শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সংঘটিত হত্যাকাণ্ড উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সংঘটিত হত্যাকাণ্ড উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড ছিল বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একদল সদস্য সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত করে এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডি ৩২-এর বাসভবনে সপরিবারে হত্যা করে। পরে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ পর্যন্ত খন্দকার মোশতাক আহমেদ অঘোষিতভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হন।[3] শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের বেসামরিক প্রশাসনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে প্রথমবারের মতো সামরিক ক্ষমতার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ঘটে।[4] হত্যাকাণ্ডটি বাংলাদেশের আদর্শিক পটপরিবর্তন বলে বিবেচিত। লরেন্স লিফশুলৎজ এই হত্যাকাণ্ডের সামগ্রিক ঘটনাবলিকে মার্কিন-পাকিস্তানপন্থী ও ভারত-সোভিয়েতপন্থী দুই অক্ষশক্তির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার স্নায়ুযুদ্ধের সহিংস বহিঃপ্রকাশ বলে আখ্যায়িত করেন।[5] ১৫ই আগস্টকে বাংলাদেশের ‘জাতীয় শোক দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। আওয়ামী লীগের সরকার দিবসটিকে জাতীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করে থাকে।[6]
শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড | |
---|---|
স্থান | ঢাকা, বাংলাদেশ |
তারিখ | ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ ভোর ৫:৩০–৭:০০ (ইউটিসি +৬) |
লক্ষ্য | শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবার [টীকা 1] |
হামলার ধরন | সামরিক অভ্যূত্থান [টীকা 2] |
ব্যবহৃত অস্ত্র | ২৮ টি ‘গোলাবিহীন’ টি-৫৪ ট্যাঙ্ক, ১০৫ এমএম হাউইটজার কামান, মেশিনগান, রাইফেল এবং গ্রেনেড |
নিহত | ৪৭+ জন:
শেখ মুজিবের বাড়িতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত: শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ আবু নাসের, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ কামাল, সুলতানা কামাল খুকী, শেখ জামাল, পারভীন জামাল রোজী, শেখ রাসেল অন্যান্য: সিদ্দিকুর রহমান (পুলিশ কর্মকর্তা), সামছুল হক (পুলিশ কর্মকর্তা), কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ (নবনিযুক্ত ডিজিএফআই প্রধান।) শেখ মনির বাড়ি (গুলিতে গুরুতর আহত এবং হাসপাতালে মৃত ঘোষিত): শেখ ফজলুল হক মনি, বেগম আরজু মনি (বেগম সামসুন্নেসা) সেরনিয়াবাতের বাড়ি (গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত): আবদুর রব সেরনিয়াবাত, আরিফ সেরনিয়াবাত, বেবী সেরনিয়াবাত, শহীদ সেরনিয়াবাত, সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, নাঈম খান রিন্টু, পোটকা (গৃহভৃত্য), লক্ষীর মা (গৃহভৃত্য) শেরশাহ সুরী রোডের ৮ ও ৯ নং বাড়ি এবং শাহজাহান রোডের ১৯৬ ও ১৯৭ নম্বর বাড়ি (মর্টারের গোলার আঘাতে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হয়ে নিহত): রেজিয়া বেগম, নাসিমা, হাবিবুর রহমান, আনোয়ারা বেগম, আনোয়ারা বেগম (২), ময়ফুল বিবি, সাবেরা বেগম, আবদুল্লাহ, রফিকুল, সাফিয়া খাতুন, শাহাবুদ্দিন, কাশেদা, আমিনউদ্দিন, হনুফা বিবি[1][2] সাভারে সংস্থিত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য: ১১ জন |
আহত | ৪৮+ জন:
|
হামলাকারী দল | ডজনসংখ্যক সামরিক অফিসার ও ১৭০ থেকে ৭০০ জন সাধারণ সৈনিক [টীকা 3] |
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়ের পর শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়। পরে তিনি যুক্তরাজ্যের লন্ডন ও ভারত হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। দেশে ফেরার পর মুজিব ১৯৭২ সালের ১২ই জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন এবং পরবর্তী তিন বছর উক্ত পদে আসীন থাকেন। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে তিনি রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পরিচালিত নয় মাস ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের পর সমগ্র বাংলাদেশ বিধ্বস্ত অবস্থায় ছিল।[টীকা 4][7][8] প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব এই ধ্বংসযজ্ঞকে “মানব ইতিহাসের জঘন্যতম ধ্বংসযজ্ঞ” উল্লেখ করে ৩০ লাখ মানুষ নিহত ও ২ লাখ নারীর ধর্ষণ হওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের উচ্চ আশা-আকাঙ্ক্ষা মুজিব সরকারের জন্য পূরণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়তে থাকে।
জাতীয় রক্ষীবাহিনী একটি নিয়মিত আধা-সামরিক বাহিনী যা নবপ্রতিষ্ঠ বাংলাদেশে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে রক্ষীবাহিনী আইন ১৯৭২ দ্বারা গঠন করা হয়।[9] শুরুতে মুজিব বাহিনী ও কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে এই বাহিনীর পত্তন করা হয়। ঢাকার শেরেবাংলা নগরে এই বাহিনীর সদরদপ্তর স্থাপন করা হয়। ক্যাপ্টেন এ. এন. এম. নূরুজ্জামানকে রক্ষীবাহিনীর প্রধান করা হয়। বিদ্রোহ দমন এবং আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য গঠিত হয়। এটি ছিল একটি বিতর্কিত আধা সামরিক বাহিনী যা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অনুগত ছিল।[10] এটি বেসামরিক জনগণের কাছ থেকে অস্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য গঠিত হলেও অনেকের মতে এটি প্রকৃতপক্ষে মুজিবের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া থেকে রক্ষা করতে এবং আওয়ামী লীগের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে।[11] এর কর্মীদের বিরুদ্ধে জনসাধারণ ও আওয়ামী লীগ বিরোধীদেরকে বিভিন্নভাবে ভয় দেখানোর অভিযোগ পাওয়া যায়। সামরিক শক্তির প্রভাবের কারণে পাকিস্তান আমলে বাজেটের বেশিরভাগই সামরিক খাতে ব্যয় হত।[12] তবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সে বরাদ্দ কমতে থাকে এবং ১৯৭৫-৭৬ সালের বাজেটে মুজিব সরকার রক্ষীবাহিনী সৃষ্টির জন্য প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ করে সেনাবাহিনীর বরাদ্দ ১৩%-এ নামিয়ে আনে, যা পাকিস্তান আমলে ছিল ৫০-৬০ শতাংশ।[13][14] এ ঘটনায় সেনাবাহিনীর মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।[15] স্বাধীনতা-পরবর্তী সামরিক বাহিনীর বাজেট হ্রাস ও দুর্দশার জন্য রক্ষীবাহিনীকে দায়ী করা হলেও তা ছিল ভিত্তিহীন কেননা ১৯৭৩-'৭৪ অর্থবছরে রক্ষীবাহিনীর জন্য বাজেট ছিল মাত্র ৯ কোটি টাকা, যেখানে সেনাবাহিনীর জন্য তা ছিলো ৯২ কোটি টাকা এবং পরবর্তীতে ১২২ কোটিতে পৌঁছায়।[16] মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অনেক সেনা তাদের আশানুরূপ পদোন্নতি পাননি বলেও দাবি রয়েছে।[17] এ সকল কারণে সেনাবাহিনীর মধ্যে তৈরি হওয়া ঘনীভূত অসন্তোষ বিদ্যমান ছিল।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সশস্ত্র বাহিনীর জওয়ানদের সংখ্যা ছিল ৫৫ হাজার। তার মধ্যে পাকিস্তান প্রত্যাগত জওয়ানদের সংখ্যা ২৪ হাজার এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ান ও নতুন করে রিক্রুটদের মিলিয়ে মোট ছিল ২৭ হাজার। পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারদের সংখ্যা ছিল ১১ শত এবং রক্ষীবাহিনীর সদস্য ছিল ২০ হাজার।[18]
রক্ষীবাহিনী বিষয়ে কে এম শফিউল্লাহ বলেন,
স্বাধীনতার পর দেশের আইন শৃঙ্খলার কিছু অবনতি ঘটে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশে অস্ত্র উদ্ধার করতে পুলিশ ব্যর্থ হয়। কাজেই অস্ত্র উদ্ধারের দায়িত্ব আর্মিকে দেওয়া হতো। ওই সময় আমি এই দায়িত্ব অন্য কাউকে দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলাম। সেটাকে লক্ষ্য রেখে পুলিশকে শক্তিশালী করার জন্য রক্ষীবাহিনী গঠিত হয়।[টীকা 5] এই বাহিনী সম্বন্ধে কিছু মহল বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বলে যে, রক্ষীবাহিনী সেনাবাহিনীর বিকল্প হিসেবে গঠিত হয় এবং এ মর্মে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। রক্ষীবাহিনীকে কার্যকর করার জন্য পার্লামেন্টে আইন পাস হয়, যাতে রক্ষীবাহিনীকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে অপপ্রচার হয় এবং সামরিক বাহিনীতে অসন্তোষ দেখা দেয়।’[19]
ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড বইয়ের লেখক ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এবিষয়ে নিম্নলিখিত মতামত বিবৃত করেনঃ[20]
লে. কর্নেল. এম এ হামিদ শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাতে মুজিব বলেন,
… কর্নেল সাহেব কী বলব! আপনার আর্মির কথা। অফিসাররা আসে আর একে অন্যের বিরুদ্ধে complain করে। অমুক এই করেছে - সে এই করেছে। আমার পোস্টিং, আমার প্রোমোশন…। বলুন তো কী হবে এসব আর্মি দিয়ে? অফিসাররা এভাবে কামড়াকামড়ি করলে, ডিসিপ্লিন না রাখলে এই আর্মি দিয়ে আমি কী করবো? আমি এদের ঠেলাঠেলি সামলাবো, না দেশ চালাবো?… আজ দেশ স্বাধীন হয়েছে, সবাই খাই খাই শুরু করেছে। কোথা থেকে আমি দেব, (তা) কেউ ভাবতে চায় না
অফিসারদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা মুজিব সরকারের জন্য অসহনীয় পর্যায়ে পৌছায়।[22]
তোমরা না কও রক্ষীবাহিনীর সবাই ভারতীয়? আমি তো দ্যাখতাছি এরা আমাগো পোলা।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে নানা কারণে বিভেদ-বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়। মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তান প্রত্যাগত সামরিক আফিসারদের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে।
সেনাপ্রধান নিযুক্তকরণ নিয়েও সমস্যা দেখা দেয়। সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও মুজিব, জিয়ার পরিবর্তে শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন।[টীকা 6] কে এম শফিউল্লাহ আদালতের জবানবন্দিতে বলেন,
১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল আমাকে চিফ অব আর্মি স্টাফ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আমি এই নিয়োগের প্রতিবাদ করি। কারণ জিয়াউর রহমান ও আমার একই রকম যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তিনি ব্যাচ নম্বর-এ আমার আগে ছিলেন অর্থাৎ আমার ১ নম্বর সিনিয়র ছিলেন। আমি মেজর রবকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে এই প্রতিবাদ জানাই। প্রতিবাদ দেওয়ার ব্যাপারে প্রায় দুই ঘণ্টা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ হয়। তিনি আমার সব কথা শোনার পর বললেন, ‘তোমার সব কথা শুনেছি। দেয়ার ইজ সামথিং কলড পলিটিক্যাল ডিসিশন। [এখানে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলে কিছু আছে]’ উত্তরে আমি বলেছিলাম, ‘ফ্রম টুডে অ্যান্ড নাউ অনওয়ার্ডস; আই অ্যাম এ ভিকটিম অব সারকামাস্টেন্স [আজ থেকে এবং এখন থেকে; আমি পরিস্থিতির শিকার]।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তোমরা বড় বড় কথা বলো, যাও কাল থেকে তুমি জেনারেল ওসমানীর নিকট থেকে দায়িত্ব বুঝিয়ে নাও।’ জিয়াউর রহমানকে টেলিফোনে আমার দায়িত্ব পাওয়া ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপের বিস্তারিত জানাই। জিয়া তখন বলেন, ‘ওকে সফিউল্লাহ। গুড বাই।’[19]
এটি ছিল একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, যার ফলে জিয়া ব্যক্তিগতভাবে মুজিব-সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হন। এর ফলে জিয়াউর রহমান ও কে. এম. শফিউল্লাহর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
কর্নেল শাফায়েত জামিল বলেন,
মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ সতীর্থ ছিলেন। জিয়াউর রহমান সিনিয়র ছিলেন। কিন্তু তাঁকে চিফ অব স্টাফের পদ দেওয়া হয় নাই। এতে দুজনের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল না।’[19]
কে. এম. শফিউল্লাহ আরো বলেন,
‘আমি যখনই কোনো অফিসারের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে ব্যবস্থা নিয়েছি, তখন ওই সব অফিসার জেনারেল জিয়ার নিকট শেল্টার নিয়েছে।’[19]
সেনাবাহিনীতে বিভেদ সৃষ্টির জন্য কর্নেল (অব.) শওকত আলী জিয়াউর রহমানকে দায়ী দাবি করে বলেন,
সেনাবাহিনীতে অশুভ কিছু ঘটলে তার দায় পড়তো শফিউল্লাহর ওপর কিন্তু ভালো কিছু ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে প্রচার হয়ে যেত যে, তা জিয়ার জন্য হয়েছে।[21]
ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড বইয়ের লেখক ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদের মতে, সবসময়ই সেনাবাহিনীতে প্রচার চলত যে, ‘‘সকল গুণ ও মেধার আকর জিয়াউর রহমান’’।[23] অনেকের মতে, পাকিস্তান প্রত্যাগত ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দ্বন্দ লাগাবার জন্য জিয়াউর রহমান দায়ী ছিলেন।[টীকা 7][21][25]
এসকল বিষয়ের পাশাপাশি, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও বিভেদ ছিলো। জিয়াউর রহমানের ‘জেড’ ফোর্স এবং খালেদ মোশাররফের ও শফিউল্লাহর ‘কে’ ও ‘এস’ ফোর্সের সদস্যদের মধ্যে বনিবনা ছিলোনা।[22] জিয়া, খালেদ ও শফিউল্লাহর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটে।[টীকা 8] যদিও ‘কে’ ও ‘এস’ ফোর্সের সদস্য সৈনিকদের সেনাবাহিনীতে আধিপত্য বেশি হওয়ার কারণে জিয়ার সঙ্গে খালেদ ও শফিউল্লাহর মধ্যে সুসম্পর্ক ছিলোনা।[22]
শেখ ফজলুল হক মনি অত্যন্ত প্রভাবশালী যুবনেতা ছিলেন। তিনি ছিলেন শেখ মুজিবের ভাগ্নে। ১৯৬২ সালে সংঘটিত শিক্ষা আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালে তিনি মুজিববাহিনীর নেতৃত্ব দেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠিত হলে তিনি এর অন্যতম সম্পাদক নিযুক্ত হন। মুজিব-বিরোধীগণ একে সুবিধাবাদী পদমর্যাদা আখ্যা দেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] তার বিরুদ্ধে ভারতের সঙ্গে বেসরকারি বাণিজ্যে (মুদ্রাস্ফীতি হ্রাসের উদ্দেশ্যে নিষিদ্ধ) শেখ মুজিবের পৃষ্ঠপোষকতায় জড়িত থাকার অভিযোগ করা হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] অনেক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও সমালোচক তাকে শেখ মুজিবের বংশতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার একটি অংশ বলে অভিযোগ করেন।[26] তবে মুজিবের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ অনেক বিশ্লেষক নাকচ করে দেন।[27] সাংবাদিক পরেশ সাহা লিখেছেন,
...ইতিপূর্বে বাজারে রটিয়ে দেয়া হয়ছিল যে শেখ মুজিবুর রহমান স্বজন পোষণ করছেন, তিনি বাংলাদেশে ‘শেখ শাহী’ প্রতিষ্ঠা করতে চান। তাই তিনি তার আপনজনদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে দিচ্ছেন।... শেখ মনি ছিলেন খুবই প্রভাবশালী যুবনেতা। রাজনৈতিক পড়াশোনাও তার ছিলো বিস্তর। ভালো লিখতে পারতেন, বলতে পারতেন। সর্বোপরি তিনি ছিলেন মুজিবের ভাগ্নে, অন্যদিকে তাঁর একজন বিশ্বস্ত সহকর্মী। যার কারণে তার দলে একটি বিশেষ স্থান থাকবে। ছিলোও। শেখ মুজিব তাকে জাতীয় দল ‘বাকশাল’ এর অন্যতম সম্পাদক মনোনীত করেছিলেন। স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহল ধরে নিয়েছিলো, শেখ মুজিব তার ভাগ্নে শেখ মনিকে পাদ-প্রদীপের আলোর সামনে এগিয়ে নিয়ে আসবেন। তার (শেখ মুজিবের) অভাবে শেখ মনিই হবেন বাংলাদেশের ভাগ্যবিধাতা।[28]
১৯৭৩ এর শেষের দিকে শেখ কামাল একটি গুলিবর্ষণে জড়িয়ে পড়েন যাতে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। গুলিবর্ষণ কীভাবে ঘটে সে সম্পর্কে একাধিক দাবি রয়েছে। অনেকের দাবি, শেখ কামাল এবং তার বন্ধুরা একটি ব্যাংকের ডাকাতির চেষ্টা করার সময় এই গুলিবর্ষণ হয়েছিল।[29] বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল দাবি করেছেন যে এটি আসলে বন্ধুত্বপূর্ণ গুলিবর্ষণের ঘটনা।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] পরেশ সাহার মতে,
আমি আগেও বলেছি এখনো বলছি, আওয়ামী লীগের সব নেতা-কর্মীই যে ধোয়া তুলসী পাতা - সে কথা বিশ্বাস করার কোন সঙ্গত কারণ নেই। আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতা - হাফ নেতা কিংবা সাব নেতার বাড়ি সত্যি সত্যি দুর্নীতির আখড়া হয়ে উঠেছিল, তার প্রমাণ আছে। কিন্তু তাই বলে যারা বলেন, শেখ মুজিবের বড় ছেলে শেখ কামাল ছিলেন পাক্কা দুর্নীতিবাজ, ডাকাতি করে ফিরতেন, তাদের সেই ‘উড়ো কথা’কে সত্য বলে মেনে নিতে আমার নিশ্চই আপত্তি থাকবে। কারণ দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারীর পুত্র যেখানেই হাত বাড়াবেন, সেখান থেকেই টাকা আসবে। একটু মাত্র ইঙ্গিত পেলেই টাকা হুড়হুড় করে তার দিকে ছুটবে, সে জন্য তাকে ডাকাতি করতে হবে কেন? মুজিবের বড় ছেলে হওয়া ছাড়াও শেখ কামালের একটা পরিচয় ছিল। তিনি ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন প্রথম সারির যুব নেতা। তিনি কি জানতেন না, ব্যংক বা অন্য কোথাও ডাকাতি করার মানে হলো নিজেদের মুখেই কলঙ্কের কালি লেপন করা? কারণ রাষ্ট্রক্ষমতা তারই দলের হাতে। সুতরাং শেখ কামাল সম্পর্কে যারা দুর্নীতির বা উচ্ছৃঙ্খলতার অভিযোগ তোলেন, তাদের মতলব সম্পর্কে আমি সন্দেহ না করে পারিনে[28]।
১৯৭৩ সালের শেষের দিকে, বাংলাদেশী সুরক্ষা বাহিনী গোপনে সংবাদ পেয়েছিল যে, বামপন্থী বিপ্লবী কর্মী সিরাজ সিকদার এবং তার বিদ্রোহীরা ঢাকার আশেপাশে সমন্বিত হামলা চালাচ্ছে। পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা কর্মকর্তাগণ পূর্ণ সতর্ক ছিলেন এবং ঢাকার রাস্তায় সাধারণ পোশাকে টহল দিচ্ছিলেন। শেখ কামাল ও তার বন্ধুরা সশস্ত্র অবস্থায় সিরাজ সিকদারকে খুঁজছিল, এবং একটি মাইক্রোবাসে শহরটিতে টহল দিচ্ছিল। যখন মাইক্রোবাসটি ধানমন্ডিতে ছিল তখন পুলিশ শেখ কামাল ও তার বন্ধুদের বিদ্রোহী বলে মনে করে এবং তাদের উপর গুলি চালিয়ে দেয়, ফলে শেখ কামাল আহত হয়।[30] তবে, এটিও দাবি করা হয় যে শেখ কামাল এবং তার বন্ধুরা ধানমন্ডিতে গিয়েছিল তার বন্ধু ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর সম্প্রতি কেনা একটি নতুন গাড়ি চালানোর পরীক্ষা করতে।[31] ঢাকায় যেহেতু পুলিশ ভারী টহল দিচ্ছিল, তাই তৎকালীন শহরের এসপি মহামুদ্দিন বীর বিক্রমের কমান্ডের অধীনে পুলিশ বিশেষ বাহিনী যাত্রীদেরকে দুর্বৃত্ত বলে ভেবে গাড়িতে গুলি চালিয়েছিল।[32] তবে এ ঘটনার পর সর্বোত্র প্রচারিত হয়ে যায় যে শেখ কামাল ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত তার "মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্র" বইয়ে শেখ কামাল ও শেখ জামালের দুর্নীতি ও অপরাধে জড়িত থাকার সপক্ষে লিখেছেন,
অবশ্য দুর্নীতি এবং অন্যায় কাজে কিছুটা জড়িত ছিল শেখের দুই পুত্র- কামাল এবং জামাল। স্নেহান্ধ মুজিব অনেক ক্ষেত্রেই তার পুত্রদ্বয়ের এই অপরাধ দেখতে পেতেন না।[33]
তবে মুজিবের তনয়যুগল কী ধরনের দুর্নীতিতে জড়িত ছিলো তা সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত উল্লেখ করেননি।
মুজিবের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অপপ্রচার বলে অনেকের মতামত।[27][28][34]
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে উদীয়মান বামপন্থী শক্তি মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য বহুলাংশে দায়ী ছিল বলে মনে করা হয়।[35][36][37] ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে এবং নব্য স্বাধীন দেশ কীভাবে পরিচালিত হবে তা নিয়ে একটি মতাদর্শগত দ্বন্দের সূত্রপাত হয়। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেত্রীবৃন্দ গণতন্ত্রকে প্রথম পছন্দ হিসেবে বিবেচনা করলেও আ স ম আবদুর রব এবং শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তার বিরোধিতা করে। ছাত্রলীগের এই অংশটি মূলত সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল আলম খানের অনুসারী ছিল। তারা পরবর্তীতে ছাত্রলীগ থেকে বিভক্ত হয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ নামক আওয়ামী লীগ বিরোধী একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে, যার লক্ষ্য ছিল সামজতন্ত্রের একটি ধারা প্রতিষ্ঠা করা, যেটিকে তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র হিসেবে অভিহিত করতেন।[38]
মুজিবের নেতৃত্বে প্রণীত ১৯৭২ সালের সংবিধানে অবাধ গণতান্ত্রিক অধিকার সন্নিবেশিত হয় এবং রাজনৈতিক দলগুলো অবাধ রাজনীতির অধিকার লাভ করে। কিন্তু এই ‘অবাধ গণতন্ত্রের’ সুযোগ গ্রহণ করে অতি উগ্র বামপন্থী দলগুলো গোপনে সশস্ত্র দল, স্কোয়াড গঠন করতে থাকে। থানা, ব্যংক লুট করা হয়। খুন-হত্যা, রাহাজানি, ডাকাতি জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সহ-সভাপতি মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন এক সাংবাদিক সম্মেলনে ৪৭টি থানা লুটের ঘটনা ও মুজিব হত্যায় নিজেদের দায় স্বীকার করেন।[39]
সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি বাংলাদেশকে ভারতের তাবেদার রাষ্ট্র আখ্যায়িত করে জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের আহ্বান জানায়।[24]
জাসদের উদ্যোগে প্রতিটি সেনানিবাসে অত্যন্ত গোপনে গঠিত হয় ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’। এর ফলে সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা চরমভাবে বিনষ্ট নয়। কর্নেল আবু তাহের ও হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে জাসদের সশস্ত্র শাখা গণবাহিনী, সরকারের সমর্থক, আওয়ামী লীগের সদস্য ও পুলিশদের হত্যার মাধ্যমে অভ্যুত্থানে লিপ্ত হয়।[40][41] এর ফলে দেশের আইন শৃঙ্খলায় সম্পূর্ণ ভাঙন ধরে[40] এবং মুজিব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পথ প্রশস্ত করে দেয়।[42]
মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানপন্থী হিসেবে, চীনাপন্থীগণ ভারতবিরোধী হিসেবে, জামায়াতে ইসলামীর স্বাধীনতাবিরোধী অনেক নেতা-কর্মী মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেননা বলে তারা সবাই কোন রাজনৈতিক দলের আশ্রয় নিয়ে নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। এ অবস্থায় সিরাজুল আলম খান, আ. স. ম. আবদুর রব ও শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বে জাসদ গঠিত হলে উপরিউক্ত রাজনৈতিক দলে অনেকে আশ্রয় গ্রহণ করেন।[43]
প্রধানত মুক্তিবাহিনী ও মুজিববাহিনীর যুবকদের একটি বিরাট অংশকে নিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠিত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে জাসদ হয়ে দাঁড়ায় শেখ মুজিবের সরকারবিরোধী যে কোন ধরন ও চরিত্রের লোকের আশ্রয়স্থল। ফলে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করার জন্য যে জাসদের জন্ম তা পরিশেষে হয়ে দাঁড়ায় এক বহুশ্রেণিভিত্তিক সংগঠন। এমনকি দুর্নীতির অভিযোগে সরকারি, আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান ও কর্পোরেশনের পদচ্যুত কর্মকর্তা এবং আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত নেতারা জাসদ- এ যোগ দেন।[44]
ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড বইয়ের লেখক ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ বলেন,
১৯৭২ সনে গৃহীত শাসনতন্ত্রের উক্ত মৌলিক অধিকারের সুযোগ নিয়ে ঐ সমস্ত দল ও চক্র অজস্র বানোয়াট মিথ্যাচারসমূহ বিভিন্নভাবে প্রচার করে জনগণকে সার্বিকভাবে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়…স্বাধীনতা বৈরি পুঁজিপতি, শোষক শ্রেণি ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহ স্ব স্ব স্বার্থে জাসদকে অর্থ, সম্পদ, সাহায্য ও সহযোগীতা দিতে থাকে।
[25] চীনাপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতীয় দুশমন’ আখ্যা দিয়ে তাঁকে ‘খতম’ করার ঘোষণা দেয়[3]। চীনাপন্থী সিরাজ সিকদার, হক, তোয়াহা, মতিন, দেবেন শিকদার, শান্তি সেন, অমল সেনদের চীনাপন্থী গ্রুপগুলো ষড়যন্ত্রের রাজনীতি ও সশস্ত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টা করে[3]। মাওলানা ভাসানী মুজিব সরকারকে উৎখাত করে ‘নতুন পতাকা ওড়াবার’ হুমকি দেন।[45] আবু সাইয়িদ বলেন,
মাওলানা ভাসানী বহুদিন ধরে প্রগতিশীল রাজনীতির কথা, নির্যাতন ভোগ করেছেন তিনি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অতি উগ্র ডান ও বামপন্থীদের হাতে এবং জাতীয় আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করে গেলেন…স্বাধীনতা যুদ্ধে বর্ণনাতীত ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্ধস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজে যেখানে প্রয়োজন ছিল সহায়তা, সেখানে প্রকাশ্য জনসভায় তিনি হুংকার দিতে থাকলেন: আমি এদেশে প্রতিবিপ্লব ঘটাবো[25]
স্ট্যানলি ওলপার্ট তার "জুলফি ভুট্টো অব পাকিস্তান" বইয়ে বলেছেন, মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির একাংশের নেতা আবদুল হক ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ‘আমার প্রিয় প্রধানমন্ত্রী’ সম্বোধন করে অস্ত্র সহায়তা চেয়ে এক চিঠি লেখেন। চিঠির ভাষা ছিল নিম্নরূপ:
“ | ‘আমার প্রিয় প্রধানমন্ত্রী,
পুতুল মুজিব চক্র এখন জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এই চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য অর্থ, অস্ত্র ও ওয়ারলেস সরঞ্জাম প্রদানের আবেদন জানাচ্ছি।’ |
” |
১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর আবদুল হকের লেখা চিঠিটি ১৯৭৫ সালের ১৬ জানুয়ারি ভুট্টোর কাছে পৌঁছায়। চিঠিটি পাওয়ার পর তিনি ‘অত্যন্ত জরুরি’ বলে মন্তব্য করেন এবং আবদুল হককে ‘সৎলোক’ বলে আখ্যায়িত করে তাকে ‘কার্যকর সাহায্য’ দেওয়ার সুপারিশ করেন। আবদুল হক সিলেটের মাহমুদ আলীর মাধ্যমে চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মাহমুদ আলী পাকিস্তানিদের পক্ষ নেন এবং এর পুরস্কার হিসেবে ভুট্টো তাঁকে বিশেষ উপদেষ্টার পদ প্রদান করেন।[46]
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠনের পরপরই জাসদ নেতাকর্মীরা শেখ মুজিবুর রহমানের জাতীয় রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। সেসময়ে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনীতিবিদদের বাড়িতে হামলা, লুণ্ঠন, নির্যাতন, হত্যা, বিরোধী মতাদর্শীদের গুম করা সহ বহু বেআইনি কাজে যুক্ত থাকার ব্যাপারে অভিযোগ করা হয়েছিল। ১৯৭৪ সালের ১৭ই মার্চ রমনায় রক্ষীবাহিনী জাসদের সমর্থকদের ওপর হামলা করে, যাকে জাসদ রমনা গণহত্যা নামে আখ্যায়িত করে থাকে। সেদিন জাসদের আন্দোলনকারী কর্মীরা ঢাকার রমনা এলাকায় অবস্থিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুহাম্মদ মনসুর আলীর বাসভবন ঘেরাও করলে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা তাদের ওপরে গুলিবর্ষণ করে, যার ফলে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় অন্তত ৫০ জন নিহত হয়।[47]
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পরেশ সাহার মতে, শেখ মুজিব সে সময় ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্পর্কের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।
স্বাধীনতার পর মুজিবের বিরোধীগণ বারংবার মুজিবকে ‘ভারতের দালাল’ এবং মুজিব-সরকারকে ভারতের তাবেদার সরকার আখ্যায়িত করে। চীনপন্থি দলগুলোও মুক্তিযুদ্ধকে ভারতীয় অংশগ্রহণের পর ‘দুই কুকুরের লড়াই’ বলে অভিহিত করে। মুজিব-ইন্দিরা গান্ধীর সম্পাদিত ভারত-বাংলাদেশ চুক্তিকে তারা ‘গোলামির চুক্তি’ আখ্যা দেয়।[25] তাদের আরো দাবি, এই চুক্তির গোপন ধারা রয়েছে। মুজিবের বিরোধীগণ বারবার ভারতে সম্পদ, গাড়ি, কারখানার কলকব্জা পাচার হওয়ার অভিযোগ করতে থাকে। এর কোনটিরই বিশেষ করে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি, ডাবল নোট বিতর্ক কিংবা গাড়ি পাচারের ঘটনার বাস্তব সত্যতা পাওয়া যায়নি।[25][28][44]
১৯৭২ সালের মুজিবের নেতৃত্বে প্রণীত সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এই সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়।[28]
নিষিদ্ধ হওয়া দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, মুসলিম লীগ উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ সালে এই দলগুলোর বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা অর্থাৎ ‘রাজাকার’, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি বাহিনী গড়ে তোলার জন্য জনগণ বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করে।
কিন্তু উক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্যগণ এতে ক্ষুব্ধ হয়ে মুজিব-সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণায় নেমে পড়ে। যুদ্ধাপরাধী, ঘাতক-দালালদের বিচার চালাতে গিয়ে মুজিব সমস্যার শিকার হন। এত বেশি সংখ্যক অপরাধীর বিচারকার্য পরিচালনা করতে গিয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়তে থাকে। পাশাপাশি সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ প্রভৃতি প্রক্রিয়ায় জটিলতা দেখা দেয়।[44]
তাই মুজিব ‘যেসব দালালদের বিরুদ্ধে ১৪টি মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনোটির অভিযোগ নেই’[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] তাদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। অনেক দালাল এতে ক্ষমা লাভ করেন।
এর পর থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইসলামকে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে যে প্রচারণা চলছিল, আরো গতিপ্রাপ্ত হয়। এসব প্রচারণাও মুজিবের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়ার জন্য দায়ী।[28]
পরেশ সাহা লিখেছেন[28],
“ | অনেক মসজিদও মুজিব-বিরোধী আস্তানায় পরিণত হয়। | ” |
১৯৭৩ সালের বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কোন দল শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি। অনেকের মতে, একারণে তারা ষড়যন্ত্রের দিকে ধাবিত হতে থাকে।[44]
১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় কবি দাউদ হায়দারের একটি কবিতা প্রকাশিত হয় যাতে মুহাম্মাদ, যীশু, বুদ্ধ ও কৃষ্ণ সম্পর্কে আপত্তিকর একটি পঙ্ক্তি ছিল, তার প্রতিবাদে জাতীয় গণতান্ত্রিক দল নামক বাংলাদেশী আলেম ওলামা মৌলভিদের সমন্বয়ে একটি নবগঠিত ইসলামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠন একটি জনসভার আয়োজন করে, পরেশ সাহার মতে সে সময় নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামী এই প্রতিবাদে গোপনে সহায়তা করেছিল। দলটির দলীয় পতাকা ছিল পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার মতো এবং দলটি জনমনে ধর্মীয় আবেগকে উস্কে দিতে কাজ করেছিল। এর ফলে সংবাদ পত্রিকা দাউদ হায়দারকে বরখাস্ত করে এবং উক্ত আপত্তিকর কবিতা প্রকাশের জন্য ক্ষমা চায়। কিন্তু লক্ষণীয় যে, তারপরও উক্ত সংগঠনটি তাদের কয়েক হাজার সদস্যকে সঙ্গে করে সংবাদ পত্রিকার কার্যালয় ঘেরাও করে আক্রমণে উদ্যত হয় এবং "দাউদ হায়দারের ফাঁসি চাই" বলে স্লোগান দিতে থাকে। পরেশ সাহার মতে, এই প্রতিবাদের উদ্দেশ্য দাউদ হায়দারের কবিতার প্রতিবাদ ছিল না, বরং তারা এর দ্বারা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের ধর্মীয় আবেগকে উত্তেজিত করে বাংলাদেশের তৎকালীন ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিতে ইসলামপন্থী রাজনীতিকে আবারও প্রবর্তনের একটি সুযোগ তৈরি করার চেষ্টা করছিল। পরেশ সাহার মতে, উক্ত ঘটনার ফলে পরবর্তীতে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতাবিরোধী ও ইসলামপন্থী আবেগ আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল।[48]
স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশে সংবাদপত্রের সংখ্যা অতি দ্রুত বাড়তে থাকে। পত্রিকার সংখ্যা ডজনসংখ্যক থেকে বেড়ে প্রায় কয়েক শতে পৌছায়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] বেশ কিছু সংবাদপত্র, মুজিব ও তার সরকারের বিরুদ্ধে সংবাদ ও জনমত প্রচারে ভূমিকা পালন করে।[49][50]
এম আর আখতার মুকুলের মতে, মুজিব হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশের কিছু সংবাদপত্রের ভূমিকা রয়েছে। তিনি বলেন,
বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোতে ষড়যন্ত্র করে আইনসম্মত সরকারের পতন ঘটানো ও প্রতিটি ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের সাথে সেই দেশের শক্তিশালী সংবাদপত্রের ও সাংবাদিকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।[50]
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত দৈনিক ইত্তেফাক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৬৯ সালে মানিক মিয়া মৃত্যুবরণ করেন এবং এর পর ইত্তেফাকের দায়িত্বলাভ করেন তাঁর দুই পুত্র ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে ইত্তেফাক অফিস পুড়িয়ে দেয়া হয়। পরেশ সাহার মতে,
…কিন্তু, ইত্তেফাকের ‘মুরুব্বি’ (পৃষ্ঠপোষক) ছিল, সে মুরুব্বি আমেরিকা। আমেরিকার সুপারিশেই পাকিস্তানের ইয়াহিয়া সরকার ক্ষতিপূরণ স্বরূপ (পাকিস্তানের গ্রামে গঞ্জে যখন বাঙালিদের হত্যা করছে) তখন আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে পশ্চিম জার্মানি ও লন্ডনে যেতে দেয়া হয়। উদ্দেশ্য: ইত্তেফাকের জন্য মুদ্রণযন্ত্র খরিদ করা। সেই যন্ত্র এনে ইত্তেফাককে যখন নতুন কলেবরে বের করা হল, তখন তার চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা।[28]
নতুন করে প্রকাশিত ইত্তেফাক, পাকিস্তানের সমর্থক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী সংবাদ পরিবেশন করতে শুরু করে। স্বাধীনতার পর মুজিব তাদের ক্ষমা করে দিলেও, সাধারণ মানুষের অভাব-অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে ইত্তেফাক মুজিব-বিদ্বেষী জনমত গড়ে তুলতে থাকে। আবদুল গাফফার চৌধুরীর মতে,
তবে একটা কথা মানিক মিয়ার মৃত্যুর ১৯ বছর পর কঠিন সত্য বলে মনে হচ্ছে, এই কথাটা হলো, এই ইত্তেফাক মানিক মিয়ার প্রতিষ্ঠিত দৈনিক ইত্তেফাক নয়, মানিক মিয়ার ইত্তেফাক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ভস্মীভূত হয়েছে, শহীদ হয়েছে। শহীদ হয়েছেন মানিক মিয়ার উত্তরসূরি ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন এখন যে ইত্তেফাক তা ইত্তেফাকের ভস্ম থেকে জেগে ওঠা প্রেতাত্মা, এ প্রেতাত্মা বাংলার জনগণের কণ্ঠ নয়; এই পত্রিকা স্বৈরাচারীর ও গণশত্রুদের সেবাদাস, পদ ও অর্থের ক্রীতদাস।[50]
উপসম্পাদকীয় - প্রবন্ধ প্রভৃতির মাধ্যমে ইত্তেফাক জনগণকে বিক্ষিপ্ত করতে সক্ষম হয়। উল্লেখ্য যে, মুজিব হত্যার পর এই হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করে একটি উপসম্পাদকীয়তে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু একে ‘স্বাভাবিক’ এবং ‘ঐতিহাসিক সূচনা’ বলে আখ্যা দেন।[25]
সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকাও সমালোচিত ভূমিকা পালন করে। এটি এর বিভিন্ন প্রতিবেদন ও নিবন্ধের মাধ্যমে মুজিব সরকারকে বিচ্ছিন্ন করতে ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতে সরকারকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে। এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়,
“ | তাহলে আমরা ছ'কোটি লোক কি কোলাবোরেটর?[50] | ” |
বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের মন্তব্যের উদ্দেশ্য ছিলো জাতীয় ঐক্যে ফাটল ধরানো।[25]
পত্রিকা সমূহের কয়েকটি অভিযুক্ত সংবাদের শিরোনামসমূহ:
‘হককথা’ পত্রিকার প্রকাশিত বিশেষ বুলেটিনের শিরোনামঃ
“ | ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ উপেক্ষিত।[51] | ” |
‘মুখপাত্র’ লিখেছিলো,
“ | এ সরকার ভারত আশ্রিত তাঁবেদার সরকার’,‘ইল্লাল্লাহুর বীজ বপন করতে হবে’ ইত্যাদি।[51] | ” |
‘চট্রগ্রামের দেশবাংলা’ পত্রিকায় বলা হয়,
“ | বিদেশী অস্ত্রে সুসজ্জিত বিদ্রোহীদের হাতে রাঙামাটি শহর পতনের আশঙ্কা[51] | ” |
খবরগুলো ভিত্তিহীন এবং বানোয়াট ছিলো।[51]
হলিডে পত্রিকা অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য তাজউদ্দীন আহমদের সমালোচনা করতে থাকে এবং সমালোচিত ভূমিকা রাখে।[50]
বাংলাদেশ টাইমস পত্রিকার সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন মাহবুবুল আলম যিনি ১৯৭১ সালে মুজিবের বিরুদ্ধে অন্যতম রাজসাক্ষী ছিলেন। তিনি করাচীর ডন পত্রিকার প্রতিনিধি ছিলেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রচার করেন।[50]
সরকার নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকা স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করে কিন্তু স্বাধীনতার পর তা নিয়মিতভাবে মুজিবকে প্রশংসা করে বিশেষ কলাম প্রকাশ করে।[50]
অধ্যাপক আবু সাইয়িদ স্বাধীন বাংলাদেশে সংবাদপত্রের গণবিরোধী ভূমিকার সমালোচনা করে সংবাদপত্র গুলোকে মিথ্যাচারের বাহন বলে অভিহিত করেন।[25]
ভিত্তিহীন সংবাদ প্রচারের অভিযোগে মুজিব-সরকার ১৯৭৫ সালের ১৬ই জুন ৪ টি বাদে সকল পত্রপত্রিকা নিষিদ্ধ করে। প্রথমে এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে ৪টি বাদে সকল পত্রিকা নিষিদ্ধ করা হয়, যার সংখ্যা ছিল ৩৪০টি। এর ২৪ ঘণ্টা পর নিষিদ্ধ তালিকার অন্তর্ভুক্ত ১২৬টি পত্রিকা ও সাময়িকীর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে বাকি ২১৪ টি পত্রিকার নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখা করা হয়।[51][52][53][54] অনেক বিশ্লেষকের মতে, কেবল রাজনৈতিক কারণেই নয়, বরং নানা প্রসঙ্গে ভিত্তিহীন সংবাদ প্রচার, সাম্প্রদায়িক প্রচারণা, অশালীনতা প্রচার প্রভৃতি কারণেও অনেক সংবাদপত্র নিষিদ্ধ হয়েছিলো।
১৯৭৪ সালে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহযোগী গাজী গোলাম মোস্তফা ও একজন সামরিক কর্মকর্তা, মেজর শরীফুল হক ডালিমকে ঘিরে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যায়। ঢাকা লেডিজ ক্লাবে মেজর ডালিমের আত্মীয় তাহমিনার সাথে কর্নেল রেজার বিয়ে হচ্ছিল, সেখানে এই ঘটনা ঘটে।[টীকা 9] কথা কাটাকাটির জের ধরে গোলাম মোস্তফা, মেজর ডালিম, তার স্ত্রী নিম্মি, ও কর্নেল রেজার মা-কে অপহরণ করে রেডক্রিসেন্টের মাইক্রোবাসে রক্ষীবাহিনীর সদরদপ্তর হয়ে শেখ মুজিবের বাসভবনে নিয়ে আসে।[55] তবে ইতোমধ্যে ডালিমকে অপহরণের খবরে বেঙ্গল ল্যান্সার্স মোস্তফার বাড়িটি আক্রমণ করে এবং সবাইকে জিম্মি করে। সারা শহরে সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট বসানো হয় ডালিমদেরকে খুঁজে উদ্ধারের জন্য। শেষ পর্যন্ত সেনাপ্রধানকে ডাকিয়ে, তার সামনে সেখানে শেখ মুজিবুর রহমান বিষয়টি মীমাংসা করে দেন। সেদিন ডালিম ও মোস্তফা মিষ্টি খেয়ে প্রায় মধ্যরাতে শেখ মুজিবের বাড়ি থেকে ফিরে গিয়েছিলেন।[25][56]
কিন্তু এ মিমাংসায় সন্তুষ্ট না হয়ে সেদিন মধ্যরাতে ডালিম সেনানিবাস থেকে এক ট্রাক সৈন্য এনে গাজীর নয়া পল্টনস্থ বাড়ি ভাংচুর করে।[25] তদন্তের পর শৃংখলা ভঙ্গের অভিযোগে ডালিমকে বরখাস্ত করা হয়।[25] তদন্তের রায়ে বলা হয়,[25]
“ | যেসব অফিসারগণ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে তাঁরা শাস্তি এড়াতে পারবেনা। | ” |
বেঙ্গল ল্যান্সারস এবং মেজর শরিফুল হক ডালিম সহ জড়িত ক্ষুব্ধ অফিসাররা অনেকেই পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যায় অংশ নিয়েছিলেন।[57][58][59]
১৯৭১ পরবর্তী সময়ে মাওবাদী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বিস্তৃতির এক পর্যায়ে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি নামক সশস্ত্র দলের মাওবাদী নেতা সিরাজ শিকদার আলোচিত হয়ে ওঠেন। এটি ছিল একটি উগ্র বামপন্থি দল যার বিরুদ্ধে গুপ্তহত্যা, রাহাজানি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ফাঁড়িতে সশস্ত্র হামলা, পাট ও খাদ্য গুদামে অগ্নিসংযোগ, খাদ্যদ্রব্য বহনকারী পরিবহন ধ্বংস ইত্যাদি সহিংস, নাশকতামূলক ও অন্তর্ঘাতমূলক ততপরতার অভিযোগ ছিলো।[44] তার দলের বিভিন্ন বিক্ষুব্ধ ও সশস্ত্র কার্যক্রমকে সরকার আক্রমণাত্বক ও অস্থিতিশীল বলে বিবেচনা করা শুরু করে এবং বিভিন্নভাবে তাকে ও তার দলকে আটক ও প্রতিরোধের চেষ্টা করা হয়, কিন্তু অধিকাংশ সময়েই সরকার এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষিত হলে সিরাজ শিকদার আত্মগোপন করেন।[60] কী অবস্থায় সিরাজ সিকদার পুলিশের হাতে শেষপর্যন্ত আটক হন, এবং ঠিক কখন কোথায় কীভাবে তিনি গুলিবিদ্ধ হন-সে সম্পর্কে অস্পষ্টতা রয়েছে। অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তার বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ গ্রন্থে বলেছেন, সিরাজ সিকদার ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে ডিসেম্বরের শেষ দিকে চট্টগ্রামের কাছাকাছি এক এলাকা (টেকনাফ) থেকে পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হন।[61] অনেকের মতে ১৯৭৫ সালের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের হালিশহরে সরকারী গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তাকে গ্রেপ্তার করেন। আবার অন্য তথ্যমতে তিনি চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন। তারই সংগঠনের আরেক ব্যক্তি রবিন ছদ্মনামের এক ইঞ্জিনিয়ার সিরাজ সিকদারকে ধরিয়ে দেয়। তার ধরা পড়ে যাওয়ার কারণ ছিলো নারীঘটিত।[16] সিরাজ সিকদারের দুই স্ত্রী থাকলেও তার দৃষ্টি পড়ে রবিনের প্রেমিকার ওপর। ফলে রবিন, সিরাজ সিকদারের ওপর ক্ষুব্ধ হন। সিরাজ সিকদার সিলেট থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলেন। রবিন তার এক বন্ধুর সহায়তায় পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে এবং সিরাজ সিকদারের অবস্থান জানিয়ে দেয়। ফলে ঘটনাক্রমে তিনি সন্দেহভাজন ব্যক্তি হিসেবে গ্রেফতার হন। গ্রেফতারকারী নিশ্চিত ছিলেন না যে তিনিই সিরাজ সিকদার। রবিনই তা পুলিশকে নিশ্চিত করেন। সেই দিনই তাকে বিমানে ঢাকায় আনা হয়। পরদিন শেরেবাংলা নগর থেকে সাভারে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে যাওয়ার পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাকে হত্যা করে।।[62][63] আবার জাকারিয়া চৌধুরী[টীকা 10] বলেন, সিরাজ সিকদারকে হাতকড়া লাগিয়ে চোখবাঁধা অবস্থায় ঢাকাস্থ রমনা রেসকোর্সের পুলিশ কন্ট্রোল রুমে নিয়ে আসা হয়। তারপর ২ জানুয়ারি ১৯৭৫ গভীর রাতে এক নির্জন রাস্তায় নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।[64] অ্যান্থনি মাস্কারেনহাস বলেন, সিরাজের ছোট বোন শামীম শিকদার তার ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য শেখ মুজিবকে দায়ী করেছিলেন।[64]
স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা দেখা দিতে থাকে। দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন, ক্রমবর্ধমান বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, খাদ্য সংকট সামাল দিতে ব্যর্থতার ফলে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দুর্ভিক্ষে মৃতের সংখ্যা ২৭ হাজার থেকে ১৫ লক্ষ পর্যন্ত দাবি করা হয়।[65] অনেক বিশ্লেষকের মতে এই দুর্ভিক্ষ মুজিব সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস করে এবং তার হত্যাকাণ্ডের পরিস্থিতি সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।[66][67]
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ মুজিব পূর্ববর্তী পাকিস্তান শাসনামলের সরকারি কর্মকর্তা ও আমলাদের স্বপদে পুনর্বহাল করে নিযুক্ত করেন। কিন্তু পরেশ সাহার মতে, অতীতে অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রাদেশিক আমলা থাকায় তারা রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় প্রশাসন পরিচালনায় অযোগ্য এবং অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল, কারণ তারা অতীতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ পালন করতেই ব্যস্ত থাকতো।[28] সাহার মতে, এই উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত আমলাতন্ত্র অনেক বিশ্লেষকের মতে শেখ মুজিবের জন্য বড় বাধা। ফিদেল ক্যাস্ট্রো সহ শেখ মুজিবের বিভিন্ন শুভাকাঙ্ক্ষী রাষ্ট্রনায়কগণও শেখ মুজিবকে এই আমলাদের ব্যপারে সতর্ক করেন।[50] শেখ মুজিব নিজেও বলতেন,[25]
“ | আমার প্রশাসনের ৯০ ভাগই কোলাবরেটর [যুদ্ধাপরাধী]। | ” |
শিল্পকারখানাগুলোর রাষ্ট্রীয়করণও চলমান অর্থনীতিতে লক্ষণীয় উন্নতি আনয়নে ব্যর্থ হয়। ফার ইস্টার্ন ইকনোমিক রিভিউ পত্রিকায়, ১৯৭৪ সালে লরেন্স লিফশুলতজ লেখেন যে, সে সময় বাংলাদেশে "দুর্নীতি ও অনাচার এবং জাতীয় সম্পদের লুণ্ঠন" বিগত সময়ের সকল দুর্নীতির "সীমা অতিক্রম করেছিল"।[68]
১৯৭৪ সালে ফেব্রুয়ারিতে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের রাওয়ালপিণ্ডিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধকালে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী জুলফিকার আলী ভুট্টো কর্তৃক আয়োজিতব্য বিশ্ব ইসলামী সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পান। আওয়ামীলীগের বিশিষ্ট কিছু নেতা, বিশেষত তাজউদ্দীন আহমেদ উক্ত সফরের ব্যপারে শেখ মুজিবকে আপত্তি জানান কারণ তখনো পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় নি, কিন্তু ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে মুজিব উক্ত সফরে যান[69][70] ও ফেরার পথে ভুট্টোকে পাল্টা ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ জানান। ভুট্টো সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ১৯৭৪ সালের জুন মাসের শেষে বাংলাদেশে আসেন,[71] পরেশ সাহার মতে, তখন ভুট্টোকে দেখার জন্য বিমানবন্দরে এতো মানুষের ভিড় হয়েছিল যে, পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীকে লাঠিচার্জ করে জনতাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়েছিল। ভুট্টো উক্ত সফরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানের "অপরাধমূলক" কর্মকাণ্ডের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং বাংলাদেশে থাকা বিহারীদেরকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য প্রস্তাব করেন।[72][73] সফর শেষে ভুট্টো সাংবাদিকদের কাছে তার সফর সফল ও মুজিব এই সফরে তার আলোচনাকে ব্যর্থ বলে মন্তব্য করে। পরেশ সাহার মতে, ভুট্টোর এই সফরের সফলতা প্রকাশের গোপন অর্থ ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডে গোপন সহায়তা করা।[48]
১৯৭৫ সালের ৭ জুন শেখ মুজিব চলমান বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতিব্যবস্থার সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে রাষ্ট্রপতিশাসিত একদলীয় জাতীয় ঐক্যের সরকার, জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) প্রতিষ্ঠা করেন। সচিবালয় থেকে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত প্রশাসনকে ভেঙে দিয়ে সকল মহকুমাকে জেলায় পরিনত করে প্রতি জেলায় গভর্নর ডেজিগোনেটদের নিয়োগ দেয়ার ব্যবস্থা করেন।[74] গ্রামভিত্তিক সমবায়কে ‘জাতীয় অর্থনীতির একক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে দেশের প্রতি গ্রামে বহুমূখী সমবায় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করে কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।[75] উৎপাদন বৃদ্ধি, দুর্নীতি দমন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও জাতীয় ঐক্যের আহবান জানিয়ে মুজিব তার বহুল আলোচিত-সমালোচিত বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যাকে তিনি দ্বিতীয় বিপ্লব নামে আখ্যা দেন।
বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠনের মাধ্যমে তার এক দলের শাসনের ঘোষণার পর সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক দলের একাংশ তার বিরোধিতা করে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের কারণে সরকারি আমলাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হলে তারা এর বিরোধীতায় নেমে পড়ে,[25] ফলে আমলাতন্ত্র, সেনাবাহিনী আর প্রশাসনের লোকজনের মাঝে দ্বন্দ্ব সংঘর্ষ আরো বেড়ে যায়। অনেক বিশ্লেষকের মতে, দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি নস্যাৎ করতেই মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।[25][তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে বৈষম্যের কারণে সেনাবাহিনী পূর্ব থেকেই শেখ মুজিবের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল। তবে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তার বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ গ্রন্থে শেখ মুজিবের প্রতি চূড়ান্ত অসন্তোষের পেছনে একটি নির্দিষ্ট ঘটনাকে প্রভাবক হিসেবে উল্লেখ করেন, যে ঘটনাটি কর্নেল ফারুক রহমান কর্তৃক বর্ণিত, তা হলঃ টঙ্গীর মোজাম্মেল নামক এক সমসাময়িক আওয়ামী লীগ তরুণ নেতা, যে সেসময় টঙ্গী আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান ছিল, সে এক নববিবাহিত গৃহবধুকে গাড়ী থেকে তুলে নিয়ে তার ড্রাইভার ও স্বামীকে হত্যা করার পর তাকে অপহরণপূর্বক গণধর্ষণ করে তিনদিন পর তার রক্তাক্ত লাশ রাস্তায় ফেলে যায়। এতে মেজর নাসের নামে ব্যাঙ্গল ল্যান্সারের একটি কোম্পানির অধিনায়ক মোজাম্মেলকে আটক করে পুলিশের হাতে সোর্পদ করলে অনতিবিলম্বে সে ছাড়া পায়। তখন অনেকেই মনে করেন, শেখ মুজিবের হস্তক্ষেপেই সে অপরাধের শাস্তি হতে মুক্তি পেয়েছিল। মাসকারেনহাসের বর্ননামতে, এ ঘটনা সেনাবাহিনীতে, বিশেষত কর্নেল ফারুকের ভেতরে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বৃদ্ধি করে শেখ মুজিবকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জীবিত বা মৃত যে কোন অবস্থায় উচ্ছেদ করার পরিকল্পনার পেছনে অন্তিম মুহূর্তের চূড়ান্ত প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।[76][77][78]
খন্দকার মোশতাক আহমেদ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর অঘোষিতভাবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।[45] কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, মোশতাক অনেক পূর্ব থেকেই মুজিবের বিরুদ্ধে চক্রান্তে জড়িত ছিলেন। মোশতাক ও সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি চক্রান্তে জড়িত ছিল বলে সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ দাবি করেন।[79]
খন্দকার মোশতাক আহমেদ মুজিব মন্ত্রিসভার মন্ত্রী ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মোশতাক আহমেদ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠালগ্নে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন। মুজিব পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি হন। মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে মোশতাক পররাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রী হন, অনেকের মতে, যদিও তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে ইচ্ছুক ছিলেন এবং সর্বোপরি মুজিবকে স্বল্পশিক্ষিত বলে মনে করতেন।[28] অনেক বিশ্লেষকের মতে, মোশতাক মুজিবের প্রতি ঈর্ষা পোষণ করতেন এবং মুজিবের মতো জনপ্রিয়তা মোশতাকের ছিলনা। জনৈক সাংবাদিকের ভাষ্যমতে,[28]
“ | লোকে বলতো, ওঁর মাথায় যতগাছি চুল, ততটা দুষ্ট বুদ্ধি তাঁর মাথার কোষে কোষে ছড়িয়ে আছে... শত ঈর্ষার ছুরিই তিনি মুজিবের ওপর বসিয়েছেন | ” |
১৯৭১ সালে কলকাতায় বাংলাদেশ মিশন গঠিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগর সরকারের অগোচরে খন্দকার মোশতাক আহমেদ মার্কিন মধ্যস্থতার মাধ্যমে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি আপোষরফার মাধ্যমে কনফেডারেশন গঠন করার গোপন পরিকল্পনা করেন।[25][49][80][81] কিন্তু আকস্মিকভাবে মোশতাকের পররাষ্ট্র সচিব মাহাবুব আলম চাষীর মার্কিন জনৈক কুটনৈতিককে লেখা একটি চিঠি তাজউদ্দিন আহমেদের কাছে ফাঁস হয়ে যায়।[80] ফলশ্রুতিতে মোশতাককে নজরবন্দি করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পরও মোশতাক মুজিববিরোধী চক্রান্ত অব্যাহত রাখেন।[28]
তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, মহম্মদ খালেক, মাহাবুব আলম চাষী,আনোয়ার হোসেন মঞ্জু প্রমূখ খন্দকার মোশতাকের সাথে চক্রান্তে জড়িত ছিলেন।[28] জিয়াউর রহমান, মাহাবুব আলম চাষীর মাধ্যমে মোশতাক-চক্রের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করতেন।[25]
কর্নেল (সেই সময়ে মেজর) সৈয়দ ফারুক রহমান, খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, বজলুল হুদা, এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী এবং রাশেদ চৌধুরী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসার ছিলেন। বিদেশি গোয়েন্দা ও মোশতাক চক্রের থেকে ইঙ্গিত পেয়ে তারা মুজিবকে হত্যা করে সরকারকে উৎখাত করার পরিকল্পনা করে।
কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদ, খন্দকার মোশতাকের নিকটাত্মীয় (ভাগ্নে) ছিলেন। খন্দকার রশিদই মূলত ঘাতক সামরিক অফিসারগণ ও মোশতাক-চক্রের সাথে সমন্বয় রক্ষা করেন। মুজিব হত্যার আরেক মূল পরিকল্পনাকারী ঘাতক কর্নেল ফারুক রহমান এক সাক্ষাতকারে বলেন, রশিদই প্রথম তাকে সরকার উৎখাতের কথা বলেছিল।[28]
পরেশ সাহার দাবি,
“ | কিন্তু এই ষড়যন্ত্রে কীভাবে তিনি (মোশতাক) সৈন্যবাহিনীর খুনিদের সংগ্রহ করেছিলেন? মুজিব হত্যার তদন্তের ব্যাপারে সেটাও আমাদের অনুসন্ধান করতে হবে। এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করেছিল তারই ভাগ্নে আবদুর রশিদ... মেজর রশিদের ভায়রা হলো মেজর ফারুক।... ফারুক লন্ডনে বলেছেন, মুজিব হত্যার কথা রশিদই প্রথম তাকে বলে। আমরা যদি মন্তব্য করি যে, মুজিব হত্যার কথাটা মেজর রশিদের মাথায়ও আসেনি, খোন্দকার মোশতাকই ভাগ্নের মাথায় তা ঢুকিয়েছেন - তা হলে নিশ্চই ভুল বলা হবেনা[28] | ” |
মেজর জেনারেল (অব.) এম খলিলুর রহমান (তৎকালীন বিডিআরের পরিচালক) তার সাক্ষ্যে বলেন, "মন্ত্রিপরিষদের শপথ অনুষ্ঠানের পর একপর্যায়ে মেজর রশিদ তাঁর স্ত্রীর (জোবায়দা রশীদ) সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। আমার মনে হলো, মেজর রশিদ একটু গর্ব করে বলেন, “ইনি আমার স্ত্রী। আমরা যা করেছি তার প্রধান প্ল্যানার আমার স্ত্রী।"[19]
এন্থনি মাসকারেনহাস তার বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ বইয়ে ফারুকের বর্ণনার উদ্ধৃতি দিয়ে মেজর ফারুককে মুজিব হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা হিসেবে তুলে ধরেছেন। ফারুক ম্যাসকারেনহাসকে বলে, সেই প্রথমে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ মুজিবকে বন্দী করার কথা চিন্তা করে, কিন্তু পরমুহূর্তে ভারতীয় হস্তক্ষেপের শঙ্কায় শেখ মুজিবকে হত্যা করাকেই তার কাছে "শৃঙ্খলিত পরিস্থিতি হতে উত্তরণের" একমাত্র অবিকল্প পথ বলে মনে হয়েছিল।
কিন্তু অনেক লেখকের বর্ণনামতে, মুজিবকে হত্যার চক্রান্ত ফারুকের হাত ধরে অনেক পূর্ব থেকেই চলে আসছিল।[28][82] ফারুকের ভাষ্যমতে, "তাকে (শেখ মুজিব) চলে যেতেই হবে (ক্ষমতা থেকে সরতে হবে বা মরতে হবে)" (He must go); ফারুক আরও বলেন এর পর থেকেই তিনি মধ্যরাতে খাকি শার্ট ও লুঙ্গি পরে ছদ্মবেশে ধানমণ্ডি এলাকায় শেখ মুজিবের বাড়ির আশেপাশে (ম্যাসকারেনহাসের ভাষায় "শেখ মুজিবের মৃত্যুদুত" হিসেবে) একাকী ঘোরাঘুরি করতেন এবং সবকিছু পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মনে মনে শেখ মুজিব হত্যার পরিকল্পনার ছক কষতেন। এছাড়াও ম্যাসকারেনহাস লিখেছেন, ঘাতকদল, বিশেষত ফারুক সম্ভাব্য ব্যার্থতার কারণগুলো কী হতে পারে তা বিবেচনা করে এবং মুজিব হত্যার পর তাদের অনুমান অনুযায়ী সম্ভাব্য ভারতীয় হস্তক্ষেপ, আওয়ামী লীগের প্রতিশোধমূলক সশস্ত্র বিরোধিতা ও আওয়ামী লীগ-বিরোধীদের বাড়তি স্বেচ্ছাচারী-বিশৃঙ্খলা দমন এবং সাময়িকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মুজিবের দল আওয়ামী লীগ থেকে তাদের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী এবং চাইলে সময়মত সরিয়ে দেয়া যাবে এমন ব্যক্তিকে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। বেশ কিছুকাল অনুসন্ধানের পর মুজিবের মন্ত্রিপরিষদের আওয়ামী লীগের একজন মন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণে সম্মত হন।[77]
ম্যাসকারেনহাসের বর্ণনায় ফারুককেই অভ্যুত্থানের মূল পরিকল্পনাকারী এবং সংঘটক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি ফারুককেই ষড়যন্ত্রের সূত্রপাতকারী হিসেবে দেখিয়েছেন। কিন্তু বেশিরভাগ লেখকই মত প্রকাশ করেছেন যে, মোশতাক ও বৈদেশিক শক্তি অনেক পূর্ব থেকে মুজিবকে হত্যার লক্ষ্যে ষড়যন্ত্র করে আসছিল।[25][28][80][83]
অ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে মেজর ফারুক বলেন, তিনি চট্টগ্রামের আন্ধা হাফিজ নামক এক জন্মান্ধ পীরের দিকনির্দেশনা নিয়ে এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করেন।[77][84][টীকা 11] যদিও সাপ্তাহিক বিচিন্তার এক সাক্ষাতকারে আন্ধা হাফিজ এ দাবি অস্বীকার করেন।[85]
মার্কিন দলিলের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে শেখ মুজিব সরকারের অগোচরে কর্নেল ফারুক মার্কিন দুতাবাসে অস্ত্র ক্রয়ের প্রস্তাব দেন।[86][টীকা 12]
১৯৭৬ সালের ২ আগস্ট ব্রিটিশ টেলিভিশন চ্যানেল আইটিভির ওয়ার্ড ইন একশন নামক অনুষ্ঠানে এ্যান্থনি মাসকারেনহাসের নেওয়া সাক্ষাৎকারে মেজর ফারুক ও কর্নেল রশিদ শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের বর্ননা দেন। সেখানে তারা মেজর জেনারেল জিয়া ও মোশতাক আহমেদের পূর্ব সম্পৃক্ততার দাবি করেন। এছাড়াও কর্নেল রশিদ বলেন, তারা শেখ মুজিবকে এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের পূর্ব পরিকল্পনা জানান নি কারণ, তার মতে শেখ মুজিব সাধারণ জনগণকে নিয়ন্ত্রণে পারদর্শী হওয়ার কারণে এ পরিকল্পনা জানলে মুজিব তার নিজ রাজনৈতিক স্বার্থে এমন কোন ব্যবস্থা নিতেন যার ফলে রশিদ নিজে আক্রান্ত হতেন, তাই দেশের রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্য তারা শেখ মুজিবকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন।[87]
কথিত আছে, তৎকালীন সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহ, ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স এবং এয়ার ভাইস মার্শাল আমিনুল ইসলাম খান মুজিব হত্যার চক্রান্ত সম্পর্কে অবহিত ছিলেন।[88]
পরেশ সাহার মতে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার একসময় বলেছিলেন, আমেরিকার বাইরে তার তিনজন শত্রু রয়েছে, একজন শেখ মুজিবুর রহমান ও বাকি দুজন হল চিলির রাষ্ট্রপতি সালবাদোর আলেন্দে ও ভিয়েতনামের রাষ্ট্রনায়ক নগুয়েন ভ্যান থিউ, এবং যেকোনভাবে তাদেরকে উৎখাত করা ছিল তার রাজনৈতিক লক্ষ্য। এই তিনজনের মধ্যে শেখ মুজিবের প্রতি তিনি সর্বাধিক অসন্তুষ্ট ছিলেন, কারণ শেখ মুজিবের কারণেই ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, যার ফলে তিনি পাকিস্তানের সহায়তায় চীন-আমেরিকা সুসম্পর্ক তৈরির যে পরিকল্পনা করেছিলেন তা চরমভাবে বিঘ্নিত হয়। পাশাপাশি শেখ মুজিবের কারণে আমেরিকার সে সময়ের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ভালো সম্পর্ক ছিল, যা ছিল আমেরিকার জন্য নেতিবাচক। তাই যে কোনমূল্যে তিনি মুজিবকে উৎখাত করতে এবং বাংলাদেশে নিজেদের অনুকূল শাসন প্রতিষ্ঠা করতে মনস্থ ছিলেন। পরেশ সাহা আরও বলেন, সি আই এর ১৯৮৭–১৯৯১ সময়কালের প্রধান উইলিয়াম ওয়েবস্টার এক বিবৃতিতে বলেন, মার্কিন কংগ্রেস ও রাষ্ট্রপতি বুশ তাদের সি আই এ কে অনুমতি দিয়েছিল যে, আমেরিকার শত্রুভাবাপন্ন দেশগুলোতে সি আই এ অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য ষড়যন্ত্র করতে পারবে। পরেশ সাহা এই উদ্ধৃতিকে শেখ মুজিব হত্যায় সি আই এর জড়িত থাকার শক্তিশালী পরোক্ষ প্রমাণ বলে উল্লেখ করেন, এবং তার সমর্থনে তিনি তৎকালীন ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের তৎকালীন স্টেশন অফিসার ফিলিপ চেরির কার্যকলাপের উদ্ধৃতি দেন। এ ব্যাপারে পরেশ সাহা লরেন্স লিফশুলজের "বাংলাদেশঃ দ্য আনফিনিশড রেভুলিউশন" বই থেকে মুজিব হত্যার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ব্যক্তির সাক্ষাৎকারে স্বীকৃত সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করে আমেরিকার সম্পৃক্ততার ব্যাপারে জোর দাবি করেন। এর মধ্যে অন্যতমগুলো হলঃ
পরেশ সাহার মতে, আমেরিকার পাশাপাশি পাকিস্তান ও সৌদি আরবসহ পশ্চিম এশিয়ার আনুমানিক আরও অন্তত একটি মুসলিম রাষ্ট্র এই অভ্যুত্থান পরিকল্পনায় জড়িত ছিল।[89]
পাকিস্তান ও চীন প্রদত্ত অস্ত্রের সাহায্যে বিভিন্ন চক্র মুজিবকে উৎখাত করার চেষ্টা করেছিল বলে অনেকে ধারণা করেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
গোলাম আযম লন্ডনে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি গঠন করেন এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র উচ্ছেদ করে আবার এই ভূখন্ডকে পাকিস্তানের অংশে পরিনত করার পরিকল্পনা করেন।[91]
অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ভুট্টো বাংলাদেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার জন্য বাংলাদেশের সশস্ত্র রাজনৈতিক দলগুলোকে অস্ত্র সহায়তা প্রদানের জন্য গোপন তহবিল গঠন করেছিলেন।[92][93][94][95][96]
লেখক ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, আবদুল হক হকের পাশাপাশি ভুট্টোর আরেকজন বাংলাদেশী প্রতিনিধি ছিল আবদুল মালেক। বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা চালানোর উদ্দেশ্যে তিনি সৌদি আরবে যান। সেখান থেকে ১৯৭৫ সালের ২২ জানুয়ারি ‘আমার প্রিয় নেতা’ সম্বোধন করে ভুট্টোকে চিঠি লেখেন।[46]
মালেক লিখেন,
‘বাংলাদেশের ৬৫ মিলিয়ন মুসলমান তাদের মুক্তির জন্য আপনার দিকনির্দেশনা ও নেতৃত্ব লাভের জন্য গভীর উৎকণ্ঠার সঙ্গে অপেক্ষা করছে।’
এই চিঠির জবাবে ভুট্টো ধর্মমন্ত্রী মাওলানা কায়সার নিয়াজীকে সৌদি আরব ও আরব আমিরাতে পাঠান, যার উদ্দেশ্য ছিল সংশ্লিষ্ট দেশের কূটনৈতিক ও আর্থিক সাহায্য তথা অস্ত্রের জোগান নিশ্চিত করা। সোহরাব হাসানের মতে, ভুট্টো ভেবেছিলেন, এদের মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধান পরিবর্তন করে ইসলামি প্রজাতন্ত্র নামকরণের জন্য মুজিব সরকার কিংবা তার উত্তরসূরির প্রতি চাপ সৃষ্টি করা যাবে, পাশাপাশি ভুট্টো পাকিস্তানের মত বাংলাদেশের ইসলামি রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠনে রাজি করাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মুজিবের জীবদ্দশায় তিনি উক্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হন নি।[46]
সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত তার ১৯৭৮ সালে রচিত "মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্র" বইতে লেখেন, বাকশাল গঠনের পর তিনি তাজউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে তার বাড়িতে দেখা করলে তাজউদ্দীন তাঁকে জানান, জিয়াউর রহমান তাজউদ্দীনের কাছে মুজিবকে গৃহবন্দী করার পরিকল্পনায় অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন যা তাজউদ্দীন সরাসরি নাকচ করে দেন, এবং তাজউদ্দীনের মনে হচ্ছিল, জিয়া নিজে থেকে আসেন নি, তাঁকে পাঠানো হয়েছিল। তাজউদ্দীন আরও বলেন, মুজিবকে তিনি এই ষড়যন্ত্রের কথা জানালে তার মনে হল মুজিব তার কথা বিশ্বাস করেন নি। তিনি আরও বলেন, ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরের পর থেকেই আওয়ামী লীগের চার পাঁচজন সদস্য এই পরিকল্পনা করে, খন্দকার মোশতাক জেদ্দায় গিয়ে পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন, এবং মোশতাক যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ডেভিড ফস্টারের সঙ্গেও এ ব্যাপারে গোপনে আলোচনা করেন এবং মার্কিন দূতাবাস ব্যাংক থেকে এজন্য তাদের কাছে তিন কোটি টাকাও আসে। তাজউদ্দীন আরও বলেন, পরিকল্পনায় বিদেশি সহায়তার অন্যতম কারণ ছিল আমেরিকা সবসময় পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, এবং সৌদি আরব, জর্ডান ও লিবিয়াসহ ইসলামী দেশগুলো ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারছিল না, তাদের ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশ ইসলামী রাষ্ট্র হোক। এছাড়াও আমেরিকার সি.আই.এ. ও রাশিয়ার পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মুজাফফর)ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের পরিবর্তে তাদের নিজেদের অনুকূলে সমর্থকগোষ্ঠী তৈরি করতে চাইছিল, তাজউদ্দীন এ বিষয়টিকে নিজ ভাষ্যে বলেন, "ভারত ছাড়া পৃথিবীর এগারটি বৃহত্তম শক্তিই চাইছে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় ভিয়েতনাম বানাতে। এবং তাদের চক্রান্তে জড়িয়ে পড়েছে এই দেশ।"[97]
সুক্রঞ্জন দাসগুপ্ত তাজউদ্দীনের বরাত দিয়ে আরও বলেন, "ডেভিড ফস্টার বলেছিলেন, বাংলাদেশে একটি সামরিক সরকার গঠন করা দরকার। জিয়া ও খন্দকার ঘাড় নেড়ে বলেছিল, আমরাও তাই চাই।"[83]
মুজিব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ততকালীন উপ-সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের ভূমিকা বেশ আলোচিত ও সমালোচিত। সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলৎসের মতে, জিয়া মুজিব হত্যার নেপথ্যচারী ''প্রধান ছায়ামানব'' (The key shadow man)।[96] তিনি বলেন,
“ | (প্রাপ্ত) তথ্যপ্রমাণ উল্লেখযোগ্য হারে এ ব্যাপারে ইঙ্গিত করে যে, জিয়া ছিলেন এই অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান নকশাকার এবং তিনি খন্দকার মোশতাক আহমেদের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা পালন করেছিলেন। | ” |
গৃহবন্দির পরিবর্তে হত্যা পরিকল্পনা করার পর খুনিচক্রের মধ্যে ফারুক এক পর্যায়ে জিয়াউর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করে। এন্থনি ম্যাসকারেনহাস বলেন, ফারুক জিয়াউর রহমানকে মুজিব হত্যা পরিকল্পনার বিষয়ে আভাস দিলে জিয়া ফারুককে বলেন,
চলো চলো আমরা বাইরে গিয়ে কথা বলি।
ফারুক তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জিয়াকে বলেন,
… আমরা পেশাদার সৈনিক। আমরা দেশের সেবা করি; কোন ব্যক্তির নয়...আমাদের (মুজিব সরকারকে) উৎখাত করতে হবে, আমরা জুনিয়র অফিসাররা এর প্রস্তুতি নিয়েছি। এখন আমরা আপনার সমর্থন এবং আপনার নেতৃত্ব চাই।[25]
ফারুকের বর্ণনামতে জিয়ার আচরণের ইঙ্গিতের অর্থ ছিল,
“ | আমি একজন সিনিয়র অফিসার হয়ে এতে জড়াতে পারি না। এমন একটি বিষয়ে, তোমরা জুনিয়র অফিসাররা যদি কিছু করতে চাও, তবে এগিয়ে যাও।[98] | ” |
ম্যাসকারেনহাসের বইয়ের বাংলা অনুবাদ সংষ্করণে লেখা হয়েছে, ফারুকের মতে, জিয়ার ইঙ্গিতের অর্থ ছিলঃ "আমি দুঃখিত, আমি এ ধরনের কাজে নিজেকে জড়াতে চাই না, তোমরা জুনিয়র অফিসাররা যদি কিছু একটা করতে চাও, তাহলে তোমাদের নিজেদেরই তা করা উচিত, আমাকে এসবের মধ্যে টেনো না।"[77]
পরবর্তীতে সাংবাদিক এন্থনি ম্যাসকারেনহাস জিয়াকে ফারুকের সাথে তার (জিয়ার) যোগসাজশের তথ্যটির সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন করলে জিয়া পরিষ্কারভাবে কিছু বলেননি। ম্যাসকারেনহাসের মন্তব্য,
জিয়া এর (আমার কথার) বিরোধিতাও করলেন না, সমর্থনও করলেন না।
তবে ঘাতক লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশীদের স্ত্রী ও আসামি জোবায়দা রশীদ জবানবন্দিতে বলেন, "...মেজর ফারুক জেনারেল জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করত ছোটবেলা থেকেই। তিনি (ফারুক) জিয়ার পূর্বপরিচিত ছিলেন। একদিন রাতে মেজর ফারুক জিয়ার বাসা থেকে ফিরে আমার স্বামীকে জানায় যে, সরকার পরিবর্তন হলে জিয়া প্রেসিডেন্ট হতে চায়। জিয়া নাকি বলে,
যদি এটি সফল হয়, তবে আমার কাছে এসো, যদি এটি ব্যর্থ হয়, তবে আমাকে (এর মাঝে) জড়িও না।
জিয়া আরো বলেন,
“ | শেখ মুজিবকে জীবিত রেখে সরকার পরিবর্তন সম্ভব নয়। | ” |
এর কদিন পর মেজর ফারুক আমার বাসায় এসে রশীদকে বলে যে, জিয়া বলেছে, “রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব খুঁজতে হবে যে দায়িত্ব নিতে পারবে।” সে মোতাবেক রশীদ খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে যোগাযোগ করে আগামসি লেনের বাসায়। ১৫ আগস্ট বিকেলে বঙ্গভবনে জেনারেল জিয়াউর রহমান রশীদের কাছে ঘোরাঘুরি করছিল যাতে তাঁকে চিফ অব আর্মি করা হয়। ১৬ অথবা ১৭ তারিখ প্রাক্তন মন্ত্রী সাইফুর রহমানের গুলশানের বাসায় সাইফুর রহমান, আমার স্বামী ও জিয়ার উপস্থিতিতে জিয়াকে চিফ অব আর্মি স্টাফ করার বিষয় ঠিক হয়।"[19]
অধিকাংশ বিশ্লেষকগণ উপর্যুক্ত তথ্য অনুসারে বলেন, জিয়াউর রহমান এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে অবগত ছিলেন এবং বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, তিনি খুনিচক্রের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাদের মদত দেন।[25][99] অনেক বিশ্লেষকের মতে, জিয়ার এই বিতর্কিত ভূমিকা সামরিক আইনের ৩১ ধারার লঙ্ঘন, সর্বোপরি উপ-সেনাপ্রধান হিসেবে সাংবিধানিক দায়িত্বের অবহেলা।[25]
পরেশ সাহা বলেন, খুনিচক্রের সাথে জিয়ার অবশ্যই কোন না কোন 'বনিবনা' ছিল।[28] খুনি মেজরগণ প্রবাসে তাদের বিভিন্ন সাক্ষাতকারে জিয়াউর রহমানের সংযুক্তির কথা উল্লেখ করেন।
অধ্যাপক আবু সায়্যিদ বলেন, মুজিব নিজেও জিয়ার চক্রান্ত বিষয়ে অবগত ছিলেন।[25] কর্নেল (অব.) শওকত আলি মুজিবকে বলতে শুনেছেন,
“ | … জিয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা, তবে এখনো ছেলেমানুষ। দেশের অবস্থাও ভালো না। তাই আমার ওপর অভিমান করে একটু-আধটু ষড়যন্ত্র করে। | ” |
মেজর জেনারেল (অব.) এম খলিলুর রহমান (তৎকালীন বিডিআরের পরিচালক) তার সাক্ষ্যে বলেন,"জেনারেল জিয়া নম্বরের ভিত্তিতে জেনারেল সফিউল্লাহর সিনিয়র থাকা সত্ত্বেও তাঁকে সেনাপ্রধান না করায় কিছু আর্মি অফিসার দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। তখন এই সমস্যা দূর করার জন্য শুনিয়াছি, জেনারেল জিয়াকে আর্মি হতে অবসর দিয়ে অ্যাম্বাসেডর (রাষ্ট্রদূত) হিসেবে বিদেশে পাঠাই দেবে।”’[19]
অনেক লেখকের দাবি, জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান না করায় তিনি ব্যক্তিগতভাবে মুজিব-সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন।
কর্নেল শাফায়েত জামিল বলেন,
মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ সতীর্থ ছিলেন। জিয়াউর রহমান সিনিয়র ছিলেন। কিন্তু তাঁকে চিফ অব স্টাফের পদ দেওয়া হয় নাই। এতে দুজনের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল না।’[19]
শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য অভ্যুত্থান সম্পর্কে অবহিত করে বিভিন্ন মহল ও গোয়েন্দা সংস্থা থেকে তাকে সতর্ক করা হয়।[100]
১৯৭৫ সালে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (র) প্রধান দায়িত্বে ছিলেন রমেশ্বর নাথ কাও। ১৯৮৯ সালে ভারতের কলকাতার আনন্দবাজার গোষ্ঠীর ইংরেজি সাপ্তাহিক সানডের এপ্রিল ২৩-২৯ সংখ্যায় তিনি এক অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে লেখেন, "বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একদল অসন্তুষ্ট সদস্য শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে, এই তথ্য আমরা আগেই পেয়েছিলাম। ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি নিয়ে আমি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলি।[100]
তাঁকে এও বলেছিলাম যে খুবই সতর্কতার সঙ্গে আমাদের কাছে খবরটা পৌঁছানো হয়েছে। যিনি এ খবর দিয়েছেন, যেকোনো মূল্যে তাঁর পরিচয় গোপন রাখতে হবে। ইন্দিরা গান্ধীর অনুমতি নিয়েই ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে আমি ঢাকায় যাই। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার শেষ বৈঠকের একপর্যায়ে তাঁকে বঙ্গভবনের বাগানে একান্তে কিছু সময় দেওয়ার অনুরোধ করি। সেখানেই তাঁর প্রাণনাশের আশঙ্কা প্রসঙ্গে আমাদের জানা তথ্য সম্পর্কে তাঁকে জানাই। তিনি হাত নেড়ে বলেন, 'তারা আমার নিজের সন্তানের মতো, তারা আমার ক্ষতি করবে না।'" বঙ্গবন্ধু কাওয়ের কথায় গুরুত্ব দেননি।[100]
১৯৭৫ সালের মার্চে আর এন কাও ‘র’-এর একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে আবারও বঙ্গবন্ধুর কাছে পাঠিয়েছিলেন। কাও লিখেছেন, "তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পদাতিক ও অশ্বারোহী ইউনিট তাঁর প্রাণনাশের চক্রান্ত করছে, এ কথা তাঁকে জানিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত শেখ মুজিব সব সতর্কতা অগ্রাহ্য করেছিলেন।"[100]
তৎকালীন গণভবনের উপসচিব ও যুগ্ম সচিব মনোয়ারুল ইসলাম পঁচাত্তরের প্রথম দিকে কমনওয়েলথ মিটিংয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে কানাডার রাজধানী অটোয়ায় গিয়েছিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিয়ের ট্রুডোও তাকে সতর্কবার্তা দেয়। মনোয়ারুল ইসলাম বিষয়টি মুজিবকে জানালে তিনি (মুজিব) বলেন, "শেখ মুজিব জীবনের ভয়ে সৈন্য আর পুলিশের পাহারায় জনগণ থেকে দূরে থাকবে, সেখানে কেউ আসার সাহস পাবে না, এমন জীবন তো আমি চাই না।"[100]
তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব ফখরুদ্দীন আহমদ তার "ক্রিটিক্যাল টাইমস: মেমোয়ার্স অব আ সাউথ এশিয়ান ডিপ্লোম্যাট" বইতে উল্লেখ করেন, "পনেরো আগস্টের দুই সপ্তাহ আগে আমি সুইডেন থেকে প্রকাশিত একটি বিশেষ নিবন্ধ সম্পর্কে তাঁকে (মুজিবকে) অবহিত করেছিলাম। সেখানে সেনাবাহিনীতে অসন্তোষ ও সেনাসদস্যদের অভ্যুত্থানের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ ছিল। তিনি আমার কথায় গুরুত্ব দেননি। বলেছিলেন, সেনাপ্রধান সফিউল্লাহকে ফোন করে তিনি ব্যাপারটা দেখতে বলবেন।"[100]
পঁচাত্তরে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে কর্মরত ছিলেন স্টিফেন আইজেনব্রাউন। তিনি দাবি করেন, "১৯৭৫ সালের জুলাইয়ের শেষ বা আগস্টের শুরুর দিকে শেখ মুজিবকে সতর্ক করতে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টারকে তাঁর কাছে পাঠানো হয়েছিল। একজন রাষ্ট্রপ্রধানের তুলনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল খুব সাধারণ। ট্রাফিক সিগন্যালে তাঁর গাড়ি থামত। গাড়ির জানালার কাচ নামানো অবস্থায় তাঁকে কখনো কখনো পত্রিকা পড়তে দেখা গেছে।"[100]
১৯৭৫ সালের ২১ মে সন্ধ্যায় মুজিবকে হত্যার একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা ঘটে। ঢাকার উপকণ্ঠে রামপুরায় নতুন টিভি স্টেশন পরিদর্শন শেষে মুজিব যখন ধানমন্ডির নিজ বাসভবনে ফিরছিলেন, তখন এ প্রচেষ্টা চালানো হয়। সাংবাদিক ও পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, এ হামলায় গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়েছিল। হামলার ঘটনায় মুজিব অক্ষত থাকলেও অজ্ঞাতপরিচয় দুই ব্যক্তি আহত হন।[101] রাষ্ট্রপতি মুজিবের নিরাপত্তায় নিয়োজিত উপপুলিশ সুপার ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে কর্মরত রাজনৈতিক সহযোগীকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। এ ছাড়া সাংবাদিকেরাও বিষয়টি দূতাবাসের তথ্য কর্মকর্তাকে অবগত করেন। তবে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তেই এ ঘটনার কথা জনসাধারণকে জানতে দেওয়া হয়নি। তথ্য অধিদফতর খবরটি প্রকাশ না করার জন্য পত্রিকাগুলোর কাছে কড়া নির্দেশনা পাঠিয়েছিল।[101]
এর পূর্বে, ১৯৭৫ সালের ১৬ মার্চ মুজিবের জন্মদিনের আগের দিন সন্ধ্যায় ঢাকার তিনটি স্থানে বোমা হামলা হয়। একটি হামলায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের বারে একজন নিহত ও চারজন আহত হন। ঢাকা নিউমার্কেটে হামলায় তিনজন আহত হন। তিনটি ঘটনায় মোট ১২ জন আহত হন। সবাইকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। হামলাগুলো বিচ্ছিন্ন হলেও এগুলো মুজিবের ওপর হামলারই মহড়া হিসেবে মনে করে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস।[101] জানা যায়, ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত জনসভায় মুজিবের উপর হামলার ষড়যন্ত্র করেছিল মেজর ফারুক। তবে সতর্কতামূলক ব্যবস্থাপনার কারণে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। বিষয়টি মুজিবকে জানানো হলে তিনি জবাবে বলেন, "এর সবকিছুই তো আমি জানি"।[102] তা সত্ত্বেও তদন্ত বা গ্রেপ্তারের কোনো হিসাব বা রেকর্ড পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ও ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থানরত আনন্দবাজার পত্রিকার সংবাদদাতা সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত তার "মিডনাইট ম্যাসাকার ইন ঢাকা" বইয়ে লিখেন যে, মুজিব হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত বর্ণনা সবসময় রহস্যে ঘনীভূত থাকবে।[103] শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড একটি সামরিক অভ্যুত্থান হিসেবে বর্ণিত হলেও এটি সমগ্র সেনাবাহিনীর কোন অভ্যুত্থান ছিল না। মধ্যম সারির কয়েকজন অফিসারদের দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। ততকালীন সেনাপ্রধান কে. এম. শফিউল্লাহর মতে,
পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্টের ঘটনাবলীকে আমি সামরিক অভ্যুত্থান বলে উল্লেখ করতে চাই না। যদিও পরবর্তীতে এটি সামরিক অভ্যুত্থান বলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আসলে সামরিক বাহিনীর একটি একটি ছোট গ্রুপ, সেনাবাহিনীর ভেতরে এবং বাইরে যাদের অবস্থান ছিল তারাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে।…এটা সামরিক অভ্যুত্থান নয়; একটা সন্ত্রাসী কাজ।[25]
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ভোরে হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারীরা চারটি দলে বিভক্ত হয়। এদের একদল ছিল মেজর হুদার অধীনে বেঙ্গল ল্যান্সারের ফার্স্ট আর্মড ডিভিশন ও ৫৩৫ পদাতিক ডিভিশনের সদস্যরা যারা মুজিবের বাসভবন আক্রমণ করেন।
আবদুর রহমান শেখ (রমা) ১৯৬৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের গৃহভৃত্য হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি শেখ মুজিবের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় আদালতে জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তিনি জানান,[104]
ঘটনার দিন রাত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব এবং শেখ রাসেল দোতলায় একই রুমে ঘুমিয়ে ছিলেন। তিনতলায় শেখ কামাল এবং তাঁর স্ত্রী সুলতানা কামাল ঘুমিয়ে ছিলেন। শেখ জামাল ও তাঁর স্ত্রী রোজী জামাল এবং বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের দোতলায় নিজ নিজ কক্ষে ঘুমিয়ে ছিলেন। গৃহভৃত্য রমা এবং সেলিম দোতলায় মুজিবের শয়নকক্ষের সামনে বারান্দায় ঘুমিয়ে ছিলেন। নিচতলায় পিএ মহিতুল ইসলামসহ অন্যান্য কর্মচারীরা ছিলেন।[104]
আনুমানিক ভোর পাঁচটার দিকে হঠাৎ বেগম মুজিব দরজা খুলে বাইরে আসেন এবং বলেন যে সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে। বেগম মুজিবের কথা শুনে রমা দ্রুত লেকের পাড়ে গিয়ে কিছু আর্মি সৈনিকদের গুলি করতে করতে মুজিবের বাসভবনের দিক অগ্রসরমান হতে দেখেন। তখন বাড়ির রিসিপশন রুমে বঙ্গবন্ধু তার পিএ মহিতুল ইসলামের সহিত সঙ্গে কথা বলছিলেন। এসময় বেগম মুজিব আতংকিত অবস্থায় দোতলায় ছোটাছুটি করছিলেন। এসময় রমা তিনতলায় যান এবং আক্রমণ সম্পর্কে শেখ কামালকে অবগত করেন। কামাল তখন নিচের দিকে যায়। রমা ও সুলতানা কামাল দোতলায় আসেন। দোতলায় গিয়ে একইভাবে আক্রমণের বিষয়ে শেখ জামালকে জানান। জামাল তাড়াতাড়ি তাঁর মার রুমে যান। সঙ্গে তাঁর স্ত্রীও যান। এই সময়ও খুব গোলাগুলি হচ্ছিল। একপর্যায়ে রমা গুলির শব্দ সহ শেখ কামালের আর্তচিৎকার শুনতে পান।[104]
একই সময় বঙ্গবন্ধু দোতলায় এসে রুমে ঢোকেন এবং দরজা বন্ধ করে দেন। প্রচণ্ড গোলাগুলি একসময় বন্ধ হয়ে যায়। তারপর বঙ্গবন্ধু দরজা খুলে আবার বাইরে এলে হামলাকারীরা তাঁর বেডরুমের সামনে চারপাশে তাঁকে ঘিরে ফেলে। তাদের লক্ষ্য করে বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?’[104] রমা'র মতে,
তারা বঙ্গবন্ধুকে তখন সিঁড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। সিঁড়ির ২/৩ ধাপ নামার পর নিচের দিক হতে কিছু হামলাকারী বঙ্গবন্ধুর প্রতি গুলিবর্ষণ করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়েন।[104]
রমা তখন হামলাকারীদের পিছনে ছিলেন। তারা রমাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি কী করো?’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘কাজ করি ।’ তখন তারা তাকে ভিতরে যেতে বলে। রমা বেগম মুজিবের রুমের বাথরুমে গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি বেগম মুজিবকে জানান বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। ওই বাথরুমে শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা, শেখ জামাল ও তাঁর স্ত্রী রোজী, শেখ রাসেল ও বঙ্গবন্ধুর ভাই নাসেরও আশ্রয় নিয়েছিলেন। শেখ নাসের ওই বাথরুমে আসার আগে তাঁর হাতে গুলি লাগে, তাঁর হাত হতে তখন রক্ত ঝরছে। বেগম মুজিব শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে তাঁর রক্ত মুছেন।[104]
এরপর হামলাকারীরা আবার দোতলায় আসে এবং দরজা পিটাতে থাকলে বেগম মুজিব দরজা খুলতে যান এবং বলেন, ‘মরলে সবাই একই সাথে মরব।’ এই বলে বেগম মুজিব দরজা খুললে আর্মিরা রুমের ভেতর ঢুকে পড়ে এবং শেখ নাসের, শেখ রাসেল, বেগম মুজিব এবং রমাকে নিচের দিকে নিয়ে আসছিল। তখন সিঁড়িতে বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখে বলেন, ‘আমি যাব না, আমাকে এখানেই মেরে ফেল।’ এই কথার পর আর্মিরা তাঁকে দোতলায় তাঁর রুমের দিকে নিয়ে যায়। পরক্ষণেই রুম থেকে গুলির শব্দসহ নারীদের আর্তচিৎকার শুনতে পাওয়া যায়।[104]
হামলাকারীরা নাসের, রাসেল ও গৃহভৃত্য রমাকে নিচতলায় এনে লাইনে দাঁড় করায়। এসময় রমা সেখানে সাদাপোশাকের একজন পুলিশের লাশ দেখতে পান। নিচে নাসেরকে লক্ষ্য করে সৈন্যরা জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি কে?’ তিনি শেখ নাসের বলে পরিচয় দিলে তাঁকে নিচতলায় বাথরুমে নিয়ে যায়। পরক্ষণেই গুলির শব্দ ও তাঁর মাগো বলে আর্তচিৎকার শুনতে পাওয়া যায়। শেখ রাসেল ‘মায়ের কাছে যাব’ বলে তখন কান্নাকাটি করছিল এবং পিএ মহিতুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে, ‘ভাই, আমাকে মারবে না তো?’ এমন সময় হামলাকারীদের একজন তাকে বলে, ‘চলো, তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যাই ।’ এই বলে তাকে দোতলায় নিয়ে যায়। একটু পরেই কয়েকটি গুলির শব্দ ও আর্তচিৎকার শুনতে পান তারা।[104]
লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় গৃহভৃত্য সেলিম, ডিএসপি নূরুল ইসলাম এবং পিএ/রিসিপশনিস্ট মহিতুল ইসলামকে আহত দেখতে পান রমা। এসময় কালো পোশাক পরিহিত আর্মিরা বাসভবনের জিনিসপত্র লুট করেন। এরপরে মুজিবের বাসভবনের সামনে একটি ট্যাংক আসে। ট্যাংক থেকে কয়েকজন আর্মি নেমে ভিতরের আর্মিদের লক্ষ্য করে জিজ্ঞাসা করে "ভিতরে কে আছে", উত্তরে ভিতরের আর্মিরা বলে, ‘All are finished’। আনুমানিক বেলা ১২টার দিকে ছাড়া পাবার পর রমা তার গ্রামের বাড়ি টুঙ্গিপাড়া চলে যান।[104]
সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত তার "মিডনাইট ম্যাসাকার ইন ঢাকা" বইয়ে লিখেন যে, মুজিবের বাসভবনের রক্ষায় নিয়োজিত আর্মি প্লাটুন প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা করে নি। মুজিবের পুত্র, শেখ কামালকে নিচতলার অভ্যর্থনা এলাকায় গুলি করা হয়।[105]
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ করার বিষয়ে আদালতকে কে এম সফিউল্লাহ বলেন,
‘আমি যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলি তিনি আমার গলার আওয়াজ শুনে বলে উঠলেন, “সফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক (হামলা) করেছে। কামালকে বোধ হয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স (সেনাদল) পাঠাও।” প্রতি উত্তরে আমি বলেছিলাম, আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং। ক্যান ইউ গেট আউট অব দ্য হাউস?’ (আমি কোন একটা ব্যবস্থা করছি। আপনি কি বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে পারবেন?) আমি যখন জিয়া ও খালেদ মোশাররফকে ফোন করি তখন তাঁদের তাড়াতাড়ি আমার বাসায় আসতে বলি। ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে তাঁরা আমার বাসায় এসে পড়ে। জিয়া ইউনিফরমড (পেশাগত পোশাক পরিহিত) ও শেভড (দাড়ি কামানো অবস্থায়)। খালেদ মোশাররফ নাইট ড্রেসে (রাতের পোশাকে) নিজের গাড়িতে আসে।[19]
মুজিবকে আত্মসমর্পণ করার সুযোগ দেওয়া হয়। মুজিব সামরিক বাহিনীর প্রধান, কর্নেল জামিলকে টেলিফোন করে সাহায্য চান।[103] জামিল ঘটনাস্থলে পৌঁছে সৈন্যদের সেনানিবাসে ফিরে যাওয়ার জন্য আদেশ দিলে তাকে সেখানে গুলি করে মারা হয়। মুজিবকেও গুলি করে হত্যা করা হয়।
হত্যাকাণ্ডের শিকার হন মুজিবের স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব (উপরের তলায় হত্যা করা হয়), মুজিবের ছোট ভাই শেখ নাসের, দুইজন চাকর (শৌচাগারে হত্যা করা হয়); শেখ জামাল, ১০ বছর বয়সী শেখ রাসেল এবং মুজিবের দুই পুত্রবধুকে হত্যা করা হয়।[106] শেখ মুজিবের শরীরে আঠারটি গুলি করা হয়েছিল। [107] সেসময় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানিতে ছিলেন।[108] তারা ভারত সরকারের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করে ভারতে চলে আসেন। তিনি নির্বাসিত অবস্থায় দিল্লীতে বসবাস করতে থাকেন। তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ই মে বাংলাদেশের প্রত্যাবর্তন করেন।[109]
দুটি সৈনিক দল মুজিবের ভাগ্নে ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা শেখ ফজলুল হককে (মনি) তার অন্ত:সত্ত্বা স্ত্রীর সাথে ১৩/১, ধানমন্ডিতে এবং মুজিবের ভগ্নিপতি ও সরকারের একজন মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতকে তার পরিবারের ১৩ জন সদস্যসহ মিন্টু রোডে হত্যা করে।[110][111] মনির দুই পুত্র শেখ ফজলে শামস পরশ ও শেখ ফজলে নূর তাপস হত্যাকাণ্ডের সময় নিজেদের জীবন রক্ষার্থে বাড়িতে লুকিয়ে থাকার কারণে প্রাণে বাঁচতে সক্ষম হন।
লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি আর্টিলারি গ্রুপ কামান নিয়ে বঙ্গবন্ধু ভবনের দক্ষিণে অবস্থান নেন। সেখান থেকে নিক্ষেপিত মর্টার শেল লক্ষ্যচ্যুুত হয়ে আঘাত হানে মোহাম্মদপুরে। এতে শেরশাহ সুরী রোডের ৮ ও ৯ নং বাড়ি এবং শাহজাহান রোডের ১৯৬ ও ১৯৭ নম্বর বাড়িতে (টিনশেড বস্তি) মুহূর্তেই আগুন ধরে যায় এবং ১৪ জন নিহত ও ৪০ জন আহত হন।[112]
চতুর্থ এবং সবচেয়ে শক্তিশালী দলটিকে সাভারে সংস্থিত নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত প্রত্যাশিত বিরোধী আক্রমণ ঠেকানোর জন্য পাঠানো হয়। একটি সংক্ষিপ্ত লড়াইয়ের পর এগারজনের মৃত্যু হলে সরকারের অনুগতরা আত্মসমর্পণ করে।[113]
শেখ মুজিব নিহত হবার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন, এই পদে তিনি মাত্র ৮৩ দিন ছিলেন।। তিনি ক্ষমতা অধিগ্রহণের পরপরই জাতির প্রতি ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের জাতির সূর্যসন্তান বলে আখ্যা দেন।[114] রাষ্ট্রপতির দ্বায়িত্ব নেবার পর তিনি ইনডেমিনিটি বিল পাশ করেন। ঐ বছরের ২৫শে আগস্ট তিনি জিয়াউর রহমানকে চিফ অফ আর্মি স্টাফ হিসেবে নিয়োগ দেন।[115] মোশতাক আহমেদ ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বর সেনাবিদ্রোহের দ্বারা অপসারিত হন।
হত্যার দিন সকালে সে সময়ের লেফটেন্যান্ট কর্নেল আমীন আহম্মেদ চৌধুরী জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাড়িতে ঢোকার সময় রেডিওর মাধ্যমে জানতে পারেন যে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে, তিনি ঘটনার বর্ণনায় বলেন, "জেনারেল জিয়া একদিকে শেভ করছেন একদিকে শেভ করেননি । স্লিপিং স্যুটে দৌড়ে আসলেন। শাফায়াত জামিলকে জিজ্ঞেস করলেন, 'শাফায়াত কী হয়েছে?' শাফায়াত বললেন, 'অ্যাপারেন্টলি দুই ব্যাটালিয়ন স্টেজড্ এ ক্যু। (খুবসম্ভব দুটি সেনাদল একটি অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে।) বাইরে কী হয়েছে এখনো আমরা কিছু জানি না। রেডিওতে অ্যানাউন্সমেন্ট শুনতেছি প্রেসিডেন্ট মারা গেছেন।' তখন জেনারেল জিয়া বললেন, সো হোয়াট? লেট ভাইস প্রেসিডেন্ট টেক ওভার। উই হ্যাভ নাথিং টু ডু উইথ পলিটিক্স। গেট ইয়োর ট্রুপ্স রেডি। আপহোল্ড দ্য কন্সটিটিউশন। (তাতে কী? ভাইস প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা নিতে দাও। রাজনীতি নিয়ে আমাদের কিছুই করার নেই। তোমার সেনাদল প্রস্তুত কর। সংবিধান বহাল রাখো।)"[116]
মেজর রফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও একজন প্রত্যক্ষদর্শী সামরিক কর্মকর্তার দাবি, মুজিব হত্যার পর উল্লাসিত হয়ে জিয়াউর রহমান মেজর ডালিমকে বলেন[25],
“ | তুমি একটা দারুণ অসাধারণ কাজ করেছো। আমাকে চুমু খাও। আমাকে চুমু খাও। | ” |
তারপর জিয়া গভীর আবেগে ডালিমকে জড়িয়ে ধরেন।[25][117]
জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হয়ে মুজিব হত্যাকাণ্ডে খুনি অনেক সামরিক অফিসারকে বৈদেশিক দুতাবাসে সচিব পর্যায়ে চাকুরীতে নিয়োগ করেন।[118][119] তারা ছিলেন:
শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমানের এই সকল ক্রিয়াকলাপকে অনেক বিশ্লেষক মুজিব হত্যাকাণ্ডে তার জড়িত হওয়ার পরোক্ষ প্রমাণ হিসেবে দাবি করেন।[28]
শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারবর্গ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনি ব্যবস্থা থেকে অনাক্রম্যতা বা শাস্তি এড়াবার ব্যবস্থা প্রদানের জন্য বাংলাদেশে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ এ ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশ সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর পর সংশোধিত আইনে এ আইনটি বাংলাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
জিয়াউর রহমানও শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিচার রুদ্ধ করার জন্য সমালোচিত। বিতর্কিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ যা মুজিব হত্যার বিচারপ্রক্রিয়া রোধ করার জন্য প্রণীত হয়েছিলো, তা জিয়াউর রহমান পুনর্বহাল করেন।[99][120][121] তিনি অবৈধ ঘোষিত ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে তা সংবিধানে সংযুক্ত করেছিলেন।[99][119]
২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ হাইকোর্ট সংবিধানের ৫ম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে।
মেজর ফারুক, মেজর রশিদ এবং খন্দকার মোশতাক আহমেদ-এর অভ্যুত্থানে গড়া সরকারের বিরুদ্ধে কর্নেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বাধীন ঢাকা ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের সহায়তায় আরও একটি পাল্টা অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন জেনারেল খালেদ মোশাররফ, যিনি শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তীব্র অনুরাগের বশবর্তী হয়ে এই অভ্যুত্থান পরিচালনা করেন। এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ৩রা নভেম্বর, ১৯৭৫-এ মোশতাক সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। কিন্তু তার পূর্বে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীরা অভ্যুত্থানের খবর পেয়ে ইতঃপূর্বে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী চার আওয়ামী লীগ নেতা (সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, মুহাম্মদ মনসুর আলী)কে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়, কারণ সে সময় অভ্যুত্থানের মাধ্যমে চার নেতার দ্বারা আওয়ামী লীগের পুনরায় ক্ষমতা লাভের একটি সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল, আর তাই ৩ নভেম্বর সকালে অভ্যুত্থানের পূর্বে আওয়ামী লীগের এই চার নেতাকে হত্যা করা হয়। এর পরপরই একই দিনে অর্থাৎ ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়, যার ফলে ৬ই নভেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমেদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন ও আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রপতি হন। এর পর জিয়াউর রহমানকে চিফ-অফ-আর্মি স্টাফ পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। ৩রা নভেম্বরের অভ্যুত্থানে খালেদ মোশাররফ রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান ঘটাতে চেয়েছিলেন। একারণে তিনি জিয়াউর রহমানকে তার নিজ বাসভবনে গৃহবন্দী করে রাখেন, যা সেনাবাহিনীর মধ্যে তার জনপ্রিয়তার কারণে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। কর্নেল (অবঃ) আবু তাহের সে সময় চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন। কর্নেল তাহের জিয়াউর রহমানের একজন বিশেষ শুভাকাঙ্খী ছিলেন এবং তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন, সৈনিক-অফিসার বৈষম্য তার পছন্দ ছিল না। তার এই নীতির জন্য তাহের সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিকদের মাঝেও অনেক জনপ্রিয় ছিলেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন জিয়াও তারই আদর্শের লোক। ৩রা নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর তাহের জানতে পারেন জিয়াউর রহমানকে বন্দী করা হয়েছে। তিনি ঢাকাতে তার অনুগত ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাহীদের বিদ্রোহের নির্দেশ দিয়ে তৎক্ষণাৎ চট্টগ্রামে থেকে ঢাকা রওনা হন, এ সময় কয়েক শত জাসদ কর্মী তার সঙ্গী ছিল। কর্নেল তাহেরের এই পাল্টা অভ্যুত্থান ৭ই নভেম্বর সফল হয়, সুখরঞ্জন দাসগুপ্তের মতে, আতাউল গনি ওসমানীও এই অভ্যুত্থান কার্যক্রমে সহায়তা করেন। তিনি জিয়াউর রহমানকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে মুক্ত করে ২য় ফিল্ড আর্টিলারির সদরদপ্তরে নিয়ে আসেন। পাল্টা এই অভ্যুত্থানে জেনারেল খালেদ মোশাররফকে তার নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত ১০ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদরদপ্তরে বিক্ষুব্ধ সৈন্যরা হত্যা করে। তবে জিয়াউর রহমান প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে সিপাহীরা বিদ্রোহ অব্যাহত রাখে। শেষ পর্যন্ত জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ দমন করেন। পরবর্তীতে জিয়ার মার্কিনপন্থী পুজিবাদী গনতান্ত্রিক মনোভাবের বিরুদ্ধে রুশপন্থী মার্কসবাদী-লেনিনবাদী সমাজতান্ত্রিক অবস্থান নেওয়ার ফলে তাহেরের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে তাঁকে সামরিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।[122]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ও গণমাধ্যম শোকবার্তা দেয়।[123]
আমেরিকান রাজনীতিবিদ হেনির কিসিঞ্জার বলেন,
"শেখ মুজিবুর রহমানের মত তেজী এবং গতিশীল নেতা আগামী বিশ বছরের মধ্যে এশিয়া মহাদেশে আর পাওয়া যাবে না।"[123]
জার্মান রাজনীতিবিদ উইলিবান্ট বলেন,
"মুজিব হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যারা মুজিবকে হত্যা করেছে তারা যেকোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।"[123]
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন,
"শেখ মুজিব নিহত হবার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন। তার অনন্য সাধারণ সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল।"[123]
বৃটিশ মন্ত্রী জেমস লামন্ড বলেন,
"বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশই শুধু এতিম হয়নি, বিশ্ববাসী হারিয়েছে একজন মহান সন্তানকে।"[123]
ব্রিটিশ লর্ড ফেন্যার ব্রোকওয়ে বলেন,
"শেখ মুজিব জর্জ ওয়াশিংটন, গান্ধী এবং দ্য ভ্যালেরার থেকেও মহান নেতা ছিলেন।"[123]
কিউবান বিপ্লবী ও প্রধানমন্ত্রী ফিদেল কাস্ত্রো বলেন,
"শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।"[123]
ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসাইন বলেন,
"বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রথম শহীদ। তাই তিনি অমর।"[123]
ফিলিস্তিনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ইয়াসির আরাফাত বলেন,
"আপসহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল মুজিবের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।"[123]
জাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট কেনেথা কাউণ্ডা বলেন,
"শেখ মুজিবুর রহমান ভিয়েতনামী জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।"[123]
আন্তর্জাতিক দৈনিক সংবাদপত্র ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস উল্লেখ করে,
"মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনই জন্ম নিত না।"[123]
যুক্তরাজ্যের টাইম ম্যাগাজিন ১৯৮২ সালের ৫ এপ্রিল তাদের একটি সংখ্যায় উল্লেখ করে,
"স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দশ বছরের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের আমল ছিল সর্বপ্রথম এবং দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আমল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক ও প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবকে হত্যার পর হঠাৎ গণতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটে।"[123]
শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার খবর বাংলাদেশ বেতারে সম্প্রচারিত হওয়ার পর কারফিউ জারি করা হয়।[124] বরগুনায় এর প্রথম প্রতিবাদ হয়। মুক্তিযোদ্ধা মোতালেব মৃধা বরগুনা এসডিও সিরাজ উদ্দিন আহমেদের সহায়তায় ছাত্রলীগ সভাপতি জাহাঙ্গীর কবির এর নেতৃত্বে ১০-১৫ জন ছাত্রলীগ কর্মীর ঝটিকা মিছিল বের করেন। পরবর্তীতে এতে বরগুনার আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা যোগ দিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে। কিশোরগঞ্জ, ভৈরব, খুলনা, যশোর, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ, নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ, ময়মনসিংহের গফরগাঁওসহ বিভিন্ন জায়গায় ১৫ই আগস্ট সকালে প্রতিবাদ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্ররা প্রতিবাদের চেষ্টা চালালে সেনা টহল জোরদার করা হয়।[125][126]
পরবর্তীতে আবদুল কাদের সিদ্দিকী ১৭ হাজার মুজিব ভক্তকে ৭টি ফ্রন্টে ভাগ করে ২২ মাস প্রতিরোধ যুদ্ধ করেন। এতে ১০৪ জন যোদ্ধা নিহত এবং কয়েকশ আহত হয়। এর মাঝে শেরপুর সদর, শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নকলা উপজেলার ৫০০ তরুণের ‘শেরপুরের ৫০০ প্রতিবাদী’র বিদ্রোহ ও লড়াই আলোচিত ছিল।[125][127]
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জামে মসজিদে মুফতি নূরুল্লাহ জুমার নামাজের খুতবায় মুজিব হত্যার প্রতিবাদ করেন।[128]
আগস্ট মাসে চট্টগ্রাম সিটি কলেজের ছাত্ররা প্রতিবাদ মিছিল করে, যা পুলিশ ছত্রভঙ্গ করে দেয়। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মৌলভি সৈয়দ, ছাত্রনেতা এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী এবং পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের নেতা এস.এম. ইউসুফ প্রতিরোধ করতে শুরু করেন। প্রতিবাদ ও প্রতিরোধকারীদের বিরুদ্ধে 'চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র' আখ্যা দিয়ে মামলা দায়ের করা হয়। মৌলভি সৈয়দ গ্রেফতার হন ও পরবর্তীতে কারাবন্দী থাকাকালীন সময়ে তার মৃত্যু হয়।[129]
৩০ আগস্ট যশোর ঈদগাহ ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পুরাতন কসবা এতিমখানার প্রতিষ্ঠাতা আব্দুর রাজ্জাক চিশতী জানাজা পড়ান। পরবর্তীতে মুজিবের কবর জিয়ারত ও গায়েবানা জানাজার আয়োজন করায় তৎকালীন যশোর-২ আসনের সংসদ সদস্য আবুল ইসলাম গ্রেফতার হন ও ২২ দিন কারাভোগ করেন।[130]
১৮ই অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্টার ও দেয়াল লিখনের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানায় ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন। ২০ অক্টোবর প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। এসময় ঢাকায় প্রতিবাদী লিফলেট বিতরণত কিছু ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়৷ ২১ অক্টোবর প্রতিবাদ সমাবেশে পুলিশ বাধা দেয়৷[125][131]
৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করে ও গায়েবানা জানাজা পড়ানো হয়। জাতীয় ৪ নেতা এবং মুজিব হত্যার প্রতিবাদে ৫ নভেম্বর ঢাকায় আধা বেলা হরতালের ডাক দেয়া হয়৷ সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত হরতাল শেষে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়৷ ৬ নভেম্বর পুনরায় প্রতিবাদ হয়৷[132]
১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট যশোর টাউন হলে দোয়া মাহফিলের উদ্যোগ নেওয়া হয়।[133] মুজিব হত্যার প্রতিবাদ করায় ১৯৭৬ সালের ১৮ আগস্ট মুক্তাগাছার প্রতিবাদী ৫ মুক্তিযোদ্ধা জাবেদ আলী, নিখিল দত্ত, সুবোধ ধর, দিপাল দাস, মফিজ উদ্দিনকে সেনা অভিযানে হত্যা করা হয়। বেঁচে যাওয়া বিশ্বজিৎ নন্দী নামে কিশোর যোদ্ধাকে আটক করে ১৯৭৭ সালের ১৮ মে সামরিক আদালতে ফাঁসির রায় দেওয়া হয়। ইন্দিরা গান্ধীসহ প্রভাবশালী বিশ্বনেতার প্রভাবে তাকে যাবজ্জীবন দেয়া হয় এবং তিনি ১৯৮৯ সালে মুক্তি পান।[125]
বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন বলেন, ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট তাকে শেখ মুজিব হত্যার প্রতিবাদের কারণে গ্রেফতার করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মেজর আ ল ম ফজলুর রহমান কর্তৃক তিনি শারীরিক নির্যাতন ও তিরস্কারের শিকার হন।[134]
শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পরিবার এবং চার জাতীয় নেতার হত্যাকান্ডের বিষয়ে ১৯৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যে ব্রিটিশ মন্ত্রী ও আইনবিদ স্যার টমাস উইলিয়ামস এর নেতৃত্বে "শেখ মুজিব মার্ডার ইনকোয়ারি" শিরোনামে চারজন ব্রিটিশ আইনবিদ দ্বারা একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। তবে তৎকালীন বাংলাদেশের সামরিক সরকার কমিশনটির বাংলাদেশে প্রবেশ বাধাগ্রস্ত করে।[135] ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের সদস্যগণকে হত্যার বিরুদ্ধে এজাহার দায়ের করা হয়। ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়। ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত সহকারী এএফএম মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে মুজিব হত্যাকাণ্ডের মামলা করেন। ১ মার্চ ১৯৯৭ সালে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারকার্য শুরু হয়। ৮ নভেম্বর ১৯৯৮ সালে জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ৭৬ পৃষ্ঠার রায় ঘোষণায় ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। ১৪ নভেম্বর ২০০০ সালে হাইকোর্টে মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলে দুই বিচারক বিচারপতি মােঃ রুহুল আমিন এবং বিচারপতি এ.বি.এম খায়রুল হক দ্বিমতে বিভক্ত রায় ঘোষণা করেন। এরপর তৃতীয় বিচারপতি মােঃ ফজলুল করিম ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেন। এরপর পাঁচজন আসামি আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করে। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল তৃতীয় বিচারক মোহাম্মদ ফজলুল করিম ২৫ দিন শুনানির পর অভিযুক্ত ১২ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিশ্চিত করেন৷[136][137] ২০০২-২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় মামলাটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। ২০০৭ সালে শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠিত হয়। ২০০৯ সালে ২৯ দিন শুনানির পর ১৯ নভেম্বর প্রধান বিচারপতিসহ পাঁচজন বিচারপতি রায় ঘােষণায় আপিল খারিজ করে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর থেকে ২০০৯ সালের ২৪ আগস্ট পর্যন্ত বাদী-বিবাদীর আপিলের প্রেক্ষিতে চার দফায় রায় প্রকাশ হয়, সর্বশেষ আপিল বিভাগ ২০০৯ সালের ৫ অক্টোবর থেকে টানা ২৯ কর্মদিবস শুনানি করার পর ১৯ নভেম্বর চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন।[137] ২০১০ সালের ২ জানুয়ারি আপিল বিভাগে আসামিদের রিভিউ পিটিশন দাখিল এবং তিন দিন শুনানি শেষে ২৭ জানুয়ারি চার বিচারপতি রিভিউ পিটিশনও খারিজ করেন। এদিনই মধ্যরাতের পর ২৮ জানুয়ারি পাঁচ ঘাতকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ঘাতকদের একজন বিদেশে পলাতক অবস্থায় মারা যায় এবং ছয়জন বিদেশে পলাতক রয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি ৩৪ বছর পর বাস্তবায়িত হয়।
২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে শেখ মুজিবুর রহমানের পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর করা হয়।[138] তারা হলেন:
২০২০ সালের ৭ এপ্রিল ক্যাপ্টেন (অবসরপ্রাপ্ত) আবদুল মাজেদকে গ্রেপ্তার করা হয়[139] এবং ১২ এপ্রিল তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।[140]
২০২০ সালের ১৯ এপ্রিল ভারতে রিসালদার মোসলেম উদ্দিন গ্রেফতার হন। [141]
২০০১ সালের ২ জুন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবদুল আজিজ জিম্বাবুয়েতে মারা যান বলে কথিত আছে। তবে তার মৃত্যু নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে।[142]
এছাড়াও এখনো ১২ জনের মধ্যে চারজন বিদেশে পালিয়ে রয়েছে। পলাতকরা হলেন,
পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্টের ঘটনাবলীকে আমি সামরিক অভ্যুত্থান বলে উল্লেখ করতে চাই না। যদিও পরবর্তীতে এটি সামরিক অভ্যুত্থান বলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আসলে সামরিক বাহিনীর একটি একটি ছোট গ্রুপ, সেনাবাহিনীর ভেতরে এবং বাইরে যাদের অবস্থান ছিল তারাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে।…এটা সামরিক অভ্যুত্থান নয়; একটা সন্ত্রাসী কাজ
গত মার্চ মাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তাণ্ডবের পর, বিশ্বব্যাংকের পরিদর্শকদের একটি বিশেষ দল লক্ষ্য করেছিল যে, কয়েকটি শহর "পারমাণবিক হামলার পরের দিনের সকালের মতো" দেখাচ্ছিল। তারপর থেকে, এই ধ্বংসাত্মকতা কেবলমাত্র আরও বেড়েছে। আনুমানিক ৬,০,০০,০০০ বাড়িঘর ধ্বংস করা হয়েছে এবং প্রায় ১৪,০০,০০০ কৃষক পরিবার তাদের জমিগুলিতে কাজ করার জন্য সরঞ্জাম বা পশু-পাখি নেয়া ছাড়াই চলে গেছে। পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ব্যাহত। রাস্তাগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেতুগুলি ভেঙে গেছে এবং অভ্যন্তরীণ নৌপথগুলি অবরুদ্ধ রয়েছে। এক মাস আগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ না হওয়া পর্যন্ত এই দেশ ধর্ষণ অব্যাহত ছিল। যুদ্ধের শেষ দিনগুলিতে, পশ্চিম পাকিস্তানিদের মালিকানাধীন ব্যবসায়গুলি - যার মধ্যে প্রায় প্রতিটি বাণিজ্যিক উদ্যোগ অন্তর্ভুক্ত ছিল - কার্যত তাদের সমস্ত তহবিল পশ্চিমে জমা করেছে। পাকিস্তান আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্স চট্টগ্রাম বন্দর নগরীতে তার অ্যাকাউন্টে ঠিক ১১৭ রুপি (১৬ ডলার) রেখে যায়। সেনাবাহিনী ব্যাংক নোট এবং মুদ্রাও ধ্বংস করে দিয়েছে, যেন অনেক অঞ্চল এখন নগদ টাকার মারাত্মক ঘাটতির মধ্যে পড়ে। বন্দরগুলি বন্ধ হওয়ার আগেই ব্যক্তিগত গাড়িগুলি রাস্তা থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল বা অটো ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল এবং পশ্চিম দিকে পাঠানো হয়েছিল।
"সে (জিয়া) প্রত্যাগতদের সাথে সুসম্পর্ক রেখে চলতো। কিন্তু গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের উস্কিয়ে দিতো প্রত্যাগতদের বিরুদ্ধে। প্রত্যাগতদের মধ্যে কিছু অফিসারের আস্থা অর্জন করে অনুরূপভাবে তাদের ক্ষেপিয়ে তুলতো মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে। চুয়াত্তরের প্রথম দিকের কথা। পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত পুরাতন বন্ধুদের সাথে আমার বন্ধুত্ব অক্ষুণ্ন ছিল। তাদের সাথে মেলামেশা জিয়ার চোখ এড়ায় নি। একদিন সে তার অফিসে এক প্রত্যাগতের নাম উল্লেখ করে বলল, তার সাথে তোমার এত ঘনিষ্ঠতা কেনো ? বললাম, সে আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু।... জিয়া গম্ভীর হয়ে বলল, ‘শওকত, কোন প্রত্যাগত অফিসার তোমার বন্ধু হতে পারে না। তোমার মত একজন মুক্তিযোদ্ধার পাকিস্তানীদের সাথে ঘনিষ্ঠ রাখা ঠিক নয়’। হঠাৎ করে আমি যেন দিব্যদৃষ্টি পেলাম। সেনাবাহিনীতে তখন যে সকল ঘটনা ঘটেছিল আমার কাছে তার অনেক কারণ পরিষ্কার হয়ে উঠলো। অবশ্য আমি আগেও কিছু কিছু জানতাম। কিন্তু জিয়া আমার কাছে ধরা দেবে তা আশা করি নি। আমি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বললাম, ‘স্যার, আমি দুঃখিত। আপনার সাথে একমত হতে পারছিনা।... অনুগ্রহ করে আপনি খেলা বন্ধ করুন। জাতীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করে সেনাবাহিনীতে বিভেদ সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকুন। আপনি সেনা বাহিনীর উপপ্রধান। আপনি যদি এ ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক কাজে লিপ্ত হন, তাহলে আমাদের জুনিয়রগণ কী করবে’? কথাগুলো বলে আমি চলে আসি। কড়া কথা ইচ্ছে করেই বলেছিলাম। এজন্য অবশ্য আমাকে ব্যক্তিগতভাবে অনেক খেসারত দিতে হয়েছে।... পরবর্তীকালে ক্ষমতার শীর্ষে বসে জিয়াউর রহমান আমার বিরুদ্ধে যেসব হয়রানিমূলক পদক্ষেপ নেয়, তার জের এখনো চলছে।"
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.