Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
স্টেগোসরাস (রোমান হরফ - Stegosaurus) হল এক গোষ্ঠীর বর্মধারী ডাইনোসর। উত্তর আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমভাগ ও ইউরোপের পর্তুগাল থেকে এদের অস্থির যে জীবাশ্ম আবিস্কৃত হয়েছে সেগুলি আজ থেকে মোটামুটি ১৫ কোটি ৫০ লক্ষ থেকে ১৫ কোটি বছর পুরনো। অর্থাৎ জুরাসিক যুগের শেষের দিকে এদের অস্তিত্ব ছিল। এরা অর্নিথিস্কিয়া বর্গের এক অত্যন্ত সুপরিচিত ডাইনোসর গোষ্ঠী।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত মরিসন ফর্মেশনের নিচের দিকের স্তর থেকে এই গণের বেশ কয়েকটি প্রজাতির প্রাণীর জীবাশ্ম মিললেও, এখনও পর্যন্ত এই গণের তিনটি প্রজাতিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত দেওয়া হয়েছে - স্টেগোসরাস স্টেনপ্স্, স্টেগোসরাস আনগুলেটাস ও স্টেগোসরাস সালকেটাস। এখনও পর্যন্ত এইধরনের ৮০টি প্রাণীর জীবাশ্ম বিভিন্ন জায়গায় খুঁজে পাওয়া গেছে।[1] ২০০৬ সালে পর্তুগালে এই গণের একটি প্রাণীর জীবাশ্ম আবিস্কৃত হওয়ায়[2] এখন বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত যে ইউরোপ ভূখণ্ডেও এই গণের ডাইনোসরদের অস্তিত্ব ছিল।
স্টেগোসরাস সময়গত পরিসীমা: জুরাসিক যুগের শেষভাগ, ১৫.৫–১৫.০কোটি | |
---|---|
স্টেগোসরাস স্টেনপ্স্ - যেমন দেখতে ছিল | |
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস | |
জগৎ: | প্রাণী জগৎ |
পর্ব: | কর্ডাটা |
উপপর্ব: | ভার্টিব্রাটা |
শ্রেণী: | সরীসৃপ |
মহাবর্গ: | ডাইনোসরিয়া |
বর্গ: | †অর্নিথিস্কিয়া |
উপবর্গ: | স্টেগোসরিয়া |
আদর্শ প্রজাতি | |
†স্টেগোসরাস স্টেনপ্স্ মার্শ, ১৮৭৭ | |
অন্যান্য প্রজাতি | |
| |
প্রতিশব্দ | |
|
এরা আকৃতিতে ছিল বেশ বড়; দৈর্ঘ্যে এরা হত প্রায় ৯ মিটার; স্টেগোসরিয়া অধোবর্গের এখনও পর্যন্ত যেসব প্রাণীর পরিচয় বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, তাদের মধ্যে এরাই ছিল বৃহত্তম। চতুষ্পদ তৃণভোজী এই প্রাণীর গড়নও ছিল বেশ ভারী; পিঠের দিক ছিল খুবই শক্তিশালী। সামনের পা দু'টি হত অপেক্ষাকৃত ছোট, পিছনের পাদু'টি বড় ও বেশি শক্তিশালী। এর ফলে এদের শ্রোণীচক্রের দিকটা একটু বেশি উপরের দিকে থাকত, সামনের দিকটা হত অপেক্ষাকৃত নিচু। ফলে এদের পক্ষে মাথা নিচু করে মাটির কাছে নামিয়ে এনে খাওয়া সম্ভব হত। এর থেকে ধারণা করা হয়ে থাকে, ছোট ছোট ঝোপঝাড়, লতাগুল্ম, প্রভৃতি ছিল এদের মূল খাদ্য। এদের মাথা ছিল দেহের তুলনায় অস্বাভাবিকরকম ছোট, ঘাড়ের দৈর্ঘ্যও ছিল বেশ কম। এদের পিঠের উপর ১৭টি চতুষ্কোণ প্লেট ও লেজের দিকে বড় বড় কয়েকটি কাঁটা থাকত। এগুলির কাজ কী ছিল, সে নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে নানাধরনের জল্পনা চালু আছে। তবে এগুলির উপস্থিতি এদের চেহারাকে এমন একটা বিশিষ্টতা দান করেছিল যে এদের বর্তমানে টিরানোসরাস, ট্রাইসেরাটপস, আপাটোসরাস, ভেলোসির্যাপটর, প্রভৃতির সঙ্গেই অন্যতম জনপ্রিয় ডাইনোসর হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।
১৮৭৭ সালে ওথনিয়েল চার্লস মার্শ যখন প্রথম এদের জীবাশ্ম সনাক্তকরণ করেন[3], তখন এদের যে অস্থি পাওয়া গিয়েছিল, তা ছিল এতটাই ভাঙাচোরা ও অপূর্ণ, তার থেকে এদের দৈহিক গঠন সম্পর্কে বৈজ্ঞানিকরা খুব সঠিক ধারণা গড়ে তুলতে পারেননি। সেই কারণে নানা বইপত্র, সিনেমায় এরা এদের অদ্ভুত চেহারার জন্য যতই জনপ্রিয়তা অর্জন করুক, প্রথমদিকে বিভিন্ন মিউজিয়ামে এদের পূর্ণাবয়ব চেহারা বা কঙ্কাল খুবএকটা স্থান অর্জন করেনি। তবে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ধীরে ধীরে নতুন নতুন জীবাশ্ম আবিষ্কারের ফলে এদের চেহারা অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে ওঠে। ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে শেষপর্যন্ত এদের পূর্ণাবয়ব কঙ্কাল পুনর্গঠন করা সম্ভব হয়েছে।[4]
গ্রিক ভাষায় স্তেগোস (στέγος) শব্দের অর্থ "ছাদ" ও সাউরোস (σαῦρος) মানে "টিকটিকি"। এই দু'টি শব্দকে একসাথে এনে স্টেগোসরাস শব্দটি গঠিত হয়েছে।[5] এইরকম অদ্ভুত নামকরণের সম্ভাব্য কারণ হল এদের পিঠের উপর থাকা চতুষ্কোণ বা এলোমেলো ত্রিকোণাকার প্লেটগুলির আকৃতি কিছুটা ছাত তৈরিতে ব্যবহৃত টালির মতো।[6] ১৮৭৭ সালে যখন প্রথম এদের আংশিক দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হয়, তখন তা দেখে মার্শ প্রথমে ধারণা করেন, জন্তুটি সম্ভবত একটি বিশালাকার জলজ কচ্ছপ জাতীয় প্রাণী এবং প্লেটগুলি এই জন্তুটির পিঠে কচ্ছপের খোলসের মতোই একটার পরে একটা করে খানিকটা ছাদে বিছানো টালির মতো শোয়ানো থাকে। তার থেকেই এদের এই নামকরণ হয়। এরপর কলোরাডোর গার্ডেন পার্ক থেকে একই গোষ্ঠীর আরেকটি প্রাণীর আংশিক দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হলে এডওয়ার্ড ড্রিঙ্কার কোপ ১৮৭৮ সালে তার নামকরণ করেন হাইপসিরোপাস ডিসকারাস।[7][8] সেই থেকে বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞই হাইপসিরোপাস ও স্টেগোসরাস শব্দদু'টিকে সাধারণভাবে সমার্থক বলে মনে করলেও[9] পিটার গালটন (২০১০) প্রমুখ বিশেষজ্ঞ মনে করেন এ' দু'টি বাস্তবে দু'টি আলাদা গণের প্রাণী এবং এদের মেরুদণ্ডের গঠনের মধ্যে বেশ কিছুটা পার্থক্য আছে।[10]
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে দুই মার্কিন পুরাজীববিজ্ঞানী ওথনিয়েল চার্লস মার্শ ও এডওয়ার্ড ড্রিঙ্কার কোপের মধ্যে যে তথাকথিত অস্থিযুদ্ধ সংঘটিত হয়, তাতে প্রথমদিকে যে প্রাণীগুলিকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়, স্টেগোসরাস তারই মধ্যে অন্যতম। ১৮৭৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোর মরিসন ফর্মেশনের উত্তর দিকে আবিষ্কৃত কিছু দেহাবশেষের জীবাশ্মকে মার্শ একটি আগে পাওয়া যায়নি এমন একধরনের প্রাণীর দেহাবশেষ বলে চিহ্নিত করেন ও টালি আকৃতির প্লেটগুলির কারণে তার নাম দেন স্টেগোসরাস।[3] প্রথম উদ্ধার হওয়া এই দেহাবশেষগুলি ছিল স্টেগোসরাস আর্মাটাস প্রজাতির। এর থেকেই দীর্ঘদিন পর্যন্ত এই স্টেগোসরাস আর্মাটাস প্রজাতিটিকেই এই গণের আদর্শ প্রজাতি বলে মনে করা হত। কিন্তু প্রথম উদ্ধার হওয়া এই দেহাবশেষগুলি ছিল খুবই ভাঙা ও অপূর্ণ অবস্থায়। ফলে এর উপর নির্ভর করে প্রাণীটির গঠন ঠিকমতো বর্ণনা করা সম্ভব হচ্ছিল না। কিন্তু পরবর্তী কয়েক বছরে এই গণের আরও অনেকগুলি প্রাণীর দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে প্রাণীটির দৈহিক গড়ন সম্বন্ধে একটা মোটামুটি ধারণা করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে।
প্রথমদিকে উদ্ধার হওয়া বিভিন্ন দেহাবশেষ পরীক্ষা করে এই গণের অন্তর্ভুক্ত অনেকগুলি প্রজাতিকে আলাদা আলাদা ভাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে গবেষণায় দেখা গেছে এদের মধ্যে অনেকগুলি বাস্তবে একই প্রজাতির অথবা আলাদা প্রজাতি বলে চিহ্নিত করার মতো উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ হাতে পাওয়া যাচ্ছে না।[11] ফলে এখন এইসব পৃথক প্রজাতিগুলির অনেকগুলিকেই আর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। যে তিনটি প্রজাতিকে এখন স্বীকৃতি দেওয়া হয়, সেগুলি হল - স্টেগোসরাস স্টেনপ্স্, স্টেগোসরাস আনগুলেটাস ও স্টেগোসরাস সালকেটাস। এদের মধ্যে স্টেগোসরাস স্টেনপ্স্কে বর্তমানে এই গণের আদর্শ প্রজাতি বলে গণ্য করা হয়ে থাকে।
১৮৭৮ সালেই কলোরাডোর গার্ডেন পার্কের যে খননস্থলটি বর্তমানে 'কোপ'স নিপল' বা কোপের সূঁচ নামে পরিচিত, সেখানকার কোয়ারি ৩ থেকে স্টেগোসরাইডি গোত্রেরই আরেকটি প্রাণীর অসম্পূর্ণ দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হলে এডওয়ার্ড ড্রিঙ্কার কোপ তার নাম দেন হাইপসিরোপাস ডিসকারাস। নামটি, আগেই বলা হয়েছে, সাধারণভাবে স্টেগোসরাসেরই একটি সমার্থক শব্দ হিসেবে গৃহীত, যদিও কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ এ' ক্ষেত্রে তাদের মতানৈক্য ব্যক্ত করেছেন। পরের বছর, অর্থাৎ ১৮৭৯ সালে মার্শ এই গোত্রের আরও একটি প্রজাতির প্রাণীকে সনাক্ত করতে সক্ষম হন। এই প্রজাতিটির তিনি নাম দেন স্টেগোসরাস আনগুলেটাস। এই প্রথম তিনি তখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত জীবাশ্মগুলির উপর ভিত্তি করে স্টেগোসরাস গণের প্রাণীদের একটি বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করেন।[10] ১৮৮১ সালে আরও একটি তৃতীয় প্রজাতির তিনি নামকরণ করেন স্টেগোসরাস আফিনিস। কিন্তু এ'ক্ষেত্রে শুধুমাত্র শ্রোণীর একটি অস্থির জীবাশ্ম উদ্ধার হয়েছিল; অপর্যাপ্ত নমুনার কারণে পরবর্তীকালে এই প্রজাতিটিকে তাই আর আলাদা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। নামটি বর্তমানে একটি নোমেন নুডাম বা শুধুমাত্র নাম হিসেবে বিবেচিত হয়, যার বিবরণ অপর্যাপ্ত। এই প্রজাতির সংগৃহীত সেই একমাত্র নমুনাটিও পরবর্তীকালে হারিয়ে যায়।[10] যাইহোক, এরপরেও মার্শ এই গণের আরও নানা প্রাণীর দেহাবশেষ সংগ্রহ ও পরীক্ষা করে চলেন ও ১৮৮৭ সালের মধ্যে আরও তিনটি নতুন প্রজাতিকে সনাক্ত করেন - স্টেগোসরাস স্টেনপ্স্, স্টেগোসরাস ডুপ্লেক্স ও স্টেগোসরাস সালকেটাস।[9] এগুলির মধ্যে স্টেগোসরাস স্টেনপ্স্এর উদ্ধার হওয়া অপেক্ষাকৃত পূর্ণ দেহাবশেষের উপর ভিত্তি করে মার্শ শেষপর্যন্ত ১৮৯১ সালে স্টেগোসরাস আনগুলেটাসের অসম্পূর্ণ কঙ্কালটির একটি আনুমানিক সম্পূর্ণ স্কেচ প্রকাশ করতে সক্ষম হন। এই স্কেচটিই হাইপসিরোপাস নামে রিচার্ড লাইডেকার ১৮৯৩ সালে পুনরায় প্রকাশ করেন, ফলে দু'টি নামের সমার্থকতা বৃদ্ধি পায়।[9]
১৯০১ সালে পুরাজীববিদ ফ্রেডেরিক লুকাস একটি নতুন প্রজাতির সনাক্তকরণ করে প্রথম আবিষ্কারক মার্শের নামে তার নাম দেন স্টেগোসরাস মার্শি। কিন্তু সেই বছরেরই শেষের দিকে তিনি নব আবিষ্কৃত প্রজাতিটিকে একটি নতুন গণের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে আবার শ্রেণিবিভাগ ঘটান ও তার নাম দেন হপলিটোসরাস। তিনি এছাড়াও স্টেগোসরাসের পিঠের প্লেটগুলির সজ্জাকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করেন ও বলেন যে এই প্লেটগুলি পিঠের উপর দু'টি সারিতে খাড়াভাবে সজ্জিত থাকত। মেরুদণ্ড ও পাঁজরের হাড়ের সংযোগস্থলের উল্টোদিকে হত তাদের সংস্থান। তার মতামতের উপর ভিত্তি করে চার্লস আর নাইট স্টেগোসরাস আনগুলেটাসের চেহারাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেন। কিন্তু পরের বছর লুকাস প্লেটগুলির সজ্জা সম্পর্কে তার মত আরও কিছুটা সংশোধন করে সেগুলি পিঠের উপর কিছুটা এলোমেলো সারিতে সজ্জিত থাকত বলে মতপ্রকাশ করেন।[9] ১৯১০ সালে রিচার্ড স্বোয়ান লাল মতপ্রকাশ করেন, প্লেটগুলোর এই এলোমেলো অবস্থানের সম্ভাব্য কারণ মৃত্যুর পর দেহাবশেষগুলির দীর্ঘদিনের চাপে ও তাপে ঘটে যাওয়া বিকৃতি। স্টেগোসরাস স্টেনপ্স্এর একটি প্রায় পূর্ণাঙ্গ কঙ্কাল প্রথম তার নেতৃত্বেই পুনর্গঠিত হয়। এটি পিবডি মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে সংরক্ষিত হয়। এই ক্ষেত্রে প্লেটগুলি পিঠের উপর জোড়ায় জোড়ায় সজ্জিত ছিল।[9] কিন্তু ১৯১৪ সালে চার্লস গিলমোর ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত স্টেগোসরাসের একাধিক জীবাশ্ম পরীক্ষা করে মতপ্রকাশ করেন, প্লেটগুলি একটা বাদে একটা করে দুটি পৃথক ও কিছুটা এলোমেলো সারিতেই পিঠের একেবারে উপরের দুই পাশে একটু ধার দিয়ে সজ্জিত ছিল।[9] বর্তমানে লুকাস ও গিলমোরের মতকেই মোটের উপর মান্য মত হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। পিবডি মিউজিয়ামে রক্ষিত লালের মডেলটিকেও তার ভিত্তিতে ১৯২৪ সালে সংশোধন করা হয়। [12]
এখনও পর্যন্ত স্টেগোসরাসের যত দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে তার সবই পূর্ণবয়স্ক প্রাণীর। কিন্তু ১৯৯৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইয়োমিং'এ একটি অপরিণত বয়স্ক স্টেগোসরাস স্টেনপ্সের দেহাবশেষ পাওয়া যায়; জীবিতকালে এটি দৈর্ঘ্যে ছিল ৪.৬ মিটার (১৫ ফিট) ও উচ্চতায় ২ মিটার (৬.৬ ফিট)। এর আনুমানিক ওজন ছিল ২.৪ মেট্রিক টন (২.৬ টন)। বর্তমানে এটি উইয়োমিং বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওলজিকাল মিউজ্যামে সংরক্ষিত আছে।[13] ২০০৬ সালে পর্তুগালে স্টেগোসরাস আনগুলেটাস প্রজাতির একটি প্রাণীর আংশিক জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়। এর থেকে প্রমাণিত হয়, উত্তর আমেরিকা মহাদেশের বাইরেও স্টেগোসরাসের অস্তিত্ব ছিল।[2]
স্টেগোসরাস আর্মাটাস এখনও পর্যন্ত এই গণের আবিষ্কৃত সর্ববৃহৎ প্রজাতি। এদের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৯ মিটার ও উচ্চতা ৪ মিটার। এদের ঘাড় ও পিঠের উপর দিয়ে প্রায় লেজ পর্যন্ত দু'টি সারিতে বড় বড় কিন্তু বিভিন্ন আকৃতির চ্যাপ্টা চতুষ্কোণ প্লেট ও লেজের দিকে ক' জোড়া বড় বড় কাঁটা থাকত। স্টেগোসরাস স্টেনপ্স্এর ক্ষেত্রে এই প্লেটের সংখ্যা ছিল ১৭।[14][15] প্লেটগুলি এদের গোল পিঠের উপরে খাড়াভাবে সজ্জিত থাকলেও লেজের একেবারে আগার দিকের কাঁটাগুলি কিছুটা আনুভূমিকভাবে অবস্থান করত। তবে বর্তমানে এই গণের আদর্শ প্রজাতি হিসেবে স্বীকৃত স্টেগোসরাস স্টেনপ্স্ আকারে ছিল তুলনায় বেশ কিছুটা ছোট। জীবিত অবস্থায় এদের আনুমানিক ওজন ৪.৫ মেট্রিক টন (৫ টন) পর্যন্ত হতে পারত। এদের যে বিভিন্ন দেহাংশ আমাদের হাতে এসেছে তা থেকে অনুমান করা যায়, এদের মাথার অবস্থান ছিল দেহের উচ্চতার তুলনায় যথেষ্ট নিচে, মাটি থেকে বড়জোর ১ মিটার বা ৩.৩ ফিট উচ্চতায়।[16] স্টেগোসরাস আনগুলেটাস তুলনায় ছিল কিছুটা বড়। তবে সমসাময়িক দৈত্যাকার সরোপডদের তুলনায় এদের সবার চেহারাই ছিল বেশ ছোটখাটো। এদের সারা দেহ ছিল বর্মাবৃত, হয়তো সমসাময়িক দৈত্যাকার থেরোপড ডাইনোসর - আলোসরাস বা সেরাটোসরাসদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্যই তা ছিল তাদের প্রয়োজন।
স্টেগোসরাসের পিছনের পা দু'টি ছিল সামনের পা দু'টির চেয়ে বড় ও বেশি শক্তিশালী। পিছনের পা দু'টি বড় হওয়ার কারণে এদের পিঠের দিকটা হত অনেকটা উঁচু। এদের পিছনের পায়ে তিনটি ছোট ও সামনের পায়ে পাঁচটি করে আঙুল থাকত। এদের মধ্যে কেবলমাত্র প্রতি পায়ের ভিতরের দিকের আঙুলক'টিতেই ছোট খুরের মতো একটা অংশ দেখা যেত। আঙুলগুলি পায়ের তলার দিকে প্যাডের মতো একটি অংশ দ্বারা ছিল সুরক্ষিত।[17]
এদের মাথার খুলিটি ছিল লম্বাটে গড়নের ও দেহের বাকি অংশের তুলনায় লক্ষণীয়রকম ছোট। মাথার নিচু অবস্থান থেকে আন্দাজ করা যায়, এরা মাটির কাছাকাছি থাকা তৃণগুল্ম ভোজন করত। মুখগহ্বরের সামনের দিকের দাঁতের অনুপস্থিতি ও তার বদলে একধরনের ছুঁচালো চঞ্চুর (রামফোথেকা) উপস্থিতিও এই ধারণাকেই সমর্থন করে। এদের নিচের দিকের চোয়ালটি দুই পাশে এমনভাবে একটু উঁচু হয়ে বিন্যস্ত যে পাশ থেকে দেখলে ভিতরের ছোট ছোট দাঁতগুলি তার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়। এর থেকে অনেকে ধারণা করেছেন যে এদের মুখের গড়নের সাথে কচ্ছপের মুখের গড়নের খানিকটা মিল ছিল।[18] আবার অন্য গবেষকদের মতে স্টেগোসরাসের নিচের চোয়ালের এই উঁচু দুই পাশ অর্নিথিস্কিয়া বর্গের অন্য প্রাণীদেরও চোয়ালের গড়নেরই একটু অন্যরকম রূপমাত্র। এর থেকে বরং মুখের মাংসল গড়নেরই বেশি ইঙ্গিত মেলে।[19] এদের দাঁতগুলো ছিল ছোট ছোট, তিনকোণা ও চ্যাপ্টা। এর থেকে বোঝা যায় তারা খাদ্য চিবিয়ে খেত। কিন্তু উঁচু নিচের চোয়ালের কারণে এরা খাদ্যকে চিবানোর সময় দীর্ঘক্ষণ মুখের মধ্যে ধরে রাখতে পারত।[18][20]
বিপুলাকার দেহ সত্ত্বেও স্টেগোসরাসের মাথায় মস্তিষ্কের পরিমাণ ছিল খুবই কম - বড়জোর একটি কুকুরের মতো। প্রায় অটুট একটি স্টেগোসরাসের মাথার খুলির এন্ডোকাস্ট (মস্তিষ্কগহ্বর) পরীক্ষা করে ১৮৮০ সালে মার্শ জানান, এদের মস্তিষ্কের পরিমাণ ছিল বড়জোর ৮০ গ্রামের মতো। প্রায় ৪.৫ থেকে ৫ টন ওজনের বিশালদেহী একটি জানোয়ারের পক্ষে মস্তিষ্কের এই সামান্য ওজন সাধারণভাবে তাদের আপাত বুদ্ধিহীনতার প্রতিই ইঙ্গিত করে। তখনও পর্যন্ত পাওয়া অন্যান্য ডাইনোসরদের মধ্যেও দেহ ও মস্তিষ্কের ওজনের এতটা বিপুল ফারাক ছিল বিরলতম। তাদের মস্তিষ্কের এই স্বল্পতা স্বাভাবিকভাবেই সেইসময় বিশেষজ্ঞমহলে চালু ধারণা - ডাইনোসররা ছিল একেবারেই বুদ্ধিহীন - তাকেই আরও মদত জোগায়।[21] অবশ্য বর্তমানে এই ধারণা ভুল হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। তবে স্টেগোসরাসের মস্তিষ্কের সঠিক অ্যানাটমি এখনও পর্যন্ত আমাদের অজানা। আর এটুকু বলা যেতে পারে, যত ছোটই হোক, তাদের মস্তিষ্ক তাদের ধীরগতির তৃণভোজী জীবনশৈলী ও সীমাবদ্ধ ব্যবহারিক জটিলতার পক্ষে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না।[22]
এছাড়া এদের খুলির এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল চোখ ও নাকের ফুটোর মধ্যে আরেকটি ছোট ছিদ্রর অস্তিত্ব, যার নাম অ্যান্ট-অরবিটাল ফেনেস্ত্রা।[18] এই অ্যান্ট-অরবিটাল ফেনেস্ত্রা ছিল সমস্ত আরকোসরাসের (আজকের পাখি ও কুমীরের সাধারণ পূর্বপুরুষ) সাধারণ বৈশিষ্ট্য। আজকের পাখিদের ক্ষেত্রে এই অ্যান্ট-অরবিটাল ফেনেস্ত্রা এখনও চোখে পড়ে, যদিও কূমীরের ক্ষেত্রে এটি বর্তমানে একটি হারিয়ে যাওয়া বৈশিষ্ট্য।
স্টেগোসরাস গণের আদর্শ প্রজাতি স্টেগোসরাস স্টেনোপ্সের অনেকগুলি নিদর্শন বর্তমানে উদ্ধার হয়েছে, যার থেকে বর্তমানে তাদের অস্থি সংস্থান সম্পর্কিত বিস্তারিত জ্ঞান অনেকখানিই অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। নিচে তা সংক্ষেপে বর্ণনা করা হল।
স্টেগোসরাস স্টেনোপসের মেরুদণ্ডে শ্রোণীদেশের সামনের দিক থেকে শুরু করে ঘাড় পর্যন্ত বিস্তৃত অংশে মোট ২৭টি কশেরুকা বা মেরুখণ্ড থাকত; এদের মধ্যে প্রথম ১০টি ছিল গ্রীবাদেশীয় (cervical vertebrae) ও পরের ১৭টি ছিল বক্ষীয় বা পৃষ্ঠদেশীয় কশেরুকা (dorsal vertebrae)। অবশ্য কিছু কিছু বিশেষজ্ঞের মতে এদের মধ্যে প্রথম ১৩টি ছিল গ্রীবাদেশীয় ও পরের ১৪টি ছিল পৃষ্ঠদেশীয়। পৃষ্ঠদেশীয় শেষ কশেরুকাটি যেহেতু মেরুদণ্ডের শ্রোণী অংশের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত থাকত, কারু কারুর মতে এটিকে পৃষ্ঠ-শ্রোণীদেশীয় কশেরুকা (dorsosacral vertebra) বলে অভিহিত করা বেশি যুক্তিযুক্ত। শ্রোণীদেশীয় কশেরুকা্র সংখ্যা সাধারণভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ৪টি, তবে খুঁজে পাওয়া কিছু কিছু দেহাবশেষে এই সংখ্যা আলাদা। শ্রোণীর পিছনদিকে লেজের দিকেও মেরুদণ্ডটি বিস্তৃত ছিল, এক্ষেত্রে পুচ্ছদেশীয় কশেরুকার সংখ্যা ছিল ৪৬।[23]
গ্রীবাদেশীয় কশেরুকার একেবারে প্রথমটি ছিল অ্যাটলাস। এটি ছিল খানিকটা U আকৃতির। দ্বিতীয়টি ছিল অ্যাক্সিস বা অক্ষীয় অস্থি। এটি অ্যাটলাস অস্থির (যার উপরে ভিত্তি করে মাথা ঘোরানো সম্ভব হয়) সাথে সরাসরি যুক্ত থাকত। তবে খুঁজে পাওয়া বেশিরভাগ দেহাবশেষ পরীক্ষা করে দেখা গেছে এই দুটি অস্থি পুরোপুরি মিশে যায়নি। এর পিছনের ৩ - ১০ নম্বর গ্রীবাদেশীয় কশেরুকাগুলি ছিল একইরকম গঠনের, শুধু আকারে কিছুটা বড়। ১১ - ১৩ নম্বর কশেরুকাকে বলা যেতে পারে মধ্যবর্তী কশেরুকা, যেখানে গ্রীবাদেশীয় কশেরুকাগুলি পরিবর্তিত হয়ে পৃষ্ঠদেশীয় কশেরুলায় পরিণত হয়। এরপর ১৪ - ২০ নম্বর কশেরুকা, অর্থাৎ ১ - ৭ নম্বর পৃষ্ঠদেশীয় কশেরুকা্র সামনের দিকের অংশ সেন্ট্রামের আকার ছিল সামনে পিছনে কিছুটা লম্বাটে ও বড়। এক্ষেত্রে সুষুম্নীয় গহ্বরের আকারও ছিল উপরে নিচে কিছুটা লম্বাটে। কিন্তু ৮ - ১৩ নম্বর পৃষ্ঠদেশীয় কশেরুকার ক্ষেত্রে এই কশেরুকীয় ছিদ্র-গুলির প্রস্থ বৃদ্ধি পেয়ে এই লম্বাটে ভাবটা কমে আসত। ১ - ৮ নম্বর পৃষ্ঠদেশীয় কশেরুকার ক্ষেত্রে দু'টি কশেরুকার মধ্যে সংযোগস্থলে অস্থিগুলোর আকার হত এমন, যারফলে পেটের কাছটায় পিঠের দিকটা কিছূটা উঁচু হয়ে উঠত। ১০ নম্বর পৃষ্ঠদেশীয় কশেরুকা পর্যন্ত পিঠের উচ্চতা এই একই থাকত। কিন্তু তারপর ১১ - ১৩'র মধ্যে এই উচ্চতা হ্রাস পেত। শ্রোণী অংশে কশেরুকার সংখ্যা ছিল সাধারণভাবে ৪টি; এরা পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে একটিমাত্র যুক্তঅস্থি গঠন করত। কিন্তু পৃষ্ঠদেশীয় কশেরুকার শেষেরটিও এই অংশে ঢুকে থাকত। খুঁজে পাওয়া কিছু কিছু স্টেগোসরাস স্টেনপ্সের দেহাবশেষে দেখা গেছে, পুচ্ছদেশীয় কশেরুকার একদম উপরের দিকের কশেরুকাটিও এই অংশের মধ্যেই অবস্থান করছে। স্টেগোসরাস স্টেনপ্সের ৪৬টি পুচ্ছদেশীয় কশেরুকা খুঁজে পাওয়া গেছে। এগুলি যত পিছনের দিকে এগোত, এদের সেন্ট্রাম ও সুষুম্নীয় গহ্বরের পরিমাণ ততই হ্রাস পেত। ৩৫ নম্বর পুচ্ছদেশীয় কশেরুকায় এসে সুষুম্না কাণ্ড একেবারেই অদৃশ্য হয়ে যেত।[23]
স্টেগোসরাস স্টেনপ্সের কাঁধের অস্থি (scapula) ছিল কিছুটা আয়তাকার। কাঁধের কাছটায় এটা ছিল দু' দিকেই একটু উঁচু। ট্রাইশেপ পেশির ভিত্তি হিসেবে তা কাজ করত। গ্রীবাদেশীয় কশেরুকাগুলি থেকে শুরু করে পৃষ্ঠদেশীয় কশেরুকাগুলির প্রায় প্রত্যেকটির সাথেই পিঞ্জরাস্থি (ribs) যুক্ত থাকত। গ্রীবাদেশীয় পিঞ্জরাস্থিগুলি যত পিছনের দিকে যেত আকারে তত বৃদ্ধি পেত; তাদের আকারের এই ক্রমবৃদ্ধি ১ম থেকে ৩য় পৃষ্ঠদেশীয় কশেরুকার সাথে যুক্ত পিঞ্জরাস্থিগুলির ক্ষেত্রেও বজায় থাকত। এরপর ১২শ পৃষ্ঠদেশীয় কশেরুকার সাথে যুক্ত পিঞ্জরাস্থি পর্যন্ত এদের আকার থাকত একইরকম, কিন্তু ১৩শ পৃষ্ঠদেশীয় কশেরুকার সাথে যুক্ত পিঞ্জরাস্থির দৈর্ঘ্য ছিল উল্লেখযোগ্য রকমের কম।[23]
এদের সামনের পায়ের কাঁধ থেকে কনুই পর্যন্ত বিস্তৃত প্রগণ্ডাস্থি বা হিউমারাস (humerus) ছিল কিছুটা ডাম্বেলাকৃতির। এগুলির মধ্যে ডানদিকের অস্থিটি প্রায় সম্পূর্ণ অবস্থায় উদ্ধার হয়েছে, কিন্তু বাঁ দিকেরটি এখনও পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। কনুই থেকে নিচের দিকে বিস্তৃত আলনা অস্থি ছিল কিছুটা উলটানো ত্রিভূজাকৃতি। এক্ষেত্রেও ডান দিকের আলনাটি প্রায় অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার হয়েছে, কিন্তু বাঁদিকেরটি পাওয়া যায়নি। একইভাবে ডানদিকের রেডিয়াসটিও প্রায় অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার হয়েছে। এটি কিছুটা ডাম্বেলাকৃতির, মাঝখানটা কিছুটা সরু, উপরে নিচে কিছুটা ছড়ানো। নিচের দিকের প্রান্তটি কিছুটা এবড়োখেবড়ো উপবৃত্তাকার। এদের শ্রোণিচক্রের ইলিয়াম অস্থিটি ছিল খানিকটা উলটানো 'C' আকৃতির ও স্যাক্রাম অস্থির সাথে যুক্ত। স্টেগোসরাস স্টেনপ্সের দু'টি ঊর্বস্থি বা ফিমারই উদ্ধার হয়েছে। নিতম্ব সন্ধি থেকে এগুলি হাঁটু পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এগুলি ছিল সামনে থেকে দেখতে খানিকটা স্তম্ভাকৃতি ও সোজা। হাঁটুর কাছে এসে এগুলি জঙ্ঘাস্থি বা টিবিয়া ও ফিবিউলার সাথে মিলিত হত। জঙ্ঘাস্থি ও ফিবিউলার দু'টি নমুনাই উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।[23]
স্টেগোসরাস স্টেনপ্সের লেজের দিকের শেভ্রন অস্থিগুলি ছিল কিছুটা ইংরেজি 'Y' আকৃতির। তবে এক্ষেত্রে Y-এর উপরের দিকের খোলা বাহুদু'টিও সেতুর মতো একটি অস্থি দ্বারা যুক্ত থাকত। এ'রকম দু'টি শেভ্রন অস্থি উদ্ধার হয়েছে। এদের একটি ছিল ২৭তম পুচ্ছদেশীয় কশেরুকার সাথে যুক্ত, অন্যটি ২৯তমের সাথে যুক্ত।[23]
স্টেগসরাসের' সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় দৈহিক বৈশিষ্ট্য ছিল তাদের পিঠের উপর সজ্জিত পাতের সারি। সংখ্যায় এগুলি ছিল প্রজাতিভেদে ১৭ - ২২ টি।[12] প্রকৃতিতে এগুলি ছিল ওস্টেওডার্ম বা ত্বকের একেবারে বাইরের স্তরের ঠিক নিচে তৈরি হাড়ের মতো শক্ত একধরনের প্লেট। আজকের দিনে কুমীরের ত্বকে যে ধরনের শক্ত আঁশ (Scale) দেখা যায়, এগুলি ছিল তারই পরিবর্তিত রূপ। এগুলি কঙ্কালের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিল না, বরং ত্বক থেকেই এগুলি উৎপন্ন হত। সবচেয়ে বড় পাতগুলির অবস্থান ছিল পিঠের একেবারে উপরের দিকে; সবচেয়ে বড় পাতগুলি দৈর্ঘ্যে ছিল প্রায় ৬০ সেন্টিমিটার ও প্রস্থেও ছিল প্রায় একইরকম। তবে পিঠের উপর এদের সজ্জা ঠিক কীরকম ছিল, তা নিয়ে প্রথম থেকেই বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নানারকম বিতর্ক আছে।[24] নিচে এ' নিয়ে বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন মতামতগুলি সংক্ষেপে বর্ণনা করা হল -
স্টেগোসরাইডি গোত্রের অন্তর্ভুক্ত প্রথম যে গণের নামকরণ করা হয়, তা স্টেগোসরাস। সেই হিসেবে এই গণকে স্টেগোসরাইডি গোত্রের প্রামান্য গণ হিসেবে ধরা যেতেই পারে। স্টেগোসরিয়া অধোবর্গের অন্তর্ভুক্ত দু'টি গোত্রের অন্যতম হল স্টেগোসরাইডি; অন্যটি হল হুয়ায়ানগোসরাইডি। এই স্টেগোসরিয়া অধোবর্গটি আবার অর্নিথিস্কিয়া বর্গের অন্তর্ভুক্ত থাইরিওফোরা বা বর্মাবৃত ডাইনোসরদের অন্যতম। এই থাইরিওফোরা উপবর্গের অন্তর্ভুক্ত আরেকটি অধোবর্গ হল অ্যাঙ্কিলোসরিয়া। এরা স্টেগোসরিয়া অধোবর্গের তুলনায় অনেক বেশি বৈচিত্রের অধিকারী। অন্যদিকে স্টেগোসরিয়া অধোবর্গের সবক'টি প্রজাতিই আকার-আয়তন, হাবভাব, স্বভাবে মোটামুটি একইরকম, প্রজাতিতে প্রজাতিতে তাদের মূল পার্থক্য প্লেট ও লেজের দিকে কাঁটাগুলির সজ্জা ও সংখ্যায়। পূর্ব-আফ্রিকায় পাওয়া কেন্ট্রোসরাস ও চীনে খুঁজে পাওয়া উয়ের্হোসরাসরা হল তাদের নিকটতম আত্মীয়।
নিচের ক্ল্যাডোগ্রামটি বাট্লার ও অন্যান্যদের দ্বারা ২০১১ খ্রিঃ প্রস্তুত। এখানে অর্নিথিস্কিয়া বর্গের মধ্যে স্টেগোসরিয়া উপ-উপবর্গটির অবস্থান বর্ণিত হয়েছে।[27]
অর্নিথিস্কিয়া |
| |||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
উপযুক্ত জীবাশ্ম বা দেহাবশেষ সেভাবে আবিষ্কৃত না হওয়ায়, স্টেগোসরাসের পূর্বপুরুষদের সম্বন্ধে এখনও পর্যন্ত বিশেষ কিছু জানা যায়নি। তবে সাম্প্রতিককালে মরিশন ফর্মেশনের নিচের দিকের স্তরেও এমন কিছু সমগোত্রের প্রাণীর অবশেষ খুঁজে পাওয়া গেছে, যারা স্টেগোসরাসের চেয়েও কয়েক লক্ষ বছরের পুরনো। অন্ত্য জুরাসিক উপযুগের মধ্যভাগে কিমেরিজিয়ান অধোযুগের (১৫ কোটি ৭৩ লক্ষ - ১৫ কোটি ২১ লক্ষ বছর পূর্বে) এই প্রাণীগুলির সাথে হেসপেরোসরাসদের কিছুটা সাদৃশ্য রয়েছে।[28] এখনও পর্যন্ত স্টেগোসরাসের যে সবচেয়ে পুরনো পূর্বপুরুষ গণকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে, তা হল লেক্সোভিসরাস। আধুনিক ইংলন্ড ও ফ্রান্সের অক্সফোর্ড ক্লে ফর্মেশনের মধ্যে এদের জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছে। মধ্য জুরাসিক উপযুগের শেষদিকে ক্যালোভিয়ান আধোযুগে (১৬ কোটি ৩৫ লক্ষ - ১৬ কোটি ১০ লক্ষ বছর পূর্বে) এদের অস্তিত্ব ছিল।
মধ্য জুরাসিক উপযুগে বসবাসকারী হুয়ায়ানগোসরাসরা হল স্টেগোসরাসের আরও পূর্ববর্তী পূর্বপুরুষ। বর্তমান চীনে এদের যে দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে, তা প্রায় ১৬ কোটি ৫০ লক্ষ বছর, অর্থাৎ স্টেগোসরাসের সময়কাল অপেক্ষা অন্তত ২০ লক্ষ বছর পুরনো। এই হুয়ায়ানগোসরাসরা হল হুয়ায়ানগোসরাইডি গোত্রের এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত একমাত্র গণ। এই হুয়ায়ানগোসরাইডি গোত্রও স্টেগোসরিয়া অধোবর্গেরই একটি গোত্র।[29] আদিম জুরাসিক ইংলন্ডে বসবাসকারী সেলিডোসরাসরা হল এদের আরও পূর্বের পূর্বপুরুষ।[30] আজ থেকে প্রায় ১৯ কোটি বছর আগে এদের অস্তিত্ব ছিল। লক্ষণীয় বিষয় হল এই যে, এদের মধ্যে স্টেগোসরাস ও অ্যাঙ্কিলোসরাস উভয়েরই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল। এদের আরও পূর্ববর্তী দুই পূর্বপুরুষ হল এমাউসরাস ও স্কুটেলোসরাস। প্রথমটির অস্তিত্বের সন্ধান মিলেছে বর্তমান জার্মানিতে ও পরেরটির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনায়। অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির, হালকা বর্মাবৃত এই দুই গণের প্রাণীরাই ছিল স্টেগোসরাস ও অ্যাঙ্কিলোসরাস - উভয়েরই নিকটাত্মীয়। এছাড়াও বর্তমান ফ্রান্সে এই ধরনের বর্মাবৃত ডাইনোসরদের বসবাস ও চলাচলের একটি সম্ভাব্য অঞ্চল আবিষ্কৃত হয়েছে, যার থেকে প্রায় ১৯ কোটি ৫০ লক্ষ বছর আগে থেকেই এদের অস্তিত্ব ছিল বলে বর্তমানে মনে করা হচ্ছে।
বিভিন্ন সময়ে স্টেগোসরাস গণের নানা প্রজাতির শণাক্তকরণের কথা উঠলেও পরবর্তীকালে দেখা গেছে, তাদের অনেকগুলিরই বিবরণ হয় এতটাই অসম্পূর্ণ যে তার উপর ভিত্তি করে তাদের আলাদা প্রজাতি হিসেবে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, অথবা তারা ইতিমধ্যেই শণাক্ত হওয়া কোনও প্রজাতিরই সমার্থক।[11] ফলে বর্তমানে সাধারণভাবে তাদের তিনটি প্রজাতিকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়ে থাকে; এদের মধ্যে দু'টি সম্পর্কে বর্তমানে আমাদের জ্ঞান যথেষ্ট সমৃদ্ধ, অন্যটি সম্পর্কে এখনও আমাদের জানা বেশ সীমিত। নিচে এদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হল -
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.