে বৃৃৃত্তিদান করা শুরু করে, ফলস্বরূপ ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একটা বড় অংশ মন্দিরের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের অনুমতি পেলে তারা সাধারণের সাথে মিশতে শুরু করে ও সামাজিক রাজনৈতিক মান্যতা পায়৷ উদাহরণস্বরূপ বলা যায় লর্ড ক্লাইভ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বারা শ্রীরঙ্গপত্তনম থেকে লুঠ করে আনা সোনা ও গয়না এই মন্দিরে দান করেন৷ কিন্তু ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে তারা মন্দিরের সমর্থক বা রক্ষাকর্তা হিসাবে কার্যনির্বাহের ভূমিকা এবং মন্দিরের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা থেকে অব্যহতি দেয়৷[48][51] মিশনারীর কর্মকর্তারা মন্দিরের শিল্পকলার বিষয়ে ব্যাঙ্গ বিদ্রূপ করা শুরু করে তারা নিজেদের "রোমান ব্রাহ্মণ" ও "উত্তরা সন্যাসী" বলে উল্লেখ করে মন্দিরের অনুষ্ঠানের সমালোচনা করা শুরু করে৷ মিশনারীর এই পরিকল্পনা সম্পূর্ণ বিফলে যায় এবং খ্রীস্ট ধর্মে দীক্ষিত হওয়া সম্প্রদায়ও মন্দিরের মাহাত্যকে রক্ষা করা শুরু করে৷ মিশনারীরা বুঝতে পারে তামিলরা খ্রীস্টধর্মের অনুসারী হয়ে থাকলেও পুরোপুরিভাবে ধর্ম পরিবর্তন তারা করছেন না৷ তারা বোঝে যে তারা খ্রিস্টান নারীদের বিবাহ করছেন শুধুমাত্র রোগের চিকিৎসায় সাহায্য পেতে ও নিজেদের দারিদ্র দূর করতে৷[52][53]
দক্ষিণে নায়ক সাম্রাজ্যের পতনের পরে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি শুরু হয়৷ এই সময়ে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশরা মন্দিরের ওপর তাদের বৃৃত্তিদান সরিয়ে নিলে মন্দিরের দুর্দশা নেমে আসে৷ ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তামিল হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা দানছত্র খুলে অর্থসাহায্য একত্রিত করে৷ তারা হিন্দু ধর্মপ্রচারক, ঐতিহাসিক ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের একত্রিত করে ও প্রযুক্তিবিদদের সহায়তায় মন্দিরের পুনঃসংস্কার শুরু করেন৷ ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে সংস্কারকার্য সম্পূর্ণ হলে এ বছরই "কুম্ভাভিষেকম" নামে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়৷[54] এসময়ে মন্দিরটিকে মীনাক্ষী এবং শহরটি মদুরা নামে পরিচিতি পায় এবং তার প্রমাণ খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের বিভিন্ন তথ্যে পাওয়া যায়৷[35]
মন্দিরটির পরম্পরাগত ইতিহাস রয়েছে যেখানে এটিকে ৬৪টি শিবলীলাক্ষেত্র বলে উল্লেখ করা রয়েছে৷ ৬৪ টির প্রতিটিই মন্দিরগাত্রে চারিদিকে দেওয়াল চিত্র হিসাবে অক্ষুণ্ণ রয়েছে৷ এটি মাদুরাই শহর ও মন্দিরের একাধিকবার ধ্বংসকরণের ইতিহাস বর্ণনা করে এবং প্রতিবারই ধ্বংসাবশেষ থেকে আবার নতুনভাবে সৃৃষ্টি হয়েছে এই মন্দির৷[55]
মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বর মন্দির হিন্দুদের ধর্মতাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মন্দির৷ অধ্যাপক খ্রীস্টোফার ফুলার তার মত প্রকাশ করেন যে, মন্দিরটির মুনাক্ষী দেবী ও সুন্দরেশ্বর শিবের বিবাহের সূক্ষ্ম ঘটনাবলীর বিবরণ, দেশান্তরণের অধিকারের দিব্য গুরুত্ব এবং "সুমঙ্গলী" তথা বিবাহিত নারীর স্বামীর সাথে বাস করেও তার প্রাপ্য স্বাধীনতা ও মঙ্গলময়তা প্রভৃৃতি আচার আচরণগুলি দৈবতার সাথে কেন্দ্রীয় সাধারণ তামিল জীবনযাপনের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে৷ দেব ও দেবীর বিবাহ প্রতীকীভাবে মানব বিবাহকেই তুলে ধরে৷[56] এই বিবাহের অনুষ্ঠানটি স্মরণ করতে এপ্রিল মাসের আশেপাশে একটি বার্ষিক পদযাত্রার অনুষ্ঠান করা হয়৷ মন্দিরটির পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মীনাক্ষী দেবীর স্বামী শিব এবং শ্রীবিষ্ণুকে তার ভ্রাতারূপে চিহ্নিত, যা হিন্দু ধর্মের শৈব ধারা ও বৈষ্ণব ধারার মধ্যে একটি ধনাত্মক সম্পর্ক স্থাপন করেছে৷ এটি দ্রাবিড়ীয় জ্ঞাতিমধ্যস্থ বিবাহ পদ্ধতির প্রতিফলন৷[56][57] মীনাক্ষী দেবী স্বয়ং হিন্দুধর্মের শাক্ত ধারার রূপ এবং এই মন্দিরের মূখ্য এবং কেন্দ্রীয় দৈবমূর্ত্তি৷ এভাবেই মীনাক্ষী মন্দিরটি হিন্দুধর্মের অন্যতম তিনটি মূল ধারাকে একত্রিত করেছে৷[58][59]
"তিরুবিলৈয়াড়ল পুরাণম" অনুসারে শৈব ধারার ৬৮ টি শিব তীর্থস্থানের মধ্যে যে চারটি মহাশৈবস্থল সেগুলি হলো যথাক্রমে, কাশী বিশ্বনাথ মন্দির, চিদম্বরম নটরাজ মন্দির, কালহস্তীশ্বর মন্দির এবং মাদুরাই মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বর মন্দির৷ মাদুরাই শহরের পরিচিতিই এই মন্দিরটি৷[60]
এই মন্দিরটি হিন্দু বিবাহের জন্য একটি উত্তম মন্দির, যদিও খুব বেশি বিবাহকার্য এই মন্দিরে সম্পন্ন হয় না৷ শুধুমাত্র কম সময়সাপেক্ষ বিবাহের মূল কাজটি এখানে সম্পন্ন করা হলেও অন্যান্য রীতিনীতি অন্যত্রই করা হয়৷[61]
মীনাক্ষী মন্দিরটি শুধু একটি ধর্মীয় স্থল নয় এটি ঐ অঞ্চলের অর্থনৈতিক কেন্দ্র ও বটে৷ মন্দিরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পূজার সামগ্রী এবং অন্যান্য একাধিক সামগ্রী মাদুরাই শহরের অর্থনীতিতে বিরাট বড় ভূমিকা রেখেছে৷[62]
মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বর মন্দিরটি শিব পঞ্চসভার একটি৷ বিশ্বাস করা হয় এই বিশেষ মন্দিরগুলিতে ভগবান শিব নটরাজরূপে আনন্দ তাণ্ডবরত৷ একটি বৃহৎ নটরাজ মূর্তি একটি বিস্তৃত রূপার বেদীতে প্রতিষ্ঠিত, এটিকে "বেল্লি অম্বলম" বা রজত মঞ্চ বলা হয়৷[63]
সভার প্রকার | মন্দির | অবস্থান | উপাদান |
রত্নসভা | বড়ারণ্যেশ্বর মন্দির | তিরুবলঙ্গাড়ু | রত্ন |
কনকসভা | চিদম্বরম নটরাজ মন্দির | চিদম্বরম | স্বর্ণ |
বেল্লিসভা | মাদুরাই মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বর মন্দির | মাদুরাই | রজত |
তাম্রসভা | তিরুনেলভেলি নেল্লাইয়াপ্পা মন্দির | তিরুনেলভেলি | তাম্র |
চিত্রসভা | কুট্রালনাথ মন্দির | কুট্রালম | চিত্রাবলী |
মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বর মন্দির হলো হিন্দুদের একটি সক্রিয় উপাসনালয়৷ মন্দিরের পুজারীগণ দেবালয়ের নিত্যপূজা সহ বিশেষ দিনগুলিতে সমস্ত নিয়ম মেনে পূজা করে থাকেন৷[64] মন্দিরের স্বেচ্ছাসেবক ও কর্মচারীরাও নিত্যপূজায় অন্যান্য কাজে নিযুক্ত থাকেন৷ প্রতীকীভাবে সুন্দরেশ্বর শিবের মূর্ত্তিটিকে প্রতি রাতে তুলে দেবী মীনাক্ষীর ঘরে পালকি করে নিয়ে যাওয়া যেন তারা একসঙ্গে থাকতে পারেন আবার সকালে উভয়কে প্রথামত জাগ্রত করার ইত্যাদি দায়িত্ব তারা পালন করে থাকেন৷[13] মন্দিরে একটি মাসিক রথযাত্রার আয়োজন করা হয়ে থাকে যেখানে ধাতুর তৈরী দেবী মূর্ত্তিরই ধাতব কোনো অবয়বকে রথে তোলা হয় এবং মন্দিরের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়৷ বাইরে রথটি রঙিন কাপড় এবং বিভিন্ন ধরনের ফুল দিয়ে সজ্জিত থাকে এবং মন্দিরের স্বেচ্ছাসেবকরা মাদুরাই শহরের রাস্তা ধরে শহরের পুরানো সমকেন্দ্রীয় বৃত্তগুলির পথে মূর্ত্তি ও রথ নিয়ে সাড়ম্বরে যাত্রা করে থাকে৷ এই প্রথা ধর্ম-বর্ণ ভেদে বছরের সবসময়ে প্রতিটি ভক্তের নিরপেক্ষ ভক্তিকে তুলে ধরে৷[13]
মন্দিরটির নিয়ম অনুসারে দিনে ছয়টি সময়ে পূজার নিয়ম রয়েছে এবংপ্রতি ক্ষেত্রেই চারটি পূজার ধাপ রয়েছে যথা, অভিষেক (দিব্যস্নান), অলঙ্কারম (সাজ-সজ্জা), নৈবেদ্য (ভোগ নিবেদন) এবং দীপ আরাধনা (প্রদীপ দেখানো)৷[note 2]) মীনাক্ষী ও সুন্দরেশ্বর উভয় দেবদেবীকেই একই পদ্ধতিতে পূজা করা হয়ে থাকে৷[66] নাদস্বরম, তবিল প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র ও বৈদিক স্তুতি উচ্চারণের দ্বারা সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে মন্দিরর নিত্যরীতি ও অনুষ্ঠানগুলি পালন করা হয়৷[64]
হিন্দুধর্মাবলম্বীরা মন্দিরের মূর্ত্তি দর্শনের পূর্বে মূর্তি ও গর্ভগৃৃহ বাম দিক থেকে ডান দিকে ঘড়ির কাঁটার দিকে প্রদক্ষিণ করেন৷ যেহেতু মন্দিরটিতে দেবী মীনাক্ষীকেই মূল দেবতা রূপে গন্য করা হয় তাই স্বভাবতই তীর্থযাত্রীরা সুন্দরেশ্বরের পূর্বে তার মূর্তিই দর্শন করে থাকেন৷ তামিলনাড়ুর অন্যান্য সকল শক্তিপীঠের মতোই তামিল "আদি" মাস (বাংলায় শ্রাবণ মাস) এবং "তৈ" মাসে (বাংলার পৌষ মাস) প্রতি শুক্রবার প্রচুর ভক্তসমাগমের সাথে অনুষ্ঠান হয়ে থাকে৷ সুন্দরেশ্বর শিবের বিবরণ এবং তার মাহাত্যর কথা ১০ দিন যাবৎ চলাকালীন "অবনী মূল উৎসবম" অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে ভক্তদের সামনে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে৷
তামিল বর্ষপঞ্জীর প্রতি মাসের নিয়মানুসারে মীনাক্ষী মন্দিরে নির্ধারিত অনুষ্ঠান করা হয়ে থাকে৷ কিছু কিছু অনুষ্ঠানে প্রচুর দর্শনার্থীর ভীড় হয়, সেগুলির মধ্যে বারোদিন যাবৎ চলাকালীন সুন্দরেশ্বর মীনাক্ষী বার্ষিক বিবাহ অনুষ্ঠানের দিন গড়ে প্রায় দশলক্ষ ভক্ত সমাগম ঘটে৷ অনুষ্ঠানটিকে স্থানীয় ভাষায় "চৈত্রী মীনাক্ষী তিরুকল্যাণম" বলা হয়ে থাকে৷ অনুষ্ঠানটি চৈত্রমাসে অনুষ্ঠিত হয় যা ইংরাজীর এপ্রিল মাসে সম্পন্ন হয়৷ এটি মীনাক্ষী দেবীর বিবাহ সম্পর্কিত হওয়াতে অন্যান্য যেকোনো অনুষ্ঠান থেকে এই সময়ে সর্বাধিক বেশি পূণ্যার্থীরা আসেন৷[67] স্থানীয় নিয়মে দেব ও দেবীর দিব্যবিবাহটি তামিল নাড়ুর মাতৃৃকুলভিত্তিক প্রথাগুলিকে প্রতিফলিত করে যা "মাদুরাই বিবাহ" নামেও পরিচিত৷ এটি পিতৃকুলভিত্তিক "চিদম্বরম বিবাহ পদ্ধতি" থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও বিপরীতধর্মী৷ শিবকে প্রাধান্য দেওয়া এই চিদম্বরম বিবাহ মূলত চিদম্বরম নটরাজ মন্দির ও চিদম্বরম ও তৎসংলগ্ন সমস্ত শিব মন্দিরগুলিতে হয়ে থাকে৷[68] এই অনুষ্ঠানে মীনাক্ষী এবং সুন্দরেশ্বরকে একটি রথে তোলা হয় ও যাত্রার আয়োজন করা হয় যেখানে ভক্তরাই রথের অসিচালনা করেন৷ এই অনুষ্ঠানে বিষ্ণু তার ভগিনী মীনাক্ষীকে শিবের কাছে বিবাহর জন্য পৌঁছে দেন৷ এই সময়ে দেবী মীনাক্ষী রাজকীয় বেশে অবস্থান করেন৷[69] দুই পক্ষ কাল ধরে তাদের বিবাহ সম্পর্কিত "থের তিরুবিলাঃ" এবং "তেপ্পা তিরুবিলাঃ" অনুষ্ঠান দুটিসহ অন্যান্য একাধিক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়৷
অন্যান্য অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে তামিল বৈকাসি মাসে (বাংলায় বৈশাখ মাস) হওয়া বসন্তম উৎসবটি উল্লেখযোগ্য৷ এছাড়া রয়েছে আনি মাসে "উঞ্জল" উৎসব, আডি মাসে "মূলৈ কোট্টু" উৎসব, আবণি মাসে "আবণি মূলম" উৎসব, ঐপ্পসি এবং কার্ত্তিক মাসে "কোলাট্টম" উৎসব, মার্কলি মাসে "অরুদ্র দর্শন" উৎসব, তামিল তৈ মাসে মাদুরাই মারিয়ম্মান মন্দিরের সহিত একত্রে মাসিক কিছু অনুষ্ঠান এবং পাঙ্গুনি মাসে মাসি উৎসব ও বসন্তোৎসব৷[70][64]
তামিল পুরট্টাসি মাসে মীনাক্ষী মন্দিরে নবরাত্রি উৎসব পালিত হয়, উত্তর ভারতে এই সময়ে দসেরা রা দশহরা উৎসবটির সাথে এটি তুলনাযোগ্য৷ এই শারদোৎসবের সময়ে মন্দিরটি রাত্রে বেলা আলোর মালা দিয়ে এবং দিনের বেলা রঙিন কারুকার্য দিনে সজ্জিত করা হয়৷ কর্ণিক পুতুল দিয়ে প্রতিটি মন্ডপে বিভিন্ন পৌরাণিক ঘটনা উপস্থাপন করা হয়৷ এই পুতুলের মাধ্যমে ঘটনার বিবরণ বাচ্চাদের মধ্যে খুব আনন্দ দেয় এবং প্রচুর পরিবার এটি দেখতে উৎসাহিত থাকেন৷[71][72][73]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.